আইসল্যান্ড একটি ছোট্ট দ্বীপ কিন্তু দেশটি এককথায় অপূর্ব। আলাস্কার মতো উত্তরের দেশ বলে আলাস্কার মতোই ঠান্ডা। তবে পাশের দেশ গ্রীনল্যান্ডের তুলনায় সবুজ বেশি, সাদা (বরফ) কম, যদিও নাম দুটো উল্টোপাল্টা। বরফের প্রাচুর্য সত্ত্বেও দেশটা ছোটো বড়ো আগ্নেয়গিরি ও গেইসারে (গরম জলের ফোয়ারা) ভরা।
বরফ ও আগুনের এই অদ্ভুত সমন্বয়ের জন্যই আইসল্যান্ড আমার কাছে এত আকর্ষণীয়।
আরেকটা আকর্ষণীয় তথ্য, এই দেশটি পানীয় জল ও ব্যাবহারিক এনার্জিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাটির নীচের জল আর গলিত হিমবাহ থেকে অসংখ্য নদীর উৎপত্তি এবং গেইসারগুলি থেকে অশেষ হাইড্রোইলেকট্রিক ও জিওথার্মাল এনার্জি আহরণ করে বাড়িঘর, জল ইত্যাদি যথেচ্ছ গরম করা যায়। ভেবে দেখুন, পৃথিবীর সমস্ত দেশেরা এই দুটি জিনিষের (জল ও এনার্জি) জন্য মারামারি করছে আর আইসল্যান্ডে এরা ফেলে ছড়িয়ে উপভোগ করছে। আমাদের গাইড বলল “আরাম করে আধ ঘণ্টা শাওয়ার নাও।” কেন? “কারণ গেইসারের দৌলতে গরম জলের কোনো অভাব নেই।”
দেশের সবথেকে বড়ো কেফলাভিক এয়ারপোর্টটা বেশ নির্জন, চুপচাপ। আমাদের ওমাহা এয়ারপোর্টের থেকেও ছোটো মনে হল। বাইরে সারা দেশটা ঝকঝকে পরিষ্কার। কয়লাটয়লা না ব্যবহারের জন্য পরিবেশ দূষণ একেবারেই নেই। দেশের জনসংখ্যাও খুব কম। মাত্র ৩৬০,০০০। মানুষের থেকে ভেড়ার সংখ্যাই বেশি। দেশবাসীদের থেকে টুরিস্টদের সংখ্যাও। ট্যুরিজ্ম এদেশের প্রধান কর্ম। সারা দেশটা ট্যুরিস্টদের আপ্যায়ন ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সাজানো।
আর ট্যুরিস্টদের দেখার জায়গারও অভাব নেই। চারিদিকে সমুদ্র, পাহাড়, হিমবাহ আর জলপ্রপাতের ছড়াছড়ি। এয়ারপোর্ট থেকে রাজধানী রেকিয়াভিক প্রায় ৫০ কিলোমিটার। ঝকঝকে পরিষ্কার নির্জন রাস্তার দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠ—কোন বড়ো গাছ বা জঙ্গল এদেশে নেই। শুধু উঁচুনিচু লাভা পাথরের জমির ওপরে সবুজ লাইকেন্সের প্রলেপ। সমুদ্র কখনোই দূরে নেই। এখানে সেখানে সমুদ্রের তটভূমি বা খাঁড়ির (ফিয়র্ড) দেখা পাওয়া যায়। শুনলাম এক সময়ে নাকি অনেক গাছপালা ও ঘন জঙ্গল ছিল কিন্তু প্রথম আগন্তুক ভাইকিংরা সব কেটে বাড়িঘর বানায়, রান্না আর ঘর গরম করতে লাগায়। এখন শুধু শহরের মধ্যে লোকেরা কিছু পাইন বা বার্চ গাছ লাগিয়েছে, ব্যাস।
রাজধানী রেকিয়াভিকও বেশ ছোটখাটো ছিমছাম শহর। এটা আইসল্যান্ডের সবথেকে বড়ো বন্দরও বটে। অন্যান্য স্ক্যানডিনেভিয়ান শহরের মতই ছোটো হলেও বেশ একটা আধুনিক, আর্টিস্টিক রূপ আছে। দেশটা গোড়া থেকেই নরওয়ে ও ডেনমার্কের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভ করে। এখনো আইসল্যান্ডের ভিসার জন্য ডেনমার্কের দূতাবাসে আবেদন করতে হয়।
আইসল্যান্ডের ভাষাটা পুরনো জার্মান থেকে জন্মেছে। কয়েকটা পুরনো অক্ষরও রয়ে গেছে যেগুলোর উচ্চারণ বেশ কঠিন। যেমন ‘ll’ ইংরাজির মতো ‘ল’ উচ্চারণ হয় না, স্প্যানিশের মতো ‘য়’ও নয়। তালুতে টক্কর দিয়ে একটা ‘ৎল’ গোছের শব্দ করতে হয়। ২০১০-এ যখন Eijafijallajokull নামের এক আগ্নেয়গিরি গরম ছাই উড়িয়ে সারা ইয়োরোপের এয়ারপোর্টগুলি বন্ধ করে দিয়েছিল বিদেশী রিপোর্টাররা ঐ নামটা উচ্চারণ করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেছিল। (উচ্চারণটা হবে আইয়াফিয়াতলাকুতল)। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আইসল্যান্ডের সবাই বেশ ভালো ইংরেজি বলতে পারে।
আমরা সেপ্টেম্বরের শেষে গেছিলাম। ওখানে তখন হেমন্তকাল। কিন্তু পত্রমোচী গাছ না থাকায় খুব একটা রংদার পাতা ঝরাও দেখলাম না। শীতের শুরুর দরুন আমার আশা ছিল অরোরা বোরিয়ালিস দেখার আর শীত এখনো শুরু না হওয়ায় আশা ছিল পাফিন নামক একটি সামুদ্রিক পাখির দেখা পাব। প্রথম আশাটা পূর্ণ হয়েছিল, আমরা প্ল্যান করে কৃষ্ণপক্ষে গেছিলাম যাতে আকাশে বেশ অন্ধকার থাকে কিন্তু দ্বিতীয় প্ল্যানটা খাটল না। পাফিনরা সবাই ততদিনে উষ্ণ দক্ষিণে পাড়ি দিয়েছে।
আইসল্যান্ড হোটেলে একটা মোবাইল ফোন অ্যাপ ফ্রি পাওয়া যায় তাতে দেশের সব জায়গায় আগামী দুই সপ্তাহের জন্য অরোরার দিনক্ষণ ও কতো জোরালো আলো হবার চান্স সব জানতে পারা যায়। অ্যাপ-এর ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী আমাদের প্রথম রাত্রিটিই অরোরা-র আলো দেখার প্রশস্ত সময়। ব্যাস, আমরা জেটল্যাগ ঘুমটুম সব ভুলে ছুটলাম অরোরার পিছনে। রাত ন’টা নাগাদ আমরা একটা ট্যাক্সি ধরে শহরের আলো থেকে বাইরে অন্ধকার সমুদ্রের ধারে পৌঁছলাম। দেখি আমাদের মতো আরও অনেক অরোরাবিলাসী অন্ধকারে এদিকওদিক হোঁচট খেয়ে ঘুরছে। একটুক্ষণ অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে হল।
তারপর আমরা আকাশের দিকে তাকালাম। ওরেব্বাস! এই বুঝি অরোরা বোরিয়ালিস? উত্তর আকাশের আলো? আমাদের সবার মুখে হাসি, উত্তেজিত ভাবে এ ওকে ডাকছি ‘এই দ্যাখ, দ্যাখ’ ‘ওদিকে দ্যাখ, ঐটে!’ কোনদিকে তাকাব? সারা আকাশ জুড়ে আলোর খেলা। উজ্জ্বল নিওন সবুজ রং তাতে কিছু হলদে মেশানো। উত্তরের আকাশেই সবথেকে বেশি আলো। স্টেজের পরদার মতো দুলছে আর ধীরে ধীরে আকৃতি বদলাচ্ছে। কখনো উজ্জ্বল, কখনো মিলিয়ে যাচ্ছে।
আমি হঠাৎ মনেপড়ায় ছবি তুলবার চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘন অন্ধকারে ক্যামেরার ডায়ালগুলোও দেখা মুশকিল। তবু দু’একটা ভদ্রগোছের ছবি উঠে গেল।
প্রায় আধ ঘণ্টা আমরা হি-হি শীতের মধ্যে অরোরার শোভায় মজে আছি, এদিকে হাত পা নাকমুখ বরফের টুকরো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখ সরাতে হল। আবার ট্যাক্সি ডেকে হোটেলে ফিরলাম। তখনো আমাদের চোখে অরোরা নাচছে, মুখে বোকাবোকা অবাক হাসি। আমরা সত্যি সত্যি অরোরা দেখলাম? জীবনে প্রথমবার? একেবারে প্রথম রাত্তিরেই বাজিমাত!
আমাদের ভাগ্য সত্যিই ভালো ছিল। মাত্র এক সপ্তাহ পরে আমাদের কয়েকজন বন্ধু অনেকবার চেষ্টা করেও অরোরার দর্শন পাননি।
আইসল্যান্ডে আমাদের ঘোরাঘুরি দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্তেই সীমিত ছিল। বিখ্যাত হিমবাহ, গেইসার (আইসল্যান্ডিক শব্দ geysir থেকে উদ্ভূত), জলপ্রপাত সব এইদিকেই বেশী ও শহর থেকে মাত্র ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে। দেশের অন্যান্য জায়গাতেও এসব প্রচুর আছে কিন্তু সেখানে যাওয়া সময়সাপেক্ষ। দেশের মাঝখানটায় লোকবসতি বিশেষ নেই। আছে শুধু বরফঢাকা আগ্নেয়গিরি আর হিমবাহ। আর আছে ভূতপ্রেত ও দৈত্যদানব—যাদের গল্প আইসল্যান্ডের লোককথায় খুব জনপ্রিয়। এখনো অনেকে এসবে বিশ্বাস করেন।
প্রথম দিন আমরা তিনটি আকর্ষণীয় জায়গা, রেকিয়াভিক থেকে খুব কাছে, দেখার প্ল্যান করেছিলাম। সবগুলোই একদিনে দেখে নেওয়া যায় বলে ব্যস্ত টুরিস্টরা এদের Golden Triangle বা সোনার ত্রিকোণ বলেন।
প্রথমটি থিংভেতলির (Thingvellir) পার্ক, এখানে ইউরোপ ও আমেরিকা দুই মহাদেশের continental plate দুটি পাশাপাশি দেখা যায়। মাঝে গভীর খাদ। প্লেটদুটি প্রতি বছর দু’এক মিলিমিটার করে সরে যাচ্ছে আর খাদটাও বাড়ছে একটুএকটু করে। এই খাদ লম্বা হয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে, সমস্তটাই আটলান্টিক মহাসাগরের নীচে। শুধু আইসল্যান্ডেই এর একটুখানি ডাঙার ওপর দেখা যায়। আমরা আমেরিকা মহাদেশে দাঁড়িয়ে খাদে উঁকি দিলাম। ওপারে ইউরোপ মহাদেশ। আইসল্যান্ড দেশটি এই টলোমলো খাদের ওপর চড়ে আছে তাই এখানে এত গেইসার ও আগ্নেয়গিরির ছড়াছড়ি। থেকে থেকে এই অস্থির পৃথিবীর শ্বাস ফেলার চেষ্টা।
সোনার ত্রিকোণের দ্বিতীয় দ্রষ্টব্য গুতলফস বা গুলফস (Gullfoss) জলপ্রপাত। আইসল্যান্ডীয় ভাষায় ফস মানে জলপ্রপাত। প্রপাতটি বেশ বিরাট, ওপরে একটি সুন্দর রামধেনু। । কিন্তু জলের শব্দে কান পাতা যায় না আর কনকনে হিমেল হাওয়া ও ঠান্ডা জলের ছাঁট বাঁচিয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করাই মুশকিল।
আইসল্যান্ডের দ্বিতীয় বিখ্যাত জলপ্রপাত সেলিয়ালান্দসফস (Seljalandsfoss). এখানে জল একটি বেশ উঁচু পাহাড় থেকে ঝরে পড়ছে। পাহাড়ের কল্যাণে হাওয়ার বেগ কম। ফলসের ঠিক পিছনে পাহাড়ের কোলে একটি সরু রাস্তা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে এই দুর্দান্ত জলের পর্দার ফাঁকে উঁকি মারা যায়। রেনকোট পরাটা কিন্তু জরুরি নইলে ঠান্ডা জলে ভিজে ভুগতে হবে।
আইসল্যান্ডে ট্যুরিজ্ম ইন্ডাস্ট্রি অপেক্ষাকৃত নতুন। এর আগে আদ্যিকাল থেকে মাছ ধরা ও রপ্তানি করাটাই প্রধান ইন্ডাস্ট্রি ছিল। এখনো এটা ট্যুরিজ্ম-এর পরেই নাম্বার টু। আইসল্যান্ডের চারদিকের সমুদ্রে প্রচুর মাছ, হাঙ্গর, তিমি—সবই আইসল্যান্ডবাসীদের প্রিয় খাদ্য। তাজা টাটকা মাছ সব রেস্টুরেন্টে পাবেন। এমনকি ফাস্টফুড হ্যামবার্গারের দোকানেও। ভেড়ার মাংসও খুব চলে। শহরের বাইরে মাঠে মাঠে ভেড়ার দল চরতে দেখা যায়। সাদা, কুচকুচে কালো এমনকী ধূসর ও বাদামি রঙের ভেড়াও দেখেছি। ভেড়ার উলের তৈরি সোয়েটার ইত্যাদি খুব নামকরা কিন্তু দামেও ভারী। পাশাপাশি চীনে তৈরি সস্তার নকলও খুব পাওয়া যায়।
আইসল্যান্ডে জারিয়ে রাখা ছমাস পুরনো হাঙরের খুব নাম, কিন্তু গন্ধের চোটে মুখে দেওয়া যায় না। আরেকটা পপুলার খাবার পাফিন পাখি! আমার প্রিয় পাখি, যাকে জীবন্ত দেখার এত আশা ছিল। প্রাণে ধরে খেতে পারলাম না। আহা, শুনি এমনিতেই ওদের সংখ্যা এত কমে যাচ্ছে।
আইসল্যান্ডে ছোটো বড়ো নানা সাইজের গেইসার দেখা যায়। মাটির ফুটোফাটা দিয়ে অনবরত গরম জল ও বাষ্প বেরিয়ে আসছে। গোল্ডেন ত্রিকোণে একটি জায়গায় বেশ বড়োসড়ো কয়েকটি আছে। বেশ কাছে গিয়ে দেখা যায়। চারপাশে বেড়া দেওয়া রাস্তা দর্শকের সুরক্ষার জন্য। চাষিরা ঐ জল দিয়ে ঘরবাড়ি গরম করেন, গরম জল ব্যবহার ও কাঁচঘেরা গ্রিনহাউস গরম করে নানা ফল, ফুল ও সবজির চাষ করেন। কেউ কেউ গ্রিনহাউসের ভিতরেই ছোটো মতো কাফে খুলেছেন, সেখানে বসে গাছ থেকে তোলা টাটকা টোম্যাটোর স্যুপে মৃদু মৃদু চুমুক দেওয়া যায়।
পাখি দেখার (আমার প্রিয় নেশা) ব্যাপারে কিন্তু আইসল্যান্ড আমাকে বেশ নিরাশ করেছিল। এমনিতেই সারাদেশে মাত্র ৭৬ জাতির পাখি। তাও সবাই গ্রীষ্ম শেষ হতে না হতেই গরমের দেশে পালিয়ে যায়। আমি দু’একটা নতুন জাতির পাখি অবশ্য দেখেছিলাম কিন্তু আমার প্রিয় পাফিনদের—খাবার প্লেট-এ ছাড়া—কোথাও দেখা পেলাম না। Whooper swan নামক এক জাতীয় বড় রাজহাঁস দেখলাম, বিরাট দল (প্রায় ৫০-৬০) বেঁধে রেকিয়াভিকের পুকুরে সাঁতরাচ্ছে। আমি আগে কখনো তিন-চারটে রাজহাঁসের বেশি একসঙ্গে দেখিনি। এরা শুধু আলাস্কা সাইবেরিয়া ইত্যাদি জায়গাতেই সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ আবার ডাঙায় উঠে ঘাড়টাড় বেঁকিয়ে ঘাস আর পাথর ঠোকরাচ্ছে খাবারের আশায়। জলের মধ্যে এদের রানীর মতো চালচলন ও গ্রীবাভঙ্গি, কিন্তু ডাঙায় তাদের একদম রাজকীয় দেখায় না।
আইসল্যান্ডের সবথেকে বড়ো আকর্ষণ—ব্লু ল্যাগুন (Blue Lagoon)। প্রায় কুড়িহাজার বর্গফুট আয়তন, এক বিরাট গরম জলের পুকুর। কোথাও ৫-৬ ফুটের বেশি গভীর নয়। চারিদিকে লাভা পাথর দিয়ে ঘেরা, আশেপাশের গেইসার থেকে গরম জল আসে, জলে সিলিকা ও অন্যান্য রাসায়নিকের দরুন নীলচে সাদা রং কিন্তু কোনও সালফার ইত্যাদির গন্ধ নেই। গরম জলে গা ডুবিয়ে খোলাখুলি সবার সঙ্গে স্নান—এদেশের লোকেদের অতি প্রিয় বিলাস। ব্লু ল্যাগুনে গিয়ে এই বিলাস খুব ভালো উপভোগ করা যায়।
ব্লু ল্যাগুন এয়ারপোর্টের খুব কাছে। সোজা বাস পাওয়া যায়। লম্বা সফরের ক্লান্তি দূর করতে অনেকেই প্লেন থেকে নেমে হোটেলে না গিয়ে ঐখানে সোজা চলে যান। লাগুনের জল আরামদায়ক ১০০-১০২ ডিগ্রী উষ্ণ।খোলা আকাশের তলায় গরম ধোঁয়া একটা আবছা আবরণ সৃষ্টি করে। জলে রাসায়নিক পদার্থগুলি নানা রকম চর্মরোগের পক্ষেও খুব উপকারী। সাদা কাদার মতো সিলিকা দিয়ে তৈরি ফেস মাস্ক খুব জনপ্রিয়। পুকুরে স্নানরত সবাইকে দেওয়া হয়, সঙ্গে এক গ্লাস ফ্রি শ্যাম্পেন।
পুকুরে ঢোকবার আগে কয়েকটা নিয়ম মানতে হবে। মাথার চুল যতসম্ভব তুলে বাঁধা ও পরে ভাল করে শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার দিয়ে ধুতে হবে কারণ জলটা নাকি চুল কড়কড়ে করে দেয়। গায়ের গয়নাগাটি, হাতঘড়ি চশমা, এমনকি চোখের কন্টাক্ট লেন্সও খুলে রাখতে হবে, নইলে জলের সিলিকা ওসবের ক্ষতি করতে পারে। সবথেকে কড়া নিয়ম জলে নামবার আগে সমস্ত জামাকাপড় খুলে, একেবারে উলঙ্গ হয়ে সাবান দিয়ে ভালো করে সমস্ত গা, মাথা ধুতে হবে। তারপর সুইমসুট পরে লাগুনে নামা। পুরুষ ও মেয়েদের বাথরুম আলাদা কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক রক্ষণশীল মহিলাদের এই ব্যাপারে বেশ মুশকিল হয়। ইউরোপিয়ানরা এসব ব্যাপারে অবশ্য গা করেন না।
সব কিছু সেরে গরম জলে নামামাত্র—আঃ বিন্দাস! হাতে সময় থাকলে আমি সারা দিন ঐ জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে পারতাম।
কিন্তু সময় নেই, সময় নেই। পরদিন আবার ছুট। এটাই আইসল্যান্ডে আমাদের শেষ দিন। এবার চললাম উত্তরে ল্যাঙয়ওকুটল নামক (Langjokull) এক বিরাট হিমবাহ (গ্লেসিয়ার) দেখতে। নামটার মানে লম্বা গ্লেসিয়ার, প্রায় আঠারো মাইল লম্বা ও ৫০০-৬০০ ফিট গভীর। এখানে ওখানে ধারালো গভীর ফাটল, পা ফেলতে হয় খুব সাবধানে। এরই মধ্যে মাইল খানেক লম্বা সুড়ঙ্গ কেটেছে, ১০০-১৫০ ফুট গভীরে। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বরফ-সুড়ঙ্গ।
সুড়ঙ্গে ঢোকবার আগে শুকনো ডাঙায় আমাদের রেনকোট ও গামবুট পরিয়ে দিল, বুটের ওপর লোহার চেন (ক্রাম্পন) লাগিয়ে দিল যাতে পিছল বরফের ওপর হাঁটতে পারি। এইসব ধড়াচূড়ো পরে আমাদের একটা গ্লেসিয়ার বাসে তোলা হল। সেই বাসের বিরাট চাকায় চেন লাগানো—বরফের ওপর চালানোর জন্য। বাস নিয়ে এল একেবারে সুড়ঙ্গের মুখের সামনে। বেশ বড়সড় টানেল, তিনচারজন পাশাপাশি সোজা হয়ে হাঁটতে পারে। ভেতরে বরফের দেয়াল ফুটে সুন্দর নীলচে আভা।
সুড়ঙ্গটা কোন কোন জায়গায় বেশ প্রশস্ত। উঁচু গলায় আওয়াজ দিলে বরফের মোটা দেয়ালে প্রতিধ্বনি ওঠে। আমাদের গাইড দরাজ গলায় একটা গানও শুনিয়ে দিল। আশেপাশে দুএকটা বেঞ্চি পাতা আছে। এখানে নাকি অনেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন, কয়েকটা বিয়েও হয়েছে এই হিমশীতল সুড়ঙ্গে।
পৃথিবীর অন্যান্য গ্লেসিয়ারের মতো ল্যাঙয়ওকুটলও একটুএকটু করে গলছে। হিমশীতল জল সুড়ঙ্গের গা বেয়ে কোথাও টিপটিপ কোথাও ঝরঝর করে ঝরছে। প্রতিদিন সারাদিন কর্মীরা এই জল পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। ভেতরে বরফের চেয়েও জলে ভেজার ঠান্ডাটা বেশি লাগে। এই রেটে গলতে থাকলে এত বড়ো গ্লেসিয়ারটাও এই শতাব্দীর মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। এইসব নিয়ে খুব গবেষণা চলছে, টুরিস্টদের দেখানো ছাড়াও সুড়ঙ্গের প্রধান কাজ এই নিয়ে রিসার্চ।
আইসল্যান্ডে আমাদের শেষদিনটা সুড়ঙ্গেই কাটল। এবার ঘরে ফেরার পালা। আরও অনেক কিছু বাকি রইল। আবার আসতে হবে—পাফিনটাই যে দেখা হল না এখনো!
(ভ্রমণকাল—অক্টোবর, ২০১৯)