“তোমার মত হারামি মেয়েছেলে আমি দুটো দেখি নি”, বলে আমি চটি গলিয়ে হনহন করে হাঁটা দিলাম। “তোমার”, “মত”, “হারামি’, “মেয়েছেলে”। বাড়ি থেকে বেরোতেই একটা বেঁটেখাটো ম্যাগনোলিয়া গাছ। সেখান থেকে নেমে আসল রুহু। রুহু রক্ত চোষে। প্রথম যে বার ওকে দেখেছিলাম খুব ভয় পেয়েছিলাম। এখনও পাই। তবে অন্য কারণে। এখন ও আমায় ফলো করবে। নাক ওর একদম খাড়া। রক্তের গন্ধ ও সবচেয়ে আগে পায়। ওর হাতে একটা বেতের ছড়ি। ওর দাঁতের জোড় নেই। সুযোগ পেলে প্রথমে ও তাই বেত দিয়ে মেরে খাল খুলে নেয়। পরে দাঁত বসিয়ে রক্ত চোষে। আমি প্রায় দৌড়োতে থাকি। বুকের মধ্যে হামান দিস্তে পড়ছে আমার। আমি জানি রুহু আগুনকে ভয় পায়। আমি চট করে দুটো চকমকি পাথর কুড়িয়ে নিই রাস্তা থেকে। প্রাণপণে ঘষতে থাকি। আগুনের ফুলকি বেরোয়। আগুন দেখে ও কাছে ঘেঁষে না। শান্ত ভাবে, তাড়াহুড়ো না করে আমায় ফলো করে। কোনো সিনেমা দ্বিতীয় বার দেখলে যেমন শেষ জানার তাড়া থাকে না। সেরকম।
শালা আমায় কিনা বাড়ি তুলল!
শুধু বয়সেই বড় হয়েছ। একটা কাজ শেখো নি। সকাল থেকে বলছি, বাসনগুলো মেজে দাও। বাবু নামলেন বিকেল বেলা। আর তারপর কি করলেন? আমার নোরিটাকের সাধের ডিনার সেটের একটা থালা হাত থেকে ফেলে ভেঙে দিলেন। শুধু পড়াশুনোই করিয়েছে বাবা মা তোমায়। ছেলের গুণমুগ্ধ ভক্ত না হয়ে সংসারের দু একটা সহজপাঠ তোমার মা তোমায় শেখালে ভাল করতেন।
এত বড় কথা! বাড়ি তুলল আমার। নিজে কোন বাড়ির মেয়ে ও? ওর মা তো ক-অক্ষর-গো-মাংস। সে না হয় ছেড়েই দিলাম। বাবাও তো ক্লার্কগিরি করে কোনোমতে জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে। ক্লাস বলে তো কিছু নেই ওদের। সে কি না আমার বাড়ি তুলল!
আমাদের বাড়ির গলি ছেড়ে বড়রাস্তায় পড়লাম। হুস হুস করে গাড়ি যাচ্ছে। আমি ডানদিক নিলাম। একটা পথ চলতি লোক হ্যালো বলল। আমিও নড করে হাসলাম। আসলে হাসার ভান করলাম। হাসার ভান করে করে আজকাল এমন অভ্যেস হয়ে গেছে সত্যি হাসি আর হাসির ভানের মধ্যের সীমারেখাটা বর্ষায় রোঁয়া ফোলানো নদীর তটভূমির মত অনির্দিষ্ট হয়ে গেছে। আমি চকমকি পাথর ঘসে আগুনের ফুলকি বানাতে থাকি। রুহু আমায় ফলো করছে। ওর কোনো তাড়া নেই। ও সময়ে বিশ্বাস রাখে। সময়ের সাথে সব কিছু নিভে আসে। স্মৃতি। আগুন। সব কিছু।
আমার চকমকি পাথর দুটো ক্ষয়ে আসে। আমি প্রাণপণে জ্বালানোর চেষ্টা করি।
এই রাস্তায় গাছের ডালগুলো অনেক নীচ অব্দি নেমে এসেছে। আমি প্রায় ছ ফুট। মাথা নামিয়ে চলতে হয়। আমি অ্যাভারেজ বাঙালির তুলনায় শুধু লম্বা নই, হ্যান্ডসামও। কলেজে কম মেয়ে আমার পেছনে ছিল না। তাও কি আমি রঞ্জনাকে ডিচ করেছি? করি নি। অন্য মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি করি নি। ওর জন্য। সব কিছু ওর জন্য। আমি কেরিয়ারে অনেক উন্নতি করতে পারতাম। শুধু এই বউ বাচ্চা সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে হয়ে উঠল না। যবে থেকে বিয়ে করেছি, যবে থেকে রঞ্জনা আমার ঘাড়ে চেপেছে একটা দিন শান্তিতে কাটাতে পারি নি। হানিমুনে গিয়েও দ্বিতীয় রাত্তিরে কি ঝামেলাটাই না করেছিল? কি না আমি বীচে নাকি কোনো সান-বেদিং বিকিনি বিচের লেগস দেখেছি অনেকক্ষণ ধরে। ন্যাগিং। ইয়েস। ন্যাগিং পার্সোনিফায়েড। দ্যাটস হোয়াট রঞ্জনা ইজ। ইন্সিকিয়োরড। ইউজলেস।
আগুন দাও। আগুন দাও। হে আমার প্রাণদায়ী চকমকি। রুহুর থেকে বাঁচার উপায় একটাই। আগুন।
একটা পুকুর ক্রস করলাম। দুটো পাখি বসে পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুর পোয়াচ্ছে। খুঁটে খাচ্ছে দানা। একটু পরে রাত্রি নামবে। ওরা বাসায় ফিরে গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বে। আমার দোষ বলতে শুধু আমার মাথাটা চট করে গরম হয়। আমি তো কই কখনো আগে থেকে ওর পেছনে লাগতে যাই না। যা চায় তাই করার অনুমতি দিয়েছি। ফি বছর ফরেন টুরে নিয়ে যাই। উইকএন্ড হলেই বন্ধুদের সাথে দেদার শপিং করে। কিচ্ছুটি বলি না। মুখে কুলুপ এঁটে থাকি। ওই তো অনিরুদ্ধ। ওর প্রাণের বন্ধু শিঞ্জিনির বর। বউয়ের প্রতিটা খরচার হিসেবে রাখে। কই আমি তো এইসব নিয়ে পেছনে খরচাপাতি নিয়ে পেছনে লেগে থাকি না। তারপরেও একটা সামান্য কাচের থালা ভাঙায় আমার বাড়ি তোলা। বেশ করব ভাঙব। একশ বার ভাঙব। আমার টাকায় কেনা। হ্যাঁ মাঝে মাঝে বাজে কথা বেরিয়ে যায় আমার মুখ দিয়ে। কিন্তু আমি...আমি ওরম হলাম কিভাবে? ওর কন্সট্যান্ট হ্যারাসমেন্টেই হয়েছি। তবে আজ একটু...এক্টু বাজে খিস্তি বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। হারামি। মেয়েছেলে। একটু বেশি। একটু? না না। একটু বেশিই বেশি। আসলে অনেকটা বেশি।
আমার চকমকি ধুলো হয়ে মিশে গেল একে অপরের সাথে।
রুহু এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। চট করে গতি বাড়িয়ে চলে এল ঠিক আমার পেছনে। ওর নিঃশ্বাস হলকার মত আমার ঘাড়ে পড়ছে। বেতটা ভাল করে মুঠো করে ধরে আমার পিঠে বসিয়ে দিল। নিখুঁত হাতের কাজ। যেন বীণার ছড় টানছে। সপাং। আমার মুখটা যন্ত্রণায় হালকা বেঁকে গেল। আমি এদিক ওদিক দিশাহারা হয়ে তাকাচ্ছি। যদি এক টুকরো চকমকি কোথাও পড়ে থাকে পথের ধারে। একটাও নেই। সপাং। সপাং। রুহু বেতটা চালাতে লাগল। আমার পিঠে। এলোমেলো বেতের বাড়ি। যেন পুকুর ধারে অনাবশ্যক কচুবন সাফ করা হচ্ছে জেলার ডি এম সাহেবের রুটিন ভিজিটের আগে। প্রথম দু একটা বেতের বাড়িতে পিঠে কালো কালশিটে পড়ল। দু বছরের কোনো খুদে আর্টিস্টের হাতে পেন্সিল দিলে সাদা দেওয়ালে সে যে রকম আঁকিবুঁকি এঁকে দেয় সেরকম। পরে চামড়া কেটে কেটে বসে যেতে লাগল। পাহাড় কেটে যেমন নদী পথ করে নেয় সেইভাবে রক্তরেখা ফুটে বেরোতে লাগল। কিছু কিছু শব্দে রক্তের স্বাদ থাকে। প্রয়োগ বিশেষে। রুহু টের পায়। রুহু ঠিক টের পায়।
আমি অনিকেত রায়। ভদ্র ঘরের ভদ্র সন্তান। স্কুল কলেজে পড়াশোনায় ভাল ফল করা ছেলে। সরকারি চাকুরে। দুই ছেলের বাবা। আমি কিনা মদ্যপ বস্তিবাসীর মত রঞ্জনাকে হারামি মেয়েছেলে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। কলেজের বন্ধুদের সাথে চার অক্ষরে বোকা বলা আর নিজের বউকে হারামি মেয়েছেলে বলার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে। ছেলেরা বোধ হয় বরাবরই দুর্বল। কোণঠাসা হয়ে গেলেই তাই নোংরামির ঢালের আড়ালে মাথা বাঁচায়। কই রঞ্জনার মুখে তো এমন শব্দ আসে না! কিন্তু সমগ্র পুরুষ জাতিকেই বা দোষ দিই কি করে? আমার বাবা তো কখনো মাকে নোংরা খিস্তি খেউড় করে নি। ঝগড়া যে তাদের হয় নি তা নয়। কিন্তু সে এমন মর্মন্তুদ অতল খাদে নামে নি কখনো। তবে কি এই জেনেরেশান? ব্যক্তিগত জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার কুরুচিকর অনুপ্রবেশ, অ্যাম্বিশানের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের নিচে কুচলে যাওয়া অহং, এই অশ্লীল অস্থির সময় - এই সবই কি সব মূল্যবোধ, সব সুচেতনাকে কালনাগের মত দংশন করছে? আমার পরিশীলন বোধ মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলেই কি এই মৃত্যুমুখে ছুটে চলা সভ্যতা পোঁদে ক্যাৎ করে লাথি মেরে কাদায় ফেলে দিচ্ছে? কর্দমাক্ত হচ্ছে সমস্ত সুন্দর?
আমি হনহন করে পা চালাচ্ছিলাম। রুহুর থেকে সরে যাওয়ার জন্য। রুহুর থেকে আমার দূরে সরে যেতে হবে। নয়তো রুহুর হাত থেকে নিস্তার নেই। আমার পিঠের খাতায় শিশুর মত যেমন ইচ্ছে আঁকিবুঁকি এঁকে এবার রুহু নিজের লকলকে সবুজ জিভ বের করে চাটতে লাগল। রক্ত দেখলেই ওর রমণ ইচ্ছা জাগে। এবার ও আমায় ধর্ষণ করবে।
আমি হাঁটতে হাঁটতে সেই বিশাল মাঠটার ধারে পৌঁছে গেছি। এটা আমাদের বাড়ির থেকে দশ মিনিট দূরেই। মাঝে মাঝে এই খোলা জায়গাটায় হাঁটতে আসি আমি। সন্ধ্যে নামতে আর বেশি দেরি নেই। টুকরো টুকরো অন্ধকারেরা গুঁড়ি মেরে অপেক্ষা করছে। পৃথিবীর দখল নেবে বলে। সন্ধ্যেবেলা এই জনমনিষ্যিহীন আদিগন্ত মাঠে না ঢোকাই ভাল। চোর ছ্যাঁচড় অ্যান্টিসোশ্যাল কত কী থাকে। কিন্তু এখনি ফেরা চলবে না। চেনা গণ্ডির মধ্যে ঢুকলেই রুহুর প্রতিপত্তি বাড়ে। আমি জানি। একটা সরু আলপথ মাঠটাকে কোনাকুনি কেটে চলে গেছে। শুরুতে একটা গেট মতন। সন্ধ্যে ছটা থেকে সকাল ছটা অব্দি “নো এন্ট্রি” লেখা আছে। কিন্তু নিয়ম। সে তো ভাঙবার জন্যই। গেটের দু তিনটে লোহার রড বাঁকানো আছে আইনের ফাঁকের মত। যাতে যে যখন খুশি ঢুকতে পারে।
আমি মাথাটা গলিয়ে দিই। পুরো বডিটা যখন ওপারে নিয়ে গেলাম কাঁটাতারে লেগে আমার ভ্যান হুসেনের শার্টটা একটু ছিঁড়ে গেল। শিট। পুরো সাড়ে তিন হাজার টাকার শার্ট। রিপু করিয়ে নেওয়া হয়তো যাবে। কিন্তু তবু মনটা খচখচ করে। আড়চোখে পেছনে তাকিয়ে দেখি রুহু গেটের বাইরে হিমবাহের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সবুজ জিভটা লকলক করছে। শিকার বেরিয়ে গেছে হাত থেকে, তবে ফিরবে আবার - ভাবটা এরকম। ও রেস্ট্রিক্টেড জোনে ঢোকে না কখনো। গেটটা ক্রস করতেই আমার অস্থির ভাবটা কমে এল। রাস্তার ধারে ধারে দু একটা কাঁটাঝোপ। কয়েকটা বেগনে জারজ ফুল সূর্যের শব থেকে মজা করে মেখে নিচ্ছে কমলা। আমি পা চালাতে থাকি। লয়ে ছন্দে। যেন আমি স্টেজে পারফর্ম করতে উঠেছি। রবীন্দ্র নৃত্যের কুশীলব। চাপ চাপ নৈঃশব্দ্য আকাশ থেকে টুপ্টাপ করে পড়তে থাকে সীসাবৃষ্টির মত। অন্ধকার আমার চারপাশে মৃত্যুর মত চেপে আসে। আমি যেন একটা আলোর বুদবুদ। অন্ধকার কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছি। আর শূন্যস্থান পূরণ করে নিচ্ছে অন্ধকার। আজ অমাবস্যার পরের দিন। প্রতিপদ। একটা ক্ষয়াটে চাঁদ নিয়মরক্ষার খাতিরে আকাশে। যেটুকু দেখতে পারছি তারই বদান্যতায়।
হঠাৎ চলতে চলতে থমকে দাঁড়াই। অদ্ভুত তো। এতদিন এই আলপথ ধরে হেঁটেছি। কোনোদিন চোখে পড়ে নি। আমি কি এতদূর আগে কখনো আসি নি? কিন্তু তা কি করে হয়? আমি তো মাঠের শেষ অব্দি গেছিলাম একদিন। সেই যেদিন রঞ্জনাকে বলেছিলাম, আসলে কী জানো তোমাদের বাড়ির কোনো কালচার নেই, দ্যাট ইজ দ্য মেইন প্রব্লেম। সেদিন হেঁটে গেছিলাম। মাঠের শেষ অব্দি। অবশ্য সেদিন দিনের বেলা ছিল। দিনের বেলা তো কত কিছু দেখা যায় না। সারাক্ষণ দিন থাকলে তো নক্ষত্রদের কথা জানতেই পারা যেত না! আর কয়েক পা দূরেই দেখতে পাচ্ছি একটা সাঁকো। নড়বড়ে কাঠের ব্রীজ। নীচ দিয়ে একটা নদীর রেখা। চাঁদের আলো পড়ে একটা নিষিদ্ধ ক্ষতের মত লাগছে নদীটাকে। দিনের বেলায় আমি মাঠের শেষ অব্দি হেঁটে গেছি এই আলপথ ধরে। কোনো ব্রীজ দেখি নি কখনো। ব্রীজটা কি পেরোব? অন্ধকারের গর্ভ থেকে জন্মায় যে সাঁকো সেটা পেরোনো কি ঠিক হবে? কিন্তু এখন ফেরার উপায় নেই। চরৈবেতি। তৈত্তীরীয় উপনিষদ কি? না বোধ হয়। শেরেহস্ত সর্বে পাপমান: শ্রমেণ প্রপথে হুতাঃ। যে ব্যক্তি শুধু চলতে থাকে, তার সব খুচরো পাপ আপনি স্খালন হয়ে যায়।
কাঠের ব্রীজটায় উঠে পড়ে আমার ভয় করে। যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। মৃত্যুপথযাত্রীর মত গোঙাচ্ছে অব্যক্ত ব্যথায়। যদি ভেঙে যায় নদীটার অন্ধকার আঁচলে কোন পাথরের বালিশ-বিছানায় শুয়ে থাকব জানি না। একবার অরিনের মুখ মনে পড়ে। আমার তিন বছরের ছেলে। বাবা অন্ত প্রাণ। আমার অমরত্ব। ওর মধ্যে দিয়ে তো আমি বেঁচে যাব মরে যাবার পরে। আমার আমির ফিক্সড ডিপোজিট ও। একবার রঞ্জনার মুখটাও মনে পড়ে। ওর বুকের বলটা হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে ঘুমোতে আমি ভালবাসি। আমি সাবধানে পা ফেলি। সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মত। ওপারে পৌঁছতেই দেখি একটা গ্রাম। চন্দ্রালোকে ভেসে যাচ্ছে। যেন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এখুনি। একটা লোক বসে বসে তালপাতা দিয়ে বাঁশি বানাচ্ছিল। ওকেই জিগেস করি আমি, এটা কোন জায়গা জানেন? এ গ্রামের নাম কী?
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটা পড়ি-কি-মরি করে ছুট লাগায়। যেন আমি পাগলা কুত্তা। এখুনি দাঁত বসাব। অদ্ভুত জায়গা বটে। ইলেকট্রিক তানপুরার যুগে তালপাতার বাঁশিও লোকে বানায়! পাগল। তার ওপর এমন পাগলাড্যাশের মত ব্যবহার! আমি আরো একটু এগোই। পুরো গ্রামটার মধ্যে একটা অদ্ভুত সুষমা। প্রতিটা বাড়ি, প্রতিটা লাগোয়া বাগান, প্রতিটা রাস্তার ধারের গাছ যেন একে অপরের অনুলিপি। খুব যত্ন করে কাটা বার্থ ডে কেকের টুকরোর যেমন একটা থেকে আর একটাকে আলাদা করা যায় না, সেরকম। কিন্তু আর একটা লোকেরও দেখা নেই। হালকা ফুরফুরে কিশোরীর মত হাওয়া বইছে। মন জুড়োচ্ছে। কিন্তু যে সাঁকোটা পেরিয়ে এসেছি সেটাকে আর লোকেট করতে পারছি না। নিশ্চয়ই পথ হারিয়েছি। সব কিছু এমন একে অপরের কপি যেন সময়ের ল্যাবিরিন্থ। পথ হারানো স্বাভাবিক। একটা কারুর দেখা পেলেই জিগেস করব। ভাগ্যিস জ্যোৎস্নালোকে সব ভেসে যাচ্ছে। নয়তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হত।
শেষমেশ পেলাম একটা মেয়ের দেখা। বয়স আঠেরো থেকে কুড়ির মধ্যে হবে। মেয়েদের বয়স গেস করার ব্যাপারে আমার ভুল হয় না খুব একটা। মেয়েটা পাহাড়ি ঝরনার মত ছিমছাম। নীল সালোয়ার পরেছে। লম্বা হাতওলা। আভরণ বলতে পায়ে নূপুর। হাত কান গলা খালি। শুধু ওড়নাটা দেখলাম কাপড়ের নয়। জলের তৈরি। যে নদীটা পেরিয়ে এসেছি, সেই নদীটাই ওর ওড়না হয়ে বুকের ওপর ছড়িয়ে আছে। চুল খোলা কিন্তু দুদিকের চুল নিয়ে এসে মাঝখানে ক্লিপ করা আছে। ঝুমকো ফুলের মত ক্লিপটা আলগোছে লেগে আছে চুলে। দু একটা সাহসী চুলের গাছি কানের লক্ষণরেখা পেরিয়ে গালের ওপর এসে পড়েছে। চোখের মধ্যে দীঘি আছে। মেয়েটা এক মনে প্রতিপদের চাঁদ দেখছিল।
আমি জিগেস করলাম, তোমার নাম কী?
যত্ন করে চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে আমার ভ্যান হুসেনের শার্টে চোখ রাখল। আমি আমার সাড়ে তিনহাজার টাকার শার্টের ছেঁড়া হাতাটা আড়াল করার চেষ্টা করি। কী ভাবছে কে জানে?
রাত্রিনদী পেরিয়ে এলে? জিগেস করল। ঠোঁট দুটো নড়ল বলে মনে হল না। কিন্তু শুনতে পেলাম মাথার ভিতরে।
হ্যাঁ। মানে একটা নদীর ওপরে কাঠের ব্রীজ পেরিয়ে এদিকে এলাম। দিনের বেলা দেখি নি।
দিনের মধ্যে আসলে নিজেকে জাহির করার লিপ্সা এত বেশি থাকে যে সব কিছু দেখা যায় না…
কিচ্ছু বুঝলাম না। মনের মধ্যে লিপ্সা কথাটা খানিক নাড়াচাড়া করলাম। মানেটা ঠিক মনে করতে পারলাম না। আমার কি লিপ্সা আছে? নাহ, ব্রীজটা কোনদিকে জেনে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ি।
তোমার নামটা কী? নদীটা কোন দিকে বলতে পার?
নাম? আমার তো নাম নেই। এই গ্রামেরও কোনো নাম নেই।
তা কী করে হয়? নাম তো একটা থাকতে হবে। যেমন আমার নাম…
পাহাড়ি ঝরনার মত মেয়েটা তার আঙুল রাখল আমার ঠোঁটে। মেয়েদের আঙুলের ছোঁয়া আগেও পেয়েছি। কিন্তু এই স্পর্শ পেয়ে মনে হল ওর আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলে গোবি মরুভূমি সহস্রবার মেঘালয় হতে পারে। ওর আঙুলের ছোঁয়ায় আমার সব কথা বন্ধ হয়ে গেল। আত্মগৌরবের লকলকে শিখায় কে জানি এক মগ জল ঢেলে দিল। আমার ভ্যান হুসেন প্রাইড গলে গলে পড়ছে। আমার নামটাও ঠিক মনে করতে পারলাম না।
নামই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। নিজের নামটা পৃথিবীর পাথর ফলকে লিখে দিতেই এত হানাহানি, এত ঈর্ষা, প্রতিহিংসা। সাঁকোর ওপারে তুমি তোমার নামটা ফেলে এসেছ। তুমি নিজেই যখন আছ, তখন তোমার নামের থাকার প্রয়োজনই বা কী! বলল পাহাড়ি ঝরনার মত মেয়েটা।
তারপর ফোঁটা ফোঁটা চাঁদ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। মেয়েটা ঝুরো ঝুরো হয়ে মিলিয়ে গেল। সাঁকোটা এইবার দেখা যাচ্ছে। আমি ফিরতি পথ ধরলাম। সাঁকোয় উঠেই পকেট থেকে বের করে জ্বলন্ত কয়লার মত দুটো শব্দ নিচের নিষিদ্ধ ক্ষতের মত নদীটাতে টুপ করে ফেলে দিলাম। দুটো শব্দ। হারামি মেয়েছেলে। আমার মুখে এখনও পাহাড়ি ঝরনার তর্জনী ছোঁয়ানো আছে। আমি তাই কথা বলতে পারছি না। রুহু নিশ্চয়ই এতক্ষণে চলে গেছে। কিন্তু আমার নামটা? সাঁকো পেরোলেই ভূতের মত আমার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো? আমার খুব ভয় করতে থাকে।