গভীর রাত। করবীর দরজার বাইরে তিনটে লোক প্রবল শব্দে তার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। ঘরের পলকা দরজা সেই আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজাটা কতক্ষণ যে করবীকে সুরক্ষা দেবে জানে না করবী। সে নিশ্চিত বাইরে তার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে। সে অসহায় দৃষ্টিতে একবার নিজের পেটে হাত রাখল। তার এই সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে তো? নাকি ওকেও ওরা শেষ করে দেবে? শিশুটির পৃথিবীতে আসার সময় এখনও হয়নি। আরও সপ্তাহটাক বাকি, এরই মধ্যে ওর অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে! একমনে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে লাগল করবী। যারা তার পেছনে লেগেছে, তাদের হাত থেকে কেউ এখানে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না সে জানে। এমন করেই সেই মানুষটাও সেদিন বেঘোরে চলে গেছিল, কেউ এগিয়ে আসেনি। সে নিজের পেটে হাত রেখে বলল,
''ঠাকুর ওকে তুমি দেখো! পৃথিবীতে ওর আর আপন বলতে কেউ থাকল না!''
এমন সময় হঠাৎ বিপদ সামনে বলেই হয়ত করবী একটা আশ্বাসভরা কন্ঠস্বর শুনতে পেল। সেই স্বর কার সে জানে না। সেই অলীক কন্ঠ যেন তাকে আশ্বস্ত করল। সেই স্বর শুনে তার মনে বিশ্বাস জাগল, এই সন্তান বেঁচে থাকবে। এর কিছুতেই কোনও ক্ষতি হবে না। নিজের কথা সে ভাবে না। তার এই তুচ্ছ জীবনটা থাকা না থাকা সমান। হঠাৎ দরজার ছিটকিনি বেঁকে গিয়ে সশব্দে দরজাটা খুলে গেল---
দরজা খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের মতো করবীর পেটের ভেতর বেশ কয়েক ইঞ্চি গভীরে জগার হাতের অস্ত্রটা ঢুকে গেল। ছুরিটা কোনাকুনি মেয়েটার পেটে ঢুকতেই কালচে রঙের খানিকটা অ্যামনিওটিক ফ্লুইড ছিটকে বেরিয়ে এল, আর তা জগার মুখে চোখে লেগে গেল। জগা দেখতে পেল, মেয়েটার পেটের ভেতর একটা প্রাণ কিলবিল করছে। সেদিকে তাকিয়ে জগার কেমন একধরনের বিতৃষ্ণার ভাব হল। 'মালটার পেটে তাহলে বাচ্চা ছিল? মরুক গে!' সে ছুরি মারার আগে তাকিয়েও দেখেনি ভালো করে। আজ জেল থেকে বেরিয়েই সে প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে চলে এসেছে। জগা সঙ্গীদের নিয়ে যেমন এসেছিল, কয়েক মিনিট পরে তেমনই বেরিয়ে গেল।
একটি শিশুকন্যা। কিছুক্ষণ আগেই তার মা খুন হয়েছে। পুলিশ আসার আগেই সে হাড়কাটা গলির অপ্রশস্ত একটি ঘরের মেঝেতে ভূমিষ্ঠ হল। শিশুটির জন্মের পর ওর দায়িত্ব নিল রমা মাসি। বাচ্চাটার গায়ের রং খুব কালো। এমন কালো রং বাঙালিদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। তবুও মেয়েটার জন্য রমার মনে অদ্ভুত একধরনের মায়া হল। মেয়েটা তার কাছেই বিছানায় শুতে পেল, এবং ওর জন্য ল্যাক্টোজেন, হাগিস ইত্যাদি আসতে লাগল। মেয়েটাকে রমা কেন যেন অসম্ভব আগলে রাখে। লাইনের মেয়েরা এই নিয়ে হাসে। বলে, 'মাসি বয়সকালে এসে বাচ্চা বিইয়েছে!'
ওদের কথা শুনে রমা বলে, 'আমি স্বপ্ন পেয়েছি রে! মেয়েটা আর জন্মে আমার মেয়েই ছিল। মাইরি বলছি! নাহলে ওর মায়ের এমন হঠাৎ সর্বনাশই বা হবে কেন? আর আমিও পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে, তাদের এতগুলো পয়সা খাইয়ে, এত ঝুঁকি নিয়ে ওকে হঠাৎ আমার ঘরে নিলাম কেন? সব হিসেব আছে, বুঝলি! তোদের তো সবেতেই ঠাট্টা।' কথার ফাঁকে সে পান গুঁজে দেয় মুখে। সে যে স্বপ্নটা কী দেখেছে, তা আর কাউকে খুলে বলে না।
মেয়েটার নাম ঠিক হল দয়িতা। এক শৌখিনবাবুকে বাচ্চাটার নাম দিতে বলা হয়েছিল। সে সবাইকে নামের মানেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। বলেছে, দয়িতা মানে হল প্রেমিকা। ওদের সবার নামটা বেশ পছন্দ হয়েছে। বাচ্চা মেয়েটা বড় শান্ত। কথাও খুব কম বলে, তবে রমা জানে ওর মাথায় দারুণ বুদ্ধি। দয়িতা সবাইকে পছন্দ করে না। রমামাসি ছাড়া ওর যেসব প্রিয় মানুষ আছে, তারাও ওর প্রতি একেবারে অন্ধ। এদের মধ্যে আছেন একজন লেডি ডাক্তার। মেয়েরা নানা সমস্যায় প্রায়ই তাঁর কাছে ভিড় করে। রমা দয়িতাকে নিয়ে একবার ওখানে গেলে মেয়েটাকে ডাক্তারদিদির খুব পছন্দ হয়। তারপরই ম্যাজিক হয়ে গেল। ডাক্তার আবীরা ঘোষ রমার বাড়িতে মেয়েটাকে পড়াতে আসতে লাগল। আবীরাদির কথামতো দয়িতাকে শিয়ালদা লোরেটো স্কুলে ভর্তিও করা হল। সব খরচও উনিই দিলেন। রমাও প্রায়ই ভাবে মেয়েটাকে নিয়ে আলাদা কোথাও চলে যাবে। এই কথা যে দয়িতারই মনের কথা, এতদিনে জেনে গেছে রমা। মেয়েটা ওর কাছের মানুষের চিন্তাকে কেমন করে যেন প্রভাবিত করতে পারে। কী করে পারে? কেন পারে? রমা অতশত জানে না।
২
দূর পাল্লার ট্রেন কোনও অজানা স্টেশানে থেমে গেলে সেদিকে তাকিয়ে আপনার কি কখনও খুব চেনা চেনা মনে হয়েছে? কিংবা কোনও কারণ ছাড়াই জায়গাটা ভালো লেগেছে? কিংবা মনে হয়েছে তখনই ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে সেই জায়গাটার চারপাশটা একবার দেখে নিলে ভালো হয়! তাহলে আপনি এখন তীর্থ-র মনের অবস্থাটা কিছুটা বুঝতে পারবেন। মেয়ে দেখতে গিয়ে ওর হঠাৎ এমনই কোনও কারণ ছাড়াই দয়িতাকে পছন্দ হয়েছে। অথচ দয়িতা যে খুব সুন্দর তা কিন্তু নয়। তাছাড়া ও মোটেই দয়িতাকে দেখতে যায়নি, বরং গিয়েছিল ওর দিদি জয়িতাকে দেখতে।
দয়িতা ছোটো আর জয়িতা বড়ো। দুই বোন আক্ষরিক অর্থেই সব দিক থেকে একদম আলাদা। জয়িতা উজ্জ্বলবর্ণা, দীর্ঘাঙ্গী। তার চোখ দুটি আয়তাকার আর টানাটানা। অন্যদিকে দয়িতা শ্যামবর্ণা। তার চোখ দুটিও আয়তাকার, তবে সে দুটি চোখ অন্য কারণে তীর্থকে আকর্ষণ করেছে। দয়িতার চোখের মণি ঠিক কালো বা বাদামি নয়, তা যেন কেমন ধূসর বর্ণের। বিড়ালের চোখের মতো সবুজাভ ধূসর। এমন রহস্যময় চোখের কোনও মানুষ তীর্থ জীবনে এর আগে কখনও দেখেনি।
দয়িতা দেখা হওয়ার পর থেকে তীর্থর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি, কিন্তু জয়িতা দারুণ উচ্ছ্বল ও প্রাণবন্ত। সে দু'ঘন্টার আলাপচারিতার মধ্যেই তাকে জানিয়েছে যে সে ইলিশ মাছ আর ক্যারামেল কাস্টার্ড খেতে খুব ভালোবাসে এবং সে ড্যান ব্রাউনের লেখার দারুণ ভক্ত। অথচ দয়িতা তার সম্পর্কে তীর্থকে একটা কথাও জানায়নি। অবশ্য তার এসব জানানোর কথাও নয়। কারণ তীর্থ তো জয়িতাকে দেখতেই ওদের বাড়িতে এসেছে। এর মধ্যে দয়িতা খামোখা আসতেও বা যাবে কেন?
জয়িতার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গেই তীর্থ অবশ্য দয়িতা সম্পর্কে কয়েকটা তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে। সে জানতে পেরেছে দয়িতা ফিলজফি নিয়ে এবার যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিয়েছে। এদিকে জয়িতা তীর্থ-র মতোই বিজ্ঞানের ছাত্রী। সে নেটে বেশ ভালো স্কোর করে এখন ওই ইউনিভার্সিটিতেই পিএইডি করছে। তীর্থর মা জয়িতাকে একেবারে তাঁর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আছেন। ছেলের জন্য এতদিনে তিনি তাঁর নিজের মনোমত পাত্রী খুঁজে পেয়েছেন।
দেখা যাচ্ছে, জয়িতাদের বাড়ির লোকও তাদের মেয়েকে নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তীর্থকেও তাদের ভালো লেগেছে। এখন মেয়ের মত থাকলেই তাঁরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। একটা ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে অনেকদিন ধরেই তীর্থর মা ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। এতদিনে তিনি রূপে গুণে উপযুক্ত পাত্রী পেয়েছেন তার ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য। তীর্থ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এমটেক পাশ করে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে।
বাড়ি ফিরেই তীর্থ হঠাৎ অদ্ভুত একটা কথা বলে উঠল, ‘আমার কিন্তু জয়িতার বোনকেই বেশি ভালো লেগেছে। কী যেন নাম? হ্যাঁ! দয়িতা। আমি যদি বিয়ে করি এই দয়িতাকেই করব। নাহলে আমি সারাজীবন বিয়েই করব না!’
‘বলিস কী? ওই কালো মতো বেড়াল চক্ষু মেয়েটাকে তোর পছন্দ? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? একেবারে মতিভ্রম? ওদের বাড়ির ওই মেয়েটা এমন ভয়ানক কুচ্ছিত কী করে হল, তাই ভাবছি অবাক হয়ে। অথচ ওর বাবা, মা, দিদি সবাই দেখতে কেমন সুন্দর! ফর্সা ধবধবে গায়ের রং। সব সুন্দরের মধ্যে ও একা একদম বিদঘুটে! বিকট!’
‘কী যা তা বলছ! তোমার দেখছি দেখার কোনও চোখই নেই। দেখোনি, মেয়েটা কী আশ্চর্যভাবে ওর উপস্থিতি কেমন অস্পষ্ট করে রাখে! কী ক্ষিপ্র অথচ নিঃশব্দ ওর হাঁটাচলা! আর ওর চোখ দুটো কী অদ্ভুত গভীর! আমার মনে হয়, মেয়েটার মনও খুবই অনুভবী। তুমি একবার ওদের বাড়িতে গিয়ে আমার কথাটা বলেই দেখো না!’
‘এমন করা যায় না! এ যে চরম অভদ্রতা! বড় মেয়েকে দেখতে গিয়ে--ছিঃ! তাছাড়া ওই মেয়েটাকে আমার কেমন কালো বেড়ালের মতো অশুভ মনে হয়েছে। তুইই বা ওকেই কেন পছন্দ করছিস?’
‘বেশ, তোমাকে কিছু করতে হবে না! আমিই না হয় জয়িতাকে ফোনে সব বলব। তারপর যা হওয়ার হোক! আমার কাছে জয়িতার মোবাইল নাম্বার আছে।’
জয়িতাকে সব কিছু বলার পর তীর্থর মন অনেক হালকা হয়েছে। তার কথা শুনে জয়িতা একই রকম উচ্ছ্বল গলায় বলেছে, ‘বাঃ এ তো খুব মজার! তুমি বুঝি চুপিচুপি সারাক্ষণ দয়িতাকেই দেখছিলে? তাই আমার বকবকের কোনও উত্তর দিচ্ছিলে না! আচ্ছা, আমি মা আর বাপিকে বলে ওদের মত করিয়ে নেব। নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। তোমার কিন্তু শিল্পীর চোখ আছে। জানো! একবার আমার এক আর্টিস্ট বন্ধুও ওকে দেখে একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিল। ও তখন খুব করে দয়িতার পোর্ট্রেট বানাতে চেয়েছিল। দয়িতা কিছুতেই রাজি হয়নি। ও কিন্তু একটু অদ্ভুত! বাড়িতে ওর পোষা একটা কালো বেড়াল আছে। পমি। পমি আর দয়িতার চোখ আর গায়ের রং একেবারে হুবহু একরকম। তবে তোমার যখন ওকেই পছন্দ, আমি সব ম্যানেজ করে নেব। টেনশান কোরো না।’
কথাটা নিয়ে জয়িতাদের বাড়িতে বোধহয় একটু গোলমাল হল। জয়িতা যত সহজে সবটা মেনে নিয়েছিল, ওর বাবা মা বোধহয় তা করেননি। কারণ পরদিন সকালে তাঁরা তীর্থদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন।
তীর্থ অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তীর্থর মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। তীর্থর বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বাড়িতে তারা কেবলমাত্র দুটি প্রাণী, মা ও ছেলে।
‘কী হয়েছে?’
‘আপনি কি সব জানেন?’
‘ছেলের কাছে শুনেছি। একালের ছেলে। আমার মতামতের তোয়াক্কাই করে না। ওর পছন্দ আমি বুঝি না! আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছিল জয়িতাকে।’
জয়িতার বাবা বললেন, ‘শুনুন একটা কথা আমরা বলতে এসেছি। জয়িতাকে তীর্থ পছন্দ করেনি বলে আমরা কিছু মনে করিনি। এটা কোনও ইস্যুই নয়। তীর্থর চেয়ে আরও অনেক ভালো পাত্র আমরা জয়িতার জন্য পরে পাব। যে কথা বলতে আজ এখানে ছুটে এসেছি তা হল দয়িতা কিন্তু আমাদের সন্তান নয়। ওকে আমরা আমাদের বাড়ির সামনে পেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ কথাটা আপনাদের আগে বলে রাখা উচিত বলেই ছুটে এসেছি।’
এক শীতের কুয়াশা-মাখা ভোরে, ঘুম ভেঙে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নিচের দিকে আমার চোখ আটকে যায়। ওখানে তাকিয়ে দেখতে পাই, সামনের বকুল গাছটার নিচে একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় ওর গায়ে কোনও গরম জামা নেই। মেয়েটা ওখানে একেবারে চুপচাপ বসে ঠান্ডায় কাঁপছিল। তবে ওর গায়ে তখন ছিল একটা আধ ময়লা কিন্তু দামী একটা ফ্রক। মেয়েটাকে দেখেই আমার ভীষণ মায়া হয়। তারপর পুলিশের সাহায্যে ওকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে, ওখান থেকে লিগ্যাল প্রসিডিওর কমপ্লিট করে তারপর ওকে আমাদের মেয়ে হিসেবে নিয়ে এসেছিলাম, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। দয়িতার বয়স এখন আন্দাজ প্রায় ছাব্বিশ বা সাতাশ হবে। ওর রোগাটে গড়ন বলে বয়সটা কিছুটা কম মনে হয়। কারণ আমরা যখন ওকে কুড়িয়ে পাই, ওর বয়স ছয় বা সাত বা তার কিছু বেশি আমার মনে হয়েছিল। ওকে যখন পাই তখন আমার মেয়ে জয়িতা সবে বছর দুইয়ের। আর হ্যাঁ, ও-ই আমাদের বলেছিল ওর নাম দয়িতা। আমার মেয়ের নাম দিয়েছিলাম জয়িতা। দুজনের নামেই বেশ একটা অন্তমিল! আমার মনে হয়েছিল একটা সুন্দর সমাপতন। হতে পারে ও কোনও বড় ঘরেরই সন্তান হবে। তবে ওর জন্ম পরিচয় আমরা জানি না। ওর জাত কী? কিংবা ও কোথা থেকে এসেছে, তা আমরা কেউ জানি না। ওর পরিচয় জানতে পুলিশ অনেক চেষ্টা করেছিল। টিভিতে এবং কাগজে ছবিও দিয়েছিল। তবুও ওর পরিচয় জানা যায়নি। ও আমাদের বাড়ির সামনেই বা হঠাৎ কোথা থেকে এল? বা কেন এল? তা আমরা কেউই জানি না, এবং ও-ও আমাদের কিছু বলেনি।
‘ছোট থেকেই দয়িতা বড় বেশি চুপচাপ। একবার আমাদের একজন সাইকোলজিস্ট বলেছিলেন মেয়েটার মনে হয়তো কোনও ধরনের অজানা আতঙ্ক আছে। এত ছোট বাচ্চা, কাউন্সেলিং করে এ বিষয়ে কিছু জানা বেশ মুশকিল। সেই আঘাতে বা ট্রমাতে হয়তো মেয়েটা এমন একেবারে চুপ হয়ে গেছে।
‘দয়িতা বড় হওয়ার পরেও চুপচাপ। ও একেবারে নিজের মনে থাকে। কেমন একটা গণ্ডি টেনে নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখে মেয়েটা। তবে বড় ভালো মেয়ে দয়িতা। ওর কোনও সময় কোনও অভিযোগ নেই এবং রাগ নেই। আমি আজ পর্যন্ত ওকে কখনও রেগে উঠতে দেখিনি। ওকে বিয়ে করলে তুমি শান্তিতে থাকবে এটুকু নিশ্চিন্ত করতে পারি।’
কথাবার্তা শেষ হলে যাবার আগে ভদ্রলোক একটু মাথা ঝুকিয়ে তীর্থর দিকে সরে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘তবে একটা কথা বলে যাব, যদিও কথাটা অদ্ভুত। আমি আজও এর কোনও ব্যাখ্যা পাইনি। দয়িতা অন্যের মনে স্বপ্ন তৈরি করতে পারে। সবার নয়, তবে ও চাইলেই পারে।‘
তীর্থ অবাক গলায় বলে উঠল, ‘স্বপ্ন? সে কী! এর মানে কী?’
‘এর ঠিক মানে যে কী, তা আমি জানি না। এইটুকু জানি যে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। তবে এমনটা হয়। পৃথিবীর সব কিছু কি স্বাভাবিক হয় নাকি? কত অলৌকিক ঘটনা ঘটে! যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানের দৌড় কতটুকু? আর কতটুকুই বা আমাদের জানার পরিধি?’
৩
একমাসের মধ্যেই দয়িতার সঙ্গে তীর্থর বিয়ে হয়ে গেল। তার দয়িতার জন্মপরিচয় জানার কোনও ইচ্ছেই নেই। দয়িতাকে দেখার পর থেকেই তীর্থ যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। কোনও বিরুদ্ধ কথাই তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে বিয়ে করছে জেনে তীর্থর মা ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়েছেন। রাগে তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন।
ফুলশয্যার দিন ফুলে ফুলে আমোদিত ঘরে এসেই তীর্থ দয়িতার হাত ধরল। দয়িতার হাত দুটো অসম্ভব ঠান্ডা। তার চোখের তারায় কোনও আনন্দের ঝিলিক নেই। তীর্থ ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করল। ফুলশয্যার রাতে বলার জন্য সুনীলের বহু কবিতার মধ্যে থেকে সে একটা বিশেষ কবিতা আজ দয়িতাকে শোনাবে বলে ঠিক করেছে। তীর্থ তীব্র আশ্লেষে দয়িতার হাত ধরে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই প্রেমের কবিতাটা বলতে লাগল ফিসফিস করে।
''যমুনা, আমার হাত ধরো। স্বর্গে যাব।
এসো, মুখে রাখো মুখ, চোখে চোখ, শরীরে শরীর
নবীনা পাতার মতো শুদ্ধরূপ, এসো
স্বর্গ খুব দূরে নয়, উত্তর সমুদ্র থেকে যেরকম বসন্ত প্রবাসে
উড়ে আসে কলস্বর, বাহু থেকে শীতের উত্তাপ
যে রকম অপর বুকের কাছে ঋণী হয়, যমুনা, আমার হাত ধরো,
স্বর্গে যাবো।--
আমার প্রবাস আজ শেষ হলো,
এ রকম মধুর বিচ্ছেদ মানুষ জানেনি আর।''
দয়িতা তীর্থর দিকে তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ে বিহ্বল! বলে ওঠে, ‘তুমি আমাকে কী বলে ডাকলে? যমুনা? কী আশ্চর্য!’
‘হ্যাঁ ওখানে দয়িতা নামটা বসিয়ে বলতে হবে। সরি! ওটা হবে,
''দয়িতা আমার হাত ধরো। স্বর্গে যাবো।''__’
‘না, এখন থেকে তুমি আমাকে যমুনা বলেই ডাকবে।’
‘কেন? আমার তো দয়িতা নামটা বেশ রোম্যান্টিক লাগে। ওটাই তো বেশি ভালো।’
‘না আমাকে আজ থেকে যমুনাই বলবে তুমি।’ জেদি গলায় বলে ওঠে দয়িতা।
‘তাছাড়া দয়িতা নামটা একটুও ভালো নয়। দয়িতা মানে প্রেমিকা। আমি কি কেবলই প্রেমিকা নাকি? একজন মানুষের মুখের উপর এমনভাবে নাম দিয়ে লেবেল সেঁটে দেওয়া উচিত নয়। তার চেয়ে যমুনা নামটা অনেক ভালো। কৃষ্ণের পদস্পর্শে পুণ্যা নদী যমুনা! যমুনার রং ঘন নীল!’
‘বেশ আমাদের দুজনের মধ্যে একান্তে কথা হলে, তোমাকে এমন নামে ডাকা যাবে না হয়!’
‘না এখন থেকে সবসময়ই আমাকে তুমি যমুনা বলে ডাকবে।‘
তীর্থ অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। দয়িতা চুপ করে যায়। তীর্থর হঠাৎ মনে হয়, দয়িতা তাকে ভয় পাচ্ছে, তাই এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। মেয়েটার মধ্যে যেন কিছুটা অস্বাভাবিকতাও আছে। তার মনটা নিভে যায়। দয়িতার উপস্থিতি অসম্ভব শীতল। এমন মেয়েকে নিয়ে বেশ কাব্য করা যায়। বিয়ে করে বউ করা আনা হয়তো তার ঠিক হয়নি। তারা পাশাপাশি শুয়ে থাকে, কিন্তু দুজনে দুজনকে স্পর্শ পর্যন্ত করে না। তীর্থ শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল নানা কথা ভাবতে থাকে।
সারাদিন অসম্ভব পরিশ্রম হয়েছে আজ তার। রিসেপশানের সমস্ত ব্যবস্থা তাকে একা হাতে সামলাতে হয়েছে। তাই ক্লান্তিতে দু চোখ বুজে আসে সহজেই। তারপর তার শরীর জুড়ে নেমে আসে ঘুম। গভীর ঘুমে ডুবে যাওয়ার আগে সে অনুভব করল, ঘুমের মধ্যে দয়িতা হঠাৎ তার হাতটা জড়িয়ে ধরল।
ঘুমিয়ে সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল।
সে দেখল তার পরনে ধুতি ও ফতুয়া। কাঁধে একটা ঝোলা। সে একটা অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। দূরে দূরে রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বলছে। রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা। সে একটা গর্তে পা দিয়ে অসম্ভব যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল। তার পায়ের শস্তা চামড়ার জুতোর ফিতেটা ছিঁড়ে গেল। রাগে গজগজ করতে করতে সে পথ চলতে লাগল। কিছুটা গিয়ে গলির মুখ হঠাৎ বেঁকে গেছে। সে একটা সংকীর্ণ গলির ভেতর এসে ঢুকল। দুপাশে উঁচু দেওয়াল। আসা যাওয়ার পথটা অসম্ভব সরু। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চলেছে। সামনে পচা গলা আবর্জনার স্তূপ মাড়িয়ে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তীর্থ এসে দাঁড়াল একটা হলুদ রঙের জীর্ণ বাড়ির সামনে। তারপর সে তারস্বরে চিৎকার করে ডাকতে লাগল,
''যমুনা! যমুনা! আরে! কোথায় গেলি?''
অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে, ছোট একটা চীনা লন্ঠন হাতে বেরিয়ে এল একটি কালো আর রোগা মেয়ে। সে তার হাতের লন্ঠনটা উপরে তুলে অবাক গলায় বলল,
‘কী হয়েচে কী?’
‘আরে চোখের মাতা খেয়েচিস নাকি? আমাকে দেখতে পাচ্চিস নে? দোরটা ভালো করে খোল দিকি! যা একটা রাস্তা করেছিস, তোর কাছে আসার! উফ! আজ আমার জীবনটাই গেচিলো আর কী! নে নে পায়ে জল ঢাল দেকি বেশ করে!’
মেয়েটার মুখটা দেখা গেল এতক্ষণে। স্বপ্নে দয়িতার মুখটা দেখে চমকে উঠল তীর্থ। দয়িতার পরনে একটা মটকার চওড়া পাড় শাড়ি। গায়ে ব্লাউজ নেই। জল ঢালার সময় তীর্থ তার উন্মুক্ত খোলা পিঠটাও দেখতে পেল। পিঠের ডান দিকে একটা লাল আঁচিল। মাথায় সিঁদুর নেই। হাতে একরাশ রঙিন চুড়ি আর ঠোঁটে চড়া রঙ। সে নিজের পায়ে জলের শীতলতা পর্যন্ত অনুভব করল। তীর্থ এরপর একটা ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরটা অন্ধকার। এক কোণে টুলের উপর একটা কালি পড়া হ্যারিকেন জ্বলছে। সে ঘরে ঢুকেই একটা উঁচু বিছানার উপর হাত পা ছড়িয়ে বসল। দয়িতাও এসে তার একপাশে বসল। তীর্থ বলল, ‘যমুনা, আজ একখানা গান করো শুনি!’
দয়িতা গান আরম্ভ করল।
''নিদয় বিধাতা, কেনরে আমারে,
ভারতে পাঠালে রমণী করিয়া।''
‘ধুর! এ আবার কেমন গান?’
‘ভালো নয়কো? বিনোদিনী দাসীর গান। পরশুই থেটার দেখে এসে তুলেচি।’
গানের মাঝখানে পাশের ঘর থেকে কোন এক মাতালের জড়ানো গলার স্বর শোনা যেতে লাগল। বিরক্ত হয়ে তীর্থ বলে উঠল, ‘উফ! অঘোরবাবুর জ্বালায় এ পাড়ায় আর থাকা যাবেনে দেকচি!’
‘আহা তুমি চটো কেন? তিনি তাঁর ঘরে বসে বাবুয়ানি করচেন। তোমার তাতে ব্যতা কীসের? তুমি শান্তিতে থাকো না কেন বাপু?’
‘এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দেব! মুকে মুকে খুপ চোপা হয়েচে না! অঘোরবাবুর জন্য আজকাল খুব দরদ উঠছে তোর দেকচি!’
‘সুকুমারবাবু! বিনা দোষে একবারে গালমন্দ করবেন নে! আমি আপনার বে করা বউ নই, যে সারাক্ষণ গাল পাড়বেন, আর আমি বসে বসে তাই শুনব!’
‘ইঃ বড্ড ডাট হয়েচে তোর আজকাল! তুমি থেকে আবার হুট করে আপনি বলতে লেগেচিস! থেটার থেকে বাবুরা ডাকতে এসচিলো বলে দেকচি দম্ভ আর ধরেনে! আয় এখন আর আমার মাথা খাস নে! কাচে সরে বোস। আবার গানটা বেশ করে ধর তো!’
মুখ কালো করে দয়িতা বলে, ‘নাঃ আজ আর গাইবার মন নেইকো।’
‘তবে কাচে আয় একবার!’ সুকুমার তার যমুনাকে বুকের ভেতর চেপে ধরল। দ্রুত হাতে তার শাড়িটা খুলে ফেলে দিল ঘরের এক কোণে। শ্যামবর্ণা মেয়েটি এখন নিরাবরণ। সুকুমার গভীর কামনায় একদৃষ্টে যমুনার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর গভীর আশ্লেষে ডুবে যেতে লাগল মেয়েটার শরীরে। প্রায়ান্ধকার ঘরে তার শরীরটা কেবল ওঠানামা করছে। কুমারীর প্রস্ফুটিত স্তনদুটি ঘরের মৃদু আলোতেও অপরূপ ভাস্বর হয়ে ফুটে আছে। তীর্থ তাতে মুখ রেখে অস্ফুটে বলতে থাকে ''যমুনা যমুনা আমার''....... এমন সময় তীর্থর ঘুমটা ভেঙে গেল। সে ঘুমন্ত দয়িতার দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলে উঠল,
'যমুনা!’
তার শরীর তীব্রভাবে জেগে উঠেছে! এ কি স্বপ্নের এফেক্ট?
যমুনা বলে ডেকে তীর্থ নিজেই অবাক হয়ে যায়। চেয়ে দেখে দয়িতার শরীরও এখন প্রায় নিরাবরণ। কালো সাপের মতো তার রোগাটে হিলহিলে শরীর। একটা স্লিভলেস আর খুব পাতলা গোলাপি রংয়ের নাইটি তার পরনে। তার গায়ে কোনও অন্তর্বাস নেই। মনে হয় ঘুমানোর আগে সে তার শাড়ি ছেড়ে এই স্বচ্ছ নাইটিটা পরে শুয়েছে। স্বচ্ছ নাইটিতে দয়িতার সমস্ত শরীরটা একেবারে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। সে কিছুটা কাৎ হয়ে শুয়ে থাকায় তীর্থ তার উন্মুক্ত পিঠটাও দেখতে পেল। দয়িতার পিঠের ডান দিকে একটা লাল রঙের আঁচিল! সে তীর্থকে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে!
দয়িতাকে ঠিক বুঝতে পারছে না তীর্থ। যত দেখছে ততই তার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কারণ সকালে ঘুম ভেঙে উঠে, সে দয়িতাকে দেখে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেছে। ঘুমন্ত দয়িতাকে এখন এত খারাপ দেখতে লাগছে, যে সে দেখেই অবাক হয়ে গেছে। সে অবাক হয়ে দেখল, দয়িতার গায়ের রঙটাও বেশ অতিরিক্ত কালো। মুখ চোখও আহামরি নয়। কামনার্ত তীর্থ দয়িতার খুব কাছে এগিয়ে এল। তারপর বক্ষলগ্না দয়িতার মুখটা দু হাতে তুলে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। তার শ্বাস-প্রশ্বাস গায়ে লাগতেই, দয়িতা চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসল। এত কাছে তীর্থকে দেখে, সে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে হেসে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল মিরাকেল! দয়িতাকে আবার অপরূপা মনে হলো তীর্থর। সে অবাক গলায় বলল,
‘আমি তোমাকে নিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে তোমার নাম কি ছিল জানো? যমুনা! কি আশ্চর্য তাই না?’
দয়িতা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘রাতে তুমি ঘুমোতে ঘুমোতে কীসব যেন বলছিলে! তারপর আমাকে হঠাৎ কাছে টেনে নিলে। ভারী দুষ্টু তুমি!’
‘আমি কী যে করেছি, আমি কিছুই জানি না।’ বলতে বলতে তীর্থ দয়িতাকে কাছে টানল। দয়িতাকে বুকে নিয়ে তার হঠাৎ মনে হল, সে তার জীবনে সবকিছু পেয়েছে। তারা দুজনেই দুজনকে পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরল। ঘরের দরজা খুলে যখন তীর্থ বাইরে বের হল, তখন সকালের রোদ চড়া হয়েছে। ঘড়িতে বেলা নটা।
৪
তীর্থর মায়ের নাম উমা। দুঃখে শোকে তিনি এখন একেবারে পাথর হয়ে গেছেন। ছেলের যে এমন মতিভ্রম হতে পারে এ একেবারেই ভাবতে পারেননি তিনি। মেয়েটাকে দেখতে এমন খারাপ যে পুরো ব্যাপারটাই তার কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে। উমা শুনেছেন এমন তুকতাক করা যায়, যাতে মানুষ একেবারে ভেড়া বনে যায়। তার ছেলেকেও এমন কিছুই করা হয়েছে বলে তাঁর স্পষ্ট ধারণা হয়েছে। উমা অকূল পাথারে পড়েছেন। এখন তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। ফুলশয্যার পরদিন সকালে ছেলে ঘুম থেকে উঠেছে বেলা নটায়। সকাল থেকে ছেলে হঠাৎ দয়িতাকে যমুনা বলে ডাকতে শুরু করেছে। ডাক শুনলেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার। এ আবার কী হিড়িক? যমুনা! এ আবার একটা নাম হল! তাদের পাড়ার কাপড় কাচার মাসিরও নাম যমুনা! এই কেলো বেড়াল-চক্ষু মেয়েটাকে নিয়ে তার ছেলের আদিখ্যেতার যেন শেষ নেই!
অষ্টমঙ্গলায় গিয়ে পরদিন অফিস থাকায় বাড়িতে একাই ফিরে এসেছে তীর্থ। অনেকদিন পর ছেলেকে একটু একা কাছে পেলেন উমা। দয়িতা যেন ছেলেকে এতদিন রাহুর মতো গিলে রেখেছিল। বিয়ের অ্যালবামটা হাতে নিয়ে ছবি দেখতে বসেছেন উমা। তাঁর দয়িতার ছবিগুলো দেখে, ক্ষোভে দুঃখে চোখে জল আসছে। তাঁর সুন্দর ছেলেটার কপালে কী একটা বউই না জুটেছে!
জামা কাপড় ছেড়ে তাঁর পাশে এসে বসল তীর্থ। অ্যালবামটা হাতে নিয়ে তীর্থর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। দয়িতার ছবিগুলো দেখেই ছেলের এমন মুখভার হয়েছে, মনে হল উমার। তিনি বেশ খুশি হয়ে উঠলেন।
জয়িতাদের ইউনিভার্সিটির লম্বা টানা বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে উমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দয়িতা কি প্রথম থেকেই এমন?’
‘হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। ওর ভেতর একধরনের অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ও মানুষের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করতে পারে। তবে যাকে ও পছন্দ করে কেবল তাকেই। “কোয়ান্টাম থিয়োরি অফ ব্রেন” বলে একটি বিষয় আছে, শুনেছি। এই তত্ত্ব বলে থাকে, কিছু মানসিক শক্তিধর মানুষেরা তাদের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে স্বপ্ন পর্যন্ত তৈরি করে থাকে। তারা চাইলে তাদের ইচ্ছামতো কাজও করাতে পারে এমনকী মনকে পরিবর্তিত করে, ও যেমন চায় দেখাতেও পারে। আমার মনে হয় দয়িতাও তীর্থর উপর তেমন প্রভাব ফেলেছে।’
‘তুমি দয়িতাকে পছন্দ করো না, তাই না?’
‘কেন বলছেন এ কথা?’
‘কারণ তোমার উপর দয়িতার কোনও প্রভাব নেই।’
‘ওকে আমার কেমন ভয় করে। বাবা ছোটো থেকেই ওকে বেশি ভালোবাসত বলে আমার খুব হিংসা হত। আমি কয়েকবার ওর বইখাতা আর জামা কাঁচি দিয়ে কেটে দিয়েছিলাম লুকিয়ে। প্রত্যেকবার উল্টে আমারও বইখাতা আর জামাকাপড়ও নষ্ট হয়ে গেছিল। হয় হারিয়ে গেছিল স্কুল থেকে, নাহলে কোনওভাবে ড্যামেজ হয়েছিল, সবই ওর অলৌকিক ক্ষমতার জন্য!’
‘ওর কথা বলো। ওকে তোমরা কোথায় পেয়েছিলে? তোমার বাবা আমাদের বলেছেন, ওকে এক শীতের সকালে তোমাদের বাড়ির সামনে পেয়েছিলেন।’
‘না, ওই কথাটা সত্যি নয়।’
‘মানে?’
‘দয়িতার একটা অতীত আছে। যা শুনলে আপনি কষ্ট পাবেন।’
‘তুমিও তো কষ্ট পেয়েছো। তীর্থকে তোমার পছন্দ হয়েছিল, এবং আমি সেটা অনুভব করেছিলাম। এটা জানবে, মায়েরা অনেক কিছুই বুঝতে পারেন। তুমি বোধহয় ভাবতেই পারনি যে তীর্থ হঠাৎ এমনটা করবে, তাই না?’
‘হ্যাঁ আন্টি। আমি ভেবেছিলাম, দয়িতা তো দেখতে খুব খারাপ, ওকে কেন তীর্থর ভালো লাগবে? তাই একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম প্রথমে। তারপর ম্যানেজ করে নিয়েছি।’
‘তুমি আমাকে দয়িতার ব্যাপারে এখন আসল সত্যিটা বলো জয়িতা!’
‘বাপিকে আবীরা আন্টি একদিন দয়িতার কথা বলেছিলেন। আবীরা আন্টি একজন প্রথিতযশা ডাক্তার এবং আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। উনি বলেছিলেন, দয়িতা একটা খারাপ পাড়ায় জন্মেছে। তবে ও পড়াশুনোয় ভালো, লরেটো কনভেন্ট স্কুলে ক্লাশ টু-তে পড়ে। ওর মাকে অ্যান্টি সোসাল গুন্ডারা মেরে ফেলেছে। আবার ওকে যে দেখাশুনো করতেন তিনিও এখন নাকি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেয়েটার থাকার জন্য একটা সুস্থ পরিবেশ দরকার। আবীরা আন্টির কথা শুনে বাপি আগ্রহ নিয়ে দয়িতাকে তারপর দত্তক নেয়। আমার মা প্রথমে মেনে নেয়নি, খুব রেগে গেছিল। পরে বাপি জেদ করায় মা-ও ওকে মেনে নিয়েছিল।’
‘দয়িতার আসল মায়ের নাম কী ছিল? ওঁকে গুন্ডারা মেরে ফেলেছিল কেন?’
‘দয়িতার মায়ের নাম মনে হয় করবী বা এমন কিছু ছিল বোধহয়। ওঁকে খুন হতে হয়, কারণ করবী পুলিশকে গিয়ে খুনির নাম বলে দিয়েছিল। গুণ্ডাদের দলের কেউ মনে হয়, করবীর সামনেই সেই খুনটা করেছিল। শুনেছি যে খুন হয়েছিল সম্ভবতঃ সে-ই হল দয়িতার বাবা।’
‘এমন একটা মেয়ে আমার ছেলেটাকে বশ করেছে, হায় ঈশ্বর! এখন উপায় কী জয়িতা? ওর হাত থেকে কখনও মুক্তি কি পাওয়া যাবে না?’
‘আমি কী বলব আন্টি! ওর হাত থেকে আমিও যে মুক্তি চাই! আমার সারাজীবনটা ও তছনছ করে দিয়েছে। উপায় জানলে আমিই ওকে—’
ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে উমা বৃষ্টিতে ভিজলেন। অসময়ে এমন মুষলধারায় বৃষ্টি সচরাচর হয় না। তার উপর শহরজুড়ে ভয়ঙ্কর ট্রাফিক জ্যাম। ভেজা শাড়ি উমার গায়েই শুকিয়ে গেল। অবশেষে একটা ক্যাব পেয়ে কোনওমতে বাড়ি ফিরলেন তিনি। দয়িতা আজ ইউনিভার্সিটি যায়নি। সে উমাকে দেখে, কিছু না বলে, কিচেনে চলে গেল। উমা দেখলেন, তীর্থও বাড়ি ফিরেছে। সে উমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘এতবার ফোন করলাম, ফোন ধরছ না কেন? এই অসময়ের বৃষ্টিতে কোথায় গেছিলে? ঠান্ডা লাগলে তোমার শ্বাসকষ্ট হয়!’
উমা সহসা জবাব দিলেন না। পায়ে জল দিয়ে তিনি সোজা রান্নাঘরে ঢুকলেন।
দয়িতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি এখানে কী করছ? সরে যাও, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি বরং তীর্থর কাছে থাকো।’
দয়িতা উমার কথার সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ গায়ে না মেখে বলল, ‘চা হয়ে গেছে মা! আপনার জন্য কাঁচাহলুদ, আদা আর দুধ একসঙ্গে গরম করেছি খেয়ে নিন, ঠান্ডা লাগবে না।’
‘না, আমার ওইসব লাগবে না।’ কথাটা বলেই উমা দেখলেন দয়িতার মুখটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেছে। এতে তাঁর একধরনের মানসিক তৃপ্তি হল।
পরদিন সকাল থেকেই উমার শরীর ভীষণ খারাপ। জ্বর ও সেইসঙ্গে প্রবল শ্বাসকষ্ট। দয়িতা উমার কাছে থাকার জন্য পরদিনও ইউনিভার্সিটি যায়নি। জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন অবস্থায় উমা একসময় তাঁর মাথায় ঠান্ডা অনুভূতি পেলেন। দয়িতা তাঁর মাথায় জল দিচ্ছে। জ্বর নেমে গেলেও মেয়েটা তাঁর মাথার কাছ থেকে উঠল না। উমা একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন।
দয়িতা এখন এক দৃষ্টে উমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সে জানে উমা তাকে একদম সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু সে তীর্থকে নিয়ে শান্তিতে সংসার করতে চায়। প্রথম দিন থেকেই তীর্থকে তার ভালো লেগেছে। নিজের ভয়ঙ্কর অতীতকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে চায় সে। নতুন জীবনে দয়িতা হতে চায় এক নতুন মানুষ। তাই ফুলশয্যার দিনে তীর্থের মুখে যমুনা নামটা শুনেই সে তীর্থকে জোর করে তাকে যেন যমুনা নামে ডাকা হয়।
সংসার জীবনে শান্তিতে থাকতে উমার সমর্থন ও ভালোবাসা দরকার দয়িতার। কিন্তু কী ভাবে? এর আগে দয়িতা কখনও উমাকে নিয়ে এত গভীর ভাবে ভাবেনি। কিন্তু উমার যে তাকে ভয়ানক অপছন্দ সে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে কয়েকদিন ধরে। সে নিবিষ্টভাবে উমার দিকে তাকিয়ে রইল। দয়িতার মন ধীরে ধীরে এক অজানা জগতের গভীরে প্রবেশ করতে লাগল।
সমস্ত পৃথিবী অস্পষ্ট হয়ে তার সামনে ধরা দিল ঘনকালো অসীম মহাকাশের মতো একটি ছবি, সেখানে অজস্র ছোট ছোট নক্ষত্রের মতো কিছু উজ্জ্বল অংশ জ্বল জ্বল করছে। এগুলি হল মস্তিষ্কের অ্যাকটিভ সেলস। মানুষের মস্তিষ্কের বহুকোষ নিষ্ক্রিয় থাকে, আর সেখানটা দয়িতা অন্ধকার হিসেবে দেখছে। এই চিত্র উমার মস্তিষ্ক তথা গহন ও অতল মনের চিত্র। যেখানে দয়িতা এইমাত্র প্রবেশ করেছে। দয়িতা নিজেকে এখানে স্থায়ীভাবে ইন্ট্রোডিউস করতে চায়। সে খুঁজে বেড়াতে লাগল। কিছু কাজে লাগানোর মতো ডেটা এখান থেকে তার এখনই রিভাইভ করা দরকার। দয়িতা আত্মমগ্নের মতো বসে আছে, সে যেন চিত্রার্পিত। উমা ঘুমিয়ে আছেন এবং সম্ভবত তিনি একটি স্বপ্ন দেখছেন, কারণ তাঁর র্যাপিড আই মুভমেন্ট হচ্ছে।
অনেকদিন আগের কথা। উমা শুয়ে আছেন হাপাতালের একটি বেডে। তাঁর বিয়ের দু বছরের মাথায় মিসক্যারেজ হয়েছে। ডাক্তার এসে তাঁকে বললেন, তার পেটের শিশুটি ছিল একটি আটমাস বয়সের কন্যাসন্তান। উমা ঘুমের মধ্যে সেই কতদিনের পুরনো কথা মনে করে হঠাৎ ভীষণ কষ্টে ফুঁপিয়ে উঠলেন। সেদিনের সেই অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা, স্মৃতির অতল অন্ধকার থেকে তাঁর সামনে হঠাৎ এসে দাঁড়ালো। চোখ মেলেই তিনি মাথার পাশে দয়িতাকে বসে থাকতে দেখতে পেলেন। দয়িতা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে। উমার মনে হল, মেয়েটা যেন তাকে নিয়ে ভারী দুশ্চিন্তায় আছে। তার মুখ চোখ শুকনো। হয়তো সে সারাদিন কিছুই খায়নি।
তার হঠাৎ মনে হল দয়িতা শান্ত এবং চমৎকার একটি মেয়ে, আর তাকে দেখতে অতটাও খারাপ নয়, যতটা তিনি এতদিন ভাবতেন। কাছ থেকে দেখে বরং কেন যেন আজ দয়িতাকে বেশ সুশ্রীই মনে হল তাঁর। একধরনের কোমলতা মাখা আছে দয়িতার মুখে যা জয়িতার মুখে একেবারেই নেই। তীর্থ খুব একটা ভুল তো বলেনি!
উমার হঠাৎ মনে হল, মানুষের রূপ বা বাইরের আবরণ হল সম্পূর্ণ তুচ্ছ। আসল হল তার অন্তর। কেমন চোখে সে তার সামনের মানুষটিকে দেখবে, তা কেবল তার নিজের মনের উপরই নির্ভর করে।
বাইরের রূপ তো আপেক্ষিক! সুন্দর আর কুৎসিত হয় কেবল মানুষের মন।