নিকটবর্তী মফঃস্বল থেকে মিনিট পঁয়তাল্লিশের বাসরাস্তার ওপারে এক গাঁ। গাঁয়ের বুক চিরে হেলেদুলে চলে গেছে কালো পিচ রাস্তা। কোথাও তার মসৃণ হাসি, কোথাও বা দাঁত বের করেছে বিশ্রীভাবে। বর্দ্ধিষ্ণু গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ কায়স্থের বাস। গ্রামীণ লাইব্রেরী, উচ্চমাধ্যমিক স্কুল, সাপ্তাহিক হাটবার, পরনিন্দা পরচর্চা এসব নিয়ে দিন এদের ভালোই কাটে। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ঐ পিচরাস্তা। দিনেমানে চারটি বাসের আনাগোনা। সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধে। শেফালি-পথিক-ঝুমু-আকাশ। সকাল আটটা থেকে সন্ধে ছটার চক্রে বাঁধা।
গ্রামের এমুড়ো থকে ওমুড়ো পর্যন্ত বার চারেক দাঁড়াতে হয় যেকোনো বাসকে। গাঁয়ে ঢুকতেই রক্ষাকালীতলা। বাস ওখানেই প্রথম দাঁড়ায়। বড়সড় চাতালকে বাঁ হাতে রেখে ছোট্ট একতলার মন্দির। মায়ের উপরেই গ্রাম রক্ষার ভার। সেকারণেই ছোট, বড়, বুড়ো, মাঝারি মাপের ও বয়সের মানুষেরা কপালে হাত ঠেকিয়ে এসে দাঁড়ায় বাসের হর্ন শুনে। আর যারা বাসের মধ্যে থাকে তারা চলন্ত বাসের জানলা থেকে জোরে চোখ বন্ধ করে মনে মনে ডাকে, “রক্ষা করো মা!”
রক্ষাকালীতলা পেরিয়ে দু-দশ পা এগিয়ে গেলেই হাট বসে। হাটের দিনগুলিতে ঐ জায়গাটা পেরিয়ে যেতে বেশ কাকুতি মিনতি করতে হয় বাসের খালাসি, ড্রাইভার এদেরকে--
“ও ভাই, মাছের ঝুড়িটা একটু সরকে রাখো।” উল্টোদিকে গামছা পেতে বাড়ির গাছের ফলন্ত দুটো পেঁপে নিয়ে বসেছে শাঁখারিপাড়ার হারান খুড়ো। সহসা নড়েচড়ে বসতে বলতে বড্ড মায়া হয় বাস ড্রাইভার মানিকের। ওদিকে আবার ফুলুদার লজঝড়ে সাইকেল বড় পেকুড় গাছে ঠেসিয়ে রাখা। গেছে তো গেছেই। ফেরার নাম গন্ধ নেই। পেট টিপে টিপে আলু পটল কেনার লোক ফুলুদা। বাজার করতে ঝাড়া একটি ঘন্টা লাগে তার। কেউ যেন তাকে কোনো ফাঁকেফোকরে ঠকিয়ে না দেয়, তাই নিয়ে সদা সন্ত্রস্ত সে।
ঢিকিস ঢিকিস করতে করতে বাস দোলমঞ্চতলায় পৌঁছায় পাক্কা পাঁচ মিনিট লেটে। বাবলু মাষ্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা দু চারটে মানুষের মুখে বিরক্তি ঝরে পড়ে,
“সকালের প্রথম বাস মানিক! লেট হলে চলে?”
“আমার গাড়ি টাইম টু টাইম চলে রাখহরিদা। কোনো শালার ব্যাটা শালা বলতে পারবে না, যে আমি টাইমে চালাতে পারি না।”
“নাও নাও আর লেকচার ঝাড়তে হবে না”—তারামণির দাদার কপালে ভাঁজ পড়ে। "তোমার প্যাসেঞ্জার তুলে এখান থেকে কেটে পড়ো তো হে...”
সকাল বেলায় বাড়ির সামনে এক বাস ভর্তি লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার বাড়ি দেখবে, এটা তারামণির দাদার পছন্দ নয়। ফুলের গন্ধের বদলে পেট্রলের গন্ধ ভেসে আসে এও কারণ। গ্রামের মানুষজন নিজেদের ভিটেমাটি বাপপিতিমের জায়গা সরকারি রাস্তার জন্য ছেড়ে দিয়েছে এই অনেক। মূল রাস্তার পাশে দু-চার ইঞ্চি বেশি ছাড়ার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। স্বাভাবিক নিয়মেই সিং গুষ্টির বাড়ি বাস রাস্তার গা লেগে দক্ষিণ দিকে। নাড়ু সিং-এর আদরের বোন কৃপালি এই বাড়ির মেয়ে।
##
জন্ম থেকেই কৃপালি খুঁতো। বাঁ পা একটু টেনে হাঁটে। বড় বড় ধূসর চোখে নিজের চারপাশ শুষে নেয়। সে দৃষ্টি উজ্জ্বল নয় আবার অনুজ্জ্বলও নয়, নির্লিপ্ত! হাসলে দুদিকের ঠোঁট সমানভাবে প্রসারিত হয় না। একদিক মজা নদীর মতো জমে থাকে। অপরপ্রান্তে শোভা পায় ঝকমকে সাদা দাঁতের টুকরো। হাঁটু ঘেরের ফ্রক পরা কৃপালি মায়ের পিছন পিছন এবাড়ি ওবাড়ির দাওয়ায় হেঁটে চলে বেড়ায় পা টেনে টেনে আর মায়ের কড়া ধমক খায়,
“কৃপালি তোকে না বারণ করেছি হাঁটাহাঁটি করে বেড়াতে! যা একজায়গায় গিয়ে বোস।”
মায়ের কড়া গলায় বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে কৃপালি ফিকফিক করে হাসে। মাথা অল্প অল্প দুলতে থাকে তালে তালে আর বিড়বিড় করে,
“বকছে! বকছে দ্যাখো! মা বকছে! আমি তো কথা শুনিনি তাই বকছে! দ্যাখো দাদা, মা বকছে!” এতটাই বিড়বিড় যে খুব যত্ন নিয়ে কৃপালির কথা শুনতে হয়। পাশে বসে মন দিয়ে না শুনলে শোনাই যায় না।
খেতে বসে বাবার শাসানি, “থালার সামনে থেকে দুধ ফেলে রেখে নড়বি না কৃপালি!”
তাতেও কৃপালির হি হি হাসি--“সব দুধ শেষ। দ্যাখো বাবা! কী করে শেষ হলো? এই খাচ্ছি, ফেলছি! খাচ্ছি, ফেলছি! ব্যাস একসময় শেষ হয়ে গেল।”
বই, খাতা, রঙ, পেন্সিল সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাশিকৃত হয়ে পড়ে থাকে কৃপালির। দুপুর গড়ালে কাজকর্মের অবসরে বাড়ির মহিলাদের চোখ এঁটে এলে রাস্তার ধারের ধুলো পড়া বারান্দায় খেলনাবাটি পেতে বসা চাই তার। গ্রীষ্মের দুপুর বিকেলের মুখ দেখার আগেই চারটের বাস এসে যায়।
ছোটো থেকে বাস দেখতে বড্ড ভালোবাসে মেয়েটা। মনে বড় সাধ বাসে চেপে দূর দূরান্তের গ্রামের ঘরবাড়ি গাছপালা ছুঁয়ে আসে। মানুষজনের ঘর সংসারের দলিল দস্তাবেজ দেখে আসে। বিকেলের বাসটা বেশ মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যায়। তাকে বিরক্ত করার লোকজনেরা সব ঝিমুতে ব্যস্ত সেসময়। বাসের জানলায় কত মানুষের মুখ। রঙ-বেরঙের জামা পরা। বাবার কোল ঘেঁষে জানলার দিকে বসে ছোটো খুকি। লাল ফিতেয় তার চুল বাঁধা। সেই ফিতে গেল হাটবারে ‘যা নেবে পাঁচ টাকা’ ফেরিওয়ালার কাছে কিনেছিল হয়ত। তার বেয়াক্কেলে আবদেরে বাবা খুব বকেছিল, তখন সে কী ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না মেয়ের। মেয়ের চোখের জল দেখে কি বাবা স্থির থাকতে পারে। চকচকে সাটিনের আরেকটি লাল ফিতে কিনে দেয়। এখন সে ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’। বাসের ডানায় ভর করে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে বসে। কৃপালিরও যদি ডানা থাকত খুঁতো পায়ের বদলে!
আরেকটা জানলায় সেদিন দেখেছিল কাঁচপোকার টিপ পরা তেল চুকচুকে চুলের মহিলাকে। বাসের ঝনঝনে কাচের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ক্লান্তির ঘুম নেমে এসেছিল তার চোখে। দুধের শিশুটি কোলে হাত পা ছড়িয়ে খেলতে লেগেছিল। কচি হাতের হাতছানি গড়িয়ে আসছিল জানলা বেয়ে। এসব দেখে কৃপালি গুনগুন করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসেছে। হাসির সুখে থুতু বুড়বুড়ি কেটেছে মুখে।
মজিদ মাষ্টার গ্রামের স্কুলে আরবির শিক্ষক। বাসে জানলার ধারে সিট না পেয়ে মজিদ মাষ্টারের বুড়ি মাকে সেদিন দরজার পাদানিতে ঝুলতে দেখেছে কৃপালি। চামড়ায় ভাঁজ ওঠা বুড়ির কপালে বিনবিনে ঘাম জমে। বাসের ঠাসাঠাসি ভিড়ে বুক যেন ধড়ফড় করে তার। তবুও পোতাপুতির জন্য ধুকি, আস্কে, টিফিন কৌটোয় গাদাগাদি করে নিয়ে পথে বের হয়েছে। মজিদ মাষ্টারের ছেলেমেয়েগুলো যে আসার সময় পায় না, পড়াশোনা করে বড় বড় স্কুলে।
এরকম মানুষগুলোকে দেখলে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে কৃপালির, নাকের পাটা ফুলে ওঠে। বাসটাকে সব শক্তি দিয়ে টেনে দাঁড় করিয়ে দিতে চায় তার ইচ্ছেগুলো। লুতফুন বিবিকে বাস থেকে নামিয়ে, ঘাম মুছিয়ে জল খাওয়াতে মন চায়। আম গাছের তলায় বুড়িকে জিরোতে বলে মজিদ মাষ্টারকে চাট্টি কথা শুনিয়ে আসবে যেন। চোখটা ঘোলাটে হয়ে আসে ক্রমে। অসহায় কৃপালি হাঁটুঘেরের ফ্রকটাকে খামচে ধরে, বিড়বিড় করতে থাকে অসহ্য আক্রোশে--
“হারামির বাচ্চা! মাষ্টার! উঁ মাষ্টার!" গালাগালির উষ্ণতা ছিটকে আসে বিরক্ত থুতুর ঢেউয়ে--“ও মানিক দাঁড়াও খানিক!”
লোকে হৈ হৈ করে ওঠে, “ঐ দ্যাখ! সিংবাড়ির মেয়েটা ক্ষেপিই হবে! কৃপালি ক্ষেপি! বাসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করছে।”... হো হো!... হা হা!... হি হি!...
##
প্রকৃতির নিয়মে কৃপালি বড় হয়। মনে শরতের কিশোরী মেঘ রৌদ্র লুকোচুরি খেললেও সে এখন শরীরে সম্পূর্ণ নারী। শিশু অবস্থায় সাধারণত মানুষ প্রধান দুটি ভাবের প্রকাশ ঘটায় কোনো ছলচাতুরি ছাড়াই, হাসি আর কান্না। কিন্তু কৃপালি কোনোদিন কাঁদেনি। বাবা মায়ের প্রশ্রয়, আদর, স্নেহের শাসনে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসেছে আর বলেছে, “বকছে দ্যাখো...বকছে! ...” পাড়া প্রতিবেশী সহজভাবে কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করলে বারান্দার ধারে পা দোলাতে দোলাতে উত্তর দিয়েছে,
“আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?...”
হাসিখুশি, দিঘির মতো শান্ত, আপনমনে চাতালে পা দুলিয়ে হাসে আর বিড়বিড় করে। যেহেতু বাস আসা যাওয়ার সময় নতুন প্রেমের ভর হয়, সেকারণে বাসের গা ঘেঁষে না বসলে বা দাঁড়ালে তার জীবন অশান্তিতে ভরে যায়। কত বিচিত্র জীবন, জীবনের গল্প ছড়িয়ে পড়ে বাস থেকে গ্রাম গ্রামান্তরে। এলিয়ে যায় গ্রাম থেকে শহরে। নিবিড় নিপাট সময় তার কাঁধের ঝোলা থেকে পথে পথে ছড়িয়ে দেয় কত শত জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না। তাই কৃপালির বাস দেখে আশ মেটে না। বাস আসা যাওয়ার সময় কাছিয়ে এলেই স্নায়ুরা একে অপরের সামনে অসি ঝনঝনিয়ে যেন বা বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। কৃপালিকে আর ঘরে আটকে রাখা যায় না। খুঁড়িয়ে খঁড়িয়ে বারান্দায় এসে বসে সে।
বয়স্কা কৃপালি এখন অনেক কিছুর কারণ। বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ। গ্রামের বেকার জীবনের মজলিসি আড্ডায় হাসি ঠাট্টার খোরাকের কারণ। কেউ কৃপালিকে বোঝে না। একমাত্র বোঝে বাস ড্রাইভার মানিক। এই রুটে মানিক পনেরো কুড়ি বছর বাস চালাচ্ছে। সিং বাড়ির মেয়েটাকে সবাই পাগল বলে হাসাহাসি করে। কষ্টে মানিকের গলার নলি তেতো হয়ে আসে। কারো পাকা ধানে কৃপালি মই দেয়নি। শুধু বাস এসে দাঁড়ালে বাসের দরজার সামনে নিবিষ্ট হয়ে যাত্রীদের ওঠানামা দেখে। সেদিন এক পকেটমার সত্যজেঠুর ফতুয়ার পকেট কেটে কটা ন্যাতানো নোট হাতানোর চেষ্টা করেছিল। দিল সবাই ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে। কৃপালির সে কী খুশি। আনন্দে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসি—“চুরি করবে! চোর! চোর! চুরি করবে! চোর চোর!”
কৃপালি রেগে যায় বাস বন্ধ থাকলে আর কোনো অন্যায় দেখলে। কোনোদিন বাস বন্ধ থাকলে পরদিন বাস এসে দাঁড়ালেই ড্রাইভারের দরজার কাছে কৃপালি ঘুরঘুর করে--“মানিক বাস কেন এল না! বাস কেন এল না! ও মানিক!” অনেক বুঝিয়ে নিরস্ত করতে হয় কৃপালিকে। মাথায় ঢোকে ‘কাল বাস খারাপ ছিল।’ সেই ইস্তক দুষ্টু ছেলেপিলের দল সুযোগ পেলেই কৃপালির কাছে গিয়ে বলে, আ বা খা ‘আজ বাস খারাপ’। একথা শুনলে চোখে অন্ধকার নেমে আসে তার। দুর্নিবার রাগের ঢেউ ছিটকানো থুতুর বন্যা নামায়। ম্যাড়মেড়ে চব্বিশ ঘন্টায় বাস আসা যাওয়ার সময়টুকুই তার জীবনে আনন্দের বৃষ্টি নামায় যে।
এসব দেখে মানিকের বড় কষ্ট হয়। মনে মনে সে ভাবে, মানুষ বড় বেয়াক্কেলে।
##
সেদিন কৃপালি সকাল থেকেই খুশ মেজাজে। বাসের এক ফুটফুটে বাচ্চাকে সক্কাল সক্কাল চকলেট খেতে খেতে নামতে দেখেছে। দুপুরের বাসে মুখে হাসি মেখে পাড়ার দাদা বৌদি গেছে শহরে। প্রতি মাসেই এরা যায়, আবার ভালোবাসার হাতে হাত রেখে সময়ের মাপে বাড়ি ফিরে আসে। বিকেলের বাসও ফুরফুরে মেজাজে চলে গেছে।
সন্ধের বাসের অপেক্ষায় কৃপালি এখন অধীর।
সময় পেরিয়ে যায় তবু বাস আসে না। ‘বাস কেন আসে না!’ এলাকার লোকের কাছে এটা যে লাস্ট বাস। কৃপালির স্নায়ুরসের উত্তাল ঢেউ মান্য সময়রেখাকে হারিয়ে দেয় একসময়। সাতটা এক... সাতটা দুই... সাতটা পাঁচ... সাতটা দশ... ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে তার। বারবার দু-চার পা খুঁড়িয়ে রাস্তার মাঝে নেমে দেখে। গ্রামের পোলের টিমটিমে আলো আর আকাশের তারার যৌথ ঘোষণায় তখন অন্ধকারের শ্বাসপ্রশ্বাস জড়িয়ে ধরেছে মানুষী স্বত্বাকে।
অবশেষে বাস ঢোকে দোলমঞ্চতলায়। বাসের দরজার ভিড়ের ঢেউ আছড়ে পড়ে কালো পিচে। উত্তেজিত মানুষগুলোর চলাফেরা কথাবার্তার পাশ কাটিয়ে দুপুরের হাসমুখ দাদা রক্তমাখা কপাল নিয়ে নেমে আসে। কিন্তু বৌদি কই! দাদার কপালে এত রক্ত কেন! কৃপালির ঠোঁটের মজা নদীতে লালার ঢেউ বাঁধ ভাঙে।
হাঁটুঘেরের ফ্রক খামচে ধরে কৃপালি। এত লোক চেঁচিয়ে কী বলছে! বৌদি ফিরে এলো না কেন! তার কথা কেউ শুনছে না। বোবা ঠোঁটেদের ভাষা আজ কৃপালির কাছে দূর্বোধ্য। কেউ তো হাসছে না। বারান্দার খুঁটি ধরে বসে পড়ে সে। তরল প্রশ্নেরা ধূসর চোখের পাতা ছেড়ে জনস্রোতে ডুবে যায়। তারা মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠে কান্নায়। বৌদি কই! দাদা একা এল কেন! নিশ্চুপ উত্তরের দলের মনে মেঘ জমেছে তখন। আর্ত ক্রন্দনে বাস ছেড়ে যেতে চায়।
কৃপালি বিড়বিড়িয়ে ওঠে, “... ও মানিক! দাঁড়াও খানিক! ... কিছুতেই এ বাসের চলে যাওয়া হবে না! দাদার সাথে বৌদিকে কেন নিয়ে এল না। ও মানিক! দাঁড়াও খানিক! ও মানিক!...”
##
এরপর জীবনের এই খামখেয়ালিপনায় খুঁতো হাসিখুশি কৃপালি বেবাক জ্বরো রুগি হয়ে আঁকড়ে ধরে বিছানা আর মায়ের কোল। দোলমঞ্চতলায় বাসের হর্ন একলা দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে, ওদিকে ঘরে বালিশে মুখ গুঁজে মায়ের কাপড়ের খুঁট টেনে ধরে কৃপালি। যেন কোন দুর্বোধ্য অকারণেই বাস তার প্রিয় সখীর বিরহে বিরহী। বাসস্টপে বাস ধরতে আসা এলাকার লোকজন ভাবে কৃপালি ক্ষেপি থাকলে বেশ রগড় জমত। বাস ড্রাইভার মানিকের বড় তনছিট লাগে, ভাবে একদিন অন্য কাউকে ড্রাইভারির দায়িত্ব দিয়ে কৃপালির খোঁজখবর নিতে যেতে হবে। ওদিকে কৃপালির বাড়ির লোকজন অনেক স্বস্তিতে, যা করে করুক, ঘরেই করুক। বাইরে তো যাচ্ছে না!
এভাবেই চলতে চলতে সেদিন বিকেলে কৃপালির দোতলার বন্দি জানলায় একটা লাল টুকটুকে ঠোঁট পাখি এসে বসল। গত একমাসে কৃপালি রঙ দেখতে ভুলে গিয়েছিল, তার ধূসর চোখে শুধু কালো কান্নার রেখা, ছবিহীন, আলোহীন অন্ধকারের হাতছানি যেন। বুকে চাপ ধরে আসত তার। তাই আজ অবাক হয়ে লাল ঠোঁট পাখিটিকে দেখছে, কী সুন্দর সবুজ ঢালা ডানা। সেই ছোটোবেলায় ছবিতে সে পাখি দেখেছে। হঠাৎ পাখি ডেকে ওঠে, অবিকল বাসের হর্ন যেন। কান্নার মতো শব্দের তীব্র ঢেউ আছড়ে পড়ে কৃপালির ঘরের পর্দায়। গুঙিয়ে ওঠে কৃপালি, মা ছুটে আসে।
কৃপালি বিড়বিড় করে, “বাস... বাস...মা...ঝুমু আসছে...” পরপর সব বাসের নাম বিড়বিড় করতে থাকে।
কৃপালির মা আদর করে বলে, “ধুর বোকা মেয়ে! এতো পাখি... দ্যাখ কেমন ডানা আছে, উড়তে পারে!”
“উড়তে পারে! উড়তে পারে! অনেএএএক দূরে যায়, বাসের মতো...!”
সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে মা কৃপালিকে বলে, “যায় তো... বাসের থেকেও বেশি দূরে যায় মা! কত গ্রাম, শহর ছাড়িয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়। গাছে গাছে নেচে বেড়ায়! বাসা বাঁধে।...”
কৃপালির ধূসর চোখে আলোরা হেসে লুটিয়ে পড়ে, মাথা দুলতে থাকে কৃপালির, “পাখি ভালো... পাখি ভালো ... বাস বাজে ... বাস বাজে... ”
এখন কৃপালি সকাল- দুপুর– বিকেল- সন্ধে চারবার লাল ঠোঁট সবুজ ডানা পাখিকে ছোলা, বিস্কুট খাওয়ায়, কত গল্প করে। পাখিরা যে উড়ে উড়ে অনেক গল্প জমায়, ঠিক বাসের মতো। দোলমঞ্চতলায় বাসের হর্ন বাজলেই কৃপালি বিড়বিড় করে, “...মানিক ও মানিক! দাঁড়াও খানিক! তোমার ঝুমু বাজে... আমার টিয়া ভালো... ” বলে বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে হাওয়ার ডানায় ভেসে যায়... ভাসতেই থাকে... কত দূরের গ্রাম শহর দেখবে... কত মানুষ দেখবে... তখন বাইরে একটা লাল টুকটুকে সবুজ ডানার টিয়া কৃপালির জানলার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে দূর আকাশ বেয়ে কোন অচিন জনপদের গল্পকথা জুটিয়ে এনে কৃপালির কানে কানে বলে যায়। কৃপালির চোখে ভেসে ওঠে সারি সারি বাসের জানলা... জানলায় লাল জামা পরা দুষ্টু ছেলের বায়না... গোমড়ামুখো কাকুর ঝুলো গোঁফ... কলেজ পড়ুয়ার দুলন্ত বেণী আর তার লুটিয়ে পড়া সবুজ ওড়না...
কৃপালির মাথা অল্প অল্প দুলতে থাকে, কৃপালি হাসে, কৃপালির মাথা দোলে, কৃপালি আবার হাসে আর বিড়বিড় করে... “ও মানিক দাঁড়াও খানিক! ... তোমার ঝুমু বাজে... আমার টিয়া ভালো...”
ইদানীং দোলমঞ্চতলায় একলা বাস যান্ত্রিক হর্ন বাজিয়ে এবেলা ওবেলা চলে যায়।