খুব ভোরে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে অনাদিবাবুর। আজকাল এই হচ্ছে, শারীরিক পরিশ্রম নেই, ঘুম খাওয়া সবই কমে গেছে। কিছুদিন ধরে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছেন, আগে লক ডাউনের জেরে সেটাও বন্ধ ছিল। সরমাকে ডাকতে গিয়ে ভাবেন থাক, কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছে। আধ ঘন্টা পরে উঠলেও চলবে। স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে যায়।
এইসব স্বপ্নগুলো দেখলেই মন খারাপ হয়। ছোটবেলার স্বপ্ন, দেশের স্বপ্ন। ঢোলা হাফপ্যান্ট পরে খালি পায়ে স্কুলে যাবার স্বপ্ন। তরফদারদের পুকুরে ছুটির দিনে হাতছিপ দিয়ে মাছ ধরা। চড়কের বা রথের মেলার ভিড়ের স্বপ্ন। ধুতি ফতুয়া পরে বাবার ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। প্রতিটা স্বপ্নই শেষ হয় হারিয়ে যাওয়ায়। হয় মেলায়, নয় অচেনা কোন জায়গায়। তারপর বুক ধড়ফড় করে ঘুম ভাঙে ঘাম দিয়ে। হার্টটা একবার চেক করানো দরকার। কিন্তু এখন নিরুপায়। কবে সব খুলবে। যোগাযোগ চালু হবে। ফিরবেন দেশে, তারপর।
ছোটবেলার কথায়, দেশের কথায় লাল্টুর মুখটা মনে পড়ে যায় হঠাৎ। কদিন আগেই হোয়াটস অ্যাপে কল করেছিল। অনেক দুঃখের কথা বলেছিল যা কোনদিন বলে নি। পরে কল করবেন বলেছিলেন লাল্টুকে। এখনো হয়ে ওঠে নি। সময়টাই সমস্যা। সাড়ে এগারো ঘন্টার তফাৎ। তবু ভাবেন আজ রাতে করবেন কমলের ফোনে। লাল্টুর তখন তো সকাল।
অনাদিবাবু আর সরমা সাড়ে তিন মাস আগে এসেছেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ছেলে প্রবীর এক বড় আই টি কোম্পানিতে বড়সড় পোস্টে চাকরি নিয়ে এসেছে গত বছর। ওর কাছেই আসা ছ’ মাসের ভিসাতে। ভেবেছিলেন ঘুরে বেড়িয়ে দেশটা যথাসম্ভব দেখে ফিরবেন। এমন কপাল, ফেঁসে গেলেন করোনার চক্করে। তবে একদিক থেকে ভালো, এই বিপদে একসাথে তো আছেন। প্রথম কিছুদিন বেশ অসুবিধে হয়েছিল লক ডাউনে। প্যানিক বাইং শুরু হওয়ায় অনেক কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন বাইরে বেরোনো ছাড়া ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। প্রায় প্রতিদিন হোয়াটস অ্যাপে নিকটাত্মীয়দের ভিডিও কল করে আর নিত্য নতুন রান্নার ছবি পোস্ট করে কেটে যাচ্ছে কোনমতে।
বিছানা ছেড়ে, হাতমুখ ধুয়ে দু কাপ চা বানিয়ে সরমাকে ডেকে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে ব্যালকনির আরামচেয়ারটায় এসে বসেন অনাদিবাবু। সামনে সুনসান রাস্তা। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মনটা মুহূর্তে পৌঁছে যায় কলকাতায়।
উত্তর কলকাতায় অনাদিবাবু ফ্ল্যাট কিনেছেন বহু বছর। ওএনজিসিতে ভাল চাকরি করতেন আগে। রিটায়ারমেন্ট নেই নেই করে নয় বছর হয়ে গেল। ভালো চাকরির সুবাদেই হোক বা অনাদিবাবুর রাশভারী ব্যক্তিত্বের জন্য হোক পাড়ায় চ্যাংড়া থেকে বুড়ো, সবাই বেশ সম্মান দিয়ে কথা বলে। মজার ব্যাপার হল সবার উনি কাকাবাবু। অনাদিবাবুও পাড়ার খুচরো রাজনীতিতে জড়ান না নিজেকে। কেউ পরামর্শ চাইলে আন্তরিকভাবে নিজের বিচার-বুদ্ধি মত চেষ্টা করেন। বন্ধু তেমন কেউ হয়ে ওঠেনি আজ অবধি। শুধু ওই লাল্টুর সাথেই কথা বলতে যা ভালো লাগে একটু। দেশের গন্ধ পান, মাটির গন্ধ পান ওর কথায়।
লাল্টু মানে লাল্টু মহাপাত্র। পাড়ায় কমলের মুদীখানা কাম স্টেশনারি, কাম বেকারিতে কাজ করে। বাড়ি মেদিনীপুরের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে। নামটা এত শুনেছেন মুখস্থ হয়ে গেছে। পটাশপুর।
লাল্টু একটা অদ্ভুত মানুষ। লম্বায় খুব বেশি হলে সাড়ে চার ফুট। রোগা ফিং-ফিঙে চেহারা। একটূ কুঁজো হয়ে হাঁটে। মাথায় আধপাকা না-আঁচড়ানো চুল, গালে সাদা না-কাটা দাড়ি, গালদুটো তোবড়ানো ভেতরে ঢুকে থাকা। মুখে অজস্র বলিরেখা। অথচ অনাদিবাবু জানেন লাল্টুর বয়স অত বেশিও নয় যতটা দেখায়। গায়ে সব সময় একটা আধ-ময়লা ফতুয়া আর পাজামা হয়ে যাওয়া সুতির প্যান্ট। দোকানের ভেতরে খালি পা, বাইরে বেরোলে হাওয়াই। ওই একইরকম ফতুয়া আর প্যান্ট লাল্টুর কটা আছে তা নিয়ে পাড়ার ছেলেরা রীতিমত বাজি ধরে। লাল্টুকে বললে শুধু হাসে। সে অবশ্য সব কথাতেই। কম তো লাগে না সবাই ওর পেছনে। কিন্তু কখনো রাগতে দেখে নি কেউ। একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন অনাদিবাবু--
—তোমার রাগ হয় না লাল্টু?
—রাগ? কেন কাকাবাবু, রাগ কেন হবে?
—এই যে সবাই তোমার পেছনে লাগে, কত অকথা কুকথা বলে তোমার সামনে।
—সে ওদের মুখে ওরা বলছে… আমি রাগ করলে তবেই না সেগুলো আমার, না রাগলে ওদের কথা ওদের। তাছাড়া আমরা হলাম গে গরীব মানুষ। আমাদের রাগ করলে চলে, বলুন?
বলেই বরাবরের মত চোখ কুঁচকে হেসেছিল। লাল্টুর মুখের মত হাসিটাও স্পেশাল। হাসলে দেখা যায় ওপরের পাটির সামনের দু-খানা দাঁত নেই । তবুও হাসলে বোঝা যায়, এ হাসি ভেতরের হাসি, অন্তরের হাসি।
প্রথমবার লাল্টুকে অনাদিবাবু ‘লাল্টুবাবু’ বলে ফেলেছিলেন। শুনে কী লজ্জাই না পেয়েছিল। প্রায় হাত পা ধরে অনুরোধ করেছিল ও নামে না ডাকতে। ঠাকুর নাকি পাপ দেবে। সেই থেকেই একটু অন্য চোখে দেখে অনাদিবাবুকে। গেলেই বাইরে রাখা টুলটা কাপড়ে ঝেড়ে বসতে দেয়। কমল কাউন্টারে না থাকলে জুড়ে দেয় গল্প। আর গল্প মানেই পটাশপুর। একটা মানুষ, যে সারাজীবন কলকাতার সরু গলিতে কাটিয়ে দিল সে কী করে নিজের গ্রামের চৌহদ্দিতেই এখনো আটকে আছে কে জানে!
অবশ্য লাল্টুকে দোষ দিয়ে লাভ কি, অনাদিবাবুরও তো একই অবস্থা। সেই ছোটবেলার অবিভক্ত বাংলার গ্রামটার কথা তিনিই কি ভুলতে পেরেছেন আজও? সেই বেতের ঝোপ, কাদাভরা আলপথে খালি পায়ে হাঁটা। নদীর ঘাটে স্টীমারের ভোঁ। সোঁদা মাটির গন্ধ, কাশ ফুল, সন্ধেবেলা অন্ধকার উঠোনে গন্ধরাজ ফুলের বাস, রাতে ঘুমচোখে খাওয়া গাঢ় দুধ, মায়ের গায়ের গন্ধ। কিছু কি ভুলেছেন? বরং সযত্নে আগলে রেখেছেন বুকের মাঝে, যেন কংক্রিটের জঙ্গলে একখণ্ড সবুজে ভরা উদ্যান।
সেদিনের ফোনে লাল্টুকে বড় বিধ্বস্ত শোনাচ্ছিল। সব কিছু খুলে বলতে পারে নি। লাল্টুর তো স্মার্টফোন নেই, কমলের ফোন থেকে হোয়াটস অ্যাপ কল করেছিল। তাড়া ছিল বোধ হয় ফেরত দেবার। শুধু বলেছিল,
—কাকাবাবু, আপনি জলদি দেশে ফিরে আসেন। আমার তো আর কিছুই রইল না। একটা কথা বলার লোক পর্যন্ত নেই। এক আপনি ছিলেন। আপনিও বিদেশে। আমার সব গেছে কাকাবাবু। সঅঅব।
—কেন কী হয়েছে লাল্টু? সব ঠিক তো? শরীর ঠিক আছে? ছেলে কেমন আছে?
আচমকা ফোনটা আসায় কিছু বুঝতে না পেরেই বলেছিলেন অনাদিবাবু। বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে ওপাশ থেকে জবাব এসেছিল।
—ছেলে রাঁচিতেই। ওখানে চাকরি করত তো। ভালো আছে শুনেছি। ঠিক আছে কাকাবাবু, কমলদা ফোন চাইছে। এখন রাখছি…
—ঠিক আছে লাল্টু। আমিই পরে কথা বলব তোমার সাথে।
—কবে আসবেন কাকাবাবু?
—জানি না লাল্টু। কেউ জানে না…
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন অনাদিবাবু। ফোন কেটে দিয়েছিল লাল্টু। আজ ভেবে একটু অপরাধবোধ হয়। কোন কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে লাল্টু। খোঁজ নেয়াটা উচিত ছিল। অবশ্য কতদিক আর সামলাবেন। নিজেরাও তো একটা অনিশ্চিতের দোলায় দুলে চলেছেন। সে ভাবে ভাবতে গেলে হয়ত সারা বিশ্বই। মানুষের প্রাণের দাম কমে যাচ্ছে প্রতিদিন ভোরের খবরে। যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কার মৃত্যুসংখ্যা কত বেশি।
লাল্টুর জীবনটাও বড় অদ্ভুত। গ্রামের ছেলে, অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। কী যেন নাম বলেছিল হ্যাঁ, পারুল… এক ছেলে হল। তখনও লাল্টু গ্রামেই। পৈতৃক জমিতে দাদার সাথে চাষ করে। বৌদি ছেলের মত ভালোবাসে। সুখের সংসার। সুখে আগুন লাগল যখন পারুল ছেলের জন্মের পরে আর ভালো হল না। মেয়েলি সমস্যা লেগেই ছিল। খালি রক্তপাত আর রক্তপাত। শহরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারবদ্যি করেছিল যতটা সম্ভব। কিন্তু সবই বিফলে গেল। এক কাকডাকা ভোরে চলে গেল পারুল।
একদম ভেঙে পড়েছিল লাল্টু। কোলের ছেলে বৌদির হাতে দিয়ে বলেছিল “নাও আজ থেকে এই ছেলে তোমার।”
সেই যে ছেলে পর হল আর আপন হয় নি কোনদিন। দাদা-বৌদি উঠেপড়ে লেগেছিল আবার লাল্টুর বিয়ে দেবে। পারে নি লাল্টু বিয়ে করতে। ভাবলেই পারুলের বড় বড় চোখগুলো ভেসে উঠত।
ছেলের দায়িত্ব বৌদি নেয়ায়, ভবঘুরে বাউণ্ডুলে হয়ে ওঠে লাল্টু। বেড়িয়ে পড়ে বাড়ি ছেড়ে। নানান জায়গায় ঠোকর খেতে খেতে এসে থিতু হয় কমলের কাছে। কে জানে কেন ভালো লেগে যায় শহরের এই সরু গলি, ঘিঞ্জি পরিবেশ, কংক্রিটের জঙ্গল। তবে আগলে রেখেছিল পটাশপুরকে বুকের খাঁচায়। সেই অশথতলা, মণ্ডলদের পুকুর, শীতলা মন্দির, শীতকালের পাতা জ্বালানো আগুন, গাঁয়ের বুক চিরে হুস করে চলে যাওয়া কালো রাস্তা। সব ছিল ওখানেই। তবে নিজের ছেলেটা সত্যিই পর হয়েছিল। দাদা-বৌদিকেই বাবা-মা মানতো। কখনো বাড়ি গেলে কথাও বলত না লাল্টুর সাথে। পড়াশুনো শিখে চাকরি পেয়ে রাঁচি চলে গেল বড় হয়ে।
এসব লাল্টুর মুখেই শোনা। ঠিক এভাবে বলেনি হয়ত। অনাদিবাবু ওর মুখে শোনা টুকরো কথাগুলো জুড়ে নিয়েছেন শুধু। ছেলের কথা উঠলে বড় কষ্ট হত লাল্টুর। মুখে হাসিটা থাকলেও চোখগুলো ছলছল করত। ছবিও দেখিয়েছিল। ছেলের, পারুলের… ছেলের ছবিতে এক জড়সড় কিশোরকে দেখেছিলেন, যাকে লাল্টুর ছেলে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। পারুলের ছবিটা নামেই ছবি। শতভাঁজে দুমড়ে যাওয়া কাগজের টুকরো। বোঝা যায় কোনকালে ছবি ছিল কোন মহিলার। ব্যাস ওইটুকু। লাল্টু কিন্তু সেই ছবিতেই কাকাবাবুকে পারুলের ডাগর চোখ দেখিয়েছিল।
সারাটা দিন রুটিনমাফিক কেটে গেলেও লাল্টুর কথা মাথা থেকে বেরোল না অনাদিবাবুর। একটু বেশি রাতে সরমা আর প্রবীর ঘুমিয়ে পড়লে ব্যালকনিতে গিয়ে কমলকে ফোন করেন।
—কমল কেমন আছ? ওদিকের পরিস্থিতি কেমন?
—ভালো নেই কাকাবাবু। এখানে কেউ ভালো নেই। আমার দোকান স্যানিটাইজ করেছে মালশুদ্ধু। এমনিতেই ক’মাস ধরে ব্যবসা নেই, মাল যা ছিল সব স্প্রে করে নষ্ট করেছে। আমিও একঘরে বন্ধ। হোম কোয়ারান্টিন। বাড়ির লোকেরাও ঘরে ঢোকে না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা, যেন বেঁচে যাই এযাত্রা।
—এমন কেন হল? আর লাল্টু? আমি তো ওর সাথে কথা বলব বলেই…
—লাল্টু আর নেই কাকাবাবু। কারো কথা শুনত না, মুখে রুমাল বেঁধে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়ে শেষে রোগটা বাঁধাল। দোকানের পেছনে একটা ছোট ঘরে থাকত। ওখানেই পড়ে ছিল জ্বরে বেহুঁশ। আমিই ভয় পেয়ে খবর দিই। ওরা পিপিই পরে এসে তুলে নিয়ে গেল। তারপর দোকান সিল, আমি আটকা। পরশু রাতে ফোন এল… লাল্টু আর নেই। বডিও ওরাই… এতদিনের পুরোনো লোক…
গলাটা ধরে আসে কমলের। অনাদিবাবু পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকেন। আওয়াজ বেরোয় না। কমল বলে চলে--
— আপনাকে লাল্টু খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করত কাকাবাবু। তবে ভেঙে পড়েছিল কিছুদিন ধরে। যে দাদাকে ভগবান মানতো সেই নাকি কখন মিথ্যে বলে সই নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তির থেকে বেদখল করেছিল। ছুটি গিয়েছিল লক ডাউনের আগে। বাড়িতে ঢুকতেও দেয় নি।
—আর ছেলে?
—খবরটা আমি ফোন করে জানিয়েছিলাম ওর ছেলেকে। বলল “লাল্টু মহাপাত্র আমার কেউ হয় না”। কী আর বলি বলুন তো…
অনাদিবাবুর কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছে করে না। ফোনটা কেটে দেন উনি। কমল দুবার ফোন করে, তোলেন না। ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত ছেলের সামনে বসেন। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। প্রবীর চমকে উঠে বলে
—কি ব্যাপার এখনো ঘুমোও নি? শরীর ঠিক আছে তো?
—হ্যাঁ। এই তো, যাচ্ছি…