• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • অকপট : চৈতালি সরকার


    টিফিনের পর মাত্র দুটো পিরিয়ড, তারপর ক্লাস সিক্সের ছুটি। স্কুলের মিড-ডে মিলে গরম ভাত, তরকারিতে খাওয়া ভালোই হয়। তবু বন্ধুদের সাথে টুকিটাকি চিপস, চানাচুর, আইসক্রিম না হলে চলে! এইজন্যই তো বায়না করে দশটাকা এনেছে দিশা।

    স্কুলে ঢোকার পারমিশন পেয়েছে দুজন। রামদা আনে চিপস, কুড়কড়ে আরও কত কি! আইসক্রিমের গাড়ি নিয়ে মতিকাকু হাজির হয় ঠিক দেড়টায়। শুধু ঘন্টা পড়ার অপেক্ষা, তারপরই গেটের মুখে অনাবিল আনন্দের স্রোত! নাইন টেনের দিদিদের টপকে জিনিস কেনার অধিকার অন্য ক্লাসের নেই। জিনিস কেনা নিয়ে কখনও ধাক্কাধাক্কি, কখনও মুখবর্ষণ দিয়ে সেদিনকার মতো মিটে যায়। ঠিক এই সময় স্টাফরুমও মেতে ওঠে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে।

    ব্যাগেই তো ছিল! টয়লেট যাবার আগেও দেখে গেছে দিশা। পাশ থেকে পল্লবী বলল, "বই বের করে দেখ তো। টাকাটা হয়তো ভেতরেই আছে।" দিশা বই বার করে ঝাড়তে লাগল। না, কোত্থাও নেই। হতাশার কালো ছায়ায় ভরে গেল দিশার ফর্সা মুখ। ঘরময় শুরু হল খোঁজাখুঁজির বাতাবরণ। ক্লাসরুম রীতিমতো পুলিশি প্রহরায়।

    দেবিকার উদ্যোগই সবচেয়ে বেশি। ও এই ক্লাসের মনিটর। দেবিকা প্রত্যেকের ব্যাগ সার্চ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও আবিষ্কার করল টাকা। খুব দূরে নয়, দিশার বেঞ্চেই বসে ছিল সুজাতা। ওর ব্যাগের জ্যামিতি বক্স থেকে পাওয়া গেল পরিষ্কার দশটাকা। ক্লাসের সবাই জানে সুজাতার বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। ওর বাবা কোন একটা দোকানে কাজ করে। সংসার চালাতে মাকেও কাজ নিতে হয়েছে। পড়াশোনায় সুজাতা ভালো বলেই এই স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছে। প্রায় দু বছর হয়ে গেলেও সুজাতা বন্ধুদের সাথে মিশতে পারে না। বেশিরভাগ সময় শামুকের মতো গুটিয়ে থাকে। চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও যেন ওর ভয়!

    সুজাতা হঠাৎ দৃঢ়তার সাথে বলে উঠল, "এই টাকা আমি বাড়ির থেকে এনেছি। আমার টাকা কেন দেব?"

    দেবিকা নাছোড়বান্দা, এই টাকা সে আদায় করবেই। মনিটর হওয়ার কৃতিত্ব ওকে দেখাতেই হবে। একদল মেয়ে সুজাতাকে ঘিরে ধরেছে। দিশা অপেক্ষা করছে কখন দশ টাকা নিজের মালিকানায় আসে। সুজাতা কিছুতেই দেবে না। ও নিজের ব্যাগ চেপে ধরল। পল্লবী বলল, "চল বড়দির কাছে যাই। বড়দি শাস্তি দিলেই সুজাতা টাকা দিয়ে দেবে।"

    দোতলায় ছিল বড়দিদিমণির ঘর। নামীদামি স্কুল না হলেও এখানে ডিসিপ্লিন আছে। ইচ্ছেমতো ছাত্রীদের স্কুলের বাইরে যাওয়ার অধিকার নেই। কোনো ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে ফোনে বাড়ির লোক ডেকে তবে ছাড়া হয়। শিক্ষিকাদের হাজিরার ক্ষেত্রেও নিয়ম বেশ কড়াকড়ি । সাড়ে দশটায় অ্যাটেনডেন্স, অন্যথা হওয়ার উপায় নেই।

    বড়দিদিমণি সামনের টেবিলে রাখা কাগজপত্রে চোখ বোলাচ্ছেন। দিশা, দেবিকা গুটিগুটি পায়ে দরজার সামনে এল।

    ভয়মিশ্রিত গলায় দিশা বলল, "বড়দি সুজাতা আমার টাকা দিচ্ছে না।"

    বড়দি চোখ তুলে বললেন, "কিসের টাকা?"

    এবার সোজাসুজি দেবিকার উত্তর, "দিশা বাড়ি থেকে দশটাকা এনেছিল। ও যখন টয়লেট গেছে, সুজাতা সেটা নিয়ে নিয়েছে।"

    ঝোড়ো হাওয়ার মতো দেবিকা এক নিশ্বাসে বলে চলল। কথাগুলো আত্মস্থ করে বড়দি সুজাতাকে ডেকে পাঠালেন। তারপর জেরা শুরু হল। ভীত হরিণী যেন বাঘের সামনে এসেছে! ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সুজাতা। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো ওর কন্ঠ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। দিশা, দেবিকা, পল্লবীদের সাবলীল বর্ণনায় হার মানল সুজাতা।

    ইতিমধ্যে অন্যান্য টিচার্সরা এসে গেছে। সুলেখাদি তো বলেই বসলেন, "সুজাতা এই কাজ করতেই পারে না।"

    ছন্দাদি অবশ্য বললেন "কাউকে ওভাবে চেনা যায় না। ছোটো মেয়ে একটা ভুল করে ফেলেছে।"

    বড়দিরও মনে হল সুজাতাই টাকা নিয়েছে। তিনি বললেন, "সুজাতা তুমি আর একাজ কোরো না। অন্যের জিনিস কখনো নিতে নেই। যাও দিশাকে টাকাটা দিয়ে দাও।"

    হুররে বলে দেবিকা ক্লাসে ধ্বনি তুলল। এই জয় যেন সম্পূর্ণ ওর। দিশার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যেভাবে জেরার মধ্যে ওদের পড়তে হয়েছিল!

    কেউ লক্ষ্য করেনি শেষ বেঞ্চে মাথা গুঁজে বসে আছে সুজাতা। বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা ওর চিবুক গড়িয়ে ড্রেসে ঝরে পড়ছে। ড্রেসের কিছুটা অংশ ভিজে উঠেছে। এত মেয়ের মধ্যে নিজেকে ওর একা মনে হল। মনে হল চারিদিকের মুখগুলি ভেংচি কেটে বলছে, "তুমি, তুমি ..."

    ঠিক সেইসময় সুজাতার পিঠে হাত রাখল সুমনা। ফিসফিস করে বলল, "আমি জানি তুই টাকা নিসনি। ওদের ভুল হয়েছে।" সুমনার কথায় মুখ তুলে চাইল সুজাতা। তখনও চোখে জল টলমল করছে। ওর মনে পড়ল কতদিন মাকে বলেছে, মা, জানো স্কুলে সবাই আইসক্রিম খায়! তাইতো মা বাবার আড়ালে টাকাটা দিয়েছিল।

    দিশা বইগুলো ঠিকমতো সাজাতে লাগল। ব্যাগটার ভেতরে ছেঁড়া জায়গাটায় হাত যেতেই কি যেন বাঁধল। কাগজের মতো লাগছে। টেনে বার করতেই বেরিয়ে এল পরিষ্কার দশটাকার নোট। যার জন্য আজ তোলপাড় হল স্কুল। দোষী প্রমাণিত হল সুজাতা। দিশার মনে হল একটু ভালো করে দেখলেই হয়তো টাকাটা পাওয়া যেত। খুব খারাপ লাগল দিশার কিন্তু প্রকাশ করল না। ও তাড়াতাড়ি ব্যাগে পু্রে নিল টাকা। একজোড়া চোরা চাহনিতে চারিদিক দেখে নিল কেউ দেখছে কিনা! দিশা ঠিক করল, একথা ও কাউকেই জানাবে না!

    স্থির হতে পারছে না দিশা। কেমন অস্বস্তি লাগছে!

    সুজাতার দিকে তাকিয়ে মনে হল ও যেন ধরা পড়ে গেছে। কোথায় লুকোবে? ব্যাগের ভেতরের চেন থেকে ও টাকাটা রাখল জ্যামিতি বক্সে। তবু ধরা পড়ে যাচ্ছে! দিশার মনে পড়ল দিদিমণিদের কথা। দিদিরা প্রায়ই বলেন, "সব সময় সত্যি বলবে। কোনো ভয় করবে না।" দিশার ভীষণ ভয় করছে। মা,বাবা, স্কুলের দিদিদের কথা বারবার মনে পড়ছে। সবসময় সত্যি কথা, সব সত্যি...! ওর মনে হল একদম ভয় করবে না, সব সত্যি কথা বলবে।

    ক্লাসরুম প্রায় শান্ত হয়ে এসেছে। মেয়েরা নিজের জায়গায় টুকিটাকি কথা বলায় ব্যস্ত। ঠিক সেইসময় দিশা দশটাকা তুলে বলল, "আমার টাকা পেয়ে গেছি, এটা সুজাতারই টাকা।" সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

    দেবিকা বিরক্তির সাথে বলল, "না দেখে মিথ্যে বললি কেন?"

    থিতিয়ে যাওয়া বিষয়টি নিয়ে শুরু হল শোরগোল। সুজাতার চোখের জল বাঁধ মানল না। সত্যি বলতে পেরে দিশার মনের গুমোট কেটে চোখে জল গড়িয়ে এল। ক্লাসে ততক্ষণে শর্মিলাদি এসে গেছেন। দিশার স্বীকারোক্তিতে তিনি প্রশংসা করলেন। সত্যি বলার মধ্যে এতো আনন্দ থাকে দিশা প্রথম বুঝতে পারল।

    ভয়হীন সেই ছোঁয়ায় কেটে গেল বাকি দুটো পিরিয়ড।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments