• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • ভূমিপুত্র : রূপসা দাশগুপ্ত



    || ১ ||

    ধূসর পিচরাস্তা চলে গেছে ন্যাশনাল পার্কের বুক চিরে, অল্পস্বল্প গাড়ির চলাচল শেষ বিকেলে। জানালার কাচ নামিয়ে কুমির দেখার আশায় উৎসুক ট্যুরিস্ট চোখ সদা চঞ্চল, হই হই করে উঠছে এক দুটো কুমিরের দর্শন পেলে। রাস্তার ধার বরাবর বয়ে চলা সরু খালে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে তারা, আপাত নিরীহ, নির্লিপ্ত ভাব।

    রাস্তার দুপাশে নানা ধরনের দোকান ঘর, তবে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে, ঘিঞ্জি বাজার এলাকার মত নয়। খাবারের দোকানই বেশি, এছাড়া আছে বাইসাইকেল, হ্যামক, ছাতা চেয়ার, কায়াক ইত্যাদি নানা সামগ্রী ভাড়া দেওয়ার দোকান। কিছু আবার আছে ট্রাইবাল আর্ট শপ। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এ অঞ্চলে দোকানের মালিকানা এখন কেবলমাত্র নেটিভ আমেরিকান আদিবাসীদের, মানুষ আজও ভুলবশত যাদের ইন্ডিয়ান বলে থাকে।

    এমনই মাঝারি আকারের একটি আর্টশপে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ, সাদা দীর্ঘ চুল মাথার দুপাশে লম্বা বেণীতে আবদ্ধ, লালচে বাদামী ত্বক বলি রেখাঙ্কিত। ঘাসের বোনা ঝুড়ি, মাটি ও পাথরের নানা আকৃতির পট, তীর ধনুক, চামড়ার ওয়াল হ্যাংগিং ইত্যাদি নানা পণ্যে ঠাসা সেই দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছে বছর দশেকের একটি বাচ্চা। সে দরজার বাইরে একবার বেরিয়ে দেখে এল সূর্যরশ্মি ওক গাছের মাথা ছুঁয়েছে কিনা। তারপর ফিরে এসে বলল—ঠাকুরদা আজ আর কাস্টমার আসবে না। দোকান বন্ধ করো, অন্ধকার হবার আগে ঘরে ফিরতে হবে মা বলে দিয়েছে।

    || ২ ||

    প্রাচীন সাইপ্রাস গাছের সারির মাঝে ছায়াময় পথে দাদু নাতি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে। দাদুর একহাতে শক্তপোক্ত একটা লাঠি অন্য হাতে নাতির আঙ্গুল ধরা।

    ছোট কোচিসে বলে উঠল--সেই যে রাজকন্যা ওলী তার গল্পটা বলো।

    --কোন রাজকন্যা?

    --ওই যে তুমি বলছিলে না পোকাহন্টাস-এর গল্পটা যার গল্প থেকে বানানো। পোকাহন্টাস আমি জানি, স্কুলে পড়েছি, ডিসনি মুভিও দেখেছি।

    দাদু একটু রুষ্ট স্বরে বলে,

    --পোকাহান্টাস সাদাদের কারসাজির গল্প, নিজেদের পাপ ধুয়ে পিঠ চাপড়ানোর গল্প, অসভ্য নেটিভদের সভ্য করে তোলার মিথ্যে ইউরোপীয় অজুহাত।

    কোচিসে ভয় পেয়ে যায়, বোঝে দাদু রেগে গিয়েছে, কিন্তু কথাগুলোর মানে বোঝে না। বলে-- --ওলী তো ফ্লোরিডার নেটিভ রাজকন্যার গল্প, তুমি বলছিলে পরশু বেড টাইম স্টোরি, মনে নেই?

    দাদু শুরু করে-- তিন চার শ’ বছরের পুরোনো মিথ এসব, নামধাম ঠিক থাকে না, মুখে মুখে ঘোরে, কত বদলে যায়। তা তোমার ওই ‘ওলী’ নামের গল্পটা বলি।

    অনেক অনেকদিন আগে যখন ইউরোপীয়দের জাহাজ সবে আমাদের সমুদ্রে আনাগোনা শুরু করেছে তখন এক বীরযোদ্ধা কন্যা ছিল, আমাদের পুরোনো মিথ বলে সে ছিল সুন্দরী ঝরনার মতো।

    --তাই তো বড়ো শহরে ওর নামে ঝরনাটার নাম হল, এই এত্তো বিরাট একটা মূর্তি বসল, আমি মা বাবা আর ভাই দেখতে গেছিলাম তো, প্রিন্সেস ওলী। জানায় কোচিসে।

    --এটা ওটা জুড়ে গপ্পো বানিয়ে নিতে জানে বটে এরা, আবার রাজকন্যাও বানিয়েছে। আমাদের গোষ্ঠীতে রাজা কেউ থাকে না, তুমি জা্নো। হ্যাঁ দলপতি থাকে, বীর যোদ্ধাদের সম্মান ও ক্ষমতা থাকে দলপতির সমা্ন। তা সে যাই হোক, সেই মেয়েটি ছিল গোষ্ঠীপতির মেয়ে। সে কোনো ইউরোপীয়কে ভালবেসে বিয়ে করেনি পোকাহন্টাসের মত, ক্রিস্টান ও সভ্য হয়ে প্রেমিকের সাথে লন্ডনও পাড়ি দেয়নি। তার বদলে সে প্রাণভিক্ষা দিয়েছিল এক হারিয়ে যাওয়া স্পেন দেশীয় মানুষকে।

    দাদু একটু ভাবে, কোচিসে বলে--তারপর?

    --সেই ছেলেটি ছিল এক জলদস্যু জাহাজের নাবিক বা কর্মচারী, কোনো কারণে জাহাজ ছেড়ে মাটিতে নেমেছিল। তারপর নেটিভদের তাড়া খেয়ে সবাই পালায়, ছেলেটি ধরা পড়ে। এ তখন আকছার ঘটত। গোষ্ঠীপতি প্রথমেই সে ছেলেটিকে মেরে ফেলতে চায় কিন্তু মেয়ে সেটা হতে দেয় না। তার মধ্যে দয়ামায়া ছিল। কিছুদিন ছেলেটি থেকেই যায় সেই নেটিভ গ্রামে, কাজকর্ম করে। সেসময় স্পেনদেশীয় জাহাজের, বিশেষ করে জলদস্যু জাহাজের আনাগোনায় এখানকার আদি বাসিন্দাদের অতিষ্ঠ অবস্থা। ভয়ানক রাগ সবার সাদা চামড়াদের ওপর, তাই গোষ্ঠীপতি শান্তি বজায় রাখতে আবারও মেরে ফেলতে চায় ছেলেটিকে।

    দাদু বুড়ো মানুষ ধীরে ধীরে বলে, কোচিসের আর তর সয় না, সে তাড়া লাগায়।

    --তা ওলীর এক বীরযোদ্ধা প্রেমিক ছিল, সে বাস করত দক্ষিণের দিকে এক দ্বীপে। ওলী ছেলেটিকে বাঁচাতে সেই দ্বীপে রেখে আসে। এরপর বেশ কিছুকাল পরে কোনো এক ইউরোপীয় জাহাজ সেই দ্বীপে আসে।”

    “এক্সপ্লোরার”? কোচিসে জানতে চায়।

    --তারা আমাদের ভূমিতে সম্পদ কেমন আছে, দখল করা যায় কিনা এই সব খোঁজে আসত। ওদের কাছে গ্রেট এক্সপ্লোরার, আমাদের কাছে স্রেফ দস্যু। দুঃখের কথা হলো এই যে, স্পেনীয়রা সেই আদিবাসী গ্রামের ভয়ানক ক্ষতি করে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। সম্ভবত সেই ছেলেটির মুখেই এই ওলীর গল্প ছড়ায়।

    --আচ্ছা তার থেকেই ইউরোপীয়রা পোকাহন্টাসের গল্প বানায়? কোচিসে জিজ্ঞেস করে।

    ---অনেকে তাই ভাবে বটে, এই গল্পের সঙ্গে কিছু মিল আছে তো, তাই। নিজেরাই ছিল বর্বর, সাথে নিয়ে আসত মারণ রোগ, উলটে আমাদের বলে স্যাভেজ।

    বৃদ্ধ বিড়বিড় করে খানিকক্ষণ।

    --গোলাবারুদ আমাদের ভয় দেখাতে পারেনি। কিন্তু রোগ অদৃষ্টের মার, আমাদের সংখ্যা দ্রুত কমতে শুরু করল। আমাদের উপকথা বলে সেই ভয়ানক সময়ে ওলী মানুষের সেবা করত, তাদের রক্ষা করত তীর ধনুক হাতে। এই ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে, ঘাসের জলাভূমে সে আজও ঘুরে বেড়ায়। --দাদু লাঠি ঘুরিয়ে ঘরফেরা পাখির ডাকে মুখর আঁধার ঘনায়মান অরণ্য দেখায়।

    কোচিসে ভয়ে ভয়ে দাদুর কাছে সরে আসে, বলে--“সত্যি দাদু? দেখেছ তুমি?”

    দাদু বলে, “দেখি, আজও দেখি। মনের চোখে দেখি বীর যোদ্ধাদের ফেলে রাখা দেহ এই জলে-জঙ্গলে শেষ সেমিনোল যুদ্ধের সময়ে, সে তো এই সেদিনের কথা। তারা জেগে ওঠে মাঝে মাঝে। ঘোরেফেরে আজও।”

    নাতি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে--দাদু আমার ভয় লাগছে।

    দাদু নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন--ভয় কীসের? ওঁরা তো আমাদের রক্ষা করেন, ভালোবাসেন আমাদের, ভয় মুছে ফেলতে শেখ, না শিখলে এই এভারগ্লেডে আমরা বেঁচে থাকতাম না।

    দাদু নাতি ঘরে ফেরে, পূর্বপুরুষদের রক্তে ভেজা পথ ধরে। প্রাচীন সাইপ্রাসের ঝুপসি ডালপালা ধরে ঝুলতে থাকে ফ্লোরিডা-মসের ফ্যাকাসে জটাজুট, রাতের হাওয়ায় দুলে দুলে অতিপ্রাকৃত নিঝুম কষ্টের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। জলাভূমির দেড়মানুষ সমান উঁচু ঘাসের জংগলের ওপরে চাঁদ ওঠে, আদি অন্তহীন শ্বাপদশঙ্কুল এভারগ্লেডস জেগে ওঠে।

    || ৩ ||

    রাত্রে ঘুমের আগে কোচিসে বলে-- তারপর কী হল দাদু?

    --তারপর লড়াই আর লড়াই, বিরামহীন। আমাদের মিকাসুকি, টোকোবাগা উপজাতীর মত আরো অনেক গোষ্ঠীর আদিবাসিরা মিলে তৈরি হল সেমিনোল ট্রাইব দল, একযোগে যুদ্ধ করতে। জলদস্যু, স্পেনীয়, ফরাসী, ইংরেজ ও সবশেষে মহান যুক্তরাষ্ট্র, প্রায় তিন চারশ বছরব্যাপী লড়াই। এক একটা যুদ্ধ শেষে এই ঘাসের সমুদ্র এভারগ্লেডের আরো গভীরে আশ্রয় নিত পূর্বপুরুষেরা। শুধু বীরত্ব সম্বল করে, স্বাধীন বেঁচে থাকার একটু স্বপ্ন নিয়ে, কুমির প্যান্থারের সাথে বসবাস আয়ত্ত করে তারা।

    ঠাকুরদা কোচিসেকে সেই সব কিংবদন্তী মানুষদের কথা বলে, যাদের মুছে দেওয়া হয় বইয়ের পাতায়। বৃদ্ধ ধরে রাখে তাদের ইতিহাস, প্রবাহিত করে ঘাসের নীচে গোপন জলের ধারার মত। প্রাচীন সাইপ্রাস মনে রাখে, ঝুলন্ত মস ফিসফিসিয়ে সে কথা বলে, শ্বাপদেরা সে গল্প শোনে। হারিয়ে যেতে যেতেও ফুরিয়ে যায় না এই পৃথিবীর অত্যাচারিত প্রতিবাদী ভূমিপুত্র ও কন্যারা।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments