• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • রলাঁ বার্তের তত্ত্ব, দর্শন এবং হেঁয়ালি — অথবা তাঁর জীবনী : অংকুর সাহা


    || ১ ||

    ৯৮০ সালের মার্চ ২৬, ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ফ্রানসের এই শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীর। তিনি ছিলেন তাঁর অ্যাকাডেমিক কর্মজীবনের শিখরে--কলেজ দ্য ফ্রানসের সম্মানীয় অধ্যাপক। তাঁর বক্তৃতা শুনতে উপচে পড়ত প্রেক্ষাগৃহ--কেবল তাঁর ছাত্রছাত্রীরাই নয়, মফস্বল থেকে আসা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মাননীয় অধ্যাপকবৃন্দ, দেশবিদেশের ট্যুরিস্ট ও অন্যান্যরা। তাঁর রচিত মন্তব্যের কলাম সংবাদপত্রে বহুপঠিত ও জনপ্রিয়। তাঁর রচিত “প্রেম বিষয়ক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন নিবন্ধ” রূপান্তরিত হয়েছিল নাটকে এবং অভিনীত হচ্ছিল মঞ্চে।

    যে মানুষটা দেশে বিদেশে এমন বিখ্যাত ও জনপ্রিয়, সেই মানুষটা আসলে কী? প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু সহজ নয়। কোন কাজের কাজী তিনি, কোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ? উত্তরগুলো একাধিক, বিচিত্র এবং পরস্পরবিরোধী। তবুও চেষ্টা করে দেখা যাক।

    প্রথমত: বার্ত গঠনবাদ অথবা অবয়ববাদের বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ স্ট্রাকচারালিস্ট; খুব সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম ও প্রধান গঠনবাদী। গঠনবাদ কাকে বলে? এটা এমন এক তত্ত্ব যাতে ক্রিয়ার থেকে গঠন বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। যে কোনও সাংস্কৃতিক ঘটনাকে তিনি বৈজ্ঞানিক এবং প্রণালীবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেন। বার্ত গঠনবাদকে বর্ণনা করেছেন “সাহিত্যের বিজ্ঞান” বলে। ভাষাতত্ত্বের এই শাখার আরেক নাম ‘সেমিওলজি’ অর্থাৎ ‘প্রতীকবিজ্ঞান’।

    দ্বিতীয়ত: অনেক ভাষাতাত্ত্বিকের মতে বার্ত গঠনবাদের অন্তর্গত বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি আগ্রহী আনন্দবিলাসে অর্থাৎ গ্রন্থপাঠের আনন্দবিলাসে অর্থাৎ পাঠকের মেজাজ-মর্জি এবং স্বভাবপ্রকৃতি অনুযায়ী পাঠের আনন্দবিলাসে।

    অন্যভাবে বলতে গেলে বার্তের আগে সাহিত্য সমালোচনা ছিল লেখককেন্দ্রিক; লেখক কী বলতে পারেন অথবা বলতে চেয়েছেন, লেখক কী ভাবছেন--সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বার্ত পাঠককে নিয়ে এলেন সাহিত্য সমালোচনা কেন্দ্রে; তিনি এমন সাহিত্যের প্রচারেও সমর্থনে মগ্ন হলেন, যাতে পাঠকের ভূমিকা সক্রিয়, এমনকী সৃষ্টিশীল।

    তৃতীয়ত: বার্ত ছিলেন আধুনিক ফরাসি আভাঁ-গার্দ সাহিত্যের এক সক্রিয় প্রবক্তা। ১৯৫০-এর দশাব্দে আলাঁ রব-গ্রিয়ে (১৯২২-২০০৮) এবং “নুভো রোমাঁ” (“নতুন উপন্যাস”)-র অন্যান্য কর্মীদের রচনাগুলিকে যখন ফরাসি সমালোচকেরা পাঠের অযোগ্য (“না আছে চেনা যায় এমন প্লট, না রয়েছে কোনও হৃদয়গ্রাহী চরিত্র; কেবল এলোমেলো বর্ণনা অথবা চিন্তাস্রোত”) বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, বার্ত তখন কেবলমাত্র তাদের সক্রিয় সমর্থন ও প্রশংসাই করেন নি, রীতিমতো তাঁদের হয়ে লড়াই চালিয়েছেন।

    চতুর্থত: তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধ অথবা সাহিত্যতত্ত্বের রচনা কিন্তু আধুনিক সাহিত্যকে কেব্দ্র করে নয়, তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলেন ক্লাসিক ফরাসি লেখকেরা, জঁ ব্যাপতিস্ত রাসিন (১৬৩৯ - ১৬৯৯) এবং অনরে দ্য বালজাক (১৭৯৯ - ১৮৫০)। তাঁর গভীর ভালোবাসার বিষয় হ’ল “শাতোব্রিয়াঁ (১৭৬৮ - ১৮৪৮) থেকে শুরু করে মার্সেল প্রুস্ত (১৮৭১ - ১৯২২) পর্যন্ত ফরাসি সাহিত্য;” প্রুস্ত স্বভাবতই ছিলেন তাঁর পরমপ্রিয় লেখক। তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে ফিরে গেছেন ক্লাসিক ফরাসি সাহিত্যের আশ্রয়ে--নতুনভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাদের পাঠ ও আলোচনার।

    শেষত: বার্ত একটি নতুন ও বিখ্যাত তত্ত্বের প্রবক্তা, যাকে তিনি বলেন “গ্রন্থকারের মৃত্যু”--তিনি সাহিত্যতত্ত্ব এবং সমালোচনা সাহিত্য থেকে নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছিলেন গ্রন্থকারকে। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা লেখককে পড়ি না--পড়ি গ্রন্থের মূল ভাব অথবা ভাষ্যকে।

    সাহিত্য জগতের প্রধান ব্যক্তিত্বদের একটা নিজস্ব আইডেনটিটি রয়েছে--তাঁদের সম্যক বর্ণনা দেওয়া যায় একটি অথবা কয়েকটি বিশেষণে, যেমন: কামু--ঔপন্যাসিক, নাট্যকার; সার্ত্রে--দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব; কিন্তু বার্ত কী তা সংক্ষেপে বলতেই লেগে যায় পাঁচ পাঁচটি অনুচ্ছেদ--এখানেই তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর রহস্য; এখানেই লেখক হিসেবে তাঁর মহত্ত্ব।

    || ২ ||

    বার্তের কর্মজীবনের যে দ্বন্দ্ব ও পরস্পরবিরোধীতা তার উৎসটি লুকিয়ে রয়েছে তাঁর পারিবারিক বৃক্ষের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায়। তাঁর মাতামহ লুইস গুস্তাভ বিংগার (১৮৫৬-১৯৩৬) এক স্বনামধন্য ব্যক্তি; তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন আফ্রিকায় অনেকগুলি সামরিক অভিযাত্রায়, বিশেষ করে নাইজার নদীর উৎস সন্ধানে; আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে তাঁর নামে বিংগারভিল বন্দর (বর্তমানে আইভরি কোস্ট দেশটির অংশ)। ১৮৮৯ সালে ৩১ মার্চ আইফেল টাওয়ারের শুভ সূচনা উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি--সেখানে নোয়েমি লেপেত নামে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় এবং পরে বিবাহ। ১৮৯৩ সালে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান এনরিয়েতের জন্ম--তিনি বার্তের মা। পরিবারটি পূর্ব ফ্রানসের আলসাস অঞ্চলের; ধর্মে প্রটেস্টান্ট এবং রাজনীতিতে উপনিবেশবাদী। ১৯০০ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের পর নোয়েমি আবার বিয়ে করবেন সমাজবাদী দলের নেতা লুইস রেভেলিনকে--তিনি শান্তিকামী এবং উপনিবেশবিরোধী। ইনি বার্তের স্নেহময়ী দিদিমা, যাঁর প্রভাবে ও ছত্রছায়ায় কেটেছে তাঁর শৈশব।

    লুই বার্তের জন্ম মারমাদেঁ শহরে ২৮ ফেব্রুআরি ১৮৮৩। বাবা লিয়ঁ জোসেফ বার্ত ছিলেন মফস্বলে রেলের ইনসপেকটর; মা বার্তে দে লাপালু সাধারণ গৃহবধূ। স্বামীর নিয়মিত বদলির চাকরিতে ঘুরতে হতো শহর থেকে শহরে। ইনি (?? কে? এখানটা confusing লাগছে) বার্তের ঠাকুমা—আকাশপাতাল তফাৎ ঠাকুমা আর দিদিমার মধ্যে--অনেকদিন পরে বার্ত লিখবেন--“একজন অপরূপা সুন্দরী, পারী শহরের অভিজাত বাসিন্দা। অন্যজন মফস্বলের ভালোমানুষ, সচ্ছল কিন্তু ধনী বলা যাবে না--যদিও তাঁর পূর্বপুরুষেরা ধনী ছিলেন।” নোয়েমির দিন কাটতো অভিজাত মানুষের বিলাসবহুল অভ্যর্থনাকক্ষে; বার্তে দিন কাটাতেন হেঁসেলে। বার্ত পরে স্মৃতিচারণ করেছেন--ঠাকুমা বানাতেন নানা রকমের আচার, জ্যাম-জেলি এবং পেসট্রি। পরিবারটি দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রানসের ধর্মভীরু, গোঁড়া ক্যাথলিক।

    বালক লুই-এর ছিল ক-অক্ষর গোমাংস এবং মাঝপথ ইস্কুলের পড়া ছেড়ে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দিলেন ফরাসি নৌবাহিনীতে। ট্রেনিং সমাপ্ত করে উনিশ বছর বয়েসে ‘আমিরাল কুরবে’ যুদ্ধজাহাজে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। দশ বছর কাজ করার পরে তিনি লেফটেন্যান্টের পদে উন্নীত হন। কাজের সূত্রে তাঁকে বারবার আতলান্তিক মহাসাগর পেরিয়ে কানাডার কুইবেক প্রদেশে আসতে হ’ত। ইতোমধ্যে এনরিয়েতের দাদা ফেলিপে ভাগ্যান্বেষণে কানাডাতে এসেছেন। ১৯১৩ সালে বিশ বছর বয়েসি এনরিয়েতে দাদার কাছে বেড়াতে গেলেন কানাডায়; জাহাজে তাঁর সঙ্গে পরিচয় তিরিশ বছর বয়েসি লুই বার্তের--প্রথম দর্শনেই প্রেম এবং ফ্রানসে ফিরেই বিবাহ। বিয়েতে নোয়েমির প্রবল আপত্তি--জামাতার না রয়েছে বংশমর্যাদা আর মাইনেপত্তরও তথৈবচ! পরের বছরই ইয়োরোপে বাধলো তুমুল যুদ্ধ; যুদ্ধ চলাকালীনই ১২ নভেম্বর ১৯১৫ রলাঁ জেরার বার্তের জন্ম। বাবা লুই তখন ‘মতেঁন’ নামক পেট্রোল বোটের নেতৃত্বে--টহল দিচ্ছেন উত্তর মহাসাগর। ২৭ অক্টোবর ১৯১৬, পাঁচটি জার্মান ডেস্ট্রয়ার সমবেতভাবে আক্রমণ করল তাঁর নৌকাটিকে। বীরের মতন যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করলেন লুই। মরণোত্তর বীরত্বের পুরস্কার তাঁকে দিয়েছিল ফরাসি সরকার। শিশু রলাঁ যখন পিতৃহীন হলেন তখন তাঁর বয়েস এক বছর পূর্ণ হতে ১৬ দিন বাকি।

    বার্তের পিতার পেট্রোল বোটের নামকরণ ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক মিশেল দে মঁতেন (১৫৩৩-১৫৯২) এর নামে। মঁতেন আধুনিক প্রবন্ধসাহিত্যের জনক। চার দশক পরে বার্তের গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হবেন মঁতেন এবং তিনি হয়ে উঠবেন বিংশ শতাব্দীর মননশীল প্রবন্ধসাহিত্যের এক মহীরুহ। কী অপরূপ এই সমাপতন?

    || ৩ ||

    লুই-এর মৃত্যুর পরে তেইশে বিধবা মেয়ে এনরিয়েতে শিশুপুত্রকে নিয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে, দক্ষিণ ফ্রানসের বেয়ন শহরে। শহরটি আদু এবং নিভে নদীর সঙ্গমস্থলে এবং পারী শহর থেকে পনেরো ঘন্টার ট্রেন দূরত্বে। তিনি নিজের মা নোয়েমির কাছে গেলেন না--মা-মেয়ের সম্পর্ক তখন সুখের ছিল না। বার্ত ও তাঁর মা একটি ছোটো বাড়ি ভাড়া নিলেন মারাক মহল্লায়--খুব কাছেই ঠাকুমা বার্তে আর পিসি অ্যালিসের বাড়ি--সেখানেই তাঁর দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত। শৈশবের স্মৃতি থেকে তিনি পরবর্তী জীবনে মন্তব্য করবেন--বেয়ন শহরটি নড়াচড়া করে, অনবরত কথা বলে, শোঁকা যায় তার গায়ের গন্ধ। পিসি অ্যালিস ছিলেন পিয়ানো-শিক্ষিকা, তাঁর কাছে খুব অল্প বয়েসেই তিনি পিয়ানো বাজাতে শেখেন--বেশি বয়েসেও তিনি সময় পেলেই পিয়ানো বাজাতেন।

    তাঁর শৈশবের গভীরতম অনুভূতি ছিল এক দিগন্তজোড়া অনীহা আর বিতৃষ্ণা সেই অনুভূতিও থেকে যাবে বাকি জীবন। অনেক বছর পরে তিনি একটি চিঠিতে লিখবেন, “As a child, I was often and intensely bored. Might boredom be my form of hysteria?” এখানে বলে রাখা ভালো যে “হিস্টিরিয়া” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ “হুসটেরা” থেকে, যার অর্থ “জরায়ু”। এই শব্দটি তাঁর লেখায় আর বক্তৃতায় ফিরে ফিরে আসবে।

    তিন নারীর শাসনে আর সোহাগে কাটবে তাঁর শৈশব। যে মাঠে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে খেলতেন তার কাছেই চলছিল এক অট্টালিকার নির্মাণ--সেখানে কাজ করত কুলি-কামিন-রাজমিস্ত্রিরা। একবার তিনি সেখানে এক গর্তে পড়ে যান পা পিছলে--বন্ধুরা তাকে ওপরে উঠতে সাহায্য করে না, বরং হাসাহাসি করে তাঁকে নিয়ে। মা খবর পেয়ে ছুটে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন এবং কোলে করে বাড়ি নিয়ে যান।

    ১৯২৪ সালের জুন মাসে তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া সমাপ্ত হবার পরে মাও সন্তান বেয়ন শহর ছাড়লেন। ওই একই সময়ে শহরে দুই বিখ্যাত লেখক--জন দোস পাসোস (১৮৯৬ - ১৯৭০) এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮১৯-১৯৬১)--পাম্পলোনায় ফিয়েস্তাতে যাওয়ার পথে। হেমিংওয়ের “আবার সূর্য ওঠে” উপন্যাসে রয়েছে বেয়ন শহরের বর্ণনা “Bayonne is a nice town. It is like a very clean Spanish town and it is on a big river. Already, so early in the morning, it was very hot on the bridge across the river. We worked out on the bridge and then took a walk through the town. We went into the street and took a look at the cathedral.”

    || ৪ ||

    ১৯২৪ সালে পারী শহরে এসে বার্ত লিসি মঁতেন স্কুলে লেখাপড়া শুরু করলেন। স্কুলটি লুকসেমবর্গ উদ্যানের পিছনে--দিনে চারবার তাঁকে যেতে হত এই পার্কের মধ্যে দিয়ে এবং সেটি হয়ে উঠল তাঁর প্রিয় খেলার জায়গা। ছ’বছর এই স্কুলে লেখাপড়া করেছেন তিনি, মা-ছেলে বাস করেছেন কমদামী ফ্ল্যাটে, ছুটিতে বেড়াতে গেছেন ঠাকুমা আর পিসির কাছে বেয়ন শহরে। সেখানে থাকাকালীন এনরিয়েতের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা আন্‌দ্রে সালজাদো নামে এক শিল্পীর সঙ্গে যার কাজ মূলত চিনামাটি নিয়ে। ১৯২৭ সালে ৩৪ বছর বয়েসে এনরিয়েতে জন্ম দিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মিশেল সালজাদোর--বার্তের থেকে এক দশক বেশি ছোটো বৈপিত্রেয় ভাই-এর। সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে তিনি পারী শহরের ফ্ল্যাটে ফিরে এলেন। আগেই বলেছি যে বার্তের দিদিমা নোয়েমি পুনর্বিবাহ করেন ১৯০০ সালে। তাঁদের একটি পুত্রসন্তানও হয় যিনি বার্তের সমবয়েসি। ধীরে ধীরে মা ও মেয়ের মধ্যে কলহ জমে ওঠে। নোয়েমি বাস করতেন পারীর অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে, সেখানে গল্প করতে আসতেন বিখ্যাত মানুষেরা। মেয়ে এনরিয়েতে থাকতেন সিকি মাইল দূরে নিম্নমধ্যবিত্তদের এলাকায়--মৃত সৈনিকের বিধবা হিসেবে তাঁর প্রাপ্য পেনশানে সংসার চলত না বলে তিনি বই বাঁধাইয়ের চাকরি নিলেন। প্রথম দিকে মা-মেয়ের সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল না, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ়া মায়ের ঈর্ষা বাড়তে লাগলো যুবতী ও সুন্দরী কন্যার প্রতি। অন্যদিকে নাতি রলাঁ লেখাপড়ায় চৌকশ, দ্রুতগতিতে ছাড়িয়ে যেতে লাগলেন দিদিমার দ্বিতীয়পক্ষের পুত্রকে এবং তার ফলে মা-মেয়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। রলাঁকে ছেড়ে দিদিমার স্নেহগিয়ে পড়ল তাঁর বৈপিত্রেয় ভাই মিশেলের ওপর। ওদিকে বেয়ন শহরে তাঁর ঠাকুমা ও পিসি অব্যাহত রাখলেন তাঁদের স্নেহ ও আশীর্বাদ, কিন্তু তাঁরা আবার এনরিয়েতের ওপর বীতরাগ প্রকাশ করলেন তাঁর দ্বিতীয়বার বিবাহের জন্যে। এইসব কারণে তাঁর পারিবারিক জীবনে ছিল সম্পর্কের জটিলতা এবং দারিদ্র (তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন অল্পবয়েসে মুদির দোকানে ধারে বাজার করার লজ্জার কথা), কিন্তু তাঁর ছাত্রজীবন হয়ে উঠল উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। ১৯৩৩ সালের গ্রীষ্মে তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করলেন নানান পুরস্কার ও জলপানি সমেত। ওই একই বছরে তিনি চেষ্টা করবেন একটি উপন্যাস লেখার এবং প্রেমে পড়বেন এলেন মানোরি নামে এক কিশোরীর সঙ্গে--দুটি ক্ষেত্রেই ভীষণভাবে ব্যর্থ হবেন তিনি। দেশের রাজনৈতিক জীবনেও ঝড়ের আশংকা--রাইন নদীর ওপারে জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করেছে হিটলারের নাৎসি পার্টি।

    ১৯৩৪ সালের মে মাসে তিনি ফুসফুসের ক্ষয়রোগে ক্রান্ত হলেন এবং ডাক্তারের নির্দেশে তাঁকে বেয়ন শহরে যেতে হ’ল বিশ্রামের জন্যে। লেখাপড়ায় সাময়িক ছেদ পড়লেও বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি চালিয়ে গেলেন তাঁর নিজস্ব পাঠ--মূলত: সাহিত্য এবং সাহিত্যের আলোচনা। দ্বিতীয় একটি উপন্যাসেরও আইডিয়া এল মাথায়--যদিও সেটা লেখা হয়ে উঠল না শেষ পর্যন্ত। এই অসুখের প্রকোপ তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপনকে প্রতিহত করবে পরবর্তী এক দশক। আপাতত তাঁকে স্বাস্থ্যের উদ্ধারে পাঠিয়ে দেওয়া হল পিরেনিস পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি গ্রামে।

    ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯। এই চার বছর তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সঙ্গে লেখাপড়া করলেন এবং ধ্রুপদী সাহিত্যে বি. এ. ডিগ্রি পেলেন। কিন্তু তার মধ্যেই যক্ষ্মারোগের আসাযাওয়া, তাঁকে বার বার যেতে হয় স্যানাটোরিয়ামে, সময়মত বসতে পারেন না বাধ্যতামূলক পরীক্ষায়। অসুস্থতার কারণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকেও তাঁর অব্যাহতি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে সাহিত্যের শিক্ষকতা করবেন।

    ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুদ্ধ বাধল। পরের মাসে তিনি অস্থায়ী শিক্ষকের চাকরি পেলেন বিয়ারিত্‌স নামে এক মফস্বল শহরে; শহরটি বেয়ন থেকে খুব দূরে নয় এবং তিনি নিয়মিত দেখা করতে পারবেন ঠাকুমা আর পিসির সঙ্গে। ঠাকুমার বয়েস তখান পঁচাশি, তাঁর মৃত্যু ঘটবে ১৯৪১ সালে। মা আর ভাইও গেল তাঁর সঙ্গে; মা নতুন চাকরি নিলেন বিয়ারিত্‌সের এক মিলিটারি হাসপাতালে। জায়গা বদল হলেও ক্ষয়রোগ তাঁর সঙ্গে রইল। ১৯৪০ সালে যুদ্ধে ফ্রানসের পরাজয়ের পর তিনি ফিরে এলেন প্যারিসে--সেখানে বছরখানেক শিক্ষকতা করার পরে অসুখ বাড়ল—১৯৪২-এর শুরুতে তিনি ভর্তি হলেন তুভে গ্রামের এক স্যানাটোরিয়ামে। সেখানে রোগীরা সবাই ছাত্র অথবা শিক্ষক--খুব ভালো লেগে গেল জায়গাটা তাঁর। অনেকদিন পরে তিনি মন্তব্য করবেন--ক্ষয়রোগীদের সারা জীবন স্যানাটোরিয়ামে কাটানো উচিত। তুভের স্যানাটোরিয়াম প্রকাশিত পত্রিকায় তিনি লিখতে থাকেন নিয়মিত তাঁর গ্রিস ভ্রমণের কাহিনি, আন্‌দ্রে জিদ আর আলব্যের কামুর রচিত গ্রন্থের পাঠপ্রতিক্রিয়া।

    যুদ্ধের বছরগুলিতে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. ডিগ্রি করলেন এবং কলেজে সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে অধ্যাপনার লাইসেন্স পেলেন। যুদ্ধের পরে শুরু হল কর্মজীবন--ফ্রানসে, রোমেনিয়ায়, মিশরে স্বল্পকালীন অধ্যাপনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ট্র্যাজেডি--সেই এবং অনান্য বিষয়ে তিনি লিখতে লাগলেন মননশীল প্রবন্ধ।

    ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাতসি বিরোধী ফরাসী সংবাদপত্র “কমবা” (Combat)-এর। তাঁর সমর্থক ও সম্পাদক আলব্যের কামু। বার্ত সেখানে লিখতে লাগলেন বামপন্থী রাজনীতি ও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রেমে পড়লেন দুই যুবকের সঙ্গে--দুজনেই ক্ষয়রোগী--প্রথমে মিশেল দেলাক্রোয়া এবং তাঁর অকালমৃত্যুর পরে রবার্ট ডেভিড। ১৯৪০-এর দশাব্দে যখন শেষ হয়ে এল, এই উত্তরতিরিশ যুবক তখনও ভবঘুরে।

    || ৫ ||

    ১৯৪০-এর দশাব্দের দ্বিতীয় পর্বে বামপন্থী “কমবা” সাময়িকপত্রে মূলত: আলব্যের কামুর প্রণোদনায় বার্ত নানান বিষয়ে লিখতে লাগলেন নিয়মিত। তাঁর গভীর সাহিত্য-আলোচনার প্রবন্ধগুলি নিয়ে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হ’ল প্রথম গ্রন্থ “শূন্য ডিগ্রির সাহিত্য”; ১৯৬৭ সালে গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করবেন অ্যানেট লেভার্স এবং কলিন স্মিথ--লনডন থেকে প্রকাশিত হবে “Writing Degree Zero।”. লেখকের নিজের মতে--সাহিত্যের সত্যিকারের ইতিহাস যে-রকমটি হওয়া উচিত, তাঁর এই গ্রন্থটি সেই ইতিহাসের ভূমিকা মাত্র। বইটি প্রকাশের পরে বার্ত গেলেন হল্যান্ডে ছুটি কাটাতে, কিন্তু দিদিমা নোয়েমির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হল প্যারিসে। যদিও উত্তরাধিকার নিয়ে ঝক্কিঝামেলা চলবে দু-বছর, তাঁর মা হাতে পাবেন প্যারিসের একটি ফ্ল্যাট এবং বড়ো মাপের নগদ টাকা--যাতে তাঁদের আর্থিক অবস্থার সুরাহা হবে।

    লেখকের মুখবন্ধের পরে বইটি দুই পর্বে বিভক্ত; প্রথম পর্বে চারটি ছোটো প্রবন্ধ--সেখানে তিনি “সাহিত্যকর্ম” অথবা মতবাদটিকে “শৈলী” অথবা “ভাষা”র থেকে খানিকটা আলাদ করে দেখতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় পর্বের দীর্ঘতর প্রবন্ধগুলিতে আধুনিক সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে। সময়াময়িক বাস্তববাদী, সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট লেখকদের বিপ্লবী ধ্যানধারণাগুলি যে তাঁদের সাহিত্যে প্রতিফলিত হচ্ছে না, তার প্রধান কারণ তাঁরা প্রথাগত সাহিত্যের রূপক ও অলংকারের নিগড় ভেঙে বেরিয়ে আসতে অক্ষম।

    যদিও চল্লিশ ছুঁই ছুঁই অনামী লেখকের একটি প্রথম গ্রন্থ এটি, সমালোচকেরা কিন্তু বিরূপ হলেন না বইটির প্রতি। মরিস নেদ্যু, যাঁকে তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন, তিনি ৮-পৃষ্ঠার একটি পাঠপ্রতিক্রিয়ায় জানালেন, “We must congratulate the author on what is a remarkable debut. It heralds an essayist who stands head and shoulders above his contemporaries.” এমনকী জনপিয় লা মঁদ সংবাদপত্রেও দমিনিক আরবান স্বাগত জানালেন এই তরুণ লেখককে--“This little book has come exactly at the right time; infact it is astonishing that it has not appeared sooner.”

    যেসব লেখকেরা বর্ণহীন সাহিত্যের সৃষ্টি করেন, পূর্বনির্ধারিত কোনও ভাষার অথবা শৈলীর বন্ধনকে মানেন না, তাঁরাই বার্তের মতে প্রকৃত লেখক; অন্য লেখকেরা তাঁদের ভাবনায় বিপ্লবী, কিন্তু লিখতে গিয়ে প্রথাসিদ্ধ ভালোমানুষির ফাঁদে পড়েন। আলব্যের কামুই হলেন একজন লেখক যিনি ভাষাকে তার নিজস্ব স্বচ্ছতা দিতে পারেন, বিশেষ করে ১৯৪২ সালে প্রকাশিত “অচেনা” উপন্যাসে তিনি ঘোষণা করলেন যে আধুনিক উপন্যাস বুর্জোয়াদের সৃষ্টি এবং মার্কসবাদী বিপ্লব ঘটলে ধ্বংস হবেন বুর্জোয়ারা এবং সেই সঙ্গে হবে উপন্যাসের মৃত্যু।

    ১৯৬৭ সালে লন্ডনের জোনাথন কেপ প্রকাশনা বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন, কিন্তু লেভার্স এবং স্মিথের অনুবাদপ্রণালী নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে। জাক এবেয়ার নামে এক ফরাসি সাংবাদিক (১৭৫৭-১৭৯৪) ফরাসি বিপ্লবের সমসময়ে “লা পের দুশেঁ” (“বুড়ো হাবড়া দুশেঁ”) নামে এক চরমপন্থী সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন এবং তাতে শত্রুদের অশ্লীল গালাগালি দেওয়া ছিল তাঁর নিয়মিত অভ্যেস। বার্ত একটি প্রবন্ধে লেখেন, “এবেয়ার তাঁর লা পের দুশেঁর কোনও সংখ্যাই শুরু করতেন না দুয়েক জনকে ‘চুতমারানি’ অথবা ‘পোঁদমারানি’ আখ্যা না দিয়ে।” মূল যে ফরাসি শব্দযুগল ব্যবহৃত হয়েছিল--‘foutre’ এবং ‘bougre’--তাদের ইংরেজি করলে দাঁড়াবে “fucks” এবং “buggers”--কিন্তু ইংরেজি অনুবাদকেরা তার অনুবাদ করলেন “যেখানে সেখানে কয়েকটি অশ্লীল শব্দ ছড়িয়ে দিয়ে।” এটা অন্যায় এবং ইংরেজি পাঠকের হতাশার কারণ যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বের সাহিত্য পড়তে নির্ভর করেন ইংরেজি ভাষার ওপরে।

    তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে অনেক সময়েই সহমত হওয়া মুশকিল, কিন্তু তাঁর প্রথম বইটিই আলোড়ন তোলে ফরাসি বুদ্ধিজীবী মহলে; দুর্বোধ্য এবং দুরূহ, কিন্তু সেই সঙ্গে গভীর চিন্তাভাবনার প্রকাশ। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত মার্কিন সংস্করণের ভূমিকা লেখেন সুসান সনট্যাগ (১৯৩৩ - ২০০৪) যাতে পাঠকের সুবিধে হয় অনূদিত প্রবন্ধগুলির অনুধাবনে। গ্রন্থের সমাপ্তি বার্তের নিজস্ব ইউটোপিয় চিন্তাভাবনায়--Feeling permanantly guilty about its own solitude it is none the less an imagination eagerly designing a felicity of words, it hastens towards a dreamed-of language whose freshness, by a kind of ideal anticipitaion, might portray the perfection of some Adamic World where language will no longer be alienated.” তিনি ফিরে যেতে চান সাহিত্যের স্বর্গোদ্যানে আদম-এর জগতে।

    || ৬ ||

    ১৯৫৩ সালে মরিস নেদ্যু (১৯১১-২০১৩) প্রতিষ্ঠা করলেন “নতুন সাহিত্য” (“লে লেত্রেস নুভেলস”) নামে এক পাক্ষিকপত্রের--সেখানে বার্তের লেখার নিয়মিত বিষয় “পপুলার কালচার” এবং তার সম্পর্কে নানান ভ্রান্ত ধারণা। আধুনিক “মিথ” (“Myth”) কীভাবে গড়ে ওঠে সেই নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন বার্ত এবং সেখান থেকেই প্রতীকবিজ্ঞান অথবা সেমিওলজির জগতে তাঁর প্রথম পা রাখা। এই সাময়িকপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধগুলির নির্বাচিত সংকলন “মিথোলজিস” (“Mythologies”) নামে গ্রন্থাকারে বেরোয় ১৯৫৭ সালে। অ্যানেট লেভার্স-এর অনুবাদে ইংরেজি সংস্করণ ১৯৭২ সালে। ৫৩টি ছোটো ছোটো নিবন্ধ, সব মিলিয়ে ১৬০ পৃষ্ঠার গ্রন্থ। প্রথম দিকে ভালো সংখ্যায় বিক্রি হয়নি বইটি, ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তা বাড়ে। এখনও ষাট বছর পরে গ্রন্থটির সংস্করণের পর সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে চলে, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তার অনুবাদ ঘটে। গ্রন্থটি কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় এক গঠনবাদী ‘মিথ’।

    যদিও বার্ত ইংরেজি ভাষায় দক্ষ ছিলেন না, তিনি আমেরিকার ভারমন্ট রাজ্যের মিডলটন কলেজে অস্থায়ী অধ্যাপকের চাকরি নেন। সেই গ্রীষ্মে তাঁর সঙ্গে পরিচয় মার্কিন কবি রিচার্ড হাওয়ার্ডের (১৯২৯--), যিনি ভবিষ্যতে বার্তের রচনার প্রধান ইংরেজি অনুবাদক হবেন। “মিথোলজিম” গ্রন্থের সাম্প্রতিকতম ইংরেজি অনুবাদটি যৌথভাবে করেছেন হাওয়ার্ড এবং অ্যানেট লেভার্স--প্রকাশ ২০১২ সালে।

    গ্রন্থটি দুই পর্বে বিভক্ত: প্রথম পর্বের নাম “মিথোলজিস”--আধুনিক মিথের ওপরে একগুচ্ছ নির্বাচিত প্রবন্ধ; দ্বিতীয় পর্বের নাম “আজকের মিথ”--তাতে একটি প্রবন্ধে বার্ত আলোচনা করেছেন পেশাদারী কুস্তির মিথ নিয়ে। তিনি বর্ণনা করেছেন মুষ্টিযুদ্ধ এবং পেশাদারী কুস্তির পার্থক্য। মুষ্টিযুদ্ধ একটি ক্রীড়া--সেখানে প্রতিযোগীরা তাঁদের ক্ষমতা, প্রতিভা এবং দক্ষতা অনুযায়ী জেতেন অথবা হারেন। কিন্তু পেশাদারী কুস্তিতে না পাওয়া যায় দক্ষতার পরিচয় এবং না পাওয়া যায় জয়-পরাজয় নিয়ে উন্মাদনা। দর্শকরা সেখানে যান অতিনাটকীয় যাত্রাপালা দেখতে--শুভর সঙ্গে অশুভের লড়াই; একজন নায়ক, অন্যজন খলনায়ক; একজন ধার্মিক অন্যজন অধার্মিক; দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। পেশাদারী কুস্তির প্রতিযোগীরা এক মূকাভিনয় অথবা ভাঁড়ামির অংশগ্রহণকারী চরিত্র--প্রত্যেকে এক একটি পরিবর্তিত স্টিরিওটাইপ--সবকিছুর পিছনে রয়েছে দর্শক ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন।

    গ্রন্থটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান তার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পটভূমি। সুখের মুখ দেখেছে; অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছে লোকজনদের জীবনযাত্রার উন্নতি। কিন্তু রাজনীতির জগতে সংকটের পর সংকট। প্রায় একদশক যুদ্ধের পর ১৯৫৪ সালে ফ্রান্‌সকে পালিয়ে আসতে হয়েছে ভিয়েতনাম ছেড়ে। উপনিবেশ বজায় রাখতে সামরিক শক্তি নিয়োগ করতে হয়েছে আলজিরিয়ায়--সেখানেও ফ্রানসের পরাজয় ঘটবে--আলজিরিয়া স্বাধীন হবে ১৯৬২ সালে। বাম থেকে দক্ষিণ, ফ্রানসের সব রাজনৈতিক দলই তার পৃথিবীজোড়া সাম্রাজ্য বজায় রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু বার্ত এবং ফ্রানসের একদল তরুণ বুদ্ধিজীবী তখন থেকেই বিরামহীনভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। গ্রন্থের একটি নিবন্ধের নাম “আফ্রিকার ব্যকরণ”--সেখানে ফরাসি প্রেস কীভাবে প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে তার সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক--সেই মুখোশ খুলে দেন লেখক।

    আরও নানান বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন সংক্ষেপে--গ্রেটা গার্বোর সুন্দর মুখ, চার্লি চ্যাপলিনের ছবি, সিট্রোন গাড়ি, আইনস্টাইনের মগজ, ইত্যাদি, ইত্যাদি। একটি নিবন্ধের বিষয় ফরাসি জীবনযাত্রায় লাল মদের প্রভাব--ধনী থেকে দরিদ্র, সবাই পছন্দ করে এই পানীয়। যদিও লাল মদ স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, বিজ্ঞাপনে তাকে দেখানো হয় স্বাস্থ্যকর ও ক্লান্তি-অপনোদনকারী পানীয় হিসেবে। বিজ্ঞাপনের এমনই মহিমা যে শীতকালে লাল মদ মানুষকে উষ্ণতা দিতে সক্ষম; আবার গ্রীষ্মকালে একই লাল মদের সঙ্গে দেখা যায় ছায়াঘন শীতলতা ও প্রাণের আরাম। এই মদ বানানোর জন্যেই আলজিরিয়ার ভূমিজ মানুষদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে যেখানে সাম্রাজ্যবাদীরা করে থাকে আঙুরের চাষ; সাধারণ মানুষেরা সেখানে ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। সাম্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশবাদের তীব্র বিরোধিতা এই গ্রন্থের এক সম্পদ।

    || ৭ ||

    ১৯৬০ এর দশাব্দে তিনি অবয়ববাদ এবং প্রতীকবিজ্ঞানের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন নেতৃস্থানীয় তাত্ত্বিক হিসেবে, অধ্যাপনা করলেন ফ্রানসের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং রচনা করলেন সুদীর্ঘ সব সন্দর্ভ। কলহ বাধল সাহিত্য সমালোচনার প্রথাসিদ্ধ অ্যাকাডেমিকদের দিক থেকে। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জাঁ রাসিন বিশেষজ্ঞ রেমোঁ পিকার (১৯১৭-১৯৭৫) বার্তকে আক্রমণ করে পুরো একটা বই লিখলেন, “নতুন সমালোচনা অথবা নতুন ভাঁওতা”--তাঁর মতে, “Barthes was the instrument of a criticism that operates by instinct.”

    তিনি কপটবিজ্ঞানের নানান শব্দসমষ্টির ব্যবহারে বিভ্রান্ত করেন পাঠককে; জীববিদ্যা, মনোবিজ্ঞান অথবা দর্শনশাস্ত্রের প্রসঙ্গ এনে উপস্থাপিত করেন অপটু এবং উদ্ভট তত্ত্ব। পিকারের যুক্তিগুলো খণ্ডন করে ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হল বার্তের নতুন সন্দর্ভ “সমালোচনা এবং সত্য”; ১৯৮৭ সালে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করলেন কাট্রিন পিলচার কুনেমান “Criticism and Truth” নামে। তিনি প্রথাসিদ্ধ সাহিত্য সমালোচনাকে “বুর্জোয়া সমালোচনা” আখ্যা দিলেন এবং মার্কসবাদ ও অন্যান্য নতুন তত্ত্বের আলোকে অ্যাকাডেমিকদের উদ্বুদ্ধ করতে চাইলেন। “To write is not to enter into an easy relationship with an average of all possible readers, it is to enter into a difficult relationship with our own language.”

    এই গ্রন্থটি প্রকাশের পরে তাঁর খ্যাতি প্রসারিত হল দেশের বাইরেও। তিনি অধ্যাপনার সাদর আমন্ত্রণ পেলেন বিভিন্ন দেশ থেকে--গেলেন মরক্কো, জাপান এবং আমেরিকার জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৬৭ সালে তাঁর কালজয়ী প্রবন্ধ “গ্রন্থকারের মৃত্যু” এর প্রকাশ--উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের এক প্রধান স্তম্ভ এই রচনা। যে-কোনো গ্রন্থের আলোচনার সময়ে তার গ্রন্থকার সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক--তিনি সাদা অথবা কালো, পুরুষ অথবা নারী, ধার্মিক অথবা নাস্তিক--গ্রন্থের ভাষ্য রচনায় তাঁর কোনো অবদান থাকবে না। এই তত্ত্বের প্রবল বিরোধীর সংখ্যাও অনেক। শন বার্ক (১৯৬১--) একজন আইরিশ লেখক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন; বার্তের এই প্রবন্ধের বিরোধিতায় তিনি একটি দুশো পাতার বই লিখেছিলেন ১৯৯২ সালে--“গ্রন্থকারের মৃত্যু এবং প্রত্যাবর্তন”; সম্প্রতি সেই বইটির পরিবর্তিত সংস্করণ বেরিয়েছে--“The Death and Return of the Author criticism and subjectivity in Barthes, Foucault and Derrida”--এডিনবরা ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত বইটি ৩১২ পৃষ্ঠার। এই বিতর্ক এখনই থামবে বলে মনে হয় না।

    || ৮ ||

    ১৯৬০ সালে বার্তের নবীন বান্ধব লেখক, সমালোচক ফেলিপে সোলার্স (১৯৩৬--) “তেল কেল” (“যেমন চলছে”) নামে একটি নতুন আভাঁ-গার্দ অতিবামপন্থী পত্রিকার সূচনা করলেন--সাহিত্যতত্ত্বের নানা দিক নিয়ে মার্কসবাদের আলোকে সেখানে আলোচনা--বার্তও যোগ দিলেন তাতে। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ ছিল এই সাময়িকপত্র--বার্ত নীতগতভাবে বামপন্থী কিন্তু কোনোদিন পার্টির সদস্যপদ নেননি। কিন্তু বন্ধুর সম্পাদিত এই সাহিত্যপত্রের তিনি হলেন নিয়মিত লেখক।

    ধ্রুপদী ফরাসি সাহিত্যিক অনরে দ্য বালজাক (১৯৯৯-১৮৫০)-এর ১৮৩০ সালে প্রকাশিত একটি প্রায় অপরিচিত বড়গল্প অথবা নভেলার, নাম “সারাসিন”, ৩২ পৃষ্ঠার এই লেখাটি পরে সংকলিত হয়েছিল তাঁর “প্যারিসের জীবনযাত্রার গল্পমালা” গ্রন্থে। ‘তেল কেল’ কাগজে বার্ত এই নভেলার নিবিড় পাঠ এবং তার গভীর গঠনবাদী বিশ্লেষণ নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন। ১৯৭০ সালে সেগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল “S/Z” নামে--অনেকের মতে এটি তাঁর গভীরতম এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর গ্রন্থ--৩২ পৃষ্ঠার গল্পের ২৭১ পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনা বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতন।

    বার্ত করেছেন বালজাকের গল্পটির ঘন, নিবিড়তম পাঠ; শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চালিয়েছেন তার গঠনবাদী বিশ্লেষণ এবং তার টুকরো অংশের ভাষা, শৈলী, বাস্তবতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ন্যারেটিভ নিয়ে আলোচনা। বার্থের বিশ্লেষণগুলি মূলত: সুইস ভাষাতত্ত্ববিদ ফার্দিনান্দ দ্য স্যসুর (১৮৫৭-১৯১৩)-এর গঠনবাদী ভাষাতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত।

    বার্ত পাঁচটি সাংকেতিক বার্তা অথবা কোড (code)-এর সাহায্য নিয়ে একটি সমন্বিত বিন্যাস অথবা নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছেন যার সাহায্যে গড়ে উঠবে এক অর্হবহুল পরিসর (meaningful space) যার মধ্য দিয়ে বয়ে যাবে কাহিনির ভাষ্য:

    ১। হারমেনিউটিক কোড--সংক্ষেপে HER, যার মধ্যে থাকবে পাঠ্যাংশের সমস্ত রকমের রহস্য এবং ধাঁধা--সেই ধাঁধার সমাধান হতেও পারে আবার না হতেও পারে। তার মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে হরেক রকমের বিলম্ব এবং বাধাবিঘ্ন; সবশেষে উন্মোচিত হবে পুরো সত্যি অথবা আংশিক সত্যি।

    ২। প্রোএয়ারেটিক কোড--সংক্ষেপে ACT, যা এগিয়ে নিয়ে চলে পাঠ্যাংশের বর্ণনার গতি--একসঙ্গে জড়ানো অনেকগুলি ঘটনাক্রমের মাধ্যমে। যদি কাহিনিতে থাকে যে একটা মানুষ ঘুমোচ্ছে, তার মানে পাঠক আশা করবেন যে সে জেগে উঠবে ভবিষ্যতে কোনো সময়।

    ৩। সেমানটিক কোড--সংক্ষেপে SEM, যার মধ্যে ভাষ্যের অনুরণন। একটা শব্দের যে আক্ষরিক অর্থ তাকে পেরিয়ে তার সঙ্গে নতুন কিছু ব্যঞ্জনা যুক্ত করা যেতে পারে। এই নতুন ব্যঞ্জনাগুলি হতে পারে অস্থির, আবছা এবং কাহিনির গতির সঙ্গে পরিবর্তনশীল। যদি কাহিনিতে উল্লেখ থাকে ককটেল পার্টি, অথবা বিশাল প্রাসাদ অথবা ফাউবুর্গের (যার অর্থ বর্ধিষ্ণু শহরতলী), তাহলে বোঝা যাবে যে মানুষটির কথা বলা হচ্ছে তিনি অমিত বিত্তশালী।

    ৪। সিমবলিক কোড--সংক্ষেপে SYM--যার মধ্যে অর্থগুলির উল্লেখ থাকবে সরাসরি নয়, কিন্তু প্রতীকের মাধ্যমে--কারণটা হতে পারে অর্থনৈতিক, যৌনতা-প্রসূত অথবা আলংকারিক। (যেমন সারাসিনের কাহিনিতে রয়েছে মুস্কচ্ছেদনের জন্যে পৌরুষহীনতার অথবা ধনীর নানান অভব্য বিলাসের প্রসঙ্গ।)

    ৫। সাংস্কৃতিক কোড--সংক্ষেপে REF, যার মধ্যে রয়েছে বৈজ্ঞানিক অথবা বৌদ্ধিক প্রসঙ্গ--পার্টিতে গিয়ে খানাপিনা, আনন্দবিলাসের মধ্যেও বেশিরভাগ পুরুষমানুষ দিবাস্বপ্নে মেতে ওঠেন--তার পিছনে মনোবিজ্ঞানের কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে কিনা।

    এইভাবে পাঁচ পাঁচটি সাংকেতিক বার্তার সাহায্য নিয়ে বার্ত পাঠককে পথ দেখান বালজাকের ঊনবিংশ শতাব্দীর উচ্চবিত্ত সমাজের রহস্য ও লালসার আখ্যানের মধ্যে দিয়ে। বার্তের মতে এই বার্তাগুলি দিয়ে গাঁথা যেতে পারে বিভিন্ন কন্ঠস্বরের এক অনুপম মালা। “The grouping of codes, as they enter into the work, into the movement of the reading, constitute a braid (text, fabric, braid: the same things); each thread, each code is a voice; these braided--or braiding--voices form the writing.”

    || ৯ ||

    ১৯৭০-এর দশাব্দে বার্ত গেলেন তাঁর খ্যাতির শীর্ষে--পৃথিবীর জনপ্রিয়তম সাহিত্যতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে লাগল ভ্রমণ, বক্তৃতা ও অধ্যাপনার আমন্ত্রণ। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রথমবার জাপান ভ্রমণে গিয়েছিলেন তোকিওর ফ্রাংকো-জাপানিজ ইনসটিটিউটের কর্ণধার মরিস পিনগুয়ে (১৯২৯-১৯৯১)-এর নিমন্ত্রণে। ১৯৭০ সালে সেখানে তৃতীয়বারের ভ্রমণ সমাপ্ত করে তিনি লিখলেন তাঁর জাপান-বিষয়ক গ্রন্থ “চিহ্নগুলির সাম্রাজ্য” (প্রকাশ ১৯৭০); ১৯৮৩ সালে গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করবেন রিচার্ড হাওয়ার্ড “Empire of Signs” নামে। জাপানের সংস্কৃতি, সমাজ, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন চিহ্ন এবং প্রতীকের মাধ্যমে। তোকিওর কেন্দ্রস্থলে সম্রাট হিরোহিতোর প্রাসাদ--“It is not a great over-bearing entity, but a silent and non-descript presence, avoided and unconsidered.”

    ১৯৭০-এর দশাব্দে চিন দেশটি ছিল পশ্চিমের মানুষের কাছে নিষিদ্ধ ও রহস্যময়। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে ‘তেল কেল’ পত্রিকা পাঁচজনের একটি প্রতিনিধিদল চিন দেশে পাঠায় ১৯৭৪ সালে--তাঁরা স্বচক্ষে দেখে আসবেন চিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ২৫ বছর পরে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা। বার্ত ছিলেন সেই প্রতিনিধিদলের সদস্য এবং এপ্রিল-মে মাসে চিন ভ্রমণের সময় তিনি দিনলিপি লিখেছিলেন তিনটি নোটবুকে। জীবিত থাকাকালীন তিনি সেগুলি প্রকাশ করেন নি। তাঁর মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পরে ২০০৯ সালে অধ্যাপিকা অ্যান হার্শবার্গ পিয়েরোর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় “চিন পরিক্রমা” নামে। ২০১২ সালে বইটির ইংরেজি অনুবাদ “Travels in China” প্রকাশিত হয় পিলিটি প্রেস থেকে ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক অ্যানড্রু ব্রাউন (১৯৫৮--)-এর অনুবাদে। বার্ত তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসবোধের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন চিনের। বেজিং বিমানবন্দরে পৌঁছে তাঁর মন্তব্য--“Airport lounge: plain, austere. Leather chairs. Switzerland fifty years ago.” অথবা বালিকাদের বিপ্লবী ব্যালে নাচের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে--“Oh dear, they have smiles like air hostesses.”

    ১৯৭৭ সালে বার্তের মা এনরিয়েতের মৃত্যু হয় ৮৪ বছর বয়েসে—মাও ছেলে প্যারিসের ফ্ল্যাটে এক সঙ্গে বাস করেছেন ষাট বছর। মায়ের মৃত্যুর পর বার্ত তাঁর শোকার্ত ভাবনাগুলি লিখে রাখেন টুকরো টুকরো কাগজে। দু-বছরে এরকম ৩৩০টি কাগজে লেখা হয় তাঁর চিন্তাভাবনা। বেঁচে থাকলে তিনি ওই কাগজগুলি নিয়ে কী করতেন কে জানে? ২০০৯ সালে নাথালি লেহের (১৯৬০--)-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় “মাতৃশোকের দিনলিপি”। ২০১০ সালে রিচার্ড হাওয়ার্ড তার ইংরেজি অনুবাদ করেন “Mourning Diary” নাম দিয়ে (প্রকাশক--হিল অ্যাানড ওয়াং)। সম্পাদকের মতে--“The reader is presented not with a book completed by its author, but the hypothesis of a book desired by him.”

    ফেব্রুয়ারি ২৫, ১৯৮০--প্যারিসের রাজপথে এক ধোপার ট্রাকের ধাক্কায় তিনি জখম হন গুরুতরভাবে। মার্চ ২৬, হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু।


    গত এক বছরের বেশি সময় আমি রলাঁ বার্তে নিমজ্জিত--পড়েছি তাঁর লেখা এবং তাঁকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ও বইপত্তর। তিনি দুর্বোধ্য, বিতর্কিত এবং অনেক সময় পরস্পরবিরোধী। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তিনি সুখপাঠ্য নন এবং কোনোদিন আমার প্রিয় লেখক হবেন না। কিন্তু তাঁকে ছাড়া আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনা অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাঁর রচনার সমালোচনা অথবা নিন্দা করা সম্ভব, কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য অথবা অস্বীকার করা যাবে না।


    ইংরেজি অনুবাদে রলাঁ বার্তের গ্রন্থতালিকা:

    জীবৎকালে প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:

    --Elements of semiology, অনুবাদ: অ্যানেট লেভার্স এবং কলিন স্মিথ; (লন্‌ডন, ১৯৬৭)

    --Writing Degree zero, অনুবাদ: অ্যানেট লেভার্স এবং কলিন স্মিথ; (লন্‌ডন, ১৯৬৭)

    --Critical Essays, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (এভানস্টন, ইলিনয়, ১৯৭২)

    --S/Z, অনুবাদ: রিচার্ড মিলার (লন্‌ডন, ১৯৭৫)

    --The Pleasure of Text, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (লন্‌ডন, ১৯৭৬)

    --Roland Barthes by Ronald Barthes, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (লন্‌ডন, ১৯৭৭)

    --Sade, Fourier, Loyola, অনুবাদ: রিচার্ড মিলার (লন্‌ডন, ১৯৭৭)

    --Image, Music, Text, অনুবাদ: স্টিফেন হিথ (গ্লাসগো, ১৯৭৭)

    --The Eiffel Tower and other Mythologies, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (ন্যু ইয়র্ক, ১৯৭৯)

    --A Barthes Reader, সম্পাদনা: সুসান সনটাগ (ন্যু ইয়র্ক, ১৯৮০)।

    মৃত্যুর পরে প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:

    --Empire of Signs, অনুবাদ: অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (লন্‌ডন, ১৯৮৩)

    --camera Lucida: Reflections of Photography, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (লন্‌ডন, ১৯৮৪)

    --The Fashion system, অনুবাদ: ম্যাথিউওয়ার্ড এবং রিচার্ড হাওয়ার্ড (লন্‌ডন, ১৯৮৫)

    --The Grain of the Voice: Interviews, 1962--1980, অনুবাদ: লিন্‌ডা কভারডেল (ন্যু ইয়র্ক, ১৯৮৫)

    --The Responsibility of Forms: Critical Essays on Music, Art and Representation, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (অক্‌সফোর্ড, ১৯৮৬)

    --The Rustle of Language, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (অক্‌সফোর্ড, ১৯৮৭)

    --Criticism and Truth, অনুবাদ: ক্যাট্রিন পিলচার কুনেমান (লন্‌ডন, ১৯৮৭)

    --Writer Sollers, অনুবাদ: ফিলিপ থোডি (লন্‌ডন, ১৯৮৭)

    --A Lover’s Discourse: Fragments, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (লন্‌ডন, ১৯৯০)

    --New Critical Essays, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (বার্কলে, ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯৯০)

    --On Racine, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (বার্কলে, ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯৯২)

    --Incidents, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (বার্কলে, ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯৯২)

    --Mythologies, অনুবাদ: অ্যানেট লেভার্স (লনডন ১৯৯৩)

    --The Neutral: Lecture courses at the colleges de France, 1977--78, অনুবাদ: রোসালিন্‌ড ক্রাউস এবং ডেনিস হলিয়ের (ন্যু ইয়র্ক, ২০০৫)

    --The Language of Fashion, অনুবাদ: অ্যান্‌ডি স্ট্যাফোর্ড (অকসফোর্ড, ২০০৬)

    --What is sport, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (লনডন, ২০০৭)

    --Mourning Diary: October 26, 1977--September 15, 1979, অনুবাদ: রিচার্ড হাওয়ার্ড (লন্‌ডন, ২০১৯)

    --The Preparation of the Novel: lecture courses and seminars at the college de France (1978--1979 and 1979--1980), অনুবাদ: কেট ব্রিগস (ন্যু ইয়র্ক, ২০১১)

    --Travels in China, অনুবাদ: অ্যানড্রু ব্রাউন (কেমব্রিজ, ২০১৫)

    --How to Live Together, অনুবাদ: কেট ব্রিগস (ন্যু ইয়র্ক, ২০১৩)

    ********

    রলাঁ বার্তের জীবনী লিখতে যে গ্রন্থগুলির সাহায্য নিয়েছি তাদের তালিকা--

    --Roland Barthes, A Biography--Louis-Jean Calvet; অনুবাদ: সারা ওয়াইকস; ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রেস; ১৯৯৪

    --Roland Barthes by Roland Barthes: অনুবাদ: রচার্ড হাওয়ার্ড;

    --Roland Barthes--Jonathan Cutter; অকস্‌ফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস; ন্যু ইয়র্ক; ১৯৮৩।

    --Critical Lives: --Roland Barthes--Andy Stafford; রিঅ্যাকসন বুকস; ২০১৫।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ ইন্টারনেট থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments