• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • মা বিশালাক্ষ্মীর নৌকা : শ্রেয়া ঘোষ


    মা বিশালাক্ষ্মীর নৌকা; — অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী; সোপান - কলকাতা; প্রথম প্রকাশ: মহালয়া ১৪২৫; পৃষ্ঠাঃ ১১৫; ISBN: নেই

    মা বিশালাক্ষ্মীর নৌকা সঙ্কলনে ষোলটি গল্প। গল্পের নির্মাণে লেখক প্রচলিত রীতিকে এড়িয়েছেন সযত্নে। শুধু বিষয়বস্তুই নয়, কাঠামো-ও চেনা ছককে অস্বীকার করে।

    ভারি অদ্ভুত সব গল্প বলে চলেন লেখক। — একটা বাড়ি, যে বাড়িতে গান করেনা কেউ অথচ সে বাড়ির ঘর দোরে খেলা করে গান। বাতাসে ভাসে সুর। সেই সুর তুলে নিয়ে বসাতে হবে কথা। আশ্চর্য নদীর গল্প কহেন লেখক। সে নদীতে গান ভেসে চলে।বহতা বাতাসে সুর। আর সে গান গলায় তুলে নিতে পারে কেবল বরণমালিকা। সে সুর কখনও গাছ কখনও সজিনাফুল।

    এই গল্পের আগে আর এক গল্প। সে গল্পে খানিক ইতিহাস। খানিক লৌকিক অলৌকিকের মেশামেশি। দেবী বিশালাক্ষ্মী পান খেতে আসেন গৃহস্থের ঘরে। ঘরের পাশে নদী। দেবীর জন্যে নৌকো গড়ে এক মাল্লা। সে নৌকায় চড়ে হয়তো আসেন দেবী গান শোনার তরে কোন মানুষ, বৃদ্ধা এক ভেসে যান সে নৌকা চড়ে। একাকার মানুষী ও দেবী, আমাদের চিরপ্রবহমান ধারা যা প্রিয়কে দেবতা করে, দেবতাকে প্রিয়।

    এই সব ভেসে যাওয়া হয়তো মনে পড়াবে বেহুলার ভেসে যাওয়া অথবা জীবনানন্দ।

    প্রথম তিনটি গল্প আসলে একই আখ্যান। যে বিশালাক্ষ্মী দেবীর মন্দির গ্রামে, সেই দেবী কুপ্পুস মাঝির নৌকা মাঝ নদীতে দাঁড় করিয়ে গান শুনতে চান। মাঝি কিনা প্রত্যাখ্যান করে সে আবদার। দেবীর শাপে নৌকাসহ মাঝির সলিল সমাধি। সেই মাঝিই অতি স্বাভাবিক ভাবে নালিশ জানাতে আসেন গ্রামের এক গৃহস্থঘরে। যে গৃহস্থীতে দেবীও নাকি আসেন পান খেতে বা হারানো পায়ের নূপুর খুঁজতে। এমন গল্প আগ্রহ জাগাবেই। যে গল্পে পাশাপাশি অবস্থান করে অচিত্যা কাঁড়ার আর বরণমালিকা, যে গল্পের মেঠো রাস্তায় সাইকেল ভ্যানে করে পৌঁছনো যায় এমন গ্রামে যা নাকি এক শূন্যতামাত্র। কাহিনী আর কবিতা, বাস্তব, পরাবাস্তব, কল্পনা, স্থান কাল পাত্র সব ইচ্ছেমতো মিলিয়ে জুলিয়ে শেষ অব্দি লেখকের যাদুকলমের কারসাজি। আর কথনের ভঙ্গিটি এমন যেন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতা।একই ঘটনা, অভিজ্ঞতা ঘুরে ঘুরে আসে, যদিও গল্প পৃথক শিরোনাম নিয়ে শুরু হয়।

    পূর্বনারীদের নিয়ে গল্প বুনেছেন লেখক। রাধে, শান্তিময়ী, মেজ ঠাকুমা। শেষ সময় যখন আগত মেজঠাকুমা উঠানে শুয়ে অপেক্ষা করেন কালপুরুষের। আজীবন যে সব গল্প শুনিয়ে এসেছেন শিশুদের সেই সব গল্প ঝোলা ভরে কুড়িয়ে নিয়ে যেত কালপুরুষ, আকাশে তার নাতিপুতিদের শোনাবে বলে। এই সব অত্যাশ্চর্য কল্পনারা শরীর দিয়েছে বিচিত্র কহিনীর। নৌকা আর মৃত পুরুষ নারী, গান আর জোড়া তেঁতুলের হারিয়ে যাওয়া ছায়া। সে তেঁতুল গাছ জোড়াও কবেকার। বুড়ি ঝুরি মানুষেরা কত কথা যে বলে, তেমন কথা শুনিনি আমরা আগে। তেঁতুল গাছ বৃদ্ধ হলে,"সব ছায়া মানুষেরে দেওয়া শেষ হলে,গাছ তখন ছায়া দেয় জলেরে।" সেছায়ায় এমনকি বসতেও পারে কেউ যদি চ্যাটাই পাতে সত্যি।

    হয়তো সঙ্কলনের শ্রেষ্ঠ গল্প এই তেঁতুলগাছ। ছায়া মানে কি শুধু সূর্যের রশ্মি আটকে দেওয়া অন্ধকার ছোপ? ছায়া মানে আশ্রয়। বুড়ি ঠাকুমার স্নেহের মতো ঠান্ডা এক প্রশান্তি। সে ছায়া খোঁজে মানুষ, এক ঠেঙে শালিক আর এক দল বুড়ি। তেমন সব বুড়ি যাদের ছায়ারা আর পড়েনা মাটিতে। অথচ যারা নিশ্চিত নয় তারা ভূত কিনা। উৎসুক হয়ে তারা দেখতে চায় জল কি কোল পেতে ধরে তাদের ভাঙাচোরা শরীরহীন ছায়া? -- "তারা সকলে ছায়ার সন্ধানে হাঁটে। জল কি ধারণ করে তাদের ছায়া ঐ তেঁতুলগাছের মতো?”

    গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ১৬টি গল্পে দুটি ভিন্ন ধারার স্রোত। এতক্ষণ প্রথম ঘরানার গল্পগুলির উল্লেখ করে এবার পরের পর্বের কথা। এখানে চরিত্রগুলি ইতিহাসের পাতা থেকে। কিছু কিছু ঘটনাও। খানিক বাঁকিয়ে চুরিয়ে নেওয়া। ১৯২৮এ জন্ম নেওয়া বিপ্লবী চে গেভারার জীবনের প্রায় অন্তিম সময় নিয়ে কাহিনী। ১৯৬৬তে বলিভিয়াতে যে গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে চে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেই দিনগুলোর কথা বলেছেন লেখক। তিনি ৬৭ সালেই ধরা পড়ে নিহত হন, জেনে যখন গল্পের পাতা উল্টোচ্ছি, সন্তানের জন্য মন কেমনের কথা পড়ছি, কমলালেবুর স্নিগ্ধতার জন্যে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা জানছি তখনই আইকনিক বিপ্লবীর ভিতর থেকে আর একজন মানুষ আবছা উঁকি দিয়ে যায়। এই গল্প আমাকে বাধ্য করে বহুদিন পর চে'র মোটোর সাইকেল ডায়ারিজ পুনরায় পাঠ করতে। আর বুঝতে পারি আমি আসলে খুঁজছিলাম মায়ের জন্মদিনে পাঠানো চে’র চিঠিটা। আমি কতবার পড়লাম-- "A huge hug from your son, who misses you from head to toe."

    এই দ্বিতীয় পর্বে এসেছে কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত বা দেবদাসী। আলেকজান্ডার তুলে নিচ্ছেন সমুদ্রতীরে পড়ে থাকা আয়লানের দেহ। বা গগ্যঁ দেবদাসীকে মডেল হিসেবে এনে দেন আরেক শিল্পীকে পুরীর সমুদ্রতটে। গল্পগুলির বিমূর্ততা কিছুটা আরোপিত মনে হয়েছে। দু একটি গল্প, যেমন পিতৃধন এ-সঙ্কলনের গল্পের স্পিরিটের সঙ্গে যেন ঠিক খাপ খায়না।তবে সব মিলিয়ে নিঃসন্দেহে সতেজ বাতাসের গন্ধ এনে দিয়েছে এই বই।

    পরিশেষে দুটি কথা-- প্রারম্ভিক লেখকের কথায় প্রায় প্রতিটি গল্পের সূত্রটি ধরে দিয়েছেন লেখক গল্প পড়ার আগেই। একটা ধারণা নিয়ে পাঠক ঢুকছে গল্পে। আমার মনে হয়েছে এই প্রাককথন গল্প ও পাঠকের ওপর সুবিচার করেনি। গল্পের রস একটু হলেও হ্রাস পেয়েছে।

    আর গল্প পাঠের বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে অজস্র ছাপার ভুল আর সম্পাদনার ত্রুটি। প্রতি পদে এই ভুল অসহ হয়ে উঠেছে।

    তবে সামগ্রিক ভাবে লেখক তাঁর পাঠক তৈরি করে নিতে সক্ষম হবেন। অনিরুদ্ধবাবুর লেখা খুঁজে নিয়ে পড়বো ভবিষ্যতে।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments