• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | গল্প
    Share
  • গৌর দাস : হীরক সেনগুপ্ত




    গৌর তিনদিন ব্যাঙ্কে আসছে। কাজ হয়নি। আজকাল ব্যাঙ্কের কাজে সময় লাগে। গৌরের কাজটা যদিও সামান্যই।


    গৌর দাস। অতীত ফুটবলার। চওড়া কাঠামো। 'বকুল-মুকুলের' গ্রুপ 'ডি'। বয়স আটান্ন। ব্যাঙ্কে আসে বৃহস্পতিবার দেখে। ভিড় কম।


    গৌর টাকা তোলে স্লিপে। লিখতে গিয়ে বিপত্তি। কলমে লেখা পড়ছে না। ও কিছু নয়। গ্রুপ 'ডি'-র জীবনে হাজারটা ফ্যাকড়া। আশ্চর্য হলে চলে না।


    কলমটা গতকাল কেনা। দিব্যি সকালে কাগজের কোনায় নকশা এঁকেছে। চমৎকার দাগ পড়ছিল। এখন পড়ছে না।


    খবরের কাগজে আঁকা গৌরের অভ্যেস। কলিগরা হাসে। গৌর বেপরোয়া। সবচেয়ে সস্তা কাগজটা কেনে। পড়ে না। ছবি আঁকে। ইস্কুলেও আনে। ফাঁক পেলেই আঁকিবুকি।


    গৌরের ছবি আঁকার ঠিক নেই। কাল ছিল অর্থমন্ত্রীর মাথায় অ্যানটেনা। ল্যাজওলা বাঘের পেছনে মুখ্যমন্ত্রী। লম্বা লম্বা কান। আগেরদিন ছিল ফুটবলের গায়ে ডানা।


    কলিগরা কাগজ আনে না। পড়ার সময় নেই। সকাল হলেই লাইন। ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র। মন্টুরামের ভূগোল। ফচকে। বলল, 'গৌরদা, নকশাটা কিন্তু ব্যাপক হয়েছে।'

    এটা মন্টুর ঠাট্টা। গৌর হাসে, 'ভালো হয়েছে ? বাহ সিয়েট খাও।'

    মন্টু ভেবেছিল গৌরদা চটে যাবে। উল্টে একটা সিগারেট দিল।

    'থ্যাঙ্কিউ।'


    সকালেই দাগ পড়ল। এখন লেখা পড়ছে না। এটা কলমেরই মস্করা! লোকজন কম। কার কাছে কলম চাইবে। মুখের ওপর যদি ফস করে বলে, 'একটা কলমও আনতে পারেন না!'


    এদিকওদিক দেখে। অল্প ক'জন স্টাফ। নতুন মুখ। একদিন গুনেছে। এঘরে আগে ২৫/৩০ জন বসত। অনেক কাউন্টার। এখন আঠেরোটা চেয়ারই খালি। এক-একজন সাত-আট রকমের কাজ করে।

    ১০

    বসার সুবিধা নেই। তিনটে করে স্টিলের চেয়ার। টেবিল নেই। লেখার অসুবিধা। সিকিউরিটিতে এক চিলতে জায়গা। লিখতে পারলে লেখো।

    ১১

    ঘড়ি দেখে। তিনটে দশ। মাথা নিচু। ভাবছে চলে যাবে কি? ঠিক তখনই হয়ত ঢুকেছিলেন বয়স্ক লোকটি। খেয়াল করেনি।

    ১২

    ফস ওই ভদ্রলোকই বললেন, 'কি কলম আনেন নি তো?'

    কথায় মজার ধরন। তারপর নিজেই বুক-পকেট থেকে কলমটা দিলেন।

    'নিন—'

    ১৩

    ঘটনাটা এক ঝলক মনে আছে। 'র' সিল্কের হাফ-শার্ট। ঘিয়ে রঙ। চওড়া কব্জি। চামড়ার বেল্টে ঘড়ি। খেলোয়াড়ের মত ছটফটে। শাঁ করে দৌড়ে গেল। ক্যাশ কাউন্টারে।

    ১৪

    গৌর চটপট ফর্ম লিখছে। এক্ষুনি কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। নাম। অ্যাকাউন্ট। টাকার অঙ্ক। সই চার-পাঁচ মিনিটের কাজ। জমা দিয়ে শান্তি।

    ১৫

    দেড়-হাজার টাকা। দু'বার করে গোনে। বুক পকেটে রাখে। কলমটা হাতেই ছিল। ফেরত দিতে গিয়ে দেখল ভদ্রলোক নেই। বড় হলঘর। কোথাও নেই।

    ১৬

    চেয়ারে ওয়েট করে গৌর। হয়ত ম্যানেজারের ঘরে আছেন। ওঁর মুখটাই ভালো করে দেখা হয়নি। ইস! কিছুক্ষণ উসখুস করে। ম্যানেজারের ঘর থেকে একজন বেরোল। গৌর ছুটে যায়।

    ১৭

    'দাদা, আপনার কলমটা—'

    'আমার কলম?'

    লোকটি আশ্চর্য। হ্যান্ডব্যাগের চেন খোলে। ভেতরটা দেখে নেয়। 'না তো। এই তো আমার কলম।'

    একটা কলম দেখায়।

    'ও, আচ্ছা। আমি ভাবলাম আপনিই কলমটা লেখার জন্য দিয়েছিলেন—'

    'না। আমি কোন কলম আপনাকে দিইনি।'

    'সরি।' গৌর চিন্তিত। ভদ্রলোক গেলেন কোথায়?

    ১৮

    সিকিউরিটি এতক্ষণ দেখেছিল। এগিয়ে আসে। 'আপনার কাজ মিটে গেছে?'

    'আজ্ঞে...ইয়ে একটা সমস্যায় পড়েছি।'

    'বাইরে যান। গেট বন্ধ করব।'

    'কিন্তু একজনের… '

    'ওসব পরে হবে। বাইরে যান। গেট বন্ধ হবে।' গৌরকে পাত্তা দিল না।

    ১৯

    ব্যাঙ্কের বন্ধ দরজার সামনে ঘুরঘুর করাটা বিশ্রী। গৌর ইতস্তত করে। খানিক পর হাঁটা লাগায়। ওই কলমটা এখনও বুক-পকেটে। হাতে নেয়।

    দামি কোম্পানির ডট। সরু কালো বডি। সোনালি রিং। সবে যেন গ্যালারি থেকে মাঠে নেমেছে। কলার তোলা রংবাজ। চকচকে জেল্লা ঠিকরে বেরোচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় দামি।

    ২০

    একটা কলমের কাহিনী গৌরেরও ছিল। সে অনেক আগের কথা।

    ২১

    মহুল দিয়েছিল। গৌর তখন নিজেও ছাত্র। সন্ধ্যায় স্টুডেন্ট পড়ায়।

    'স্যার, এটা আপনার জন্য।'

    গোলাপি মোড়ক। চওড়া সাদা রিবন। চমৎকার ফুলওলা গিঁট। ভেতরে কী আছে? বই মনে হয়। 'এটা কী?'

    'নিন না। আপনার জন্য। মা পাঠিয়েছে।'

    'তোমার মা?'

    'হুঁ।'

    কৌতূহলে মোড়ক খোলে। যত্নে সাজানো একটা ডায়েরি। আর কলম।

    'একী! উপহার মনে হচ্ছে!'

    মহুল উত্তর দেয়নি প্রথমে। পরে বলল, 'হ্যাঁ স্যার। মা বলল। আজ নাকি আপনার জন্মদিন।‘

    'আমার জন্মদিন, তোমার মা জানেন!'

    'সত্যি। মা পাঠিয়েছে।'

    'আচ্ছা বেশ। তবে এ কেমন উপহার!'

    ২২

    মহুলের গভীর দৃষ্টিতে সংশয়। হঠাৎ যেন স্তব্ধ হওয়া ঝরনা। চঞ্চল টুংটাংয়েরা স্ট্যাচু। গৌর গম্ভীর। ডায়েরির পাতা উল্টে যায়।

    'কেন স্যার কিছু ভুল হয়েছে?'

    'হুম। তা তো হয়েছেই।'

    মুখ শুকিয়েছে মহুলের। 'কী গোলমাল স্যার!'

    'আমার উপহার। নাম কই?'

    'ওহ…'

    ২৩

    প্রবল উত্তেজনা ...কী আশ্চর্য অভিমানে বদলে গিয়েছিল মহুলের গলায়। মাথা নিচু। ওড়না কামড়ে যাচ্ছে।

    গৌর হাসছে। কলমটা বাড়িয়ে দেয়। 'সব ঠিক হয়ে যাবে। ঝট করে আমার নামটা লিখে দাও দেখি।'

    প্রস্তাবটা আন্দাজ করেনি। মহুল তাকিয়ে। বৃষ্টিশেষে ঘাসের মাথায় জলের দৃষ্টিতে। শেষে ওই কলমেই প্রাণভ'রে অসমাপ্ত 'গৌর..' লিখে দেয়।

    ২৪

    আজ পকেটে অন্যের কলম। ফেরত দেওয়া হল না ...

    ২৫

    ভাবতে ভাবতে স্টেশন এসেছে। লোকজনের দৌড়ঝাঁপে খেয়াল হয় স্টেশন। গৌর হৃদয়পুরে থাকে।

    চারটে তেত্রিশ বেরিয়ে গেছে। বনগাঁ চারটে একান্নয়। বেজায় ভিড় হয়। গাদাগাদি পছন্দ নয়। আগে হলে? ভিড়ের মধ্যেই ড্রিবল করে ঢুকে যেত। ফাঁকাই এল বনগাঁ। ট্রেনে উঠে বোঝে শনিবার।

    ২৬

    হৃদয়পুরের জমিতে আগে ছিল বেড়া আর পলকা ইঁটের গাঁথনি। টালির চাল। দুটো ঘর। ঘেরা বারান্দায় রান্না।

    তিন ভাই, এক বোন। খেলার সোর্সে বড়দার চাকরি হল জামশেদপুরে। ফার্নেস ব্লাস্টে মারা গেল। মেজদাও টাইফয়েডে। বোন ড্রাইভারকে বিয়ে করে।

    ২৭

    গৌর নিয়মিত অন্ধকার থাকতে ময়দানে যায়। ফুটবল খেলছে। সেকেন্ড ডিভিশন। খোলা মাঠ।

    সেবার আর এক পয়েন্ট... জিতলেই নেক্সট ইয়ার ...ফার্স্ট ডিভিশন ...ঘেরা মাঠ... ভরা সাপোর্টার…

    ২৮

    …ঘেরা মাঠে ফুটবল তখন স্বর্গ। সবুজ ঘাসে কালো স্পাইকের বর্বর সোহাগ। ...বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ ...হলুদ-কালো বল ...ভাসিয়েছে ... সোয়ার্ভ করে... পোস্টের কোণ ঘেঁষে জড়িয়ে যাচ্ছে জালে…

    লাইন্সম্যান ফ্ল্যাগ হাতে দৌড়ে আসছে...অফ সাইড! ...না অফ সাইড নয়...রেফারির তীক্ষ্ণ হুইসিল …

    ২৯

    ...আবার অপোনেন্টের ...ডিফেন্স ভেঙ্গে.. গৌর দাস ঢুকে গেছে. সেন্টার ফরোয়ার্ডকে আউট সাইড ইন সাইডে ছিটকে….সতের সেকেন্ডে…গোওওওল!

    ৩০

    … গাদা গাদা ...মুঠো ভর্তি ছোলা... উঁচু করে ছড়িয়ে দিচ্ছে ...একঝাঁক মাউন্টেড পুলিশ ঘোড়া ...টগবগ আসছে খেতে…

    এই এক পয়েন্টে আজ আরও দুটো সেদ্ধ ডিম গৌর বাড়ি যেতে যেতে খোসা ছাড়িয়ে নেবে… ডিমে মহুলের নরম গন্ধ...

    ৩১

    … ঘিয়ে রঙ র'সিল্কের শার্ট। হাফ হাতা ...অল্প গোটানো.. বাঁ হাতে জিপের স্টিয়ারিং .…ঘন জঙ্গলের এবড়োখেবড়ো রাস্তা...একপাল হাতি ...পাহাড়ের মাথায় কালো মেঘের মত ... মহুল ভয়ে জড়সড় ...গৌরদা…!

    ৩২

    বাবার ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু।

    ৩৩

    গৌরের গায়ে মাথায় জার্সির ধুম জ্বর ... বক্সের বাইরে থেকেই.. তিনকাঠির ঠিকানা লেখা বল ...তখন নিশ্চিন্তে উড়ে যাচ্ছে গন্তব্যস্থলে ...দূর থেকে সাইডলাইন ধরে ফ্ল্যাগ তুলে দৌড়ে আসছে কেন লাইন্সম্যান ...!..মাঠ খেপে উঠেছে…লালকার্ড! কেন লালকার্ড!

    গৌর দাস ছিটকে যাচ্ছে ...অনিচ্ছাকৃত ফাউলে... এটা পার্শিয়ালটি …

    ৩৪

    'বকুল-মুকুলে’ 'গ্রুপ ডি' কোয়ালিফাই করে হেরে গেল।

    ৩৫

    গৌরের দুই মেয়ে। টুসি বিয়ের চার বছর মাথায় বিধবা। মেয়ে নিয়ে আবার হৃদয়পুর। মৌয়ের কলেজে। টানাটানির সংসার ছিলই। সেটাই রয়ে গেল।

    ৩৬

    সবাই শুয়ে পড়লে কলমটা বের করে গৌর। মোবাইলের আলোয় নেড়ে চেড়ে দেখে।

    একদম নতুন। ঢাকনার সঙ্গে লাগানো রিফিল ভেতরে স্প্রিং। উজ্জ্বল সোনালি ক্লিপ আর টপ চকচকে। খবরের কাগজে দাগ দিল। নিঃশব্দ ইএমইউয়ের ইঞ্জিন.. ছুটে যায় মসৃণ দাগে।

    ৩৭

    যেন মাখন… বাতাসে ভেসে যাচ্ছে...হলুদ-কালো ...পোস্টের কোণ দিয়ে ...বাঁক নিয়ে ঢুকে গেল … কেমন একটা লোভ হয় … শিরশির করে শরীর... স্টেডিয়াম ভর্তি সাপোর্টার… চিৎকারে কানে তালা ধরেছে ...মেক্সিকান ওয়েভ খেলছে বাতাসে… ভুভুজেলার রংবাজি...চিৎকার করে...ফাটিয়ে দেয়

    হৃদয়পুর..

    ...গৌ..উ..র….গৌ..উ..র ..

    ৩৮

    অত রাতেও আলো জ্বলছে। মহুল ধড়ফড় করে উঠে। 'কি গো ঘুমোও নি?'

    'এই তো ঘুমোবো।'

    'হাতে কি ওটা?'

    গৌর একটু আড়াল করার চেষ্টা করে।

    'ওই একটা কলম।'

    'কলম, মানে!' মহুলের ঘুম উড়ে যায়। বেকায়দা উত্তরে। আলো জ্বালাতে যাচ্ছিল। গৌর বাধা দিল।

    'এইতো আলো।'

    ৩৯

    ফোনের আলো হীরের মত জ্বলজ্বল করে। অন্ধকারে আবছা মহুল। কলমের অরোরা বোরিয়ালিস... বাঁক নিয়ে কোনাকুনি উঠে আসছে। ব্লাউজের নিচ বোতামহীন ...সমস্ত ডিফেন্ডার উঠে গেছে মাঝমাঠে … ফর্সা বর্তুল চামড়ায় হলুদ-কালো চেকনাই…

    হারমোনিয়ামের রিডের মত ভাঁজ হয়ে থাকা গ্যালারির আঁচল। স্ফীত বুকের ওপর দিয়ে কাঁধের ওপাশে। রেফারির বাঁশির মতো উন্মুখ, সতর্ক অথচ দ্রুত মহুলের কন্ঠ, 'এ কলমটা কার…'

    গৌর সবটা বলল। মহুল কি আশ্চর্য হয় না?

    'ভারী একটা কলম। ভাবলাম কি না কি। কালকে ফিরিয়ে দিও। শুয়ে পড়ো।'

    গৌর কথা বাড়ায় নি। চুপচাপ শুয়ে পড়ল। কানে তালা ধরা চিৎকার হইচই…কারা করছে এমন প্রচণ্ড কলরব?

    ৪০

    সোমবার মন পড়ে রইল কলমে। বের করার সাহসও হয়নি। যদি ইয়ারকি মেরে কেড়ে নেয়! কাউকে বলেনি। এক মহুল জানে। ইস্কুলে হাফ-ডে সিএল হয় না। তবুও একে তাকে বলে ম্যানেজ হল। বেরোল দুটো পঞ্চাশ।

    ৪১

    ব্যাঙ্কে পৌঁছতে তিনটে পনেরো। কুইক। সোজা সিকিউরিটির কাছে। শনিবারের লোকটা নেই। এ লোকটার ধৈর্য আছে। গৌরের কথা শুনল।

    'কেউ কলমের খোঁজে এসেছিল ভাই?'

    'না। এলে তো বলেই দিতাম।'

    'তা ঠিক।'

    'আচ্ছা একটু ওয়েট করি।'

    'চেয়ারে বসে যান।'

    ৪২

    অপেক্ষাই সার। কেউ আসেনি। গৌর কাউন্টারে আসে। অল্পবয়েসি মেয়ে টাকা গোছাচ্ছে।

    'কত টাকা?'

    থতমত খেয়ে গৌর বলে, 'টাকা তুলব না।'

    'তবে?'

    সংক্ষেপে কারণটা বলে। কাউন্টার বন্ধ করে মেশিনে টাকা গুনছে। শেষে বলে,

    'এনকোয়ারিতে যান।'

    ৪৩

    এনকোয়ারিতে লাভ হল না। কলমের খোঁজে কেউ আসেনি।

    'রেখে যান। খোঁজ করলে দিয়ে দেব।'

    'আর যদি কেউ খোঁজ না করে?'

    এমন বিচিত্র প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না।

    'তবে আর কী। রাখার দরকার নেই।'

    'না না, এটা তো অন্যের কলম...'

    'আপনার কাছেই থাক।'

    লোকটি মজা করছে। তবুও বলল,

    'কাল একবার আসব?'

    'আসবেন।'

    ৪৪

    কলমটা রেখে যাওয়ার পরামর্শে ভরসা হল না। বৃহস্পতিবার আসবে। বলল, 'আমার নাম আর ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাব?'

    গৌরের প্রব্লেমটা পিকিউলিয়ার। এনকোয়ারির লোকটি আশ্চর্য হলেও আগ্রহ দেখাল না। 'রেখে যান।'

    নিজের নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে দিল। বেরিয়ে একবার ব্যাগ খুলে দেখে নেয়। ঠিকই আছে। কাগজে মোড়ানো। শক্ত শক্ত ঠেকছে।

    ৪৫

    ফেরার পথে বইখাতার দোকান পড়ে। গৌর জিজ্ঞেস করে, 'ভালো কলম হবে?'

    'হবে। বাজেট কত?'

    'আসলে আমার একটা বাক্সের দরকার। এই কলমটার জন্যে।' পকেট থেকে বের করে দেখায়।

    'ওসব হেবি দামি। শুধু বক্স নেই। আপনাকে বক্স দেয়নি …'

    'না, তা ঠিক নয়। বক্স আছে। বাড়িতে। আমার আরেকটা বক্স চাই। এটা রাখার জন্য…'

    ছেলেটি অবাক। 'বক্স এমনি বিক্রি হয় না …'

    'আচ্ছা। আসলে এই পেনটার একটা বক্সের দরকার ছিল…'

    'আরেকটা পেন কিনে নিন। বক্সও পেয়ে যাবেন।'

    'নতুন কলমের কত দাম পড়বে?’

    'এগারো শ’।'

    ৪৬

    দাম শুনে আঁতকে ওঠে। সারা মাসের মান্থলি! এখন কি গৌরের চলে যাওয়াই উচিত? মনটা খুঁতখুঁত করে। ইস ভদ্রলোকের এমন দামি কলমটা। একটা কাগজে মুড়ে রেখেছি!

    যদি ফেরৎ নেওয়ার সময় বলেন, “দাদা, দামি কলমটায় দুদিনের মধ্যেই স্ক্র্যাচ ফেলে দিলেন!”

    ছিছি। লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। একটু মরিয়া হয়েই বলে,

    'আচ্ছা ভাই, একটু কম-সম ...'

    'এখানে বার্গেন হয় না।'

    'আচ্ছা আমি যদি শুধু এর বাক্সটা নি?'

    'আমি কাস্টমারকে বেচব কী করে? ছেলেটা পেনের সেটগুলো তুলতে তুলতে বলে, 'কিনবেন না বেকার দামাদামি করছেন। একি ফুটের মাল?'

    ৪৭

    'ঠিক আছে ভাই, দিয়েই দাও।'

    কড়কড়ে এগারোশ' টাকা। মহুলকে কি চেপে যাবে বক্সের ঘটনাটা? দোকানের ছেলেটি কলমটা মুড়ে দিচ্ছিল। গৌর বলল, 'ভাই, এই কলমটা বক্সে রাখো।'

    ৪৮

    একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল কি? ভদ্রলোক হয়ত কলমটা চাইতেই এলেন না। ভুলে গেলেন। আবার মনে হয়, ছিছি ওনার কলমটা এভাবে হাতিয়ে নেওয়া… ঘোর অন্যায়।

    তাছাড়া ব্যাঙ্কে গৌর নিজের নাম, ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছে।

    যদি নাও দিত ...হঠাৎ ব্যাঙ্কের মধ্যেই আবার দেখা হয়!

    ৪৯

    'দাদা, আমার পেনটা ...আপনাকে লেখার জন্য দিয়েছিলাম… ফেরত নেওয়া হয় নি।'

    গৌর বলবে? 'কই না তো ...আপনাকে তো সেদিনই ফেরত …'

    উনি খুব আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছেন। সিকিউরিটি এসে বলছে, 'কেন দাদা, আপনি তো তারপর অনেকদিন ব্যাঙ্কে এসে খোঁজ করেছেন। কলমটা ফেরত দেবেন বলে। আমাদের কাছে নাম ঠিকানা আছে...’

    ৫০

    'গৌর দাস। হৃদয়পুর বাই লেন ... ফোন …'

    মাথা ঝিমঝিম করে। চারদিক থেকে সবাই ঘিরে ধরেছে ...কাউন্টারের মেয়েটি বলে, 'সেদিন শনিবার, ১৭ই ফেব্রুয়ারি …আপনি টাকা…'

    ৫১

    প্রায়ই ব্যাঙ্কে খোঁজ নেয়। ঘন ঘন ব্যাঙ্কে আসছে বলে অনেকেই জেনে গেছে। ফালতু ঘটনায় কেউ আগ্রহ দেখায় না।

    ৫২

    গৌর ম্যানেজারকে বলল। এমন অদ্ভুত ঘটনায় উনিও হতবাক। অবাঙালি লোক। 'ও আপ রাখ লিজিয়ে।'

    'ইয়ে ক্যায়সে হো সকতা। ওহ চিজ দুসরো কা …'

    'তব তো ম্যায় ফেল হো গ্যয়ে।'

    'স্যার এক অপশন হ্যায় ...'

    'অপশন ওহ কেয়া?' গৌরের প্রস্তাব শুনে আকাশ থেকে পড়েন।

    'আপকো সিসিটিভি ফুটেজ চাহিয়ে ...ওহভি এক মামুলি কলমকে কে লিয়ে ... মজাক উড়ানা বন্ধ কিজিয়ে ...মেরে নোকরি কা সওয়াল …আপকা দিমাক তো ঠিক হ্যায় না..!'

    ৫৩

    প্রস্তাবটা শোরগোল ফেলল। স্পষ্টত ব্যাঙ্কের মধ্যে দুটো ভাগ। একদল গৌরকে খ্যাপাটে বলে। অন্যরা বলে, 'সৎ মানুষকে আপনারা তো খ্যাপাটেই বলবেন। সততার দাম নেই। গৌরবাবুকে খ্যাপাটে ভাবাটাই স্বাভাবিক। এমন মানুষ এযুগে অচল।'

    ৫৪

    বিষয়টা অনেকদূর গড়াল। গড়াক। শেষ পর্যন্ত একটা হিল্লে হবে। ওই ভদ্রলোককে আইডেন্টিফাই করা যাবে। তারপর ঠিকানা নিয়ে কলমটা ফেরত দিয়ে দেবে।

    ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ রাজি। অবশ্য অনেক মেল চালাচালি হল। ফুটেজের ব্যাকআপ পাওয়া গেছে। হেডঅফিস পারমিশন দিয়েছে। ওটা চালিয়ে দেখবার।

    ৫৫

    আজ ফুটেজ ডিসপ্লে হবে। ব্যাঙ্কিং আওয়ারের শেষে। গৌর ছুটি নিয়েছে।

    গৌরের হিসেব মতো ওই কলম দেওয়ার ঘটনা তিনটের পর।

    স্টাফেরাও উত্তেজিত। আইডেন্টিফিকেশনের জন্য সবার কৌতূহল। ভদ্রলোকের হদিশ মিলবে। ওঁকে এতদিনেও কেউ ট্রেস করতে পারেনি। গৌর দাসের কথামত ওইদিন যারা যারা ব্যাঙ্কে এসেছিল, কেউই কলমটা দাবি করেনি।

    ৫৬

    ফুটেজ চলছে আড়াইটে থেকে ...দুটো বাহান্ন, গৌর ঢুকেছে ... কাউন্টার থেকে স্লিপ নিল...কলম ঘষছে ...লেখা বেরোচ্ছে না....তিনটে দুই, একজন মহিলা টাকা জমা দিচ্ছেন… তিনটে ছয়, ব্যাঙ্ক মোটামুটি ফাঁকা ...গৌর স্টিলের চেয়ারে ...তিনটে এগারো, একজন ঢুকেছেন—লাল হেলমেট পরা ...ডানদিক ঘুরে গৌরের দিকে যাচ্ছেন… ভদ্রলোক গৌরের কাছে দাঁড়িয়ে… ক্যামেরার পিছন দিকে ...হেলমেট খুলে হাতে নিলেন...

    ৫৭

    র' সিল্কের শার্ট। ঘিয়ে রঙ।

    …গৌর দাসের মুখ নিচু ...ভদ্রলোক বুক-পকেট থেকে কলম বের করে গৌরকে দিচ্ছেন… ক্যামেরা পজ হল ...স্লো মোশনে দেখা হচ্ছে ...গৌর ফর্ম ভর্তি করতে ব্যস্ত…ভদ্রলোক ...দৌড়ে কাউন্টার ওয়ানে এসে দাঁড়িয়েছেন ...গৌর তখনও দূরে ওই চেয়ারে বসে …

    ৫৮

    সবাই অবাক হয়ে দেখছে। কাউন্টার ওয়ানে র' সিল্কের শার্ট …চওড়া কব্জি। চামড়ার বেল্টের ঘড়ি... ...স্বয়ং গৌর দাস।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments