আহা, বিধবা বিবাহ যদিকবিতার নাম— ‘ধন্য দাদু’। লিখেছেন নবনীতা দেবসেন। কবিতাটিকে কবির জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যায়। বিদ্যাসাগর যদি বিধবাবিবাহ প্রচলন না করতেন, তবে নবনীতার জন্মই হত না। কবি রাধারাণী দেবী ও নরেন্দ্র দেবের কন্যা হলেন নবনীতা। রাধারাণীর জন্ম হয়েছিল কোচবিহার জেলার দিনহাটায়, ১৯০৩ সালের ৩ নভেম্বর। তাঁর বাবা আশুতোষ ঘোষ কোচবিহার রাজ্যের শাসন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। কোচবিহারের প্রশাসনিক বিবরণে (১৮৯২-৯৩) পাচ্ছি দিনহাটা মহকুমার Sub-Naib Ahilkar পদে তাঁর উল্লেখ এবং বিভিন্ন তথ্য। লেখা হচ্ছে--“Babu Gopal Chunder Chatterjee is a very able and intelligent officer and discharged the duties of his office to the satisfaction of council. Since his transfer to Mathabhanga Babu Ashutosh Ghose has performed the duties of Secretary with zeal and assiduity.”[২] দিনহাটার ছবিরুন্নিসা বিদ্যালয় থেকে ছাত্রবৃত্তি ও মাইনর পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন রাধারাণী। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় পেশায় ইঞ্জিনীয়ার দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত দত্ত বংশীয় সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশত তিন মাসের মধ্যেই স্বামী এশিয়াটিক ফ্লু রোগে ভুগে মারা যান প্রবাসে। রামপুর স্টেটে তিনি কর্মরত ছিলেন, মাত্র আটদিনের ছুটিতে কলকাতায় এসে বিবাহ করে ফিরে গিয়েছিলেন কর্মস্থলে। রাধারাণীর জীবন তারপর যেন আশ্রয় পেতে চাইল সাহিত্যের কাছেই। উনিশ কুড়ি বছর বয়সেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘মানসী ও মর্মবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকায়। লেখালেখির সূত্রে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠল কবি নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে—“১৯৩১ সালের একত্রিশে মে দুই কবি বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। বিবাহের সময় নরেন্দ্র দেবের বয়স তেতাল্লিশ; রাধারানীর আটাশ। বাংলার সারস্বত সমাজ এই বিবাহকে স্বাগত জানালো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এবং কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র দেবদম্পতিকে আশীর্বাদে অভিনন্দিত করলেন। বিবাহের এক বছর পরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হল। শিশুটিকে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। তৃতীয় দিনেই সে মায়ের কোল শূন্য করে চলে যায়। কয়েক বছর পরে কবিদম্পতি একটি কন্যারত্ন লাভ করেন —কবিগুরুই তার নামকরণ করেন নবনীতা। নবনীতা পিতামাতার সারস্বত ঐতিহ্যের অধিকারী। সেও কবি।”[৩] প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রাধারাণীর বাবা এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। এরপর আমরা ‘রাধারাণী–নরেন্দ্র দেব বিবাহ: কন্যার আত্ম-সম্প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনের অংশবিশেষ উল্লেখ করছি, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, সোমবার, ‘দৈনিক বঙ্গবাণী’ পত্রিকায়—“গতকল্য রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাত ঘটিকায় লিলুয়ার “দেবালয়” গৃহে প্রথিতযশা কবি বালবিধবা শ্রীমতী রাধারাণীর সহিত সুসাহিত্যিক শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র দেবের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হইয়াছে। বিবাহের সকল কার্য্য হিন্দু-শাস্ত্র-মতে নারায়ণ শিলা সাক্ষ্য করিয়া খ্যাতনামা পণ্ডিতগণ দ্বারা পরিচালিত হইয়াছে। বিবাহের প্রধান বিশেষত্ব এই যে কন্যা সম্প্রদান কার্য্য স্বয়ং সম্পাদন করিয়াছে—শাস্ত্রমতে প্রাপ্তবয়স্কা কন্যা নিজেই সম্প্রদান করিতে পারেন বলিয়া ইহা সম্ভব হইয়াছে। পাত্র ও পাত্রী উভয়েই কলিকাতার খ্যাতনামা বনিয়াদী কায়স্থ বংশ-সম্ভুত। তাঁহারা স্বেচ্ছায় সৎসাহসের বশবর্ত্তী হইয়া সম্পূর্ণ বৈদিক শাস্ত্রমতে যে বিবাহ সম্পাদন করিলেন, তাহার দৃষ্টান্ত বাঙ্গলার সর্ব্বত্র অনুসৃত হইবে এবং প্রাণের দাবী মনুষ্যত্বের দাবী, প্রাণহীন সামাজিক বিধিনিষেধের উচ্চে স্থান লাভ করিবে—ইহাই আমাদের বিশ্বাস।”[৪] বিদ্যাসাগর ও কোচবিহারের সম্পর্কের আলোচনা শুরু হল রাধারাণী দেবীর জীবনকথা দিয়েই। যে জীবনের পরতে পরতে রয়েছে বিদ্যাসাগরের নারীমুক্তির ধারণা ও তার সফল প্রয়োগ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাধারাণী দেবী সংকলন করেছিলেন ‘কিশোর-সাহিত্য’। ‘ইংরেজী বিদ্যালয়সমূহের’ তৃতীয় শ্রেণীর জন্য প্রথম ভাগ ও চতুর্থ শ্রেণীর জন্য প্রণীত হয়েছিল দ্বিতীয় ভাগ। ১৩৪১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত এই দুটি বই প্রকাশ করেছিলেন গ্রন্থকর্ত্রী স্বয়ং। বালক-বালিকাদের গল্প-কবিতা যাতে ভালো লাগে, তার জন্য তিনি সহজ ভাষায় লিখেছেন। ‘কিশোর সাহিত্য’ দ্বিতীয় ভাগের ভূমিকায় জানাচ্ছেন—“ছাত্রছাত্রীদের চিত্তাকর্ষণের জন্য বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলি কথোপকথনচ্ছলে লিপিবদ্ধ করিয়াছি।...চরিত্র গঠনমূলক গল্প, জীবনী ও কবিতা এবং সাধারণ জ্ঞানমূলক বিষয়সমূহের সমাবেশে বইখানি যাহাতে সুকুমারমতি বালকবালিকাদের জীবন গঠনে সহায়ক হইতে পারে, তাহার জন্য যথাসাধ্য যত্ন করিয়াছি। পুস্তকখানি ছাত্রছাত্রীদের জীবনে সুফলপ্রদ এবং চিত্তবিনোদক হইলে, শ্রম সার্থক জ্ঞান করিব।”[৫] ‘জীবনে সুফলপ্রদ এবং চিত্তবিনোদক’—এই কথার মধ্যেই ধরা রইল গ্রন্থপরিকল্পনার উদ্দেশ্য। বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়বার সূত্র ধরেই চলে যাই ভিন্ন প্রসঙ্গে।
থাকতো বারণ
হায়, আমার তাহলে আর
হতো না জনম!
ভাগ্যে আইন বানিয়েছিলে
বালবিধবার বিয়ে দিলে
তাই তো আমার মা জননীর
মা হবার কারণ।
নইলে হয়ে ‘কড়ে- রাঁড়ী’
থাকতো পড়ে বাপের বাড়ি
বদলে যেত স্বপ্ন, স্মৃতি
জীবন ধারণ।
আহা, বিধবার বিয়ে যদি
না হতো চারণ!
ধন্য দাদু, আমার তুমিই
জন্মের কারণ।। [১]
১৮৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কোচবিহার মহারাজার কাছে ম্যাজিস্ট্রেট পদের জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। এবং সেখানে যুক্ত ছিল বিদ্যাসাগরের মন্তব্য—‘একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম। দেখিও যেন বাতাসে উড়িয়া না যায়।’ মাইকেলের মূল চিঠি ও বিদ্যাসাগরের সুপারিশপত্রটির বর্তমানে কোনো খোঁজ নেই। ফলে আমাদের পূর্ববর্তী গবেষকদের লেখার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে এই ব্যাপারে। যাইহোক, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে সময়ে চিঠি লিখেছিলেন, সে সময় কোচবিহারের মহারাজা ছিলেন নরেন্দ্র নারায়ণ। তাঁর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্কসূত্র নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আনন্দগোপাল ঘোষ জানাচ্ছেন—“প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণই কোচবিহার রাজপরিবারের প্রথম রাজকুমার যিনি ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। এই শিক্ষার জন্য তিনি প্রথমে বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র কৃষ্ণনগর কলেজে (তখন বিদ্যালয়কেও কলেজ বলা হতো) ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। এরপরে নরেন্দ্র নারায়ণ কলকাতায় ইংরেজ সরকার স্থাপিত ও পরিচালিত ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হয়েছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে ইংল্যান্ডের ধাঁচে এদেশের জমিদার-রাজা-মহারাজাদের পুত্রদের শিক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশন খুলেছিলেন। এই ইনস্টিটিউশনের পরিচালক ছিলেন রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র।... ওয়ার্ডস ইন্সটিটিউশনের পরিদর্শক ছিলেন বিদ্যাসাগর। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করতে পারি যে এই সময়েই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে নরেন্দ্র নারায়ণের পরিচয় ঘটেছিল।”[৬] মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহারে ফিরে এসেছিলেন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট। কিন্তু ইন্দ্রমিত্র আমাদের জানাচ্ছেন—“ওয়ার্ডস ইন্সটিটিউশনের জন্য চারজন পরিদর্শক নিযুক্ত হয়েছেন। ঠিক হল, প্রত্যেক পরিদর্শক বছরে তিন মাস করে পরিদর্শন করবেন। বিদ্যাসাগর ওই চারজনের একজন। ১৮৬৩ সালের নভেম্বর থেকে বিদ্যাসাগর পরিদর্শন আরম্ভ করেছেন।”[৭]
নরেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ঠিক কোন সময় থেকে গড়ে উঠেছিল, সেটা বলা নিশ্চিতভাবে সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তাঁদের সম্পর্কের উষ্ণতা পরিলক্ষিত হয় বিদ্যাসাগরের চিঠির বয়ান থেকেই। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তিদের কেউ কেউ কোচবিহার রাজদরবারে চাকরি নিয়েছিলেন, এই তথ্য বিদ্যাসাগরের নিশ্চিতভাবেই জানা ছিল। স্বপনকুমার রায় লিখছেন—
“আহিলকার পদে যোগদানকারী স্ট্যাম্প অফিসার তথা ‘গীতসূত্রসার’ রচয়িতা সমসাময়িক প্রখ্যাত নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং ছিলেন মাইকেলের অতি প্রিয়। তাঁর রচিত ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের নাম ভূমিকায় মাত্র তেরো বছর বয়সেই কৃষ্ণধনের প্রথম অভিনয় মাইকেলকে বিস্মিত করেছিল। একই নাটকে অভিনয় করেছিলেন প্রিয়নাথ ঘোষ, যিনি লণ্ডন প্রত্যাগত প্রেসিডেন্সির ছাত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণের গৃহশিক্ষক ও পরে মহারাজার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিযুক্ত হয়েছিলে। প্রিয়নাথ ঘোষ মহারাজার ব্যক্তিগত সহায়ক থাকার ফলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সম্পূর্ণ রচনাবলী মহারাজার প্রাসাদ লাইব্রেরীতে অনেকটা উজ্জ্বল আসনে স্থান করে নিয়েছিল এমন তথ্যও পাওয়া যায়।”[৮]
কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৮৫৯ সালের ২৩ এপ্রিল ‘কেশবচন্দ্র সেন আর তাঁর দলের যুবকদের উৎসাহে’ ‘বিধবা বিবাহ’ নাটক অভিনীত হয়। সে নাটক দেখতে একাধিকবার এসেছেন বিদ্যাসাগর। এই প্রসঙ্গে সতীকুমার চট্টোপাধ্যায় বলছেন—“বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের সমর্থনে ১৮৫৯ খৃঃ তিনি ‘বিধবা বিবাহ’ নাটক অভিনয় করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে তাঁর এই হৃদয়ের যোগ চিরদিন ছিল এবং ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’ পত্রিকার সংবাদ থেকে দেখা যায় যে সময়ে সময়ে অর্থাভাব বশতঃ ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’ পত্রিকা প্রকাশিত না হলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বিনামূল্যে, নিজ মুদ্রাযন্ত্রে তা ছাপিয়ে দিয়েছেন।”[৯] কেশবচন্দ্রের কন্যা সুনীতি দেবী ও জামাতা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক গড়ে ওঠা খুব স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ‘মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণই কোচবিহার রাজপরিবারের প্রথম রাজা যিনি একটি-ই বিবাহ করেছিলেন।’ বহুবিবাহ রদ করবার জন্য বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা স্মরণীয়। আর আরেকটি তথ্য এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, কোচবিহার রাজ্যে প্রথম বিধবা-বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ৫ আষাঢ়। পাত্র--অবিনাশচন্দ্র সাহা। পাত্রী কমলা সাহা। কোচবিহারের নূতন বাজারে অনুষ্ঠিত এই বিয়েতে পৌরোহিত্য করেছিলেন দীনেশচন্দ্র চক্রবর্তী। পাত্রের বয়স ছিল ৪০ ও পাত্রীর ২০। ‘কোচবিহার দর্পণ’ পত্রিকায় (৪র্থ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা; ১লা শ্রাবণ, ১৩৪৮) এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
কোচবিহার রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র থেকে বিদ্যাসাগরের পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হতেই পারে। মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণের আমলে তিনটি ভার্নাকুলার স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। তিনি নিজে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন এবং রাজ্যেও ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ভার্নাকুলার স্কুলটি ১৮৬১ সালে জেঙ্কিন্স স্কুল হিসেবে পৃথক পরিচিতি লাভ করে। এবং এই স্কুলটি ছিল রাজ্যের প্রথম ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৬৮-৬৯ সালে বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬টি, ১৮৭৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৩টি। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সময় ‘প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নে এক নবদিগন্তের উন্মোচন হয়’। কী অদ্ভুত সমাপতন! সময়টা ১৮৯১ সাল।
বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর কলকাতার বেথুন কলেজে আয়োজিত সভায় তাঁর স্মৃতিচিহ্ন তৈরির উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী। বিদ্যাসাগর স্মরণ ফান্ডে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ২৫০০ টাকা দান করেছিলেন বলে ‘পরিচারিকা’ পত্রিকা সূত্রে জানা যায়। নৃপেন্দ্রনাথ পাল জানিয়েছেন—“কলিকাতায় বিদ্যাসাগরের স্মৃতি রক্ষায় সাধারণ কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ (সূত্র: দেশ পত্রিকা, ২৭.৭.১৯৯১)।”[১০] প্রাবন্ধিক তাঁর ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও কোচবিহার’ প্রবন্ধে ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ৭ ভাদ্র কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে দেওয়ান কালিকাদাস দত্তের সভাপতিত্বে বিদ্যাসাগর স্মৃতিরক্ষা কমিটি গঠনের উল্লেখ করেছেন। ১৮৯৩ সালের ১ অক্টোবর সভার কার্যবিবরণীর সূত্রে জানা যায় যে, ‘কলিকাতাস্থ রোরণ এবং সেপার্ড কোম্পানী কৃত বিদ্যাসাগরের মূর্তি ক্রীত হইতেছে।’ কমিটির পক্ষ থেকে ‘বিদ্যাসাগর বৃত্তি’ প্রচলনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রকে ষড়দর্শন, প্রাচীন ও নব্য স্মৃতি, বেদ এবং উপনিষদ, গণিত ও ফলিত জ্যোতিষ, আয়ুর্বেদ-সাহিত্য-ব্যাকরণ-অলঙ্কার-ছন্দ এই বিষয়গুলি থেকে যেকোনো একটি নির্বাচন করতে হবে। কালিকাদাস দত্তের থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব সম্বলিত চিঠি পাবার পর মহারাজার আপ্ত সহায়ক প্রিয়নাথ ঘোষ উত্তরে জানিয়েছেন—“বিদ্যাসাগর স্মৃতিচিহ্ন সংস্থাপন কমিটির শেষ অধিবেশনের কার্যবিবরণী সম্বলিত আপনার ১৮৯৩ সনের ১০ই ডিসেম্বর তারিখে লিখিত ২৩৪৭ নং চিঠি যাহাতে আপনি কমিটির নির্দ্ধারিত বিষয় গুলি অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করিয়াছেন, তাহার প্রাপ্তি স্বীকার করিতে এবং ধন ভান্ডারের কার্যকলাপ যেভাবে পরিচালিত হইয়াছে এবং যে রূপ সন্তোষজনক ফল লাভ হইয়াছে, তজ্জন্য মহারাজ বাহাদুরের সন্তুষ্টি প্রকাশ করিতে আমি আদিষ্ট হইয়াছি।
২। প্রতিকৃতিটি ক্ষুদ্রায়তন হইলেও তাহা ল্যান্ড্ডাউন গৃহ নির্মাণ সম্পন্ন অন্তে তথাতে সংস্থাপনার্থে শ্রী শ্রী মহারাজ বাহাদুরের সন্তোষ সহকারে অনুজ্ঞা দিয়াছেন। কার্যবিবরণী দৃষ্টে জানা যায় যে, প্রতিকৃতিটির মূল্য দেওয়ার পরও কমিটির হস্তে ১৫০৫/৩ পাই (এক হাজার পাঁচশত পাঁচ টাকা পাঁচ আনা তিনপাই, বর্তমান এক হাজার পাঁচ শত পাঁচ টাকা পয়ত্রিশ পয়সা) আছে। কমিটি ঐ টাকা দ্বারা কোম্পানীর কাগজ ক্রয় করিয়া তাহার সুদ হইতে “বিদ্যাসাগর বৃত্তি” নামক একটি বৃত্তি স্থাপন মানসে ঐ টাকা কুচবিহার খাজানা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর হস্তে রক্ষিত হওয়ার মানস করিয়াছেন। এই প্রস্তাবে শ্রী শ্রী মহারাজ ভূপবাহাদুর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছেন, কমিটির প্রার্থনানুযায়ী তিনি খাজানা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে ঐ টাকা গ্রহণ করিতে এবং তাহা কমিটির ইচ্ছানুরূপ কার্য্যে পরিণত করিতে উপদেশ করিবেন।”[১১] —পুরো চিঠিটি আমরা উদ্ধৃত করছি না। একটা বিষয় পরিষ্কার যে, রাজপ্রশাসনের একাধিক ব্যক্তির ওপর বিদ্যাসাগর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
কোচবিহার-সাহিত্য-সভার দ্বিতীয় বার্ষিক কার্য্যবিবরণী’ (১৩২৪ সন) থেকে জানতে পারি ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ বইটি এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা হয়েছিল। রাজ আমলে প্রকাশিত বিদ্যাসাগর বিষয়ক লেখাপত্রের খোঁজ করলে সম্পর্কের ইতিহাসে আরো নতুন তথ্য সংযুক্ত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। রাণী নিরুপমাদেবী সম্পাদিত ‘পরিচারিকা’ (নবপর্য্যায়) পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় অনাথকৃষ্ণ দেব ‘আমাদের হিন্দুর নারী পূজা’ প্রবন্ধটি সমাপ্ত হয়েছিল বিদ্যাসাগরের উদ্ধৃতি দিয়ে— “হায় কি পরিতাপের বিষয়! সে দেশের পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধর্ম্ম নাই, ন্যায়অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সভাসদ্ বিবেচনা নাই; কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম্ম ও পরম ধর্ম্ম, আর হতভাগা অবলা জাতি জন্মগ্রহণ না করে। হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে ভারতবর্ষে বলিতে পারি না।” (পৃ: ৪০৮)
এবার আসি ভিন্ন প্রসঙ্গে। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা প্রাইমারের আলোচনায় কোচবিহারের কথা একেবারেই উঠে আসেনি। যে টেক্সটটির কথা এখন বলব, সেটি লিখেছিলেন ক্ষেত্রমোহন ব্রহ্ম। আলোচ্য ‘নূতন সচিত্র বর্ণপরিচয়’ পুস্তিকাটির চতুর্থ বা অভিনব সংস্করণ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে লেখকের প্রপৌত্রী সঞ্চারী ব্রহ্ম ও বন্ধুবর জয় দাসের সৌজন্যে। তাঁদের সম্পাদনায় এই প্রাইমারটি পুনঃপ্রকাশের অপেক্ষায়। আনুমানিক ১৯২৭ সালের কাছাকাছি সময়ে মুদ্রিত এই টেক্সটের ‘নিবেদন’ অংশে লেখক জানাচ্ছেন— “এই ক্ষুদ্র পুস্তকখানি পূজ্যপাদ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পদাঙ্ক অনুসরণে সঙ্কলিত। মধ্যে ইহার প্রচার বন্ধ হইয়া যায়। সম্প্রতি, ইহার প্রতি কুচবিহার ভদ্রমণ্ডলীর অনুরাগ দর্শনে ইহা চতুর্থবার মুদ্রিত ও প্রচারিত হইল।” ‘পুস্তক সম্বন্ধে কয়টি কথা’-য় বলছেন— “প্রথম ভাগে যেখানে যে স্বরের ও দ্বিতীয় ভাগে যেখানে যে ব্যঞ্জনের যোগ শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে, উদাহরণের শব্দাবলীতে শুদ্ধ সেই স্বর ও ব্যঞ্জনেরই যোগ দেখান গিয়াছে। দুই চারিটী মিশ্র যোগের শব্দ ও উদাহরণের শেষ ভাগে স্বতন্ত্র ভাবে দেওয়া গিয়াছে। উভয় স্থলেই পাঠাবলী গদ্যে পদ্যে প্রদত্ত হইয়াছে।
উদাহরণের দুই এক স্থলে সহজ শব্দের সহিত দুই চারিটি কঠিন শব্দও দিতে হইয়াছে—কঠিন শব্দ শিখিতে শিশুদের আগ্রহও দেখা যায়। শিশুদিগকে প্রথম হইতে ভাষার প্রাঞ্জলতা ও বাক্যের মাধুর্য্য আস্বাদন করাইবার জন্য, বিদ্যাসাগর ও তর্কালঙ্কার মহাশয় কৃত বর্ণপরিচয় ও শিশুশিক্ষা হইতে পাঠ্যাদিও কিছু কিছু ইহাতে উদ্ধৃত হইয়াছে।”[১২] বিদ্যাসাগরের লেখা কোনো বই রাজ আমলে পাঠ্য ছিল কিনা, সে বিষয়ে আমরা জানতে পারিনি। তবে তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন বই যে রচিত হয়েছিল, তা অনুমান করাই যায়। ক্ষেত্রমোহন ব্রহ্মের লেখা পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারী থেকে, যে প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর!
তথ্যপঞ্জি :
[১] ‘বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা কবিতা’, সুজিত সরকার, ‘দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর’, ‘কোরক’, তাপস ভৌমিক (সম্পা.), শারদীয় ২০১৯, পৃ: ২৩০-২৩১।
[২] Annual Administration Report on the Cooch Behar state for the year 1892-93, Cooch Behar State Press, Page: 17।
[৩] ‘আমার কালের কয়েকজন কবি’, জগদীশ ভট্টাচার্য, ভারবি, কলকাতা, দ্বিতীয় প্রকাশ পুনর্মুদ্রণ, জুলাই ২০১৪, পৃ: ৯৮।
[৪] ‘রাধারাণী দেবীর রচনা-সংকলন’, দ্বিতীয় খণ্ড, অভিজিৎ সেন, অনিন্দিতা ভাদুড়ী (সং.),পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০০, পৃ: ৩৭৫।
[৫] ওই, পৃ: ৩৫৩।
[৬] ‘বিদ্যাসাগর ও কোচবিহারের রাজপরিবার’, আনন্দগোপাল ঘোষ, ‘বিদ্যাসাগর ও সমকালীন ভারতবর্ষের সমাজসংস্কার আন্দোলন’, সংবেদন, মালদা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃ: ৩০।
[৭] ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’, ইন্দ্রমিত্র,, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, প্রথম সংস্করণ একাদশ মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০১৯, পৃ: ২৩২।
[৮] ‘রাজনগর কোচবিহারে বিদ্যাসাগর অনুরাগ’, স্বপনকুমার রায়, ‘শারদ ছন্দ’, শুভাশিস চৌধুরী (সম্পা.), ১৪২৬, পৃ: ২৪।
[৯] ‘সমন্বয় মার্গ’, সতীকুমার চট্টোপাধ্যায়, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ, ১২ই মাঘ ১৩৬৭, পৃ: ১৪৯।
[১০] ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও কোচবিহার’, ড. নৃপেন্দ্রনাথ পাল, ‘নানা প্রসঙ্গে কোচবিহার’, অণিমা প্রকাশনী, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৪২৪, পৃ: ১৮৩।
[১১] ওই, পৃ: ১৮১।
[১২] ‘নূতন সচিত্র বর্ণপরিচয়’ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ), ক্ষেত্রমোহন ব্রহ্ম, সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারী হইতে শ্রীযোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কর্ত্তৃক প্রকাশিত, কলিকাতা, চতুর্থ বা অভিনব সংস্করণ, প্রকাশকালের উল্লেখ নেই, চতুর্থ প্রচ্ছদ।