"গল্পটা কেমন লাগলো বলো" — সৌজন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ।
"কেউ কেউ খুব খারাপ, আবার কেউ একজন ভালো লোক" — গম্ভীর ভাবে বলছিলো সৌজন্য।
"তা বেশ। কিন্তু গল্পটা?"— আবার ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সুধীন্দ্রনাথ।
"গল্পের কিছু কিছু ঘটনা খুব খারাপ। কিন্তু দু-একটা ঘটনা ভালো।" — গম্ভীর ভাবেই বললো সে।
"সমস্ত ঘটনার মধ্যে কিন্তু একজন আছেন — নেপথ্যে" — বললেন সুধীন্দ্রনাথ
'"নেপথ্যে' — মানে?" — জিজ্ঞেস করলো সৌজন্য।
“মানে তিনি সবকিছুতেই আছেন — সব ভালোতে সব মন্দতে — পিছন থেকে — অদৃশ্যের মতো — তিনি ওই ব্যাসদেব" — বলে শরীরটাকে ইজিচেয়ারে এলিয়ে দিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ।
সৌজন্য খুব বিজ্ঞের মতো বলেছিল — “হুম”।
"কিন্তু আমার এই গল্প বলার দক্ষিণাটা — এতক্ষণ ধরে বললাম” — ছদ্মগাম্ভীর্যে বললেন সুধীন্দ্রনাথ।
"হবে — কিছু দিন বাদে" — বেশ ভারিক্কি ভাবেই বললো সৌজন্য।
ঘটনার সূত্রপাত কিছুদিন আগেই। এবং সেটা সৌজন্যের নীহারস্যারকে নিয়ে। নীহারস্যার অর্থাৎ নীহারবিন্দু ঘোষ সৌজন্যকে আঁকা শেখাতে আসতেন। ‘আসতেন' — এই কারণে বলা যে উনি হঠাৎ করে আর আসছিলেন না। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। এরপর একদিন ভোরবেলায় পার্কে হাঁটতে যাওয়ার সময় সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল নীহারস্যারের।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "আরে নীহারস্যার যে! আপনাকে কিছুদিন ধরে দেখছি না কেন আমাদের বাড়িতে আসতে? শরীর-টরীর সব ঠিকঠাক তো?"
নীহারস্যার কোনো উত্তর না দিয়ে একটু ম্লান হাসলেন।
এই নীহারস্যার এক আশ্চর্য মানুষ। পুরো নাম নীহারবিন্দু ঘোষ। অত্যন্ত গুণী শিল্পী। আর্ট কলেজের ফার্স্ট হওয়া ছাত্র। সরকারি বৃত্তি নিয়ে ফরাসি দেশে কাজ শিখতে গেছিলেন। দেশে ফিরে কলাভবনে চাকরির সাথে বেশ কিছু মনে রাখার মতো চিত্র প্রদর্শনী করেছিলেন। কিন্ত কোনো দিনই প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না। তাছাড়া বড়োই খামখেয়ালি এবং অত্যন্ত অভিমানী মানুষ। তাই কলাভবন থেকে বিখ্যাত বহুজাতিক বিজ্ঞাপন কোম্পানির চাকরি কিছুই তাঁর বেশি দিন পোষায় নি।
সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে নীহারবিন্দুর পরিচয় হয়েছিল একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে। সুধীন্দ্রনাথ তাঁর আঁকা ভীষ্মের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তখনই তিনি নীহারবিন্দুকে তাঁর 'মহাভারতের কয়েকটি নিঃসঙ্গ চরিত্র' বইটির প্রচ্ছদ এঁকে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। নীহারবিন্দু একটি অসাধারণ প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন কোনো পারিশ্রমিক না নিয়েই। এরপর থেকেই তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটি সুন্দর সম্পর্ক। নীহারবিন্দু সৌজন্যের হাতের আঁকা দেখে নিজে থেকেই তাকে বাড়ি এসে আঁকা শেখাতে শুরু করেছিলেন। এই ধরণের ক্ষ্যাপা মানুষ হলেন নীহারবিন্দু ঘোষ অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের নীহারস্যার।
সুধীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন নীহারস্যারের আঁকা শেখানোর কি অনবদ্য পদ্ধতি। এক এক দিন এক একটা ছোটোখাটো জিনিস নিয়ে আসতেন তিনি পকেটে করে। কখনো দেশলাইয়ের বাক্স কখনো নস্যির ডিবে। সেটা টেবিলে বসিয়ে সৌজন্যকে বলতেন — 'যা দেখছো তাই আঁকো'। কখনো আবার সৌজন্যকে নিয়ে খাতা পেন্সিলের ব্যাগ ঘাড়ে করে বেরিয়ে পড়তেন বাড়ির বাইরে। কোনো পুরোনো বাড়ি কিংবা রাস্তাঘাট বা পার্কের গাছ স্টাডি করাতে।
নীহারবিন্দুর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে সুধীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন একটা গোলমাল হয়েছে কোথাও। নীহারবিন্দু সামনের রাধাচূড়া গাছটির দিকে তাকিয়ে বললেন — "দেখুন প্রোফেসর! ওই গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখুন।"
সুধীন্দ্রনাথ দেখলেন সদ্য সকালের আলোয় ঝলমল করছে ফুলে ভরা ওই গাছের মাথাটা।
"এটা দেখিয়ে কি আপনি আমায় কিছু বোঝাতে চাইছেন?" — জিজ্ঞেস করলেন সুধীন্দ্রনাথ।
নীহারবিন্দু বললেন — "এই গাছটা স্টাডি করানোর জন্য সৌজন্যকে আনতাম এখানে — বসাতাম ঠিক আপনি যে জায়গাটায় বসেছেন ঠিক ওই জায়গাটায়।"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "বাহ্।"
নীহারবিন্দু আস্তে করে বলে যেতে লাগলেন — "বিকেলবেলায় সৌজন্য স্কুল থেকে ফেরার পর ওকে নিয়ে আসতাম এখানে — পড়ন্ত আলোটাকে তো ভালোভাবে দেখতে হবে — সেটা কিভাবে গাছের পাতাগুলোয় ফুলগুলোয় পড়ে তার তো জানতে হবে — কিন্তু —" বলে নীহারবিন্দু একটু থামলেন।
সুধীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন — "কিন্তু আবার কি?"
নীহারবিন্দু ম্লান হেসে বললেন — " হ্যান্ডবুক অফ নেতার ড্রয়িং"
সুধীন্দ্রনাথ ভুরু কুঁচকে বললেন —"তার মানে?"
নীহারবিন্দু বললেন — "আমার পদ্ধতিটা ঠিক পছন্দ হোলো না সৌজন্যের। ওর স্কুলের আর্ট কম্পিটিশন আছে। তাই তাড়াতাড়ি শিখতে হবে ওকে — একটা রেডিমেড টেকনিক চাই ওর । তাই —"
"তাই এখন আর আসবেন না — যদি না —" বলতে বলতে থেমে গেলেন সুধীন্দ্রনাথ। তাঁর ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিলো কথাটি বলতে গিয়ে।
তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলেন — "আপনি সেই গাছ আঁকার গল্পটা জানেন তো? সম্ভবত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির। একজন ছাত্র একটা গাছ এঁকে তাকে দেখাতে এলে তিনি তাকে সারা দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ওই গাছটিকেই আলাদা আলাদা ভাবে এঁকে আনতে বলেন। ছাত্রটি অনেক কষ্ট করে তাই করল। তখন লিওনার্দো তাকে বললেন তারপর বছরের এক একটা ঋতুর জন্যে এক একটা আলাদা ছবি এঁকে দেখাতে। এইভাবে সারাবছর ধরে তাকে খাটিয়ে মেরে সবশেষে একটি গাছের ছোটো চারা এনে তার শিকড়টি দেখিয়ে লিওনার্দো বলেছিলেন — শিকড়টাকে দ্যাখো। গাছ ভর্তি ফুলফল কোত্থেকে আসে জানো — ওই শিকড়ের মধ্যে দিয়ে । এই শিকড়টাকে ভালো ভাবে দ্যাখো। নয়তো গাছ আঁকবে কি করে?"
নীহারবিন্দু সামান্য হাসলেন। সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "আরে আপনি তো সৌজন্যকে সেই রকমই কিছুই টাস্ক দেন নি।" বলেই প্রসঙ্গ বদল করে নীহারবিন্দুর হাতদুটো ধরে বললেন — “আমার পরের বইটার প্রচ্ছদটাও আপনি করছেন, অবশ্য যদি আগের বারের দক্ষিণাটা নেন।”
নীহারবিন্দু হেসে বললেন — “বেশ — তাই হবে”
সুধীন্দ্রনাথও হাসি মুখে বললেন — “তাহলে আসি”
বাড়ি ফেরার সময় সুধীন্দ্রনাথ ভাবছিলেন এতো বড় গুণী গুরুর মূল্য বুঝতে পারলো না তার নাতিটি। আর এখন থেকেই যদি হ্যান্ডবুকসের খপ্পরে পড়ে তো মার্কশীটের রেজাল্ট হয়তো হবে কিন্তু শিক্ষাটা হবে না।
বাড়ি ফিরে ইচ্ছে করেই সুধীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন তার নাতির পড়ার টেবিলটির সামনে। আর তখনই দেখতে পেলেন তাঁর এই ক্লাস এইটে পড়া নাতিটির টেবিলে বইয়ের স্তূপের মধ্যে 'হ্যান্ডবুক অফ নেচার পেন্টিং'। সুধীন্দ্রনাথ বইটি হাতে তুলে নিলেন। উল্টেপাল্টে দেখলেন। কিছু ছবি। আর তার কপি করার কিছু টেকনিক।
"এই বইটা তুমি কোত্থেকে পেলে পিকাইভাই” — জিজ্ঞেস করলেন সুধীন্দ্রনাথ। সৌজন্য একটু থতমত খেয়ে উত্তর দিল — 'রাহুল দিয়েছে'। তারপর যেন একটু কৈফিয়ৎ দেওয়ার মতো করে বললো — 'ওতে কিছু শর্টকাট ড্রয়িং টেকনিক শেখানো আছে — আমাদের ড্রয়িং কম্পিটিশনে খুব কাজে লাগবে'।
'শর্টকাট' — কথাটা সুধীন্দ্রনাথের কানে লাগল সঙ্গে সঙ্গে। উনি বললেন — 'হুম'। তারপর বললেন — "তোমায় অনেক দিন আগে একটা কবিতা শুনিয়েছিলাম 'এক যে ছিল গাছ' — মনে আছে?" সৌজন্য সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো — “হ্যাঁ! হ্যাঁ! পুরোটাই মনে আছে।" বলে দু হাত তুলে বলতে লাগলো —
এক যে ছিলো গাছ— বলেই জিভ কেটে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌজন্য। আর সুধীন্দ্রনাথ একেবারে থ। কারণ কবিতার পুরোটাই সৌজন্য এভাবে বলতে পারবে ভাবতেই পারেন নি সুধীন্দ্রনাথ।
সন্ধেয় হলেই দুহাত তুলে জুড়তো ভূতের নাচ
আবার হঠাৎ কখন
বনের মাথায় ঝিলিক দিয়ে মেঘ উঠতো যখন,
ভালুক হয়ে ঘাড় ফুলিয়ে করতো সে গরগর
বিষ্টি হলেই আসতো আবার কম্প দিয়ে জ্বর
এক পশলার শেষে
যখন চাঁদ উঠতো হেসে
কোথায় বা সেই ভালুক গেলো কোথায় বা সেই গাছ
মুকুট হয়ে ঝাঁক বেঁধেছে লক্ষ হীরার মাছ
ভোরবেলাকার আবছায়াতে কান্ড হোতো কী যে
ভেবে পাইনে নিজে
সকাল হোলো যেই
একটিও মাছ নেই
কেবল দেখি পড়ে আছে ঝিকিরমিকির আলোর
রূপালি এক ঝালর
সেই সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন যে সেই শৈশবের আলোটা যেন আবার ঝলমল করে উঠলো তার পিকাইভাইয়ের মুখে। সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "সত্যিই অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তোমার! যাইহোক শনিবার রাতে একবার আমার ঘরে এসো। ভুলো না যেন!"
শনিবার ঠিক নটার সময় সৌজন্য ঢুকলো তার দাদাইয়ের পড়ার ঘরটিতে। সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "বসো। একটা গল্প শোনো।"
সৌজন্য বললো — "মহাভারতের?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "অবশ্যই"। বলে এক টিপ মৌরী মুখে ফেলে বলতে শুরু করলেন — "কিছু দিন আগে তোমায় অষ্টাবক্র মুনির কথা আর সমঙ্গা নদীর কথা বলেছিলাম মনে আছে তো?"
সৌজন্য মাথা নেড়ে বললো — "হ্যাঁ হ্যাঁ — সব মনে আছে।"
সুধীন্দ্রনাথ বলতে থাকলেন — "ওই সমঙ্গা নদীর আরেক নাম হোলো মধুবিলা নদী।"
সৌজন্য বলে উঠলো — "মধুবিলা! কি দারুণ নাম!"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "হ্যাঁ পিকাইভাই — নদীনালাপর্বতের এরকম অনেক সুন্দর সুন্দর নাম আছে মহাভারতে — এই মধুবিলা নদীর পাশেই ছিলো কনখল পর্বত। আর এর কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মহাগঙ্গা, যার পাশেই ছিলো মহামুনি রৈভ্যের কুটির। সেখানে বাস করতেন ঋষি রৈভ্য, তাঁর দুই পুত্র পরাবসু ও অর্বাবসু। তাঁদের সাথেই থাকতেন ঋষি রৈভ্যের সখা ঋষি ভরদ্বাজ ও তাঁর একমাত্র পুত্র যবক্রীত। যবক্রীত লক্ষ্য করলেন যে ব্রাহ্মণেরা তাঁকে ও তাঁর পিতা ভরদ্বাজকে মোটেই সম্মান করেন না। কিন্তু ঋষি রৈভ্য ও তাঁর দুই পুত্রকে যথেষ্ট সম্মান করেন। কারণ তাঁরা উত্তম বেদজ্ঞ পণ্ডিত। তাই যবক্রীত এক কঠোর তপস্যায় বসলেন। দেবরাজ ইন্দ্র সেই তপস্যায় উদ্বিগ্ন হয়ে যবক্রীতের কাছে এসে তাঁর এই কঠোর তপস্যার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। যবক্রীত বললেন — “আমি ও আমার পিতা প্রকৃত বেদজ্ঞানী হতে চাই। কিন্তু কোনো গুরুর থেকে এই বিদ্যা লাভ করা বিরাট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমি কোনো গুরুর সাহায্য না নিয়ে শুধু তপস্যায় এই বিদ্যা লাভ করতে চাই।” ইন্দ্র যবক্রীতের কথা শুনে বললেন — “ছি! ছি! বেদজ্ঞান একটা গুরুমুখী বিদ্যা! আর তুমি সেটাকেই অস্বীকার করে ভিন্ন পথে বেদজ্ঞ হতে চাইছো! এই ভুল পথে আর এগিয়ো না তাহলে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে!"
— এই পর্যন্ত বলে সুধীন্দ্রনাথ সৌজন্যের চোখের দিকে একটু গভীরভাবে তাকিয়ে বললেন — "কি? বুঝতে পারছো তো পিকাইভাই আমার কথাগুলো?"
সৌজন্য যেন একটু অস্বস্তি পেলো সুধীন্দ্রনাথের শেষের কথাগুলোতে। সে কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো।
সুধীন্দ্রনাথ বলে যেতে লাগলেন — “যবক্রীত কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রের কথা না শুনে আগের মতোই তপস্যা করে যেতে লাগলেন। এইভাবে কেটে গেলো আরো কিছুকাল । হঠাৎ একদিন তপস্যা করার সময় যবক্রীত দেখলেন যে এক ক্ষীণজীবী ব্রাহ্মণ যবক্রীতের সামনে এসে মহাগঙ্গায় মুঠো করে এক নাগাড়ে বালি ফেলছেন। তাই দেখে যবক্রীত ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন — 'এ কি করছেন ব্রাহ্মণ?'
ব্রাহ্মণ উত্তর দিলেন — 'গঙ্গায় বাঁধ দিচ্ছি।'
সেই শুনে যবক্রীত বললেন — আপনি কি উন্মাদ? এই ভাবে আপনার এই অশক্ত শরীরপাত করছেন? আপনি আপনার জীবন দিয়েও এইভাবে গঙ্গায় বাঁধ দিতে পারবেন না'।
এই কথার পরেই যবক্রীত দেখলেন ওই ব্রাহ্মণের রূপ বদলে গেল। দেখা গেল তিনি স্বয়ং ইন্দ্র! তিনি বললেন — 'ঠিক এই কথাটাই তোমায় বোঝাতে চাইছিলাম। এইভাবে সারা জীবন তপস্যা করেও বেদজ্ঞানী হওয়া যায় না। অতএব এখনই এ কাজে নিরস্ত হও।'
যবক্রীত কিন্তু নিরস্ত হলেন না। তপস্যা করেই যেতে লাগলেন।”
সৌজন্য বেশ বিজ্ঞের মতো বলল — "যবক্রীতের ও তো খুব দম আছে বলতে হবে!"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "অবশ্যই। সেই জন্যেই তো ইন্দ্র বাধ্য হলেন — তাকে বর দিতে। যে বরে যবক্রীত ও তার পিতা ভরদ্বাজ বেদজ্ঞ হয়ে গেলেন।"
সৌজন্য বলল — "তাহলে তো শেষ অবধি ভরদ্বাজ মুনি আর তার ছেলে যবক্রীতের জয় হোলো"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — “শোনো তো পরের কথাগুলো। ভরদ্বাজ মুনি কিন্তু এ কথা জেনে তখনই হায় হায় করে উঠলেন।"
সঙ্গে সঙ্গে সৌজন্য বলে উঠল — "সে কি? কেন?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — ভরদ্বাজ ঋষি তাঁর পুত্র যবক্রীতকে বললেন — 'এই ভাবে অন্যপথে বেদজ্ঞ হলে বিরাট বিপদ হবে। কারণ এইভাবে বেদজ্ঞানী হলে এত সহজে পাওয়া জ্ঞানের জন্য তোমার মিথ্যা অহংকার আসবে — আর সেই অহঙ্কার তোমায় নিয়ে যাবে অধর্মের পথে — মনে রেখো ঋষিরাজ রৈভ্য কিন্তু ভীষণ রাগী মানুষ — তিনি এসব সহ্য করবেন না।" যবক্রীত বললেন — ‘এসব কিছুই ঘটবে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন।' যবক্রীত কিন্তু যা বললেন কাজের বেলায় করলেন তার ঠিক বিপরীত। শুরু হোলো ঋষি রৈভ্যের আশ্রমে যবক্রীতের অত্যাচার অনাচার। এবং এটি মাত্রা ছাড়ালো যখন দেখা গেল যবক্রীত রৈভ্যের পুত্র পরাবসুর স্ত্রীকে গিয়ে বললেন — 'এবার থেকে পরাবসুর বদলে আমার ভজনা করবে।' সেকথা জানতে পেরে মহর্ষি রৈভ্য প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে আগুন থেকে সৃষ্টি করলেন এক অসামান্য রূপবতী নারী ও এক ভয়ঙ্কর রাক্ষস। সেই রূপবতী যবক্রীতকে ভুলিয়ে তাঁর কমন্ডলুটি হরণ করতেই ওই রাক্ষস তাঁকে তাঁর ভয়ঙ্কর শূলের আঘাতে হত্যা করলেন।"
সৌজন্য বললো — "এখানেই শেষ তো গল্পটার?"
সুধীন্দ্রনাথ সৌজন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত কিন্তু শীতল কন্ঠে বললেন — "তোমার কি খুব তাড়া আছে পিকাইভাই?"
সৌজন্য একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বললো — "না না — তা নয় — ভাবছি এরপর আর তো কিছুই রইল না গল্পটায়।"
সুধীন্দ্রনাথ একই ভাবে সৌজন্যের দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে করে বলতে লাগলেন — "তুমি যদি মনে করো এইখানেই গল্পটা শেষ তাহলে তাই — আর তুমি যদি চাও এরপরেও কিছু শুনতে তাহলে সেটিও হতে পারে — আসলে মহাভারতের গল্প তো মুখে বলা — এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হোলো শ্রোতার ইচ্ছেতেই কথক গল্পের শুরু করে আর শ্রোতার আগ্রহেই সে ওই গল্পের জাল বাড়িয়ে যায়। তাই যে শুনছে তার ইচ্ছে না থাকলে গল্প তো আর এগোবে না পিকাইভাই। এটাইতো মহাভারতের গল্পের আসল শর্ত।"
এই কথাগুলো শুনে সৌজন্য বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। থতমত খেয়ে বললো — "না না — তুমি বলো — বলো —"
সুধীন্দ্রনাথ আবার বলতে শুরু করলেন — পুত্রের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভরদ্বাজ পুত্রশোকে বিলাপ করতে করতে বললেন — 'আমার পুত্র অন্যায় করেছিল নিশ্চয়ই — কিন্তু এইজন্য তাকে রৈভ্য এভাবে হত্যা করলো? ও নির্বোধ ছিল বলে গুরুর কাছে বেদ অধ্যয়ন না করে তপস্যায় বেদজ্ঞ হতে চেয়েছিল — তাহলে দেবরাজ ইন্দ্র ওকে সেই বর দিলেন কেন যা তার এতো বড়ো সর্বনাশ করলো? এখন এই পুত্রহীন জীবনের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে — তাই এখনই অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেবো আমি — কিন্তু রৈভ্যকেও এর মূল্য দিতে হবে — আমি যদি সৎপথে থেকে থাকি তো ওর সন্তানই ওকে হত্যা করবে —"
সৌজন্য চোখ বড়ো বড়ো করে শুনেছিল সুধীন্দ্রনাথের কথাগুলো। সে বলে উঠল — "তাই হোলো?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "নিশ্চয়ই।" তারপর একটু থেমে বললেন — "এবার একটা জিনিষ লক্ষ্য করো ভালো করে — একটা অন্যায় কিভাবে আরেকটা অন্যায়কে ঘাড়ে করে নিয়ে আসে — এরপর তার থেকে ফের আরেকটা — এইভাবে অন্যায়ের জাল তৈরি হয়ে যায় — তখন সেই জালের মধ্যে আটকে যায় অনেকেই — তাদের ইচ্ছে থাকলেও আর কিছুতেই সেই জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না — অদৃশ্যের পুতুল হয়ে দুলতে থাকে — এটাও মহাভারতের একটা বিশেষত্ব।"
সৌজন্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দাদাইয়ের মুখের দিকে। সুধীন্দ্রনাথ একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন — "এইসময়ে এক বিখ্যাত রাজা বৃহৎদ্যুম্ন এক বিশাল যজ্ঞ করছিলেন। সেখানে সেই যজ্ঞে সাহায্যের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ঋষি রৈভ্যের দুই পুত্র — পরাবসু ও অর্বাবসু। পরাবসু যখন বাড়ি ফিরে আসছেন — ভোররাতে — গভীর বনের মধ্যে — আধো অন্ধকারে — কৃষ্ণজিনপরা তাঁর পিতাকে দেখে ভুল করে —"
ঠিক এইসময়ে সৌজন্য বলে উঠল — "কৃষ্ণজিন মানে?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "ও হ্যাঁ — এটা তো তোমার জানার কথা নয় — তখনকার দিনে মুনিঋষিরা হরিণের চামড়া পরতেন কাপড়ের মতো করে — সে যাই হোক — পরাবসু তো ওই আবছায়াতে তার পিতা রৈভ্যকে প্রকাণ্ড একটা হরিণ ভেবে ঘাবড়ে গিয়ে তির চালালেন এবং সেই তির বিদ্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারালেন ঋষি রৈভ্য।"
"ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো — এরকম কি সম্ভব?" — বলল সৌজন্য।
"হ্যাঁ পিকাইভাই — খুব অদ্ভুত ব্যাপার। কিন্তু কি করে সম্ভব হয় জানো? যখন একটা ইভল স্পিরিট মানে অশুভ শক্তি এসে বসে কারুর উপর তখন তার মাধ্যমে অনেক অন্যায় অনাচার হতে পারে। কিন্তু এই অশুভ শক্তিকে ডেকে আনে কোনো মানুষই। তাতে সে অন্যকে মেরে নিজেও মরে। ওই অশুভ শক্তিটা কিন্তু সহজে মরে না। সে তখন দ্যাখে কার ঘাড়ের উপর এবার চড়াও হওয়া যায়। এই গল্পে ওই অশুভ শক্তিটা কে এনেছিল বলো তো? ওই যবক্রীত।
সৌজন্য একটু চুপ করে থেকে বলল — "ঠিক ঠিক।"
সুধীন্দ্রনাথ বলতে থাকলেন — "ভরদ্বাজ মুনির মৃত্যুর সময় দেওয়া অভিশাপ সত্য হল। কারণ কি জানো? একটা ইভল স্পিরিট অর্থাৎ একটা অশুভ শক্তি কিন্তু এসে বসেছে পরাবসুর উপর। তাই এরপর যা ঘটল তা আরো ভয়ানক।"
একটু থেমে সুধীন্দ্রনাথ আবার বলতে লাগলেন — পরাবসু তার ছোট ভাই অর্বাবসুর কাছে গিয়ে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি বললেন। এবং এও বললেন যে তিনি এই ভয়ঙ্কর পাপ কাজের প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছেন। ফিরে এসে তিনি আবার বৃহৎদ্যুম্নের যজ্ঞে উপস্থিত হবেন। অর্বাবসু যজ্ঞে ফিরে গেলেন। এবার পরাবসু কিছুকাল বাদে সেই যজ্ঞস্থলে এসে বৃহৎদ্যুম্নকে বললেন — 'রাজা! এই অর্বাবসু পিতৃহত্যাকারী পিশাচ! পিতাকে হত্যা করে এখানে যজ্ঞের কাজে চলে এসেছে। আর আমি পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পূর্ণ করে এখন আপনার যজ্ঞে এলাম। এই নরাধমকে দিয়ে যজ্ঞের কাজ করালে কোনো মঙ্গল হবে না।'"
"যা ব্বাবা — এ তো পুরো উল্টো কথা" — বলল সৌজন্য।
"অবশ্যই" — বললেন সুধীন্দ্রনাথ। "কারণ ওই যে তোমায় বললাম না — অশুভ শক্তি — সেই অশুভ শক্তি তো ভর করেছে তখন পরাবসুর ঘাড়ে। তাই এই কাজ। অর্বাবসু এর যত প্রতিবাদই করুন না কেন কিছুই লাভ হল না। রাজা বৃহৎদ্যুম্ন পরাবসুর কথাই বিশ্বাস করলেন। আর অর্বাবসুকে তাড়িয়ে দিলেন।" — বললেন সুধীন্দ্রনাথ।
"এত বড়ো অন্যায় কাজটা হল?" — চোখ বড়ো করে জিজ্ঞেস করল সৌজন্য।
"হবেই তো। কারণ লক্ষ্য করে দ্যাখো ওই অশুভ শক্তিটা, যাকে নিয়ে এল সেই যবক্রীত — অনুচিত পথে বেদজ্ঞানী হয়ে রৈভ্যের পবিত্র আশ্রয়ে শুরু করল অনাচার — সেইখান থেকেই অশুভ শক্তির রাজত্ব শুরু। এর পর রৈভ্যের আক্রোশে যবক্রীতের মৃত্যু — যবক্রীতের মত্যুতে তার পিতা ভরদ্বাজের অভিশাপ আর আত্মহত্যা — এরপর ভরদ্বাজের অভিশাপে নিজের পুত্র পরাবসুর হাতে রৈভ্যের হত্যাকাণ্ড — পরপর করে সব ঘটে গেল ওই অশুভ শক্তির চালনায়।"
"তাহলে এরকম চলতেই থাকল?" — বেশ উৎকণ্ঠার সঙ্গেই জিজ্ঞেস করল সৌজন্য।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "শোনো বাকিটা। অর্বাবসু এই ভাবে চরম অপমানিত হয়ে চলে গেলেন নির্বাসনে — গভীর অরণ্যে । আর সেখানেই শুরু হল তার কঠোর সূর্যতপস্যা। দীর্ঘ তপস্যার পর সূর্যদেব স্বয়ং এলেন অর্বাবসুর সঙ্গে দেখা করতে। জিজ্ঞাসা করলেন যে অর্বাবসু কি বর চান। অর্বাবসু বললেন তিনি এই বর চান যাতে তার পিতা রৈভ্য, ঋষি ভরদ্বাজ এবং তাঁর পুত্র যবক্রীত পুনর্জীবন লাভ করেন। সূর্যদেব বললেন — 'তাই হবে। আর কিছু চাইবার আছে তোমার?' অর্বাবসু বললেন — 'পরাবসুর যেন আত্মসচেতনতা ফিরে আসে — সে যেন পাপের পথে ত্যাগ করে।' সূর্যদেব বললেন — 'তথাস্তু'।"
সৌজন্য চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল — “তাই হোলো?”
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "অবশ্যই। সবাই পুনর্জীবিত হয়ে আশ্রমে ফিরে গেলেন। পরাবসু ভুলে গেলেন তাঁর সমস্ত পুরোনো পাপাচার। রৈভ্য ভুলে গেলেন তাঁর হত্যাকাণ্ড। ভরদ্বাজ ভুলে গেলেন তাঁর অভিশাপের কথা। আর যবক্রীত, তিনিও স্মরণ করতে পারলেন না যে কি কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। দেবতারা শুধু বললেন যে যবক্রীত গুরুমুখীবিদ্যাকে অস্বীকার করে অন্যপথে বেদজ্ঞ হতে চেয়েছিলেন। আর সেইখান থেকেই শুরু সমস্ত বিপত্তির।" এইবার শরীরটাকে ইজিচেয়ারে এলিয়ে দিয়ে আবার এক টিপ মৌরী মুখে ফেলে সুধীন্দ্রনাথ বললেন — কি বুঝলেন পিকাইবাবু?"
"গুরুমুখীবিদ্যা মানে?" — জিজ্ঞেস করল সৌজন্য অর্থাৎ সুধীন্দ্রনাথের পিকাইভাই।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "যে বিদ্যা কেবল গুরুর মুখ থেকেই শুনে শেখা যায়। অর্থাৎ বেদ। কিন্তু এর একটা আরো বড়ো অর্থ আছে। যে বিদ্যা কেবল গুরুর সাহায্যেই হবে নয়তো হবেই না যেমন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নৃত্য বা আঁকা। এগুলোও গুরুমুখীবিদ্যা।"
সুধীন্দ্রনাথের কথাটা শেষ হলে সৌজন্য বলল — "বুঝলাম"। তারপর একটু থেমে বলে উঠল — "কিন্তু ব্যাপারটা একেবারে অবাস্তব। এইভাবে কাউকে মেরে ফেলে আবার বাঁচিয়ে তোলা যায় নাকি?"
সুধীন্দ্রনাথ সৌজন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন — "দুটো খুব জোরালো কথা বলেছো পিকাইভাই। একটা — 'মেরে ফেলা' আরেকটা 'অবাস্তব'। মেরে ফেলা কথাটার মানে কি মনে হয় তোমার — ফাঁসিতে ঝোলানো? গুলি করে মারা? গাড়ির তলায় পিশে মারা? না পিকাইভাই। মহাভারতে অনেক সময়েই মেরে ফেলা মানে হল তোমার সত্তাটাকে ধ্বংস করা। তোমার নিজের ভিতরটা, বিশেষ করে ভিতরের অশুভ আত্মাটাকে শেষ করে দেওয়াটাই মহাভারতে বহুক্ষেত্রে হত্যা বলে মনে ধরা হয়। আর এরপর যখন তার শুভবোধ ফিরে আসে সেটাই তার পুনর্জীবন। কি? এবার বুঝতে পারলে তো?"
সৌজন্য কোনো কথা না বলে আস্তে করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো।
সুধীন্দ্রনাথ আবার বলতে শুরু করলেন — "আর অবাস্তব?" বলে একটু হেসে সৌজন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন — "তোমার ওই ড্রয়িং খাতাটা আনো দেখি। যেখানে তুমি ওই নেচার স্টাডির বই থেকে আঁকা প্র্যাকটিস করছিলে।" সৌজন্য একটু অবাক হয়েই তার পড়ার টেবিল থেকে নিয়ে এল সেই ঢাউস আঁকার খাতাটা। খাতাটা নিয়ে সুধীন্দ্রনাথ কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে একটি ড্রয়িং বের করে সৌজন্যের মুখের দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন — "আমি যদি বলি তোমার এই আঁকাটা অবাস্তব?"
সৌজন্য সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল — "তা কি করে হবে? এটা তো আমার নিজের আঁকা।"
সুধীন্দ্রনাথ একইভাবে সৌজন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন — "এই যে ছবিটা এঁকেছো — এই যে বিরাট একটা গাছ — তার বিশাল বিশাল পাতা — আর এমন ফুলের থোকা — তুমি এ গাছ দেখেছো কখনো নিজের চোখে?"
সৌজন্য একটু থতমত খেয়ে বলল — "না"।
সুধীন্দ্রনাথ এবার খুব আস্তে করে বললেন — "তাহলে কি করে এটা বাস্তব হয়?"
সৌজন্য একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল — "নাহ। কিন্তু ওই বইটাতে তো আঁকা আছে।"
সুধীন্দ্রনাথ এবার একটু হেসে বললেন — "ঠিক বলেছো। ওই বইটাতে আছে। তাই মেনে নিচ্ছ। এমন গাছ। তার এমন পাতা। এমন ফুলের থোকা। আর এমনভাবে রোদ পড়ে ঠিক এমনই আলোছায়া তৈরি করছে। তুমি কি মিলিয়ে দেখতে গেছো সত্যিই এমনটা হয় কিনা?"
সৌজন্য আবার চুপ করে থেকে বলল — "হুম"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "কয়েকদিন আগে তোমায় সেই ছোট্টবেলায় শেখানো 'এক ছিল গাছ' পদ্যটার কথা বলছিলাম মনে আছে? বলেছিলাম কবিতার মানেটা ঠিক সময় তোমায় বুঝিয়ে দেবো। এবার ভাবো তো কোনো গাছ কি কখনো দুহাত তুলে নাচতে পারে? রাতের বেলায় ভালুকের মতো দেখতে হতে পারে? বৃষ্টি হলে চাঁদের আলোয় সেখানে অসংখ্য হীরের মাছ থাকতে পারে? এগুলো কি বাস্তব পিকাইভাই?"
পিকাই অর্থাৎ সৌজন্য এবার খুব বিজ্ঞের মতো বলল — "নাহ। এগুলো কবির কল্পনা।"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "ঠিক বলেছো। কবির কল্পনা। যার ভিতর দিয়ে তুমি গাছটাকে দেখতে পাও নানাভাবে। কারণ গাছটা যেমন সত্যি। তেমন ওই গাছের উপর এসে পড়া অন্ধকার, বৃষ্টির ফোঁটা সেগুলোও সত্যি। তোমাকে ভালোভাবে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে কবির এই কল্পনা। একে তুমি অবাস্তব বলবে?"
সৌজন্য এবার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "ঠিক এমনটাই করেছেন কবি বেদব্যাস। তোমার ওই বাস্তব আর অবাস্তব মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন। যাতে আমরা ওই বাস্তবটাকে একেবারে ভিতর থেকে দেখতে পাই। এই ব্যাপারটা এখনকার সাহিত্যেও উঠে আসছে। এর নাম জাদুবাস্তব। সে তুমি আরো বড়ো হয়ে জানবে নিশ্চয়ই। এখন শুতে যাও। কত রাত হয়ে গেল আজ তোমার শুতে শুতে।" বলতে না বলতেই ঢঙ ঢঙ করে এগারোটা বাজল ঘরের প্রকাণ্ড দেওয়াল ঘড়িটায়।
"কিন্তু গল্পটা কেমন বললে না তো তুমি" — সৌজন্য উঠে যাওয়ার সময় বললেন সুধীন্দ্রনাথ।
সৌজন্যের কথায় সুধীন্দ্রনাথ বুঝলেন যে তার গল্পটা বিশেষ পছন্দ হয়নি। এরকমটা হতে পারে তিনি আন্দাজ করেছিলেন। এবার ইচ্ছে করেই সুধীন্দ্রনাথ ছদ্মগাম্ভীর্যে বললেন — "তা এর দক্ষিণাটা — এতক্ষণ ধরে যে বললাম।"
"হবে — কিছু দিন বাদে" — বেশ ভারিক্কিভাবে কথাগুলো বলে খাতাপত্র গুটিয়ে চলে গেল সৌজন্য। শুতে যাওয়ার সময় 'গুরুমুখীবিদ্যা' কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। আর ঘুমের মধ্যে তার চোখে ভেসে এলো যবক্রীতের কাল্পনিক মুখটা।
এর কিছুদিন বাদে সৌজন্য এসে হাজির তার দাদাইয়ের ঘরে। সঙ্গে সেই ঢাউস আঁকার খাতাটা। তার থেকে একটা পাতা বের করে সে খাতাটা তার দাদাইয়ের চোখের সামনে মেলে ধরল।
এবার তার দাদাই অর্থাৎ সুধীন্দ্রনাথ সেই পাতায় আঁকা ছবি দেখে হতবাক! একটা গাছের ছবি। রঙিন পেন্সিলে আঁকা। রীতিমত চমকে যাওয়ার মতো ডিটেলস। আর তেমনই পেন্সিলের টান। সুধীন্দ্রনাথ অবশ্যই চিনতে পারলেন গাছটাকে। এটি সেই পার্কের গাছটা। সুধীন্দ্রনাথের মুখে কোনো কথা নেই। শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন ওই ছবিটার দিকে। তারপর অবাক হয়ে তাকালেন সৌজন্যের মুখের দিকে।
সৌজন্য একগাল হেসে বলল — "এটা তোমার — দক্ষিণা"। তারপর ফিসফিস করে বলল — "বারো দিন লাগল। ঠিক বারো দিন।"
সুধীন্দ্রনাথ যেন সদ্যকৈশোরে পড়া সৌজন্যের মুখে বেশ তার ছোট্টবেলার মুখের আদলটা আবার দেখতে পেলেন।
সৌজন্য আবার একই রকম ফিসফিসিয়ে বলল — "মা ছাড়া কেউ জানেনা। স্কুল থেকে ফেরার পথে রোজ একটু একটু করে এঁকেছি। মাকেও দেখাই নি। তুমিই ফার্স্ট।"
সুধীন্দ্রনাথ মুহূর্তের জন্য যেন বিহ্বল হয়ে গেলেন। তার মনে পড়ল নীহারবিন্দুর মুখটা। তখনই তিনি বললেন — সৌজন্যের কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে করে বললেন — "এটা এবার অবশ্যই কাকে দেখানো উচিত বলো তো?"
সৌজন্য একটু চুপ করে থেকে তার দাদাইয়ের চোখের দিকে তাকালো। তারপর খুব আস্তে করে বললো — "নীহারস্যার।" কথাটা শুনে সুধীন্দ্রনাথের মুখটা যেন ঝলমল করে উঠল। ওই ছবিটার উপর হাত বোলাতে বোলাতে তিনি বললেন — "কারেক্ট! এই ছবিটার প্রত্যেকটা পেন্সিলের আঁচড়ে তিনি আছেন।"
সুধীন্দ্রনাথের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌজন্য বিজ্ঞের মতো বলে উঠল —" নেপথ্যে"।
এবার সুধীন্দ্রনাথ তাঁর দুহাতের তেলোয় তুলে ধরলেন তার আদরের পিকাইভাইয়ের মুখটা। একটা আশ্চর্য ভালো লাগা থির থির করে কাঁপতে লাগলো সৌজন্যের মুখে। সে বুঝতে পারলো কে আছে তার এই ভালো লাগার নেপথ্যে।