• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • সাময়িক স্বর্গবাস : রাহুল মজুমদার

    ৬ মে ২০০৯

    রাত পৌনে দশটা বাজতে পাঁচ মিনিটে কলকাতা থেকে দুজনে চড়ে বসলাম গরীব রথে। উদ্দেশ্য সাময়িক স্বর্গবাস। এই রথ আমাদের পৌঁছে দেবে স্বর্গ-দ্বার নিউ জলপাইগুড়িতে।

    ৭ মে

    প্রায় গোটা দিনটাই কাটল পথে পথে, গাড়িতে গাড়িতে। NJP থেকে সুমোর কাঁধে, থুড়ি, পেটে চেপে ঘুরুন্ডি পথে ঘুম — পথে কার্শিয়াংয়ে চা-পান, আবার সুমো-চাপন এবং বেলা একটায় ঘুম-দেশে উত্তরণ।

    গাড়ি বদল, পাড়ি বদল — এবার যাব মানেভজ্যাং। সুখিয়াপোখরিতে এসে গাড়ির উৎসাহে ভাটা পড়ল। বোধহয় ঠান্ডা লাগছিল; তাই মাথায় একজোড়া জব্বর সাইজের তক্তা চাপালো। সেই সুযোগে আমরাও চা চাপালাম। অবশেষে আড়াইটেয় আমাদের মান ভঞ্জন করতে মানেভজ্যাংয়ে সযত্নে নামিয়ে দিয়ে সে ছুট লাগাল রিমবিকপানে। পুরো পথটা এসেছি মেঘ মাখতে মাখতে, চাখতে চাখতে। মনমেজাজ তাই ঠান্ডাই ছিল। জনবিরল মানেভজ্যাংও দিব্যি ঠান্ডা। কলকাতার ৩৮ ডিগ্রি ছেড়ে মানেভজ্যাংয়ের ১২ডিগ্রিতে এসে ঠান্ডার ডান্ডা বেশ টের পাচ্ছি। আজ আর নট নড়ন চড়ন; তাই প্রধান হোটেলের তিনতলার ঘরে জমিয়ে বসা গেল। শেষ বিকেলে নিচে নেমে সাক্ষাত পেলাম অর্জুনের — বহুদিনের সখা অর্জুন। সে তো বউদিকে দেখে আত্মহারা, আঁধার নামার আগে পর্যন্ত সাহচর্য দিল মহানন্দে।

    ৮ মে

    সকালে উপবাসভঙ্গের পর ল্যান্ডরোভারের পেটে ল্যান্ড করা গেল। গতকালই চারজনের এক দলের সঙ্গে আলাপ। আমরা আজ তাদেরই সঙ্গী। পৌনে ন-টায় মানেভঞ্জ্যাং ত্যাগ করে সন্দকফু-র চড়াই পথে চাকা চড়াল ল্যান্ডরোভার। বেশ কিছুদূর অবধি পিচ পড়েছে পথে। পাইন পাহারায় চিত্রে অবধি পৌঁছে দিয়ে সে থেমে গেল; এবার বুকে টেনে নিল সেই আদি অকৃত্রিম পাথুরে পথ। ঝালমুড়ি-ঝাঁকানি খেতে খেতে আপার চিত্রে, লামেধুরা হয়ে মেঘমায় এস.এস.বি-র ছাউনির সামনে সাময়িক বিরতি। আসন্ন উৎসবের জন্য মেঘমার গুম্‌বার চত্বরে পুঁথিকে রোদ খাওয়ানো চলছে। এখান থেকে বামপন্থী পথে নেপালী পথে রোমাঞ্চ মাখতে মাখতে গুরাঁসে হয়ে তুমলিং। নীলার সঙ্গে কফি-আড্ডা সেরে আর ফিরতিপথে দু দিন থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার বাহন-চাপন এবং অস্থি-পঞ্জার স্থানচ্যুতকারী যাত্রায় গৈরিবাসে অবতরণ। জোরসে দম নিয়ে গাড়ি চড়চড়িয়ে চড়ল কায়াঁকাটা পেরিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে শেষবেলায় গোঁত্তা মেরে কালপোখরি। তাকে হাত নেড়ে আবার চড়ে নেমে বিকেভঞ্জ্যাং। বড় ভালোবাসার সেই লজের জায়গায় শুধুই শূন্যতা। মনখারাপকে বাড়িয়ে শেষ চড়াই ক্রমশ ঈগলের রূপ নিল। সিলভার ফারের পাহারায় সেই পথ পেরিয়ে একটা বাজতে এক মিনিটে স্বর্গারোহণ — সন্দকফুতে পি.ডব্ল্যু.ডি বাংলোর সামনে ল্যান্ডরোভার ফাইনালি ল্যান্ড করালো আমাদের। বারোহাজারি সন্দকফুতে এখন হালকা বেগুনি রডোডেনড্রনের ফুলসজ্জা। তাপমাত্রা বারোর ওপর উঠতে নারাজ। কলকাতার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই গরম এখন স্রেফ দুঃস্বপ্ন।

    ৯ মে

    আজ ২৫শে বৈশাখ বিশ্বকবির জন্মদিন। আজ বুদ্ধপূর্ণিমাও। তথাগত গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বিবাহ আর পরিনির্বাণের তিথি। কাল রাত্রে জব্বর ঠান্ডা পড়েছিল — দুই তিন ডিগ্রির মধ্যেই ঘোরাফেরা করছিল তাপমাত্রা। আজ ভোর পৌনে পাঁচটায় বাইরে বেরোতেই তিন ডিগ্রির ঠাণ্ডা জব্বর হাওয়ার থাপ্পড় লাগিয়ে বলল, ‘ঘুমন্ত বুদ্ধেরই ঘুম ভাঙেনি, তুই বেরিয়ে পড়েছিস! সাহস তো কম নয়!’

    উদার আকাশ কমলা ওড়নাখানা পরতে শুরু করেছে। ঝটমট ঘরে ঢুকে গরম জ্যাকেট আর গরমচাদর মোড়া গিন্নীকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ডাক দিলাম বাকিদেরও। আমাদের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল — সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট সোনালী পোশাক চড়িয়ে নিল এবার। একটু একটু করে সমস্ত চরাচর সেই সোনা মেখে নিল। বহুবার দেখা এই স্বর্গীয় দৃশ্য আর একবার স্বর্গদর্শন করালো।

    তৃপ্ত মনে পৌনে ন-টায় অবতরণ আরম্ভ। পাথুরে গড়ানো নড়ানো পথে যে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সারথি নিয়ে চলল, তাতে তার নিদেনপক্ষে পদ্মবিভূষণ পাওয়া উচিত — আড়াই ঘণ্টায় নীলার দোরগোড়ায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে, বাকিদের নিয়ে দৌড় লাগাল মানেভঞ্জ্যাংপানে। আমরা নীলার আদরের আওতায় নিজেদের নিশ্চিন্তে সঁপে দিলাম। বেলা গড়াল সমাদরে। বেলা বাড়তে দলে দলে টুরিস্ট আর মেঘের দল ঘনিয়ে এল। চারটেয় মেঘেরা আর অপেক্ষা করতে পারল না — বৃষ্টি হয়ে নেমে এল। ফলে নীলার আস্তানায় তিন চার দল বিদেশী ট্রেকার, তাদের গাইডেরা, একজন পুনর্জন্মপ্রাপ্ত লামা, শেষবেলায় ভিজে চুপ্পুস হয়ে পঁচিশ জনের এক বিশাল দল। দেখলাম কর্মব্যস্ততা, কর্মদক্ষতা, work culture বলতে কী বোঝায়। চল্লিশ জন অতিথির সেবায় নিবেদিত প্রাণ নীলাদের পরিবারের সাতজন সদস্যের অনলস কর্মচাঞ্চল্য — সবজি কাটা, পনির বানানো, ডিম সেদ্ধ করা, চাল ডাল ধুয়ে উনুনে বসানো, একই সঙ্গে ডাইনিং হলের ‘fire place’-এ কাঠের যোগান দেওয়া, ফরমাস অনুযায়ী চা কফি ছাং Beer যুগিয়ে যাওয়া! Star lamp-এর আলোয় এ এক রূপকথার জগৎ। বাইরে গর্জন বর্ষণ, ভিতরে গুঞ্জন। রাত (কলকাতার ভাষায় সন্ধে) বাড়ল, বর্ষণ কমল, কমতে কমতে ধুত্তেরি বলে একসময় থেমেই গেল।

    ‘রাত’ সোয়া সাতটা রাত্রিকালীন ভোজন সমাপ্ত, আটটার আগেই জাগরণের সমাপ্তি।

    ১০ মে

    ভোরবেলা ঘুম ভেঙে বাইরে বেরোতেই বুদ্ধপূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্রের স্মিত হাস্যে দর্শন, শায়িত বুদ্ধের ঝাপসা দর্শন। ক্রমে ক্রমে তুমলিং পর্যটকশূন্য হলো। নিস্তব্ধতার আবহে ছাগলছানাদের ছুটোছুটি, মিহিগলায় ডাকাডাকি, পাখিদের ওড়াউড়ি, কুকুর, বেড়াল আর আমাদের রোদ পোয়ানো। হিংসুটে মেঘেদের সহ্য হবে কেন? বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করল রোদকে, লেলিয়ে দিল ঠান্ডাকে।

    দুপুরে অলস পদচারণায় জোবাড়ি ফটক পরিক্রমার নামে খিদে বাড়িয়ে আসা গেল। ফ্রায়েড রাইসে পেট ফুলিয়ে এক চক্কর টংলু ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া গেল। সঙ্গী হলো চপল মেঘের দল; টংলুর টংয়েও সঙ্গ ছাড়ল না, আমার সঙ্গে আড্ডায় মাতল।

    দু জন বাঙালী ভদ্রলোক ধোতরের সুঁড়িপথ বেয়ে উঠে এসে আড্ডার সঙ্গী হলেন। মেঘেরা বোধহয় ব্যাপারটা তেমন পছন্দ করল না, গর্জিয়ে বলে উঠল, ‘যা পালা — নইলে ভিজিয়ে দেব।’ হুমকিতে চমকে দৌড়ে তুমলিং ফিরে টের পেলাম, পুরোটাই মেঘের ইয়ার্কি।

    এলাকা দখলটা কিন্তু কালো মেঘের দল জারিই রাখল, ছ-টার সময় শুরু হলো তাদের হাঁচি। ক্রমশ সেটা দ্রুতলয়ের লহরা হয়ে দাঁড়াল, সঙ্গে মেঘগর্জনের বাঁয়ার সঙ্গত। এত ঘনঘটার মাঝেও পশ্চিম আকাশে কমলার মেলা। বর্ষার নাচ আর মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন এখন তুমলিংয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।

    ১১ মে

    ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখি নির্লজ্জ চাঁদ প্রাণ খুলে হাসছে। বুকভরা আশা নিয়ে রিজে উঠে এসে সে আশা ধুক করে নিভে গেল। তুমলিংয়ের আকাশ পরিষ্কার হলেও উত্তরে মেঘের পুরু লেপ। সেই লেপের ফাঁক দিয়ে তুষারশৃঙ্গেরা ঘুমচোখে বার দুই উঁকি মারার চেষ্টা করে ক্ষান্ত হল। সকাল ছ-টায় স্বর্গ থেকে বিদায় নিতে হল। জোবাড়ি থেকে আসা সার্ভিস ল্যান্ডরোভারে চেপে বসলাম। নীলা বলে রেখেছিল, তাই আমরা সামনের সীটেই জায়গা পেলাম। নীলা কিছুতেই দাদা আর বৌদির থেকে একটি পয়সাও নিতে রাজি হল না। ভালোবাসার দেনায় ডুবে নেমে চললাম। তিন বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই মেঘ আমাদের গিলে ফেলল। নাচতে নাচতে গুঁরাসে হয়ে মেঘমা। এখান থেকে আরও একজন আরোহী বাড়ল — সামনের সীটে এখন ড্রাইভার ভাইকে নিয়ে আমরা তেঁতুলপাতায় চারজন। হেলপার-শিশু এখন পিছনে ঝুলন্ত। না, ঠিক ঝুলন্ত না, দাঁড়ন্ত। লামেধুরায় এসে আরেকজন যাত্রিনী স্কুল পড়ুয়া শিশু ট্যাঁকে নিয়ে পিছনে কোনও এক ঐন্দ্রজালিক কৌশলে সেঁধিয়ে গেল। তারা অবশ্য চিত্রেয় নেমে গেল। সোয়া সাতটায় ল্যান্ডরোভার মানেভঞ্জ্যাংয়ে ল্যান্ড করে আমাদের উপরে দিল। সাময়িক স্বর্গবাসে যবনিকাপাত হল।



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচ : রাহুল মজুমদার

    Tags: Bengali travelogue with sketches on Sandakphu, Rahul Majumdar
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments