• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮০ | অক্টোবর ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • 'দূরপন্থচারী’ কবি সুচেতা মিত্রকে নিয়ে : শম্পা রায়


    একদিকে বহির্ভারতে আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠা অন্যদিকে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু—১৯৪৩ খ্রি.র এই দুই ঘটনায় সারা দেশে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও কলকাতার ভবানীপুরে টাউন্স এন্ড রোডের ১৬নং বাড়িটি তখন আনন্দমুখর। ওই বছরই ২৫শে জুন জন্ম হয়েছে অধ্যাপক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য ও গৌরী ভট্টাচার্যের জ্যেষ্ঠ কন্যা সুচেতার, শৈশব থেকেই যার চরিত্রে – ব্যক্তিত্বে – চিন্তা – চেতনা – কর্মধারায় লক্ষ করা গিয়েছিল কালের আগ্নেয়দীপ্তি।

    পিতৃবংশ এবং মাতৃকূলের পারিবারিক উত্তরাধিকার অনুযায়ী সুচেতাও ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। ছোটো থেকেই পড়াশোনায় তুখোড়; পাশাপাশি অপূর্ব রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং কীর্তন গাইতেন, সুমধুর আবৃত্তি করতেন, ছন্দোময় কাব্যভাষায় চিঠি লিখতেন বহু প্রবীণ সাহিত্যিককে (পত্রপ্রাপকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক)। এছাড়া ছবি আঁকাতেও অত্যন্ত সাবলীল ছিলেন তিনি। শৈশবে হাতেখড়ির আগেই মুখেমুখে ছড়া বানিয়ে ফেলতেন আর লিখতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে কবিতায় ভরে উঠল বেশ কিছু খাতা। বস্তুত বিশিষ্ট শিশুপত্রিকা রামধনুর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য এবং সম্পাদক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের উত্তরসূরিত্বের দায়বদ্ধতা নিয়েই ‘সাহিত্যিক’ সুচেতার গড়ে ওঠা। ছোটোবেলা থেকেই লেখালিখির প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ছিল তাঁর। ঠাকুমা শৈলবালা, মা গৌরী, দাদামশাই নিবারণচন্দ্র এবং জেঠু মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য—এঁরা সবাই লেখার জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়েছিলেন। এঁদের দেখাদেখি এবং বংশধারা সূত্রে প্রাপ্ত সাহিত্যপ্রীতি সাত বছর বয়সেই সুচেতাকে সাহিত্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৫০এর রামধনু পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রথম কবিতাঃ

    সোনা ঘুমাল মায়ের পাশে রাত্রি হল ওই,
    চাঁদ এসে যে ডাকছে সোনায়—-“মুখটি তোমার কই?
    একটুখানি মুখটি তোল, টিপ পরিয়ে দি,
    মিষ্টিমাখা মুখ যে এমন কোথাও দেখিনি।” [সোনা ঘুমাল]

    রামধনুর পাশাপাশি সেকালে ছোটোদের প্রায় সমস্ত পত্রিকাতেই সুচেতা কবিতা লিখেছেন। সেইসঙ্গে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। মিতা, ছুটির বাঁশি, সপ্তডিঙা সহ আরো কয়েকটি হাতে লেখা পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যা অ-পরিণত বয়সে তিনি প্রকাশ করেছেন, যার গল্প–কবিতা–প্রবন্ধের অধিকাংশই তাঁর একক সৃষ্টি। সমান্তরালে ছিল পত্রিকা সম্পাদনাও। প্রথমে রামধনু (সহকারী সম্পাদক) এবং ১৯৬৯–১৯৮৪ পর্যন্ত জীবনানন্দ কবিতাপত্রিকার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে গেছেন সুচেতা। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার পাশাপাশি গদ্য লেখাতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এমনভাবে লেখালিখি করতে করতেই সুচেতা প্রকাশ করে ফেললেন চারটি কাব্যগ্রন্থঃ

    প্রান্তরে সূর্য বদলের ছায়া ( প্র. প্র. ১৯৬৮)—বাবা ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণকে উৎসর্গ করা কাব্যটি একইসঙ্গে কবির জীবন ও সমকালের রূপবদলের প্রতিবিম্ব।

    কঙ্কাবতীর জন্যে ( প্র. প্র. ১৯৭১)—স্বামী অধ্যাপক পলাশ মিত্রের সঙ্গে যুক্তভাবে রচিত এই বইতে কবির মাতৃত্ববোধ, বাৎসল্যময় সত্তার প্রকাশ ঘটেছে।

    প্রসারিত দক্ষিণবাহু ( প্র. প্র. ১৯৭২)—ঊনচল্লিশটি কবিতা নিয়ে রচিত এই কাব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কবি ইঙ্গিত দিয়েছেন বইয়ের প্রচ্ছদ নামপত্রে, আট পঙ্‌ক্তির একটি গানেঃ

    “হিয়ায় লুকানো বঁধু লোকে যদি জানে।
    পরাণ কোটরা ভরি রাখিব যতনে।। …
    দুই অঙ্গ ঘুচাইয়া এক অঙ্গ হইব।
    বলুক বলুক লোকে মন্দ তাহা না শুনিব।।” [ময়মনসিংহ গীতিকা]

    ওপরের ছত্র ক’টি স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেয় যে প্রেম এবং তৎসংক্রান্ত বিচিত্র অনুভবই কাব্যটির মূল প্রতিপাদ্য।

    দূরপন্থচারী (প্র. প্র. ১৯৮৫)—নারীমানসের দুঃখ বেদনা নিঃসঙ্গতা এই কাব্যের স্থায়ী ভাব। তবে কবির দেখার ভঙ্গিটি স্বতন্ত্র, কন্ঠস্বর নিজস্ব। প্রতিশ্রুতি চিহ্নিত এক স্বাদ বয়ে আনে এই কবিতা গুচ্ছ।

    প্রথম ভালোলাগা ও ভালোবাসা কবিতা হলেও সুচেতা ছিলেন নিষ্ঠাবান প্রাবন্ধিকও। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ দুটি হলঃ

    ১. শব্দের শরীরী প্রতিমা (১৯৮৫)—আধুনিক বাংলাকবিতার দেহ ও আত্মা নিয়ে রচিত এই গ্রন্থ লেখকের পরিণত মনন ও রসভাবনার যৌগিক নিদর্শন।

    ২. আমি সেই পুরোহিত—জীবনানন্দ দাশের কবিতার আলোচনা সমৃদ্ধ এই বইটি প্রথম বের হয় ১৯৮৫ খ্রি.।

    কবি এবং প্রাবন্ধিক হিসেবে সুচেতা মিত্র ছিলেন মননশীলতায় পরিমার্জিত, প্রমায় পরিশীলিত, অধ্যবসায়ী। কিন্তু এমন প্রতিভাময়ী ব্যক্তিত্ব তাঁর আশৈশব সঙ্গী হাই ব্লাডপ্রেশারের কারণে ১৫ই জুন, ১৯৮৫ খ্রি. মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে অকালে চলে যান। রেখে গেলেন নিজের রচনাসম্ভার ছাড়াও একমাত্র কন্যা, অগণিত মুগ্ধ পাঠক, প্রিয়জনকে।

    প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশকালের হিসেবে সুচেতা মিত্র ছয়ের দশকের কবি, সময়ের মানদণ্ডে যা স্বপ্নদর্শন আর স্বপ্নভঙ্গের কাল। ইতিহাস জানাচ্ছে, ছয়–সাতের দশক জুড়ে পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতিতে যে ঘন ঘন পট পরিবর্তন চলছিল সেই উত্তালতা ছুঁয়ে গিয়েছিল সমকালীন সাহিত্যকেও। প্রসঙ্গত স্মরণীয় এই সময়ের ‘হাংরি সাহিত্য আন্দোলন’। কিন্তু রাজনীতি ও সাহিত্য–সংস্কৃতির এই সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝখানে সুচেতা মিত্র যেন থেকেও ছিলেন না। ষাট এবং সত্তরের দশকের ঘটনাবলির অন্তর্নিহিত স্রোতের সারাংশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েও তিনি আত্মমুখী। তবে সমকাল – সমাজ এবং রাজনীতিকে সচেতনভাবে বর্জন করলেও প্রেম, প্রকৃতি, বাৎসল্য—এককথায় জীবনাকাঙ্ক্ষা নিয়ে গৃহস্থজীবনের অনায়াস নিয়মকলায় যে কোমল পরিপূর্ণতা ব্যাপ্ত, তাকে বিশেষ রূপেই পাওয়া যায় এই কবির লেখায়ঃ

    লাল অঙ্গুরীয় দিলে। উত্তেজিত অনামিকা তার
    প্রসন্ন চুম্বন পেলো স্মরণীয় সন্ধ্যার আলোকে।
    প্রিয়, প্রসারিত কর তোমারি সম্মুখে দেখো চেয়ে
    সমুদ্রের ঢেউ বুকে স্পন্দন তোমারি অনুগামী। [অভিজ্ঞান; প্রসারিত দক্ষিণ বাহু, পৃ. ৪৬]

    এইধরনের ইতিবাচকতার পাশাপাশি জীবনের আরো গভীরে যে কান্না, প্রেমহীনতা, ভালোবাসা নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া মানুষের, বিশেষত নারীর দহন—সেইসব বিক্ষোভও গোপন থাকে না সুচেতার কবিতায়। দূরপন্থচারী কাব্যের ‘পরবাসে’ কবিতাটিকে অপ্রেমের ভাষ্য রূপে তুলে ধরা চলেঃ

    পরবাসে কাটে দিন
    অসুখে বিষণ্ণ শয্যা পড়ে থাকে মমতাবিহীন।
    শুশ্রূষা দূরত্ব রাখে, সেবা ভুলে যায় আচরণ
    স্বজন – বান্ধবহীন অন্ধকারে
    এমন কঠিন এই নির্বাসন - ভূমে
    কি করে কাটাবে কাল ? [পৃ. ৫৯]

    জীবনের তিক্ত–মধুর অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ কবি অল্প বয়সেই জেনেছিলেন,

    আমি আজন্মের নিঃসঙ্গ পথিক।
    আমার জন্য কেউ নয়। [নদীর সঙ্গে; দূরপন্থচারী, পৃ. ৬১]

    প্রিয়তমজনদের নিয়ে সাজানো গৃহকোণের স্রষ্টা যখন এমন উচ্চারণ করে তখন বুঝতে ভুল হয় না যে সেই গৃহস্থালি কত ঠুনকো। এই শ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে কবি আশ্রয় পেতে চেয়েছেন প্রকৃতির কাছেঃ

    হাত বাড়ালেই পাবো অতি ছোটো পাতাবাহারের
    ঘনিষ্ঠ বাগানখানা, বড়ো সড়ো সহকার শাখা
    দেবদারু নিম কিংবা শাল – মহুয়ার প্রসারতা,
    কখনো আকাঙ্ক্ষা নয় স্বপ্ন কিংবা দূর পরবাস। [স্বস্তি; প্রসারিত দক্ষিণ বাহু, পৃ. ১৬]

    অনুভবজাত এমন সমস্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তথা কবিতা নির্মাণে দৈবীপ্রতিভা বা প্রভাবে সুচেতার আস্থা ছিল না। বরং ‘আত্মক্ষয়ে কবিতার জন্ম হয়’—কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের এই ধারণায় সমর্থন ছিল তাঁর। তাই এই কবির রচনা বহুলাংশেই আত্মজৈবনিক, কখনো বা স্মৃতিনির্ভর, স্বীকারোক্তিমূলক। তাত্ত্বিকতা, বক্তব্যধর্মিতা কিংবা সামূহিক কোনো আবেগমোচন তাঁর কবিতাগুচ্ছে বিরলদৃষ্ট। জীবন ও জীবনের চারপাশ সুচেতার কবিতায় স্থায়ী পটভূমি হয়ে থেকে গেছে। শ্রম ও স্বতঃস্ফূর্ততা, মেধা ও আবেগের বৈপরীত্যে মণ্ডিত অজস্র বর্ণমালার পরিক্রমায় তিনি, ব্যক্তিগত জীবন ও এর নিকটতম অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি থেকে অবিরত যে অনুপ্রবেশ ধৃত হয়েছে তাঁর অবচেতনায়, সেইসব বিষয়কেই অনায়াসে শিল্পসম্মত করে তুলেছিলেন। বলা চলে, একজন অতি সংবেদনশীল অন্তর্মুখী মানুষের ডায়েরি যেন সুচেতা মিত্রের কবিতামালা। তিনি জানতেন ‘ভালোবাসা’ হল জীবনের এক ‘অরূপরতন’, যা …কবেকার/ প্রথম পূর্ণিমার আলো। [প্রসারিত দক্ষিণ বাহু, পৃ. ১৫ ];

    পাশাপাশি অপচয়, বয়ে যাওয়া, ক্ষয়ক্ষতিও জীবনে ‘অনিবার্য’—

    আমার প্রত্যেক দিন বিষণ্ণ মাঠের ধুলো হয়ে,
    বালকের মতো কোনও কুড়োনো – পাখির – ডানা নিয়ে;
    আমি কি চেয়েছি, তবু
    বিশ্বস্ত হাতেই সব কিছু
    ঘটে গেছে নির্বিকার। [ওই, পৃ্‌. ২২ ]

    এই মরমি ভাব তাঁর কবিতাকে যেমন এক স্নিগ্ধ নিরভিমান মর্যাদা দিয়েছে, তেমনি গভীর আত্মখননময়, আবেগার্ত কবিতার রচয়িতা রূপে সুচেতা মিত্র হয়ে উঠেছেন রোমান্টিকতার এক আধুনিক রূপকার।

    একথা অবশ্যস্বীকার্য যে, কোনো কবিই উত্তরাধিকারের দায় থেকে মুক্ত নন। তবে তিনি কীভাবে ওই দায়ভাগ থেকে নতুন দায়িত্ববোধ তৈরি করে নেবেন, সেটাই হল মৌল বিবেচ্য। রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ—এই দুই প্রিয়তম পূর্বসূরির কাছে সুচেতার ঋণ অসীম। এঁদের রচনার শিরোনাম, ভাব, প্রকরণ তাঁর বহু কবিতায় ছড়ানো। দুজনেই এঁরা আত্মিক শক্তিতে কবিতাকে বলিষ্ঠ করে তুলতে চেয়েছেন। একই ভাবনার অনুসারী ছিলেন সুচেতাও। তাই কবিতাকে শিল্পের বহিস্থ কোনো অভিপ্রায়ে ব্যবহারে তাঁর অনীহায় কবিতাশিল্পের অন্তর্গত স্বাভিমান সতত সক্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথকে ‘বিষয়’ করে তিনটি কবিতা লিখেছিলেন কবি—‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথ-কে’, ‘বাইশে শ্রাবণ’। সেখানে তিনি মুক্তকন্ঠে পূর্বজ কবির অধমর্ণতা স্বীকার করেছেন; প্রতি মুহূর্তে, অবচেতনেও তাঁকেই স্মরণ করেছে তাঁর কবিসত্তা। আর নিজের প্রিয় কবি জীবনানন্দের দ্বারা সুচেতা প্রভাবিত হয়েছিলেন কবিতার রূপ নির্মাণের ক্ষেত্রেও। একই শব্দ, শব্দবন্ধ বা বাগবন্ধকে বারবার ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এক স্বরচিত ঘরানা ছিল জীবনানন্দের। যেমনঃ

    ‘একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়
    একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
    একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
    তবে আমি হেঁটে চলে যাবো মানে মানে … ’ [ভিখারী]

    আগের অংশটিকে একটু বাদ দিয়ে, অর্থের আরো প্রচ্ছায়া যোগ করতে করতে এই জীবনানন্দীয় চলন সুচেতার লেখারও একটি বৈশিষ্ট্যঃ

    কোথায় কীভাবে যাবো, কে বলবে
    এইদিকে পথ ,
    এইদিকে পথ, ফেরো সরল স্পষ্ট চোখে
    ঋজুবুধ তাকাও খানিক।
    আলো যদি ভ্রষ্ট হয়, হোক;
    তবু এইদিকে পথ, তুমি ফেরো। [এইদিকে পথ, দূরপন্থচারী; পৃ. ১৮ ]

    তবে এই বৈশিষ্ট্য কবির রচনায় সর্বাত্মক নয়। আর, বোধের যে গভীরতা ও যন্ত্রণা জীবনানন্দের ছিল সুচেতার তা দুর্লভ, সময়ের যে বেদনা জীবনানন্দের কবিতায় অনুভূত হয় তা সুচেতার রচনায় সহজপ্রাপ্য নয়। বস্তুত সাম্প্রতিকতা, সময়ের উপকরণগত বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ বা এর অনুপস্থিতি জনিত যন্ত্রণাবোধ—এসবের কোনোটিই সুচেতা মিত্রের কবিতায় নেই। তাঁর সৃষ্টি পাঠককে কোনো বিশেষ সামাজিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে না, মানবিক সম্পর্কের মহত্ব বিষয়েও তাঁর কাছে নতুন শিক্ষণীয় কিছু নেই। সুচেতার সমসময়ে ‘নারীবাদী’ কবিতায় দেখা গেছে দুটি ধারা—একটিতে শোনা যেত নারীর সমানাধিকার এবং স্বাধীনতা সম্পর্কিত দৃপ্ত, বলিষ্ঠ উচ্চারণ। এক্ষেত্রে প্রথমেই রাখতে হবে কবিতা সিংহকে। পরবর্তী সময়ে তাঁর ভাবনার শরিক হয়েছেন কৃষ্ণা বসু, মল্লিকা সেনগুপ্ত সহ অনেকেই। নারীজীবন নিয়ে ভার্জিনিয়া উলফ্, সিমোন দ্য বেভোয়ার প্রমুখের চিন্তা ও বক্তব্য দ্বারা প্রাণিত হয়ে এঁরা সেই বিকল্প বিশ্বের অনিবার্যতা অনুভব করেছেন যেখানে পৌঁছোলে নারীর সমস্ত অসহায়তা ও লাঞ্ছনা অবসিত হবে, জন্ম হবে নতুন নারীর, ক্ষমতার নির্যাতন ও স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত হয়ে যে বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত জীবন কাটাতে পারবে। কিন্তু এই নারীবাদী মনোভাবের সমান্তরাল কবিতায় ছিল নারীঅভিজ্ঞতার বিপুল উন্মোচন, যে অভিজ্ঞতার যাবতীয় স্বরূপ কোনো নারীই একমাত্র উপলব্ধি করতে পারে। অনুরাধা মহাপাত্র, গীতা চট্টোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, রমা ঘোষ, রাজলক্ষ্মী দেবীর কলমে রয়েছে নারীর সেই হৃদমাঝারের সংবাদ। নারীত্বের অনুভব ও বিচিত্র বন্ধনমুক্তির আকাঙ্ক্ষা, পুরুষের ভালোবাসার প্রতি তীব্র আর্তি, মাতৃত্বের অনুভব, নিঃসঙ্গতা ও একঘেয়েমিকে এঁদের মতোই নিজের কবিতাভাবনায় প্রাধান্য দিলেও সুচেতা মিত্রের কবিতার মেজাজ অনেক বেশি প্রত্যক্ষ, গম্ভীর, চিত্রময় ও ব্যঞ্জনাধর্মী। এখানেই সমকালীনদের তুলনায় তাঁর স্বকীয়তা স্বয়ংপ্রকাশিত।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments