• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | গল্প
    Share
  • সুলতা-রা : শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়


    সুলতা বাবুর বাড়ি কাজ শেষ করে বস্তিতে ফেরার জন্য সবে বড় দরজাটা খুলতে যাবে তখনই মাথায় চক্কর দিল। চোখের সামনে কালো কালো বিন্দু, তলপেটে চিনচিনে ব্যথা ঘাড়ে শীতল স্রোত। মাথা নীচু করে একটু সময় নিয়ে শরীরটা নাগালের মধ্যে এলে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা চালায়। ভাগ্যিস আজ ওর এ অবস্থা বৌদি দেখেনি, নাহলে খুব বকুনি খেত। গতকাল সতর্ক করেছিল: ‘তোর একমাস আগের ছবিতে কিন্ত বড় টিউমার ধরা পড়ায় ডাক্তার তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে বলেছে, তুই কিন্তু যাচ্ছিস না।’ ওবাড়ির আয়া ধরিত্রী চুপি চুপি বলে ওর বাচ্চা হওয়ার জায়গায় টিউমারটা আছে। সুলতা নিজে অতশত বোঝে না, পাত্তাও দেয় না। হবে তো হবে এবার কন্ট্রাক্ট হয়ে গেলে আর ওদিক পানে যাবনি, নিজের মনে আওড়ায়।

    কোনরকমে শরীরটা টেনে লাইনের সামনে আসে। সমস্ত রেললাইনে ছড়ানো অসংখ্য রংবেরংয়ের জামা, কাঁথা, চাদর, শাড়ি। ছোট ছোট বাড়িগুলো কালো নীল পলিথিনে ঢাকা এক বিবর্ণ কোলাজ। সুলতা লাইনের উপর বসে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বাচ্চাদের খেলা দেখে। অযত্ন আর অপুষ্টিতে বেড়ে ওঠা একপাল খুদে মানুষ দৌড়ে প্ল্যাটফর্মের উপর থেকে লাইনে লাফ দিচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতের চড়াই উৎরাই পার হওয়ার রসদ এখান থেকে শুষে নেয়। হঠাৎ খেয়াল হয় এ দলে টুবলুকে দেখা যাচ্ছে না তো। টুবলু ওর সাহেব ছেলে, ফরসা মুখখানা মায়াবী কিন্তু শরীর তালপাতার সেপাই। মুহূর্তে মন অস্থির হয়ে ওঠে, ছুটে আসে বাড়িতে। পলকা দরজা একটু ধাক্কা লেগেই হাঁ মুখ হয়ে খুলে যায়।

    সামনেই বিরিঞ্চি চৌকির উপর আধশোয়া হয়ে বেগুনি আর মুড়ি খাচ্ছে। সুলতার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে—‘তুই এখানে গিলছিস আর বাচ্চাটা না খেয়ে রোদে রেললাইনের কোথায় ঘুরছে!’

    বিরিঞ্চি পাত্তা না দিয়ে একমুঠো মুড়ি আবার মুখে চালান দেয়।

    ‘কিরে আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না? মন তো অনেক আগেই মরেছে, এখনকি কানটাও গেল।’ বিরিঞ্চি এক পায়ের উপর আরেক পা আড়াআড়ি দিয়ে পায়ের পাতা নাচিয়ে বলে, ‘ছেলে ছেলে করে হেদিয়ে মরছিস “ও’’ তো আমাদের নয়।’

    ‘তো?--তুই সেবার অনেক খোসামোদ করতে আমি রাজি হই। টুবলু আমার দোষে এসেছে না তোর গুণে হয়েছে।’

    বিরিঞ্চির হঠাৎ খেয়াল হয় এবারকার টাকা এখনও হাতে আসেনি। তড়াক্ করে লাফ দিয়ে চৌকি থেকে নেমে সুলতাকে বলে, ‘এই দেখ, সত্যি বলছি ওর জন্য একটা বেগুনি রেখে দিয়েছি।’

    ‘উদ্ধার করেছ।’ কথাটা ছুড়ে সুলতা বাইরে চলে যায়। বিরিঞ্চিও পিছন পিছন এসে সামনে দেখে ধনঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ার সবাই ওকে জামাই ডাকে। বিরিঞ্চি জিজ্ঞেস করে, ‘জামাই, টুবলুকে দেখেছিস? দেখ না তখন থেকে ওর জন্য মুড়ি আর বেগুনি নিয়ে বসে আছি কিন্তু পুত্তুরের নাগাল পাচ্ছি না।’

    ধনঞ্জয় হকচকিয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে বিরিঞ্চির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে ঠিক কথা বলতে যাবে এমন সময় শিয়ালদা-লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ছুটির দিনে প্রায় ফাঁকা কামরা নিয়ে প্রচণ্ড শব্দে ছুটে চলে যায়। ট্রেনটা চলে গেলে ধনঞ্জয়ের চোখে পড়ে বিরিঞ্চি আর সুলতা মুখোমুখি যুদ্ধং দেহী ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। সুলতা আখাম্বা বাঁশের মত কোমরে হাত দিয়ে চিৎকার করে শুধোয়, ‘তুই সত্যি করে বল টুবলু কোথায়?’

    বিরিঞ্চি ভালমানুষের মুখ নিয়ে বলে, ‘আমি তো ওকেই খুঁজছি।’ ঠোঙার মধ্যে নেতিয়ে পড়া মুড়ি আর একটা বেগুনি সুলতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই নে খা, পরিশ্রম করে এসেছিস। তোর সুপুত্তুরকে তো পাচ্ছি না, তুই খেয়ে নে।’

    ‘মানে? এখানেই সবসময় থাকে, গেল কোথায়?’

    ‘সে আমি কী বলব। ছেলে তোর, তুই-ই জানিস।’ বিরিঞ্চি হলদেটে দাঁত বার করে খ্যাকখ্যাক করে হাসে।

    সুলতা শাড়িটা কোমরে শক্ত করে গুঁজে সোজা রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে—জোরে, আরও জোরে। পাড়ার শেষ প্রান্তে ক্লাবঘরে এসে থেমে একটু দম নেয়। ঠিক যা মনে করা--একজন আপাত ধোপদুরস্ত লোকের সামনে টুবলু নীচু হয়ে বসে। লোকটি হাত থেকে এক একটা লজেন্স ছুড়ছে আর টুবলু লুফে নিয়ে পকেটে রেখে দিচ্ছে। নিরীহ এ খেলাটির মধ্যে অন্য কেউ কোন জটিলতা খুঁজে পাবে না। কিন্ত সুলতা চিৎকার করে ওঠে—‘টুবলু! আবার তুই পাড়ার বাইরে এসেছিস, ফেলে দে ফেলে দে লজেন্স।’

    টুবলু ছলছল চোখে মার দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলে, ‘মা আমি রিকু পিকু সব্বাইকে দিয়ে খাব, সত্যি বলছি।’

    ‘কারুকে দিতে হবে না, এক্ষুনি ফেলে দে।’

    ‘ও বউ তুমি মিথ্যেই ছেলেটাকে শাস্তি দিচ্ছ। আমি ভালবেসে দাদার বেটাকে একটু লজেন্স দিতে পারি না।’

    ‘দাদার বেটা, কী বললি?’ সুলতার খেয়াল হয় ওর রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখে লোকটা একটু হলেও চুপসে গেল। ছাইরঙা প্যান্ট, হলদেটে চকরাবকরা সার্ট, চোখের নীচে গাঢ় কালি, গালের দুপাশে ছোপ ছোপ ছুলি। লোকটিকে আবছা চেনা লাগে। রেললাইনের আশেপাশে এ-চরিত্তিরের মানুষের গন্ধ ও অনুভব করে। কম দিন হল না তো এ রেললাইনের বস্তিতে থাকা। প্রথম প্রথম সব অচেনা বিতিকিচ্ছিরি লাগলেও এখন বুঝে ফেলে। মাঝে মাঝে কোন বাচ্চা বা ডাগর মেয়ের খোঁজ না পেলে সবাই কয়েকদিন হা-হুতাশ করে আবার ভোর না হতেই যে যার মত বাবুর বাড়ির হাল ধরতে ছোটে।

    সুলতা সব লজেন্স মুঠোতে এনে ছুড়ে মারে। লোকটির টায়ারের চপ্পলের সামনে রংবেরংয়ের লজেন্সগুলো চকচক করে ওঠে। টুবলুর ডান হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে। ছোট ছোট কচি হাত লাল হয়ে ওঠে। সুলতা বাড়ির সামনে এসে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আকুল হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমাকে বিকেলে ভাল লজন্স এনে দেব। তুমি কথা দাও আর কোন দিন অচেনা কারুর সাথে যাবে না, কথা দাও, বলো।’

    ‘মা ওই কাকুটা অচেনা নয়, বাবা আগের দিন আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল।’ টুবলুর অসহায় উত্তর।

    এমন সময় বিরিঞ্চি বাঁকা হয়ে সকালের নেতিয়ে পড়া মুড়ি আর বেগুনি নিয়ে এসে দাঁড়ায়—‘’টুবলু নে, খা, আমি তোর জন্য বেগুনি এনেছি।’

    সুলতা খপাত করে মুড়ি বেগুনির ঠোঙাটা নিয়ে রেললাইনে ছুড়ে মারে। মুড়ি নেতিয়ে বেগুনির সঙ্গে মাখামাখি হয়ে লাইনের উপর চেটকে থাকে। সুলতার মনে হয় অনাদরে পড়ে থাকা কতগুলো ভ্রূণ। কোমরে কাপড় কষে জড়িয়ে বিরিঞ্চির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওই ছেরাদ্দের পিণ্ডি তুই গেল। নিজের গতর খাটিয়ে দুমুঠো ভাত দিতে পারিস না সাতবাসি বেগুনি দিয়ে সোহাগ দেখাচ্ছে।’ বিরিঞ্চি বোঝে এখন হাওয়া গরম, বেশি ঘাঁটালে এবারকার দাঁও ফসকে যাবে। কথা না বাড়িয়ে কুঁজো হয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকে।

    বিরিঞ্চির সঙ্গে সুলতার থাকা কমদিন হল না। প্রথম প্রথম বুঝে উঠতে পারেনি লোকটা ধূর্ত না সরল। গ্রামের বাড়ি ডায়মন্ডে মাঝেমাঝে নিয়ে যায়। কথায় কথায় বলে এ ভেড়িটা ওদের। সারা দুপুর মাছ ধরে কাটিয়ে বিকেলে ছোট মৌরলা চাঁদা পুঁটি মিশিয়ে পেঁয়াজ চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেয়ে কাটিয়েছে। অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা সুরে আর পেঁচার ডাকে রাত নামে, চারিদিক শুনশান্। পরে জেনেছে বিরিঞ্চির বাবা ওই ভেড়ির পাহারাদার ছিল। কী কারণে খুন হওয়াতে মাটির বাড়ি ও ভাবেই পড়ে আছে। কেষ্টপুরের খালপাড়ে বাপ মা মরা মেয়ে মামার কাছে মানুষ সুলতা, মুক্তি পেতে একদিন বিরিঞ্চির হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিল।

    এতক্ষণে সুলতার খেয়াল হয় টুবলুর হাতটা ও এতজোরে ধরেছিল তাতে পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গেছে। আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে ফুঁ দিয়ে শাড়ির আঁচল নিয়ে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলে, ‘সোনা আমার, খুব লেগেছে; না রে?’ গালে গাল ঠেকায়, ‘আমার প্রাণ, আমার মানিক।’

    টুবলু মাকে আদর করে, ‘না মা লাগেনি। চলো আমরা ঘরে যাই, খুব খিদে পেয়েছে।’

    সুলতার চোখে জল আসে, তাড়াতাড়ি হাত ধরে ঘরে ঢোকে। বাটিতে পেঁয়াজ কুচিতে ময়দা মেখে স্টোভ জ্বালায়। চারকোণে তিনটে করে ইট দিয়ে চৌকি উঁচু করে নীচে রান্নার ব্যবস্থা, আগুন বেশি করা যায় না। অল্প আঁচে পেঁয়াজিগুলো ভাজতে শুরু করে টুবলুকে খেতে ডাকে। বিরিঞ্চি বারান্দা থেকে চিৎকার করে বলে, ‘আমার ভাত আর পেঁয়াজি গরম থাকে যেন।’ সুলতার ঠান্ডা গলায় উত্তর, ‘তোর তো এতে হবে না, গোটা দশেক কাঁচালঙ্কা, একথাবা শুকনো লঙ্কা চাই। ঠিক করা আছে ওর খাওয়া হোক দেব।’ বিরিঞ্চি চুপ করে যায়, বোঝে ওর সঙ্গে মদনের মোলাকাত হয়েছে।

    টুবলুর খাওয়া শেষ হলে সুলতা কেষ্টপুরের খালপাড়ের বন্ধু রাবেয়ার বাড়িতে ওকে দিতে যায়। রেললাইনের ওপারে, রাবেয়ার বাড়িতে ফ্যান আছে, ছেলেটা দুপুরে একটু আরামে শুতে পারে। বাড়িতে ফিরে দেখে বিরিঞ্চি খাওয়া শেষ করে হাঁড়ি পরিষ্কার করে রেখেছে। সুলতার চোখ জলে ভরে যায়, হায়রে লোভী পুরুষ, নিজেকে ছাড়া কিছুই জানে না। এ-চত্তরে বিরিঞ্চিকে সবাই মাছদাদা বলে। এ-বস্তির অনেকে ওর সঙ্গে যাওয়ার কথা বললে বিরিঞ্চি রাজি হয় না; ও যে এখন মাছ কাটায় নেই সেকথা সুলতা ছাড়া কেউ জানে না। বিরিঞ্চি আরো বড় ব্যবসা ফেঁদে ওর শরীরের উপর জোঁকের মত বসে রক্ত শুষে নিচ্ছে, ও সুলতার জীবনের সময় কিনে নিয়েছে।

    সুলতার মন চলে ধূসর অতীতে—‘চল মুম্বাই যাই, সমুদ্র দেখতে পাবি, কত সুন্দর বাড়ি সব, কী অপ্সরার মত মেয়েরা। তোকে বাচ্চা হওয়ার ডাক্তারও দেখিয়ে নেব।’’ বিরিঞ্চি স্বপ্ন দেখায়।

    ‘কাজটা ধরব না বলছিস?’

    বিরিঞ্চি দার্শনিকের মত মুখ করে বলে, ‘বোঝ, তোর দোষেই তো বাচ্চাটা চলে গেল, এখন দেখি কী করা যায়।’

    সুলতার সন্দেহ বিরিঞ্চি নিজের সন্তান দিয়েই সুলতার সক্ষমতার পরীক্ষা নিয়েছে। পরে মুম্বায়ের ডাক্তাররা কী দিয়ে কী করছে কমবয়েসি সুলতা বোঝে না, ওর মনে আনন্দ নতুন বাচ্চা আসবে। একদিন সত্যিই বড় হসপিটালে ভর্তি করা হয়। জ্ঞান ফিরলে সুলতার প্রশ্ন, ‘বাচ্চা কোথায়?’

    বিরিঞ্চির উদাসীন উত্তর, ‘এটাও মরা হয়েছে।’

    সুলতা চারপাশ দেখে, এতবড় হসপিটাল এত বড় বড় ডাক্তার, তাও বাঁচাতে পারল না। এরপর থেকে ওর চিন্তায় ধাঁধাঁ শুরু হয়ে যায়--কেন বিরিঞ্চি বাচ্চা আসার আগে আর হওয়ার সময় ওই বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সুলতা জট খুলতে মাঝে মাঝে বিরিঞ্চিকে প্রশ্নের ফাঁদে ফেলে, ধূর্ত বিরিঞ্চি আধাআধি বখরার পথ নেয়। দালালের সঙ্গে যোগসাজসে প্রথম টাকা নিয়ে তিন-চার মাস বাদে হাতুড়েকে দিয়ে সাফাই করিয়ে নিজেরা দুজন বেপাাত্তা হয়ে যেত, পড়ে থাকত সুলতা ভগ্নশরীর নিয়ে।

    বিরিঞ্চি ফিরলে সুলতা প্রশ্ন করে, ‘কলকাতা শহরে কি মেয়েমানুষেরা বাচ্ছা বিয়োয় না? আগে তবু পুরো সময় পেটে থাকত এখন তো মাঝেই ওয়াস করতে হয়, তুই বা কোথায় চলে যাস?’

    শেয়ালের মত ফ্যাসফেসে হাসির সঙ্গে বিরিঞ্চি বলে, ‘কলকতায় আমার কত কাজ থাকে। মাছ কেটে এত উপার্জন করছি, বলি ভাল পুত্তুর পাব না! তোর এতে আপত্তি কেন, তুই কি মা হতে চাস না?’ বিরিঞ্চি বোঝে ওর দ্বিতীয় কৌশলও ধরা পড়ার মুখে।

    সুলতার মনে অজানা এক সন্দেহ দানা বাঁধে। ওর শরীর প্রতিবারের এ ধকল নিতে পারছে না; সিদ্ধান্তে আসে বাচ্ছা পেটে এলেই ও পালাবে। সেইমত সে টুবলু পেটে এলে বুম্বাই থেকে কলকাতা ফিরে পালানোর ছক কষতে থাকে। সুযোগ পেয়ে শুধুমাত্র রাবেয়াকে বলে সোদপুরে দূরসম্পর্কের মামার বাড়ি পালায়। টুবলুর জন্মের পরে এক বছর হলে রেল লাইনে ফেরে। বিরিঞ্চি ওদের দেখে খ্যাপা কুকুর হয়ে যায়, প্রতিদিন মার খেলেও পাখিমায়ের মত সুলতা টুবলুকে আগলায়।

    ‘তুই যতই মারিস একবার আমি পুত্তুরের মুখ তো দেখেছি।’

    ‘পুত্তুর পুত্তুর করছিস ও তো আমাদের না, তোর ঘেন্না হয় না?’

    সুলতা সমানে মুখ চালায়, ‘যে পুরুষ ইস্তিরির পেট ভাড়া দেয় তাকে আমি ঘেন্না করি।’

    বিরিঞ্চি চুপসে যায়, বোঝে সুলতা আর ওর মাঝের ব্যবসায়িক দেওয়ালটা ভেঙে গেছে, একটু সামলে চলতে হবে। মুখে বলে, ‘খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা হয়েছে, কোথা থেকে কী বুঝেছিস ও নিয়ে মিথ্যে জল ঘোলা করিসনে। আচ্ছা টুবলু আমাদের পুত্তুর।’ যদিও পরের বার মোটা টাকায় আরেকজনের জন্ম দিতে হয়। এবার ডাক্তারের কাছে যাবার আগেই সুলতার শরীর ঠিক জুত পাচ্ছিল না। ও বিরিঞ্চিকে বলে, ‘এবার যাওয়া বাদ দে। অনেক পয়সা তো কামাই করেছিস, আমার কী ধনদৌলত হল!’

    ‘আসবে রে আসবে, নতুন কাজে পুরোনো দোস্ত মদনকে ফিট করেছি। বুঝলি সামনের মাসে মুম্বাই যাওয়ার টিকিট কাটব, এবারেই শেষ।’

    ‘কীসের?’

    ‘এইযে এসব কাজের--’ বিরিঞ্চি একচোখ টিপে উত্তর দেয়। সাপের মত হিসহিস করে বলে, ‘মাইরি বলছি, সত্যি আমি ভাল হতে চাই। তোকে কী করে বোঝাব বল তো, তুই আমার একমাত্র ই-স্তীরি, টুবলুর মা।’একটা টানা সুর লাগায়। সুলতা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

    বিকেলের আলো পড়ে আসছে, বৌদির বাড়ির দিকে এক-পা দু-পা করে এগিয়ে যায়। দরজায় পৌঁছে কলিংবেল টিপতেই সমস্ত শরীর কেমন অবশ হয়ে চোখে অন্ধকার লাগে। বৌদি দরজা খুলে ওকে এ অবস্থায় দেখে ধরে ঘরে নিয়ে আসে, নুন চিনির জল খেতে দিয়ে গজর গজর করতে থাকে—‘কবে থেকে বলে আসছি টিউমারটা অপারেশন করে নে তা কথা শুনছিস না।’

    সুলতা প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা বৌদি টিউমারটা নিজে নিজে একটু করে বড় হয়, এটার জন্ম দিতে কেন ডাক্তার লাগে না।’

    ‘এ আবার কেমন কথা, এটা তো তোর শরীরই তৈরি করেছে, সে অনেক বিজ্ঞানের বিষয়, তুই একটু রেস্ট নে তো।’

    ঠিক এসময় ঝড়ের বেগে দাদা বাইরে থেকে এসে বলে, ‘কীরে লাইনে শুনে এলাম একটা ছেলে চুরি হয়েছে।’

    সুলতার সামনে বিভিন্ন রংয়ের লজেন্সের ছবি ভেসে ওঠে। হঠাৎ শরীরে দৈত্যের শক্তি চলে আসে, বিদ্যুৎবেগে দৌড়োতে শুরু করে। ও নিজে জানে না এ শক্তি ওর কোথায় ছিল। সত্যি লাইনে একটা জটলা, ধনঞ্জয়কে দেখে জিজ্ঞেস করে ‘টুবলু কোথায়?’

    ‘কেন ও তো বিরিঞ্চি আর ওর ভাইয়ের সঙ্গে চলে গেছে, আরো দুজন বাচ্চাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো রেললাইনে আবার বাচ্চা চুরি শুরু হল।’

    সুলতা আঁতকে ওঠে, বিরিঞ্চির সাতকুলে কেউ নেই, তবে কি পুরোনো দোস্ত মদন? ওর সঙ্গে নতুন ব্যবসা? বুঝতে পারে সুলতার উপর আর ভরসা না করে শিশু বিক্রির বড় লাভের লেনদেনে বিরিঞ্চি পা বাড়িয়েছে। আবছা আলোয় ওভারব্রিজে বিরিঞ্চিকে যেন দেখা যাচ্ছে। সুলতার শরীর ছাড়িয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম উদ্দেশে এ পৃথিবীর কোন এক নামহীন স্টেশনে কয়েকটি শিশু নিয়ে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

    ওর জীবনে টুবলু এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছিল। শূন্য রিক্ত সুলতা ঘরে ফিরে টুবলুর ছোট ছোট জামাগুলি ভাঁজ করে হাত বুলোতে থাকে। গতির এ রেললাইনের পাশে স্থবির অনিশ্চিত জীবনে টুবলুর স্মৃতিকে যত্নে বেঁধে রেখে কাল ছুটতে হবে বাবুর ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে। এক সমুদ্র জলে ভাসে চোখ, ঢেউয়ের ফেনায় সাহেব ছেলে, তালপাতার সেপাই ওঠা নামা করে, থেকে যায় অধরা।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments