ডিং ডং করে কলিং-বেলটা বেজে উঠলো।
মাস্কটা পরে দরজা খুলতে কয়েক সেকেন্ড বেশী লাগলো রাজেনবাবুর – তার মধ্যেই আরেকবার বেলটা বেজে উঠলো। ঈষৎ বিরক্ত হলেন রাজেনবাবু।
দরজাটা খুলে অবশ্য সেই বিরক্তিটা এক ধাক্কায় মিলিয়ে গেল। কারণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন ওঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও এককালের প্রতিবেশী রামমোহন গুপ্ত।
রাজেনবাবু আর রামমোহনবাবু এই গ্রামেরই ছেলে। গ্রামের একই ইস্কুলে পাশাপাশি বসে পড়াশোনা করেছেন দুজনে, যদিও সামাজিক অবস্থানে তাঁরা দুজনে ঠিক পাশাপাশি শ্রেণীর নন। রাজেনবাবুরা একসময় এই গ্রামের জমিদার ছিলেন, এখনো তাঁদের বিস্তর জমিজমা, ফলের বাগান, চালের কল ইত্যাদি; তুলনায় রামমোহনের পরিবার নিতান্তই সাধারণ। এই সামাজিক ব্যবধান কিন্তু ওঁদের বন্ধুত্বে ছায়া ফেলে নি কোনদিন – এমনকি ইস্কুল পাশ করে আলাদা কলেজে পড়তে গেলেও ওঁদের যোগাযোগ ছিন্ন হয় নি। যোগাযোগে একটু ভাঁটার টান এসেছিল কলেজ পাশ করার পর - যখন রাজেনবাবু গ্রামে ফিরে এলেন পৈত্রিক সম্পত্তির দেখাশোনা করতে আর রামমোহনবাবু চলে গেলেন উত্তরবঙ্গে, চাকরিসূত্রে। তারপর অনেক বছর পেরিয়ে আবার নতুন করে দুজনের যোগাযোগ হল বছরদশেক আগে, যখন রামমোহনবাবু কলকাতায় বাড়ি কিনে পাকাপোক্তভাবে থাকতে শুরু করেন।
যদিও রাজেনবাবুদের একটা অতি চমৎকার বাড়ি আছে কলকাতায়, রাজেনবাবু কিন্তু নিজেদের সাবেকি গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। ব্যবসার কারণে গ্রামে থাকাই ওঁর পক্ষে সুবিধে - চাষের জমির লিজ থেকে ভালই রোজগার ওঁর, চালের কল দুটির দেখাশোনাও উনিই করেন। কিন্তু ওঁর আসল শখ ওঁদের পারিবারিক বাড়িটির পিছনের বিশাল আমবাগানটি। সৌখিন রাজেনবাবু শুধু বিক্রির জন্যে আমগাছ লাগিয়ে খালাস নন, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের দেখাশোনা করেন। বহুরকম দিশি আম আছে ওঁর – তাদের সযত্ন লালনপালনে ওঁর অনেকটা সময় যায়। ছেলেছোকরাদের গাছে উঠে বা ঢিল মেরে আম চুরি বন্ধ করতে উনি একটি রিভলভার কিনেছেন, এবং তার নিয়মিত চর্চা করে থাকেন। আম নিয়ে এই পাগলামির জন্যে পাড়ার বয়ঃজ্যেষ্ঠরা ওঁকে “আমবাবু” বলে ডেকে থাকে আর ছেলেছোকরারা বলে “আমজেঠু”, “আমদাদু”, “আমবুড়ো” অথবা “আমখ্যাপা”। তবে সবই আড়ালেই। রাজেনবাবু প্রবল ব্যক্তিত্ববান মানুষ, এককালে জমিদার ছিলেন, এখন বন্দুক রাখেন – এহেন লোকের সামনে ছ্যাবলামো করার দুঃসাহস কারোরই নেই।
স্বেচ্ছাঅবসর নিয়ে কলকাতায় চলে আসার পর রামমোহনবাবু মাঝে মাঝেই চলে আসেন রাজেনবাবুর বাড়িতে, আড্ডা মারতে। মাসে একদিন বা দুদিন সকাল সকাল কলকাতা বেরিয়ে পড়েন। ট্রেনে ঘণ্টা তিনেক, তারপর আধঘণ্টা টোটোতে – এগারোটার আগেই রাজেনবাবুর বাড়িতে। সারাদিন কাটিয়ে ফেরেন সেই রাতের খাওয়া সেরে। প্রথমদিকে এতটা নিয়মিত ছিল না, বছরপাঁচেক আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর যাতায়াতটা বেড়েছে। রাজেনবাবুর মধ্যে রয়েছে বনেদি অতিথিবাৎসল্য আর সৌখিন রুচির মেলবন্ধন – কাজেই এখানে রামমোহনবাবুর সারাদিনটা বেশ ভাল কাটে।
এবার অবশ্য এলেন আটমাস পরে। কারণটি সহজেই অনুমেয়।
“আরে – আয় আয়। কদ্দিন পরে এলি!”
“কী আর করি বল। চারমাস আগে ট্রেন চালু হয়েছে বটে, কিন্তু আমি এদ্দিন চড়ি নি। আজই প্রথম চড়লাম আর এতটা দূর এলাম। সত্যি বলতে কী – বেশ ভয়ই করছিল।” বললেন রামমোহনবাবু।
“বুঝতেই পেরেছি! আমি একবার ভেবেছিলাম আমার গাড়িটা নিয়ে তোর ওখানে ঢুঁ মারবো – কিন্তু ড্রাইভারকে নিয়ে অতটা রাস্তা যাওয়া ঠিক নয়। যা গরম, এসি তো চালাতেই হবে – অর্থাৎ বদ্ধ জায়গায় হাওয়া সারক্যুলেট হওয়া - রিস্কি ব্যাপার।”
বলতে বলতে রাজেনবাবু খেয়াল করলেন যে রামমোহনবাবু হাতে একটা কাগজের ঠোঙ্গা ধরে আছেন।
“ওটা আবার কী রে?”
“আরে হঠাৎ পেয়ে গেলাম আমাজনে, তাই তোর জন্যে তুলে আনলাম। বিখ্যাত আলফান্সো আম – যাকে বম্বের মাস্তানরা বলে ‘রত্নাগিরি হাফুস”, যার প্রথম পেটি বিশাল টাকায় নিলাম হয় সেই জিনিস। এখন এটা পাবার কথা নয়, আচমকা পেয়ে গেলাম – তাই নিয়ে নিলাম তোর জন্যে। খেয়ে দেখিস একবার...“ বলতে বলতে রাজেনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রামমোহনবাবু একটু গুটিয়ে গেলেন। কারণ রাজেনবাবুর চোখে একেবারে গনগনে আগুনের হল্কা।
“তুই আমার বাড়িতে আম নিয়ে এসেছিস? ক্যারিইং কোল টু নিউ-ক্যাসল? তায় আবার অনলাইনে কেনা কারবাইডে পাকানো আম? তোর স্পর্ধা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি।” গর্জে উঠলেন রাজেনবাবু।
“আহা, খেয়েই দেখ না বাপু।” মিনমিন করে বললেন রামমোহনবাবু।
“ওভাবে তো খাওয়া যাবে না। তুই ওপাশে রেখে দে, বিশু ফিরলে ওগুলো পাশের ঘরের বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে রাখবে। ওই বাথরুমটা তো এই স্যানেটাইজেশনের জন্যেই আছে – ডেকচি, সাবান, পটাশ – সব রাখা আছে। তুইও ওখানে গিয়ে হাতটা ধুয়ে আয়।”
“আমার লাগবে না।” বললেন রামমোহনবাবু। তারপর টপ করে পকেট থেকে ছোট্ট বোতলটা বের করে দু-ফোঁটা হাতের তালুতে ঢেলে ঘষে নিলেন। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে খবরের কাগজটা বের করে বললেন “এই নে, আজকের অমৃতবাজার।”
রাজেনবাবু বিরক্তভাবে মাথা নাড়লেন। “আবার ওটাতে হাত দিলি! আবার স্যানেটাইজ কর হাত। আর খবরের কাগজ কিনলি কেন? আমি তো সব ফোনেই পড়ে নিই।”
“তুই শব্দ-জব্দ করতে ভালোবাসিস, তাই আনলাম। তাছাড়া রোববার করে এদের ‘রবিবারের কলকাতা’টা বেরোয়…।”
“আ’টার রাবিশ। অসহ্য!” রাজেনবাবু নাক সিটকোলেন।
“শোন না সব। এই দ্যাখ –
করোনায় ডিভোর্সঃ সম্প্রতি এক দম্পতি আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। স্বামীর অভিযোগ স্ত্রী তাঁকে মাস্ক পরে চুম্বন করতে বাধ্য করেছেন…।”
বাধা দিলেন রাজেনবাবু “তোর এইসব রসের গপ্প খুব ভালো লাগে বুঝি?”
“আহা - তা কেন?” বললেন রামমোহনবাবু, “এটা শোন -
বহুরূপী করোনাঃ করোনা ভাইরাসটি যে অনবরত মিউটেট করছে, সেটা তো সকলেরই জানা। বিজ্ঞানীদের মতে এরপর তার রূপ সম্পূর্ণ বদলে যাবে। সে যে শরীরকে আক্রমণ করবে, তার চেহারা ধারণ করবে। অর্থাৎ মনুষ্যরূপী করোনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।”
রাজেনবাবু রাগে গরগর করতে করতে কিছু একটা বলবার আগেই মহাশ্বেতা – অর্থাৎ রাজেনবাবুর স্ত্রী এসে পড়লেন খাবারের ট্রে নিয়ে। তাতে একটা বড় প্লেটে আম আর সন্দেশ।
“দাঁড়াও, দাঁড়াও – কী দিলে ওকে? চলো, ওঘরে চলো” বলে রাজেনবাবু ট্রে সমেত স্ত্রীকে একেবারে তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। তারপর নিজেই একটু বাদে ফিরে এলেন ট্রে হাতে। ট্রেতে এবার আলাদা আলাদা তিনটে ছোট প্লেটে খোসা ছাড়িয়ে ছোট করে কাটা আম। ট্রে-টা রামমোহনবাবুর সামনের টেবিলে রেখে বললেন “এইবার তোর জিভের তথা রুচির পরীক্ষা। এগুলো টেস্ট করে বলতে হবে কোনটা কী আম।”
“সব তোর গাছের?” শুধোলেন রামমোহনবাবু।
“সেটাও কী বলে দিতে হবে? ”
প্রথম প্লেটটা তুলে নিলেন রামমোহনবাবু। তারপর দুমুখো কাঁটা দিয়ে একটা টুকরো মুখে তুলে খুব আস্তে আস্তে চিবোলেন সেটা। তারপর আরেকটা। আবার আরেকটা। তারপর মুখ তুলে বললেন “বুঝেছি। এটা তো সেই ‘চাটুজ্যে’। কি, ঠিক তো? ”
রাজেনবাবুর মুখ ভাবলেশহীন। নিঃস্পৃহ কণ্ঠে শুধু বললেন “সব কটা হোক, তারপর উত্তর পাবি।”
দ্বিতীয় প্লেটটা তুলে নিয়ে পর পর দুটো আম মুখে তুলে নিয়েই রামমোহনবাবু বললেন “জলের মতো সহজ। এটা আম্রপালী।”
রাজেনবাবু নিরুত্তাপ।
তৃতীয় প্লেটটা শেষ করতে সময় নিলেন রামমোহনবাবু। তারপর বললেন “এটা শক্ত ছিল, কিন্তু আমি ধরতে পেরে গেছি। এটা লালমোহন। সামান্য কষা স্বাদ।” তারপর একটা উদ্গার ছেড়ে বললেন “যাই বল, এটা তেমন টেস্টি নয়। এর চেয়ে আমার আনা আলফান্সো কিন্তু বেটার। খেয়ে দেখিস।”
রাজেনবাবু কিছু না বলে ভিতরে গেলেন। ফিরলেন আরেকটি ট্রে নিয়ে, তাতে চা আর বিস্কুট। বললেন “চা-টা খেয়ে নে, তারপর রেজাল্ট বেরোবে। তোর প্রিয় চকলেট বিস্কুটও দিয়েছে শ্বেতা।”
“ওঃ – ফ্যান্টাস্টিক।”
ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখতে গিয়ে রাজেনবাবু থমকে গেলেন। টেবিল জুড়ে আমের প্লেট। তাই রামমোহনবাবুকে বললেন “ট্রে-টা একটু ধর, আমি আমের প্লেটগুলো সরিয়ে দি। কাজের লোকগুলোকে ছুটি দিয়েছি, আর ওই বিশুটা কোথায় যে গেল…”
“দে, আমি ধরছি।”
রামমোহনবাবুর হাতে ট্রে-টা তুলে দিয়ে নিচু হলেন রাজেনবাবু। তারপর এক ঝটকায় তুলে নিলেন টেবিলে রাখা সার্ফেস-ক্লিনার স্প্রেটা। তারপর সোজা রামমোহনবাবুর মুখের দিকে তাক করে স্প্রে টিপে দিলেন পরপর চারবার। বন্দুকের ঘোড়া টেপার ভঙ্গিতে।
ছিটকে পড়লো রাজেনবাবুর চায়ের ট্রে, খান খান হয়ে ভেঙে গেল “রয়্যাল অ্যালবার্ট” চায়ের পেয়ালা আর পিরিচ। দৌড়ে এলেন মহাশ্বেতা।
ওঁদের দুজনের চোখের সামনে রামমোহনবাবুর বিশাল চেহারা গুটিয়ে একটা ফুটবলের আকার ধারণ করলো। তার রং লাল, তার গায়ে লাল লাল কাঁটা। এই চেহারা এখন সব খবরের কাগজ-ম্যাগাজিন-নিউজচ্যানেলে নিত্য দেখা যায়।
তিরতির করে কাঁপতে থাকা বীজাণুটির ওপর আবার স্প্রে করলেন রাজেনবাবু। আবার – আবার – আরেকবার। একসময় তার কাঁপুনি থেমে গেল।
মহাশ্বেতার দিকে তাকিয়ে রাজেনবাবু বললেন “এক্ষুনি হীরককে ফোন করো। পুলিশের দিকটা ও সামলাক। তারপর হাসপাতালে।
***
হীরক এসে পড়লো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। ছেলেবেলা থেকেই সে জ্যাঠা আর জেঠিমার খুব আদরের, এখন কলকাতার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। কলকাতাতেই থাকে, ক’দিনের জন্যে এখন এখানে এসেছে।
হীরকের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় থানা থেকে তড়িঘড়ি লোক এসে পড়লো রাজেনবাবুর স্টেটমেন্ট নিতে। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ডাক্তারবাবু এসে পড়লেন প্লাস্টিকের প্যাকেট এবং আইসবক্স নিয়ে। কোভিডের এই স্যাম্পেল অ্যাম্বুলেন্সে করে চলে যাবে কলকাতায় – স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে। ওদিকে কলকাতার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের লোক রওনা গেছে রামমোহনবাবুর বাড়িতে – সরজমিনে তদন্ত করতে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে রামমোহনবাবু সম্ভবত আর বেঁচে নেই, তবে তদন্ত না করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ঝামেলা মিটতে মিটতে দুপুর গড়িয়ে গেল। অবশেষে পুলিস-ডাক্তার-অ্যাম্বুলেন্স সব বিদায় নিয়েছে, মহাশ্বেতা ওঁর সাধের “রয়্যাল অ্যালবার্ট” টি-সেটটি ভাঙার জন্য তাঁর স্বামীর ওপর প্রভূত গঞ্জনা বর্ষণ শেষ করে আরেক রাউন্ড চা করে নিয়ে এসেছেন। রাজেনবাবু ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছিলেন, ফার্স্ট ফ্লাশের গন্ধে চোখ খুললেন। হীরক চা হাতে ওঁর সামনের মোড়াটায় বসে বলল “কী করে বুঝলে, বলো।”
“বলছি।” বললেন রাজেনবাবু। “তার আগে বল, এই ধরণের মিউটেশন যে হয়েছে, সেটা তুই জানতিস?”
“এটা টপ সিক্রেট। এরকম তিনটে ভাইরাস-মানুষের খবর আমরা জানি। তার একটা কলকাতায় ইনফিল্ট্রেট করেছে, এ খবরটাও ছিল। সে যাই হোক, তুমি কি করে বুঝলে?”
“বুঝলাম ওর আম খাওয়া দেখে।” বললেন রাজেনবাবু, মুচকি হেসে।
“আম? মানে?”
“ওকে আমি প্রথম দিয়েছিলাম ‘মল্লিকা’, যেটা ও বলল ‘চাটুজ্যে’। ‘চাটুজ্যে’ আমের সিজনের একেবারে প্রথম ব্যাচের আম, এতো দেরী অব্দি পাওয়াই যায় না। খুব বাজে ভুল। “
“ঠিক আছে, তারপর?”
“দ্বিতীয় আমটা ছিল ‘মধুকুলকুলি’ যেটাকে কেউ কেউ ‘মধুবুলবুলি’ও বলে থাকে। ভুল হবার কোন সম্ভবনাই নেই – ছোট্ট ছোট্ট সাইজ, লাল রং, মধুর মতো মিষ্টি । যেটাকে ও বললো ‘আম্রপালী’। অবিশ্বাস্যরকম বাজে ভুল। চেহারা দেখেই ‘মধুকুলকুলি’ চেনা যায় - তাছাড়া আম্রপালী মিষ্টি হলেও তাতে একটা সামান্য আঠালো ভাব আছে, যেটা স্পষ্ট টের পাওয়া যায় গলায়।”
“আর তৃতীয় আমটা?”
‘এটা একটু শক্ত হলেও রামমোহনের পারা উচিৎ ছিল। ওটা ‘লক্ষ্মণভোগ’। এটা সামান্য কষা বলে এটা আমি বরাবর গোপালভোগ বা ল্যাংড়ার সঙ্গে পেয়ার করে দি – হাফ-হাফ রেশিওতে। এটা ও আমাদের বাড়িতে অনেকবার খেয়েছে।” বললেন রাজেনবাবু।
“কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ও ওই আমটার নাম বললো ‘লালমোহন’। ‘লালমোহন’ আমের টেক্সচারটাই সম্পূর্ণ আলাদা – ফ্লেশি – অনেকটা সয়াবিনের বা মাংসের মতো। আর সবচেয়ে মারাত্মক ভুল – আমাদের এই অঞ্চলের একমাত্র ‘লালমোহন’ আমের গাছটি আমার বাগানেই ছিল বটে, কিন্তু দুবছর আগে বাজ পড়ে সেটি মরে যায়। এটা নিয়ে আমি খুব দুঃখ করেছিলাম রামমোহনের কাছে, কাজেই এটা ওর কোনমতেই ভুল হবার কথা নয়। “
“অ-সা-ধা-র-ণ, জেঠু! অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তোমার! “ বলল হীরক। “কিন্তু একটা কথা বলো – করোনা ভাইরাস রামজেঠুকে ইনফেক্ট করে তার স্মৃতি-মেধা-চিন্তা এসবের কন্ট্রোল নিয়ে নিয়েছিল, তাই তো? সেইজন্যেই সেই ভাইরাস-মানুষ তোমার বাড়ি চিনে আসতে পেরেছে। কিন্তু রামজেঠুর ব্রেন কপি করে নেওয়া সত্ত্বেও করোনা এই আমগুলো চিনতে পারলো না কেন?”
চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে ছাতের দিকে তাকালেন রাজেনবাবু। তারপর বললেন “এর কোন স্পষ্ট উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমার একটা থিয়োরি আছে - সেটা বলতে পারি।”
“তাই বলো।”, বলল হীরক।
“আমার বিশ্বাস করোনা মানুষের ব্রেনকে ইনফেক্ট করতে পারে অর্থাৎ তার ইন্টেলেক্টকে, তার ইমোশনকে নয়। আর আমের স্বাদ কি ইন্টেলেক্টের ব্যাপার? ওই স্বাদ-গন্ধের সুক্ষ অনুভব আসলে একটি গভীর শিল্পবোধ, যার অবস্থান আমাদের হৃদয়ে। দেশী আম, ফার্স্টফ্লাশ চায়ের স্বাদ, সানডাউনের ঠিক পরের সিঙ্গল-মল্ট – এগুলো ব্রেন দ্বারা কন্ট্রোলড নয়, এদের অবস্থান হৃদয়ে।‘
একটু দম নিয়ে রাজেনবাবু বললেন “সেইজন্যেই আমি ওকে ধরবার জন্যে ফাঁদ পেতেছিলাম। এ ফিনেস উইথ ফার্স্টফ্লাশ চা এন্ড চকলেট বিস্কুট।”
“ফিনেস?” থতমত খেয়ে গেল হীরক।
“ইয়েস স্যার। ওপরের হাত থেকে ছোট তাস খেলে নিচের হাতের টেক্কা দিয়ে সাহেব ধরা। যারা চা ভালবাসে, তারা সকলেই জানে যে ভাল চা খাবার আগে জিভ থেকে অন্য স্বাদ তুলে দিতে হয় – ফরাসীরা যাকে বলে ‘ক্লিনিং দ্য টাংগ’। আম খাবার পর ভাল চা খেতে হলে আগে থিন এরারুট অথবা মারি বিস্কুট গোছের নিউট্র্যাল বিস্কুট খেয়ে আমের আফটার-টেস্টটা তুলে নিতে হয়। চকলেট বিস্কুট একেবারেই চলে না, কারণ তাহলে তার নিজস্ব টেস্ট এসে পড়বে। এটা যে আমি খুব কঠোরভাবে পালন করি, সেটা রামমোহনও জানতো। ও নিজেও ভাল চায়ের ভক্ত ছিল। কাজেই ফার্স্ট ফ্লাশ চায়ের সঙ্গে চকলেট বিস্কুট দেখে খুশি হবার বদলে ওর অবাক হওয়া উচিৎ ছিল।”
জ্যাঠাবাবুর বিশ্লেষণটা যুক্তিপূর্ণ, কাজেই শুনতে শুনতেই হীরক ঘাড় নাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু তার আশৈশব বদমায়েশি স্বভাব, যেটা বড় হবার পর আরও ধারালো হয়েছে, সেটা ইতিমধ্যেই আমজ্যাঠার নতুন নাম ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। “আমগোয়েন্দা”? নাকি “আমকেশ” বা “শার্লক আমস”? “আমচাদা”? ভাবতে ভাবতে মুখ তুলেই হীরক দেখলো জেঠিমাও মুখে আঁচলচাপা দিয়ে প্রাণপণে হাসি চাপছে। নিজের পেট থেকে ভুসভুসিয়ে উঠে আসা হাসির দমকটা চাপা দিতে কথা ঘোরালো হীরক “জেঠু, সবই তো হলো, কিন্তু তুমি একটা বিরাট সামাজিক কেলেঙ্কারি করেছিলে। যদি দেখা যেত উনি সত্যি সত্যিই রামজেঠু? তাঁর মুখে সার্ফেস-ক্লিনার ছিটিয়ে দিলে, তাঁকে ভাইরাস মনে করলে … ইসসস, খুব এমব্যারেসিং একটা কাণ্ড হতো কিন্তু।”
রাজেনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন “সে ব্যবস্থাও সঙ্গেই ছিল।” তারপর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বের করলেন ওঁর রিভলভারটা।
“যে বন্ধু লক্ষ্মণভোগ আমের চেয়ে ‘আলফান্সো’কে ভাল বলে, তাকে কুকুরের মতো গুলি করে মারতে আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করতাম না, হীরক।”