বাল্যবিবাহকে বিদ্যাসাগর বলেছেন ‘পাণিপীড়নের প্রথা’।[২] ‘অষ্টমবর্ষীয় কন্যা দান করিলে পিতা মাতার গৌরীদানজন্য পুণ্যোদয় হয়, নবম বর্ষীয়াকে দান করিলে পৃথ্বী দানের ফল লাভ হয়, দশমবর্ষীয়াকে পাত্রসাৎ করিলে পরত্র পবিত্রলোকপ্রাপ্তি হয়।’[৩]—শাস্ত্রনির্দিষ্ট এই পুণ্য অর্জনের জন্য অবিবেচক বাবা-মা সেকালে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতেন। তবে কেবল পুণ্যলাভের মোহ নয়, এর পিছনে শাস্ত্রকারদের মস্তিষ্কপ্রসূত কূটবুদ্ধিও সমান দায়ী ছিল। সেকালে বিয়ের আগেই যদি কোনো মেয়ে রজঃস্বলা হতো, তবে শাস্ত্র অনুযায়ী সে পিতৃ-মাতৃ দুই কুলেরই কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হতো। তার সাতপুরুষের জন্য নির্দিষ্ট হতো নরকবাস এবং সমাজে তার বাবা-মাকে অস্পৃশ্য একঘরে হয়ে থাকতে হতো। কাজেই অনেক অভিভাবকই বাল্যবিবাহকে সমর্থন না করলেও সামাজিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অল্পবয়সে সন্তানের বিয়ে দিতে বাধ্য হতেন। এক্ষেত্রে অসহায় অভিভাবকদের প্রতি প্রাবন্ধিকের সহানুভূতি আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। একইসঙ্গে প্রশংসনীয় লেখকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যক্তি নয়, লেখকের আক্রমণের লক্ষ্য প্রথা। বিদ্যাসাগর ছিলেন ভীষণভাবেই সদর্থক ও আশাবাদী মানসিকতার অধিকারী। দেশ ও দেশবাসীর দুরবস্থা, অজ্ঞানতা তাকে যন্ত্রণাদীর্ণ করেছে; কিন্তু সুদিনের আশা করতে তিনি ভোলেননি—
“…অধুনা এতদ্বিষয় লইয়া যে আন্দোলন হইতেছে, ইহাও মঙ্গল।… এইরূপে অস্মদ্দেশীয় অন্যান্য অসদ্ব্যবহার বিষয়ে যদ্যপি সর্বদাই লিখন পঠন ও পর্যালোচনা হয়, অবশ্যই তন্নিরাকরণের কোন সদুপায় স্থির হইবেক সন্দেহ নাই। অনবরত মৃত্তিকা খনন করিলে কতদিন বারি বিনির্গত না হইয়া রহিতে পারে?”[৪]উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের প্রতি তিনি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। নবজাগরণের ফলে সেকালের জনমানসে বা বলা ভালো সামান্যকিছু মানুষের মধ্যে যে চেতনার জাগরণ ঘটেছিল, তা আশা জাগিয়েছিল লেখকের মনে।
বিদ্যাসাগরের মতে বিয়ের সুমধুর ফল প্রেম এবং প্রেমের মূলকথা মনের মিল। সেই মিল নির্ভর করে স্বামী-স্ত্রীর বয়স, রূপ, গুণ, অবস্থা, চরিত্র, অভিপ্রায় ইত্যাদির ওপর। পারস্পরিক প্রেমসম্পর্কের মধ্য দিয়েই দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। আমাদের দেশে বিয়ে হয়, স্বামী-স্ত্রী নিয়ম মেনে সংসারও করে; কিন্তু বিয়ের যে মূল বিষয় অর্থাৎ প্রেম, কেবল সেটিই থাকে অনুপস্থিত। এর জন্য বিদ্যাসাগর দায়ী করেছেন আমাদের বিবাহ পদ্ধতিকে—
“কেবল একজন উদাসীন বাচাল ঘটকের প্রবৃত্তিজনক বৃথা বচনে প্রত্যয় করিয়া পিতামাতার যেরূপ অভিরুচি হয়, কন্যাপুত্রের সেইবিধিই বিধিনিয়োগবৎ সুখদুঃখের অনুল্লঙ্ঘনীয় সীমা হইয়া রহিল।”[৫]ঘটকের মধ্যস্থতায় বাবা-মায়ের অভিরুচি অনুসারে যে বিবাহরীতি আমাদের দেশে চলে আসছে, তা নির্দিষ্ট করে দাম্পত্যের করুণ পরিণাম। কেন-না এর ফলে বর-কনে পরস্পরকে জানতে বা বুঝতে পারে না, এমনকী বিয়ের আগে পরস্পরকে একবার দেখবার সৌভাগ্যও তাদের হয় না। ফলস্বরূপ প্রেম দূরস্থান, ‘কেবল প্রণয়ী ভর্তাস্বরূপ এবং প্রণয়িনী গৃহপরিচারিকাস্বরূপ হইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করে[৬]।’ বিয়েতে পাত্র-পাত্রীর ব্যক্তিগত রুচি-পছন্দকে বিদ্যাসাগর গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজও আমাদের সমাজে সম্বন্ধ করে বিয়ের রীতিই প্রচলিত। খুব সামান্য ক্ষেত্রে হলেও দেখা যায়, পাকা কথা হওয়ার আগে অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়েদের কিছুদিন মেলামেশার সুযোগ দেন। এতে তারা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া বা পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে। ফলে পরস্পরকে জেনে-বুঝে নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সুবিধে হয়। এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় আগামীদিনের বহু অবাঞ্ছিত-অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা তথা জটিলতা। তবে অধিকাংশ ছেলে-মেয়েই সে সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত। বরং নিজেদের পছন্দে বিয়ে করলে বা বিয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করলে তাদের নিন্দা-সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। অথচ আজ থেকে প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে বিদ্যাসাগর এই বিষয়ে সমর্থন জানিয়ে গিয়েছেন। আবার কেবল সমর্থন নয়, বলা ভালো তার সপক্ষে রীতিমতো সওয়াল করেছেন। বিয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন পাত্রীর মতামতকে—
“যে পতির প্রণয়ের উপর প্রণয়িনীর সমুদায় সুখ নির্ভর করে, এবং যাহার সচ্চরিত্রে যাবজ্জীবন সুখী ও অসচ্চরিত্রে যাবজ্জীবন দুঃখী হইতে হইবেক, পরিণয়কালে তাদৃশ পরিণেতার আচার ব্যবহার ও চরিত্র বিষয়ে যদ্যপি কন্যার কোন সম্মতির প্রয়োজন না হইল, তবে সেই দম্পতির সুখের আর কি সম্ভাবনা রহিল।”[৭]অর্থাৎ বিয়ে করে যার সঙ্গে একটি মেয়েকে সারাজীবন কাটাতে হবে, যার আচার-ব্যবহার, চরিত্র তথা মানসিকতার ওপর মেয়েটির ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখ নির্ভরশীল, তাকে জেনে-বুঝে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার মেয়েটির আছে। নয়তো দাম্পত্য সম্পর্কে সুখ অধরাই থেকে যাবে। যে সময়কালে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরুষের তুলনায় কোনো দিক থেকেই নারীদের বিবেচনায় আনা হতো না, সেই একই সময়ে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর মেয়েদের সুখের অধিকার, ব্যক্তিগত স্বাধীন মতামতের কথা চিন্তা করেছেন। মেয়ের ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা না করে কেবল ‘অসার কৌলীন্যমর্যাদা’[৮] রক্ষার তাগিদে মূর্খ অপ্রাপ্তবয়স্ক অযোগ্য পাত্রের হাতে কন্যাদান করার ভ্রান্ত অবিবেচনাপূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার বিরোধিতা করেছেন। বোঝা যায় প্রথা নয়; মানুষ, মানুষের সুখ-দুঃখই তাঁর কাছে প্রধান বিবেচ্য।
জীবের অন্যতম প্রধান কাজ বংশবিস্তার এবং বিয়ে সেই কাজেরই সামাজিক স্বীকৃতি। লেখক আক্ষেপ করেছেন যে, বিশ্বের সকল দেশে যেখানে এই বিবাহ প্রথা ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে চলেছে, সেখানে আমাদের দেশে তার গতি নিম্নমুখী। বাল্যবিবাহ তারই পরিচায়ক এবং একেই বিদ্যাসাগর আমাদের দেশের সর্বনাশের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন— “বর্তমান বিবাহনিয়মই অস্মদ্দেশের সর্বনাশের মূল কারণ।”[৯]
বিদ্যাসাগরের মতে শিক্ষাই মানবজীবনের সারকথা। বিদ্যাচর্চাই মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি বলেছেন—
“তাহাদিগের বিদ্যালোচনার বিষম ব্যাঘাত জন্মিবাতে সংসারের সারভূত বিদ্যাধনে বঞ্চিত হইয়া কেবল মনুষ্যের আকারমাত্রধারী, বস্তুতঃ প্রকৃতরূপে মনুষ্য গণনায় পরিগণিত হয় না।”[১০]শিক্ষাপ্রসারে বিদ্যাসাগরের যে বিপুল কর্মপ্রচেষ্টা, তার মূলে এই ভাবনাই ক্রিয়াশীল। আমাদের দেশে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিদ্যাসাগর চিহ্নিত করেছেন বাল্যবিবাহকে। কেন-না পড়াশোনার যে মুখ্য সময় অর্থাৎ বাল্য-কৈশোর, তা তারা বিবাহ-সংশ্লিষ্ট আমোদ-প্রমোদ ও কামকলাকৌশলের চর্চাতেই ব্যয় করে। শিক্ষাব্যতীত যথার্থ মানুষ হওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি শিক্ষার যে ব্যবহারিক উদ্দেশ্য অর্থাৎ উপার্জনশীলতা তাও ব্যাহত হয়। অথচ অল্পবয়সে বিবাহ ও সন্তানের আগমনে অর্থ উপার্জনের গুরুদায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় সংসারের প্রয়োজনে তারা সহজেই বিপথে পা বাড়ায়, কখনো-বা বাবা-দাদাদের গলগ্রহ হয়ে পড়ে। এতে তার বা তার পরিবার, কারোরই সম্মান থাকে না। সারাজীবন এই অসম্মানের অন্ধকারে ডুবে থাকতে তারা বাধ্য হয়। ফলে একদিকে দুর্বৃত্ত ও অন্যদিকে ব্যক্তিত্বহীন, আত্মমর্যাদাহীন মানুষে সমাজ ভরে ওঠে। যারা বলেন অল্পবয়সে বিয়ে না দিলে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে খারাপ কাজের প্রবণতা বাড়ে, তাদের যুক্তি খণ্ডন করে বিদ্যাসাগর বলেছেন যে, তরুণ প্রজন্মকে সুপথে পরিচালিত করার উপায় বাল্যবিবাহ নয়, বিদ্যাচর্চা। শিক্ষাই পারে মানুষের মনে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, বিবেক, ন্যায়বোধ, মানবিকতা জাগাতে। তাই বিবাহ নয়, শিক্ষাই বাল্য-কৈশোরের প্রধান চর্চিত বিষয় হওয়া উচিত।
নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও বিদ্যাসাগর উল্লেখ করেছেন। নারীর নিজের জন্য যেমন তা জরুরি, তেমনি অপরিহার্য সন্তানের জন্য। ইউরোপীয়দের সঙ্গে আমাদের তুলনা করে তিনি বলেছেন, তাদের জননীরা শিক্ষিত বলে সন্তানেরাও মায়ের শিক্ষায় অল্পবয়সেই বিচক্ষণ ও সভ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বাল্যবিবাহের কারণে এদেশের মেয়েরা শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। হাতেগোনা কয়েকজন সৌভাগ্যবতী বাবার বাড়িতে পড়াশোনা শুরু করলেও, শ্বশুরবাড়িতে তা আর স্থায়ী হয় না—
“পরগৃহবাসিনী হইয়া তাহাকে পরের অধীনে শ্বশ্রূ শ্বশুর প্রভৃতি গুরুজনের ইচ্ছানুসারে গৃহসম্মার্জন, শয্যাসজ্জন, রন্ধন, পরিবেষণ ও অন্যান্য পরিচর্যার পরিপাটী শিক্ষা করিতে হয়। পিতৃগৃহে যে কয়েকটি বর্ণের সহিত পরিচয় হইয়াছিল, তৎসমুদায়ই স্থালী, কটাহ, দর্ব্বী প্রভৃতির সহিত নিয়ত সদালাপ হওয়াতে একেবারেই লোপ পাইয়া যায়।”[১১]অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরা প্রবেশ করে শিক্ষার এক স্বতন্ত্র আঙিনায়। সেখানে গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজকর্ম আয়ত্ত করাই তাদের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়। সবসময় হাঁড়ি, কড়াই, হাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পড়াশোনার সুযোগ তারা পায় না। শ্বশুরবাড়ির এই প্রতিকূল পরিবেশ যে নারীর শিক্ষার পথে অন্যতম প্রধান বাধা, বিদ্যাসাগরের উক্তিতে তা স্পষ্ট। নিজেরা অশিক্ষিত হওয়ায় সন্তানদের শিক্ষাদানে তারা কোনো ভূমিকাই নিতে পারে না। অথচ শিশু মায়ের কাছ থেকেই সবচেয়ে ভালোভাবে শিখতে পারে। বিদ্যাসাগরের অভিমত—
“সন্তানের হৃদয়ে জননীর উপদেশ যেমন দৃঢ়রূপে সংসক্ত হয় ও তদ্দ্বারা যতশীঘ্র উপকার দর্শে, অন্য শিক্ষকের দ্বারা তাহার শতাংশেরও সম্ভাবনা নাই, জননীর উপদেশকতাশক্তি থাকাতেই ইউরোপীয়েরা অল্প বয়সেই বিচক্ষণ ও সভ্যলক্ষণসম্পন্ন হয়।”[১২]মনোবিদ্যার আধুনিক গবেষণায় জানা যায়, যেহেতু খাওয়া-পরা, যত্ন, সুরক্ষা, আরাম-স্বাচ্ছন্দ্য এই সমস্তকিছুর জন্য শিশু মায়ের ওপর নির্ভরশীল; সেই কারণে শৈশবে মায়ের সাথেই তারা সবচেয়ে বেশি একাত্মতা বোধ করে। ‘An Autobiographical Study’ গ্রন্থে ফ্রয়েড বলেছেন— “…the first love-object in the case of both sexes is the mother; and it seems probable that to begin with a child does not distinguish its mother’s organ of nutrition from its own body.”[১৩] আর যার সাথে শিশুর একাত্মতা গড়ে উঠবে, শিশু যে তার দ্বারাই প্রভাবিত ও পরিচালিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। তাই মায়ের কাছ থেকে শিশু যত তাড়াতাড়ি ও ভালোভাবে শিখতে পারে, আর কারও কাছে তা সম্ভব নয়। নারীশিক্ষার সপক্ষে বিদ্যাসাগরের যুক্তিতে যে গভীর মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিচয় মেলে, তা সেযুগের প্রেক্ষিতে সত্যিই বিস্ময়কর।
বিয়ের মূল উদ্দেশ্য বংশগতি রক্ষা করা। অল্পবয়সে বিয়ের ফলে অপরিণত শরীরে যে সন্তান জন্মায়, তা হয় মৃত অবস্থায় নাহলে দুর্বল-অসুস্থ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয় এবং অল্পকাল পরেই মারা যায়। অর্থাৎ বাল্যবিবাহের ফলে বিয়ের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। বিদ্যাসাগর বলেছেন—
“দুর্বল কারণ হইতে সবল কার্যের উৎপত্তি কদাপি সম্ভবে না। যেমন অনুর্বরা ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট বীজ বপন এবং উর্বরা ক্ষেত্রে হীনবীর্য বীজ রোপণ করিলে উৎকৃষ্ট ফলোদয় হয় না, সেইরূপ অকালবপনেও ইষ্টসিদ্ধির অসঙ্গতি হয়।”[১৪]তাই বাল্যবিবাহের ফলে যে সন্তানের আগমন ঘটে, তারা কেবল শারীরিক দিক থেকেই দুর্বল নয়, প্রকৃতিতেও হয় ভীরু অলস উদ্যমহীন। ভারতবর্ষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সেখানে বীরপুরুষের অভাব নেই। একটু মনোনিবেশ করলেই চোখে পড়ে, এঁরা কেউই বাঙালি হিন্দু নন। বিদ্যাসাগর ভারতবর্ষের পশ্চিম ও পূর্ব অংশে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে তুলনা করে দেখিয়েছেন, পশ্চিম ভারতীয়দের তুলনায় বাংলাদেশ ও ওড়িশার মানুষ অনেক দুর্বল ও ভীরু। তার কারণ ভারতবর্ষের পশ্চিম অংশে বেশি বয়সে বিবাহের রীতি প্রচলিত। আর এই অঞ্চলে প্রচলিত বাল্যবিবাহ। ফলে সৈন্যবাহিনী ইত্যাদি সাহসিকতার কার্যে বাঙালিদের অংশগ্রহণ নগণ্য। একজন শারীরবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে যে যুক্তি তিনি দিয়েছেন, তা অকাট্য। কেন-না কেবল প্রাপ্তবয়স্ক পরিণত নর-নারীর মিলনেই সুস্থ সবল সন্তানের আবির্ভাব সম্ভব। ফলে বাল্যবিবাহ সামগ্রিকভাবে একটি জাতিকেই পিছিয়ে দেয়, শারীরিক-মানসিক উভয় দিক থেকে।
বিদ্যাসাগর দেখিয়েছেন বিধবার সংখ্যাধিক্যের অন্যতম প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ, যেহেতু বিশ বছর বয়সের মধ্যে মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বলা যায়, বাল্যবিবাহের করুণতম পরিণতি বৈধব্য। আমাদের দেশে বৈধব্যযন্ত্রণা নরকযন্ত্রণার সমতুল্য। স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নারীর জীবনে সমস্ত আনন্দ আহ্লাদের অবসান ঘটে। বিদ্যাসাগরের উপলব্ধি, ‘বিধবার জীবন কেবল দুঃখের ভার’[১৫]। তাদের সারা জীবন কাটে অপরিসীম যন্ত্রণা, ত্যাগ আর কঠিন-কঠোর ব্রত-উপবাস পালনের মধ্য দিয়ে—
“যে কঠোর ব্রহ্মচর্য ব্রতাচরণ পরিণত শরীর দ্বারাও নির্বাহকরণ দুষ্কর হয়, সেই দুশ্চর ব্রতে কোমলাঙ্গী বালিকাকে বাল্যাবধি ব্রতী হইতে হইলে তাহার সেই দুঃখদগ্ধ জীবন যে কত দুঃখেতে যাপিত হয়, বর্ণনা দ্বারা তাহার কি জানাইব।”[১৬]তাছাড়া শ্বশুরবাড়িতে বিধবা নারীর বিপথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনাও বিপুল। বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই যন্ত্রণা ও সহানুভূতিবোধ থেকেই তিনি পরবর্তীকালে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করতে উদ্যোগী হন। সেকালের সাধারণ মানুষ, এমনকী বিধবাদের কাছেও যে লোকাচার ও শাস্ত্রবিধি ছিল প্রশ্নাতীত ও দুর্লঙ্ঘনীয়, তার নিষ্ঠুরতা ও অযৌক্তিকতা কিন্তু বিদ্যাসাগরের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ে তাঁর মন্তব্য—
“উপবাস দিবসে পিপাসা নিবন্ধে কিংবা সাংঘাতিক রোগানুবন্ধে যদি তাহার প্রাণাপচয় হইয়া যায়, তথাপি নির্দয় বিধি তাহার নিঃশেষ নীরস রসনাগ্রে গণ্ডূষমাত্র বারি বা ঔষধ দানেরও অনুমতি দেন না।”[১৭]নারীর সমস্ত যন্ত্রণার মূলে যে বাল্যবিবাহ, তাকে বিদ্যাসাগর তুলনা করেছেন দুঃখের সাগরে প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে এবং দেশবাসীর কাছে তাঁর অনুরোধ—
“অতএব আমরা বিনয়বচনে স্বদেশীয় ভদ্র মহাশয়দিগের সন্নিধানে নিবেদন করিতেছি, যাহাতে এই বাল্যপরিণয়রূপ দুর্নয় অস্মদ্দেশ হইতে অপনীত হয়, সকলে একমত হইয়া সতত এমত যত্নবান্ হউন।”[১৮]তাঁর এই আবেদন একালেও সমান প্রাসঙ্গিক। কারণ উনিশ শতকের মধ্যভাগে যে সমস্যার সুদূরপ্রসারী কুফল বিষয়ে বিদ্যাসাগর সোচ্চার হয়েছিলেন, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাতে সামান্যই অগ্রগতি চোখে পড়ে। বাল্যবিবাহ না থাকলেও একালের বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে নাবালিকাবিবাহ। আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বহু অভিভাবক তাদের নাবালিকা কন্যার বিয়ে দিয়ে দেন। ঠিক-ভুল বুঝে ওঠার আগেই অপরিণত দেহ-মনে শুরু হয় সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশে অভিযোজন। সংসারের গুরু দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পড়াশোনার ইতি ঘটে সেখানেই। একজন নারীর মধ্যেও লুকিয়ে থাকে যে অমিত সম্ভাবনার বীজ, গোড়াতেই তার মূলোচ্ছেদ হয়। সংসারের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় নারী নিজেকে প্রমাণ তথা প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় না। পরিণামে বঞ্চিত হয় সমগ্র সমাজ তথা রাষ্ট্র। জনসচেতনতা বাড়াতে কন্যাশ্রীর মতো সরকারি উদ্যোগ ও কিছু নাবালিকা বীরাঙ্গনার স্বতঃপ্রণোদিত প্রতিবাদ নিবিড় অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো জ্বেলে রাখে। বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেক্ষিতে তাই সহজেই বোঝা যায় সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে থাকা মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর, আবির্ভাবের দুশো বছর পরও যাঁর দোসর মেলা ভার।
তথ্যসূত্র:
১. শ্রীঈশ্বরচন্দ্রশর্ম্মা, ‘বাল্যবিবাহের দোষ’, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা: দেবকুমার বসু, প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ, ১লা বৈশাখ ১৩৮১, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা-৯, পৃ: ২৪৮।
২. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪১।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪১।
৪. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪২।
৫. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৩।
৬. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৩।
৭. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৩।
৮. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৩।
৯. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৩।
১০. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪১।
১১. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৫।
১২. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৫।
১৩. Freud, S., ‘An Autobiographical Study’, Freud-Complete works, edited by Ivan Smith, 2010, Retrieved from: https//www.valas.fr>IMG>pdf>Freud…, Accessed on: 20.06.17, Time: 8.00PM, P. 4212.
১৪. শ্রীঈশ্বরচন্দ্রশর্ম্মা, ‘বাল্যবিবাহের দোষ’, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা: দেবকুমার বসু, প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ, ১লা বৈশাখ ১৩৮১, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা-৯, পৃ:২৪৪।
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৭।
১৬. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৭।
১৭. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৭।
১৮. প্রাগুক্ত, পৃ:২৪৭।