প্রভাতফেরির চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। বাইরে বৃষ্টির দমক। রাতের দিকে বেশ জোরে শুরু হয়েছিল,তবে ভোরের দিকে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ভরা শ্রাবণের মেঘের দল। তার মধ্যেই ভেসে আসছে আজাদী পালনের ‘জয়হিন্দ’ হাঁক। মনে হল যেন গলির মুখে যে পার্টি-অফিসটা আছে, সেখান থেকেই আওয়াজটা আসছে। ঝিমঝিমে বৃষ্টির তালের সাথেই ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’-র সুর মিশে যাচ্ছে। কোলবালিশটা আঁকড়ে পাশ ফিরে শুতেই মনে পড়ল আজ মায়ের চলে যাওয়ারও দিন।
মোবাইলে, নয় ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে মাথার কাছে রেখে শোয়াটা আমার বহুদিনের অভ্যেস। সেই ঘড়িধরা এলার্মের দিন এখন অতীত। অনন্ত ছুটির দিনগুলোয় লেখার টেবিলে বসে সামনের জানলাটা দিয়ে একটুকরো আকাশ দেখাই আমার গৃহবন্দী দশার একমাত্র কাজ। কী মনে হতে আলসে চোখেই একবার মোবাইলটা চেক করলাম আমি। গতরাতে যা দেখেছিলাম সেটাই আছে--সাতটি মাত্র লাইক! দ্রুত স্ক্রল করে একবার সুমন্তর টাইমলাইন ঘুরে এলাম। কুড়ি মিনিট আগে করা একটা লেখায় এর মধ্যেই একশ’আট লাইক জমে গেছে। মনটা বিষিয়ে উঠল।
‘সকাল দশটা থেকে দুপুর দেড়টার মধ্যে পোস্ট রিচ বেশি হয়’ – ব্রাশ করতে করতেটেকগুরু যুবির বলা কথাগুলো মনে পড়ল। রিভুই ওই উদ্ভট চ্যানেলটা দেখিয়েছিল আমাকে।
‘এটায় মাঝেমাঝে চোখ বোলাস। অনেকরকম মোটিভেশানাল স্পীচ দেয় যুবি। তারমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ফেমাস হওয়ারও টিপস আছে। অসম্ভব পপুলার। কমেন্ট সেকশান দেখলে বোঝা যায় কত ফ্যান ওর। তোর কোনো কাজে আসবে কিনা জানি না, বাট যুবি ইজ লাভ, ম্যান!’
রিভুকে কালকের পোস্টটা দেখাতে হবে। ‘দ্যাখ ব্যাটা। কেমন টিপস দেয় তোর ‘লাভ!’
কি মনে হতে একবার লাইকদাতাদের নাম দেখে এলাম। যা ভেবেছি ঠিক তাই। রিভুর লাইক নেই। ও পর্যন্ত দেখে না আমার পোস্ট! এই নিয়ে তিনদিন আগেও ঝগড়া হয়েছিল আমাদের।
“স্মল থিংস ম্যাটারস ইন এভরি রিলেশানশিপ”-- রিভুই বলেছিল ওর জন্মদিনে রাত বারোটাতে কেন উইশ করিনি সেই নিয়ে। কিন্তু সেই স্মল থিংসের মধ্যে কি আমার লেখালেখি পড়ে না! এই নিয়ে কিছু বললেই উত্তর আসে-–“আরে,তোর লেখা দেখেই তো প্রেমে পড়েছিলাম, আলাদা করে কী আর বলি! ইউ আর সো ট্যালেন্টেড! বিশ্বাস কর,আমি পড়ি সব লেখাই। কিন্তু রিয়্যাক্ট বা কমেন্ট করা হয়ে ওঠে না। আসলে তোর মত এত গুছিয়ে কিছু তো লিখে উঠতে পারি না। বাট আই লাভ রিডীং দেম। ইউ আর রিয়েলি আ জেম, মাই লাভ!”
--‘ভালবাসি’ বলেই টেকেন ফর গ্রাণ্টেড করা যায়,রিভু!
ঠিক এই পয়েন্টেই গত একবছর ধরে মন কষাকষি চলছে। টেকেন ফর গ্রাণ্টেড – নিয়ে রিভুর অভিযোগও কম না। আমি নাকি যতটা গল্পের বই বা লেখালিখিকে ভালবাসি, ততটা ওকে পাত্তা দিই না। আমার নাকি কথন আর কর্ম আলাদা। কিছুতেই বুঝিয়ে পারছি না যে লেখা একটা সাধনা। একপাতা লিখতে গেলে একশ পাতা পড়ার দরকার, সেটুকু চর্চার জন্য যথেষ্ট খাটনি হয় মগজের। সেজন্য চাই একাগ্রতা ও পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু ঠিক সেইসময় ঘণ্টাখানেকের জন্য ফোনে ব্যস্ত হওয়া মানেই মনঃসংযোগে ব্যাঘাত। গতবছর প্রথম বইটা বেরনোর পরে দীর্ঘদিন ভাল কিছু লিখতে পারি নি। যেদিন এটা কাটিয়ে উঠতে একরকম জোর করেই বসলাম, শুরু হল করোনাকাল। লকডাউনের ক্রাচে ভর দিয়ে এল অসহ্য বেকারত্ব। এরপর থেকেই যেন বোবায় ধরেছে আমার। মুখ, মন, মস্তিষ্ক সবেতেই লকডাউন।
রিভুর সাথে আড়াই বছরের সম্পর্কে তিনবার নানা ছোটখাটো জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি, দুর্দান্ত সময় কেটেছে দুজনার। ভালোই ছিলাম আমরা। কিন্তু আজকাল ও যেন বড্ড অস্থির হয়ে গেছে। বিশেষত আমার প্রথম বই প্রকাশ হওয়ার পরে যখন লেখালিখিতে সময় দিতে লাগলাম ঠিক তখন থেকেই শুরু হয়েছে রিভুর এক অদ্ভুত হীনমন্যতা।
--যে বয়সটায় একসাথে থাকার কথা সেটা এভাবে হেলায়ফেলায় চলে যাচ্ছে — তুই বুঝছিস না! অনেক কিছুই তো তুই জানিস। ‘টাইম অ্যাণ্ড টাইড ...’ প্রবাদটা ভুলে গেলি?
লংডিস্ট্যান্স রিলেশানের অসুবিধা নিয়ে কিছু বললেই ‘অজুহাত’ বলে চেঁচায়! বেশ বুঝছি, গতানুগতিক যাপনের একটা ছন্দপতন ঘটছে। রিভুর ক্রমাগত ‘সেটল করা’র ইচ্ছে, বাড়িতে জানিয়ে একত্রবাসের ব্যবস্থা করা — এসব ধীরে ধীরে চাপ হয়ে উঠছে আমার কাছে। দু’জন এডাল্ট স্বাধীনভাবে একত্রবাসের অধিকার পেলেও, বাড়িতে আমার সত্তরোর্ধ বাবাকে কীভাবে জানাব তাঁর ‘বেকার’ ছেলেটি আরেকটি ছেলের সাথে জীবন কাটাতে চায়! সবচেয়ে বড় কথা, আগে নিজের কাছেও তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
রিভু আমার একাকীত্বের মরু-যাপনে একমাত্র মরুদ্যান। আমার প্রতিটা খুঁটিনাটি নিয়ে সচেতন সাহচর্য আর আগলে রাখাটাকে আমি ভীষণভাবে আঁকড়ে থাকতে চাই। প্রথম যেদিন আমায় আদর করেছিল,সেদিন যেন ম্যাজিকের মত পালটে গিয়েছিল ভেতরের আমিটা। বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল শরীরে মনে। মেতে উঠেছিলাম ছকভাঙা এক উদ্দাম প্রেমকাব্য রচনায়। কিন্তু সময় যত গড়াল তত স্পষ্ট হল এই মায়া, এই ভালোলাগা — সবকিছুই একটা বুভুক্ষু একলা হৃদয়ের স্বাভাবিক কামনা। রিভু আমার জীবনের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঠিকই, কিন্তু সে কখনোই পুরো আমিটিকে ঘিরে নেই। ওর ‘গে ম্যারেজ’ নিয়ে উৎসাহ কিম্বা গে কমিউনিটির সখ্যতা--আমায় বারবার আয়না দেখায়। আদৌ কি নিজের ওরিয়েন্টেশান নিয়ে সচেতন আমি!
যতবার ঝগড়ায় ও বলে ‘তোর কাছে তো আমি এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ মাত্র। জানি খেলা শেষ হলেই ছুঁড়ে ফেলবি!’ ততবার আমার ভেতরখানা প্রশ্নের ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত হয়।
কলেজজীবনে খুব শখ ছিল প্রেমপত্র পাওয়ার। আজও পাই নি। তিনজন মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়েও শেষরক্ষা করতে পারি নি। রিভুকে জানিয়েছিলাম তাদের কথা। সম্পর্কের ভিত্তিকে স্বচ্ছ ও সৎ রাখা আমার উদ্দেশ্য হলেও নানা তর্ক-বিতর্কে রিভুর দিকে থেকে বুমেরাং হয়ে ফিরেছে আমার অতীত। সেসব সম্পর্ক ভাঙার কারণ যাই থাকুক, স্পষ্ট টের পাই, আজকাল যতবার রিভু আমায় প্রশ্নবাণে বিধ্বস্ত করে, ততবার সেই ‘স্ট্রেইট’ সম্পর্কের ছবিগুলো শেল হয়ে বিঁধতে থাকে বুকের গভীরে।
‘এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ!’ ‘দেমাক হয়েছে লেখকবাবুর!’ — আমি সত্যিই কি ঠকাচ্ছি রিভুকে! নাকি আমি বাইসেক্সুয়াল! উত্তর পাই না, কেবল বুঝি আমাদের মধ্যে মান-অভিমান আর ফরম্যাল কিছু খবরাখবর ছাড়া স্বাভাবিক আড্ডা, বন্ধুত্ব, খুনসুটিগুলো মরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
একটা বিশ্রী ‘ভাল্লাগছে না’ উলটো বাদুড়ের মত বুকের মাঝে ঝুলে থাকে রাতদিন। তার অবিরাম দংশনে সৃজনশীলতার ঘরে তালা পড়েছে, শব্দের অভিমান ভাঙানো হয়ে উঠল না আজও। রিভুর সাথে জড়ানোর আগে কি আরও একটু সময় নেওয়া উচিত ছিল!
--বুঝতে পারি আমি তোর যোগ্য নই। তোর মত একটাও গুণ নেই আমার। কত মেয়ে তোকে পাওয়ার কাঙাল, অথচ তুই আমার মত অকর্মার ঢেঁকিকে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছিস। আমার মনে হয় জোর করে ধরে রেখেছি তোকে। সেজন্যই তোর মন ভাল নেই। আমি সরে গেলে হয়ত ভাল থাকবি তুই। কিন্তু কী করব আমি থাকতে পারি না তোকে ছাড়া।
--এক কাজ কর, আমায় সাবজেক্ট ধরে একটা ‘না-ছেলে, না-মেয়ে’ ‘অন্যরকম’ শ্রেণির মানুষ নিয়ে লেখ।
--বেঁচে থাকাকালীন তো পারছিস না, আমি মরলে অন্তত বাড়িতে জানাস তোকে ভালবাসার মানুষও কেউ একজন ছিল।
হোয়াটস্যাপ উপচে পড়ে রিভুর মধ্যরাতের এসব প্রলাপে। প্রথম প্রথম এসব নিয়ে খুব উত্তেজিত হতাম, ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত ওকে বোঝাতে। কিন্তু এখন জেনে গেছি এটা রিভুর একটা মানসিক রোগ। ছোট থেকে নিজের ওরিয়েন্টেশান নিয়ে চাপা অবসাদ ওর ছিলই। এই ‘অন্যরকম’ হওয়াটাই আজ হীনমন্যতায় দাঁড়িয়েছে। কেউ ওর ইচ্ছের দাম দেয় না, ভালবাসে না--যখন তখন এই উটকো ভাবনাগুলোই ওর অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। রিভুর জীবনসাথী হতে গিয়ে কখন যেন ওর মনের ডাক্তার হয়ে গেছি আমি। কিন্তু আমার মনের খবর কেই বা রাখে! ও কি আদৌ বোঝে আমায়?
তিন বছর আগেওআমি এরকম ছিলাম না। বরাবরই দিলখোলা বহির্মুখী স্বভাবের ছেলে আমি। ভার্চুয়াল লেখালিখি জগতে ফলোয়ার ছিল বেশ কিছু। সকাল থেকে রাত আমি যাই লিখি না কেন, হু হু করে লোক তা পড়ত। না, ঠিক পড়ত না, গিলত। বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সেইসব লেখাগুলো আজ দেখলে বেশ বালখিল্যই লাগে আমার, তবু ওসব লেখাই লোকে কত ‘লাইক’ করত। কিন্তু যেদিন থেকে আমি ভাবনায় গভীরতা এনে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখতে শুরু করেছি তবে থেকে তাল কেটেছে। সেগুলো সাহিত্য কতটা জানি না, তবে অত্যন্ত যত্ন করে যা কিছুই লিখি–- দেখছি লোকে সেসব সৎ লেখা আর নিচ্ছে না। এ কি সত্যিই পাব্লিকের ‘চয়েস’-এর দোষ! নাকি আমি নিজেই অপাংক্তেয় হয়ে পড়ছি উল্টোস্রোতে সাঁতরাতে গিয়ে।
স্ক্রিনে খোলা সাদা পাতা। সামনে রাখা চা জুড়িয়ে গেছে। মাথায় আস্ত এক সাহারা মরুভূমি নিয়ে বসে রয়েছি। খোলা জানলা দিয়ে দৃষ্টি বেশিদূর হাত পা ছড়াতে পারে না। এত এত আবাসন চারিদিকে, বসার ঘরের জানলা দিয়ে কারোর বাথরুমের পাইপ, ব্যালকনি দিয়ে উল্টোদিকের আবাসনের গ্যারাজ এসব স্থির চিত্রে ধাক্কা খেয়ে চোখ সরিয়ে নিতে হয়। এই যেমন লেখার টেবিলের সামনে পশ্চিমদিকের ফ্ল্যাটের এক উদোম গায়ের লোকের আঁচানো দেখতে হচ্ছে। গতরাত থেকে রিভুর ফোন ধরি নি। মোট বারোটা মিসডকল জমে আছে। মাঝেমাঝে মনে হয় লেখাপড়াকে সাধনা হিসেবে নিলে বোধহয় সম্পর্কের শেকলে নিজেকে না জড়ানোই ভাল। সবার পক্ষে কি আর সম্পর্কর বোঝা টানা সহজ হয়! ল্যাপটপের সাদা পাতায় মোট সাতটি শব্দ লিখে মুছে ফেলতে হল। কিছুতেই মন বসছে না।
আরও একবার সোশাল মিডিয়া ঘুরে এলাম। বিস্মৃতপ্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর খুব যত্নে লেখা পোস্টে এখন মোট বারোটা ‘লাইক’ জমেছে। টাইমলাইন জুড়ে নানারকম খবর। পরিযায়ী শ্রমিক, আমফানে উদ্বাস্তু হওয়া ভিড়ের ছবি — গলার কাছে একটা তেতো ভাব পাকাপাকি বাসা বেঁধেছে। ইনবক্সে একটা সাহিত্য-গ্রুপের মেসেজ ঢুকল। লেখা চেয়েছে পূজাবার্ষিকীর জন্য। শেষ তারিখ জানতে চেয়ে মেসেজ করছি এমন সময় টুং করে মেসেজএল রিংকুর -‘বইটা পাঠিয়েছিস?’
এই নিয়ে প্রায় আটজনের এমন আবদার পেলাম। বন্ধুদের মধ্যে মাত্র তিনজন আমার বইটা কিনে পড়েছে। বাকিরা সবাই ফ্রি কপি পাওয়ার প্রত্যাশায় মেসেজ করেই চলেছে। যেকোনো লেখকের কাছে তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই, প্রথম-সন্তানের মত। কিন্তু পরিচিত মহল আমার মানসকন্যাকে ফ্রিতে পেতে উদগ্রীব। তাদের মতে, ‘সোশাল মিডিয়ার কলমচিদের লেখক বলে না- ওরা ফেখক। অতএব ফেখকদের বই কিনে পড়াটা স্রেফ বাজে খরচা।’ ওদের বন্ধুকৃত্য করার আবদার না মেটালে টিপ্পনী আসে-- ‘ফেখকদেরও আজকাল বড্ড দেমাক!’ কাকেই বা বলি, পাঁচ বছরের লেখালিখিতে এখনও এক পয়সা পাই নি আমি।
ঠান্ডা চা-টুকু বেসিনে ফেলে বাবার ঘরে এলাম। এই সময়টায় বাবা প্রাণায়াম করে। আজ দেখি পায়জামা পাঞ্জাবি পরে একেবারে তৈরি হয়ে বসেছে মায়ের ছবিটার সামনে। মৃদু সুরে বাজছে রবি ঠাকুরের গান, ... বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই/ বনের গান গাও দিখি।/ খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই খাঁচার গান লহ শিখি।/ বনের পাখি বলে-–না/ আমি শিখানো গান নাহি চাই।/ খাঁচার পাখি বলে ‘হায়, আমি কেমনে বন গান গাই...’
মায়ের প্রিয় গান ছিল এটি। কে জানে সব মানুষেরই বোধহয় মনের কোনও তন্ত্রীতে বসত করে একএকটা গান। কেবল সময়মত তাকে খুঁজে নেওয়ারপালা। বেলা কি অনেক গড়িয়েছে! ধূপের মৃদু সুগন্ধে ভরা বাবার ঘরের এই পবিত্র পরিবেশে নিজেকে বেখাপ্পা লাগছে।
--তুই কি আজকের দিনেও এরকম চেহারায় থাকবি? শিগগির তৈরি হ। বাবার এই মৃদু স্বরের ধমক যেন অনেক দিন বাদে শুনলাম। কে জানে কেন বেশ লাগল। আজকাল আমাদের মধ্যে কথাই বা কতটুকু হয় যে ধমক শুনতে পাব। বুকের ভেতরে যেন কাপড় নিংড়ানো মোচড়। এই অনন্ত বড়বেলাটায় কত কিছুই যে হারিয়ে ফেলছি একে একে।
মুখভর্তি দীর্ঘদিনের জঙ্গল। আচ্ছা, অবসাদে ভোগা সব ছেলের মুখ কি একরকমের হয়! ওদিকে আমার ক্লিন-শেভড, ধোপদুরস্ত বাবার পাশে আয়নাতে নিজেকে দেখে বেশ লজ্জাই লাগল। মনে পড়ল--আজ মঙ্গলবার,জঙ্গল সাফ করার দিন!
বাবাকে প্রেসারের ওষুধটা মনে করিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। ‘আনন্দনিকেতন’-এর গ্যারাজের সামনের রাস্তাটায় দৃষ্টিপথ ধাক্কা খেল। ফুলে ফুলে ছেয়ে রয়েছে কৃষ্ণচূড়ার শাখা। তার ঠিক নিচ দিয়ে অমর্ত্যের কাঁধে হাত রেখে প্রণবকাকু ফিরছেন স্কুটারের পেছনে বসে। বাপ-বেটায় দারুণ বন্ধুত্ব ওঁদের।
ছোটবেলায় শুনতাম,ষোলো বছর বয়সের পরে নাকি বাপ-বেটা বেস্টফ্রেন্ড হয়ে ওঠে। সে বয়স ষোল বছর আগেই পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু এখনও বন্ধু হিসেবে মায়ের জায়গাটা বাবাকে দিতে পেরেছি কি! নইলে মায়ের কোলে মাথা রেখে যে কথাগুলো অকপটে বলতে পারতাম, এখন কেন বাবার সামনে দাঁড়ালে জিভ জড়িয়ে আসে, বোবায় ধরে।
পৃথিবীর এই কঠিন সময়ে প্রতিটা মানুষ যেসব গভীর সমস্যায় ভুগছে, সে তুলনায় আমার ব্যক্তিগতমনখারাপগুলো নিতান্তই তুচ্ছ ঠেকে নিজের কাছে। চাকরি হারিয়েছি, আমার রাইটার্স-ব্লক চলছে, নাকি রিভুর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন–-কোন সমস্যার ভার সবচেয়ে বেশি! কিম্বা কোন্টা তুলনায় কম কর্কশ! দুটো স্ট্রোক সামলে ওঠা বৃদ্ধ মানুষটাকে এসব বলা কি যুক্তিসঙ্গত! পেন্ডুলামের মত অস্থির মনকে জোর করে দমিয়ে পায়ে পায়ে বাথরুমের দিকে এগোই।
রান্না-মাসির পাঁচমেশালি শব্দে মুখরিত আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটের আটপৌরে গেরস্থালি। জানি না আর কদ্দিন ওঁকে মাইনে দিতে পারব। বাথরুমে ঢোকার মুখে দেখি কাগজের প্রথম পাতায় মৃত্যুর উর্দ্ধমুখী খতিয়ান। পৃথিবীর এ অসুখ সারবে কবে! মেদিনী মন্থনের শেষে কবেই বা মানুষের হাতে পৌঁছাবে অমৃতকুম্ভ!
মধ্য যৌবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একের পর এক বসন্তের বিদায় দেখে এখন পরিষ্কার বুঝি একমাত্র নস্টালজিয়ার সাথেই আমার দীর্ঘদিনের সহবাস। তাই হয়ত বাবার দেওয়া পুরনো মডেলের রেজারটা ফেলে আজওট্রিমার কেনা হয় নিআমার। রিভু একবার বলেছিল‘শেভিং-বক্স’ গিফট করবে। কড়া স্বরে নিষেধ করেছিলাম। খুব কষ্ট পেয়েছিল বেচারা। ওকে বোধহয় কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারি না আমি। কলের ধারাস্রোতের চেয়েও দ্রুত নামছে দু’চোখের নায়াগ্রা। উপোসী কপোলে কতদিন পড়ে নি ভালবাসার ছোঁয়া! আজ কি তাই সবটুকু শোধ তুলছে অবুঝ সময়!
টেবিলে উচ্চস্বরে বাজছে ‘তেরে বিনা জিন্দেগী সে..’চেনা সুরে রিভু ডাকছে আমায়। কল বন্ধ করে শুনছি সে ডাক, কিন্তু পা সরছে না। আমার কানে তখন সবকিছু ছাপিয়ে আরেকটা সুর ...
‘...দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বুঝাতে নারে আপনায়। / দুজনে একা একা ঝাপটি মারে পাখা,/ কাতরে কহে ‘কাছে আয়’।/ বনের পাখি বলে- ‘না। কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার’/ খাঁচার পাখি বলে — ‘হায়, মোর শকতি নাই উড়িবার’।
মনটাকে গোছাতে গোছাতে শ্লথ হাতে ব্লেড টানতে থাকি। শুনতে পাচ্ছি ওদিকে সুরটা বাজছে,থামছে আবার বাজছে...