• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ABC — কেঁচে গন্ডুষ : রাহুল মজুমদার

    ২৩ অক্টোবর


    সকাল ৮.৪৫— বাঁশবনের মাঝে নতুন গড়ে ওঠা আপার দোবান। চা চাপানো গেল।

    সকাল ৯.০৫— আবার বাঁশপথে। আজ সিঁড়ি কম পথ বেশি, আরও বেশি জলধারা।

    সকাল ৯.৩৫— ফেসবুক বন্ধু তমোঘ্ন-র সঙ্গে ফেস টু ফেস। ওরা চারজন ফিরতিপথে। দশ মিনিট আড্ডা তো বনতা হ্যায় ভাই।

    সকাল ৯.৫৩— ঝরনা টপকাতে টপকাতে চড়াই ভাঙা। বাঁশবনেও সিঁড়ি হাজির।

    সকাল ১০.০৫— উল্টোদিকে শতধারার ঝরনা ঝলমলাচ্ছে। ছোটো দুটো নবীন মন্দির এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে। দু দণ্ড না দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া অসম্ভব। দুইয়ের জায়গায় দশপনেরো হয়ে যাচ্ছে অনেকেরই।

    সকাল ১০.১৫— সামনেই ভয় ধরানো পাথুরে সিঁড়ির খাড়া চড়াই বাঁশবনের ঘেরাটোপে।

    সকাল ১১.১২— বাঁশ আর অন্য গাছেরা খানিক সরে জায়গা করে দিয়েছে হিমালয়কে। গোটা দুত্তিন লজ এমন ডাকল, না বসে পারলাম না দুজনে।

    সকাল ১১.৪৪— কোল্ড লেমনে শানালো না, লেমন টীতেও চুমুক দিতে হল; সামনে চড়াই উঁকি দিচ্ছে।

    দুপুর ১২.১০— 'একটু বোস' — হাঁটু কোমরের বক্তব্য।

    দুপুর ১২.৪০— উল্টোদিকে আবার এক মনমোহিনী ঝরনা — না বসলে চলে!

    দুপুর ১.২৪— এক স্প্যানিশ দম্পতির সঙ্গে আলাপ করার ছুতোয় পাদুটোকে খানিক বিশ্রাম দেওয়া গেল।

    দুপুর ১.৪২— সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি — চড়ি চড়ি চড়ি করে এসে পড়লাম হিংকো কেভ — প্রাচীনকালের আশ্রয়স্থল এই রকশেল্‌টার। উল্টোদিকে মাছাপুছারের উঁকি।

    বেলা ২টো— মারাত্মক চড়াই চড়ে কাত।

    বেলা ২.৩০— উৎরাই নেমে ঝরনা পেরোনো।

    বেলা ২.৩৫— আবার ঝরনা পার। সামনে আবার চড়াই। বাঁশবন খানিক সরে বসেছে।

    বেলা ২.৪৫— খাড়া সিঁড়ি ভেঙে মাছাপুছারের পশ্চাৎপট নিয়ে বিছিয়ে থাকা দেওরালির ড্রীম লজে (৩১৮০ মি.) আজকের মতো বিশ্রাম।

    সন্ধ্যা ৬.০৫— বাইরে বেশ ঠাণ্ডা — প্রায় ৬ ডিগ্রীর কাছাকাছি। চা চাপানো ছাড়া উপায় নেই। খবর পেলাম ABC-র পথে হিমবাহে দুর্ঘটনা ঘটেছে।

    ২৪ অক্টোবর


    সকাল ৬.১৭— ভোরে ঘরে তাপমাত্রা ছিল ২ডিগ্রী। এই শীতেও মাছাপুছারে নির্বিকার।

    সকাল ৮.০৮— আজ MBC হয়ে ABC যাবে সবাই। নিজেদের নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।

    সকাল ৮.২২— প্রথম থেকে দমফাটানো চড়াই। সিঁড়ি থমকে ৩৫ ডিগ্রী কোণের মাটি পাথরের চড়াই হাজির। মাঝেমধ্যেই সে ৫০ ডিগ্রী ছাড়াচ্ছে।

    সকাল ৮.৫০— মাঝেমধ্যেই চতুষ্পদ হয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে উঠছিলাম, এখন হাঁফাবার জন্যই বসতে হল। পিঠের বোঝাটা গুণিতকে ওজন বাড়াচ্ছে।

    সকাল ৯.৩৬— এই প্রথম রোদের ছোঁয়া পেলাম।

    সকাল ৯.৪৩— আবার বেদম। Aclimatization এর জন্য দেওরালিতে আজ থেকে যাওয়া উচিত ছিল মনে হচ্ছে। কিন্তু বাঁধা সময়।

    সকাল ১১.৪০— বড্ড কষ্ট হচ্ছে — যেমন চড়াই, তেমন বিচ্ছিরি রাস্তা।

    ঠিক দুপ্পুরবেলা— অল্প চড়েই হাঁফিয়ে যাচ্ছি।

    দুপুর ১২.২৪— চড়াই বিশ্রাম।

    দুপুর ১২.৫২— আবার চড়াইতে।

    দুপুর ১. ১৮— আবার বসতে হল। অন্যেরা বোধহয় এতক্ষণে MBC পৌঁছে গেছে।

    দুপুর ১.২৮— অন্নপূর্ণা সাউথ, হিউঁচুলি, অন্নপূর্ণা ৩ আর মাছাপুছারের উৎসাহে আবার উত্থান।

    দুপুর ১.৫০— চড়াইয়ের বিশ্রামের পালা এবার। মোদীথোলার সঙ্গে গল্প করতে করতে পথ চলা। দূরে একটা খসে পড়া হিমবাহের টুকরো (মাত্র শ খানেক ফুট লম্বা, ফুট কুড়ি উঁচু)।

    দুপুর ১.৫৩— সেই ভেঙে পড়া তুষার 'খণ্ডে'র সামনে। এখানেই নাকি ঘটেছিল গতকালের সেই দুর্ঘটনা। তুষারপ্রাচীরের নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাতে গিয়েই বিপত্তি। প্রাচীরের একটা অংশ খসে পড়ে সরাসরি ওদের ওপর। একজনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। অন্য দুজনের অবস্থাও ভালো নয়। ভারি মন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম (মনে পড়ল, ১৯৮৩ সালেও এখানেই এম্মনই এক তুষার খণ্ডের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল)। সামনে আবার চড়াই।

    বেলা ২.১৩— চড়াইয়ের সঙ্গে ধ্বসা এলাকার যুগলবন্দী।

    বেলা ২.৩৩— আরও চড়াই, আরও দমে টান, আবার বিশ্রাম। সামনে এবার পথ দুভাগ — বাঁদিকে মেটে পাথুরে পথ ABC মুখী আর ডাইনে স্বর্গের সিঁড়ি MBC পৌঁছবার পথ।

    বেলা ২.৪০— স্বর্গের সিঁড়ি ভেঙে MBC-র ১ম লজের সামনে। অন্নপূর্ণা সাউথ, হিউঁচুলি আর বরাহ শৃঙ্গকে পিছনে আর মাছাপুছারে, গঙ্গপূর্ণাকে সামনে রেখে দু মুহূর্তের বিশ্রাম। আমাদের আস্তানা আরও এগিয়ে।

    বেলা ২.৫৮— দুই হা-ক্লান্ত বুড়ো শেষমেশ মাছাপুছারে গেস্ট হাউসের আঙিনায় (৩৬৭০ মি.)। আমাদের ঘিরে রয়েছে অন্নপূর্ণা সাউথ, হিউঁচুলি, বরাহ, অন্নপূর্ণা ১, অন্নপূর্ণা ৩, টেন্ট পীক, মাছাপুছারে।


    মাছাপুছারে বেসক্যাম্প, মাছাপুছারে গেস্টহাউস থেকে

    বেলা ৪টে— এখানে কোরীয়দের তৈরি 'হিমালয়ান রেসকিউ সেন্টার' আগামী ১৪ নভেম্বর উদ্বোধনের অপেক্ষায়। তাপমাত্রা এখনই ৫ ডিগ্রী!

    সন্ধ্যা ৫.৩০— বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে দেওয়ার মতো সূর্যাস্ত। এখনও ভোম মেরে আছি। তাপমাত্রা শূন্যের দিকে ছুটছে।

    রাত ৭টা— ডিনার সেরে বিছানায়। ঝুমুরকাকু গতকাল ডান গোড়ালিতে চোট পেয়েছিল, আজ সেটা অনেকটা বেড়ে গেছে। ABC বোধহয় এবার বাদ দিতে হবে।

    ২৫ অক্টোবর


    সকাল ৬.২২— আজই ঘুম থেকে উঠতে ৬টা বেজে গেল। ইচ্ছে ছিল ABC ঘুরে ফিরে এসে যতদূর সম্ভব নেমে যাব। তড়িঘড়ি ধড়াচুড়ো পরে বাইরে বেরিয়েই দেখি সোনার সাজ পরানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঝুমুরকাকুকে ডেকে দিয়ে জোরে পা চালালাম ক্যামেরা চালাতে চালাতে। মিনিট চল্লিশ পা চালিয়ে (তাপমাত্রা ২ডিগ্রী) সেই বাঁকটায় পৌঁছলাম, যেখান থেকে ABC চত্বর দেখা যায়।

    সকাল ৭.০৪— হঠাৎই কেন জানিনা সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম ABC পৌঁছবার কোনও তাগিদই আর অনুভব করলাম না। এমনকি ক্যামেরাও গলাতেই ঝুলতে থাকল। নেমে যেতে না পারলে ঝুমুরকাকুর যন্ত্রণা কমবে না এই ঠাণ্ডায়, এই চিন্তাটাই প্রবল হয়ে উঠল। একরকম দৌড়েই নেমে এলাম আস্তানায়।

    সকাল ৭.১১— একটা হেলিকপ্টার এসে নেমেছে। তথ্যচিত্রের জনা চারেক শিল্পী অল্পবিস্তর চোট পেয়েছেন, তাঁদের নিতেই তার আগমন। তাঁদের উড়ে যাওয়া দেখে, আমরাও ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। তাপমাত্রা এখনও শূন্যের নিচে।

    সকাল ৯টা— বিদায় MBC, বিদায় ABC।

    সকাল ১১.৩৯— দু-বার বিশ্রাম নিয়ে দেওরালি। আজ দিনভর বিশ্রাম — এবার New Panorama Guest House-এ।

    ২৬ অক্টোবর


    সকাল ৮.২৫— দোবান ডাকছে।

    সকাল ১০.৪৮— হিমালয়ায় দু গ্লাস করে কোল্ড লেমন গিললাম।

    দুপুর ১.১২— আপার দোবানে উদরপূর্তির বিরতি।

    বেলা ২.১৬— দোবান। আগের আস্তানাতেই।

    বেলা ৪.০১— ভুলেই গিয়েছিলাম, কিছু বাড়তি জামাকাপড় এখানে রেখে গিয়েছিলাম। লজমালিক মিলন গুরুংভাই ফিরিয়ে দিতে মনে পড়ল।

    ২৭ অক্টোবর


    সকাল ৮.২৮— আজ চেষ্টা করব লোয়ার সিনুয়ায় নেমে যেতে। ঝুমুরকাকুর গোড়ালির ব্যথা এখন বেশ খানিকটা কম।

    সকাল ৯.৫৮— ব্যাম্বু লজ।

    দুপুর ১.৪৮— অনবরত সিঁড়িভাঙা অঙ্ক কষে হাঁফাতে হাঁফাতে সিনুয়া পৌঁছে লাঞ্চ।

    বেলা ২.৩১— এবার আবার সিঁড়িভাঙার খপ্পরে।

    বেলা ৩.৩৫— লোয়ার সিনুয়ার সুন্দর শেরপা গেস্ট হাউসে। কাছেই একটা দোকানে ট্রেকিংয়ের যাবতীয় সরঞ্জাম মজুত। মাছাপুছারের আশীর্বাদধন্য লোয়ার সিনুয়াকে ভালো লেগে গেল।

    রাত ৭.০১— দীপাবলীর রাত এত শব্দহীন হতে পারে!

    বেলা ২.৩১— এবার আবার সিঁড়িভাঙার খপ্পরে।

    ২৮ অক্টোবর


    সকাল ৮.০১— জিনুদাঁড়া পৌঁছবার তাড়ায় পথে।

    সকাল ৮.৩৫— ছোমরংখোলার পাড়ে আরেক ফেসবুক বন্ধু সুমন্ত বসুর সঙ্গে মোলাকাত। EBC করার পর সময় হাতে ছিল বলে ABC-ও করে নিল!

    সকাল ১০.৫৫— গরম, খাড়া সিঁড়ি, পিঠের বোঝা সব নিংড়ে নিয়েছে। ছোমরং চেকপোস্টে চেক আউট করার সঙ্গে ঘাম শুকোনোর পর্ব।

    দুপুর ১২.৩৪— প্রায় ঘন্টাখানেকের বিশ্রামের পর ছোমরং-এর মাথায়। এবার অন্য পথে জিনুদাঁড়া নামা।

    দুপুর ১.১১— অনন্ত উৎরাই। মাঝপথে ছোট্ট চা বিরতি।

    বেলা ২.৪৯— উৎরাই। সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি, ভাঙাচোরা খাড়াপথ। শেষমেশ জিনুদাঁড়ার মিষ্টি টিবেট গেস্ট হাউসে।

    রাত ৭.০৭— ছোট্ট 'মালকিন'-এর হাতে জ্বলে উঠল গুটিকয় মোমবাতি — ভালোবাসার আলোয় উদ্ভাসিত হল লজের আঙিনা, বারদুয়ার।

    ২৯ অক্টোবর


    সকাল ৮.২৯— আজ ভাইফোঁটা — এখানে ভাইদুজ, মনের সবথেকে কাছের উৎসব। আজ পোখরা পৌঁছব। ন-ই-চে একটা পুল (নিউ ব্রিজ) দেখা যাচ্ছে — ওটা পেরিয়ে আমাদের পথ।

    সকাল ৯টা— বিউমনুখোলাকে পেরোলাম ২৮৭ মি. লম্বা পুলে চড়ে। সামনে চড়াই, ভাঙাচোরা পথ।

    সকাল ১০.৩৫— জিভ বার করা পরিশ্রমে এসে পৌঁছলাম বাস/জীপ স্ট্যান্ডে।

    সকাল ১১.৪২— অনন্ত অপেক্ষার পর সুমোর সওয়ার।

    দুপুর ১২.৪৮— বিরেথাঁটিতে চেক আউট।

    দুপুর ২.১৭— পোখরা। ABC পর্ব সমাপ্ত।


    দেওরালি, নিউ প্যানোরামা গেস্ট হাউস

    (শেষ)



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচ : রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)