খোশ্ক্ বিরয়ান
|| ১ ||
আমিনাবাদের নবাবের একটা বাবুর্চী ছিল। সে একটা এমন বিরিয়ানি বানাত যার গন্ধে মরা মানুষের জিভে জল এসে যায়। ক্রমে সেই বিরিয়ানির গন্ধ আর বাবুর্চীর নাম গোটা আর্যাবর্তে এত ছড়িয়ে গেল যে লোকে বলতে লাগল ওমর খৈয়ামের পর এই একটা লোক ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে বোধহয়। লোকটাকে সবাই বলত—খোশ্ক্ বিরয়ান।
আমিনাবাদ থেকে পঁচিশ ক্রোশ পুবে সাহিবাবাদ। সেখানকার বাদশা এ দেশ,ও দেশ, বিদেশ থেকে বহু বাবুর্চী আনিয়েও বিরিয়ানিটা দাঁড় করাতে পারছিলেন না। তুর্কি, মালয়, কম্বোজ, জাম্বেজি কিছুই বাদ রাখেন নি। কিন্তু আমিনাবাদের বিরিয়ানির তুলনায় তাদের বিরিয়ানিকে ঘি-ভাতের বেশি বলা যায় না।
যুগটা ছিল বিরিয়ানির। তখন রাজাবাদশার দরবারে নবরত্নের প্রথম রত্ন বাবুর্চীকেই ধরা হত। লোকে বলে তানসেন কি বৈজুও যখন মালকোসে তান মেরেছেন তখন যদি একটা তেমন লজিজ বিরিয়ানির গন্ধ সভায় ভেসে আসত তো গান নাকি বন্ধ হয়ে যেত। শ্রোতারা অজুহাত দেখিয়ে পালাত। বিরিয়ানি যে কত বড় শিল্প সেটা তো ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত।
কী করা যায়? শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হল খোশ্ক্ বিরয়ানকে চুরি করতে হবে। বৃদ্ধ আমির হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন। আমিনাবাদ যদি হামলা করে তো কী হবে? বাদশা বললেন—মামলা? এক কথায় ফেরৎ দিয়ে দেব। বিরয়ান তো চাই না। বিরিয়ানিটা চাই। কীভাবে বানায়, কী মশলা ব্যবহার করে সেইটা জেনে নিতে হবে।
—যদি না বলতে চায়?
—সে দায়িত্ব আমার। বললেন সাহিবাবাদের বাদশা।—একটা জাসুস লাগাও। আমিনাবাদের প্রাসাদে ঢুকে খোঁজখবর নিক।
একটা জাসুস, দুটো তালিম দেওয়া বাঁদর আর আধডজন পায়রা দূত বরাদ্দ হয়ে গেল। দিন সাতেকের মধ্যে আমিনাবাদে গিয়ে কাজও শুরু করে দিল তারা। আফতাব আর খণ্ড্ নামের বাঁদর দুটোর কাজ ছিল দরকারের সময় গোলমালের সৃষ্টি করে জাসুসকে তার কাজে সুবিধে করে দেওয়া এবং গাছে লুকোনো পায়রা দূতের কাছে চিঠি দিয়ে আসা।
প্রিয় জাঁহাপনা,
আমিনাবাদ একটা আজব মুলুক। নবাব একটু পাগলাটে। প্রাসাদের সকলেই একটু ক্ষ্যাপাটে আছে। বাড়িটা দুভাগে ভাগ করা। শীশমহল আর হাওয়ামহল। বেগমরা থাকেন শীশমহলে। নবাব থাকেন হাওয়ামহলে—যেখানে সাচমুচ সব হাওয়ার। নবাব সারাদিন একটা ছাতিম গাছের তলায় বসে হুক্কা খান।
আফতাব কাল গোটা একটা দিন গায়েব ছিল। পরে তাকে পাওয়া গেছে ছোটি-বেগমের বিছানার তলায়। তারপর থেকে সেও পাগলের মতো হু হু করে হাসছে।
ইতি জাসুস।
প্রিয় জাসুস,
খোশ্ক্ বিরয়ানকে দেখলে? কীরকম লোক? কী করে? কোথায় থাকে? কখন ঘুমোয়? কখন ওঠে? কী রঙের সুর্মা লাগায় চোখে? সব বিস্তারিত জানাও।
ইতি সাহিবাবাদের বাদশা।
প্রিয় জাঁহাপনা,
খোশ্ক্ বিরয়ান থাকে হাওয়ামহলে। কিন্তু রাঁধে শীশমহলে। হাওয়ামহলের বারান্দায় কোথাও একটা সতরঞ্চি পেতে শুয়ে পড়ে সে। রাঁধে গভীর রাতে। মশলাগুলো রাখে শীশমহলের ভিতর বাবুর্চীখানায়, যেখানে ঢোকা খুব সহজ নয়। যদিও তার কাঁধে চেপে খণ্ড্ একদিন শীশমহল ঘুরে এসেছে—আপত্তি করে নি কেউ। খোশ্ক্ বিরয়ানের চোখে সুর্মা নেই। কিন্তু দাড়িতে একটা লালচে ভাব আছে। মনে হয় জাফরান।
নবাব কিন্তু আশ্চর্য, কোনো আমিষ খাবার ছোঁন না। বিরিয়ানি তো নয়ই। অথচ বেগমরা দিনরাত তাই খাচ্ছেন। এমনকি চাকর সেজে আমিও। এ স্বাদ ভোলার নয়।
ইতি জাসুস।
নবাব কেন মাংস খায় না জানো? জানাও। শীগ্গীর!—সাহিবাবাদের বাদশা।
প্রিয় জাঁহাপনা,
একটা কিছু আছে আমিনাবাদে, যার রহস্য আমাদের ভেদ করতেই হবে। নবাবের এই সাড়ে সাতশো নাতিনাতনি—এরা দিনের বেলা কোথায় যায়? রাত্রে শীশমহলে সবাই ঠিক চলে আসে খেতে। নবাব চান না তারা মাছ মাংস খাক, বিরিয়ানি স্পর্শ করুক। কেউ শোনে না। আশ্চর্য খোশ্ক্ বিরয়ান নিজে কিন্তু নিজের বিরিয়ানি খায় না। সেও খায় নবাবের মতো রুটি আর গুড়।
বিরিয়ানিটা যারা দিনের পর দিন খাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তারা দিনের বেলা ঘুমোয়, রাতে জাগে। অনর্গল হাসে। হাসতে হাসতে ছুটোছুটি করে। ভীষণ কথা বলে। আর কী একটা আনন্দে বিভোর হয়ে থাকে।
কাল সকাল থেকে আফতাব আর খণ্ড্ দুজনেই বেপাত্তা। খুঁজে খুঁজে সন্ধ্যে হয়ে গেল। হঠাৎ দেখি আমি শীশমহলের পিছনের একটা দরজায়। দরজাটা খোলা। কেউ কোথাও ছিল না। ভিতরে ঢুকে পড়লাম।
একটা অদ্ভুত দৃশ্য—মহলের মাঝখানে চকমিলানো উঠোনে দাঁড়িয়ে খোশ্ক্ বিরয়ান বলছে—নহিঁ, নহিঁ, নহিঁ। উঠোনের চারদিক থেকে সব বেগম, তাদের ছেলেপুলে আর সাড়ে সাতশো নাতি বলছে—হাঁ, হাঁ, হাঁ। হঠাৎ দেখি দূরে ব্যাটা খণ্ড্ দুহাত তুলে নাচছে। আমি ভিড়ের পাশ কাটিয়ে তাকে ধরতে যাব, এমন সময় মাথায় পড়ল একটা বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সব অন্ধকার।
জ্ঞান ফিরলে দেখি হাওয়ামহলের উঠোনে ছাতিমগাছের উপর চাঁদ উঠেছে। আমি পড়ে আছি মাটিতে। সামনে একটা আরাম কেদারায় বসে আমিনাবাদের নবাব খাচ্ছেন তাম্বাকু। তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে।
—সাহিবাবাদের জাসুস তুমি? নবাব জিজ্ঞেস করলেন আমায়।
মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে উঠে বসলাম। দেখি নবাবের দুপাশে ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মূর্তিমান আফতাব আর খণ্ড্। মনে হল তাদেরই একজন মাথায় মুগুর ভেঙেছে আমার। রাগের চোটে বলে ফেললাম—হ্যাঁ। নবাব বললেন—বাদশা'কে বলো খোশ্ক্ বিরয়ানের খোয়াব না দেখতে। এ জিনিস পাবার নয়।
—কিন্তু আপনি তো বিরিয়ানি খান না। বললাম আমি।
নবাব আস্তে আস্তে আসন ছেড়ে উঠে পড়ল। যেতে যেতে বলল—এ আমিনাবাদের অভিশাপ। এ আমাদের নসীব থেকে যাবার নয়।
আফতাব আর খণ্ড্ নবাবের সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেল হাওয়ামহলে। আমি মাটিতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম—এ বিরিয়ানি কি সত্যি সাহিবাবাদের নসীবে নেই?
ইতি জাসুস।
প্রিয় জাসুস,
খো. বি.-কে আমরা হাসিল করবই। তিনরাত্রি পর একটা গাধার কাফিলা ঢুকবে আমিনাবাদে। একটা লোক থাকবে। এক চোখ কানা। দরজাটা খুলে দিও তাকে। খো. বি.-কে তুলে আনতে হবে। সজাগ থেকো। খুদা হাফিজ।
ইতি সাহিবাবাদের বাদশা।
তিনরাতের পর ভোররাতে, ভোরের সানাই বেজে ওঠার ঠিক আগে আগেই, হাওয়ামহল থেকে বেরিয়ে এল একটা গাধার কাফিলা। একটা ঘুমন্ত মানুষকে সতরঞ্চি সমেত মুড়ে।
সাহিবাবাদে ফিরে এসে জাসুস যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। আমিনাবাদের প্রাসাদের ভিতরটা অবিকল নকল করে বসানো হয়েছে সাহিবাবাদের প্রাসাদে। একধারে শীশমহল, অন্যদিকে হাওয়ামহল। একদল বোরখা পরা মেয়ে ছুটোছুটি করছে শীশমহলে। বাদশা বললেন—বিরয়ানটাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। রাত্রে ঘুম ভাঙলেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে রান্নাঘরে। লুকিয়ে তখন দেখবে ব্যাটা কী করে। জানতেও পারবে না, কোথাকার রান্না কোথায় গিয়ে করছে।
জাসুসের কেমন মনে হল, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
রাত্রিবেলা নিজের থেকেই উঠল বিরয়ান। পাগড়িটা ঠিক করে নিয়ে চলল শীশমহলের দিকে। ছাতিমগাছের তলায় বসে বসে অন্ধকারে তামাক টানছিলেন সাহিবাবাদের বাদশা।
খোশ্ক্ বিরয়ান বলল—নহিঁ, নহিঁ, নহিঁ।
বাদশার ভাড়া করা সাড়ে সাতশো ছেলেপুলে আর জেনানা বলল—হাঁ, হাঁ, হাঁ।
খোশ্ক্ বিরয়ান মাথা নিচু করে চলে এল রান্নাঘরে।
খোশ্ক্ বিরয়ান মাংসটা রেঁধে নিয়ে চালটা চাপাল অল্প আঁচে। হালকা করে ভেজে নিল দেহরাদুনীর লম্বা দানা। কেশর গুঁড়ো করতে লাগল এক পাশে। শুকনো আলুবোখরার আঁশ সমেত বীচিগুলো ছড়িয়ে দিল মাংসের উপর। একটুখানি ঢালল অঙ্গুরী সিরকা, একটু গুলকন্দ-এ-আফরোজ, এক চিমটে মিষ্টি সোডা, এক টুকরো আনারের ফুল। তুলসীর কাঠ জ্বালিয়ে হাঁড়ির ভিতর করে নিল হকীমী ধুঁয়া।
তারপর সে পাগড়ি খুলে মাথাটা ঝাঁকাতে লাগল। হতবাক, ভয়ার্ত, বিনিদ্র জাসুস তখন জিভ গিলে ফেলে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে।
নিজের কামরায় বসে বাদশা সবে বিরিয়ানির প্রথম পাহাড় ভেঙে দ্বিতীয়টিতে যাবেন এমন সময় জাসুস এসে আছড়ে পড়ল।—জাঁহাপনা, ওর মশলা হল খুশকি!
বাদশা বমি করতে লাগলেন। অশ্রাব্য গালিগালাজ বেরোতে লাগল মুখ দিয়ে।—`বাঁধকে লাও' না `কাঁধকে লাও' কী বললেন বোঝা গেল না। কাঁধে করেই নিয়ে এল পেয়াদারা খোশ্ক্ বিরয়ানকে। তার চুল খুলে গেছে। লণ্ডভণ্ড পাগড়ি। বাদশার আরো একপ্রস্থ বমি। —`কুঁধ দো' না কী একটা বললেন। সবাই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। একজন কনুই দিয়ে গুঁতো মারতে গেল খোশ্ক্ বিরয়ানকে। বাদশা দুহাত তুলে নিজেকে দেখিয়ে বললেন—আমাকে আমাকে। কাশতে কাশতে আবার বমি হতে থাকল তাঁর।—পিঁদ্দা দো, পিঁদ্দা দো। পেয়াদারা কী করবে বুঝতে না পেরে কনুইয়ের গোঁত্তা মেরে অজ্ঞান করে দিল বাদশাকে। যতক্ষণে জাসুস বুঝল বাদশা পিকদানটা চেয়েছিলেন ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে।
আরো গভীর রাতে উঠে বাদশা আবার শুরু করলেন গালির বর্ষণ। খোশ্ক্ বিরয়ানকে বাঁধা হয়েছিল থামের সাথে। বাদশা বললেন—ছাঁটো, ছাঁটো। নাপিত এল একটা। ভীষণ রেগে গিয়ে বাদশা বললেন—জল্লাদকো লাও। নাপিত বলল—সে তো কালই চুল ছাঁটিয়ে গেছে। কিন্তু জল্লাদ এসেই চট্ করে বুঝে গেল কী করতে হবে। বাদশা কাশতে কাশতে একটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন খাম্বায় বাঁধা খোশ্ক্ বিরয়ানকে।—গর্দন তক্ ছাঁটো।
জল্লাদ একটা হাড়িকাঠ এনে তাতে চাপিয়ে দিল খোশ্ক্ বিরয়ানকে। জাসুস সভয়ে দেখল খোশ্ক্ বিরয়ান বাদশার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে।
আউর নহিঁ তো কম্বখ্ৎ তু মেরা খুশকি লে।"
খোশ্ক্ বিরয়ান দুচোখ বুজে বলল—হাঁ, হাঁ, হাঁ।
তারপর তার মুণ্ডু গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
বাদশাও হঠাৎ—আ-আ-আ-আ বলে চিৎকার করে নিজের আসন থেকে ছিটকে পড়ে গেলেন মেঝেতে গালচের উপর।
রাত্রে ছাতিম গাছের উপর চাঁদ উঠেছে। আমিনাবাদের নবাব একা একটা আরামকেদারায় বসে তামাক খাচ্ছিলেন। তখন হাওয়ামহলের বারান্দা থেকে সতরঞ্চি গুটিয়ে উঠে পড়ল খোশ্ক্ বিরয়ান। আমিনাবাদের যে অভিশাপ ঘোচার নয়।
শীশমহলের উঠোনগুলোয় কাচ্চাবাচ্চারা কিলবিল করছিল।
—নহিঁ, নহিঁ,নহিঁ।
—হাঁ, হাঁ, হাঁ।
নতুন খোশ্ক্ বিরয়ান তার ভারি হতে থাকা মাথার উপর পাগড়ি চাপিয়ে রওনা হল রান্নাঘরের দিকে। বিরিয়ানি না বানিয়ে যার কোনোদিনও নিস্তার নেই।
আফতাব আর খণ্ড্ সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল চেনা হাতের বিরিয়ানির জন্য শীশমহলের ভিতরেই কোথাও একটা ভিড়ে। বিরিয়ানির যুগে তারা জানত বিরিয়ানির কখনো অন্ত হয় না, নেই।
শুধু চাইতে হয়, চেপে ধরে।