ইমিগ্রেশান অফিসার হাসিমাখা মুখে অভ্যর্থনা জানায়। রাত প্রায়তিনটে বাজে। রবিবারের সকাল হতে বেশি বাকি নেই আর। ক্লান্ত শরীরে ব্যাগ-এন্ড-ব্যাগেজ টানতে টানতে ধীর পায়ে কেম্পেগৌড়া এয়ারপোর্টের বাইরে আসে উজান।ওর নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষা করছিল ড্রাইভার। গভীর রাত্রে ট্রাফিকহীন রাস্তায় হু-হু করে ছুটে চলে গাড়ি।
বেশ কয়েক বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরছে উজান। যদিও কলকাতা নয় ব্যাঙ্গালুরু। তাও উৎফুল্ল লাগছে বেশ। মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। শেষপর্যন্ত ভারতবর্ষের সিলিকন ভ্যালিতে এসে পৌঁছেছে সে। ব্যাঙ্গালোরবাসী বন্ধুরা বলেছে এখানে এলেই সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। চিন্তার কোন কারণ নেই। সুতরাং মাত্র এক ব্যাগ বস্ত্র ও এক ব্যাগ বই নিয়ে চলে এসেছে সে। দরকার মতো বাকি সব কিনে নেবে।
জেটল্যাগ কাটাতে রবিবার সারাটা দিন ঘুমিয়েই কাটাল প্রায়। মাঝে ফোন করে রুমে খাবার আনিয়ে খেয়েছিল একটু।
সোমবার সকালে শরীর অনেকটা ঝরঝরে বোধ করল। ব্রেকফাস্ট খেতে রেস্টুরেন্টে গেল। ইডলী, দোসা, বড়া, সম্বর, চাটনি, বিসি বেলে বাথ, কারা বাথ, কেসরি বাথ। নানা রকমের ভাত। ভাত নয় বাথ। খাবারের স্বাদ সবসময় তার নিজস্ব জায়গাতেই সেরা। সব কিছু একটু একটু করে প্লেটে তুলে নেয় উজান।
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে ‘দ্য হিন্দু’ নিউজ পেপারটায় চোখ বোলায়। কাবেরী নদীর জলবন্টন সমস্যার ওপর এক ইন্টারেস্টিং আরটিক্ল আছে। কিন্তু পড়ায় একটুও মনঃসংযোগ করতে পারে না। নানা ভাষার ক্যাকোফোনির মধ্যে একটা কাপলের বাংলায় নিচু স্বরে প্রেমালাপ কানে আসছে। আর সে অনিচ্ছে সত্ত্বেও কোন এক অমোঘ আকর্ষণে আড়িপেতে শুনে চলেছে। জোর করে উঠে পড়ে সে।
প্রথম দিন একটু তাড়াতাড়িই আফিস যেতে চায়। রেডি হয়ে রিসেপশানে এসে জানতে পারে এখানে রাস্তায় বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরা যায় না। আগে থেকে প্রাইভেট ট্যাক্সি বা ওলা-উবের বুক করতে হয়। তবে অটো যাবে সব জায়গায়। অগত্যা উজান একটু হেঁটে মেন রোডে গিয়ে অটোর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
পাক্কা কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে আছে সে। পাঁচজন অটোচালকে এলো এবং প্রত্যেকেই ‘উলটো দিক থেকে অটো ধরুন’ উপদেশ দিয়ে অন্য যাত্রী তুলে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এই ভয়ানক ট্রাফিকে উজান কিছুতেই সাহস করে রাস্তা পেরোতে পারল না। বাইক, অটো, ট্যাক্সি এবং বাসে ড্রাইভাররূপী জেমস বন্ডরা যেন শহরের সব ট্র্যাফিক নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছে। দু’চার মিনিট ডান দিকে বাঁদিকে হেঁটে কোথাও কোন সিগন্যাল বা জেব্রা ক্রসিং দেখতে পেল না। ব্যাঙ্গালোরের রাস্তায় পদার্পণ করে প্রথম দিনেই নিজেকে এমন দিশেহারা লাগবে স্বপ্নেও ভাবে নি।
হঠাৎ এক অটোচালক অবতাররূপ ধারণ করে উপস্থিত হয়।
—নিশ্চয় যাব স্যার। ভাড়াটা একটু এডজাস্ট করে দেবেন।
—কতো লাগবে?
—স্বল্প এডজাস্ট মাড়ি স্যার। দেখছেন না কিরকম জ্যাম রাস্তায়।
একটু চিন্তিত মুখে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,
—মিটারে যা উঠবে তার ডবল দিয়ে দেবেন স্যার।
অগত্যা ডবল টাকা দেবার এগ্রিমেন্টে করে অফিসের দিকে রওনা দেয়। অস্বাভাবিক জ্যাম। উল্টোদিকে প্রায় দু কিলোমিটার গিয়ে ইউটার্ন করে একই জায়গায় রাস্তার ওপারে পৌঁছতেই লেগে গেল আরো কুড়ি মিনিট। প্রথম দিনেই অফিসে লেটে পৌঁছবে ভেবে মনটা খচখচ করছিল খুব। অটোচালককে জিগ্যেস করল, কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে?
—আপনাকে কটায় পৌঁছতে হবে স্যার।
—দশটার মধ্যে হলে ভালো হয়।
—পরোয়াগিল্লা স্যার।
বলেই অটোর স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে এক প্রচণ্ড সরু গলিতে ঢুকে পড়ল সে। সেটা নাকি দুর্ধর্ষ এক শর্টকাট। দুদিকে সারি দিয়ে নানা ধরনের দোকান। রাস্তার এক ধারে কীসব পাইপ বসছে, মাটি খুঁড়ে রাশ করা। তার মধ্যে দিয়েই অসাধারণ দক্ষতায় বড় বড় গাড়ি, বাইক, অটো চলছে, মানুষেরা রাস্তা পেরোচ্ছে, ছেলেরা স্কুলে যাচ্ছে। তার ওপর রাস্তা কখনো ঢালু কখনো চড়াই। চোখেমুখে এসে বিঁধছে হাওয়া এবংতার সঙ্গে উড়ে আসা ধুলোবালি। প্রাণ হাতে নিয়ে প্রায় চোখ বন্ধ করে সামনের রড শক্ত করে ধরে বসে রইল সে।
একবার জোরে ব্রেক কষে অটোটা দাঁড়িয়ে পড়তেই সামনে তাকিয়ে দেখে এক বিশাল চেহারার স্বাস্থ্যবান গরু রাস্তা জোড়া করে শুয়ে মনের সুখে জাবর কাটছে। সুন্দর রঙ করা লম্বা শিং, গলার দড়িতে বাঁধা এক শামুক। গাড়ির কর্কশ হর্নের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে উঠে একটু সরে দাঁড়াল। আবার জেমস-বন্ড-স্পীডে অটো চলতে শুরু করল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই গলি পেরিয়ে অটো এসে পড়ল একটা বড় চওড়া রাস্তায়। ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে। তাই চারিদিকে বড় বড় পিলার, লোহার রডের ডাঁই। রাস্তার অবস্থা গাড়ির টায়ার পাংচার হওয়ার জন্যে একেবারে আদর্শ।
একটু দূরেই বিশাল সাইজের খোলা নর্দমা বয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরা। এমন আশ্চর্য সুন্দর রঙের ফুল সে আগে কখনো দেখেনি। নর্দমার ওপর দিয়ে একটা ছোট সেতু। উল্টোদিকে এক সারি সুন্দর সুন্দর বাড়ি। একটা দোকানে বিশাল বিশাল পাত্রে বিরিয়ানী রান্না হচ্ছে। রাস্তার ধারে ধারে অনেক প্রাচীন গাছ। তার বিশাল মোটা মোটা গুঁড়ি। গুঁড়িতে অসংখ্য পোস্টার আটকানো। বেশিরভাগই ছেলেমেয়েদের পেয়িং গেস্টের এডভার্টাইজমেন্ট। কিছু ‘লোক চাই’ বিজ্ঞাপন। সেলসের লোক চাই, ডেলিভারি বয় চাই। মাইনে এমনকী বোনাসও লেখা আছে।
হঠাৎ এক পশলা ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টির ছাঁটটা ডান দিক থেকে এসে শার্টের ডান হাতাটা ভিজিয়ে দিল মুহূর্তের মধ্যে। একেবারে বিরক্তির একশেষ। অটোচালক যেন বুঝতে পেরেই হঠাৎ মেট্রো ফ্লাইওভারের তলায় একটা থামের আড়ালে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে দিল।
—পাঁচ মিনিট দাঁড়ান স্যার। বৃষ্টিটা থামলে আবার যাব।
—পাঁচ মিনিটে বৃষ্টি থামবে?
—খন্ডিতাভাগি।
এতো একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কোন চান্স নেই থামার। কখন অফিস পৌঁছবে কে জানে। অটোওলা ওকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে দিব্যি একটা চা-সিগারেটের দোকানে গিয়ে নিশ্চিন্তে আড্ডা দিতে শুরু করল।
আশ্চর্য। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই বৃষ্টি শেষ হয়ে ঝলমলে রোদ উঠে গেল। জলে ভেজা গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি। মাটি যেন মরুভূমির মতো সব জল শুষে নিয়ে খটখটে শুকনো হয়ে গেলো। অটো চলতে শুরু করল আবার।
মিনিট দশের মধ্যেই অফিস পৌঁছে গেল। ভাড়া মিটিয়ে অফিসে ঢুকতে যাবে, সিকিউরিটি আটকাল। চিঠি দেখিয়ে, সই করে, ভিজিটার্স কার্ড গলায় ঝুলিয়ে প্রথম গেট পেরোল। দ্বিতীয় গেটে ব্যাগ এমন ভাবে সার্চ করা হল যেন সে সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী। অতঃপর ভেতরে ঢোকার অনুমিত মিলল।
অফিসের দেওয়ালগুলোতে বেশ আধুনিক গদ্য কবিতার মতো মর্ডান-আর্ট, পেন্টিং ও নানান কোটেশান দিয়ে সাজানো। একটা বোর্ডে লেখা আছে ‘গ্রোথ’। এই কথাটা শুধু আই টি ইন্ডাস্ট্রি কেন সারা পৃথিবীর কাছেই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, অর্জুনের সামনে মাছের চোখের মতো একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ কথাটার সামনেই একটা টবে বাঁশগাছ রাখা। গ্রো করতে গেলে বাঁশ খাবেই, এটাই কি বোঝাতে চেয়েছে?
প্রাথমিক জয়েনিং ফরমালিটিস সেরে নিতে সময় লাগল না। রিপোর্টিং ম্যানেজার মিঃ গণেশন-এর সঙ্গে আলাপ হল। উনি একটা শর্ট ইন্ট্রোডাকশান দিলেন অফিস আর প্রজেক্ট নিয়ে। ওদের কোম্পানির মোট পাঁচটা অফিস আছে ব্যাঙ্গালোরে। এই হেড অফিসটা একদম সিটি সেন্টারে। বাকি চারটে অফিস শহরের চার প্রান্তে। উজান এই অফিসেই বসবে। টিমের সঙ্গে মিটিং করার জন্যে তাকে অবশ্য মাঝে মাঝে হোয়াইটফিল্ডের অফিসে যেতে হবে। অফিসের গাড়ি প্রত্যেকদিনে সকালে দু’বার, বিকেলে দু’বার ইন্টার অফিস যাতায়াত করে। সেটা ধরে নিলেই হবে।
একদিনের আলাপে ভদ্রলোককে বেশ মাই ডিয়ার লোক বলেই মনে হলো। বললেন,
—কদিন একটু রিল্যাক্স করো। ব্যাঙ্গালোরের রাস্তা ঘাট চেনো। কাছাকাছি একটা ভালো বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেটল করে যাও। তারপরে মন লাগিয়ে কাজ শুরু করবে। ততদিন সকালের দিকে রোজ টিমের সঙ্গে একটা নলেজ শেয়ারিং সেশান চালু রাখো। অল্প অল্প করে কাজ বুঝতে শুরু করো। টিমের সঙ্গে আলাপ পরিচিতিটাও হয়ে যাবে।
ম্যানেজারের সঙ্গেই লাঞ্চ সেরে নিল অফিস ক্যান্টিনে। টিপিক্যাল সাউথ ইন্ডিয়ান লাঞ্চ - নানা রঙের ভাত, নানা ধরনের ডাল, পাঁপড়, আচার। লাঞ্চ করতে করতে গাছপালায় ভরা ভিজে ভিজে সবুজ শহরটা খুব মনোরম লাগছিল দেখতে। ঝকঝকে ঘরবাড়ি, নানা রঙের ফুলগাছ, স্টেডিয়াম, স্কুল কমপ্লেক্স। মন্দির, মসজিদ, চার্চ।
লাঞ্চ সেরে অফিস থেকে বেরিয়ে আশেপাশে একটু ঘুরে দেখল। মাল্টিস্টোরিড অফিস বিল্ডিং আর মল-এর পাশাপাশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা রকমের দোকান। জুতো থেকে বই, খেলনা থেকে চারচাকা গাড়ি, গয়না থেকে জামাকাপড় সব কিছু মিলবে। দেশি-বিদেশি নানা কুইজিনের রেস্টুরেন্ট, কফি শপ থেকে ফাইভ স্টার হোটেল, লিকার শপ থেকে ব্রু পাব - সব জায়গায় উপচে পড়েছে ভিড়।
এয়ারটেলের অফিসে ঢুকে একটা লোকাল সিম কার্ড কিনে লাইফলাইন এক্টিভ করল উজান। দু সপ্তাহ মাত্র গেস্ট হাউসের একোমোডেশান। তার মধ্যে বাড়ি খুঁজে নিয়ে মুভ ইন করে যেতে হবে। নতুন বাড়িতে বিছানা থেকে চেয়ার টেবিল মায় খাওয়ার প্লেট, চায়ের কাপ সব কিছু কিনতে হবে। অন্তত একটা বন্ধু কাছাকাছি থাকলেও অনেকটা সুবিধে হতো। কিন্তু কলেজের যে দুজন বন্ধু এখানে আছে তাদের একজন থাকে ইলেক্ট্রনিক সিটিতে, একজন ইয়েলাহাংকায়। ওগুলো নাকি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। ব্যাঙ্গালোরের বিখ্যাত জ্যামের দৌলতে উইকেন্ড ছাড়া দেখা করার কোন উপায় নেই।
গেস্টহাউসে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির ব্যাপারে আলোচনা করে নেয়। সেই মতো ম্যাজিকব্রিক্স ডট কম আর হান্ড্রেড একারস ডট কমে লগ ইন করে রেজিস্টার করে। নিজের ফোন নাম্বার, কোন লোকালিটিতে কী রকম বাড়ি চাই লিখে দেয়। ওর চাহিদা খুব অল্প। দু কামরার ফ্ল্যাট। আলো হাওয়া থাকবে। কমপ্লেক্সটা এমন হবে যাতে নিশ্চিন্তে একটু মর্নিং বা ইভনিং ওয়াক করতে পারে।
ব্রোকাররা অসম্ভব প্রম্প্ট। আধঘন্টার মধ্যেই ফোন আসা শুরু হয়ে গেল। দুজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঠিক হলো ওরা ঠিকানা মেসেজ করে দেবে। অফিসফেরত পাঁচটা নাগাদ ঐ ঠিকানায় ওকে পৌঁছে যেতে হবে। সেখান থেকে নানা জায়গায় বাড়ি দেখানোর দায়িত্ব ওদের।
পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল বাড়ি খোঁজা অভিযান। অটোতে করে যাওয়া সহজ। কিন্তু বেশিরভাগ অটো মিটারে যেতে রাজি হয় না। ভাড়া নিয়ে দরাদরি করে ক্লান্ত হয়ে উবের নিতে শুরু করে উজান।
প্রথমে গেল স্টারলিং আপার্টমেন্টে। ব্রোকার বলল – খুব বড় ফ্ল্যাট স্যার। তিনটে রুম।
—কিন্তু আমার দরকার তো টু রুম।
—টু রুমের দামেই পাবেন স্যার।
সাজানো গোছানো ছোট্ট কমপ্লেক্স। হাঁটার কোন জায়গা নেই। ফ্ল্যাটের ডিজাইন ভালো। কিন্তু একটুও আলো ঢোকেনা ঘরগুলোতে।
দ্বিতীয় বাড়ি ‘রাজেন্দ্র এনক্লেভ’। একটা ছোট্ট পার্কের পাশে। তিনতলার ফ্ল্যাট। সুন্দর বারান্দা আছে। আরাম করে গল্পের বই পড়া যাবে, ছোটদের খেলা দেখা যাবে। কিন্তু লিভিং রুমের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে বিসদৃশ ঠাকুরঘর। নাহ, এ চলবে না। অত ভগবানে মতি নেই তার।
—স্যার, এটা তো ভালো। ম্যাডামের খুব ভালো লাগবে। বিয়ে করেছেন স্যার?
—না করিনি এখনো।
—আজ নয় কাল তো করবেন স্যার।
ওর মুখে বিরক্তির আভাস দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
—আপনার মায়ের খুব পছন্দ হবে স্যার।
তৃতীয় ‘প্যারাডাইস এপার্টমেন্ট’ বেশ পছন্দসই। কিন্তু বিল্ডিংটা মেন রোড থেকে অনেকটা ভেতরে। গাড়ি ছাড়া এখানে থাকা অসম্ভব। অফিস যাতায়াত করা, বাজার করা সবই অসুবিধাজনক।
চতুর্থ ‘শ্রীনিকেতন’। নামে ‘শ্রী’ থাকলেওরূপে কোন শ্রী নেই। কমপ্লেক্সটা একটা খাঁচা, ফ্ল্যাটগুলো দেশলাই বাক্সর মতো। নিচে বা আশেপাশে কোথাও কোনজায়গা নেই। বেরোলেই বস্তি। ভাড়াটা যদিও অনেকটাই কম।
আরো গোটাকয়েক বাড়ি দেখে সে এতটাই হতাশ হয়ে গেল যে ব্রোকারদের বলল, সে কয়েকদিন আর কোন বাড়ি দেখতে চায় না। গেস্ট হাউসে অলরেডি এক সপ্তাহ কেটে গেছে। এত তাড়াতাড়ি কিছু করা যাবে না। আরো পনেরোদিন থাকাটা এক্সটেন্ড করতে হবে।
তার স্ট্রাটেজিতেও কিছু বদল দরকার। যত গুড় ঢালবে তত মিষ্টি হবে বাড়ি। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হবে কতোটা গুড় সে ঢালবে। মোটামুটি পছন্দের ফ্ল্যাট নিতে হলে বাড়িভাড়া লাগবে মাসে তিরিশ হাজার টাকা। এগারো মাসের রেন্ট এগ্রিমেন্ট হবে। দশ মাসের এডভান্স দিতে হবে বাড়িওয়ালাকে আর ব্রোকার নেবে এক মাসের টাকা। তারওপর বাড়িতে ঢুকলেই অনেক জিনিষ কিনতে হবে। এক ধাক্কায় প্রায় লাখ চারেক টাকা খরচ।
বন্ধুদের সঙ্গে উইকেন্ডে দেখা করবে ঠিক করে রেখেছিল। নিখিল মেয়ের জ্বর বলে আসতে পারল না। সুমন গেস্ট হাউস থেকে ওকে গাড়িতে পিক আপ করে নিল। জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করে আর লম্বা আড্ডা দিয়ে মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেল। সুমন বছর দুই হলো বিয়ে করেছে। তার মধ্যেই একটা ছোট্ট ভুঁড়ি বানিয়ে ফেলেছে।
—সারাদিন বসে বসে কাজ আর কনফারেন্স কল। অন্য কিছুর সময়ই হয়না। তুই একটু সেটল করে যা। গাড়ি কেন। তারপর চল একটা উইকেন্ড ট্রিপ দিই। এখানে কাছেপিঠে অনেক বেড়াতে যাওয়ার জায়গা। উটি, মাইসোর, কুর্গ।
বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনেই উত্তেজিত হয়ে গেল উজান।
—ভাবছি গাড়ি কিছুদিন পরে কিনব। তোর বা নিখিলের গাড়িতে আমার জায়গা হবে না?
—অবশ্যই হবে। কিন্তু বাইক বা গাড়ি ছাড়া ব্যাঙ্গালোরে রোজ যাতায়াত করবি কী করে? এই কুখ্যাত ট্রাফিকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুব স্ট্রেসফুল। অবশ্য বাড়ি থেকে অফিস হেঁটে যাতায়াত করতে পারলে বেস্ট।
গেস্ট হাউসে ফেরার সময় ওদের গাড়ির সামনেই একটা ছোটখাট একসিডেন্ট হয়ে গেল। একটা টয়োটা গলি থকে স্পীডে বেরিয়ে এসে সামনের ফোর্ডকে ধাক্কা দিল। খুব জোর ব্রেক করেছিল তাই সাংঘাতিক কিছু হয় নি। কিন্তু রাস্তার মাঝখানেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে দুই ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তার সব ট্রাফিক মুভমেন্ট সাময়িক ভাবে স্তব্ধ। দুজনে নিচু হয়ে বাঁদিকে হেলে ডান দিকে হেলে কার গাড়ির কী ক্ষতি হয়েছে পর্যবেক্ষণ করল খানিকক্ষণ। তারপর কোন ঝগড়া-চেঁচামেচি না করে নিঃশব্দে যে যার গাড়িতে উঠে চলে গেল। ট্রাফিক আবার ক্লীয়ার।
উজান বলল - কী আশ্চর্য! আমি তো ভাবছিলাম হাতাহাতি হবে। অন্তত একটু কথা কাটাকাটি। সুমন খুব ঠান্ডা গলায় বলল – এরা বেশিরভাগ এরকম বিন্দাস টাইপ। জানে ঝগড়া করে বিশেষ কিছু লাভ নেই।
সোমবার থেকে ভলভো বাসে অফিস যাতায়াত শুরু করেছে উজান। রাস্তাগুলোও চেনা হয়েছে কিছুটা। বাস স্টপেজ থেকে গেস্ট হাউস দশ মিনিট লাগে হাঁটতে। কিন্তু এয়ারকন্ডিশান বাসে যাতায়াতটা আরামদায়ক। কানাড়া গানের সুর উপভোগ করতে করতে টুক করে পৌঁছে যায়। জ্যামে আটকে থাকলেও বিরক্ত লাগে না।
অফিস থেকে বেরিয়েই সেদিন দেখল ওর গেস্ট হাউসে ফেরার ভলভোটা আসছে। রাস্তার উলটো দিকে স্টপেজ। সিগন্যাল ছাড়া রাস্তা পেরোনোতে সে এখনো সড়গড় হয়নি বিশেষ। ভলভোটা মিস করলে আবার আধঘন্টা অপেক্ষা। কিছুটা জোরজবরদস্তি সাহস দেখিয়ে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পেরোতে গেল। কিন্তু বাস পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই ধাক্কা খেল এক স্কুটারধারীর সঙ্গে। স্কুটারধারী ছিটকে পড়ল ফুটপাথ ঘেঁষে। স্কুটার রাস্তায় ধরাশায়ী। স্কুটারের ওপর ধরাশায়ী সে।
মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটা লোক জমে গেল। বাদামওয়ালা, ফলওয়ালা, অটো ড্রাইভার, দু’চারজন পথচারী মানুষ। নানারকম মন্তব্য ভেসে আসছে অবোধ্য ভাষায়। একটা কুকুরও লেজ নাড়তে নাড়তে চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় উজান। ভাগ্যক্রমে তেমন চোট পায়নি কোথাও। বাসে আর ওঠা হলো না। কান মাথা গরম হয়ে আছে। কি কাণ্ডজ্ঞান মেয়েটির! চোখ বন্ধ করে কি স্কুটার চালাচ্ছিল? একটা মানুষ রাস্তা পেরোচ্ছে দেখতে পাচ্ছে না? মেয়ে তো নয় সাক্ষাৎ টেররিস্ট। কালো টি শার্ট, কালো জীনস। চোখ বাদে বাকি পুরো নাকমুখ মাথা সব কালো দোপাট্টা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। খালি স্কুটার আর হেলমেটটা টকটকে লাল।
লোকজন এসে স্কুটারটা তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। মেয়েটি আগেই উঠে পড়েছে। কনুই-এর কাছে একটু চোট পেয়েছে মনে হয়। মেয়েটি কিছু একটা বলতে জমে যাওয়া লোকের ভিড় ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে গেল।
মেয়েটা ওর সামনে এগিয়ে এসে বলল,
—স্যার, লেট আস সেলিব্রেট দিস ননফেটাল এক্সিডেন্ট উইথ আ কাপ অফ কফি। সিসিডি ইজ জাস্ট এরাউন্ড দা কর্নার।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না উজান। মেয়েটা কি তার সঙ্গে ডেটিং করতে চাইছে? আধ ঘন্টার আগে তো বাসও পাওয়া যাবে না। রাগটা জল হয়ে যায় নিমেষে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়
—নট আ ব্যাড আইডিয়া।
দুজনে হাঁটতে থাকে কফি শপের দিকে। মেয়েটির পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ, গলায় পরিচিত আইটি কোম্পানির আইডি কার্ড। মেয়েটির স্মার্টনেসে উজান ইম্প্রেসড। প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না তো? ব্যাঙ্গালোর ওর জন্যে হ্যাপেনিং প্লেস হতে যাচ্ছে নিশ্চিত। ‘মন তাই ভাবছে – কী হয় কী হয়, কী জানি কী হয়’।
কাফে কফি ডেটা বেশ ফাঁকা। কর্নারের দিকে একটা টেবিলে বসে উজান। মেয়েটি গিফট র্যাপ খোলার মতো প্রথমে ল্যাপটপটা রাখে একটা ফাঁকা চেয়ারে। তারপর তার লাল হেলমেট খুলে টেবিলে রাখে। তারপর টেররিস্ট স্টাইলে বাঁধা দোপাট্টার বাঁধন খুলতে থাকে। এদিকে চোখে হাসি উপচে পড়ছে। চোখ দেখেই হার্ট বন্ধ হবার জোগাড় উজানের। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে মোড়ক উন্মোচনের। দোপাট্টা সরিয়ে যখন মেয়েটি তাকালো তখন উজান পুরো বোল্ড আউট।
—ঊর্মি!! ওহ মাই গড।
—কেমন আছেন স্যার? আপনি কোথায় প্রেমে পড়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আর কিনা সেই পুরোনো পাপীর সঙ্গে আবার মোলাকাত।
—ভারতীয় মেয়েরা কবে থেকে এত স্মার্ট হলো? এই ভাবে রাস্তায় ধরাশায়ী হওয়ার পরে কেউ কফি খেতে অফার করতে পারে!
—অনেস্টলি আপনাকে দেখে একটু ফ্লার্ট করার লোভ সামলাতে পারলাম না। আশা করিনি আপনি কফি খেতে রাজি হবেন। ধাক্কা দেওয়ার জন্যে আমি সত্যিই খুব দুঃখিত স্যার।
প্রায় ছ’বছর পর দেখা হল ঊর্মির সঙ্গে। ইঞ্জীনিয়ারিং পড়ার সময় বেশ কয়েকটা টিউশান করেছিল উজান। ঊর্মি ছিল তার সব থেকে উজ্জ্বল ছাত্রী। কিশোরীর খোলস ছাড়িয়ে সে এখন সপ্রতিভ ঝকঝকে এক তরুণী।
—আর কতোদিন এই ‘আপনি’-টা চালাবে।
—কেন স্যার? আপনি সম্বোধনটা কিন্তু কিছু কম রোমান্টিক নয়।
—দয়া করে অন্তত ‘স্যার’ বলো না প্লীজ। ব্যাঙ্গালোরে এসে থেকে ‘স্যার’ শুনে শুনে আমার মাথা চিড়বিড় করছে। ইমিগ্রেশন অফিসার থেকে অটো ড্রাইভার, অফিসের সিকিরিটি গার্ড থেকে টিমের ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত চান্স পেলেই স্যার স্যার করছে। নাম ধরে ডাকতে বললেও শোনে না।
—দাঁড়ান। আপনাকে স্যার-মর্মটা বোঝাই তাহলে।
ঊর্মি জমিয়ে বসে ওকে ‘স্যার’ কথাটার মর্ম বোঝাতে শুরু করল। ‘স্যার’ নাকি এরা সম্মান জানানোর জন্যে বলে। তেল দেওয়ার জন্যে মোটেই নয়। এটা এখানকার কালচার।
—‘স্যার’ কথাটা ব্যাঙ্গালোরে একটা ম্যাজিক ওয়ার্ড। যখনই কোন কাজ উদ্ধার করতে হবে তখন প্রত্যেকটা বাক্যের আগে পিছে ‘স্যার’ যোগ করে দেবেন। পাঁচটা বাক্য পিছু কমপক্ষে দুটো করে স্যার। ম্যাজিকের মতো কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে। ধরুন একটা ভুল করে ফেলেছেন, বলবেন, সরি স্যার। হিসেবের খাতা সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার। দু মিনিট পরে আবার দোষ করুন কোন অসুবিধে নেই। আর একবার ‘সরি স্যার’ বললেই হবে।
দুজনেই হাসতে থাকে। কফি আর স্মোকড চিকেন স্যান্ডুইচ অর্ডার দেয় উজান। খেতে খেতে কথাবার্তা চলতে থাকে। ঊর্মির অফিস হোয়াইটফিল্ডের আইটি পার্কে। অফিসের কাছেই আরো দুই বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে থাকে। এই পুরো সপ্তাহটা ডেটা এনালিটিক্সের ওপর একটা ট্রেনিং করতে এদিকে আসতে হচ্ছে। নাহলে এদিকে সে সচরাচর আসে না।
—ভাগ্যিস ট্রেনিং ছিল।
—না হলে ধাক্কা-ধাক্কিটা হতো না আর মোলাকাতও হতো না।
—একদম তাই। এই শহরে তোমায় কোথায় খুঁজে পেতাম বলো। বিয়ে করেছ?
প্রশ্নটা করে ফেলেই খুব অপ্রস্তুত লাগে উজানের। এত তাড়াতাড়ি এতটা কৌতূহলী হওয়া উচিত হয়নি।
—সরি। প্রশ্নটা ইগনোর করতে পারো।
ঊর্মি হেসে ফেলে,
—নাহ্। করি নি এখনো। প্রেমে পড়ছি না কিছুতেই। কলকাতায় থাকলে হয়তো একটা সুযোগ থাকত। কিন্তু চাকরির শুরু থকে চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর ঘুরে বেড়াচ্ছি।
—কোন যোগ্য প্রেমিক নেই এখানে?
—আছে নিশ্চয় কিন্তু আমি পেলাম না কাউকে। হয় ঠাকুরদা টাইপ রক্ষণশীল পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার মানুষ, নয় ঠাকুমা-টাইপ ঠাকুর-দেবতা ভক্ত অথবা গোপাল-বড়-সুবোধ-বালক টাইপ আদরের নাড়ুগোপাল। আর এদের কাস্টের কী রকম গোঁড়ামি তা তো জানেন না!
মনে পড়ে গেল ছয় বছর আগের দিনটা। হঠাৎ অফিস থেকে ওকে টেক্সাস পাঠানোর কথা ঠিক হয়। লং টার্ম। প্রাথমিক ভাবে তিন বছরের জন্যে। বাড়ি থেকে বাবা-মা বিয়ে করে যেতে অনুরোধ করে। অফিস দু-তিন মাস সময় দিয়েছিল। পাত্রী দেখার ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু ঊর্মি ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করার কথা ও ভাবতেই পারে নি সেদিন। একদিন ঊর্মিকে ফোন করে পিটার ক্যাটে ডেকে নেয় লাঞ্চে। ও তখন সবে ইঞ্জীনিয়ারিং পাস করেছে। চাকরির অফার আছে হাতে কিন্তু জয়েন করে নি তখনো। অনেক দিন পরে দেখা হবে, তাই জয় গোস্বামীর কতকগুলো কবিতার বই নিয়ে নেয় উপহার হিসেবে।
ঊর্মিকে ও ওর আমেরিকা যাওয়ার কথা জানায়। তারপর কোন ভূমিকা না করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বিয়ের কথা শুনে ও আকাশ থেকে পড়ে। সোজা জানিয়ে দেয় যে ও উজানকে বিয়ে করতে পারবে না।
—কাউকে পছন্দ করো?
—না সেরকম ব্যাপার নয়। আপনাকে পছন্দই করি আমি।আপনি বিয়ের পাত্র হিসেবেও আদর্শ।
—সমস্যাটা কী তাহলে?
—আপনি এতদিন আমাকে পড়িয়েছেন। একবারও বলেন নি কেন?
—আমি তোমাকে পড়াতাম সেটাই একটা মানসিক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেবল মনে হতো তুমি এত ছোট। কীভাবে নেবে।
—মাত্র তিন বছরের ছোট।
—ভেবেছিলাম আরও কিছু দিন পরে বলব। তোমার পড়াশোনাটা শেষ হোক। হঠাৎ করে আমেরিকা যাওয়াটা ঠিক হয়ে গেল তাই বিয়ের তাড়াহুড়ো। আমাকে নাকচ করার কারণটা কিন্তু এখনো জানতে পারলাম না।
—চাকরি করলাম না, প্রেম করলাম না। বিয়ে করা যায়?
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ওর মতামত টলাতে পারে নি সেদিন। ওর স্বপ্ন, ও চাকরি করে নিজের ইচ্ছেমতো মাইনের পয়সা খরচ করবে। উদ্দাম প্রেম করবে। আর প্রেম করে যখন মনে হবে আর ছেড়ে থাকা যাচ্ছে না, তখনই বিয়ে করবে। কী নিস্পৃহ মুখে ওর প্রস্তাব নাকচ করেছিল সেদিন। আমেরিকা যাওয়ার পুরো আনন্দটাই মাটি হয়ে গিয়েছিল। তারপর অনেক মেয়েকে ভালো লেগেছে। কিন্তু সেই ভালোলাগাটা বাউন্ডারি লাইন টপকে একচুলও এগোতে পারেনি যে উজান আর কিছু ভাববে।
—আমার কথা থাক। আপনার কথা বলুন স্যার। কতদিন এসেছেন এই শহরে? কত দিন থাকবেন?
ও নিজের কথা বলে। বলে গেস্ট হাউসের কথা। ওর বাড়ি ভাড়া নিয়ে অশান্তির কথা। সব শুনে ঊর্মি পরামর্শ দেয় অফিস লোকেশানটা হোয়াইটফিল্ডে নিতে। বাড়িভাড়া অনেক কম হবে। ট্র্যাফিকও অপেক্ষাকৃত ভালো হবে। শুধু ঊর্মি কাছাকাছি থাকবে, উজানের কাছে এটাই যথেষ্ট হোয়াইটফিল্ডে থাকার ডিসিশান নেওয়ার জন্যে। কিন্তু ম্যানেজারকে কি রাজি করাতে পারবে?
ঊর্মি সেটাতে পাত্তা দিল না। খুব কনফিডেন্টলি বলল,
—একটু স্যার স্যার করে অনুরোধ করুন, রাজি হয়ে যাবেন। একদিনে না হলে দু’চারদিন অনবরত বলতে থাকুন।
ঊর্মির এই নতুন রূপ উজানকে আরো অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে টানছে। মন জুড়ে প্রেমে ডুবে যাওয়ার এক নেশাতুর আমেজ। ঊর্মির মনে কি কোন দুর্বলতা আছে তার জন্যে? নাকি সবটাই শুধু সৌজন্যতাবোধ? জানে না উজান। কিন্তু সে বুঝতে পারছে যে হাজারো রঙিন স্বপ্ন আর নতুন সম্ভাবনা জন্ম নিচ্ছে তার মনের মধ্যে।
ব্রোকার পরের দিনই হোয়াইটফিল্ড এরিয়াতে বাড়ি দেখাবে জানায়। উজানের অনুরোধে ঊর্মি তার সঙ্গে বাড়ি দেখতে যেতে রাজি হয়। দুজনে কাফে কফি ডে-র বাইরে দেখা করে একটা উবের ধরে নেয়।
উবেরের ড্রাইভারটি খুব স্মার্ট একটা কমবয়সি ছেলে। বেশ ভালো ইংরেজি বলে। বললো চেন্নাই-এর এক নামকরা কলেজ থেকে সে কম্পুটার সায়েন্স নিয়ে ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করেছে গত বছর। কিন্তু চাকরিতে খুব কম মাইনে তাই উবের চালাচ্ছে।
—উবেরই চালাবে? চাকরি করবে না কখনো?
—আপাতত দু’এক বছর তো চালাবই। তারপর ভেবে দেখব কী করা যায়।
ভয়ানক ট্র্যাফিক আজ। সেন্ট্রাল থেকে ইস্ট ব্যাঙ্গালোর বেশ অনেকটা রাস্তা। পাশে একটা আইটি অফিসের এমপ্লয়ি ভর্তি টেম্পো ট্রাভেলার অনেকক্ষণ ধরে ওদের গাড়িকে বাঁদিক দিয়ে ডান দিক দিয়ে ওভারটেক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর বিশ্রী ভাবে হর্ন বাজাচ্ছে। উজান হর্নের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে উবের ড্রাইভারকে বলল গাড়িটাকে ছেড়ে দিতে। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে রাস্তা একটু ফাঁকা পেয়ে উবের গাড়িটাকে জায়গা করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা হু-হু করে ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে সামনের ক্রসিং এর রেড সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারপরেই প্রায় সিনেমার দৃশ্যের মতো হঠাৎ এক ট্র্যাফিক পুলিস কোথা থেকে ছুটে এসে গাড়িটাকে দাঁড় করালো। আর ড্রাইভারকে কী সপাটে একটা থাপ্পড় মারল! উজান স্তম্ভিত হয়ে গেছে দেখে। সিগন্যাল গ্রীন হতেই আবার সব গাড়ি স্বাভাবিক ভাবে চলতে লাগল - যেন কিছুই হয়নি।
ব্রুকফিল্ড পৌঁছনোর একটু আগে উবেরের ড্রাইভার বলল – একটা অনুরোধ করব স্যার। যা টাকা আপনাকে মোবাইলে দেখিয়েছিল, সেটাই আমাকে নামার সময় দিয়ে দেবেন। কিন্তু ট্রিপটা শেষ করবেন না প্লীজ।
ওরা ব্যাপারটা বুঝছে না দেখে বলে,
—আসলে আমার গার্লফ্রেন্ড ওয়েট করছে ইন্দিরানগরে। অফিস ফাঁকি দিয়ে আজ অনেকদিন পরে বেরোনোর সুযোগ পেয়েছে। এই গাড়িতে ঘুরে ঘুরে একটু প্রেম করব আজ। এইসময় আর কোন প্যাসেঞ্জার তুলতে চাই না। কোইন্সিডেন্টালি আমার গার্লফ্রেন্ডও বাঙালি, স্যার।
উজান আর ঊর্মি পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে ফেলে। উবেরর ভাড়া দিয়ে, ট্রিপ শেষ না করে ওরা নেমে পড়ল কসমস মলের সামনে।
ব্রোকার ফোন করে জানায় ট্র্যাফিকে আটকে রয়েছে সে। পাঁচ-দশ মিনিট লাগবে আরো আসতে। ঊর্মি বললো–চলুন, কফি খাই। ব্রোকারের আসতে আধঘন্টা তো লাগবেই।
—তুমি শিওর?
—একদম। আধঘন্টা দেরি হলেও ওরা হামেশাই দশ মিনিট বলে।
—আর কেউ কিছু বিরক্ত বোধ করে না?
—করে না আবার! কিন্তু করলেও কিছু সুরাহা হয় না। ধীরে ধীরে সবাই বুঝে যায় যে যাহা দশ মিনিট তাহাই আধঘন্টা।
ডানকিন ডোনাটে ঢুকে কফি আর ডোনাট নিয়ে মুখোমুখি বসে দুজনে। উজান তখনো পুলিশের থাপ্পড় মারার দৃশ্যটা মন থেকে সরাতে পারছে না। বলল,
—ট্র্যাফিক পুলিশের সঙ্গে ড্রাইভারটার একটু বাকবিতণ্ডাও হলো না। ব্যাঙ্গালোরকে যত দেখছি তত অবাক লাগছে।
—ব্যাঙ্গালোর শহরের মন্ত্র হলো – ‘স্বল্প এডজাস্ট মাড়ি।’ মানে ‘অল্প এডজাস্ট করুন’। এখানে লোকেরা বেসিক্যালি শান্তিপ্রিয়। একটু আনন্দে, একটু মজায় জীবন কাটাতে চায়। এই যে এত মাল্টিকালচারড পরিবেশ এখানে, কানাড়া না জেনে, শুধু তামিল, তেলেগু, হিন্দি, ইংরেজি বলেই দিব্যি চালানো যায়, তারও কারণ কিন্তু এদের এডজাস্ট করার মানসিকতা। অনেকে অবশ্য বলে এখন লোকেরা আর আগেকার মতো হিউমারাস নেই, অনেক রুক্ষ হয়ে গেছে ব্যবহার।
—আমার যদিও এতটা নজরে পড়েনি এখনো।
—একটু সময় লাগবে স্যার। যেকোন শহরের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। সেটা বুঝতে শহরটাকে একটু ভালোবাসতে হয়, সময় দিতে হয়। থাকুন এক বছর, দেখবেন সব নজরে পড়ছে।
উজান তো শুধু ঊর্মিকেই নজর করে চলেছে। সময় দিয়েছে, ভালোবাসাও। তাও আজও বুঝে উঠতে পারল কই? ‘ভালোবাসবে তবে? বলো, ভালোবাসবে কবে?’
ব্রোকার আসতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগালো। তিনটে বাড়ি দেখল দুজনে। এদিকে অনেক বাড়ির নাম খুব স্টাইলের - লাফিং ওয়াটারস, টেন ডাউনিং স্ট্রীট, পাম মিডোস, ফ্লোটিং গার্ডেন্স, ওসান ব্লু ক্যাসেল, হুইস্পারিং উইন্ডস। ঊর্মি বাড়ির ব্যাপারে অভিজ্ঞদের মতো নানারকম খোঁজখবর নিল। জলের কাবেরী কানেকশান আছে কিনা, গ্রীষ্মকালে জল কিনতে হয় কিনা, ইলেক্ট্রিক এর ব্যাকআপ সাপ্লাই কেমন, অটোমেটিক সুইচওভার হয় কিনা, মেন্টেনেন্সের টাকা আলাদা করে দিতে হবে না ভাড়ার মধ্যে ধরা আছে, ক্লাব ব্যবহার করলে কি আলাদা পে করতে হবে? ভাবখানা যেন সে উজানের বিয়ে করা বউ।
শেষ পর্যন্ত এটলান্টিস এপার্টমেন্টে দশ তলার একটা ফ্ল্যাট খুব পছন্দ হল দুজনেরই। একদম নতুন ফ্ল্যাট। হাফ ফারনিসড। ঘরে কাবার্ড, কিচেনে ক্যাবিনেট গ্যাস ওভেন সব আছে। মুভ ইন করার জন্যে রেডি। কুড়ি হাজার টাকা ভাড়া। সুন্দর কমপ্লেক্স। ক্লাব, জিম, সুইমিং পুল। কী নেই? বাড়িওয়ালার সঙ্গে ফোনে কথা হল। তিনি আমেরিকায় থাকেন। এখানে এসেছেন কিছুদিনের জন্যে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ভাড়া দিয়ে স্বস্থানে ফিরতে চান।
পরদিন সকাল সকাল অফিস যায় উজান। মিঃ গণেশন অফিসে এসে একটু সেটল ডাউন করতেই উজান ওনার ঘরে গিয়ে কথা বলে।
—কেমন আছেন স্যার?
—ফার্স্ট ক্লাস। তোমার কী খবর? বাড়ি পেলে?
—হ্যাঁ স্যার। হোয়াইটফিল্ডে একটা বাড়ি প্রায় ফাইনালাইজ করে ফেলেছি।
—হোয়াইটফিল্ড কেন? এই অফিসের কাছেপিঠে কিছু খোঁজো। সোমবারই একটা হায়ার ম্যানেজমেন্ট মিটিং আছে। তুমি কাছাকাছি থাকলে আমার অনেক কাজের সুবিধে হবে।
—সে ব্যাপারে কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। প্রত্যেক বুধবার আমি এখানে চলে আসব। আপনি বললে, সপ্তাহে দুদিনও আসতে পারি, স্যার। আসলে আমি ভাবলাম পুরো ডেভালাপমেন্ট টিমটা হোয়াইটফিল্ডে বসে। ওদের কাছে থাকলে, প্রোডাক্টিভিটিটা বেটার মনিটার করা যাবে। আপনার তো এ ব্যাপারে অনেক বেশি এক্সপিরিয়েন্স। আপনার কী মনে হয় স্যার?
—সেটা অবশ্য মন্দ বলোনি, উজান। ঠিক আছে তাহলে। মনে রেখো, এখানে কিন্তু দরকার হলেই চলে আসতে হবে।
—নিশ্চয় স্যার। অনেক ধন্যবাদ স্যার।
ঊর্মির পরামর্শ মতো পাঁচটা বাক্য পিছু দুবার স্যার বলতেই কেল্লা ফতে হয়ে গেল। হিউম্যান রিসোর্সের সঙ্গে কথা বলে আইডি কার্ডে এড্রেসটা চেঞ্জ করিয়ে নেয় উজান।
সেদিনই বাড়িভাড়ার এগ্রিমেন্টসেও সইসাবুদ হয়ে গেল। বাড়ির চাবি হাতে পেয়ে গেল। এত তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে ভাবেনি উজান। গেস্টহাউসে থাকাটা আর এক্সটেন্ড করতে হবে না। ব্রোকার ও বাড়িওয়ালা চলে যাওয়ার পর উজান আর ঊর্মি আরো খানিকক্ষণ রইল। ঘরের মেঝেতেই বসে পড়ে দুজনে। ঊর্মি ব্যাগ থেকে কাগজ পেন বার করে উজানের হাতে ধরিয়ে দেয়।
—কী কী লাগবে মুভ ইন করতে গেলে সব এই কাগজে লিখে ফেলুন।
উজান লিস্ট বানানোর চেষ্টা করে আর মনে মনে ভাবে ‘তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী’। ঊর্মি বলে চলে,
—আপনি যদি রবিবার থেকেই এখানে থাকতে শুরু করেন তাহলে ইমিডিয়েটলি আপনার বিছানা বালিশ আর ব্ল্যাঙ্কেট লাগবে। ব্যাঙ্গালোরে সব সময় ভোরের দিকটা ঠান্ডা থাকে। আজ রাত্রে গেস্ট হাউসে ফিরে সব আমাজন বা ফ্লিপকার্টে অর্ডার করে দিন।
—সকালে চা খাওয়ার ব্যবস্থা চাই। লাঞ্চ ডিনার বাইরে খেয়ে চালিয়ে দেব।
—হোম ডেলিভারিও নিতে পারেন। সুইগি, যোমাটো অ্যাপগুলো ডাউনলোড করে রাখুন।
—খাবারের কথা শুনেই খিদে পেয়ে গেল। কাছাকাছি কিছু মল থাকলে চলো। খেয়ে নেব কিছু আর মুভ ইন করার জন্যে যেগুলো এক্ষুনি লাগবে, সেগুলো পেলে আজই কিনে নেব।
দুজনে সিটি মলে যায়। বাড়ি থেকে দশ মিনিটের হাঁটা রাস্তা। কলকাতা কাঠি রোলের দোকান থেকে এগ চিকেন রোল কিনে খেতে খেতে ঘুরে ঘুরে দেখে দোকানপত্র। হোম সেন্টার আর স্লীপ ওয়েল থেকে মুভ ইন করার জন্যে ইমিডিয়েট যা যা লাগবে সব কিনে নেয়। ম্যাট্রেস, বেডসীট, ব্ল্যাঙ্কেট, বালিস, পাপোষ, হ্যাঙ্গার, চা-এর সরঞ্জাম, কাপ, কিছু নানা মাপের কনটেনার।
বাজারের প্যাকেটগুলো বাড়িতে রেখে উজান গেস্ট হাউসে ফেরার জন্যে উবের ধরে। ঊর্মিকে বাড়িতে ড্রপ করে দিতে চেয়েছিল। ঊর্মির বাড়িটাও দেখা হতো তাহলে। কিন্তু ‘আমাদের গন্তব্য পুরো উল্টোদিকে। আমি বাস ধরব’ বলে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল ঊর্মি।
পরদিন দুপুরে ম্যাট্রেস ডেলিভারি করবে বলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে আসে উজান। রিসেপসান থেকে একটা খবরের কাগজ এনে মেঝেতে পেতে বসে ল্যাপটপ খোলে। অফিসের কাজ জমে গেছে অনেক। বাড়িটা শিফট করতে না পারলে মন দিয়ে কাজ করতেও পারছে না। গতকাল রাত্রেই সব প্রয়োজনীয় জিনিষ অনলাইন অর্ডার করে দিয়েছে সে। এক সপ্তাহের মধ্যে আশাকরি সব পৌঁছে যাবে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। ম্যাট্রেস আর এসে পৌঁছয় না। ডেলিভারির লোকটি দুপুরে একবার ফোন করে জানিয়েছিল, ‘স্যার, আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব’। তারপর অনেক আধঘন্টা কেটে গেছে। কারো দেখা নেই। ফোন করলেই সেই একই কথা –‘স্যার, আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব’। দশ মিনিট যদি আধঘন্টা হয় তাহলে আধঘন্টাটা কতক্ষণ তা জানা নেই উজানের।
ঊর্মিকে ফোনে একটু অভিযোগ জানাতে সে তার স্বভাবসিদ্ধ গলায় বলে,
—স্বল্প এডজাস্ট মাড়ি, স্যার। অ্যামাজন প্রাইমে একটা মুভি দেখুন।
—সেটা ভালো আইডিয়া।
—আর সব ঘরে একটু ঘুরে ঘুরে দেখুন আর কী কী লাগবে। পর্দা অর্ডার করেছেন কি?
—একদম মিস করে গেছি। প্লীজ উইকেন্ডে এসে পর্দাটা কিনে দিয়ে যাও।
—উইকেন্ডে একটুও সময় হবে না। আমি অফিসের সামনের দোকান থেকে কিনে ডেলিভারি করিয়ে দেব বরং।
ফোন ছেড়ে দিয়ে উজান বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল। পশ্চিমের বারান্দাটা খুব রোমান্টিক। অনেকটা দূর পর্যন্ত শহরটাকে দেখা যাচ্ছে। লাল টকটকে সূর্যটা দিগন্তে ঝুঁকে পড়ছে। পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলোতে মায়াময় হয়ে উঠেছে চারিদিক। দুটো চেয়ার আর একটা ছোট টেবিল চাই এখানে। চা, গল্প, প্রেম, খুনসুটি সব কিছুর জন্যে আদর্শ এই বারান্দাটা। আর একবার প্রোপোজ করলে কি আবার রিজেক্ট করবে ঊর্মি।
হু-হু করে এক সপ্তাহ কেটে গিয়ে আবার উইকেন্ড এসে গেল। বাড়িটা এতদিনে বাড়িবাড়ি লাগছে বেশ। নতুন বিছানা বালিশ পর্দায় দিব্যি দেখাচ্ছে। ঊর্মি পর্দা কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ফ্রীজ, ওয়াশিং মেশিন, ডাইনিং টেবিল, রান্না খাওয়ার সরঞ্জাম সব এসে গেছে।
সকাল সকাল বেরিয়ে কিছু বাজার করে এনেছে উজান। আজ রান্না করবে সে। ঊর্মিকে ফোন করে ইনভাইট করল।
—আজ দুপুরে ব্যস্ত না থাকলে চলে এসো। ডাইনিং টেবিল আর থালাবাটিগুলো উদবোধন করব তাহলে।
মেনু খুব সাদামাটা। ফ্রাইড রাইস, মাংস আর স্যালাড। কোল্ড ড্রিংক্স কিনেছে। আপেল জুসও। কী জানি কী পছন্দ করবে ঊর্মি।
ফুল, চকোলেট, একটা ফ্লাওয়ার ভাস আর চোখমুখ ভর্তি হাসি নিয়ে ঊর্মি চলে এল ঠিক এগারোটায়। ঘরটা যেন আলো ঝলমলে হয়ে গেল।
—আজ এত কিছু আনার মতো কিছু স্পেশাল দিন নয়।
—স্পেশালটা আপেক্ষিক। উপঢৌকনও ভাবতে পারেন। আজ আমার একটা সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে আপনাকে। স্টুডেন্ট লাইফে কত অংক আর ফিজিক্সের প্রবলেম সল্ভ না করতে পারলে আপনার জন্যে ফেলে রাখতাম। আপনি তো আমার মুশকিল আসান।
—এত গৌরচন্দ্রিকা না করে সমস্যাটা কী বলো।
ফুলসমেত ফ্লাওয়ার ভাসটা ডাইনিং টেবিলে রেখে উজানের মুখোমুখি বসে ঊর্মি।
—আমার দুই ফ্ল্যাটমেট। একজন হায়দ্রাবাদের মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আর চাকরি করবে না। তাই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। অন্যজন দিল্লীর। সে দিল্লীতে ফিরে যাচ্ছে। ওখানে চাকরি পেয়ে গেছে। তাই আমার একার পক্ষে বাড়ি রাখাটা খুব প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে।
একটু চুপ করে থেকে বড়িটার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে বলল,
—আপনার তো দুটো রুম। একটা ভাড়া দিন না আমাকে।
উজান মনে মনে ভাবল কী সাংঘাতিক মেয়ে! মুখে বলল,
—এটা কি আমাকে নিয়ে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইচ্ছে?
—না না। আমি সিরিয়াস। যদি ভাড়া দিতে একান্তই আপত্তি থাকে তাহলে আমরা বিয়ে করতে পারি বা লিভ টুগেদার।
—তুমি আমাকে প্রপোজ করছ?
—হ্যাঁ। কতোদিন আর ইলেক্ট্রন প্রোটনের মতো গোলগোল ঘুরে বেড়াব দুজনে। দেখছ না এত বছরেও কেউ কক্ষচ্যূত হইনি।
—আর তোমার উদ্দাম প্রেমের স্বপ্নের কী হবে?
—সে তো পূরণ হয়ে গেছে কবে। আমার মতো উপন্যাসপ্রেমী মেয়েকে তুমি জয় গোস্বামীর কবিতার বই উপহার দিয়ে আমেরিকা কেটে পড়লে। তারপর ঐসব কবিতা পড়ে পড়ে হৃদি ভেসে গেছে অলকানন্দা জলে। কল্পনায় আর স্বপ্নেই তো তোমার সঙ্গে প্রেম করলাম। স্বপ্নেই ভিক্টোরিয়া গেলাম হাত ধরে, কল্পনাতেই তো ‘কাঁধে লাগল কাঁধে, কনুই ছুঁল হাত’।
—বাকি রয়েছে কিছু?
—সমস্তটাই। ‘এক পৃথিবী লিখবো বলে একটা খাতাও শেষ করিনি।’ প্লীজ স্বল্প এডজাস্ট মাড়ি স্যার।