ক্যালিফোর্নিয়া সুন্দর আবহাওয়ার জন্য সারা বছরই নানারকম পাখিতে ভরা। জলচর পাখিদের জন্য অনেক নদীনালা ও জলাজঙ্গলও আছে। সেইরকমই একটি জায়গায় দুদিন কাটিয়ে এলাম।
জায়গাটি উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায়, রাজধানী স্যাক্রামেন্টো থেকে পঞ্চাশ-ষাট মাইল দক্ষিণে, স্যাক্রামেন্টো নদীর মোহনার কাছে। সেইখানে আরেকটি নদী স্যান ওয়াকিম মিলেছে। নদীর শাখা-প্রশাখা আর বদ্বীপগুলি আশেপাশের জলাজঙ্গলে মিলে পাখিদের জন্য বেশ নিভৃত, নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছে। নদীতে প্রচুর মাছ আর জলাডাঙ্গা ব্যাঙ, শামুক ইত্যাদিতে ভরা। স্থানীয় পাখি ছাড়াও প্রতি বছর শীতের সময় ঝাঁকেঝাঁকে পরিযায়ী পাখিরাও আসে উত্তর ক্যানাডা ও আলাস্কা থেকে। এদের দেখতে হলে জলেই নামতে হবে, ডাঙা থেকে এদের দেখা পাওয়া যায় না। সবথেকে ভালো উপায় নিঃশব্দ মোটর-বিহীন ক্যানো বা কায়াক, যাতে চড়ে পাখিদের খুব কাছে যাওয়া যায়। ফোটো তোলার উত্তম উপায়। কিন্তু নৌকো বাওয়ার পরিশ্রম আছে, তাছাড়া আমরা দশ-বারো জনের দল, তাই আমাদের জন্য একটি ছোটো মোটরবোট রিজার্ভ করা হয়েছিল। পাখিরা অবশ্য নৌকো-টৌকোর কোনো তোয়াক্কা করে না (ঠিক ডাঙায় গাড়ির মতই)। আমাদের নৌকো থেকে মাত্র দশহাত দূরেই পাখিরা একেবারে নির্ভয়। কিন্তু নৌকো থেকে নামলেই সবাই তক্ষুনি উড়ে যাবে।
বোটের ক্যাপ্টেন ও পাখির গাইড দুজনে স্বামী-স্ত্রী এবং সব কাজে দক্ষ। নৌকো চালানো, টুরিস্টদের আবদার সামলানো, পাখি খোঁজা, নদীনালার ইতিহাস--জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ! ঐ ইতিহাসের লেকচারটিতে কিন্তু আমি একদম কান দিইনি, আমি পাখি নিয়েই মস্ত ছিলাম। পাঠকরা মাফ করবেন, নদী দুটির নানারকম বাঁধ, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ষেতখামারের জলসেচন এবং তাই নিয়ে অনেক বাদবিবাদের ইতিহাস আছে, আমি তার কিছুই শুনিনি।
পাখিদের বিচরণ সর্বত্র। মাথার ওপরে একটা ব্রিজ, তারই নীচে একটা লোহার বীমের খাঁজে বাসায় বসে একটা বাজপাখি! পেরেগ্রীন ফ্যালকন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও তীব্র গতিতে সে অন্য সব পাখিদের ছাড়িয়ে যায়। ভাগ্যিস আমাদের গাইড দেখিয়ে দিয়েছিল, আমি তো ব্রিজের নীচে তাকাবার কথাও ভাবিনি। জলের ওপর অন্য ধরনের চিল ও হক ওড়াউড়ি করতে দেখলাম। রেড টেল হক বলে এক বিরাট বাজপাখি এখানে প্রচুর। প্রত্যেকটি গাছের গুঁড়ি বা টেলিফোন পোস্টের ওপর একটি রেড টেল হক অবশ্যই মজুত।
ফ্যালকনের মতই আরেকটি পাখি গাইডের সাহায্য ছাড়া কক্ষনো খুঁজে পেতাম না — হুতোম পেঁচা বা গ্রেট হর্নড আউল। ঘন পাতাহীন ডালপালার পেছনে লুকিয়ে ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু ঠিক গাইডের চোখে পড়ে গেল। দেখুন তো ছবিতে দেখতে পান কিনা।
খোলা নদীতে পানকৌড়িদের আনাগোনা। এখানে সেখানে বসে দুই ডানা মেলে রোদ পোয়াচ্ছে। আরও আছে বিরাট ধূসর-নীল রঙের গ্রেট ব্লু হেরন, জলের ধারে মাছ, ব্যাঙ, শামুক ইত্যাদি খায়। শীতের শেষে উঁচু গাছের ডালে বাসা বেঁধেছে। বিরাট পাখিদের ভারে গাছ নুয়ে পড়ে।
কোথাও কোথাও খোলা মাঠ চোখে পড়ে। ধানের মাঠ জলে ভরা। ঝাঁকে ঝাঁকে রাজহাঁস নেমেছে — এরা প্রধানত দু ধরনের-- ধুসর-সাদা হোয়াইট ফ্রন্টেড গুজ আর পুরো শাদা স্নো গুজ। শ’খানেক স্নো গুজ যখন মাঠে নামে, মনে হয় মাঠ ভর্তি পেঁজা তুলো। এদের আশেপাশে ঘুরঘুর করে চিল, ঈগল ও বাজপাখিরা। পেটে খিদে আর মনে আশা কোনও দুর্বল, আহত বা বাচ্চা পাখি যদি ধরতে পারে।
মোহনার কাছে নদী যেখানে বেশ চওড়া ও গভীর, বেশ কয়েকটা ক্যালিফোর্নিয়া সি-লায়ন দেখলাম। বাচ্চারা জলে সাঁতার কেটে খেলছে আর বড়রা নদীর পাড়ে বা জেটির খুঁটিতে চড়ে রোদ্দুর পোয়াচ্ছে। এদের খাওয়ার জন্য নদীতে মাছ প্রচুর, স্যান ওয়াকিম নদীতে স্যামনও আসে শুনলাম।
সি-লায়ন ছাড়াও নদীতে মাঝেমাঝে আসে ডলফিন এমনকি তিমিও! নদীর ধারে একটা ছোট্ট শহর রিও ক্রিস্তো, মোহনা থেকে প্রায় ষাট মাইল, সেখানে এক বছর একটা হাম্পব্যাক তিমির আবির্ভাব হয়েছিল। শহরবাসীরা আদর করে নাম দিয়েছিল ‘হামফ্রি’। সে সমুদ্রে ফিরে যাবার পর একটা স্মৃতিফলক পর্যন্ত বানিয়ে রেখেছে।
জলাজঙ্গলে কতোরকমের পাখি। খোলা জলে বিরাট সারস — মিউট আর তুন্দ্রা--দুই জাতির পাখি, মিউটের ঠোঁটে টুকটুকে লাল রং। ব্যাস, ঐটুকুই পার্থক্য। নানারকমের পাতিহাঁসও দেখলাম। ঝকমকে রঙের ম্যালারড, সরু-ল্যাজ পিনটেল, কুচকুচে কালো কুট, বেঁটে-ঠোঁট গ্রিব, আরও কতো। কেউ কেউ জলের নীচে ডাইভ দিয়ে শিকার ধরে, কেউবা জলের ওপরে ভেসে শুধু মাথাটা ডুবিয়ে পোকামাকড় খায়। সারিসারি হাঁস একেবারে উলটে মাথা ডুবিয়ে পেছনটা উঁচুকরে যখন খায় ভারি মজার লাগে দেখতে।
প্রাণ ভরে পাখি দেখলাম সারাদিন। সব মিলিয়ে ৭২টি বিশিষ্ট জাতির পাখি। সবশেষে, নামার একটু আগে, জেটির ঠিক পাশে আবির্ভূত হল একটি বরফ-সাদা ইগ্রেট (বক)! আমার এক সঙ্গী ছড়া কাটলেন —
At last, I see an egret!
Now I’ve no more regret.
(ভ্রমণকাল-- জানুয়ারি, ২০২০)