• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | গল্প
    Share
  • দিল্লি ভ্রমণ دلی کی سیر : রাশিদ জাহাঁ
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়


    ১৯৩২ সালে লেখা এই গল্পটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করে শুভময় রায় এই সংখ্যাতেই উর্দু সাহিত্যে এই পথিকৃৎ লেখিকা রাশিদ জাহাঁর (১৯০২-১৯৫২) নির্ভীক জীবন ও সাহসী সাহিত্যের আলোচনা করেছেন।

    —সম্পাদক



    “ওহ্‌, এটা ঠিক নয়, আমাকে তো আসতে দেবে!” দালান থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একটি কিশোরী কুর্তার পাড়ে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল। তার সব বান্ধবীদের মধ্যে মালকাহ্‌ বেগমই এই প্রথম ট্রেনে চড়ল। আর তাও ফরিদাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করে পাক্কা এক দিনের জন্য দিল্লি যাওয়া! পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই তাঁর এহেন সফরের গল্প শুনতে জড়ো হয়েছে।

    “যদি আসতে হয়, তাহলে তাড়াতাড়ি এসো! আমার তো মুখ ব্যথা হয়ে গেল। আল্লাহ্‌-র কৃপায় আমার মুখ দিয়ে মিথ্যে যেন না বেরোয়। কয়েক’শ বার তো সে কাহিনী শোনালাম। এখান থেকে রেলে চড়ে দিল্লি তো পৌঁছলাম। সেখানে পরিচিত কোনও হতচ্ছাড়া স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে ওঁর দেখা হয়ে গেল। আমাকে লটবহরের পাশে বসিয়ে রেখে উনি তো অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর আমি সেই মালপত্রের ওপরে চড়ে বোরখা জড়িয়ে বসে রইলাম। এক দিকে তো এই কমবখ্‌ত বোরখা, আর ওদিকে বেহায়া পুরুষগুলো। মরদগুলো তো এমনিতেই খারাপ। আর যদি কোনও মহিলাকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে, তো চারদিকে ঘোরাঘুরি শুরু হয়ে গেল। একটা পান চিবোনোর সুযোগ পর্যন্ত এল না। কোনও কমবখ্‌ত কাশে তো কেউ চেঁচিয়ে কিছু বলে। আর ভয়ে যেন আমার দম বেরিয়ে যায়। আর খিদে যে কী পেয়েছিল... শুধু খোদাই জানেন! আর দিল্লির স্টেশন, বুয়া! কেল্লাও অত বড় নয়। যেদিকে চোখ পড়ে ইস্টিশন হি ইস্টিশন! খালি রেলের কামরা, ইঞ্জিন আর মালগাড়ি! ইঞ্জিনের মধ্যে ওই কালো কালো পুরুষগুলোকে দেখে সবচেয়ে ডর লাগছিল তো।”

    “ইঞ্জিনে কারা থাকে?” কেউ থামিয়ে জিগ্যেস করে।

    “কারা থাকে? জানি না বুয়া, কারা। নীল রঙের জামাকাপড়, কারও দাড়ি আছে, কারও বা সব কামানো। এক হাতে ধরে চলতি ইঞ্জিন থেকে ঝুলে পড়ে। সে দৃশ্য যারা দেখে ভয়ে তাদের প্রাণ যায়। আর বুয়া, দিল্লি স্টেশনে এত সাহেব আর মেমসাহেব যে গোনা যাবে না। একে অন্যের হাত ধরে গট্‌মট্‌ গট্‌মট্‌ করতে করতে মুখে ইংরেজির ফোয়ারা ছুটিয়ে চলেছে। আর আমাদের হিন্দুস্তানি ভাইয়েরা – সে দৃশ্য দেখে তাদের চোখ তো ছানাবড়া! মনে হয় কমবখ্‌তদের চোখ খুলে বেরিয়ে আসবে। একজন তো আমাকে বলেই ফেলল, ‘একটু মুখটা দেখাও।’

    আমি তো সঙ্গে সঙ্গে...”

    “তাহলে তুমি কি মুখ দেখালে না?” কেউ প্রশ্ন করে।

    “আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করো বুয়া! আমি কি ওই হতচ্ছাড়াদের আমার মুখ দেখাতে গিয়েছিলাম? আমার বুক ধুকপুক করছিল।”

    তারপরে ভ্রূ কুঁচকে বলে, “শোনার হলে কথার মধ্যে ফোড়ন কেটো না!”

    সকলে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এমন মজাদার কাহিনী ফরিদাবাদে কম শোনা যায়। আর মালকাহ্‌-র কথা শুনতে তো দূর দূর থেকে মহিলারা আসতেন।

    “হাঁ বুয়া, সেখানে সওদা নিয়ে আসা লোকজনেরা আমাদের এখানকার মত নয়। পরিষ্কার খাকি পোশাক, কারও বা সাদা, তবে কারও কারও ধুতি অবশ্য বেশ ময়লা ছিল। টুকরিতে মাল নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। ‘পান-বিড়ি-সিগ্রেট’, ‘দহি-বড়া’, ‘খিলোনা হ্যায় খিলোনা’, চলতে থাকা গাড়ির মধ্যে বাক্সবন্দি মিঠাই নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়চ্ছে। একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। এমন শোরগোল হল যে কানের পর্দা ফেটে যায়। এদিকে কুলিদের হাঁকডাক তো ওদিকে সওদাওলারা কান খেয়ে নিচ্ছে। আর যাত্রীরা একে অপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আর এসবের মধ্যে বেচারা আমি মালপত্রের ওপর চড়ে বসে আছি। কতবার যে আমাকে ঠেলেঠুলে ধাক্কা দিয়ে লোক চলে গেল। আর আমি ভয়ে ভয়ে বিড়বিড় করে চলেছি ‘জল তু জালাল তু আই বালা কো টাল তু’। খোদা খোদা করতে করতে রেল তো চলতে শুরু করল, কিন্তু যাত্রী আর কুলিদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হল।”

    ‘এক রুপিয়া লুঙ্গা।’

    ‘নহিঁ, দো আনে মিলেঙ্গে।’

    “এক ঘণ্টা সে ঝগড়া চলল। তারপরে স্টেশন খালি হল। কিন্তু স্টেশনের বেহায়াগুলো তখনও ভিড় করেই আছে। প্রায় দু-ঘণ্টা পরে ইনি গোঁফে তা দিতে দিতে এলেন। আর কোনও কিছুকে যেন পরোয়া করেন না এমনভাবে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার খিদে পেয়েছে? পুরি-টুরি কিছু নিয়ে আসব? খাবে? আমি তো ওদিকে হোটেলে খেয়ে এলাম।’”

    আমি বললাম, “খোদার দিব্যি, আমাকে আমার ঘরে পৌঁছে দাও। আমার দিল্লি দেখা অনেক হয়েছে। তোমার সঙ্গে কেউ যেন কোথাও না যায়। স্বর্গেও না যায়। দারুণ বেড়াতে নিয়ে এসেছিলে।” ফরিদাবাদের গাড়ি তৈরি ছিল। সে গাড়িতে আমাকে বসিয়ে উনি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “তোমার মর্জি, বেড়াবে না তো বেড়িও না।”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ দীপঙ্কর ঘোষ; Memories of Madhupur বই থেকে

    Tags: Rashid Angarewali Jahan
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments