• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • বাঙাল এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা : সুনন্দন চক্রবর্তী


    বেসক্যাম্প থেকে ফেরার দিন সকালবেলা
    পনি যদি বাঙাল হন তাহলে খুব ছোটো ছোটো পর্যবেক্ষণ থেকে বড়ো বড়ো সব সিদ্ধান্তে আসার ক্ষমতা আপনার থাকবেই। আমি আট বছর বয়েসে বাবার সঙ্গে দার্জিলিং-এর মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-এ গিয়ে তেনজিং-এর ছবি দেখি এবং ছেলেবেলা থেকেই আমার নাক বোঁচা। সুতরাং পরবর্তী জীবনে আমি সহজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছই যে পাহাড় চড়া আমার পক্ষে সোজা। ঘটনাচক্রে আমার কিশোর বয়েসের সময় থেকেই আমাদের বাংলায় ট্রেকিং নামক পাগলামিটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই দুই চক্করে পড়ে অর্ধেক জীবন আমি আদাড়ে-পাঁদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বিস্তর হয়রান হয়েছি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। খেলাটা সোজা নয় বটে কিন্তু মজা আছে।

    তাই বন্ধুরা — কয়েকজন তরুণতর আর কয়েকজন গোঁয়ার প্রবীণ — যখন কাঞ্চনজঙ্ঘা সাউথ বেস ক্যাম্প যাওয়ার মতলব আঁটল আমিও তাদের দলে ভিড়ে পড়লাম। সেই মত আমরা সক্কাল সক্কাল পৌঁছলাম সীমান্তশহর কাঁকরভিটা। বহুবার নেপালে ট্রেক করে করে এ আমাদের অতি পরিচিত জায়গা। যদিও আমাদের সবার মতো তারও কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে ভালোই। এখানে টাকা বদলানো, স্থানীয় সিম কার্ড যোগাড় করা, তাপলেজং পর্যন্ত জিপ ভাড়া করা, চাট্টি খেয়ে নেওয়া ইত্যাদিতে ঘন্টা দুই সময় গেল। সন্ধে নাগাদ তাপলেজং।

    নেপালে মূলত দু-রকমের ট্রেকিং হয়। একটা স্টাইলের নাম ব্যাকপ্যাকিং বা টি শপ ট্রেকিং। অর্থাৎ আপনি একটি পিঠের ব্যাগে যাবতীয় সংসারসহ ভেসে পড়বেন। গোটা পথেই নানান কিসিমের সরাইখানা বা টি শপ। রাতে এর কোনো একটায় থাকা খাওয়া। নেপালের বিখ্যাত পথরেখাগুলোতে এক্কেবারে কুঁড়ে ঘর থেকে ঝাঁ চকচকে চার তারা মার্কা হোটেল গোছের পাওয়া যায়। আপনি অভিরুচি এবং রেস্ত অনুসারে তার একটা বেছে নিতে পারেন। বেশিরভাগ জায়গাতেই ডাল-ভাত-তরকারি থেকে পিতজা, অ্যাপল পাই অবধি সব পাওয়া যায়। গত শতকের প্রায় শেষপাদ পর্যন্ত থাকা যেত বিনাপয়সায় অথবা নামমাত্র মূল্যে। শর্ত ছিল যেখানে থাকবেন খেতে হবে সেখানেই। এখন সে সুখের দিন গেছে। তবে এখনও থাকার জন্যে টাকা কমই লাগে, খাওয়ার দামই বেশি। এই সরাইগুলোর প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে খাবার ঘর। অনেক সময় তা রান্নাঘরের লাগোয়া। এখানে সারা দুনিয়ার নানান ঢং-এর মানুষেরা কেউ বই পড়ছে, কেউ গিটার বাজিয়ে গান গাইছে মৃদু স্বরে, কেউ চিন্তিত হয়ে পথের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে আছে, চা-কফি-বিয়র নিয়ে তুমুল এক আন্তর্জাতিক ভিড়।

    আর কতগুলো পথরেখা আছে যেখানে আপনাকে যেতে হবে ক্যাম্পিং করে করে। সেখানে গোটা রাস্তায় থাকার বন্দোবস্ত নেই। ফলে বইতে হবে থাকার তাঁবু, খাবার-দাবার, স্টোভ, জ্বালানি — সব। বলাই বাহুল্য এই পথগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্গম এবং নির্জন। এইসব পথে যেহেতু মালবাহকদের ছাড়া আপনি যেতে পারবেন না খরচ-ও পড়ে অনেক বেশি। গাদা গাদা এজেন্সি আছে এই ধরনের ট্রেকের গাইড এবং পোর্টার ঠিক করে দেওয়ার জন্যে। বিদেশিরা এঁদের সাহায্য নিয়ে থাকেন বেশ চড়া দামে। কতগুলো এলাকায় ঢোকার জন্যে বিশেষ অনুমতিও প্রয়োজন। কাঞ্চনজঙ্ঘা এমনি একটি দুর্ভেদ্য অঞ্চল। গোটা রাস্তাটায় টি শপ হাতে গোনা। তাঁবু নিতেই হবে। তার মানে মালবাহকও দরকার। আগে একমাত্র স্বীকৃত এজেন্সির সঙ্গেই এই রাস্তায় আসা যেত। ফলে তারা মাথা পিছু দর হাঁকত দু-হাজার ডলারের কাছাকাছি। কিন্তু এখন ভারতীয় ট্রেকারদের জন্যে এই নিয়ম শিথিল হয়েছে। তাই সাহস করে আমরা আসতে পেরেছি। আমাদের ইচ্ছে নিজেরা সরাসরি মালবাহক ঠিক করে নেব।

    তাপলেজং-এর হোটেল পতিভরা থেকে আশ্বাস পাওয়া গেল সকালে তিনজন মালবাহক পাওয়া যাবে। বিদেশিদের দুটো বড়ো দল রয়েছে এখানে। তবে তাদের বড়ো দলটা যাবে প্রথমে নর্থ বেসক্যাম্প বা পাং পেমার দিকে। সকালে তিনটি নেহাতই বাচ্চা ছেলে হাজির হল আমাদের সঙ্গে যাবে বলে। তাদের একজন মাত্র এই রাস্তায় মালবাহকের কাজ করেছে। অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু হাসিখুশি তিন বন্ধুকে আমরা নেওয়াই ঠিক করলাম। আমাদের চারজনের মিলিত অভিজ্ঞতা তো একশ বছরেরও বেশি।

    বাজারহাট করে নিতে নিতে দশটা বেজে গেল। আমাদের তাড়া নেই আজ। জিপ রাস্তা এগিয়ে গেছে তাপেথক পর্যন্ত। একদিনের হাঁটা আমাদের বেঁচে যাবে। তা গেল বটে কিন্তু সে রাস্তা দুঃস্বপ্নের। ১৬ কিলোমিটার মতো রাস্তা যেতে জিপের লাগল ছ ঘন্টারও বেশি। সন্ধেবেলা তাপেথকের একমাত্র হোটেলে আছি কেবল আমরা আর স্থানীয় কিছু যাত্রী। কাবেলিখোলার প্রকৃত বামতীরে তাপেথক। খোলা বা নদীর অন্য পার দিয়ে রাস্তা গেছে নর্থ বেসক্যাম্পের দিকে। আমরা যাব উলটো পার ধরে।

    তাপেথক-এ পুলিশ চৌকি আছে। সকালে গেলাম অনুমতিপত্র নিতে। একটি তরুণী তখন দফতর সামলাচ্ছে। আমাদের পরিচয়পত্র নিয়ে সে জানতে চাইল গাইড কে। আমাদের গাইড নেই। সরকার-স্বীকৃত এজেন্সি ছাড়া যাওয়ার ব্যাপারটা শিথিল হয়েছে। কিন্তু অনুমতি পাওয়ার জন্যে গাইড জরুরি কি না তার কোনো গাইডলাইন নেই। সেই মুহূর্তে যিনি দায়িত্বে আছেন তার মর্জির ওপর খানিকটা নির্ভর করতে হবে। আমরা এই নেপালের রাস্তায় রাস্তায় মূলত গ্রামের লোক এবং মালবাহকদের কাছ থেকে নেপালি ভাষা শিখেছি ফলে আমাদের ব্যাকরণ যেমনি হোক না কেন আমাদের টানটোন আদবকায়দা একেবারে নেপালি। তদুপরি আমার নাক বোঁচা। এবং তরুণীটি হাসিখুশি ও সহৃদয়। ফলে দু-একটা সাবধানবাণী শুনিয়েই সে পটাপট আমাদের অনুমতিপত্রে ছাপ মেরে রসিদ কেটে দিয়ে দিল। দশটা নাগাদ সামান্য মেঘলা আকাশের নীচে আমাদের চলা শুরু হল।


    কাশবনের মধ্যে দিয়ে হাঁটা শুরু
    একটা বড়ো কাশবনের মধ্যে দিয়ে খানিকটা ওঠার পর দেখি আবার চওড়া গাড়ির রাস্তায় এসে পড়েছি। বুঝলাম আমরা যে শুনেছিলাম রানীপুল অবধি গাড়ির রাস্তা চলে গেছে সেটা সত্যি। দুপুরের খাওয়ার সময় রানীপুল পৌঁছনো গেল। এসব সুযোগ ছাড়তে নেই। সেখানের একমাত্র হোটেলটিতে খাওয়াদাওয়া করে আমরা কড়া চড়াই পথে উঠতে শুরু করলাম। বাঁদিকে নীচে পড়ে রইল কাবেলি খোলা। এরপর প্রায় দশদিন আমরা লোকালয় থেকে বহু দূরে থাকব, থাকা খাওয়া যেমন জুটবে।

    পাহাড়ে ওঠার সময় হাঁফ ধরবে, পায়ে চাপ পড়বে, পিঠের বোঝাটা অসহ্য মনে হবে। সবসময় তাই হয়। কিন্তু বাঙালপনার একটা লক্ষণ হল ট্রেক শুরু করার সময় বা প্ল্যান করার সময় আপুনি বেমালুম সেকথা ভুলে যাবেন। আর বয়সের কথাটা মনে রাখে কোন ‘ফাগল’। তাতে যা দুর্গতি হবার তা হবে। কিস্যু হয়নি ভাবটা বজায় রেখে সন্ধেবেলা পৌঁছলাম লাপসেটার গ্রামে। দু-তিন ঘর লোকের গ্রাম। সেখানে মনকুমার নামে এক নেপালি বাঙাল দু-বছর ধরে একার হাতে নিজের একটি বাড়ি তৈরি করছে আর সামান্য খেতখামার করছে। তার আঙিনায় আমরা তাঁবু পাতলাম, তার রান্নাঘর আজ আমাদের দখলে। পড়শিদের বাচ্চারা আমাদের ঘিরে সময় কাটাল কিছুক্ষণ, অন্ধকার গাঢ় হলে নৈশভোজ সারা হবার পর কানে এল দূরাগত গানের আওয়াজ। মনকুমার জানাল কাছেই আশপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা নাচাগানা করতে জড়ো হয়েছে। পুজো থেকে কালীপুজো এটা চালু ব্যাপার। আমাদের দলের লোকেরা সে আসরে উপস্থিত হল যখন সে আসর ভাঙতে বসেছে, তাও বিদেশি অতিথিদের সম্মানে আবার একপ্রস্থ নাচগান হল। যত্ন করে আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল দেশি আরক।

    চমৎকার সব দেশি মদ খেয়েছি আমরা নেপালে। ছাং বা রকসি আমাদের বাংলা মদের বাঙাল সংস্করণ। আর টুংবা হল মিলেট বিয়র। ঠান্ডা নয়, তা খেতে হয় কুসুম কুসুম গরম জল দিয়ে। এগুলো শুধু মদিরা নয়, পাহাড়ি লোকেদের সুখদুঃখের সঙ্গী, বিদেশি ভাষা শেখার ক্লাস, জীবনে জীবনে যোগ করার মহৌষধি। কত কঠিন পথ আমাদের সরল হয়ে গেছে এইসব সান্ধ্য দেশি মদের আসরে। কিন্তু এ বিষয়ে আর কথা বাড়াব না। আমার মা মদ খাওয়া দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না।


    ধূলাসে ক্যাম্প
    এর পর আমরা তিনদিন এক অপরূপ বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাব। ধুলাসে বলে একটা ছোটো গ্রাম পেরিয়ে যেতে হবে অবশ্য। সেখানে একটা স্কুলও রয়েছে। সেখানেও ক্যাম্প করে থাকা যেত। কিন্তু আমরা পছন্দ করলাম আরও দেড়ঘণ্টা হেঁটে একদম নিরালা এক ক্যাম্প। কাছেই একটা বেশ বড়ো ঝরনা। এই গোটা পথরেখা ধরে আমরা অগণিত ঝরনা আর ঝোরা পার হয়েছি। জলের কষ্ট নেই এই রাস্তায়। কিন্তু পাহাড়ের রাস্তায় ঝরনা থাকা মানেই হল অসংখ্য ওঠানামা। তার মধ্যে বিকেলের দিকে একটা নদীমুখে এসে রাস্তাও বোঝা যাচ্ছিল না। সন্ধে নেমে আসছে আর আমাদের শেষ তিনজনের মধ্যে কাশীর টর্চ গেল খারাপ হয়ে। এ অবস্থায় বাঙাল মাত্রেই যা করে আমরাও তাই করলাম। তুহিন-এর স্যাকে রাখা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালা হল। ঠিক হল আমরা নদী ধরে এগোতে থাকব। আগে যারা গেছে তারা নিশ্চয় এতক্ষণে শিবির গেড়েছে। আমাদের তরুণ মালবাহকদের অন্তত একজনকে তারা পথ দেখানোর জন্যে পিছনে পাঠাবেই। আধ ঘন্টাটাক পরে দূরে একটু ওপরে একটা আলো জ্বলছে নিভছে দেখা গেল। তার মানে সুবোধ অনভিজ্ঞ মালবাহকদের ওপর ভরসা না করে নিজেই এসেছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম কেন।

    আমাদের ধূলাসে-র বান্ধবী

    বেশ চওড়া আর খরস্রোতা নদী পেরোতে হবে ইতস্তত পড়ে থাকা কয়েকটা পাথরে পাথরে পা দিয়ে দিয়ে বা বলা ভাল লাফ দিয়ে দিয়ে। আমার শুভানুধ্যায়ী ইয়ার দোস্তরা এইসময় জিজ্ঞেস করবে জল কেমন ঠান্ডা ছিল? ইঙ্গিত যে আমি হেন অপদার্থ নিশ্চয় পিছলে না পড়ে ওটা পার হতে পারিনি। কিন্তু হাঁটু খারাপ বলে আমি দুটো স্কি স্টিক ব্যবহার করি। তাতে একটু ভর দিয়ে কোনো ঘটনা ছাড়াই পার হয়ে গেলাম। তবে শিবির আরও বেশ খানিকটা দূরে। রান্না চলছিল সেখানে। আমরা আসার পর ঠিক হল এমন একটা সন্ধে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। তাই ভদকা-চা-চিঁড়ে ভাজা সহকারে আড্ডা চলল বেশ রাত পর্যন্ত। তারপর অমৃতসমান খানা খেয়ে ঘুম। কাল সকালে ওঠার তাড়া নেই। আমরা লাসি ব্রিজের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। অল্প হাঁটা কাল।

    ঘন্টা দুয়েকে এলাম তরণদিন। কেউ বলে তরংতরং। দুটো পথে নীচ থেকে সাউথ বেস ক্যাম্পের দিকে যাওয়া যায়। একটা শেরপা-গাঁ বা ইয়ামফুদিন হয়ে। আরেকটা আমরা যে পথে এসেছি। এই দুটো রাস্তার সঙ্গমস্থল তরণদিন। ইয়ামফুদিনের পথে অনেক ওঠানামা। ফিরব আমরা সেই পথে। তরণদিন বেশ বড়ো জায়গা। অর্থাৎ এখানে দু-দুটো হোটেল আছে। আর কিছু নেই অবশ্য।


    ইয়ামফুদিনের পথে

    এখানে টাটকা ইয়াকের মাংস পাওয়া গেল কিনতে। তাঁবু পাতার ঝামেলা নেই আজ। মালবাহক তরুণদের খুব খুশির দিন আজ। আমাদেরও। কাজ কম আজ। সায়েবদের একটা দল বিকেলে এল ইয়ামফুদিনের দিক থেকে। বিধ্বস্ত। সায়েব হতে পারে কিন্তু বুদ্ধিতে বাঙালদের সঙ্গে পারবে কেন। গুগল আমাদের আসা রাস্তা সুপারিশ করে না। এজেন্সিগুলোও এদিক দিয়ে আসতে চায় না। তাই শরীরপাত করে কঠিন রাস্তায় উঠে এসেছে ওরা। তবে হ্যাঁ, শরীর ওদের অনেক বেশি তাগড়া।


    চেরামের হোটেল
    তাই পরের দিন আমরা ক্যাম্পিং-এর জায়গা বদলে ফেললাম। সবাই বলবে তরণদিন থেকে পরের ধাপ চেরাম বা সেরাম। কিন্তু বিকেলের দিকে যখন চেরামের ঘন্টা দুই আগে একটা গোঠ দেখতে পেলাম চা বা অন্য যা পাওয়া যায় তার লোভে আমরা সেখানে হানা দিলাম। ট্রেল থেকে একটু ওপরে একটা ভাঙাচোরা মলিন বাড়ি। সায়েবরা ফিরেও না তাকিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। আমরা ঢুকলাম চা খেতে। তারপর দেখা গেল স্থানীয় মানুষ সেটাকে সরাই হিসেবেও ব্যবহার করে। আমরাও তাই করা মনস্থ করলাম। ফলে পরের দিন অল্প হেঁটে যখন চেরাম পৌঁছলাম তখন সেখানে সায়েবদের চিহ্নমাত্র নেই, সামনের চাতালে ফুটবল ম্যাচ চলছে আমাদের দলের সঙ্গে হোটেলের ছেলেদের। দিগন্তে প্রথমবারের মতো দেখা যাচ্ছে তুষারশৃঙ্গ।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্প (সাউথ)

    এখন থেকে এর পরের পাঁচদিন আমরা থাকলাম হিমাঙ্কের নীচে। আর সে যে কি ছুরির মতো হাওয়া দেয় আমরা বিজয়গড়েও কখনো দেখিনি। চেরাম থেকে রামজে বা রামচে ওঠার রাস্তা বলা যেতে পারে খাড়া নয়। কিন্তু সহজও নয়। ট্রি লাইন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সটান হিমবাহ-র দিকে চলেছে রাস্তা, হাওয়া পাতলা, শানিত। চেরামে বিকেল থেকে তুষারপাত শুরু হল। একটি দোকান-কাম-হোটেল আছে চেরামে। একটি ঝাঁ চকচকে নতুন বাড়ি হয়েছে। নাকি যাত্রীদের জন্যে বানিয়েছে পঞ্চায়েত। কিন্তু তার উদ্বোধন হয়নি বলে তাতে এখনও তালা। আমরা তাঁবু ফেলেছি তার গা ঘেঁষে । হাওয়া আটকাবে একটু আর বারান্দাটা প্লাস্টিক দিয়ে ঘিরে নিয়ে আমাদের রান্নাঘর। বেশ ভালো বরফ পড়ল সারা রাত। অনেকবার তাঁবুর গা থেকে বরফ ঝেড়ে ফেলতে হল যাতে জমা বরফের ভারে তাঁবু ধ্বসে না পড়ে। এইসব বেয়াড়া কাজ করে করেই কিন্তু বাঙালদের মাথা গরমের বদনাম। ঋষিপ্রতিম মহাপুরুষদের অনুরোধ করি একবার — শুদু একটিবার — ঘুমথলির ভিতর থেকে কনকনে হাওয়ার মধ্যে তাঁবুর গায়ের বরফ ঝেড়ে দেখুননা কেমন লাগে। এত বরফ পড়েও কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হল না। ট্রেকারদের একাধিক দল এল এবং বিমর্ষভাবে ফিরে গেল। আমরা দাঁতে দাঁত দিয়ে থেকে গেলাম আরও তিনদিন। আফটার অল আমরা বাঙাল। মন ভালো রাখার জন্যে একদিন শুঁটকি মাছ রান্না হল, একদিন ইয়াকের মাংস। হিকমত লিখেছেন স্বামী যার জেলখানায় মনে তার ফুর্তি থাকা দরকার।


    বিকেলের আলোয় রাতং ও কোকতাং শৃঙ্গ

    অবশেষে তিনদিন বাদে আবহাওয়া ভালো হল। ভোরবেলা উঠে দেখা গেল সামনে ঝকঝক করছে রাথং চূড়া, ডান পাশে কোকতাং। পায়ের নীচে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে মুচমুচ করছে বরফের গালিচা। সোজা গিয়ে বাঁয়ে ঘুরলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। ডানদিকের গিরিশিরার মাথায় উঠলে নিচে দেখবেন ইয়ালুং হিমবাহ। ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে চলে আসতে পারেন এখানে। মাইরি বলছি মনের ভার নেমে যাবে।


    ফিরে দেখা রাতং

    এরপর তো শুধুই ফিরে আসার গল্প। শপথ করতে করতে নামা এমন পথে আর না। স্বাভাবিক লোকেদের মতো বাসে-ট্রেনে-প্লেনে ঘুরে বেড়াব। যত কষ্টই হোক না। ফের যদি কেউ ট্রেকিং এর কথা কইসে দিমু তারে একখান।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবি : সুনন্দন চক্রবর্তী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments