• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গল্প
    Share
  • জানোয়ার : ফাল্গুনী ঘোষ



    ।। ১ ।।

    ব রং ধীরে ধীরে মুছে গেল, কেন না দিন আর নেই। সন্ধ্যার ঘুলি ঘুলি অন্ধকার মাথার উপরে। পায়ের নীচে অবিরাম ছপ ছপ ছপ ছপ। যেন চারদিকের নিচ্ছিদ্র নৈঃশব্দ্য জমাট বেঁধে আওয়াজে রূপ নিয়েছে। হালকা অন্ধকারে নাও-এর মানুষগুলো সমবেত শোক পালনের শেষ প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে বুঝিবা। জামিল হোসেনের মুখে হাসি ফোটে। এই ভেবে যে, শহরে বাবু বিবির দল এটা জানে না এখনি এক অলৌকিক আলোয় ভরে যাবে সবকূল। সারেঙের গোল হাসিকে সম্মান জানাতে পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে গোল সাদা রুটির মত। দুদিন আগেই পূর্ণিমা ছিল কিনা!

    নৌকা যাত্রীদের কারো কারো গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ে। এই অন্ধকারে নদীর একূল ওকূলের হদিস নেই! দিনের আলোয় দেখা সুন্দরী গরান হেঁতালের বন এখন পুঞ্জীভূত অন্ধকারের স্তুপ। এখানকার জলে জঙ্গলে বিপদ-আপদেরা সাঁতরে বেড়ায়। এদিকে নৌকার মধ্যে আলো জ্বালার হাজার বিধি-নিষেধ। নাও-এর মাঝির কড়া বারণ। জলের উপর ঘুরপাক খাওয়া ছেঁড়া ছেঁড়া ধোঁয়ার অতলে মিটমিটে আলেয়ার মতো এক একটা আলো মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। ওগুলো অন্য কোনো নৌকার আলো।

    "ওহে সারেঙ নৌকা কি চলছে? মনে হচ্ছে যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।"

    উদ্বিগ্ন মহিলা কণ্ঠস্বরে হেসে ফেলে জামিল।

    "দু-পাশের কালো কালো গাছগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকো!"

    কিন্তু গাছগুলো পিছন দিকে সরে গেলেও নৌকা যেন এগোচ্ছে না। ওদিকে আকাশের চাঁদ নদীর স্রোতে নিজের মুখ খুঁজছে, যেহেতু এক টুকরো জোৎস্নামাখা বিষাদ নাও-এর চাপে জলের ঠেলায় কণা কণা হয়ে মিশে যাচ্ছে দিগ্বিদিকে। নাতনিটার দুদিন ধরে জ্বর! কেমন আছে কে জানে! চাপা নিঃশ্বাস পড়ে জামিলের। এখন ভাঁটির টানে নাও বেশি এগোয় না।

    ডুম ডুডুম ডুম.... ডুম ডুডুম.... ডুম ডুমা ডুম....।

    "দেখ গোপী, বনবিবির ঢাক বাজছে—"

    হাঁক পাড়ে জামিল। সারেঙের সব সময়ের সঙ্গী গোপী। নৌকার আগায় কাছি ধরে ঝিমুচ্ছিলো। সচকিত হয়ে কপালে হাত ঠেকায় উভয়ে। মনে মনে গুনগুন করে ওঠে—

    "রক্ষা করো বনবিবি। বাউলে মউলেদের যেন ক্ষেতি না হয়। আল্লা আল্লা হরিবোল হরিবোল।"

    সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে মধু সংগ্রহের জন্য প্রবেশের আগে মৌলিরা পুজো দিয়ে যাত্রা আরম্ভ করে। সেরকমই কেউ হবে হয়ত। ঢাক বাজিয়ে হাজত করল বনবিবিকে।

    নাও-এর ভেতর যাত্রীদের চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে তখন, হঠাৎ নৌকা থেমে গেল কেন! গোপী তা বুঝেও চুপ করে থাকে। জামিল সারেঙকে সে জন্ম ইস্তক দেখছে। মাঝনদীতে বনবিবির পথ কেটে সে কিছুতেই যাত্রা করবে না। একসময় নাও নড়েচড়ে ওঠে। ডুডুম.... ডুমা... ততক্ষণে ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেছে। দক্ষিণ রায় বড় কাঁচা দেবতা, জানে জামিল।


    ।। ২ ।।


    জামিল হোসেন নেশায় সারেং, এটা তার পেশাও। দুবেলা দুমুঠো রুজি-রুটির জোগাড় এখান থেকেই। তবে খাওয়া-পরা নিয়ে কোনদিনই বেশি ভাবে না জামিল। জলই তার ঘর বাড়ি। জীবন। চাঁদনী রাতে জলের গোপন ইশারা,গা ছমছমে রূপ তার শরীরকে শক্ত করে তুলতো একসময় । অন্যরা যখন রাতের বেলা বড় মিঞার হাঁকারে গুটি গুটি বাড়ির পথ ধরত, জামিলের তখন ভয় ডর নাই। পারঘাটায় নাও লাগিয়ে পা ছড়িয়ে আয়েস করে বসতো ছই-এর উপর। পাড়ে নোঙর করে জলের দিকে অপলক চেয়ে থাকত। যখন অতি ভোরের কুয়াশার জড়তা কাটিয়ে রোদের মিটমিটে হাসি জলে পড়ে তার কলজে ঠান্ডা করত, তখন সে মিল পেত তার বহুদিনের চেনা পুরনো বিবির প্রাণ জুড়ানো হাসির সাথে। জলের সঙ্গে প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের কথা ভাগ করে নিত জামিল। জামিলের জলের প্রতি নেশা ছিল তার বিবির চক্ষুশূল, কিন্তু তা সত্ত্বেও জামিলের জলের নেশা বিন্দুমাত্র কমেনি কোনো দিন।

    পঞ্চমুখী পেরিয়ে ভরা জোয়ারের বিদ্যাধরী, মাতলা নদীর মাতলামি সঙ্গী করে জামিল যেত মোহনায়। কাছি আগলে বসে থাকত নাও-এর আগায়। আকাশে দলা পাকানো কালো মেঘের আনাগোনা দেখে সঙ্গী-সাথীরা যখন নিরাপদ আশ্রয়ে নৌকা ভিড়োত তড়িঘড়ি, তখন জামিলের ভরসা ছিল ফকির আলি (গুণীর বাবলে)-র মন্ত্র। জোরে জোরে আউড়ে যেত —

    "ঈশান কোণে ম্যাঘ জমেছে
    করছে চঁচর চঁচর চঁ
    এহ্যানে ডিঙা বাইন্দা থো
    নদীর কূলে পানি ডাকে
    প্যাটের কুলে চমকে ওঠে
    করসে চঁচর চঁ
    এহ্যানে ডিঙা বাইন্দা থো...."
    মন্ত্রের জোরেই হবে হয়ত, ঝড় বাদলের কিছুক্ষণের মাতন-এর পর পশ্চিম দিক পরিষ্কার হয়ে আকাশের কালো মেঘের গায়ে রাঙা ছিটে লাগত, অনেকটা তার বিবিকে আদরের সময় যেমন লাজ ধরত বিবির গালে, তেমন।

    জামিল আসলে 'পোকাচালাক'। বাবাকে গোর দিয়ে সে এই কাজে পাকাপাকি নেমে পড়েছিল। মৌমাছির চাক ঘন জঙ্গলে কোথায় আছে এই ব্যাপারে সে বিশেষজ্ঞ। শহুরে বাবু বিবিরা তখন এত ঘুরতে আসত না বনে জঙ্গলে,তাদের চেনা সুখ ছেড়ে। কিন্তু বাঘের চোখে ধুলো দিয়ে মধু সংগ্রহের ঝুঁকি না নিয়ে সেই ব্যবসায় নামলে দু-একজন স্যাঙাত। আজও ভাবলে মুখ হাসিতে ভরে ওঠে জামিলের! অই কিনা পুরুষ মানুষের কাজ! ছো! তখন জামিলের হা হা হাসি স্যাঙাতদের বুকে থম ধরাত।এখন তোবড়ানো গালে সেই হাসি কুঁচকে ঝুলে পড়ে।

    'কি দিন ছিল আর কি দিন এল'— ভাবে জামিল! আজকালকার ছেলেরা জলে যেতে আরো নারাজ। তারই নিজের ছেলে ক্যানিংয়ে রেস্টুরেন্টের চাকর। সব সময় বাপকে দেখে বিরক্ত হয়। বাপ পিতিমের নাও বন্ধক রেখে,সবজি চালানের ব্যবসায় ডাহা ফেল মেরে, এখন চাকরগিরি করছে। গলার কাছটা তেতো হয়ে ওঠে তার।

    গোপী ঠেলা দেয় ঝিমন্ত জামিলকে—

    "কি হে সারেঙ ঘুম দিলা নাকি?"

    রাতের খাওয়ার পাট চুকিয়ে এসময় জামিল সারেঙ গোপি নাইয়াকে সঙ্গে করে লাঘাটায় এসে বসে। রাতের বেলায় জলের সাথে সোহাগ না দিলে সারেঙের ভাত হজম হয় না এখনো! ছেলে রাগে গজ গজ করে, বিরক্ত হয়।

    "ওই তো তোর মুরোদ! মামুর ভয়ে চাকর হলি!"—

    থুঃ করে তামুক চিবানো থুতু ফেলে একদলা জামিল।

    "— ঐ লেহ! আবার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে বসেছ!"

    "হা হা হা.... গোপীরে, ওদের বড়ো মিঁয়ার ভয়! কালু রায়ের ভয়! ভয় জলা-জংলা বা' এর..."

    জামিলের দম-ধরা গলা হিসহিসিয়ে ওঠে—

    "'বাঘ তোর জন্ম ফতেমার ঘরে
    ধামাচাপা দিয়ে রাখি তোরে
    বাঘ তোর ধর্ম করিস কুকর্ম
    যদি নাড়িস হাত যদি নাড়িস পা
    দোহাই মা ফতেমা দোহাই মা ফতেমা'---"
    ফকির আলীর 'কামাল সাজন' ডিঙোবে বড় মিঞার অত ক্ষ্যামতা ছিল না। গুণীর বাউলে বটে ফকির আলি। উয়ার খিলেন মন্তরটা বেথা যাওনের ছ্যালো না কখনও!"

    তাল দেয় গোপী---

    "সিবার তোমার ঘাড়ে যখন বাঘে ধরলে...."

    মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জামিল জড়ানো গলায় বলে চলে,

    "...হ, হ! কু'দে কু'দে এগুচ্ছিলাম! চোখ তো পোকার দিকে, পোকা ঝিদিক পানে যাচ্ছে আমিও সেদিক পানে, সেই মওকায় বাঘে ধরল...."

    "বাউলে কয়ে দেছিল 'বনগরম' তাও তুমি কারু কথা শুনবার না!"

    এক ঝাঁকান দিয়ে বলে ওঠে জামিল,

    "হ রে হালার পো! আমি গুণ গান বুঝি! খোঁজতোলা দেখে বুঝেছিলাম। সাথে ছিল 'বোটকা'। তোরা পটকা মেরে বাঘ তাড়ালি তাই আজও তর লগে বসে আছি রে!"

    কপালে হাত ঠেকিয়ে গোপী বিড়বিড় করে,

    "বনবিবি রক্ষা করেছেন!"

    জামিলও তাই জানে এবং মানেও। গুণীর বাউলের খিলেন, চালান কখনও ভুল হয় না। নিশ্চয় তার বিবি বা ঘরের কারো নিয়ম পালনে কিছু দোষত্রুটি হয়েছিল। নাহলে বাঘের কি ক্ষমতা যে খিলানের বাঁধন কেটে অকেজো দাঁত নখ নিয়ে জামিলের বুকে থাবা বসায়! পাঁজরের মতো দেখতে বুকের মধ্যে বাঘের থাবার শুকনো অতীতের আঁচড়ে হাত বুলোতে বুলোতে জামিল ভাবে — "মা বনবিবি সেদিন খুব রক্ষা করেছেন দক্ষিণ রায়ের কবল থেকে।"


    ।। ৩ ।।


    নিঃশ্বাস দীর্ঘতর হয় সারেঙের। সময় মানুষের অনেক জেদ আর গোঁয়ারতুমি গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। একবগ্গা, তেজী জামিল আজ মেনে নিয়েছে মহাজনী শোষণ। নাও-এর মালিক প্রতাপ নস্করকে বাইরে সে সমীহ করে চললেও মনে মনে হাজার বার থুতু ফেলে প্রতাপ নস্করের প্রতাপ-এর উপর।

    বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা চেহারার প্রতাপের চোখদুটো লোভী, চকচকে। মুখের হাসি দিয়ে ঢেকে রাখে সে চোখ, সহসা মানুষ বোঝে না যে উদগ্র লোভ খেলা করছে অন্তরালে। বৈষয়িক হিসেবে প্রতাপ তুখোড়। খুব অল্প দিনের মধ্যেই একটা রেস্টুরেন্ট, টুরিস্ট লঞ্চ, মাছ ধরার ট্রলারের মালিক। শীতের তিন-চার মাস সুন্দরবন ভ্রমণকারীদের সহায়তায় চার-পাঁচ লাখ হাতে আসে। বছরের বাকি পড়ে থাকা গ্রীষ্ম বর্ষার ঘড়ির কাঁটায় মাছ ধরার ট্রলার ভরসা। সাথে বছরভর রেস্টুরেন্ট চলে রমরম করে।

    প্রতাপের দাপটে জামিল, গোপীদের শরীরগতিক নরম পড়ার উপায় নেই তাই। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে হাওয়ায় গা ম্যাজম্যাজ করলেও মাছের খোঁজে নাও ভিড়োতে হয় মোহনায়। গ্রীষ্মের জ্বলুনে রোদে শরীর পোড়ে, পুড়ুক! মাঝির রেহাই নেই! আগের মতো শরীরের তাগদ নাই জামিলের। তিনটে পেট চলে তার রোজগারেই। রেস্টুরেন্টে সারা দিনমান থেকে ছেলে যা পায়, মদে উড়িয়ে টলতে টলতে ঘরে ফেরে। মেয়েটা যে বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠছে সে কথা খেয়াল থাকে না নবাবজাদার।

    "দাদা... ও দাদাআ আ আ... তোমার ঘুম ধরে নাই! এহ্যানে বসি বকরবকর করবা নাকি রাতভোর!"—

    মেয়েলি ডাক চাঁদনী রাতের সমস্ত মায়া খানখান করে দেয়।

    "অ মিঁয়া! তোমার নাতনি হাঁক পারসে। যাও গিয়া।" —

    গোপীর ঠ্যালায় জামিলের তামাকের ঘোর ছিঁড়ে যায়! বড় ত্রস্ত হয়ে ওঠে জামিল। নাতনি তার নয়নের মণি।

    "তুমি এই রেতের বেলায় কেনে ঘরের বাইরিলা মা! দুবলা শরীর! সবে জ্বরটুন থে উঠেছ!"

    "না দাদা, আমার শরীর গতিক ঠিকই আছে! দুদিন হেঁসেলে মাছ হয় নাই। কাল বিহানবেলায় নদীর ওপারের চড়ায় যেতে হবে।"

    জামিলের সোহাগী নাতনি পরীবিবি দেখতে দেখতে দিব্যি ডাগরডোগর হয়ে উঠেছে। গ্রামের পাঠশালায় দু-তিনবছর যাওয়ার পর আর এগোয়নি তার শিক্ষা। জামিলের হেলাফেলার সংসারের নূর পরী। বড় সোহাগে জামিল তার সুন্দরী পোতির নাম রেখেছিল। সেই পরী এখন দাদার কষ্ট বোঝে। প্রায় প্রতিদিন নদীর ওপাশের জঙ্গলের চরে মাছের সন্ধানে যায়, বুড়ো মানুষটার পাতে দু- এক টুকরো দেওয়ার জন্য। বুড়ো হাড়ে যা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে লোকটা, বড্ড মায়া হয় পরীর।

    জোয়ার ভাঁটায় ভেসে থাকা দেশে সকাল আর বিকেলে জোয়ারের জল নামে। এত দিন বিকেলেই পরী যেত মাছ ধরতে। কিন্তু তখন সব মাছ ধরুনেদের হুড়োহুড়ি। সে কারণে মেয়েটা আজকাল রাত থাকতে উঠে ওই পাড়ের চরায় জল কাদার মধ্যে মাছ ধরে। মাছ ধরার যন্ত্রপাতি বলতে প্রায় কিছুই নেই। জলকাদা মেশানো প্যাঁকপেঁকে পাঁকে শরীর ডুবিয়ে 'হাতচালান'। পলিযুক্ত জল কাদার মধ্যে গলা অবধি শরীর ডুবিয়ে মন্ত্র পড়লেই মাছ হাতে ওঠে।

    জামিলের বড্ড ভয় করে। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে। পরী ডাগর হইছে। সারা দিনমান ঘর গুষ্টির সাথেই থাকে। তাই জামিলের চেষ্টা তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসার। এদিকে রাত্রে দাদার মুখে জঙ্গলের গল্প না শুনলে পরীরও ঘুম আসে না। দাদার আসতে দেরি দেখে সে তাই একাই পারঘাটায় ছুটে এসেছে। এখন বুড়োর ডরের বহর দেখে খিলখিলিয়ে ওঠে ---

    "এই চাঁদনী রাতে কে ধরবে তোমার পরীরে! নাকি বড়োমিঁয়া টুঁটিতে ধরবে!"

    তাড়াতাড়ি পোতির মুখ চাপা দেয় দাদা।

    "বড়োমিঁয়া কেন ধরবে রে! বনবিবি আছে! মা বনবিবির নাম লিবা! মানিকপীর আছে! আল্লা আল্লা হরি বোল হরি বোল!"

    এই বিশ্বাস পরীর মনেও। বনবিবি থাকতে ভয় কিসের! সেই যে জঙ্গলে তার দাদার বুকে হ্যাঁচোড় মেরেছিল। কিন্তু টেনে নিয়ে তো যেতে পারেনি। সে সেই বনবিবির দয়ায়। না হলে কি রক্ষে থাকত!

    "বাঘ তোর জন্ম ফতেমার ঘরে…."

    দাদার মুখে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। জঙ্গলের চড়ায় সেঁধোবার আগে বিড়বিড় করে, মা বনবিবির উদ্দেশ্যে মাথায় হাত ঠেকায় রোজ পরী।

    "তুমি ডর করোনা দাদা আমি বাঘ বাইন্দা মন্ত্র পড়ে নিই।"

    * * * *
    গদগদে পাঁক থেকে ডুব দিয়ে হাতে মাছ ধরে যখন পরী সটান সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়, তখন পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি এক অনন্য নারী মূর্তি সে। একদিন বেলাবেলি নাও নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় জামিল দেখেছিল তার পরীকে। নাও-এর প্রতাপ নস্করের কড়া দৃষ্টি চারদিকে টহল দিতে দিতে ভাস্কর্যসমান নারীমূর্তির সামনে চকচকে লোভী দৃষ্টিতে বদলে গেল। তীব্র সে চোখ, গোধূলি বিকেলের মরচে রঙ আলো, কাদামাখা পরীর নারীশরীরের উদ্ভাস জামিলের পাঁজরে কাঁপন ধরিয়েছিল সেদিন।

    "তাড়াতাড়ি সাদী করাতে হবে পোতির," মনে মনে ভাঁজে জামিল।

    "কিগো দাদা বাঘের হাঁকাড় শুনলা খোঁজতোলা দেখলা, বড় মামুর লগে দুগা কথা কইলা না!"

    শরীর দুলিয়ে হাসে পরী। ঘুমোতে যাওয়ার আগে বুড়োর সাথে এই রসিকতা প্রায় সব দিনই হয়। আজ কিন্তু জামিলের মন ভারী। ভাবনায় চিন্তায় কোমর ঝুঁকে যাচ্ছে তার।

    "ও দাদা বড় মিঞার কথা শোনাও কেনে"— পরীর আবদেরে গলা।

    "হ রে মা, আগে আগে মধু আনবার ঝন্যি বাদাবনে ঢুকলে খোঁজতোলা দেখি ঠাওর করতাম; হাঁকাড় পেতাম রেতের বেলা। মাছ ধরার ঝন্যি যে দিক-পানে সরের বন সিদিক পানে পাড়াবন্ধ দিতাম। তারপর নাও বাঁধতাম সিখানে। তখন শুনেছি হাড়হিম করা হাঁকাড়। রেতের আইন্দারে গা হাত পা শিরশিরিয়ে উঠত বেটি।"

    আজকাল জামিল আর তার স্যাঙাৎরা বাঘের পায়ের ছাপ দেখেনা। জোয়ার ভাঁটার মতো ভোর আর সন্ধ্যায় মাঝে মধ্যে কেবল বাঘের হাঁকাড় শোনে। সে যাই হোক। বাদাবনের মানুষগুলোর বাঘের ভয় করে থাকলে পেট চলে না। সে-কারণে পুরনো অভ্যাসে জামিল আজও নাও ছাড়ে। পরী আধো আলোর আবছা পাঁকে হাত চালিয়ে জলের জীবের খোঁজে মত্ত হয়ে ওঠে।


    ।। ৪ ।।


    ভোরের কুয়াশার পর্দা দেওয়া পাঁকে ডুব দিলে কাপড় চোপড় বশে থাকে না পরীর। কেইবা দেখছে ভেবে সেও অত সামলায় না। আজ ভোর থেকেই গুমোট ধরে আছে। সকাল বেলার গাছের পাতা কোনও নরম হাওয়া দিচ্ছে না। সূর্য ওঠার আগে একরকম কুসুম রঙা বাতাস বয়। নদীর ঘোলা জলে, জঙ্গলের ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে থাকা ধোঁয়ার সাথে তাদের মিতে পাতানো থাকে। পরী হাত চালিয়ে মাছ ধরতে ধরতে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে এই ভেলকি দেখে। করররর..... করররর.... ঠরঠর....ঠরঠর..... বিচিত্র সব পাখির ডাক। পরীর সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন। লম্বা ঠ্যাং নিয়ে পা টিপে টিপে গরান হেঁতাল গাছের ঝোপ ঘেঁষে ঘেঁষে পরীর ঠিক আগে আগে এগিয়ে চলেছে।

    দাঁতে দাঁত চাপে পরী। ঢং দেকো দিকি! সব মাছ, গেঁড়ি গুগলি উয়ারাই খাবেন। প্রায় দৌড়ে দৌড়ে তেড়ে যায় বকগুলোর দিকে। কাঁকড়াগুলোও গর্তের মধ্যে সেঁদিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। খচ খচ খচ... থমকে যায় পরী। কিসের যেন খচর-মচর শব্দ ভেসে আসছে, জঙ্গলের একটু ভিতরে বাইন গাছের পাশ থেকে। শিরশির করে পা কাঁপে মেয়েটার। বড় মিয়াঁ নাকি! বিড়বিড় করে —

    "বাঘ তোর জন্ম... শ ইশ...শ...

    বাঘ তোর ধর্ম করিস কুকর্ম... জোরে জোরে শ্বাস টানে... শ শ শ...

    দোহাই মা ফতেমা দোহাই মা ফতেমা... '

    খচ মচ খচ মচ... জোড়হাত কপালে ঠেকায় ত্রস্ত পরী, 'বনবিবি রক্ষা করো মা... আল্লা আল্লা হরিবোল হরিবোল...' হলুদ কালো ছোপ ছোপ কিছু একটা নড়ে উঠল হেঁতালের ঝোপে। কোনোও খোঁজতোলা নাই। হাঁকাড়ও নাই। ওটা কি তাহলে! রুদ্ধশ্বাসে পরী অপেক্ষা করে! হলুদ সবুজ হেঁতালের ঝোপ থেকে জ্বলজ্বলে লোভী চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

    শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে পরী। পিছন ফিরে জলের দিকে পা বাড়ায়। ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে সে। তার ঘাড়ের উপর থাবা দিয়ে পাঁকের মধ্যে লেপ্টে ফেলে দিচ্ছে........ 'হে মা বনবিবি! আর বুঝি দাদার সঙ্গে দেখা হলো না! দাদা জোয়ান পুরুষ ছিল, তাই লড়েছিল'...পরীর ঘুরে চোখ মেলবার সাহস নেই। দুবলা শরীর থর থর করে কাঁপছে। হিংস্র জানোয়ারটা পরীর নরম ছোট বুকে থাবা বসায়। পরী প্রাণপণে চেঁচাতে চায়, কিন্তু হিংস্র জন্তুর আর একটা থাবা পরীর মুখে চেপে বসেছে ততক্ষণে।

    থকথকে ঘন জেলির মতো পাঁকে জন্তুটা তাকে প্রায় পুঁতেই ফেলে। আর পারে না পরী। শুধু গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ের কাছে। কোন গরগর আওয়াজ নেই। এটা কি তবে বড় মিঁয়া নয়! কোন হাঁকাড় নেই। গোঁ গোঁ নেই! শুধু খসখস খচরমচর আওয়াজ!

    * * * *

    সেদিন সন্ধ্যেবেলায় জামিল ঘাটে নাও বাঁধতে বাঁধতেই শোনে প্রতিবেশীদের গুঞ্জন। পরীকে নাকি বড়মিঁয়া ধরেছে। কেউ কেউ আবার বলে অন্য কোনও কথা। মাথা ঝুঁকিয়ে ভাবে জামিল, বেশ ডাগর হয়েছিল পরী মা। আজ আর ঘরে ফেরার দরকার নেই, নেই কোনো মশকরা। পেটের আগুন ছাইচাপা পড়ে গেছে। নৌকা বাঁধা রেখে জলের ছলাৎ ছল শোনে শুধু।

    মনে হয় পরীকে দক্ষিণরায়েই নিলে। কোনোও ত্রুটি হয়ে ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সে তো কোনদিন বনবিবির রাস্তা কাটেনি! বিশ্বাস হয় না মনে যে, বড়মিঁয়া পরীকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। সে তো প্রতিবছর নিয়ম করে শিরনি দেয় বনবিবিকে। তবে কি পরী ঠাট্টা করত বলে! গলার নলি শুকিয়ে খসখস করছে জামিলের। চোখের পানি মরে গেছে। খরখরে চোখে ওপাড়ের জঙ্গলের দিকে চায় অশক্ত জামিল। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে হিংস্র ধকধকে দুটি চোখ ঘন জঙ্গলের মধ্যে জেগে আছে। খিদে, তেষ্টায়, মনের যন্ত্রণায়, ঘোরালো চোখে সেদিক পানে চেয়ে আনমনে বলে ওঠে —

    "চোখ দুগা লাগছে যেন প্রতাপ নস্কর চেয়ে আছে...."

    তার আঠালো চটচটে জিভে এর বেশি কোনও আওয়াজ বেরোয় না।

    গোপী দাঁত চিপে বলে ওঠে —

    "বিহালে শালার হাঁকাড় দেখলা! আরো মধু, আরো মাছ না আনতে পারলে নাও লিয়ে লেবে! দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলে! ঘরে ঢুকতে দিলেনা!"

    পরীর কাদামাখা উদ্ভিন্নযৌবনা নারীমূর্তি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। থুতুর সাথে এত দিনের জমানো ঘৃণা, আক্রোশ ছেটায় জামিলের গলা —

    "শালা জানোয়ার!!!!"



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments