আজ ট্রেনে সেরকম ভিড় নেই। দেবারতি একটা জানালার ধারের সিটে গিয়ে বসল। কাঁধের ঝোলাগুলো পাশের সিটে রেখে একটু দম নিল সে। আশেপাশে কোনো চেনা নিত্যযাত্রী চোখে পড়ল না। অবশ্য দেবারতি সচরাচর এর আগের মেদিনীপুর লোকালটায় যায়। সরকারি অনুদানে চলা বাঙলা মিডিয়াম স্কুলগুলোর দিদিমণিদের ভিড় থাকে বলে ফেরিওয়ালারা 'দিদিমণি স্পেশাল' বলে ডাকে ওই ট্রেনটাকে। সাড়ে ন' টার ওই ট্রেনটায় খুব ভিড়ও হয়। তবু বেশিরভাগ ওই ট্রেনটাতেই যায় দেবারতি। তাহলে একটু সুস্থির হয়ে স্কুলে ঢুকতে পারে। ও জানে আজকে আধঘন্টা পরের ট্রেনটায় যাচ্ছে বলে বড় দিদিমণির মুখ ফুলে যাবে। কিন্ত ওর কিছু করার ছিল না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেবারতি গা এলিয়ে দৃষ্টি চালিয়ে দিল। ভাবল গতির একটা নিজস্ব দর্শন আছে। যেন মনে হয় ফেরার দরকার নেই যে কোন দিকে চলে গেলেই হয়। এই মূহূর্তে মনে মনে যেন সেটাই চাইছে ও। আজকে সকালের ঘটনাটা মনে পড়লে মাথার ভেতর দপ দপ করছে। এত বড় ঘটনাটাকে রুদ্র কি করে সামান্য বলে উড়িয়ে দিতে পারে বুঝতে পারছে না দেবারতি। তবে কি ঘটনাটা সত্যিই সামান্য? ওই কি একটু বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। চারপাশের সবুজ সরে সরে যাচ্ছে। নিজেকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে ফেলতে খণ্ডিত আত্মপরিচয়ে মনে মনে টুকরো হতে হতে এগিয়ে চলেছে দেবারতি, দেবারতি আহমেদ। স্বামী: রুদ্র শহিদুল্লা আহমেদ। নিবাস: শ্যামপুর। এককালে বৃহৎ নদীবন্দর ছিল এই শ্যামপুর। দামোদর, ভাগীরথি, রূপনারায়ণের মত তিন তিনটে নদীকে ছুঁয়ে আছে এই সবুজ শ্যামল শ্যামপুর। প্রথম থেকে দেবারতির ভালই লেগেছিল গ্রামটা। যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাট থেকে সিধে এই শ্যামলিকাময় গ্রাম। তখন রুদ্র-র জন্য সব কিছুই ভাল লাগছিল। কাস্টমসের বড় অফিসার অনিমেষ গোস্বামী কিছুতেই মেনে নেননি রুদ্রকে। একমাত্র আদরের মেয়ে যে এমন কাজ করতে পারে তা তাঁর কল্পনার অতীত ছিল। উনি বড় মুখ করে সন্তানদের শিখিয়েছিলেন বটে কোন মানুষকে জাত ধর্মের দোহাই দিয়ে ছোট চোখে দেখা ঠিক নয়। তাই বলে একেবারে বিয়ে করতে হবে একটা মুসলমানকে, এ যেন বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের সহিষ্ণুতার পরিচয়। তাই যখন দেবারতি আর রুদ্র-র সম্পর্কের কথা কানে গেল নিজের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে রুদ্রকে থানায় তুলিয়ে নিয়ে গেলেন অনিমেষ। বেধড়ক মার মেরে রুদ্রর ভুল শুধরোবার চেষ্টা করা হল। সে একটা দিন গেছে। খবর পেয়ে থানায় গিয়ে রুদ্র-র জামিনের ব্যবস্থা করা, ওকে ডাক্তার দেখানো সবই দেবারতিকেই করতে হয়েছে। কারণ রুদ্র-র শ্যামপুরের বাড়িতে বিধবা মা আর নাবালিকা এক বোন ছাড়া কেউই ছিল না ওর পাশে দাঁড়াবার মতো।
দেবারতি তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সে রুদ্রকেই বিয়ে করবে। সে এই ধর্মান্ধতার প্রতিবাদ করবেই। রুদ্র-র ফেটে যাওয়া কপালে হাত বুলোতে বুলোতে প্রশ্ন করেছিল, "আমাদের সন্তানের ধর্ম কি হবে রুদ্র? আজ জন্মসূত্রে তুমি মুসলমান আর আমি হিন্দু। আমাদের কেউ কোনও দিন সুযোগ দেয় নি নিজেদের ধর্ম বেছে নেওয়ার। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এই ধর্ম আমি মানি না। আমি মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী। আমি চাই আমাদের সন্তানের ওপর কোন ধর্ম কেউ যেন চাপিয়ে না দিতে পারে। ওরা বড় হয়ে সহজ মনে যে ধর্ম পালন করতে চায় যেন করতে পারে। তুমি কি পারবে রুদ্র?”
রুদ্র চোখ বন্ধ করেছিল, শুধু ক্ষীণ জলের ধারা নেমেছিল গাল বেয়ে। রূপনারায়ণের জলের মতো চিকচিক করে উঠেছিল সে ধারা। যেন সেই জলের ধারায় ধর্মের সীমারেখা মুছে গিয়েছিল দুটি শিক্ষিত যুবক যুবতীর মাঝখান থেকে। প্রেম এমনই, সে যা পেতে চায়, ধরেই নেয় তা পেয়ে গেছে। সম্মতির অপেক্ষা রাখে না।
সেদিন ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা দিয়ে আর বাড়ি ফিরল না দেবারতি। রুদ্র তখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের রিসার্চ স্কলার। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস ঘুরে সিধে রুদ্র-র হোস্টেলে গিয়ে উঠেছিল সে। ধর্ম সেদিন হার মেনেছিল।
ঘটাং ঘটাং করে আওয়াজ করে ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল মাঝপথে। অন্যমনস্ক থাকায় ঠিক খেয়াল করতে পারল না কোথায় এসে পৌঁছেছে। দেবারতি মনে প্রমাদ গুনলো। আজ বড্ড দেরি হয়ে যাবে। সকালে রুদ্র-র সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ায় অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে। বিয়ের কয়মাস পর থেকেই রুদ্র যেন কেমন বদলে যেতে লাগল। শ্যামপুরে ওদের বাড়ি নিয়ে এলো, সব ভালোই লাগল তবু দেবারতি গোস্বামী থেকে আহমেদ হতে হল তাকে। একটু খারাপ লেগেছিল বটে তবু সে গুরুত্ব দেয় নি তেমন। রুদ্র বুঝিয়েছিল পরিবারের আর সবার জন্য যদি....। দরকার ছিল। ঠিক সেই মূহূর্তে দেবারতির একটা পরিবারের প্রয়োজন ছিল, ভীষণ প্রয়োজন ছিল। দেবারতি যে মা হতে চলেছিল।
দেবারতি একটু অধৈর্য হয়ে উঠল, কি ব্যাপার এত তো দেরি হয় না। ট্রেনটা ছাড়ছে না কেন? দূরে যেন কোন শোরগোল শুনতে পাচ্ছে। দেবারতি চিন্তায় ডুবে যায়। কিন্তু রুদ্র তার একমাত্র ছেলের সাথে যা করলো সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না দেবারতি। একে তো জোর খাটানো বলে। সৌম্যর বয়স মাত্র দশ। তার ধর্ম যে মানবতার ধর্ম হবে রুদ্র-র সাথে এমনই তো কথা ছিল। সৌম্য বড়ো হয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে কোন ধর্ম তার আদৌ লাগবে কিনা। তাহলে কেন রুদ্র ওর হয়ে সিদ্ধান্ত নিল। কেন দেবারতিকে না জানিয়ে ওর শিশু সন্তানের সুন্নত দিল? ভিতরে ভিতরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেবারতি আহমেদ, নাকি দেবারতি গোস্বামী? সে কি সত্যিই ধর্ম মানে না। তা হলে সৌম্য মুসলমান হলেও বা ক্ষতি কি? নাকি ভেতরে ভেতরে আসলে নিজের আনুষ্ঠানিক ধর্মকে আঁকড়ে রাখতে চায়। মনে মনে আজও দেবারতি কি...
দূরের শব্দ এখন অনেক কাছের। কামড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা যাত্রীদের মুখে উদ্বেগের চিহ্ন স্পষ্ট ...কে একজন দৌড়ে এসে হাতল ধরে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠল কামরায়। 'দাঙ্গা, বড় দাঙ্গা লেগেছে গো। ওই ওরা এগিয়ে আসছে।' দেবারতির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে আসছে। 'হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন।' লোকটাকে চেনে দেবারতি। একটু ক্ষ্যাপা গোছের মানুষ ট্রেনে ভিক্ষা করে খায়। হিন্দু না মুসলমান জানা নেই। তারস্বরে চিৎকার করে রোজ ছড়া কেটে কেটে অনেক বুলি কপচায়। আজ এই বিপদের দিনেও তার বিরাম নেই। “হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন/ ধর্ম শুধু নেতার খেলা সবাই আপনজন।” কামরার সবাই একে একে লাফিয়ে নামছে পাশের সবুজ ধানখেতের ওপর। দেবারতিও। তারপর দৌড় দৌড় দৌড়। পিছনে উন্মত্ত জনতা ধেয়ে আসছে। দেবারতি দৌড়চ্ছে। ও সত্যিই জানে না কোন দেবারতি প্রাণ ভয়ে পালাচ্ছে। দেবারতি আহমেদ নাকি দেবারতি গোস্বামী। শুধু জানে দাঙ্গাবাজরা পিছনে আসছে, তাকে খুব অল্প সময়ে উত্তর খুঁজে নিতে হবে।