• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • করোনা ডায়েরি--ইতালি থেকে : মানসী ভট্টাচার্য


    ২রা এপ্রিল, ২০২০

    আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম লাঞ্চের পর, তখন বোধ হয় দুটো বাজে--আজকাল প্রতিদিনই খাওয়াদাওয়া দেরিতে হচ্ছে। ‘করোনা’র ত্রাসে বাড়িতে ধোয়ামোছার ধুম পড়ে গেছে--তাতেই অনেকটা করে সময় যাচ্ছে রোজ। রান্নার পর্ব শুরু হতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। সবাই বাড়িতে, তাই মেনুতে একটু অন্য রকম কিছু রাখতে হচ্ছে! এবেলা ধোসা হয়েছিল--একটা একটা করে ভাজতে হলো! সবাই হাত লাগালো তাই, নইলে আরও দেরি হত! রোদ্দুরটা আজ বেশ ঝকঝকে--আর আকাশ ঘন নীল! রোমের ভূমধ্যসাগরীয় আকাশ প্রায় সব সময়ই মন-কাড়া নীল, কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পুরো দেশে লকডাউন-এর পর আকাশ যেন এখন আরও সুন্দর! আমাদের ব্যালকনি থেকে সামনের বাড়িগুলোর টেরেস আর ব্যালকনি বেশ স্পষ্ট দেখা যায়! বাড়িগুলোর কোনটাই চার পাঁচ তলার বেশি উঁচু নয়--সব বাড়ির ব্যালকনিতেই টবে আর বক্সে প্রচুর ফুলের গাছ, নানা রঙের ফুল ফুটে রয়েছে। টেরেসগুলোর খানিকটা অংশ ঢাকা, টেবিল চেয়ার পাতা রয়েছে। এখানকার মানুষজন ছাতে কাপড় শুকোতে দেয়, খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব করে, বিশেষ করে শীত চলে গেলে। সামনের হলুদ বাড়িটার পাশেই একটা লম্বা আমব্রেলা পাইন গাছ, একদম ছাতার মতন দেখতে। আমাদের বাগানেও দু তিন রকমের পাইন আছে।


    আমব্রেলা পাইন গাছ, একদম ছাতার মতন

    দুটো পেনসিল পাইন তো খুব লম্বা। বাগানের বেশিরভাগ পাতা-ঝরা গাছগুলোর রিক্ত শাখায় আবার সবুজের সমারোহ। গাছে গাছে কত পাখির জটলা! ওদের কলকাকলিতে সকাল সন্ধে চারিপাশটা মুখর হয়ে থাকে। বাগানটা এখন তারার মত ফুটে থাকা ঘাসফুলে ভরা। গেটের পাশের চেরি গাছটা সাদা ফুলে ঢেকে গেছে--এখন বসন্ত! তবে রোমের বাতাসে এখনো হিমেল ছোঁয়া, এখানকার সদা হাসিখুশি মানুষের মনেও! রোমে লকডাউন চতুর্থ সপ্তাহে পড়ল, খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বেরোচ্ছে না। আমরাও শুধু পাশের সুপার মার্কেটে যাচ্ছি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। এখন পর্যন্ত সব কিছুরই জোগান আছে, মানুষজনও হুমড়ি খেয়ে জিনিসপত্র স্টক করছেন না। প্রথম দু-তিন সপ্তাহ দেশবাসীর পাশে থেকে সকলের মনোবল জোগানোর জন্য ইতালিয়ানদের ব্যালকনিতে গান বাজনার বেশ ধুম ছিল, কিন্তু এখন তা ক্রমশঃ ঝিমিয়ে আসছে। মৃত্যুর ভ্রূকুটি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো ছায়া যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সকলকে। এখানকার মানুষজন উত্তরোত্তর অনুভব করছেন যে যতটা ভাবা গেছিল এ লড়াই তার চাইতে অনেক বেশি কঠিন আর তার জন্য মাশুলও দিতে হবে অনেক। গত কদিন ধরে সামনের বাড়িগুলোর ছাতে বা বারান্দায় প্রায় কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না সেরকম! কয়েকজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলাকে এর আগে দেখেছি বাইরে বসে কফি খেতে বা ফুল গাছের দেখভাল করতে। কদিন ধরেই কেমন একটা নিঝুম ভাব চারিপাশে। আমাদের বছর ষাটের বাড়িওয়ালা সকালসবেলা বাগানে বসে খবরের কাগজ পড়েন, তারও দেখা নেই আজ দুদিন! এঁরা সব গেলেন কোথায়? শুধু বেড়াল দুটো বাগানের এদিক সেদিক দুলকি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে।


    শুধু বেড়াল দুটো বাগানের এদিক সেদিক...

    মাঝে মাঝে রট আয়রনের টেবিলটার ওপর গিয়ে বসছে, কখনো আবার বাগানের মাঝখানের ফাউন্টেনটা থেকে জল খাচ্ছে। থেকে থেকে কুকুরটাও ঘুর ঘুর করে ওদের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে, যদিও খুব একটা পাত্তা ও পাচ্ছে না! ওদের চালচলনে সেই পুরনো নিশ্চিন্দি--ওদের যে কেউ ‘করোনা’র পাঠ পড়িয়ে বলেনি, “তোমরা এটা কোরোনা বা ওটা কোরোনা”! ভাবতে ভাবতেই সোয়েটার-এর পকেটে রাখা ফোনটায় একটা নোটিফিকেশন এল, আমাদের ভাইবোনদের হোআটসআপ গ্রূপে এল আরেকটা করোনা জোক। ভাবলাম, এরই নাম বোধ হয় জীবন-–চরম সঙ্কটের মধ্যেও মানুষ হাসির রসদ ঠিক খুঁজে নেয়!

    ৫ই এপ্রিল, ২০২০

    আজ সকাল দশটা নাগাদ এডওয়ার্ড-এর ফোন এল--বাচ্চাদের নিয়ে বাড়িতে বসে আছে। ওরা আমাদের পেছনের লেনটাতেই থাকে। এডওয়ার্ড ইথিওপিয়ান ছেলে আর ওর বউ সারা কানাডার মেয়ে। আমাদের মতই বছর খানেক আগে রোমে এসেছে চাকরির সুবাদে। ওদের ছেলে-মেয়ে দুটো টিনএজার, আর অসম্ভব ছটফটে। বেচারা ওদের সামলাতে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে। বলছিল আজ বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখতে ওদের নিয়ে পিত্জা বানিয়েছে। সারা কদিন আগে ওর বাবা, মাকে দেখতে টরন্টোতে গিয়ে আটকে পড়েছে। তাই এডওয়ার্ডকে একাই সব দেখতে হচ্ছে। তার ওপর রয়েছে ওদের কুকুর টাইগার। প্রতিদিন বাচ্চারা বেশ খানিকটা সময় ওদের নেবারহুড-এর পার্ক-এ কাটায় টাইগারকে নিয়ে খেলাধুলো করে। এখন আর তা সম্ভব নয়। তবু স্কুলের অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়াতে খানিকটা রক্ষে, বাচ্চারা অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকে। সেই সময়টাতে এডওয়ার্ড বাড়ির অন্য কাজগুলো সেরে নেয়।

    রোমের রাস্তাঘাট এখন বিলকুল সুনসান--রেস্তঁরা, পিত্জেরিয়া, ক্যাফেটারিয়া সব বন্ধ। টুরিস্ট আর স্থানীয় লোকেদের ভিড়ে সদা জমজমাট রোম এখন যেন এক পরিত্যক্ত শহর! লকডাউন রোমের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে কিন্তু ইতালির আড্ডাবাজ মানুষজনদের জন্য বাড়িতে আটকে পড়ে থাকা খুবই কঠিন। এখানকার রেস্তঁরা বা পিত্জেরিয়া গুলো সারা বছর-ভর বেশ রাত পর্যন্ত গমগম করে খাদ্যরসিক, মিশুকে ইতালিয়ান মানুষজনদের ভিড়ে। বিশেষ করে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য, যারা ইতালির জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ, লকডাউন যেন এক অভিশাপ। এখানে সত্তর-আশি বছরের মানুষজন নিয়মিত পার্কে হাঁটতে যান, বাজার করেন, ক্যাফেটারিয়াতে বসে গল্পগুজব করেন। এডওয়ার্ড বলছিল দু দিন আগে ওদের বাড়ির আশেপাশে এক বয়স্ক মহিলাকে দেখা গেছে রাস্তায়--উনি কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন কিন্তু বহুক্ষণ ওনাকে বাইরে দেখে পুলিশ লক্ষ্য করে যে উনি কিছুক্ষণ বাদে বাদে নতুন নতুন কুকুর নিয়ে হাঁটছেন। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারা যায় যে উনি ঘরে বসে এত অসহ্য হয়ে গেছিলেন যে, ওর আশেপাশের সব বাড়ির কুকুরকে একে এক করে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন। পুলিস ওনাকে সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের বাড়ির সামনের কাফেটারিয়াতে প্রায় সময় দেখি ফ্যাশনেবল ইতালিয়ান বৃদ্ধাদের গ্রুপ; কফি নিয়ে বসে জমিয়ে আড্ডা মারছেন। ওদের পোশাক, ম্যাচিং লিপস্টিক, স্টিলেটো হিল, আর সর্বোপরি সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার তাগিদ আমায় বার বার মুগ্ধ করে। কিন্তু লকডাউন ওদের বেঁচে থাকাতেই যেন তালা মেরে দিয়েছে!


    আবার বাগানের মাঝখানের ফাউন্টেনটা থেকে জল খাচ্ছে...

    ইতালির তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের (১৮-৩৪ বছর) দুই-তৃতীয়াংশ এখনো তাদের বাবা-মার সঙ্গে এক পরিবারে থাকে, এ ব্যাপারে তারা ইউরোপের অন্য দেশগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু লকডাউন-এর সময় তাদের অনেকেই বাবা মায়ের থেকে দূরে থাকছে তাঁদের সুরক্ষিত রাখার জন্য, কেননা ইতালির করোনা-আক্রান্তদের সিংহভাগই সত্তর আশি বছর বয়সী মানুষজন। ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনিদের থেকে দূরে বন্দী হয়ে থাকা এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের তিল তিল করে মারছে তাদের একাকীত্ব। জীবনসায়াহ্নে এসে এই ‘সামাজিক দূরত্ব’ ওদের কাছে মৃত্যুর চাইতেও মর্মান্তিক! ইতালির বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাহায্যে অনেক জায়গাতেই এগিয়ে এসেছেন তাদের তরুণ প্রতিবেশীরা--এঁদের দরকারী জিনিসপত্র কিনে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসে বা অন্য প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে। লকডাউনে থাকা ফুটবল-পাগলা ইতালিয়ানরা ফুটবল ম্যাচ না দেখতে পেয়ে খুবই কাতর। বোলোনিয়া ক্লাবের কিছু নামী পেশাদার ফুটবল তারকা তাই বয়স্ক ফুটবল অনুরাগীদের ফোন করে কথা বলেন, মনোবল যোগান এবং তাদের সাপোর্ট করার জন্য ধন্যবাদ জানান। এভাবেই সমাজের বিভিন্ন মানুষজন এই সঙ্কটের সময়ে তাদের অগ্রজদের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।

    আমাদের রাস্তার উল্টোদিকের কর্নার-এ ভ্যান নিয়ে এক বাঙলাদেশী ভদ্রলোক জেলাটো বিক্রি করেন। মাঝে মাঝেই জেলাটো খেতে গিয়ে ওনার সাথে আমাদের গল্পগুজব হয়। আজকাল ওঁকে আর দেখা যায় না। চার সপ্তাহের লকডাউন ইতালির দরিদ্র পরিবারগুলিকে অনিশ্চয়তা এবং অনিরাপত্তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ইতালির বিভিন্ন শহরে মানুষজন এদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন এক সুন্দর পদক্ষেপে যার নাম ‘পেন্ডিং শপিং ভাউচার’। যে গরিব পরিবারগুলি এখনো পর্যন্ত সরকার থেকে ‘ফুড ভাউচার’ পাননি তাদের জন্য এলাকার মানুষজন ফুটপাথের বেঞ্চের ওপর বিভিন্ন রকমের খাবারদাবার রেখে যান, যাতে তাঁদের হাত পেতে কারুর অনুগ্রহ নিতে না হয়। এই সমস্ত সংবেদনশীল উদ্যোগ প্রমাণ করে যে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং’ আসলে দৈহিক দূরত্বের কথা বলে, ‘সামাজিক দূরত্বের’ নয়।

    ৭ই এপ্রিল, ২০২০

    কাল ভোররাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল, বোধহয় শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। হয়ত বা কোনো লুকোনো স্ট্রেস থেকেও হতে পারে--কদিন ধরে টিভি, সোশ্যাল মিডিয়াতে অনবরত যা সব খবর দেখছি আর শুনছি, স্ট্রেস হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। উঠে বসে বালিশের পাশে রাখা ফোনটা হাতড়ে সময় দেখতে যাব, আবছা একটা আওয়াজ কানে এল, এম্বুলেন্স-এর। বুকটা কেঁপে উঠল, মনে পড়ে গেল কাল নিউজে দেখা ডক্টর আন্তনিওর ইন্টারভিউটা। ডক্টর আন্তনিও কার্ডিওলজিস্ট কিন্তু গত কিছুদিন উনি নিজে রুগী হিসেবে ভর্তি ছিলেন রোমের কাসাল পালোক্কো হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তার গলা বুঁজে আসে। ষাট বছর বয়সী ডক্টর আন্তনিও দশ দিন আই.সি.উ.-তে ছিলেন। তার অসহনীয় কষ্ট, ডাক্তার আর স্বাস্থ্য কর্মীদের নিঃস্বার্থ সেবা মনে করে তার অশ্রু বাধ মানে না। এই মহামারীর জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স এবং প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মীর অক্লান্ত সেবার কোনো ত্রুটি ছিল না। ডাক্তাররা স্পেস স্যুট-এর মত মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পরে রুগী দেখেন, কাঁচের মাস্ক-এর পেছনে শুধু তাদের চোখ দুটি দেখা যায়, তাদের সেই স্নেহমাখা দৃষ্টি ভোলার নয়। ডাক্তারদের অনেকেই তরুণ, কিন্তু নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে তাদের সেবা সত্যি প্রশংসার যোগ্য! ডক্টর আন্তনিও নিজে ডাক্তার বলে অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারতেন বা সইতে পারতেন, কিন্তু আশে পাশের রুগীদের কষ্ট তাকে কাতর করে তুলত। দিন কোনক্রমে কেটে গেলেও রাত যেন কাটতে চাইত না, মৃত্যুভয় এক নিকষ কালো দানবের মত গ্রাস করে নিত হাসপাতাল আর তার রুগীদের। উনি শুয়ে থাকতেন কিন্তু ঘুমোতেন না, তার পাশের বেডে শোয়া তরুণ রুগীটির নিশ্বাস গুনতেন ফোনের স্টপ ওয়াচের দিকে তাকিয়ে। তার খেয়াল রাখতে গিয়ে উনি নিজের কথা ভুলে যেতেন। হাসপাতালের আই.সি.উ.-তে শুয়ে তাঁর একটাই ভয় ছিল যে উনি হয়ত তাঁর পরিবারকে আর কখনো দেখতে পাবেন না! আজ সুস্থ্ হবার পর তাঁর জীবনের একটাই লক্ষ্য, ইতালির জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করে তোলার জন্য তাঁর যথাসাধ্য করা।

    বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমি জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম, কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। কানের পাশে যেন এক রাশ ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে। আগডুম বাগডুম চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। এপাশ ওপাশ করতে করতে বোধহয় একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে উঠে মাথায় বজ্রাঘাত; হিটিং কাজ করছে না। আমাদের বাড়িওয়ালি সিলভিয়ার গ্রামের একটি ছেলে রবার্তো, সিলভিয়ার বাড়িতেই থাকে আর ওই আমাদের মুশকিল আসান--রবার্তো জানে না হেন কোনো কাজ নেই। কিন্তু সিলভিয়াকে ফোন করে জানা গেল রবার্তো লকডাউন-এর আগে ওর বাড়ি চলে গেছে। শুনে আমাদের তো মাথায় হাত--কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে দেখি সিলভিয়া নিজেই এসে হাজির হিটিং ঠিক করতে। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর ঠিক হলো হিটিং, আমি মনে মনে এই ষাট ছুঁইছুঁই মহিলার প্রশংসা না করে পারলাম না। এই বয়েসেও কত কর্মঠ। সিলভিয়া ইংরেজি বলতে পারেন না, বলা যেতে পারে ওর ইংরেজি অনেকটা আমাদের ইটালিয়ানের মত। কিন্তু ভাষার সমস্যা সিলভিয়া কে দমাতে পারে না--কোভিড নিয়ে সিলভিয়া বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে গেলেন, আমরাও আমাদের মত জবাব দিলাম। বোঝা গেল এব্যাপারে উনি অনেক কিছুই জানেন, আমি খুশিই হলাম তা জেনে। পরে আমাদের এক তরুণ ইতালিয়ান বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে জানলাম শুধু সিলভিয়া না, ঘরে ঘরে ইতালিয়ানরা সবাই এখন ভাইরোলজিস্ট। আমার খুব মজা লাগল এবিষয়ে আমাদের সবজান্তা বাঙালিদের সঙ্গে ওদের অদ্ভুত মিল দেখে! সিলভিয়া কোনো এক প্রসঙ্গে ওর এক ডাক্তার বন্ধু আন্দ্রেয়ার কথা বলছিলেন, যিনি লোমবারদির এক হাসপাতালে এখন ডিউটি করছেন এবং করোনা আক্রান্তদের চিকিত্সা করছেন। করোনার সাথে লড়াইযে ইতালির ডাক্তারদের অক্লান্ত সেবা এবং বলিদানের জন্য দেশের মানুষজন তাঁদের কাছে চিরঋণী। লোমবারদির বিখ্যাত শেফ-রা জানিয়ে দিয়েছেন তারা ডাক্তার এবং হাসপাতাল কর্মীদের পছন্দমত খাবার বিনামূল্যে ডেলিভারি করতে প্রস্তুত। এক জনপ্রিয় পিত্জেরিয়া কৃতজ্ঞতা-স্বরূপ ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিনামূল্যে পিত্জা ডেলিভারি করেছে হাসপাতালে।


    অল্পবয়সী দম্পতি তাদের ছোট ছেলেটিকে নিয়ে খেলছে

    সিলভিয়া চলে যাবার পর দু-তিনটে ফোন এল বন্ধুদের। খবরে ইতালির অবস্থা দেখে সবাই আমাদের নিয়ে চিন্তিত। সকলকে আশ্বস্ত করে ছাতে উঠেছিলাম দুপুরের খাবারদাবার নিয়ে। সামনের বাড়ির লনটায় দেখি এক অল্পবয়সী দম্পতি তাদের ছোট ছেলেটিকে নিয়ে খেলছে। বাচ্চাটা একটা কাঠের ঘোড়ায় চেপে দুলছে, ঠিক আমাদের ছোটবেলার মতন! সামনের নেচার রিসার্ভটায় একপাল ভেড়া সবুজ গালচের মত ঘাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে--আচ্ছা ওদের সাথে কোনো রাখাল ছেলে আছে? সে কি বাঁশি বাজায়? এক সারি বক উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে--কেবল আমি বসে রইলাম স্থাণু হয়ে! মন চলে গেল ওদের পাখায় ভর করে—এ সব কিছুর থেকে দূরে--বহু দূরে!


    ব্যালকনি থেকে






    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখিকা
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments