কথাটা শুনে কল্যাণ পিছন ঘুরে তাকালো। দেখল বছর আটেকের এক বালক তার পাশে দাঁড়ানো বাবার কাছে বেলুনের আবদার করছে। খানিক দূরেই বেলুনওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। কল্যাণের মনে তার বাবার স্মৃতিটা এমন মধুর নয়। সেই কুৎসিত স্মৃতিগুলো তার মনে এখনও টাটকা। একেবারে ছোটবেলা থেকে কল্যাণ দেখেছে – রোজ রাতে একটা লোক টলমল পায়ে দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে ঘরে এসে ঢোকে, তারপর কর্কশ গলায় মাকে বকাবকি করে আর মাঝেমধ্যে খুব রেগে গিয়ে মারধর করে। লোকটার গা থেকে একটা অদ্ভুত বোটকা গন্ধ বেরোয়। কল্যাণের গা গুলোয়। আরও একটু বড় হওয়ার পর কল্যাণ জানতে পেরেছিল ওই লোকটাই তার বাবা। লোকটাকে বাবা বলে ডাকার ইচ্ছা তার কোনওদিনই হয়নি। মায়ের চেষ্টায় পাড়ার পৌরসভার স্কুলটায় ভর্তি হয়েছিল কল্যাণ। সে যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে, তখন একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখেছিল মা অচৈতন্য অবস্থায় বাড়ির দরজার সামনে পড়ে আছে আর চারপাশে পাড়ার লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কল্যাণ মায়ের কাছে গিয়ে অনেকবার ডেকেছিল। মা সাড়া দেয়নি। পুলিস এসেছিল। কল্যাণকে অনেক প্রশ্ন করেছিল। পুলিসের কথা শুনে কল্যাণ বুঝেছিল কেউ ঠান্ডা মাথায় গলায় নাইলনের দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তার মাকে দমবন্ধ করে হত্যা করেছে। পুলিশ কোনও প্রমাণ পায়নি। বাবা এসে অনেক কান্নাকাটি করেছিল। মায়ের মুখাগ্নি করে শ্মশান থেকে বেরিয়ে আর বাড়িমুখো হয়নি কল্যাণ। ওই লোকটার সঙ্গে ওই বাড়িতে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল। কলকাতার রাস্তায় টানা ষোল ঘন্টা এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর পর যখন মনে হয়েছিল পেটে কিছু না পড়লে আর বাঁচা যাবে না, তখন রাস্তার ধারের একটা রোলের দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কল্যাণ বলেছিল – “ও কাকু, একটু খেতে দেবেন? খুব খিদে পেয়েছে...”
উত্তর পেয়েছিল – “কে রে এটা! যা ফোট্!”
কল্যাণ সে’দিনই বুঝেছিল তাকে জীবনে অনেক লড়াই করতে হবে। সে বছর তিরিশ আগেকার কথা। তারপর অনেক ঝড়ঝাপ্টা বয়ে গিয়েছে কল্যাণের উপর দিয়ে। মানুষের জীবনের কুৎসিত দিকগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়েছে কল্যাণ। সৎপথে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি সে। কল্যাণের মনে হয় সততা একটা বিলাসিতা, যে সব মানুষের কাছে বেঁচে থাকার অনেক সহজ পথ রয়েছে শুধু তাদেরই এই বিলাসিতা সাজে। সমাজের আলোকিত অংশের তথাকথিত সৎ মানুষজনের কাছ থেকে কোনওরকম সম্মান সে আশা করে না। তাদের কাছ থেকে জীবনে কোনওদিন সে কোনোরকম সাহায্য পায়নি। পাঁচ বছর আগে ঝুমা চলে গিয়েছিল সঠিক চিকিৎসার অভাবে। পরিবর্তে রেখে গিয়েছিল কাবেরীকে। ঝুমা বাড়িবাড়ি গিয়ে ঘরমোছা-বাসনমাজার কাজ করত। মাস গেলে চার হাজার টাকা এনে কল্যাণের হাতে দিত। তখন কল্যাণের রোজগার বলতে ছিল মাসে গড়ে হাজার টাকা। টুকটাক বাসেট্রামে পকেট কেটে যেটুকু পেত। সংসারের হাল ধরেছিল ঝুমা। সদ্যজাত কাবেরীকে কোলে নিয়ে ঝুমার নিথর মুখটার দিয়ে তাকিয়ে পা কেঁপে উঠেছিল কল্যাণের। মনে হয়েছিল ঝুমাকে ছাড়া সে বেঁচে থাকবে কী করে। পরক্ষণে নিজেকে দৃঢ় করে মনে মনে ভেবে নিয়েছিল কাবেরীকে একটা সুন্দর জীবন দিতেই হবে, তার নিজের বা ঝুমার মত অন্ধকার জীবন নয়, সম্মানের জীবন। ঝুমারও তো এটাই স্বপ্ন ছিল। আজ পর্যন্ত জীবনে কল্যাণ যা করেছে নিজের হিম্মতের জোরে করেছে। এখন কল্যাণ পাঁচ বছরের কাবেরীকে নিয়ে শিয়ালদার একটা ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে আরামে থাকে। কাবেরী স্কুলে যায়। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। গত পাঁচ বছর ধরে সেলিমের দলে কাজ করতে করতে আজ পেশাজগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী একটা নাম কল্যাণ। নিখুঁত পরিকল্পনায় প্রমাণহীন প্রক্রিয়ায় নির্লিপ্ত এবং নির্বিকারভাবে যে কোনও সাধারণ মানুষকে কল্যাণ সরিয়ে দিতে পারে এই পৃথিবী থেকে। পরিবর্তে দক্ষিণা নেয় নগদ দশ হাজার টাকা, বাকিটা চুক্তি অনুসারে সেলিমের। কাবেরীর একটা সুন্দর জীবনের মূল্য একটা অচেনা মানুষের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি। দুই-এক মাস অন্তর একটা করে দায়িত্ব পেলেই কল্যাণের দুই সদস্যের সংসার তরতরিয়ে চলে। কল্যাণ সুখী। সুখী, কারণ কাবেরী পড়াশুনো শিখছে। সুখী, কারণ কাবেরী রোজ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমায়, কোনও মাতাল লম্পটের তাণ্ডবে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় না। সুখী, কারণ কাবেরী তার বাবাকে সাদরে বাবা বলে ডাকে। কল্যাণ সুখী হলেও একটু ভীত। ভীত, কারণ কাবেরীর কাছে তার বাবার পেশা তথা অর্থ উপার্জনের উৎস অজ্ঞাত। ভীত, কারণ কাবেরী এই সত্য জানতে পারলে সে আর তাকে সাদরে বাবা বলে ডাকবে না। ভীত, কারণ কাবেরী কোনওদিনও বুঝবে না কোন দায়বদ্ধতার বন্ধনে জড়িয়ে পড়লে মানুষ নির্দ্বিধায় অন্য মানুষকে হত্যা করতে পারে। তা বুঝতে হলে এমনি এমনি বোঝা যায় না, কল্যাণের মত জীবন দিয়ে বুঝতে হয়। তাই এই অবুঝ কাবেরীর দিকে তাকিয়েই সুখী থাকতে চায় কল্যাণ।
“ও-ও দাদা… চেঞ্জটা নিন…”
“অ্যাঁ? হ্যাঁ…” কল্যাণ নিজের শৈশবের স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিল। দোকানদারের গলা শুনে হুঁশ ফিরল। কল্যাণ কাবেরীর জন্য পেন্সিল কিনতে এসেছিল।
* * *
ভাড়াবাড়িটা একটা অনেক বছরের পুরোনো দোতলা বাড়ি। একতলায় একটা ঘর, তার সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম আর একটা ছোট রান্নাঘর নিয়ে কল্যাণের বাস। গায়ে গায়ে দু’পাশে আরও দুটো একইরকম বাড়ি আছে, মাঝে কোনও পাঁচিল নেই। একপাশের বাড়ির একতলায় একটা পোষা মোরগ আছে। রোজ সকালে সে নিয়ম করে হাঁক ছাড়ে। সেই শব্দেই গোটা পাড়ার ঘুম ভাঙ্গে। আজও তার অন্যথা হল না। ঘুম থেকে উঠে বসে চোখ কচলে পাশের বিছানায় তাকিয়ে কল্যাণ দেখল কাবেরী ঘুমাচ্ছে। কল্যাণ না ডাকলে কাবেরী কোনওদিনই ওঠে না। কাবেরীকে ডাকার জন্য হাত বাড়াতেই কল্যাণের ফোনটা বেজে উঠল কর্কশ শব্দে। কল্যাণ তাকিয়ে দেখতে পেল স্ক্রিনে লেখা উঠেছে – সেলিম।
“বলো দাদা...”, কল্যাণ ফোন কানে দিয়ে বলল।
“ভাল কাজ এসছে... করবি তো?”
“হ্যাঁ দাদা... তোমাকে না বলেছি কোনওদিন?”
“ঠিক আছে... তা’হলে আমার আড্ডায় চলে আয় আজ দুপুরে... তখন কথা হবে...”
“ক’টার সময় যাব?”
“একটা নাগাদ আয়...”
“ওই সময় তো হবে না দাদা, জানো তো...”
“ও আচ্ছা আচ্ছা... তা’হলে সকালের দিকেই আয়... আটটা নাগাদ...”
“ও কে দাদা... চলে যাব...”
কল্যাণের মনটা ভাল হয়ে গেল। গত দু’মাসে একটাও কাজ আসেনি। হাতে বেশ কিছু টাকা আসবে। পুজো আসছে। কয়েকদিন আগে একটা দোকানে একটা ফ্রক দেখে কাবেরীর খুব পছন্দ হয়েছিল।
কাবেরীকে ডেকে দিল কল্যাণ। কাবেরীর স্কুল শুরু হয় সকাল সাতটায়। ওকে স্নান করিয়ে, জলখাবার খাইয়ে স্কুলের জন্য তৈরি করতে করতে সাড়ে ছ’টা বেজে যায়। তারপর ওকে নিয়ে স্কুলে যায় কল্যাণ। স্কুলটা কাছেই। পৌনে সাতটার মধ্যেই ওরা পৌঁছে যায়। ঠিক সাতটার সময় স্কুলের উঠানে দাঁড়িয়ে সমস্ত শিক্ষিকা আর ছাত্রীরা সমবেতকন্ঠে প্রার্থনা করে তিন মিনিট। বাইরে দাঁড়িয়ে শোনে কল্যাণ। মনের ভিতরটা কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়। কল্যাণের স্কুলেও প্রার্থনা হত। তখন মনই বসত না। মনে হত কতক্ষণে শেষ হবে। কাবেরীদের প্রার্থনা শেষ হলে কল্যাণ সাধারণত বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়, যদি কোনও কাজ না এসে পড়ে। আজ যেমন বাড়ি না গিয়ে সেলিমের আড্ডায় যেতে হবে। পাঁচ বছরের কাবেরীকে একা বাড়িতে রেখে কল্যাণের পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কল্যাণকে কাজ করতে হয় শুধু সেইসব সময়ে যখন কাবেরী বাড়িতে থাকে না। স্কুল ছাড়া কাবেরীর যাওয়ার জায়গা দু’টো – রিমাআন্টির বাড়ি আর নিতাইস্যারের বাড়ি। স্কুলে সবকিছু আজকাল ঠিকমত পড়ানো হয় না। কাবেরী বাড়ি এসে বলে ওর অনেককিছুই বুঝতে অসুবিধা হয়। অন্যান্য বাবাদের সঙ্গে কল্যাণের একটা পার্থক্য আছে। কল্যাণ নিজেই ক্লাস ওয়ান অসম্পূর্ণ রেখে পড়াশুনায় ইতি দিয়েছে, তাই নিজের বিদ্যায় ভর করে কাবেরীকে সাহায্য করা তার পক্ষে অসম্ভব। রিমাআন্টি সেই অভাব ঢেকে দেন। নিতাইস্যার অঙ্ক শেখান কাবেরীকে। কল্যাণ শুনেছে অঙ্কে ভাল হলে জীবনে নাকি আর কোনও চিন্তা থাকে না। সপ্তাহে সোম থেকে শনি ভোর সাতটা থেকে বেলা দশটা অবধি স্কুল, বুধ আর শুক্র সন্ধ্যে ছ’টা থেকে রাত আটটা রিমাআন্টি আর শনিবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা নিতাইস্যার। এই হল কল্যাণের কাজের সময়।
পার্কসার্কাসগামী একটা বাসে উঠে পড়ল কল্যাণ। জ্যাম ঠেলে আধঘন্টা পর বাস থেকে নেমে ছ’সাতবার ডানদিক-বাঁদিক করতে করতে অলিগলি পার করে একটা পুরোনো বাড়ির পাল্লাহীন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে এল।
“বোস...”, সেলিম কল্যাণের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
ছোট্ট উঠোনের একধারে রাখা চেয়ারে বসল কল্যাণ। সেলিম একটা খাটিয়ায় পা তুলে বাবু হয়ে বসে আছে। পাশে একটা বাটি রাখা। বাটি থেকে মুড়ি তুলে নিয়ে খাচ্ছে মাঝেমাঝে। এই ব্যাবসার সুবাদে সেলিমের প্রচুর উপার্জন। কিন্তু দেখলে বোঝার উপায় নেই। বাড়িটা অতি সাধারণ। সেলিমের পোশাকেও আর্থিক স্বাচ্ছন্দের কোনও প্রতিফলন নেই। এখন সে বসে আছে খালি গায়ে, পরনে একটা মেটে রঙের লুঙ্গি। গলায় অবশ্য একটা সোনার চেন ঝুলছে। কোথাও বেরোতে হলে সেলিম শুধু গায়ে একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে নেবে। পেশাদার জগতে সেলিম খুবই পরিচিত নাম। পেশার সঙ্গে সেলিমের ব্যবহারিক আচরণের কোনও মিল নেই। সেলিম অত্যন্ত ভদ্র এবং মার্জিত। সেলিমের একটা পলিটেকনিক ডিগ্রি আছে। একটা কাঁচের বোতল তৈরির ব্যবসাও আছে। সেলিম আজ পর্যন্ত নিজের হাতে একটাও খুন করেনি।
“একটা মালদার পার্টি আছে... আর কাজটাও তুই যেমন সব কাজে এক্সপার্ট তেমনই... সেইজন্যই আর কাউকে না ডেকে তোকে ডাকলাম...”
“বলেই দেখ না... কোনওবার তো মিস্ করিনি...”
“শোন... এই ছবিটা নে আগে...”, সেলিম একটা ফটো কল্যাণকে দিল হাত বাড়িয়ে।
ফটোটা দেখল কল্যাণ। এক ভদ্রমহিলার ছবি। কল্যাণেরই মত বয়স হবে বা তার চেয়ে একটু ছোট। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। সাজগোজ ভাল। সুন্দরী নয়, কিন্তু একটা ব্যক্তিত্ব আছে। বেশ ফর্সা। বয়কাট চুল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা কিন্তু পাওয়ার কম।
“নাম?” কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল।
“টিনা দত্ত...”
“বাঙালি?”
“হ্যাঁ...”
“ঠিক আছে... বাকি গল্পটা বলো শুনি...”
“কাজটা করার জন্য এর বেশি যা গল্প তোর জানার দরকার সেটা তোকে নিজেকে জেনে নিতে হবে... যেমন তুই করে থাকিস আর কি... আর আমার কাছে যে’টুকু গল্প আছে সেটা বলছি...”
“আচ্ছা...”
“আমার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করেছিল একটা লোক... নিজের নাম বলেনি... গত রোববার এসছিল এখানে... বেশ ভদ্রলোকের মতই চেহারা... ছবিটা ওরই দেয়া... আমার ফিক্সড্ রেটের দেড়গুন দেবে বলেছে... অ্যাডভান্স দিয়ে গেছে... একটাই দাবি – এক শটে কাজ হাসিল করতে হবে... ফেল করলে কন্ট্র্যাক্ট শেষ, বাকি টাকা আর দেবে না...”
“কোথা থেকে শুরু করতে হবে?”
“প্রত্যেক শনিবার সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা-সাতটা নাগাদ এ নিজে গাড়ি চালিয়ে লেক কালীবাড়িতে দর্শন করতে যায়...”
“লেক কালীবাড়ি মানে সাউথে?”
“হ্যাঁ... মেনকা সিনেমা চত্বরে...”
“বুঝেছি... বাড়ি কোথায় তা জানা নেই?”
“না... আর কিছুই জানা নেই...”
“আচ্ছা...”
“ও... আরেকটা দাবি আছে... খুব ইম্পর্টেন্ট...”
“কী?”
“অ্যাক্সিডেন্ট কেস সাজাতে হবে... অন্য কোনওভাবে চলবে না...”
“ও ঠিক আছে... আমি তো বেশিরভাগ সময় তাইই করি... ও হয়ে যাবে দাদা...”
“কাজ শুরু কর তা’হলে... কিছুদিন ফলো কর... রুটিনটা বোঝ... তারপর প্ল্যান বানা... নিজের মত করে কাজ করিস... তুই তো ওস্তাদ ছেলে... তোকে আমি আর কোনও জ্ঞান দেব না... আমি দেড়গুণ পাচ্ছি যখন, তুইও দেড়গুণ পাবি... ঠিক আছে?”
“একদম দাদা... আজ আসি তা’হলে”, কল্যাণ উঠে দাঁড়াল।
“আয়...”, সেলিম উঠল না; শুধু হাত তুলে বিদায় জানাল।
* * *
কল্যাণের একটা বাইক আছে। এটা কল্যাণ শুধু কাজের জন্য ব্যবহার করে। অন্যান্য সময় বাস-ট্রাম-ট্রেন করে চালিয়ে নেয়। তেলের অনেক খরচ। কাজের জন্য ব্যবহার করার সময় যে তেল ভরে তার বিল সেলিমকে দিলে সেলিম টাকাটা হাতেহাতে কল্যাণকে দিয়ে দেয়। সূর্যাস্তের পর সাদার্ন এভিনিউ একটু অন্ধকার আর নিঝুম হয়ে যায়। শুধু লেক কালীবাড়ির জায়গাটা বেশ জমজমাট থাকে। একটু দূরের একটা অন্ধকার গলিতে বাইকটা রেখে এসেছে কল্যাণ। সাড়ে ছ’টা বাজে। এখনও টিনা দত্তর দেখা মেলেনি। সাতটার মধ্যে শিয়ালদার দিকে রওনা না দিলে কল্যাণ পৌঁছাতে পৌঁছাতে কাবেরীর পড়া শেষ হয়ে যাবে। কল্যাণ অবশ্য কাবেরীকে আর নিতাইস্যারকে বলে এসেছে, যদি কল্যাণের ফিরতে একটু দেরি হয় আজ তা’হলে কাবেরী নিতাইস্যারের বাড়িতেই অপেক্ষা করবে। নিতাইস্যার নিপাট ভালমানুষ। এই ধরনের অনুরোধে কোনও দিনই আপত্তি করেন না। ভক্তদের সঙ্গে ফুল-মালা বিক্রেতাদের কোলাহল আর রাস্তা দিয়ে চলা অজস্র গাড়ির হর্নে পরিবেশটা একটা অশান্ত রূপ নিয়েছে। তারই মধ্যে কল্যাণ মন দিয়ে ভক্তদের দেখছে আর হাতের ফটোটার সঙ্গে মেলাচ্ছে। পৌনে সাতটা নাগাদ হঠাৎ কল্যাণের অপেক্ষার অবসান ঘটল। ভদ্রমহিলার ব্যক্তিত্ব ফটোর থেকে সামনাসামনি অনেক বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। একটা দোকান থেকে একটা পুজোর ডালা কিনলেন টিনা। তারপর মন্দিরের ভিতর ঢুকে গেলেন। বেরিয়ে এলেন পনেরো মিনিট পর। হাতে পুজোর ডালাটা নিয়ে টিনা ফুটপাথ ধরে হাঁটা দিলেন। কল্যাণ একটু দূর থেকে অনুসরণ করতে শুরু করল। কল্যাণ যে গলিতে বাইক রেখেছিল টিনাও সেই গলিতে ঢুকে গেলেন। কল্যাণ আর এগোল না। আড়াল থেকে লক্ষ্য করল টিনা একটা মেরুন মারুতি অল্টোয় উঠে বসলেন। তারপর দক্ষ হাতে গাড়ি চালিয়ে গলি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কল্যাণ তৎক্ষণাৎ বাইকে চেপে গাড়িটার পিছন পিছন চলতে লাগল। মিনিট কুড়ি পরে গাড়ি এসে থামল যোধপুর পার্কের একটা অন্ধকার গলিতে বেশ বড় একটা তিনতলা বাড়ির সামনে। দেখলেই বোঝা যায় বেশ বিলাসবহুল বাড়ি। কল্যাণ একটু দূর থেকে দেখল দারোয়ান গ্যারাজের দরজা খুলে দিল। টিনা গাড়িটা ঢুকিয়ে দিলেন। গ্যারাজে আরও একটা গাড়ি ছিল। হন্ডা সিটি। গ্যারাজের হলুদ আলোয় রংটা ঠিক বোঝা গেল না। টিনা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। কল্যাণ বাইক নিয়ে শিয়ালদার দিকে রওনা দিল। আজকের মত কাজ শেষ।
* * *
বাড়িটা কত সুন্দর সেটা অন্ধকারে আগের দিন ভাল বুঝতে পারেনি কল্যাণ। আজ বোঝা যাচ্ছে। মনে ভাবল পরের জন্মে কল্যাণ এ’রকম একটা বাড়ির ছেলে হয়ে জান্মাবে। সারা জীবন বাপ-মায়ের আদরে বড় হবে, স্কুলে পড়বে, কলেজ পাস করবে, বড় চাকরি করবে, বিদেশ যাবে, ডলারে কামাবে। সবাই তো এমনই চায়। হঠাৎ গাড়ির শব্দে কল্যাণের মনোযোগ ফিরে এল। গ্যারাজ থেকে হন্ডা সিটিটা বেরচ্ছে। দিনের আলোয় বোঝা যাচ্ছে ধূসর রংটা। ভিতরে একজনই আছেন। তিনিই চালাচ্ছেন। বেশ ঝকঝকে স্যুট-টাই পরা একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। চোখদুটো খুব ছোট দেখাচ্ছে। গালে বসন্তের পুরোনো দাগ। এর বেশি কিছু দেখার আগেই গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেল। এখন সকাল আটটা। লোকটা নিশ্চয়ই অফিসে গেল। এর মিনিট পাঁচেক পর আবার গ্যারাজ খুলল দারোয়ান। টিনার সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে। দেখে কাবেরীর বয়েসি মনে হয়। স্কুলড্রেস পরে আছে। টিনা গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। বাচ্চাটা পাশের সিটে বসেছে। গাড়িটা বড় রাস্তার দিকে এগোল, কল্যাণ পিছনে পিছনে চলতে লাগল। গাড়ি গিয়ে থামল একটা বেশ বড় স্কুলের গেটের সামনে। ফুটপাথের ধারে গাড়িটা পার্ক করে টিনা গাড়ি থেকে নিজে নেমে তারপর বাচ্চাটাকে নামালেন। হাত দিয়ে বাচ্চাটার চুল ঠিক করে দিয়ে কপালে আদর করে দিলেন। বাচ্চাটা টিনাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকে গেল। টিনা আবার গাড়ি চালিয়ে রওনা দিলেন। একঘন্টা পর গাড়ি পৌঁছাল পার্ক স্ট্রীট এলাকায় একটা বিল্ডিঙের সামনে। বিল্ডিংটা দেখে কোনও অফিস বলেই মনে হয়। বিল্ডিঙে ঢোকার গেটের উপর বড় বড় করে লেখা ‘দত্ত অ্যান্ড লাহা ফেব্রিক্স্’। কল্যাণ একটু দূর থেকে দেখল গেট খুলে দিয়ে দারোয়ান সেলাম ঠুকল, তারপর গাড়িটা ভিতরে ঢুকে গেল। টিনা দত্ত যে এই কোম্পানির মালকিন তা বুঝতে কল্যাণের অসুবিধা হল না। সঙ্গে এটাও বুঝল টিনাই একমাত্র মালকিন নন, সঙ্গে এই লাহাও আছেন। কিন্তু লাহা কে? এনার সম্পর্কে কল্যাণ এখনও কিছু জানতে পারেনি। আর এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময় নেই। কাবেরীর ছুটি হয়ে যাবে। কল্যাণ কাবেরীর স্কুলের দিকে রওনা দিল। আজ সোমবার। কাবেরীর কোনও কোচিং নেই। তাই আজ কল্যাণের আর কোনও কাজ হবে না।
সন্ধ্যে নাগাদ কল্যাণের ফোনটা বেজে উঠল। সেলিম। কাবেরী পড়তে বসেছে। কল্যাণ ফোন নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল।
“হ্যাঁ বলো দাদা...”
“কাজ এগোচ্ছে রে?”
“হ্যাঁ দাদা... ফলো করছি... আর ক’দিন একটু বুঝে নিই... তারপর প্ল্যান করে নেব...”
“কোনও রিস্ক দেখলি?”
“না তেমন কিছু নয়... একটাই ব্যাপার আছে... ওনার বাড়িতে অনেক সিকিউরিটি...”
“আচ্ছা... সে তাতে আর তোর কী? বাড়িতে তো আর অ্যাক্সিডেন্ট করাতে পারবি না...”
“না তা নয়... যাই হোক... ও হয়ে যাবে...”
“ঠিক আছে... রাখি তা’হলে...”
“ওকে দাদা...”
কল্যাণ ঘরে ফিরে এল।
মঙ্গলবার কল্যাণ আরও একবার টিনার বাড়ির সামনে গেল। পুরো ঘটনাটা সোমবারের মতই ঘটল। শুধু দত্ত অ্যান্ড লাহা ফেব্রিক্স থেকে ফেরার ঠিক আগে আরেকটা গাড়িকে গেটের সামনে এসে হর্ন বাজাতে দেখল কল্যাণ। গাঢ় সবুজ রঙের হুন্ডাই অ্যাক্সেন্ট। দারোয়ান একই ভঙ্গিতে সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল, ঠিক যেমন টিনার ক্ষেত্রে করেছিল। ড্রাইভার-চালিত গাড়ির পিছনের সিটে একজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। ইনিই হয়ত লাহা।
* * *
রিমাআন্টির বাড়িটা কল্যাণের বাড়ি থেকে হাঁটাপথ। কল্যাণ একবারে বাইকে করে কাবেরীকে নিয়ে বেরিয়ে রিমাআন্টির বাড়িতে কাবেরীকে নামিয়ে দিয়ে দত্ত অ্যান্ড লাহা ফেব্রিক্সের দিকে বাইক ছুটালো। ছ’টা বাজে। কল্যাণের পৌঁছাতে পৌঁছাতে আধঘন্টা লেগে গেল। কল্যাণ দেখল গেট বন্ধ হলেও বিল্ডিঙের ভিতরে আলো জ্বলছে। গেটের সামনে দারোয়ানও বসে আছে। কল্যাণ বুঝতে পারল না টিনা এখনও এখানেই আছেন না চলে গিয়েছেন। আধঘন্টা অপেক্ষা করার পর কল্যাণ দেখল বিল্ডিঙের ভিতরের আলো নিভে গেল। তার পাঁচ মিনিট পরেই সে’দিন দেখা হুন্ডাই অ্যাক্সেন্টটা গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়ে গাড়ির ভিড়ে মিলিয়ে গেল। দারোয়ান গেটের ভিতরে ঢুকে গেল। তার দশ মিনিট পর গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে গেটে তালাচাবি মেরে ফুটপাথের মানুষজনের মধ্যে হারিয়ে গেল। কল্যাণ বুঝল আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। সে বাইকে স্টার্ট দিল। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। সেলিম।
“বলো দাদা...”
“তুই কোথায় আছিস রে?”
“আমি টিনার অফিসের সামনে...”
“ঠিক আছে... তোর কাজ হয়ে গেলে একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবি?”
“এখন?”
“হ্যাঁ... একটু জরুরি দরকার...”
“আমার এখানে আর কোনও কাজ নেই... আসছি তা’হলে...”
“আয়... এলে কথা হবে...”
কল্যাণ রওনা দিল।
সেলিমের বাড়ির কাছে পৌঁছে কল্যাণ যে দৃশ্যটা দেখল সেটার জন্য সে খুব একটা তৈরি ছিল না। সেলিমের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধূসর হন্ডা সিটি। কল্যাণ চমকে উঠল। সেলিমের বাড়িতে ঢুকল না সে। বাইকটা একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে সেলিমের বাড়ির দরজার কাছেই কিন্তু আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট কুড়ি পর মাঝবয়েসি ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। চোখদুটো খুব ছোট দেখাচ্ছে। গালে বসন্তের পুরোনো দাগ। কল্যাণের চিনতে অসুবিধা হল না। লোকটা গাড়িতে উঠে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল। কল্যাণ সেলিমের বাড়িতে ঢুকল।
“দেখলি লোকটাকে?” কল্যাণ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সেলিম জিজ্ঞাসা করল।
“দেখলাম...”
“এইই টিনার কেসটা দিয়েছে...”
“বুঝেছিলাম...”
“কী করে বুঝলি? লোকটাকে আগে দেখেছিস? টিনার সঙ্গে?”
“হ্যাঁ... লোকটা টিনার বাড়িতেই থাকে...”
“বলিস কী! কে হয় টিনার? আত্মীয়?”
“জানি না...”
“সত্যি... কতরকম ভদ্দরলোক যে দেখলাম এ’জীবনে!”
“যাগ্গে ছাড়ো ওদের কথা... কেন ডেকেছিলে বলো...”
“এই ব্যাপারেই ডেকেছিলাম... লোকটা এসেছিল তাগাদা দিতে... বলছে সামনের সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শেষ করতে... তুই কদ্দূর এগিয়েছিস?”
“অসম্ভব! এ কি হাতের মোয়া নাকি? তারপর কাঁচা কাজ করে আমি কি জেলে যাব? অত তাড়া থাকলে ওকে নিজেকে করে নিতে বলো...” কল্যাণ হঠাৎ রেগে উঠল।
“আরে চটছিস কেন? আমি ওকে কোনও কথা দিইনি... বলেছি আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেষ্টা করব...”
“আমি ও’রকম তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে পারি না... আমি যখন খুশি তখন কাজে নামতে পারি না... জানো তো...”
“জানি... তুই তোর মত করেই কর... আমি ওকে সামলে নেব...”
“আজ তা’হলে আসি দাদা...”
“আয়...”
সেলিমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইকে চড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল কল্যাণ। অস্থির লাগছে। চোখের সামনে বারবার পুরু লেন্সের চশমা আর বসন্তের দাগগুলো এসে বিরক্ত করছে। কাবেরীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল কল্যাণ। রাতে ঘুম এল না। বসন্তের দাগগুলো ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে।
* * *
এই সময়ে যোধপুর পার্ক চত্বরে অনেক কুকুরপ্রেমী মানুষ তাদের মনের মত চতুষ্পদ বন্ধুটিকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরোন। অনেকরকম সুন্দর-কুৎসিত কুকুরকে এই সময়ে দেখা যায় তাদের মালিকের সঙ্গে সানন্দে লেজ নাড়াতে নাড়াতে চলেছে। আশ্চর্য এই প্রাণী। কোনওদিন বিশ্বাসঘাতকতা করতে শিখল না। এই অক্ষমতাই কুকুরকে কুকুর করে রাখল আর মানুষকে তার প্রভু করে রাখল। টিনার বাড়ির থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে কল্যাণ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুকুর আর তাদের মালিকদের দেখছে। আজ বৃহস্পতিবার। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। টিনার বাড়ির গেট এখনও খোলেনি। কিছুক্ষণ পরে আগের দিনের মতই বেরিয়ে এল স্যুট-টাই, পুরু লেন্সের চশমা আর বসন্তের দাগ। হন্ডা সিটি রাস্তায় নামতেই কল্যাণ বাইকে স্টার্ট দিল। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে হন্ডা সিটি পৌঁছোল কসবা এলাকায় একটা সুন্দর দোতলা বাড়ির সামনে। কল্যাণ দূরে দাঁড়াল। লোকটা বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। কল্যাণ বাড়িটার একটু কাছে এসে দেখল দরজায় ধাতব নেমপ্লেটে লেখা ‘অ্যাডভোকেট জি সি রয়’। টিনার বাড়ির মত এই বাড়ির গেটে কোনও দারোয়ান নেই। কল্যাণ বাড়িটার পাঁচিল ঘেরা চত্বরে ঢুকে পড়ল। চত্বরের একপাশে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, আরেকপাশে একটা ছোট্ট বাগান। কল্যাণ বাগানের দিকে এগিয়ে গেল। এই ধরনের বিপজ্জনক কাজ কল্যাণ অবলীলায় করে ফেলে। হঠাৎ কল্যাণ দু’জনের গলার আওয়াজ পেল। দুটোই পুরুষকন্ঠ। বাগানের দিকে বাড়িটার দেওয়াল ঘেঁষে উঁকি মারল কল্যাণ। একতলার একটা জানলা থেকে গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। কল্যাণ আরেকটু এগোল। এখন কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
“আপনি যতই অ্যাপিল করুন, কেস আপনার দিকে ঘুরবে না...”
“কেন ঘুরবে না? আপনি কোন লজিকে কথাটা বলছেন আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না... সুশান্ত তো আমারই ভাই ছিল... নিজের ভাই...”
“তো? তাই বলেই ওনার মৃত্যুর পর ওনার সব সম্পত্তি আপনার হয়ে যেতে পারে না...”
“কিন্তু বাবার উইলে তো সেটাই বলা ছিল... সেটার কোনও দাম নেই?”
“থাকত... যদি সুশান্তবাবু আর কোনও উইল না বানাতেন... উনি তো পরিষ্কার লিখে গেছেন যে ওঁর মৃত্যুর পর ওঁর সব সম্পত্তির মালিকানা যাবে ওঁর স্ত্রীর কাছে...”
“কিন্তু বাবা তো টিনাকে পছন্দই করতেন না... সেইজন্য তো উনি স্পেসিফিকালি লিখেছিলেন যে বাড়ির কোনও বউ বা জামাই কোনও শেয়ার পাবে না... ওঁর যা সম্পত্তি তা ভাগ হয়ে যাবে আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে...”
“আপনি আবার ভুল করছেন... এ’সব কথা অ্যাপ্লিকেব্ল্ ততক্ষণই যতক্ষণ সম্পত্তিটা আপনার বাবার থাকছে... আপনার ভাই যে মুহূর্তে মালিকানা পেয়ে গেলেন তখন ওঁর উইল প্রযোজ্য, কারণ আপনাদের ভাইবোনদের মৃত্যু হলে তার সম্পত্তির মালিকানা কে পাবে তা নিয়ে আপনার বাবার উইলে কিছু বলা নেই... আপনার কাছে একটাই রাস্তা খোলা আছে মিস্টার দত্ত... দুশ্চিন্তা করবেন না... দত্ত অ্যান্ড লাহা ফেব্রিক্সের মালিকানা পেতে হলে আপনাকে হাত ময়লা করতেই হবে... তবে আমি আবারও একই কথা সাজেস্ট করব যা প্রথম থেকে করে আসছি... ও’সব করতে যাবেন না... কী দরকার?... নিজের এতবড় একটা ড্রেস মেটিরিয়াল্সের বিজ্নেস আছে, বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে ঘর করছেন... আর কী চাই? পয়সার তো অভাব নেই আপনার...”
“আমার কিসে কী দরকার আছে বা নেই সেটা আমাকেই ভাবতে দিন... থ্যাঙ্কস্ ফর ইয়োর সাজেশান...”
“বেশ বেশ...”
“আমাকে একটা কথা বলুন... টিনাকে সরিয়ে দেওয়ার পর যদি দেখা যায় সুশান্তর উইলে এমনও লেখা আছে যে টিনার মৃত্যুর পর মালিকানা যাবে ওদের ছেলের কাছে? তখন?”
“সেটা আমার মনে হয় উইলে নেই... আর যদি থাকেও, টিনা না থাকলে কে লড়বে এই কেস? বাচ্চাটা তো আর কেস লড়তে পারবে না... আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই কেউ কেসটা লড়ল, তা’হলেও অতটুকু বাচ্চার হাতে তো আর কোনও ক্ষমতা আসবে না, বড়জোর ও নামে মালিক থাকবে, কিন্তু দায়-দায়িত্ব অটোমেটিকালি আপনার হাতেই চলে আসবে... আর ও বাচ্চা যদ্দিনে বড় হবে তদ্দিনে আপনি যা ভোগ করার করে নিতে পারবেন...”
“বলছেন?”
“বলছি... নিশ্চিন্ত থাকুন... টিনার কাজটা হয়ে গেলেই আপনার রাস্তা ক্লিয়ার...”
“আর দত্ত অ্যান্ড লাহার লাহা? সে তো অর্ধেক শেয়ার নিয়ে বসে আছে...”
“ওটা আরেকটা চিন্তার বিষয় বটে... উনি তো আবার সুশান্তবাবুর বন্ধু... তবে টিনা সরে গেলে উনি কতটা উৎসাহ রাখবেন সেটা দেখার... দত্ত অ্যান্ড লাহা ফেব্রিক্স ভাঙ্গিয়ে তো ওনার সংসার চলে না... ওনার তো আরও পাঁচটা ব্যবসা আছে... আমার মনে হয় উনি হয় নিজে থেকেই বেরিয়ে যাবেন নয়ত আপনি একটু মোটা অ্যামাউন্ট টোপ দিলেই কাজ হয়ে যাবে...”
“আর যদি ইন্টারেস্ট দেখান? যদি বেরিয়ে যেতে না চান?”
“দেখুন, আপনি একবার ফিফ্টি পার্সেন্টের মালিকানা পেয়ে গেলে তারপর ওনাকে কাটানোর অনেক রাস্তা আছে... এখনই ও’সব নিয়ে ভাববেন না...”
হঠাৎ বাগানের ভিতর থেকে মৃদু পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠল কল্যাণ। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। আর দাঁড়াল না কল্যাণ। যেমনভাবে সবার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে ঢুকেছিল, তেমনভাবেই বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে বাইকে স্টার্ট দিল কল্যাণ। কাবেরীর স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওর ছুটি হওয়ার সময় হয়ে যাবে। কলকাতার কর্মব্যস্ত রাস্তার দিয়ে চলতে লাগল কল্যাণ। মাথাটা দপ্দপ্ করছে। কানদুটো গরম হয়ে উঠেছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে হঠাৎ।
* * *
ঘর অন্ধকার। হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কায় দরজাটা ঝন্ঝন্ শব্দে কেঁপে উঠল। বিছানার উপর উঠে বসল কল্যাণ। ধাক্কাটা ক্রমশ বাড়তে লাগল। একসময় বিকট শব্দ করে দরজাটা ভেঙ্গে পড়ল। কল্যাণ ভয়ে কেঁপে উঠল। চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে ঘরে এসে ঢুকল স্যুট-টাই পরা একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। চোখদুটো খুব ছোট দেখাচ্ছে। গালে বসন্তের পুরোনো দাগ। ঘরে ঢুকেই লোকটা কল্যাণের মায়ের গলা টিপে ধরল। মা অনেক ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। এমন সময় হঠাৎ এক তীক্ষ্ণ শিশুকন্ঠের চিৎকারে ঘাড় ঘুরিয়ে কল্যাণ দেখল ঘরের অন্য প্রান্তে রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে আছে কাবেরী। কল্যাণ কিছু বলার আগেই ভদ্রলোকের দিকে নিশানা করে পরপর তিনবার গুলি চালাল কাবেরী।
চোখ মেলে কল্যাণ দেখল জানলার বাইরে একটু একটু ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে। পাশে তাকিয়ে দেখল নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে কাবেরী। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল দরজা বন্ধই আছে। বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গেল কল্যাণ। ভাল করে মুখেচোখে জল দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিল। তারপর বেসিনের আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে কিছুক্ষণ ভাল করে দেখল।
কুকুরপ্রেমী মানুষজন তাদের কুকুর নিয়ে আজও বেরিয়ে পড়েছেন। টিনাদের বাড়ির গেট এখনও খোলেনি। সময়ও হয়নি। কল্যাণ অপেক্ষা করছে। পৌনে আটটা নাগাদ গেট খুলল। গাড়ি বেরোল গ্যারাজ থেকে। পিছন পিছন চলল কল্যাণ। গাড়ি এসে পৌঁছোল নিউ মার্কেট এলাকায়। লিন্ডসে স্ট্রীটের গলির ভিতর গাড়ি পার্ক হল। একটু দূরে কল্যাণ বাইক রাখল। এখন গাড়ি ফাঁকা। গাড়ির দু’পাশে অন্য দুটো গাড়ি পার্ক করা আছে কিন্তু একটাতেও ড্রাইভার নেই। হাতে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে সবার অলক্ষ্যে নিপুণভাবে গাড়ির সামনের চাকার পাশে বসে পড়ল কল্যাণ। তিন মিনিটে কাজ সেরে উঠে পড়ল সে, চলে এল নিজের বাইকের পাশে। আধঘন্টা পরে আবার রওনা দিল গাড়ি। পিছু নিল কল্যাণ। লিন্ডসে স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে জওয়াহারলাল নেহেরু রোডের ফ্লাইওভারে উঠে পড়ল গাড়ি। পিছনেই একটু দূরে কল্যাণ। ফ্লাইওভারের মাঝামাঝি পৌঁছোতেই আচমকা গাড়ির সামনের একটা চাকা খুলে বেরিয়ে গেল। গাড়ি তৎক্ষণাৎ বেসামাল হয়ে উল্টে গিয়ে ছিটকে পড়ল। তীব্রবেগে ধেয়ে আসা একটা স্করপিও আচমকা গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গাড়িটাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ব্যাপারটা ঠাহর করতে পেরে আশেপাশের গাড়িগুলো ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে থেমে গেল। ভিড় জমে গেল এক মিনিটের মধ্যে। কল্যাণও বাইক থামাল। ভিড় ঠেলে গাড়ি অবধি পৌঁছোল। ইতিমধ্যে লোকজন ধরাধরি করে স্যুট-টাই পরা মাঝবয়সি ভদ্রলোকের রক্তাক্ত দেহ তোবড়ানো ধূসর হন্ডা সিটি থেকে বের করে রাস্তায় রেখেছে। চোখের চশমা ভেঙ্গে পাশেই পড়ে আছে। চোখদুটো এখন আর অত ছোট দেখাচ্ছে না। গালের বসন্তের দাগগুলো রক্তে ঢেকে গিয়েছে। একজন ডাক্তার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসে হাতের নাড়ি পরীক্ষা করে জানিয়ে দিলেন সব শেষ হয়ে গিয়েছে।
কল্যাণ বাইক নিয়ে রওনা দিল। কাবেরীর ছুটির সময় হয়ে এসেছে।