জোজো যখন আমাদের বাড়িতে থাকতে এল তখন থেকেই আমার ওকে খুব ভালো লেগেছিল। অথচ আমি ওকে আগে কখনও দেখিনি। আমার থেকে বছর চারেকের ছোট সে। ছোটখাটো রোগাসোগা কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। জোজো আমার পিসির ছেলে। ওরা আমেরিকায় থাকত। একটা সাংঘাতিক মোটর দুর্ঘটনায় পিসি, পিসেমশাই আর ওর দাদা কোকো মারা যাওয়ার পর জোজো আমাদের বাড়িতে থাকতে এসেছে মাস ছয়েক হল। ওরা তিনজন গাড়ি করে কোকোর জন্যে কলেজ দেখতে যাচ্ছিলেন। জোজো যায়নি, সে স্কুলে ছিল। তারপর থেকেই নাকি খুব কম কথা বলে জোজো।
আমি সেটা মাকে বলতে মা আমাকে বললেন, “সেটা নিয়ে মন খারাপ কোরো না লয়। ও ভয়ঙ্কর একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে এসেছে। ওর স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।”
তা লাগুক, কিন্তু নয় নয় করে ছটা মাস তো কেটে গছে তাও আমাকে দাদা বলে ডাকা তো দূরের কথা আমার সঙ্গে ঠিক করে কথাও বলে না!
রাতে আমার ঘরেই অন্য একটা খাটে শোয় সে। প্রথম মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠত। কতবার আলো জ্বালিয়ে ওকে ঘুম থেকে তুলে সান্ত্বনা দিয়েছি। তখন সে এমন ভাবে আমার দিকে চেয়ে দেখেছে যেন ওর দুঃস্বপ্ন দেখার সব দোষ আমার!
ওকে বাংলা পড়াতে একজন স্যার আসেন কারণ অন্য সব বিষয়ে ও খুব ভালো কিন্তু জন্ম থেকে আমেরিকায় থাকার দরুণ বাংলা বলতে পারলেও লিখতে পড়তে একদমই পারত না। যদিও এই কদিনে অনেকটাই শিখে ফেলেছে। বাংলা স্যার না এলে আমি ওকে বাংলা পড়াই মাঝে মাঝে। পড়ে চুপচাপ কিন্তু কিছুই প্রায় বলে না। বুঝতে পারল কী না পারল, তাও না!
আমি মাকে বলি সেটা, মা বলেন, “আমি সব শুনছিলাম। তুমি ভালোই পড়িয়েছ। ও সব বুঝতে পেরেছে। ও তো আর বোকা নয়! ওকে একটু সামলে উঠতে দাও, ঠিক কথা বলবে।”
আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। স্কুলেও কারো সঙ্গে কথা বলে না জোজো। সবাই ওর ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গেছে আর ওকে অহংকারী, নিজেকে কী মনে করে এই সব বলে! আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে তাই ওই সব কানাঘুষো আমার কানেও আসে।
সেদিন যেমন লাঞ্চের সময় হঠাৎ ওদের ক্লাসের অর্ক আমার কাছে ছুটে এসে বলল, “লয়দা শিগগির চলো! তোমার ভাই পরেশদার খপ্পরে পড়েছে!”
আমি কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
অর্ক বলল, “আমি ঠিক জানি না, কিন্তু গণ্ডগোল হতে পারে! তাড়াতাড়ি চলো তুমি!”
পরেশ ছেলেটা একদন ভালো নয়, বখাটে টাইপের। ক্লাস নাইনে দুবার ফেল করেছে। তবে বিশাল বড়লোকের ছেলে বলে বেশ কিছু চেলা চামুণ্ডা সব সময় ওর সঙ্গে চিপকে থাকে।
আমি গিয়ে হাজির হলাম সেখানে। দেখি পরেশ জোজোর কলার চেপে ধরেছে। জোজোর মুখ লাল কিন্তু তাও মুখ দিয়ে কোন কথা বেরচ্ছে না!
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “কী হচ্ছে পরেশ! ছেড়ে দে ওকে!”
পরেশ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “কথা বলবে না তো বলবে না তারপর কী অ্যাক্সেন্ট মেরে কথা বলল!”
আমি বললাম, “ও তো আমেরিকা থেকে এসেছে, ওর কথা ওই রকমই, ও মোটেই অ্যাক্সেন্ট মারছে না, ওকে ছেড়ে দে!”
“আমাকে কিছুতেই দাদা বলবে না! এত বড়ো দুঃসাহস ওর!”
“ছেড়ে দে পরেশ, ওখানে দাদা বলার চল নেই। টিচারদেরও ওরা নাম ধরে ডাকত অনেক সময়!”
“সে ওখানে যা করত করত, এখন তো আর ওখানে নেই, এখানকার মতন থাকতে শিখতে হবে!”
“ঠিক আছে আমি বলে দেব, তোকে দাদা বলতে। এবার ছাড়বি নাকি স্যারকে ডাকব?”
পরেশ ওর কলার ছেড়ে দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল। অন্যরা যারা মজা দেখছিল তারাও আস্তে আস্তে সরে পড়ল।
আমি জোজোকে মাটি থেকে তুলে ওর প্যান্ট শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে বললাম, “কেন লাগতে যাস ওই সব বিশ্রী ছেলেদের সঙ্গে? দাদা বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”
জোজো আমার দিকে তাকাল, ওর দৃষ্টিতে রাজ্যের ঘৃণা ঝরে পড়ছে! একটাও কথা না বলে সে নিজের ক্লাসে চলে গেল। আমি আর কী করব আমিও বাধ্য হয়ে ক্লাসেই ফিরে গেলাম।
বাড়ি ফিরে মাকে বললাম ঘটনাটা, মা আবার বললেন, “থাক না লয়, জানোই তো ওর মনটা কত খারাপ! ওই ছেলেগুলো কেন যে সেটা ভুলে যায়। ওইটুকুনি বয়সে নিজের পরিবারকে হারিয়েছে বেচারা। ওর ওইটুকুনি মনে কতটা চাপ, কত দুঃখ ভেবে দেখো!”
আমি চুপ করে গেলাম। তারপর মাস খানেক পরে আমাদের কাজের লোক শর্মিলা মাসি এসে বলল, “জোজোকে নিয়ে নন্দদার দোকানের ওখানে কী সব গণ্ডগোল হচ্ছে গো! দাদা বউদি তো বাড়িতে নেই তুমি দেখবে একবার?”
আমি আঁতকে উঠলাম, “সেকি! কী হচ্ছে?”
“জানি না বাপু! আসার সময় ভিড় দেখলাম!” আমি দেখলাম এ তো মহা বিপদ! মা-বাবা বাড়িতে নেই, মামার বাড়ি গেছেন দিদাকে দেখতে। আমি যত দূর জানি জোজো স্কুলের প্রোজেক্টের জন্যে চার্ট পেপার কিনতে পাড়ার নন্দদার দোকানে গিয়েছিল। একদম কাছেই দোকান বলে একাই গিয়েছিল। আমি কোন রকমে গায়ে জামা চাপিয়ে, পায়ে জুতো গলিয়ে ছুট দিলাম।
গিয়ে দেখি ওখানে বেশ কিছু লোকের জটলা। পাড়ার মস্তান বাচ্চুদা রেগে চেঁচাচ্ছে আর জোজো নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমি দুয়েকজনকে সরিয়ে বাচ্চুদার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে বাচ্চুদা?”
সে আমার দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে জোজোকে দেখিয়ে বলল, “ওটা কে? তোর ভাই?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমার ভাই জোজো!”
“ওর এত দেমাক কীসের শুনি? আমি কথা বললাম কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছে না এত গুমর? কিসের এত অহংকার ওর?”
আমার মাথাটা এবার বোঁ করে ঘুরে গেল, আবার!
আমি কাকুতি মিনতি করে বললাম, “ছেড়ে দাও বাচ্চুদা! ও কারো সঙ্গেই কথা বলে না!”
“মিথ্যে কথা বলিস না! ও মোটেই বোবা নয়! নন্দর সঙ্গে কথা বলছিল আমি শুনেছি!”
“সে তো দরকারে বলছিল। আমার সঙ্গেও ও কথা বলে না, সত্যি বলছি!”
জোজোরও যেমন বুদ্ধি! ঠিক তক্ষুনি সে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিল বাচ্চুদাকে! ব্যস আর যাবে কোথায়! বাচ্চুদা প্রবল রেগে গিয়ে এক ঘুষি চালালো। আমি কোনরকমে ঝাঁপ দিয়ে জোজোর সামনে নিজেকে ছুঁড়ে দিলাম আর ঘুষিটা ধাঁ করে আমার বাঁ চোখে এসে লাগল। আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চোখে অন্ধকার দেখলাম। মাটিতে বসে পড়লাম ধপাস করে।
সবাই এবার ভয় পেয়ে বাচ্চুদাকে বোঝাতে লাগল, “বাচ্চু এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!” বলে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
আমি কোনমতে টলতে টলতে জোজোকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
আমার নিখুঁত ব্ল্যাক আইটা দেখে মাসি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি গরম জল চাপাতে গেল সেঁক দেবে বলে।
আমি সোফায় বসে চোখে হাত বোলাচ্ছি এমন সময় জোজো চার্ট পেপার নিয়ে হাজির, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব!
বলল, “হাফ করতে হবে!”
কাগজ ধরাধরি করে অর্ধেক হতে হঠাৎ বলল, “তোমাকে লয় বলে ডাকতে পারি?”
আমি প্রথমে চমকে উঠলাম, তারপর হেসে ফেললাম, আঘাতটা টন টন করে উঠল, বললাম, “কেন? দাদা বলতে অসুবিধা আছে বুঝি?”
অদ্ভুত একটা চাউনি দিয়ে আমার দিকে তাকাল জোজো তারপর আস্তে করে বলল, “দাদারা ছেড়ে চলে যায়। তুমি চলে যাবে না তো?”
আমার মাথায় বাজ পড়ল। ওই টুকুনি একটা ছেলে এত বড় পাহাড়প্রমাণ দুঃখ বুকে নিয়ে ঘুরছে। ওই বদমাইশগুলোকে ও কেন দাদা বলতে পারছে না বুঝতে পারলাম। ওর কাছে দাদা একজনই ছিল। তাই যেন থাকে সেই ভেবে আমি ওকে বললাম, “সে ঠিক আছে, লয় বলেই ডাক্। আমার সব সময়ই মনে হয় লয়দাটা কেমন যেন ‘ময়দা’-র মতন শোনায়!”
ও এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কি খুব লেগেছে?”
আমি বললাম, “না, না। তাছাড়া আমার অনেকদিনের শখ একটা ব্ল্যাক আই নিয়ে ঘোরার! কালকে ক্লাসের ছেলেদের যা সব গল্প দেব না!”
জোজো এবার মুচকি হেসে বলল, “বাংলার নতুন চ্যাপটারটা একটু পড়িয়ে দেবে? অনেক কিছুই বুঝতে পারছি না।”