The Mind And Work of Sarat Chandra Bose; Prabhas Chandra Ray; First Published : January 2006; Ashabari Publication - Howrah; ISBN: 81-89468-11-1
বহুকাল আগে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন — বাঙালী বড়ই আত্মবিস্মৃত জাতি। বঙ্কিম বলেন — সাহেবরা যদি পাখী মারতে যান তারও ইতিহাস লেখা হয়, কিন্তু বাঙলার ইতিহাস নেই। কিন্তু কে লিখবে? জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ বঙ্কিম বলেন — কেন তুমি লিখবে। আমরা লিখব।
ইতিহাসচর্চাতত্ত্বকাররা সাম্রাজ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী, সাবঅলটার্ন প্রভৃতি দৃষ্টিকোন রচিত ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের কথা বলেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেন একই ঘটনাপ্রবাহের। সব ক্ষেত্রেই দরকার তথ্য সংগ্রহ, পূর্বকৃত ব্যাখ্যার পুনর্বিচার এবং নব মূল্যায়ন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের প্রধান অধ্যাপক র্যা ঙ্কে তথ্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, যত নগণ্যই হোক, কোনো তথ্যই শেষপর্যন্ত বাজিয়ে না নিয়ে ছাড়তেন না। বলতেন — ‘নগ্ন সত্য, অলঙ্কারহীন, প্রত্যেকটি তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান দরকার। কিছুতেই কল্পনার প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না, ক্ষুদ্রতম বিষয়েও না।’ ঐতিহাসিক অ্যাকটন মনে করতেন প্রাপ্ত তথ্য বিচার্য, কিন্তু বাইরের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিত দেখাটারও দরকার আছে। আমাদের এখানে যে কোনো শাখার ইতিহাস রচনার প্রধান প্রতিবন্ধক — প্রাপ্ত তথ্যাদি অল্প, যাও বা আছে তা ব্যবহার করতে পারার পথে নানা বাধা। সর্বোপরি কল্পনা, গল্প কথা’র প্রভাব। তাছাড়া দেশজ ইতিহাস বিচারের অনেক রেকর্ড আজও বিদেশে, সেখানে যাওয়া অর্থ ও অনুমতি সাপেক্ষ।
সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন ও কর্মকাণ্ডের ওপর নানা আলোচনা হয়েছে। হয়তো তাঁর উজ্জ্বলতর আড়ালে থেকে গিয়েছে তাঁর মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসুর (১৮৮৯--১৯৫০) অবদান। তিনি ছিলেন বিশের দশকের বাংলা কংগ্রেসের পঞ্চব্যক্তিত্বের অন্যতম এবং ১৯৪৭ এর ক্ষমতা হস্তান্তরকালে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নেন। তাঁর তিন যুগের সক্রিয়তায় ফুটে উঠেছিল মানসিক সামর্থ্য, সাহসী বিবেক এবং বাঙালী বিপ্লবপন্থীদের অনুভব ও আর্থিকতা সম্পর্কে সহানুভূতি। এই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আছে কিছু সান্নিধ্যকথা (অমিয় বসু, অশোক বসু, শিশির বসু), শরৎবাবুর কিছু বক্তৃতার সংকলন, লিওনার্ড গর্ডনের ভ্রাতৃদ্বয় সম্পর্কে বই, শরৎ বসু সম্মাননা গ্রন্থ ইত্যাদি। আছে কিছু অফিসিয়াল রেকর্ড, দৈনিক ও সাময়িক পত্রপত্রিকা, পুলিশ ও গোয়েন্দা দপ্তরের রিপোর্ট ইত্যাদি।
সুখের বিষয় শরৎচন্দ্র বসুর ব্যক্তি জীবন এবং অবদান সম্পর্কে যথেষ্ট পরিশ্রমে একটি গবেষণাপত্র রচনা করেছিলেন ড. প্রভাস চন্দ্র রায়, শিবপুর দীনবন্ধু কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক। আলোচ্য বিষয়ে আজ পর্যন্ত এটিই সম্ভবত একমাত্র গবেষণাগ্রন্থ।
এই বইতে আছে ৯টি অধ্যায়। ইতিহাস পাঠে আগ্রহীদের জন্য বইটির প্রতিপাদ্য নিবেদন করি। এত পরিশ্রমের ফসল অনাঘ্রাত থেকে যাবে এটা অনুচিত হবে মনে হয়।
১ম অধ্যায়ে লেখক শরৎচন্দ্রের talent এবং Vision ভরা কর্মজীবনকে চারটি পর্বে ভাগ করেছেন। ক) ১৯২১-২৫ — চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে শরৎ এবং সুভাষ দুই ভাই কর্মরত। স্বরাজ্য পার্টির অধীনে কর্ম ব্যহত হয় চিত্তরঞ্জনের আকস্মিক তিরোধানে। এ সময় অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হয়ে তিনি ভারতীয়দের দৃষ্টিতে এলেন। আইনজ্ঞ হিসেবে ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ফরোয়ার্ড পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টার হিসেবে কাজ করেছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তীব্র স্বরায়নে বাংলার তরুণ বুদ্ধিজীবিদের জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করেন। খ) ১৯২৬-১৯৩২ এ সময় তাঁরা দুই ভাই চিত্তরঞ্জন প্রাণিত পথে বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন, যদিও সে সময় সুভাষ কারান্তরালে। শরৎ ভাবনার মধ্যে ছিল বিপ্লবী ভাবনাপ্রসূত জাতীয় সংগ্রাম চিন্তা। কলকাতা কর্পোরেশনের কাজকর্ম, আইন অমান্য আন্দোলন দুদিকেই ছিলেন তিনি। সরকার একে একে গ্রেপ্তার করল গান্ধী, প্যাটেল, প্রসাদ, নেহেরু, বোম্বে, কলকাতা ও দিল্লীর নেতৃবৃন্দকে। কংগ্রেসের যাবতীয় সংগঠন হল বেআইনি। শরৎ গ্রেপ্তার হলেন ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ ঝরিয়া থেকে। জেলে সাক্ষাৎ হল ভাইয়ের সঙ্গে। গ) ১৯৩৫-৪১ শরৎ যখন কার্শিয়াং-এ অন্তরীণ কংগ্রেস জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্য হবার জন্য মালব্যের নেতৃত্বে, কয়েকজন সুপরিচিত নেতা পরাজিত হলেন। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষ নেওয়া শরৎ জয়ী হলেন কলকাতা থেকে। ১৯৩২-এ সাম্প্রদায়িক পুরস্কার প্রত্যাখ্যান। কারারুদ্ধ থাকায় আইনসভায় কাজ করতে পারলেন না। ১৯৩৫, ২৬ শে জুলাই মুক্তি পেয়ে বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত।
গ) ব্যাপক মন্দায় ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত। এল গর্ভনমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ১৯৩৭। জাতীয় নেতাদের মধ্যে বিভেদ ঘটাল যদিও মুক্তি সংগ্রামে গতি। বসু ভাই দুজনের জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল পর্ব। ১৯৩৭-এ সুভাষ ইউরোপে, শরৎ এখানে আইনসভায় বিরোধী পক্ষের নেতা হিসেবে নৈপুন্য দেখালেন। হরিপুরা কংগ্রেসে (১৯৩৮) সুভাষ ৫১তম সভাপতি, শরৎ ভাইয়ের প্রধান সমর্থক, দুজনে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের বদলে দাবী করলেন পূর্ণ স্বাধীনতা, ৬ মাসের মধ্যে। দ্বিতীয়বারও সুভাষ সভাপতি, গান্ধীজীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। অবাধ্য ছেলে সুভাষ, গান্ধী নেহেরু জোট ভাঙতে সমর্থ, তবে সভাপতি পদ ত্যাগ। এরপর সুভাষের রাজনৈতিক সক্রিয়তা বন্ধ করে দেওয়া হল। ১৯৪১ দুই ভাইয়ের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সময়। সুভাষের দেশত্যাগ, তখন শরৎ একা শুরু করলেন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বক্তৃতা ভারতব্যাপী। ফজল-উল-হকের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হল প্রগতিশীল কোয়ালিশন সরকার, শরৎ হলেন হোম মিনিস্টার। জাপ দূতাবাস মারফৎ সুভাষের সঙ্গে যোগ। সুতরাং ইংরেজ সরকার পুনরায় তাকে গ্রেপ্তার করল ১৯৪১, ১১ই ডিসেম্বর, রাখা হল ত্রিচিনোপল্লী, মেরকারা, কুনুরে। ঘ) ১৯৪৫-৫০: মুক্তি ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫, কংগ্রেস কর্তারা ৫ বছর পরে ডাকলেন, সাড়া দিলেন, মন্ত্রী হলেন। কিন্তু ৬ সপ্তাহ পরে পদত্যাগ, মুসলিম লীগ সভ্যকে সুযোগ দেবার জন্য। মতবিভেদ শুরু কংগ্রেস কর্তাদের সঙ্গে। নেহেরু ও কৃপালনী তাঁকে চাইছিলেন না। কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ, সোসালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি স্থাপন (জানুয়ারী ১৯৪৭) তখন তাঁর ভাবনা সমাজতন্ত্রী পথেই সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি। মোহভঙ্গ ও জাতিগঠনে আত্মনিয়োগ। জুন ১৯৪৯ নির্বাচনে বিপুল জয়। এ জয়ে কম্যুনিস্ট পার্টি বাদে অন্য বামপন্থীরা ছিল।
এবার লড়াই ব্রিটিশের সাথে এবং উত্তর পশ্চিম ভারতীয় নেতাদের সাথে। শরীর খারাপ হতে লাগল। প্রয়াত হলেন ১৯৫০ এর শীতে। ভারত হারাল সমর্থ পার্লামেন্টারিয়ান, মান্য আইনজ্ঞ ও স্বদেশপ্রেমিককে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে বংশ পরিচয়। পিতা জানকীনাথ আইনজ্ঞ হিসেবে সুখ্যাতি পান। ব্রিটিশ আনুগত্যের কারণে রায় বাহাদুর উপাধি ও সরকারী উকিল পদ পান। শরৎ তাঁর ২য় পুত্র। পিতার মতই শরৎ নানা গুনান্বিত, লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারী পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টে সক্রিয়। স্বাধীন চিত্ততা দুজনের মধ্যেই। নিয়মমনস্কতা, বুদ্ধি, প্রখর স্মৃতি থাকায় সিভিল ও ক্রিমিন্যাল কেসে খ্যাত। আইনজ্ঞের ব্যস্ততার পরই স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রতী হওয়া।
তৃতীয় অধ্যায় রাজনৈতিক জীবন পর্ব। জাতীয় সংগ্রামে শরৎ আগ্রহী পিতৃ পরম্পরায়। ১৯১৯-এ জাতীয় কংগ্রেসে যোগ। চিত্তরঞ্জন ছিলেন শরৎ ও সুভাষের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু। চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক চেতনা অবশ্য অধ্যাত্মপ্রাণিত। চিত্তরঞ্জনের মতাদর্শ অনুযায়ী কাজের যোগ্য নেতা তাঁর মতে সুভাষ, যিনি ‘ঝঞ্ঝা বাজপাখি’। সুভাষের আই. সি. এস হওয়া সত্ত্বেও সরকারী প্রশাসনে অনাগ্রহে মদত দেন শরৎ। সুভাষের নানাবিধ সিদ্ধান্তগ্রহণে পরামর্শদাতা শরৎ ও তাঁর স্ত্রী। দেশবন্ধুর আকস্মিক প্রয়াণে স্বরাজ্য পার্টির দায়ভার যারা নেন শরৎ তাঁদের অন্যতম। ইতিমধ্যে বিধান, তুলসী, নলিনী, নির্মল সহযোগে পঞ্চজন জাতীয় গঠনে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করলেন। কলকাতা কর্পোরেশনের কাজে এবার তিনি ছিলেন ভীষণ ব্যস্ত। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, রাজনৈতিক বাতাবরণ দূষিত করে দিয়েছিল। ফরোয়ার্ড, নিউ ফরোয়ার্ড লিবার্টি প্রভৃতি পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখা বার হয়। হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ধর্মযোদ্ধা।
চতুর্থ অধ্যায়ে আসছে তাঁর র্যা ডিকাল রাজনৈতিক চিন্তার কথা। এখানে বলা হচ্ছে শরৎবাবু চেষ্টা করেছিলেন অহিংস ও সহিংস প্রয়াসকে সমন্বিত করতে। এক্ষেত্রে দু ভাইয়ের প্রয়াস উল্লেখ্য। শরৎবাবুকে তিনি র্যা ডিকাল ও রেভলিউশনারী নেতা হিসেবে দেখাতে সচেষ্ট। বহু বিপ্লবীকে ব্যক্তিগতভাবে, গোষ্ঠীগতভাবে আর্থিক সাহায্য করেছেন। তাঁকে তরুণ কর্মীরা এই সব কারণে শ্রদ্ধা করত। পুলিশ কমিশনার টেগার্ট উদ্বুদ্ধকরণে শরৎবাবুকে দায়ী করেছেন। ২১--২৩ পর্বে রাজনীতিতে না এলেও ভাইকে সমর্থন করেছেন। পুলিশ রিপোর্ট মতে ৬ বার তিনি বিপ্লবীদের অর্থ সাহায্য করেছেন, অনন্ত সিং এর মামলা চালিয়েছেন ফি না নিয়ে, টেগার্ট হত্যাপ্রয়াসীদের ৩০০০ টাকা দিয়েছেন, অনেক পলাতক বিপ্লবীকে আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করেছেন। লিবার্টি পত্রিকার নানা হেডিং-এ সরকারকে তিরস্কার করেছেন, সুভাষের লাহোর বক্তৃতার উদ্ধৃতি তুলে তীব্র আবেদন তরুণদের কাছে। প্রাক্তন ডেটিনিউ এবং রাজনৈতিক বন্দীদের চাকরির ব্যবস্থা করেন কর্পোরেশনে। যুগান্তর এবং বি. ভি. দলের সঙ্গে দুই ভাইয়ের যোগ ছিল। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বড়ো প্রভাব ছিল দুই ভাইয়ের চিন্তায়। ১৯৩৮, ২ জুলাই বক্তৃতায় কম্যুনিস্ট আদর্শ কথা। এ অধ্যায় সম্পর্কে বলার কথা হল সহিংস ও অহিংস সমন্বয় করা বিপ্লবী সাফল্যের উদাহরণ কি অন্যত্র আছে? দ্বিতীয়ত: অর্থসাহায্য প্রমাণ করে সহানুভূতি। ইংরেজ সরকার অবশ্য সর্বত্র কম্যুনিজমের ভূত দেখেছে, তাই রিপোর্টে অতিশয়োক্তি। শরৎবাবুর কম্যুনিজম প্রীতি যথার্থ হলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সরে দাঁড়ায় কেন? গান্ধী ও গান্ধীপন্থীরা কি বিপ্লবী? সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একটি প্রবন্ধে বলেন — সুভাষের জীবনবেদে পাঁচটি উপাদান — বিবেকানন্দের ব্যবহারিক বেদান্তের প্রভাব, হেগেলের সামূহিকতাধর্মী ব্রহ্মবাদ এবং ডায়ালেকটিক্স এর প্রভাব, শোপেনহাওয়ারের ইচ্ছামন্ত্রের (the world as will) প্রভাব, ডারউইন হার্বার্ট স্পেনসার ও বের্গসঁর সৃজনশীল বিকাশ তত্ত্বের (creative evolution) প্রভাব। তবে বিবেকানন্দ ও হেগেলের দর্শনই সুভাষচন্দ্রের ভাবনার মধ্যমান। সুভাষ দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মেনে নেননি, শ্রেনীসংগ্রাম তত্ত্ব ও শ্রমিকশ্রেণীর ডিকটেটরশিপ মেনে নেননি। সুভাষের বামপন্থা — সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, বলশেভিক সাম্যবাদ বিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক। নীটশের অতিমানব তত্ত্বকে প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদে অনেক মিল। (নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবনবেদ — সতীন্দ্র চক্রবর্তী, পরিচয়, শতবর্ষে সুভাষচন্দ্র, জুন-জুলাই ১৯৯৬) এই মূল্যায়নের যাথার্থ বিচারে আমার যোগ্যতা নেই। সুভাষের ভাবাদর্শ শরৎবাবুর ভাবাদর্শের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তাই প্রসঙ্গ তোলা গেল। শরৎবাবু দক্ষ বক্তা, নিপুণ আইনজীবী, আন্তরিক মানবতাবাদী কিন্তু তাঁকে Radical Political Thinker বলা যাবে কিনা এ প্রশ্ন উঠতে পারে।
পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচ্য — শরৎ বসুর পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে অনন্য দক্ষতার কথা। প্রভাসবাবু একের পর এক দৃষ্টান্ত তুলে শরৎ বসুর ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কলকাতা কর্পোরেশন কেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে এ কাজে তাঁর অনুপ্রবেশ ত্রিশের দশকে, তখন তিনি স্বরাজ্য পার্টির নেতা। কারারুদ্ধ সুভাষ ও নিজের রাজনৈতিক ভোটাভুটির ম্যানিফেস্টো লিখলেন। তাঁর আলোচ্য ছিল ডেটিনিউ ও পুলিশ সম্পর্ক, যুগল শাসন প্রসঙ্গ, বাজেট, সেচ, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে। প্রচুর পরিশ্রমে তথ্য সংগ্রহ করে বক্তব্য রাখতেন। স্বরাজ্য পার্টির বাধাদানের রাজনৈতিকতা যে নিষ্ফলা নয় এটা বোঝাতে কালাভার(??) উদাহরণ রাখেন। কিন্তু ভোটাভুটির যাঁতাকলে ব্যর্থতা আসে। শিক্ষামন্ত্রী পি. সি. মিত্রের প্রয়াস, ব্রিটিশ সরকারী তথ্যবিকৃতি সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দাবী, নো কনফিডেন্স মোশন ইত্যাদি প্রসঙ্গ তোলার ক্ষেত্রে মুসলিম নেতাদেরও পাশে পান। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের ৩০% সদস্যপদ দাবী ও সাম্প্রদায়িক বিলের অসম সুবিধা, আপত্তিজনক দিক নিয়ে আলোচনাতেও তাঁর নৈপুণ্য লক্ষণীয়। তবে ক্রমশ হিন্দুমুসলিম সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল। বাঙালী মহাজনী বিল, মারওয়াড়ী ব্যবসায়ী স্বার্থরক্ষায় তাদের গান্ধীর কাছে ছুটে যাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ। সেকেন্ডারী শিক্ষা বিল, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল সংশোধনী (১৯৪০) তে তাঁর তৎপরতা লক্ষণীয়। তবে সুভাষের দেশত্যাগ শরৎ বসুর শারীরিক ও মানসিক শান্তি নষ্ট করে দেয়।
৬ষ্ঠ অধ্যায়ের বিষয় — সমঝোতাহীন সেকুলার মনোভাবের দিক। পারিবারিক এবং ব্রিটিশ শিক্ষার দৌলতে শরৎ পেয়েছিলেন সেকুলার মনোভাব। তাঁর আজীবন কর্মপ্রয়াসের একটা বড়ো দিক হিন্দু ও মুসলমান দ্বৈরথ। প্রথমে লেখক ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ইতিহাস বিবৃত করে নেন। এটাও বলেন সাম্প্রদায়িক সংকট ব্রিটিশ সরকারের সচেতন ইন্ধন জোগানোর ফলে মারাত্মক রূপ পায় (পৃ. ১০১) এটাও ঠিক সশস্ত্র বিপ্লব, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, কংগ্রেস চালিত জাতীয় আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবই তাৎপর্যপূর্ন। (পৃ. ১০২) কর্পোরেশন প্রয়াসে উগ্র মুসলিম নেতাদের ক্ষমতার লড়াই, ওয়াক আউট শরৎবাবুকে বিব্রত করে। নিজে হিন্দু, হিন্দু নেতৃত্বের সমর্থন সত্ত্বেও শরৎ কিন্তু মুসলিম বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু যাবতীয় সৎ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস আসছিল। (পৃ. ১০৮) মেয়র ও ডেপুটি মেয়র পদে জন্মসূত্রে ২জন হিন্দু নির্বাচিত হওয়ায় মুসলিম অসন্তোষ। (পৃ. ১০৯)। শেষ পর্যন্ত মুসলিম কাউন্সেরলরা নির্দিষ্ট সংখ্যক পদ দাবী করে বসল এরই অন্তিম পদক্ষেপ ভারত বিভাজন। জি. ডি. বিড়লার নেতৃত্বের ব্রিটিশ তোষণ এবং গান্ধীবাদী আন্দোলন সমর্থন (পৃ. ১১৬) উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শরৎ কংগ্রেস থেকে সাসপেন্ড হয়। ১৯৪১, ডিসেম্বর শরৎ-এর গ্রেপ্তার, প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার শপথ, মুসলিম লীগ থেকে ফজলুল হক বহিষ্কার — তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। (পৃ. ১২৪) শরতের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূরীভূত হয়নি। কৃষক মজদুর সংগ্রামে, তেভাগা আন্দোলনে, সুভাষের বহির্ভারতীয় লড়াইয়ে হিন্দুমুসলিম বিদ্বেষের কথা কিন্তু শোনা যায়নি। যেখানে ক্ষমতার, স্বার্থের লড়াই সেখানেই সংঘাত। এ কথা লেখক গুরুত্ব দেবেন অনুরোধ রইল।
৭ম অধ্যায় — পথের বিভাজন। বসু ভাইরা এবং কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের বিভেদ বাড়ছিল। ১৯৩৯ ত্রিপুরী কংগ্রেসে বসুভাইদের পরাজয় ঘটে। বসু ভাইরা বাম ব্লক কনফারেন্স এর কথা চিন্তা করতে থাকে। সুভাষ প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রস্তাব বামেরা পছন্দ করে। জেলমুক্ত শরতের প্রথম জনভাষণে (সেপ্টেম্বর ১৯৪৫) ছিল যুদ্ধযাত্রার ডাক। শরৎ ভাবছিলেন ভারত হবে a union of Socialist Republics, ‘যুক্ত স্বাধীন বঙ্গ’ প্রস্তাবও চিন্তা করেন। পুত্র এবং কতিপয় প্রিয়জনের আগ্রহে একটা নতুন দল করার কথা হল — যাতে থাকবে আই.এন.এ, ফরোয়ার্ড ব্লক, সোসালিস্টরা, অন্য বামেরা। ৪৭-এ এই দল হল। SRP ভোটে দাঁড়াল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, কমনওয়েলথ ত্যাগ, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন, নানা বাম দলের একত্রীকরণ এর কথা বলে। (পৃ. ১৬৪--৬৫) ৪৮-এ বাঙালী উদ্বাস্তু আগমনেও এ দল সচেতন। বঙ্গভাগ যে সমস্যা সমাধানের পথ নয় তা তিনি বুঝলেন। ৪৯-এ ইউরোপ থেকে ফিরে যুক্ত বাম প্রয়াসে লাগলেন। ৪৯-এ SRP, ফরোয়ার্ড ব্লক, চাষী মজুর দল (মহারাষ্ট্র) নিয়ে বোম্বেতে মিটিং, শরতের ভাষণ। ১৯৪৯-এ দক্ষিণ কলকাতা থেকে বাইইলেকশনে জয় পেলেন শরৎ। সরকারকে পুলিসী অত্যাচার, বিনা বিচারে কারাবাস, অস্ত্রবিহীন শোভাযাত্রাকারীদের ওপর গুলির জন্য দুষলেন, বললেন গণতন্ত্র বিপন্ন। জয়প্রকাশ শরৎ সাক্ষাতে যুক্তফ্রন্ট গঠনে জয়প্রকাশ সব দলের পৃথকত্ব বিসর্জনের কথা বলল। অন্যদিকে যতীন চক্রবর্তী (R.S.P), সৌমেন ঠাকুর (R.C.P.I)। শরতের সঙ্গে থাকতে চাইলেন না। জয়প্রকাশ যাবতীয় বামের একীভবনে অবিশ্বাসী। জয়প্রকাশের বিরুদ্ধে সাবোটাজের অভিযোগ উঠল শরৎ পক্ষ থেকে। শেষ পর্যন্ত C.P.I এবং জয়প্রকাশের সোসালিস্ট পার্টি বাদ দিয়ে যুক্ত মোর্চা হল। কিন্তু ক্রমান্বয় শারীরিক বিপর্যয় ও মৃত্যুতে এ প্রয়াস শেষ হয়ে যায়।
৮ম অধ্যায়ের নাম — রাজনীতি ও প্রজ্ঞাদৃষ্টি। প্রভাসবাবু ৮ ও ৯ নং অধ্যায়ে লেখক শরৎ বসুর সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হয়েছেন। লেখক বলেন শরৎবসু স্বপ্ন দেখেছিলেন এক স্বয়ংক্রিয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ঐক্যের। ব্যাখ্যা করে বলেন — তাতে ছিল সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ও সমাজতান্ত্রিক বিতরণ। ১৮৮ পৃষ্ঠায় বলা আছে শরৎ ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন না কিন্তু ১৯০ তে বলেন — শরৎ রামকৃষ্ণ ভক্ত, রামকৃষ্ণের দুটি আদর্শ অনুসরণে সচেষ্ট ছিলেন। তা হল — আত্মমুক্তি এবং ঈশ্বরের কার্যরূপে মানবকার্য করণ। শরৎ চেয়েছিলেন — মুখ্য শিল্পগুলির জাতীয়করণ, বিশেষত বিদেশী নিয়ন্ত্রিত শিল্পের (যা হয়নি), কমনওয়েলথ বিযুক্তি (হয়নি), মুক্ত শিক্ষা ( হয়নি) বরং শিক্ষা হয়েছে উত্তরোত্তর অর্থ সাপেক্ষ। ১৯৫০-এ নব সংবিধান সংশোধন, কারণ তা মিথ ও অস্বীকৃতি প্রণোদিত। চেয়েছিলেন ক্ষমতাক্ষুধিত নব শাসকদের নিয়ন্ত্রণ। স্বভাবতই তাঁর এই সব সদিচ্ছা শাসকরা পছন্দ করেনি। একসময় আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে নেহেরু নীতির তিনি সমালোচক। মাও সে তুঙের প্রতি আন্তরিক প্রশংসার কথা আছে। চেয়েছেন দুই দেশের সামীপ্য। আর চেয়েছেন এক Asian Federation সৃষ্টি করতে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রসঙ্গে তিনি জেনারেল আঙ সানের সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন। শরৎচন্দ্র ছিলেন খোলা মনের নেতা, বিতর্কিত প্রশ্নে চাইতেন বিচারবুদ্ধি সম্মত সমাধান।
৯ম পরিচ্ছেদ — উপসংহার। ইতিহাস পর্যালোচনায় লেখক বলেছেন ত্রিবিধ জাতীয়তাবাদের কথা। রামমোহন ও বঙ্কিমের ভূমিকার কথা একাধিক অধ্যায়ে আছে কিন্তু অনিবার্য যৌক্তিকতা কোথায় বুঝিনি। সহস্র বাঙালীর আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগের কথা আছে। সুভাষের ও শরতের ভূমিকা এক হয়েও কিছুটা ভিন্ন। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, বক্তৃতা ও লেখায়, যুক্তিবোধে অনেক স্বপ্নসম্ভবের আশা রেখেছেন। অন্যজন বক্তৃতা ছাড়াও মরণবিজয়ী সংগ্রামে সৈনিক (আক্ষরিক অর্থে) হয়েছেন। একজন লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে অবিনশ্বর, আর একজন তুলনায় কিছু শিক্ষিত সেকুলার মানুষের কাছেই প্রেরণা সঞ্চারী। পার্লামেন্ট ও কর্পোরেশনে বা রাজনৈতিক দলাদলিতে চিরকালই দলাদলি, পাশাখেলা, স্বার্থবুদ্ধির চাল চলতেই থাকে। প্রশাসনিক ইতিহাস তো মুখে প্রগতি কার্যে পাশার দান ফেলা, এ ব্যাপারে হিন্দু মুসলমান নেতারা আলাদা নন আর ধূর্ততা চালনায় ইংরাজের পারদর্শিতা আন্তর্জাতিক। শরৎ বসুর আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত কিন্তু ভারতবর্ষীয় নীচুতলার এবং মধ্যবিত্তের বড়ো অংশে তাঁকে বুঝবার ক্ষমতা ছিল না। সুভাষের সম্পর্কে জন্ম নিয়েছিল এক বিরল আবেগ। পার্লামেন্টীয় প্রয়াস যে পশুপ্রবৃত্তির খোঁয়াড় কথাটা অপ্রিয় কিন্তু সত্য। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির পত্তন হয়েছে বিশের দশক থেকে। সেখানে দলাদলি, ক্ষমতা-দ্বন্দ্ব, স্বার্থ একাল পর্যন্ত প্রসারিত। কম্যুনিস্ট পার্টি অবশ্য অজস্র শিবিরে বিভক্ত, কিন্তু সুভাষ ও শরতের অবদান সম্পর্কে তাদের মতামত, ব্যাখ্যা নিয়ে কিছু কথা এই পরিশ্রমী গবেষণায় থাকলে ভালো হত। বামপন্থী ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের ‘মর্ডান ইন্ডিয়া’তে সুভাষ সম্বন্ধে অতি সামান্য কথা থাকলেও শরৎ বসুর নামোল্লেখ নেই। ‘পরিচয়’ ১৯৯৬ তে শতবর্ষ স্মরণ সংখ্যা করেছিল। সেখানে দুটি প্রবন্ধ আছে (সুভাষচন্দ্র ও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন — গৌতম চট্টোপাধ্যায় এবং সুভাষচন্দ্র ও বামশক্তি: অকমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট — অমিতাভ চন্দ্র) সি. পি. এম বা অন্য কোনো বাম দলের এমন সংকলন বা গ্রন্থ আছে কিনা আমার জানা নেই। সি. পি. এম. বা অন্য বাম দল কিছু সংখ্যা করেছিল কি? পরিশ্রমী গবেষক বাম মূল্যায়ন বিষয়ে কিছু কথা রাখলে ভালো হত। Victoria University of Wellington এর প্রখ্যাত ইতিহাসকার শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন From Plassey to Partition : A History of Modern India. (২০০৪) সম্ভবত ইনি বামপন্থী নন। এঁর বহুপঠিত বইটিতে সুভাষের সম্পর্কে সামান্য কথা থাকলেও শরৎবাবুর নামোল্লেখ আছে মাত্র। Trinity College, Cambridge এর খ্যাতনামা অধ্যাপিকা জয়া চ্যাটার্জীর Bengal Divided বইতে অবশ্য বেশ কিছু কথা আছে। ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে শরৎচন্দ্র নিয়ে অধ্যাপক প্রভাস রায় যদি কিছু লেখেন তাহলে উদাসীনতার প্রতিকূলে কিছু করা হবে।
প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার এই বই। তাতে অধ্যাপক প্রভাস রায়ের Painstaking research এর পরিচয় আছে। এ হল এখনও পর্যন্ত পূর্নায়ত মূল্যায়ন যাতে আর্কাইভাল এভিডেন্স, গৌণ উপাদানসমূহের প্রয়োগ আছে, দুর্লভ পত্রিকা সমূহের ব্যবহার আছে, সাক্ষাৎকার প্রযুক্ত হয়েছে। তাঁর রচনার ভাষা অত্যন্ত সাবলীল এবং প্রাঞ্জল। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপায়কের সম্পর্কে বইটি আগ্রহী পাঠকের মধ্যে আগ্রহ সঞ্চার করুক এই কামনা করি।