নৈঃশব্দের নীচে (সনেট সংগ্রহ)—দত্তাত্রেয় দত্ত; প্রকাশকঃ যাপনচিত্র; প্রথম প্রকাশঃ ২০২০; পৃষ্ঠাঃ ৩২
একটিমাত্র ভাবকল্পনা এবং একটি ধ্রুপদী নিয়মকে অবলম্বন করে রূপায়িত কাব্যকৃতিকেই যদি সনেট হিসাবে আখ্যায়িত করতে হত, তাহলে সেই পেত্রার্কের সময় থেকে আজ পর্যন্ত এত অক্ষরশিল্পীকে এই ফর্ম আকৃষ্ট করতে পারত না। চৌদ্দমাত্রার চৌদ্দটি পঙ্ক্তিতে ভাব ও ভাবনাকে বেঁধে রাখাটা কতকটা এমন বাগানের মালী হওয়া যার একটিও ফুল যেন বেড়ার বাইরে ঢলে না পড়ে। একই সঙ্গে কবিকে এখানে কুশলী দাবাড়ুর মত চৌষট্টি খোপের প্রতিটির দিকে সমান নজর দিয়ে শব্দনির্মাণ করতে হয়। কিন্তু এই নির্মাণ যখন ভার্সের মাত্রা অতিক্রম করে পোয়েট্রিতে চলে যায় তখন পরিসীমা আর শব্দসংহতি পাঠকের কাছে গৌণ হয়ে যায় তা সে কবি চান বা না চান। সুখের কথা এই যে, বাংলা সনেটের ধারাটি প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কলম নিঃসৃত হয়ে। মোহিতলাল, অক্ষয়কুমার বড়াল, জীবনানন্দ হয়ে আল মাহমুদে পৌঁছে সে ধারা এত নিবিড়ভাবে লোকায়তকে, কৌম সমাজকে, গ্রামজ আচারকে এবং দেহকে ধারণ করেছে যে প্রথাগত গীতিকবিতার আদলে তাকে ভাবা পাঠক হিসাবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দত্তাত্রেয় দত্তর সনেট সংগ্রহ ‘নৈঃশব্দের নীচে’ এই ধারায় একটি শক্তিশালী সংযোজন, যদিও স্বীকার করতেই হবে তা আমাকে বেশ একটা অন্তর্বর্তী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। কোলরিজ বলেছিলেন সনেট হল এমন একটি অখণ্ড ভাবকল্পনার প্রকাশ where some lonely feeling is developed. দত্তাত্রেয়র কবিতায় যে ধ্রুপদী ভাবনার অনুরণন পাওয়া যায় তাতে কোলরিজের কথা যদি বেশি করে মনে পড়ে তাহলে সেটাকে পাঠকের সীমাবদ্ধতা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েই পাঠের মুগ্ধতাটুকু সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হল। এ কথা তো ঠিক যে সাহিত্যকে শেষ বিচারে নন্দনতত্ত্বের বিচারে উত্তীর্ণ হতে হয়, কিন্তু পাঠককে যা বেঁধে রাখে অথবা পেড়ে ফেলেই বলা যায় তা হল ওই মুগ্ধতা যার কোন ব্যাকরণ হয় বলে আমার মনে হয় না। এ এক অনির্দেশ্য অনুনাদ যা ততটা বৌদ্ধিক নয় যতটা হার্দিক। দত্তাত্রেয়র কবিতাগুলি যথার্থই একক কথন এবং তাঁর সনেটগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটিতে স্তবকবিভক্ত আবর্তন ও নিবর্তনের ভাবনা আছে, কিন্তু এগুলির চলন ততটাই ধ্রুপদী যতটা নাগরিক।
দত্তাত্রেয়র কবিতায় প্রেম ও অসহায়তা, বিচ্ছেদ ও মৃত্যুচেতনা হাত ধরাধরি করে চলে। ‘মন্বন্তর’ কবিতায় তিনি বলেনঃ
প্রেম, স্নেহ, সখ্যের মতো যত পরিধেয় শেষেমনে হল, বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় মন্ত্রোচ্চারণে আবাহন করা হল অনিত্যতার মধ্যে জাগরুক এক অনন্য সত্যকে। জীবনকে এমন এক তীর্থযাত্রার সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দিতে পারেন যেখানে যূথজীবন আসলে এক একক অভিযাত্রার নামান্তরঃ
একে একে খুলে দেবো; বিপন্ন ও পরিচিত মুখ... (মন্বন্তর )
সব মুছে গেছে। এরা বুকে বেঁধে শূন্যতার ধনকখনও সংশয়ই প্রেমের ভাষ্য হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। উপন্যাসের মত কবিতার ডিসকোর্সগুলির ব্যবহার, বিন্যাস, নির্মাণ কবির অবস্থান নিরপেক্ষ হওয়া যে সম্ভব নয়, সে কথা বাখতিন বহুদিন আগেই আমাদের বলে গিয়েছিলেন। কবিতায় কবি প্রত্যক্ষতঃ উপস্থিত এবং কবিতার ডিসকোর্সগুলির দ্বন্দ্ব থেকে কবির কথাই একস্বরী হয়ে প্রকাশিত হয়। সম্মতিতে, প্রত্যাশায়, প্রত্যাখ্যানে, মিলনে, বিচ্ছেদে এবং মৃত্যুতে এই দ্বন্দ্ব থেকে উৎসারিত যে গভীর স্বর শুনতে পাওয়া যার তাঁর কবিতায় তা’ই এই সংকলনের সারাৎসার।
স্মৃতিতীর্থে যাবে বলে কাঁধে কাঁধে ভর দিয়ে চলে;
জানে, তীর্থে বিচ্ছেদ বুকে বাজবে মৃত্যুর মতন
তাই এরা ইচ্ছে করে ধীরে চলে, চেনা পথ ভোলে...। (তীর্থযাত্রা)
শামুক কবিতা থেকে একটা স্তবক উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না-
সাধে কি তোমায় বলি ছোটো মেয়ে? শিশুরা, দেখো না-বালিকার খেলার অনুষঙ্গে যে কবিতার শুরু, সেই কবিতার অন্তিম শেষ দুটি লাইন এ’রকমঃ
ফড়িঙের ঠ্যাং ছিঁড়ে, ডানা ছিঁড়ে, নিষ্পাপ নয়নে
বিমুগ্ধ তাকিয়ে থাকে--বোঝবার চেষ্টা করে মনে
কেন এরা কষ্ট পায়, কিসে পায় কতটা যাতনা?
নিতান্ত শামুক সে যন্ত্রণাই তার রূপলোক।কাঙ্ক্ষিতের কাছ থেকে পাওয়া আশ্লেষ-পীড়ন যে সুখ ও সংরাগের জন্ম দেয়, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হবার যে বাসনা স্খলিত হতে হতে জাগরূক হয়ে ওঠে, তা কার্যত অসহায়তারই নামান্তর। যেন প্রত্যাখ্যান, ফিরে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া অথবা মৃত্যুতেই তার পূর্ণতা--এ ভাবনা দত্তাত্রেয়র অনেক কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। তাঁর সার্থকতা পাঠককে এই অনুভবের অংশীদার করতে পারায়। ‘নৈঃশব্দের নীচে’র মূলসুরটি এই ডিসকোর্সে বাঁধা, তবে, এখানে বলা থাক যে, তা এই সংগ্রহের একমাত্র সুর নয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থের ১৮১৫’র কবিতা Yarrow Visited শিরোনাম অপরিবর্তিত রেখে দত্তাত্রেয় যেন সমস্ত জীবনটাকে উল্টো দূরবীন দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন আমাদের। The genuine image Yarrow!/ Will dwell with me to heighten joy/ And cheer my mind in sorrow--ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই ইয়ারো-দর্শনকে দত্তাত্রেয় দাঁড় করিয়ে দেন যে প্রান্তরের সামনে তা এই রকমঃ
জানে না সে, ক্লান্ত হলে ছুঁড়ে তাকে পাথরে ফাটাবে... ( শামুক)
তাই সে দ্বিধায় পড়েঃ অদেখার প্রান্তর পেরিয়েভ্রামণিক জীবনের এই সব সঞ্চয়গুলি কবির একান্ত অবলোকন; তাতে পাঠককে সামিল করতে পারাটা সহজ কাজ নয়। ‘নৈঃশব্দের নীচে’ এই কারণেই বৃহত্তর পরিসরে পঠিত হওয়া দরকার, আলোচিত হওয়া দরকার। তবে শিরোনাম নিয়ে আমার খটকা থেকেই গেল, কেন না ওয়র্ডসওয়র্থের অনুষঙ্গ ছাড়াই কবিতাটি নিজের জোরে দাঁড়াতে পারছে যখন, তখন এই লেবেলিং-টার দরকার ছিল বলে মনে হয় না। আরো একটি কবিতা আছে ইংরেজি শিরোনামে--টিল ডেথ ডু আস পার্ট (এভাবে লিখলে কেমন হয় ভেবে দেখতে পারেন কবি!)--এটির শিরোনাম সম্পর্কে ইংরেজি কেন, সে প্রশ্ন তোলাই যাবে না--খুবই শক্তিশালী কবিতা এটি। বিবাহ আর বিবাহ-পরবর্তী জোয়ালে জুতে দেওয়া নারী জীবনের যন্ত্রণাকে প্রতিটি শব্দে যেমন ধরেছেন, তেমনই পুরুষের দখলদারিকে ঘৃণায়, উপহাসে, বিবমিষায় বিদ্ধ করে যেন পাঠককেই নিজের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করেছেন:
সে নিশ্চয় ব্যগ্র মুখে এসে গেছে ভুল ঠিকানাতে।
এ গৃহ, এ গৃহস্থালি, তার চোখে কল্পলোক হয়ে... (Yarrow Visited)
বলদ পড়েছে কম ত্রিভুবন ঘোষের গোয়ালে।একই ভাবে প্রচলিত ছড়ার আদলে বানভাসি, সব-হারানো মানুষের কোনক্রমে বেঁচে থাকা আর সামান্য প্রাপ্তি--এই নিয়ে তিনি লিখেছেন ইকিড়-মিকিড়।
চাকরেরা খুঁজে দেখে, সবকটা গিয়েছে পালিয়ে
তাই খুব বুদ্ধি করে মাঠে-ঘাটে সন্ধান চালিয়ে
সাতরঙা প্রজাপতি খুঁজে এনে জুতেছে জোয়ালে... ( Till death Do Us Part)
কবিতা ধরে ধরে আলোচনা করার অবকাশ নিতে চাই না। প্রধানত আঠারো মাত্রার এই সনেট সংকলনে যেমন ২৬ মাত্রার অন্ত্যমিল আছে তেমনই অক্ষরবৃত্তে নিবদ্ধ ছন্দও আছে। স্তবক বিন্যাসেও তিনি ৪+৪+৩+৩ বা ৪+৪+৪+২ বা ৪+৪+৬ লাইনের পরীক্ষাগুলি করেছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে। বলবার কথা এই যে, সফল সনেট সব সময়ই একজন কুশলী এবং স্বভাবকবির কাব্যকৃতি--যেমন-তেমন ভাবে ‘নামিয়ে দেওয়া’ যাকে বলে--যেভাবে আজকাল হাটে-বাজারে, সোশ্যাল মিডিয়ায়-ফেসবুকে কবিতার বান ডেকেছে, সেই ভিড়ে সনেট চোখে পড়ে কদাচিৎ। এই ভিড় থেকে আড়ালে থাকা কুশলী কবিকে সামান্য অক্ষরকর্মী হিসাবে কুর্নিশ জানাই। শেষ করি সেই কবিতাদুটির কথা বলে যে দুটির কাছে আমি বারবার ফিরে যেতে চাই। এর একটি হল প্রথম কবিতা--ঝিল। একটি অতি অপাংক্তেয় ঝিলের বর্ণনায় যে নির্মোহ প্রেক্ষণ তিনি আনতে পেরেছেন তা বাকি রচনাগুলির থেকে এটিকে স্বতন্ত্র করেছে।
সাগরবিমুখ ধারা সমতলে দাঁড়িয়ে নিশ্চল।অপর কবিতা ‘অস্বীকৃতি’। ...অন্দরেতে আনো,/অথচ দূরত্বে রাখো। মোহ গড়ে ভাঙো বারবার।” এমন উচ্চারণে একই সঙ্গে নিবিড়তা, অসহায়তা এবং হয়ত সাহচর্যের অন্তঃসারশূন্যতার মত বিপরীতমুখী অনুভূতিমালা কবিতায় বুনে দিতে পেরেছেন দত্তাত্রেয় দত্ত। তাঁর পরের সংগ্রহের অপেক্ষায় রইলাম।
তীরে তার বনভূমি, বুকে মহাকাশের দ্যোতনা,
গাছের পাতায় দিনে সূর্য, রাতে চন্দ্র দেয় হানা
চিত্রার্পিত সঙ্গীহীন মৌনী বক, সন্ধানে অটল।... (ঝিল)