• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গল্প
    Share
  • অপদার্থ : কৌশিক ভট্টাচার্য


    "অপদার্থ!"

    এই বলে গালি দিয়ে, জগুকে ছেড়ে রঘুর সাথে প্রেম করা শুরু করলো মোনালি। পুরোটাই যে ওই হাড় বদমাস রঘুটার প্যাঁচ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেকদিন ধরে অনেক সয়েছে জগু, আর সহ্য হলো না। ভূতচতুর্দশীর রাতে একটা চিরকুটে "আমার মৃত্যুর জন্য রঘু দায়ী" লিখে গলায় দড়ি দিলো জগু।

    তারপর জগু ভূত হলো।

    ভূত হয়ে জগু দেখলো অবস্থাটা আরো খারাপ। বেঁচে থাকতে সবাই ওকে অপদার্থ বলে এসেছে এতকাল —বাড়িতে মা-বাবা, পাড়াতে দাদারা, ইস্কুলে মাস্টাররা, কলেজে মেয়েরা, অফিসে বসেরা —কে নয়? কিন্তু ভূতেদের মধ্যে ওইসব অপদার্থ-টপদার্থ বলা তো আছেই, উপরি হলো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকার মতন কোনো জায়গাই নেই। সব ভালো গাছ বা হানাবাড়ি কোনো না কোনো ভূতের দখলে, আর তারা সকলেই বনেদি ভূত, কেউ দু’শ' বছরের কেউ তিনশ' বছরের পুরোনো। জগুর মতন অর্বাচীন ভূতকে দেখলেই তারা দাঁত খিঁচোয়, "যা ভাগ, এখানে জায়গা হবে না!"

    বাধ্য হয়ে জগু ভুঁইফোঁড় ভূত কালু ওস্তাদের শরণ নিলো। কালু ওস্তাদ এক নেতার লেঠেল ছিলেন কিছুদিন আগেও। ইলেকশনের সময় দুই নেতার কাজিয়ায় তাঁর এন্তেকাল হয়। ভূত হবার পরে আপন পৌরুষবলে নিজেই বড়মাপের নেতা বনে গেছেন। ইদানিং কালু ওস্তাদ বড় বড় গাছ আর হানাবাড়ি জবরদখল করবার ব্যবসাতে বাংলার ভূতসমাজে বেশ নাম করেছেন।

    সব শুনে কালু ওস্তাদ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন:

    —আগে ভালো কিছু করে দেখা।

    —কি করতে হবে, স্যার?

    —দুলোপাড়ার অশথ গাছের মামদোটাকে মেরে ভাগাতে পারবি?

    জগু মাথা নিচু করে চুপ হয়ে রইলো।

    —তেঁতুলতলার ব্রহ্মদত্যিটাকে ভয় দেখিয়ে পাড়াছাড়া করতে পারবি?

    জগু আবার মাথা নিচু করে চুপ।

    —হুম, তুই কেমন বীর সে বেশ বোঝা যাচ্ছে। একটা সহজ কাজ দিচ্ছি, কালীতলার ঝামাপুকুরের ধারের যে বড় শেওড়াগাছটা, ওটাতে গতকাল একটা নতুন শাঁকচুন্নি এসেছে। বেটির প্রচণ্ড দেমাক। গতকাল শেষরাতে আমার লোকেরা যখন ওর কাছে সেলামি চাইতে গেছিলো তখন নাকি ঝাঁটা হাতে বেরিয়ে এসে দাঁত খিঁচিয়ে তাদের বলে, “কে কালু ওস্তাদ? ওসব কালু ওস্তাদ-ফোস্তাদ কাউকে আমি পরোয়া করি না!” পারবি ওই শালীর চুলের মুঠি ধরে আমার কাছে নিয়ে আসতে?

    ওই শাঁকচুন্নি-টি যে কে জগু সেটা ভালো করেই জানে। যমুনাদি — কাঁসারিপাড়া গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। পুলিশ স্বামীর সাথে মারপিট করতে গিয়ে পরশু রাতে মরেছে, তবে মরার আগে স্বামীটিকে এমন কামড়ে দিয়েছে যে সে বেচারা এখনো হাসপাতালে। বেঁচে থাকতেই জগু ওনার ধারেকাছে যেত না, আর এখন যাবে? পাগল!

    "অপদার্থ!", জগুর মুখে কোনো বাক্যি নেই দেখে গর্জে উঠলেন কালু ওস্তাদ, "লাঠালাঠি যখন তোর দ্বারা হবে না, তখন মানুষ বাঁচা!"

    —মানে বুঝলাম না স্যার।

    —একটা গাধাও তোর চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে। চারদিকে কি হচ্ছে চোখ-কান খোলা রেখে দেখ একবার। মানুষ ব্যাটারা সব লড়ছে, মরছে আর তারপর ভূত হয়ে আমাকে বাসাবাড়ির জন্য জ্বালাচ্ছে। যদি একটা মানুষেরও ভূত হওয়া ঠেকাতে পারিস, তবেই তোর কেসটা ভেবে দেখবো, নইলে নয়। যা, ভাগ এবার এখান থেকে!


    ***


    মানুষ বাঁচানো! কি অদ্ভুত! জগু জানবে কি করে কোন হতচ্ছাড়ারা অপঘাতে মরার তাল করছে!

    নাঃ, বাসা আর জুটবে না জগুর। নেহাত ঝুড়িপুকুরের পাশের পার্কে একটা বেঞ্চ এখনো ফাঁকা রয়েছে, নইলে রাস্তাতে শুতে হতো।

    সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পার্কের যে বেঞ্চটাতে জগু রাত কাটায় সেটার মাথার উপরের লাইটটা আবার গেছে বিগড়ে। আজকাল ভূত হবার পর অন্ধকারের ভয়টা জগুর আরও বেড়েছে। কালু ওস্তাদের যোগ্য শিষ্য খুব কম নেই, অনেকেই ঝুড়িপুকুরের আশেপাশে থাকে। জগু পার্কের বেঞ্চে রাত কাটাচ্ছে জানতে পারলেই তাদের কে যে কখন তোলা চেয়ে বসবে কে জানে? একমাত্র ভরসা ছিলো ওই লাইটটা। কালু ওস্তাদের শিষ্যরা আলোর ধারেকাছে সচরাচর আসে না।

    তাড়াতাড়ি বেঞ্চি-বাসার দিকে পা বাড়ায় জগু।

    অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, তবে মনে হয় বেঞ্চটাতে কারা যেন বসে আছে। এই খেয়েছে, বেঞ্চিটাও জবরদখল হয়ে গেলো নাকি?

    —প্লিজ, মোনালি, প্লিজ, ভুল হয়ে গেছে! আর একবার চান্স দাও আমাকে!

    —আর কোনো চান্স নয়!

    রঘু না? আনন্দে গায়ে কাঁটা দেয় জগুর। মোনালি ওকে ছেড়ে দিচ্ছে নাকি? বেশ করছে! ওই রকম একটা বদমাশকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত!

    রঘুকে এড়াতে উঠে দ্রুত হাঁটা দেয় মোনালি। রঘুও চলে পিছন পিছন, কিন্তু মোনালি একবার পিছন ফিরে কোমরে দু হাত রেখে ভুরু কুঁচকে দাঁড়ায়। থমকে থেমে যায় রঘু।

    —মোনালি, মোনালি, প্লিজ শোনো। আমাকে ছেড়ে গেলে আমিও দেখো সুইসাইড করবো ওই জগুটার মতন।

    কোনো পাত্তা না দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে যায় মোনালি।

    বলে কি? সুইসাইড করবে রঘু? নাটক করছে নাকি?

    সোনায় সোহাগা! রঘু আবার দাঁড়িয়ে আছে কালু ওস্তাদের গাছ-বাড়ির ঠিক নিচে। মানুষ বাঁচানো কাকে বলে তা এবার কালু ওস্তাদকে দেখিয়ে দেবে জগু।

    একগাল হেসে রঘুর সামনে এসে দাঁড়ায় জগু।

    —কি রে রোঘো, তুই নাকি আমার মতো সুইসাইড করবি? অত সোজা?

    এক লহমা হাঁ করে জগুর দিকে তাকিয়ে থাকে রঘু, তারপর দু হাতে বুক চেপে ধরে দুলতে দুলতে ধপাস করে আছড়ে পড়ে মাটিতে।

    উপর থেকে কালু ওস্তাদ হাঁক পাড়েন:

    —বাড়ালি তো আরও একটা ভূত? অপদার্থ!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments