গরম চায়ের কাপটা প্লেটের ওপর রাখতে গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল সুজাতা। প্রায় সাড়ে দশটা বাজতে চলল অথচ বিধানের সেই চেনা হাঁকডাকটা তো শোনা যাচ্ছে না! সকালের দিকে সেকেন্ড রাউন্ড চা-টা না খেলে শরীরের ঝিমুনি ভাবটা পুরোপুরি কাটতে চায় না ওঁর। এটা ওঁর বহুদিনের পুরনো অভ্যাস। সেই চাকরি জীবনের দিনগুলোতে যখন সাড়ে আটটার মধ্যে স্নান করে কোনো রকমে নাকেমুখে দুটো গুঁজে দৌড়তে হতো ট্রেন ধরতে, তখনও কাগজ পড়তে পড়তে আর এক কাপ চা না খেলে ওঁর চলত না। অবসরের পরেও সেই অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখন অবশ্য দিন চলে অনেক ধীর গতিতে, রয়েসয়ে। সুজাতাকেও এখন আর ভোর রাতে উঠে রান্না চড়াতে হয় না। বুবাই-টুবাই চাকরিতে ঢোকার পর থেকে পারতপক্ষে সুজাতাকে আর রান্নাঘরে খুব একটা ঢুকতেই হয় না। রান্নার লোক, বাগানের মালী, ঠিকে কাজের লোক কোনো কিছুরই অভাব রাখেনি বুবাই। টুবাইও মাস গেলে হাজার কয়েক টাকা হাতখরচের জন্য পাঠিয়ে দেয় নিয়মিত। ঝিমলিটাও মাসে দু-একবার যখনই আসে কিছু না কিছু কিনে আনে। সত্যি বলতে কী, ছেলেমেয়েদের জন্য আজকাল চাপা একটা গর্ব অনুভব করে সুজাতা। কম কষ্ট তো এককালে করতে হয়নি এই সংসারের জন্য! বিধানের ছিল প্রাইভেট ফার্মের সাধারণ চাকরি। সংসার খরচ ছাড়াও তিন ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, অতিথি-অভ্যাগতদের আসা-যাওয়ার খরচ, শ্বশুর-শাশুড়ির অসুখ-বিসুখের খরচ, সবদিক সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হত প্রতিমাসে। তারমধ্যেই যখন যেটুকু সুযোগ পেত সেটুকু টাকাই “নেই করে” জমিয়ে রাখত সুজাতা। স্বপ্ন দেখত ভাড়াবাড়ির বদলে মাথার উপর একটুকরো নিজস্ব ছাদের। জমানো কিছু ফিক্সড ডিপোজিট আর অফিস থেকে নেওয়া লোনের টাকায় এই জমিটা যখন কিনেছিল বিধান তখন এইসব অঞ্চল বাঁশঝাড় আর জলাজঙ্গলে ভরা। সন্ধ্যে নামলেই শেয়ালের ডাক শোনা যেত। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই নাক সিঁটকেছিল। সুজাতা সেসব পাত্তা দেয়নি। বদলে বছর ঘুরতেই ভাড়াবাড়ির আরাম ছেড়ে উঠে এসেছিল দুকামরার প্লাস্টার না হওয়া, ছিরিছাঁদ-হীন “নতুন বাড়ি”তে। আর সেই জলা জায়গাই এখন বিত্ত বৈভবের আড়ম্বর নিয়ে বৃহত্তর কলকাতার অংশ। কাঠাপিছু জমির দাম এখানে অনেকদিন আগেই লাখের গণ্ডি ছাড়িয়ে কোটির ঘর ছুঁই ছুঁই। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সুজাতার সেই বাড়িরও আড়েবহরে স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটেছে। আর এই বাড়িকে কেন্দ্র করেই আজ ছুটির দিনে অনেকদিন পর সবাই একসাথে হয়েছে ওরা। বুবাই, শ্রেয়া দুজনেই বাড়িতে রয়েছে। আর্য-তিন্নিরও আজ স্কুল ছুটি। দুদিন হলো টুবাই, শ্বেতা আর ওদের ছেলে বিল্টু এসেছে। আজ সকালেই ঝিমলি এসেছে মেয়ে সৃজাকে নিয়ে। জামাই সুরঞ্জন বিকেলে আসবে বলেছে। সবার হইচইতে সুজাতার মনেও খুশির বান এসেছে।
আমি চা নিয়ে সারা বাড়ি খুঁজছি, আর তুমি কিনা একা একা এই বারান্দায় বসে? কি ব্যাপার, আজ চায়ের জন্যে তাড়া নেই মোটে? শরীর-টরীর ঠিক আছে তো? ... সেন্টার টেবিলের উপর চায়ের কাপদুটো রেখে বিধানের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল সুজাতা।
—সকাল থেকে তুমি যা ব্যস্ত! তাই আর বিরক্ত করিনি।
—কেমন একটা রাগের গন্ধ লেগে আছে যেন কথাটায়!
—না, রাগ করব কেন? টুবাইরা আসার পর থেকেই তো দেখছি তোমার রান্নাঘরে দৌড়াদৌড়িটা একলাফে কেমন বেড়ে গেছে। আর আজ তো আবার...
—তো কী আর করি বলো! টুবাইটা লাউচিংড়ি, কচুরলতি এসব খেতে এতো ভালোবাসে, অথচ ওদের দেশে সবকিছু পাওয়াই যায় না ঠিকমতো। যদিও বা কিছু মেলে, সে আবার রাঁধার হাঙ্গামার জন্য খাওয়াই হয় না।
—আর তাই তুমি এই হাঁটুর ব্যথা নিয়ে সারাদিন ধরে টুবাই-এর জন্য গলদা চিংড়ির মালাইকারি, মোচার ঘন্ট, বুবাই-এর ফেভারিট মাটন কষা, ঝিমলির পছন্দের চিকেন পসন্দা, বিকেলে জামাইয়ের জন্য মাছের কচুরি...
—আরে না, আমি শুধু রেসিপিগুলো বলে দিচ্ছিলাম, রান্না তো মালিনীই করছে। কিন্তু তুমিও তো কিছু কম যাও না! এখানে বসে বসেই সারাদিনের মেনুর খবর জোগাড় করে ফেলেছ!
—কথা ঘোরাচ্ছ? আচ্ছা সু, তুমি সত্যিই খুশি হতে পারছ? নাকি নিজেকে ভোলাতে এই আনন্দ-আনন্দ খেলাতে ডুবে রয়েছ?
—কেন শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছ বলোতো? কোনো কিছুই কি আর পৃথিবীতে চিরস্থায়ী হয়?
—না, তা হয় না। কিন্তু তবুও মন মানছে কই! কত কষ্ট করে তিলে তিলে গড়ে তোলা একটা জিনিস... নিজেদের সমস্ত শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তৈরি করা…চাকরি পাওয়ার পর বুবাইও তো কত উৎসাহ নিয়ে দোতলাটা তৈরি করালো, পুরো বাড়িটা সাজালো, গোছালো। তারপর এক এক করে ছেলেমেয়েদের বিয়ে, আর্য-তিন্নির জন্ম...কত টুকরো টুকরো স্মৃতি এর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ওরা তো পুরোটাই ভেঙে...
—এতো ভেবো না। ...বিধানের বাঁহাতটা নিজের ডানহাতের মুঠোতে আলতো করে জড়িয়ে নিল সুজাতা। ...সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুরই তো পরিবর্তন হয়। সেগুলো মেনে নিতে না পারলে শুধু কষ্টই বাড়ে। একবার ওদের দিকটাও ভেবে দেখো তো। এই এতো বড় বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, সেকি মুখের কথা? এমনিতেই সংসারে হাজার একটা খরচ। আর্য-তিন্নি বড় হচ্ছে, ওদের পড়াশোনার খরচও বাড়ছে। বুবাই-শ্রেয়া আর কত করবে বলতো? টুবাইটা দু-তিন বছর পর পর আসে। তাও পাঁচ-সাত দিনের বেশি এবাড়িতে থাকার সুযোগ পায় না। তার কাছে তো আর বাড়ি সারানোর খরচ চাওয়া যায় না।
—আর ঝিমলি? তার কথা কিছু বললে না?
—যাহ্, কী যে বলো না! জামাইয়ের থেকে হাত পেতে টাকা নেবে তুমি?
—জামাইয়ের থেকে কেন নেব? মেয়ে কি আমার অকর্মণ্য? ছেলেদের সাথে সমান তালে লেখাপড়া শিখিয়ে তাকেও তো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগটুকু তৈরি করে দিয়েছিলাম আমরা।
—তাতে কী? বিয়ের পর মেয়ের থেকে টাকা নেওয়া যায়? আসার সময়ে হাতে করে কিছু নিয়ে আসে সেটা আলাদা ব্যাপার।
—অ, বিয়ের পরে মেয়ের থেকে টাকা নেওয়া যাবে না, কিন্তু ছেলেদের থেকে নেওয়া চলে। অথচ বাড়ির ভাগ নেওয়ার সময়ে ছেলে-মেয়ের সমানাধিকার! অদ্ভুত যুক্তি তোমাদের সু। যাক্গে, তোমাদের নিয়ম তোমাদেরই থাক। আমার ও নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। তাছাড়া ওদের কারো কাছে কিছু দাবি জানানোর ইচ্ছেও আমার নেই। আমি শুধু ভাবছিলাম আমাদের কথা। ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে বসবাস করা অভ্যেস। এই বাড়িতে আসার আগে যে ভাড়াবাড়িতে থাকতাম আমরা, সেটাও তো কত খোলামেলা ছিল। আমরা কি পারব ওই ফ্ল্যাটের একচিলতে গণ্ডির মধ্যে বসবাস করতে? তোমার অসুবিধে হবে না?
—শুধু খারাপটাই বা দেখছ কেন? উল্টো দিকটাও একবার চিন্তা করে দেখোতো, বুবাই-শ্রেয়া সেই কোন সকালে অফিসে বেরিয়ে যায়। তারপর ঠিকে কাজের মেয়েটার আসাযাওয়া, মালী আসে, বাচ্চাগুলোকে স্কুল থেকে নিয়ে মালিনী আসে, তারপরও এটা সেটা তো লেগেই আছে, এই হাঁটুর ব্যথা নিয়ে সারাদিনে কতবার আমাকে ওপর-নিচ করতে হয় বলোতো! তারচেয়ে যদি দখিনখোলা একটা দুকামরার ফ্ল্যাট আর কিছু টাকা হাতে পাওয়া যায়, এই বয়সে এসে ছেলেদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার চেয়ে সেই তো ভালো গো।
—হুম, দেখো তবে কথা বলে। প্রোমোটার ছেলেটা কখন আসবে?
—প্রোমোটার আবার কী? ও তো বুবাই-এর ছেলেবেলার বন্ধু, সৌম্য। ...অ্যাই..অ্যাই…
দাদুভাই, বোনুকে মারছ কেন?...তিন্নি দিদি, তুমি এদিকে এসো....বিধানের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সুজাতার চোখে পড়ে গেছে বারান্দার অন্যদিকে খেলতে খেলতে নাতি-নাতনিদের মধ্যে কিছু নিয়ে গোলমাল লেগেছে।
******
—তোমার বন্ধুকে ফোন করে ব্যাপারটা আরেকবার ব্রিফ করে রাখতে পারতে তো। ...সদ্য স্নান সেরে ঘরে এসে কথাগুলো বুবাই-এর দিকে ছুঁড়ে দিল শ্রেয়া। বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে মোবাইল ঘাঁটছিল বুবাই। শ্রেয়ার গলা পেয়ে ঘুরে তাকালো।
—ওকে কাল যা বলার বলে দিয়েছি। বাকিটা ও ঠিক সামলে নেবে। তা ম্যাডামের এতক্ষণে খেয়াল পড়ল এদিকে? আর হবে নাই বা কেন? সেই সকাল থেকে ননদ আর জায়ের সঙ্গে যে-হারে আড্ডা চলছে!
—হুঁ, আড্ডাই বটে, তোমার বোন এবার পুজোয় কটা দামী শাড়ি কিনছে, কী কী নতুন গয়না গড়াচ্ছে, বাড়িতে দু-দুটো গাড়ি থাকা সত্ত্বেও সুরঞ্জন একটা লেটেস্ট মডেলের এসইউভি বুক করেছে, এইসব গল্প শোনাকে যদি আড্ডা বলা যায়...
—দায়দায়িত্ব কাকে বলে কোনোদিন টের পেতে নাহলে, ওসব বড় বড় বুকনি দেওয়া যায়। শ্বশুরের অত বড়ো ওষুধের ব্যবসা, বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে সবটাই তো সুরঞ্জনের। ঝিমলির স্যালারিটা পুরোটাই ওদের সেভিংস। এখন এতো বড়োলোকি কেতা দেখাচ্ছে অথচ ওর বিয়ের সময়ে সমস্ত খরচ অফিস থেকে লোন নিয়ে এই আমাকেই করতে হয়েছিল। তখন সবে বাড়ির দোতলাটা কমপ্লিট হয়েছে। আমারও হাত খালি। কত করে বললাম, একটা বছর অপেক্ষা কর। আমার কথা তো কানেই তুলল না। বাবা-মাও তখন ওর হয়েই কথা বলল। আর এখন দেখো, ঠিক সময়মতো এবাড়ির ভাগ নিতেও চলে এসেছে। তুমিই বা বসে বসে ওর লেকচার শুনছিলে কেন? এসব কথা তোমার অজানা তো নয়।
—পাগল নাকি? আমি ওখানে একটা কথা বললেই তো বলত, আমি ওকে অপমান করছি। তোমার মাও তখন মেয়ের মন রাখতে আমাকে যাচ্ছেতাই করে কথা শোনাবে। আর তুমিও তখন বোবা-কালা সেজে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে। এসব আমি বহুবার দেখেছি। আমাকে শুধু শুধু উস্কিও না।
—যাব্বাবা, এরমধ্যে আবার আমি এলাম কোত্থেকে?
—তুমি আসবে না তো কে আসবে? বিয়ের পর থেকে কারণে-অকারণে কম কথা তো শোনায়নি তোমার বাড়ির লোক, কোনোদিন একটা প্রতিবাদ করেছ? নিজের ছোটভাইকে দেখে শেখো। শ্বেতার গায়ে কোনোদিন সংসারের আঁচটুকু লাগতে দেয় না।
—ওর থেকে আবার কী শিখব? নিজের স্বার্থ ছাড়া কোনোদিন কিছু বুঝেছে ও? মাস গেলে পাঁচহাজার টাকা মায়ের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেই সব দায়িত্ব শেষ? পাঁচহাজারে আজকাল দুজন মানুষের কী হয়? এদিকে বাবা-মার সব খরচই তো আমাদের ঘাড় দিয়ে চলে যাচ্ছে। আর শ্বেতার কথা বলছ? সংসার করা তো পরের কথা, এইবাড়ির সঙ্গে কোনোদিন মন খুলে মেলামেশাটুকু করেছে শ্বেতা? দশবছর হলো বিয়ে হয়েছে, দু-তিন বছর পর পর সাজানো হাসি মুখে ঝুলিয়ে দুদিনের জন্য আসে। তারপরই তো বাপের বাড়ি কেটে পড়ে। ওদের সঙ্গে তুলনা করলে তোমার-আমার চলবে? আমাদের এখানে বসবাস করতে হয়। দুজনের অফিস আছে, আর্য-তিন্নি, ওদের স্কুল… তুমি পারবে ওদের মতো সবকিছু থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে?
—সেটাই তো সমস্যা।
—সমস্যা থাকলে তার সমাধানও আছে ডার্লিং। মাথা ঠান্ডা রেখে সবকিছু ম্যানেজ করতে হবে। এসবের মধ্যে তুমি প্লিজ আমার ওপর চেঁচামেচি করে সবকিছু ঘেঁটে দিও না। ...বিছানা থেকে নেমে এসে বুবাই শ্রেয়ার কাঁধদুটো জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ রাখল।
—আমি আবার তোমার ওপর চেঁচালাম কখন?
—নাঃ, চেঁচাওনি। তোমার অভিযোগের বন্দুক তাক করছিলে। ...এই শ্যাম্পুটা নতুন? গন্ধটা বেশ সুন্দর তো...
*******
খেলতে খেলতে বাচ্চাগুলোর মধ্যে এমন ঝগড়া লেগেছিল! মায়ের গলা পেয়ে ঝিমলিও তখন দৌড়ে গেছিল বারান্দায়। খুদেগুলোর ঝগড়ার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ঝিমলির খেয়ালই হয়নি ঘরে ওর মোবাইলটা একটানা বেজে যাচ্ছিল। যখন খেয়াল হল, তখন স্ক্রিন জুড়ে একাধিক মিসড কলের নোটিফিকেশন। সবগুলোই সুরঞ্জনের নম্বর। ঝিমলি পাল্টা কল করলো। কলটা রিসিভড হতেই ওপাশ থেকে অসহিষ্ণু গলাটা ভেসে এলো – কী করছিলে কী এতোক্ষণ? তখন থেকে কতবার ফোন করছি!
—একটু ব্যস্ত ছিলাম। বলো, কী দরকার?..কেঠো কিন্তু সতর্ক গলায় উত্তর দিল ঝিমলি।
—গেছো তো বাপের বাড়িতে ঘুরতে। ওখানে আবার তোমার কীসের ব্যস্ততা?
—সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি থাকলে বাড়িতে বসে না থেকে তুমিও আজ এখানে চলে আসতে।
—বাজে বোকো না। দশটা-পাঁচটার শখের চাকরি করে বড় বড় লেকচার দিতে ভালোই লাগে। আমার মতো সারাদিন গাধার খাটনি খাটতে হলে বুঝতে কটা ধানে কটা চাল।
—তোমার খাটনির গল্প শোনার মত সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার এই মুহূর্তে নেই। সাত বছর ধরে তো দেখছি, তোমার যত হামবড়া আমার সামনে। ওদিকে তোমার মা যে দিনরাত আমাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলে, বাপের বাড়ির পয়সার গুমোর দেখায়, সেসব চোখেও দেখতে পাও না, কানেও শুনতে পাও না।
—তা তুমিও তো সংসারে চোখ কানগুলো একটু কম খোলা রাখলেই পারো। তাছাড়া মা তো ভুল কিছু বলে না। আমার মামারা তাদের বোনকে তো সমান ভাবেই সম্পত্তির ভাগ দিয়েছে। তোমার দাদাদের মতো ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেনি।
—আমার দাদারা যে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে সে ব্যাপারে তোমরা এতো নিশ্চিত হচ্ছ কীকরে?...গলার স্বরে উষ্মা ঝরে ঝিমলির।
—তোমার ছোড়দা এসেছে সাতদিন আগে। প্রোমোটার আবার তোমার বড়দার ছোটবেলার বন্ধু। তুমি কি ভাবছ এই সাতদিনে ওদের মধ্যে বাড়ির বিষয়ে কোনো কথাই হয়নি? আমি বলে রাখছি, মিলিয়ে নিও, আজ বিকেলের মিটিংটা পুরোপুরি সাজানো। কথাবার্তা যা হওয়ার সব আগেই ফাইনাল হয়ে গেছে।
—হুঁ...ফাইনাল করাচ্ছি। আমিও কি এতো সহজে ছেড়ে দেব নাকি? আমার অংশ কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিয়ে তবে আমি সই করব।
—তোমার বাপের বাড়ির নামে কিছু বললেই তো গায়ে ফোস্কা পড়ে। পারবে নিজের দাদাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে?
—পারি কিনা তখন দেখতে পাবে। অ্যাই, তুমি কখন আসছ গো?
*********
কথা হচ্ছিল নিচের তলার বড় হলঘরে বসে। সমস্ত কাগজপত্র দেখে সৌম্য মোটামুটি যা হিসেব দিল সেই অনুযায়ী বাড়ির অংশীদাররা প্রত্যেকে হাজার স্কোয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট পেতে পারে অথবা ফ্ল্যাটের বাজারদরের সমান টাকা। ঝিমলি আগেই বলে দিয়েছে সে টাকা নেবে। টুবাই মনে মনে হিসেব করছিল টাকার অঙ্কটা। তখনই প্রশ্নটা এলো সুজাতার কাছ থেকে-- সৌম্য,আমি বলি কি, আমরা তো দুজন বুড়োবুড়ি থাকব, তার জন্য অতো বড়ো ফ্ল্যাট... তুমি বরং দেখো না, ছোট একটা ফ্ল্যাট দিয়ে টাকার অঙ্কটা যদি বাড়ানো যায়...
অবাক চোখে সৌম্য একবার বুবাই-এর দিকে তাকাল। পরক্ষণেই অবশ্য ব্যাপারটা সামলে নিল--সেকি কাকিমা, তোমরা… মানে, তুমি আর কাকু তো বুবাই-এর সঙ্গেই… মানে তোমরা একসাথেই তো থাকো। আমি তাই ভেবেছিলাম তোমাদের জন্য একটু বড় সাইজের একটাই ফ্ল্যাট..
ঝিমলি সঙ্গে সঙ্গে তড়বড় করে উঠল--একটা ফ্ল্যাট মানে? ওদের অংশটা কী হবে?
—ওদের অংশ মানে তো একটা থ্রি বেডরুম। তার মধ্যে সিঙ্গল বেডরুমের পার্টটা বুবাই-এর ফ্ল্যাটের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে আর বাকি টুবেডরুমটার দাম ক্যাশে নিয়ে নেবে। এবার কাকিমা বল কী বলছ। সৌম্যর গলার স্বরে কিছুক্ষণ আগের ঘরোয়া ভাবটুকু আর নেই। ঝিমলির কথার রুক্ষতা সৌম্যর মানে লেগেছে।
এইভাবে মায়ের দিক থেকে টাকার কথা যে উঠতে পারে সেটা বুবাই-এর ভাবনাতেই ছিল না। সৌম্যর সঙ্গে একান্তে আলোচনার সময়ে বুবাই সৌম্যকে বলেছিল, মা-বাবার অংশ থেকে কিছুটা জায়গা নিয়ে একটা ঘর আর একটা বাথরুম ওদের ফ্ল্যাটের সঙ্গে জুড়ে দিতে আর বাকি অংশটা আলাদা ফ্ল্যাট হিসেবে বিক্রি করে যা পাওয়া যাবে সেটা সৌম্য পরে বুবাইকে দিয়ে দেবে। শ্রেয়াকেও বুবাই বুঝিয়েছিল, এই ব্যবস্থায় কিছুটা ক্যাশ হাতে পাওয়া যাবে আবার ফ্ল্যাটের সাইজটাও অনেক বড়ো হয়ে যাবে। বাবা-মা তো আর চিরকাল থাকবে না। প্রস্তাবটা শ্রেয়ার মনে ধরেছিল কিন্তু বাবা-মার সঙ্গে একবার আলোচনার কথাও বলেছিল। বুবাই সেকথায় পাত্তা দেয়নি। এখন শাশুড়ির কথা কানে যেতেই কটমট করে বুবাই-এর দিকে তাকিয়ে আছে।
বেসামাল ভাবটা কাটিয়ে বুবাই সমে ফেরার চেষ্টা করল--মা, তোমাদের আবার আলাদা ফ্ল্যাট কীকাজে লাগবে? এই বয়সে আলাদা থাকা-খাওয়ার ঝক্কি, অসুখ-বিসুখের সময়…
বিধান বলল--আলাদা আবার কী? পাশাপাশিই তো থাকছি। এঘর-ওঘর করার মতোই তো…
—না বাবা, এঘর-ওঘর করার মতো ব্যাপার নয়। হাইরাইজ তৈরি হলে সেখানে অনেক বাইরের ফ্যামিলি থাকবে। কোনো একটা ক্রাইসিস হলে... সবার সামনে দিয়ে ওভাবে ...কোনো প্রাইভেসি থাকবে না বাবা।
সৌম্য এবার হাল ধরল--ব্যাপারটা কিন্তু একই কাকু। আপনাদের সিঙ্গল বেডরুমের ফ্ল্যাটটা বুবাই-এর ফ্ল্যাটের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে মাত্র। ফ্ল্যাটের ভেতরে সবকিছু একই রকম থাকবে...মানে আলাদা বাথরুম, ব্যালকনি, যদি বলেন তো কিচেনও আলাদা করে দিতে পারি, শুধু এন্ট্রান্স একটাই থাকবে।
সুজাতা এবার ঝিমলির দিকে তাকাল। ঝিমলিই কদিন ধরে বুঝিয়েছিল, একটা আলাদা ফ্ল্যাট খুব দরকার। বাবা-মার আলাদা ফ্ল্যাট হলে ঝিমলি মাঝে মাঝে তবু এসে থাকতে পারবে দু-চারদিন। এতদিন নিজেদের বাড়িতে খোলামেলা প্রচুর জায়গা ছিল তাই অসুবিধে হয়নি। কিন্তু ফ্ল্যাটে বুবাই-শ্রেয়ার সংসারের সীমিত পরিসরে ঝিমলি অতোটা স্বচ্ছন্দ হতে পারবে না। মায়ের সঙ্গে একান্তে মন খুলে দুটো কথা বলার উপায় থাকবে না। কথাগুলো সুজাতার অযৌক্তিক মনে হয়নি তখন। কিন্তু এখন বুবাই-এর কথাগুলো শোনার পর অন্য চিন্তা হচ্ছে। সত্যিই তো, বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেভাবে অসুখ-বিসুখের থাবা বসছে শরীরে, তাতে দুজনে আলাদা থাকা...বিশেষ করে রাতবিরেতে, দোলাচলে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সুজাতা। বিধান সুজাতার হাতে আলতো চাপ দিয়ে হ্যাঁ বলে দিল সৌম্যর কথায়। সঙ্গে সঙ্গে ঝিমলির মুখটা থমথমে হয়ে গেল। সুরঞ্জনও গোমড়া মুখে ফোন ঘাঁটছে। টুবাই-এরও বোধহয় ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। ওর চোখেমুখে ফুটে ওঠা অস্বস্তিটুকু দেখে অন্তত তেমনটাই মনে হচ্ছে। উপস্থিত সবাই মুখগুলোর উপর চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল বুবাই। তারপর সরাসরি টুবাইকে জিজ্ঞাসা করল--টুবাই কিছু বলবি?
—কী বলি বল তো? তোর কি মনে হয় এই ব্যবস্থাটা একদম ঠিকঠাক হচ্ছে?
—কোথায় সমস্যা হচ্ছে বল?
—না ঠিক সমস্যা নয়, আসলে বাবা-মার জন্য আলাদা ফ্ল্যাট…
—এগ্জ্যাক্টলি। টুবাই-এর কথার মাঝখানেই প্রায় চিৎকার করে উঠলো ঝিমলি--আমিও চাই বাবা-মা আলাদা ফ্ল্যাটে থাকুক।
ঝিমলির এভাবে চিৎকার করে ওঠাটা সবারই চোখে লেগেছে। চোয়াল শক্ত করে বুবাই বলল-- বেশ তো, তোরা যখন চাইছিস তখন থাকুক আলাদা। কিন্তু সেক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলোর কথা হচ্ছিল তার কী সমাধান তোদের কাছে আছে বল।
—বারবার সমস্যার কথা যে বলছিস দাদা, সমস্যাটা কার বেশি বলতো,বাবা-মার না তোদের? ঝিমলির কথাগুলো তীরের মতো কানে বেঁধে।
—মানে? আমাদের কী সমস্যা?
—এই যে তোরা দুজনেই রোজ বেরিয়ে যাস। সারাদিন বাচ্চাদুটোর দেখাশোনা করার জন্য লোক তো দরকার। সেক্ষেত্রে বাবা-মার থেকে..
—ঝিমলি, সংসারে থাকতে গেলে একে অপরের প্রয়োজন পড়বে। এটাই নিয়ম। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র আমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার জন্যই বাবা-মাকে দরকার? আর ওদের প্রতি আমরা কি কোনো দায়িত্বই পালন করি না? অসুখ-বিসুখের সময়.. এই যে গতবছর বাবার পা ভাঙল, প্লেট বসল.. নার্সিংহোম, ডাক্তার, ওষুধ, অফিস ছুটি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি..এসব কে করেছিল রে? তুই তো রবিবার বিকেলে চারটে আপেল নিয়ে ঠাকুর দর্শন করার মতো একবার ঘুরে গিয়েই দায় সারলি। আর টুবাই-এর কথা তো ছেড়েই দিলাম। দু-তিনবছরে একবার তিনদিনের জন্য বাড়ি আসে।
—সারাবছর বাবা-মা তোদের ছেলে-মেয়ের দেখাশোনা করে। তাদের অসুখ-বিসুখের সময় তোরা করেছিস। এ তো সোজা হিসেব। শুধু শুধু আমাকে এসবের মধ্যে জড়াচ্ছিস কেন?
ছেলেমেয়েদের কথা উঠতেই শ্রেয়ার মনে পড়ল, পাশের ঘরেই বাচ্চাগুলো খেলছে। শ্রেয়া উঠে পাশের ঘরে গেল। বাচ্চাগুলোকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওপরের ঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে। ওদের ব্যাপারে এখন কারোরই কোনো খেয়াল নেই।
বুবাই একই ভঙ্গিতে উত্তর দিল--জড়াচ্ছি। কারণ সবকিছুর মধ্যে তুই আমার আর শ্রেয়ার স্বার্থ খুঁজছিস।
—আমি খুঁজছি না দাদা। এখানে সবাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আসল হিসেবটা কী?
—কীসের হিসেব?
—বাড়ির অংশীদার হিসেবে মোট চারটে ফ্ল্যাট আমরা পাচ্ছি। তারমধ্যে তুই একাই নিচ্ছিস দেড়খানা ফ্ল্যাট। তারপর টাকাটাও যে কোথায় কীভাবে খরচ হবে সে আর কে দেখতে যাচ্ছে?
—মানে? আমি বাবা-মার টাকা...ওদের ফ্ল্যাটের অংশ...
—ওই হল। বাবা-মা কি চিরকাল থাকবে? তারপর তো পুরো ফ্ল্যাটটাই তোদের দখলে..বাবা-মার আলাদা ফ্ল্যাট হলে পরে অন্তত রিসেল-টিসেল কিছু একটা…
মুহূর্তের জন্য ঘরে পিনপতনের নৈঃশব্দ্য নেমে এলো। ঘরের সবকটা চোখ ঝিমলির মুখের উপর স্থির এখন। বিধান আর সুজাতা অবাক দৃষ্টিতে একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। বুবাই-এর মুখচোখ রাগে-অপমানে থমথমে হয়ে রয়েছে। যে শ্বেতা এতক্ষণ ঘরের কোণে চুপচাপ বসে মোবাইল ঘাঁটছিল সেও ফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে অবাক চোখে ঝিমলিকে দেখছে। শ্রেয়া এসময় ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে পড়ল। টুবাই এবার বিরক্ত গলায় বলল-- আহ্, ঝিমলি ভুলভাল বকাটা বন্ধ কর। দাদা যে কথাটা বলেছে সেটা তো অযৌক্তিক নয়। রাতবিরেতে কিছু একটা হলে...
—বেশ তো, দাদা যেমন এই ইস্যুতে নিজের ফ্ল্যাটের সাইজটা বাড়িয়ে নিচ্ছে, আমাদের ভাগেও তেমন টাকার অংকটা বাড়িয়ে দিক। ভাগ যখন হচ্ছে, তখন তো সমান সমানই হওয়া উচিত।
সৌম্য আক্ষরিক অর্থেই বিব্রত বোধ করছিল কিছুক্ষণ ধরে। এখন হঠাৎই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বুবাইকে বলল--বুবাই, তোরা নিজেদের মধ্যে আলোচনাটা নাহয় করে নে। আমি পরে কখনো…
গম্ভীর গলায় বুবাই বলল--না সৌম্য, ফয়সালা যা হওয়ার আজই হবে। তাছাড়া, শুরু যখন তোর সামনে হয়েছে, শেষটাও তখন তোর সামনেই হবে। তারপর ঝিমলির দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলল--শোন ঝিমলি, বড় ফ্ল্যাট, বাবা-মার অংশের টাকা, কোনোকিছু আমার চাই না। তোরা যে কেউ দায়িত্ব নে। আমি শুধু আমার অংশের টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে যাব এখান থেকে। আর টাকার হিসেবের কথাটা যখন তুললি তখন একটা কথা বলি। যদিও কথাটা বলা আমার হয়ত উচিত নয়। ... সরি মা, ঝিমলি আমায় বাধ্য করল কিন্তু এখন আর চুপ করে থাকার উপায় নেই। ঝিমলি, আজ বাড়ি বিক্রি হবে, ভাগ হবে তাই বাবা-মার টাকার অংশের কথা আসছে। টাকার হিসেব চাইছিস তুই। কিন্তু এতোদিন ধরে যে খরচ-খরচা হয়েছে, তোর বিয়ে, বাড়ির দোতলা তৈরি, লোকলৌকিকতা, বাবা-মার অসুখ-বিসুখের সময় ডাক্তার-নার্সিংহোম-ওষুধ খরচ, রোজের খাইখরচ নাহয় বাদই দিলাম, কই সেসব তো কোনোদিন হিসেব করিসনি? বাড়ির ভাগ যখন সমান সমান নিবি তখন এই খরচগুলোও সমান ভাবে ভাগ কর?
বুবাইকে এভাবে উত্তেজিত হতে সহজে দেখা যায় না। সুজাতা বুবাইকে শান্ত করতে চাইল-- বুবাই, সবার সব কথা অত ধরতে গেলে চলে বাবা? ওসব বাদ দে। বরং সৌম্যর সঙ্গে কথাটা…
—ওসব কথা পরে হবে মা। আগে যে কথাটা উঠেছে সেটা আগে মেটাতে দাও।
ঝিমলিরও পাল্টা জবাব যেন তৈরিই ছিল--বাড়ির দোতলাটা তোরা ব্যবহার করিস। আমি মাঝে মাঝে এসে থাকতাম মাত্র। সে পাটও তো এবার চুকল। আমার বিয়েতে তুই কত খরচ করেছিলিস তার হিসেব দিস, আমি টাকা ফেরত দিয়ে দেব। আর রইল বাবা-মার খরচ। তা সে তো তুই দিস না। সে খরচ এতোদিন ছোড়দা পাঠিয়েছ। বরং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি করেই পাঠিয়েছে।
সুজাতার গলা একবার শোনা গেল ঘরের একপাশ থেকে--ঝিমলি, কেন শুধু শুধু আবোল তাবোল বকছিস? কিন্তু সেকথা কারো কান পর্যন্ত পৌঁছল বলে মনে হল না। পরক্ষণেই বুবাই-এর গলা ঝলসে উঠল--তাই নাকি? তোর ছোড়দা তাহলে তোর সঙ্গে আলোচনা করেই টাকাপয়সা পাঠায়? কি রে টুবাই? পাঁচহাজারে আজকাল দুজন মানুষের সমস্ত খরচ-খরচা হয়েও উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। কি বলিস?
—শোন দাদা, আগেই বলে দিচ্ছি, ঝিমলি কি বলতে কি বলছে আমি জানি না। ওর কথার সঙ্গে আমাকে জড়াস না। কিন্তু তুইও তখন থেকে কথা কিছু কম শোনাচ্ছিস না। হ্যাঁ, মানছি, আমি এখানে ঘন ঘন আসতে পারি না। যে-কোনো ক্রাইসিস পিরিয়ডে ম্যানুয়ালি তোকেই সবটা সামলাতে হয়। তার জন্য একটু আগেও তুই ঠেস দিয়ে কথা শোনালি। কিন্তু আমার অপারগতার খেসারত দিতে টাকাপয়সার দিক থেকে আমি তো কখনো কোনো হিসেব করিনি। একটু আগে তুই যে বাবা-মার অসুখ-বিসুখের খরচের কথা বলছিলিস, কোন খরচটা আমি দিই নি রে? আর "পাঁচহাজার" টাকার কথা আসছে কোথা থেকে? কবে আমি মাকে পাঁচহাজার টাকা পাঠিয়েছি?
—আহ্, এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা এখন ছাড় না তোরা। যে ব্যাপারে কথা বলতে এখানে সবাই এলি, সেটা তো আগে ঠিকঠাক কর।--সতর্ক শোনায় সুজাতার গলা। এবারও বুবাই-এর গলা সুজাতাকে ছাপিয়ে গেল--অসুখ-বিসুখের খরচ তুই দিস?
—হ্যাঁ, এবং পুরোটাই। গতবার বাবার পায়ে প্লেট বসানোর সময়ও পুরো সত্তর হাজার পাঠিয়েছি। সবকিছু জেনেশুনে এখন ভান করিস না প্লিজ।
বুবাই কিছুটা হতবাক ভঙ্গিতে একবার সুজাতার দিকে আর একবার টুবাই-এর দিকে তাকাল। সুজাতার মাথা নিচু, চোখ এখন মেঝের উপর স্থির। বুবাই এবার সরাসরি সুজাতাকেই প্রশ্ন করল--টুবাই কি বলছে মা? সুজাতা নিশ্চুপ। হঠাৎই ভীষণ হতাশ লাগে বুবাই-এর। সে বরাবরই ভেবে এসেছে বড় ছেলে হিসেবে তার ওপর বাবা-মার আলাদা একটা টান আছে। বিশেষত চাকরিজীবনের প্রথম দিকে যেমন নিঃস্বার্থভাবে এ সংসারের জন্য সাধ্যাতীত ব্যয় সে করেছ, তাতে মাতৃস্নেহ তার ভাগে অন্য ভাইবোনের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশিই প্রাপ্য। কিন্তু বাস্তবে সেই মায়ের জন্যই যে তাকে সবার সামনে এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হবে তেমন কিছু তার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। এতোদিন সুজাতার মারফতই সে জেনে এসেছে টুবাই প্রতি মাসে মাত্র পাঁচহাজার টাকা মায়ের অ্যাকাউন্টে পাঠায়। সেই টাকাটা বাবা-মার হাতখরচের জন্য স্থির ধরে বাদবাকি সব খরচের দায়ভার নিজের কাঁধে স্বেচ্ছায় সে তুলে নিয়েছিল। তার মধ্যে সেরা সন্তান হওয়ার কিছুটা অহংকারও মিশে ছিল। কিন্তু এখন যখন সে জানতে পারল সেই অহংকারের ভিত একটা মিথ্যে তথ্য, তখন দুনিয়ার সবচেয়ে বোকা প্রাণীর জায়গায় নিজেকে স্থাপন করল সে। সেই সঙ্গেই তার মনে সবচেয়ে স্বার্থপর মানুষের স্থান পেল তার নিজের মা। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল শ্রেয়ার মুখেও মেঘ জমেছে।
কাঁধদুটো একবার ঝাঁকিয়ে সৌম্যর দিকে ফিরল বুবাই। - সৌম্য, তুই বরং চারটে ফ্ল্যাটেরই ব্যবস্থা করে দে।
এতক্ষণ পরে মূল বিষয়ে কথা বলতে পেরে সৌম্যও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল--কাকু-কাকিমার ফ্ল্যাটের এন্ট্রান্স তাহলে…
—আলাদা হবে।
—ওকে, ক্যাশের অ্যামাউন্ট তাহলে সবার একই থাকছে শুধু কাকু-কাকিমার জন্য একটা সিঙ্গল বেডরুম ফ্ল্যাট থাকছে। সেক্ষেত্রে কাকিমা তোমাদের ক্যাশটা.. কথা বলতে বলতেই সৌম্য নিজের মোবাইলে ক্যালকুলেটর খুলে হিসেব করতে শুরু করেছে। ঝিমলি মুখে আবার স্বাভাবিক হাসিটা ফেরানোর চেষ্টা করছে। টুবাই মন দিয়েছে মোবাইল স্ক্রিনে। বিধানের মুখচোখ গম্ভীর হয়ে আছে। হিসেব শেষ করে সৌম্য বলল--কাকু, আপনারা ঐ পনের লাখ মত ক্যাশ পাচ্ছেন।
টুবাই মুখ তুলে বলল--ওহ্, গ্রেট। মা, তাহলে তোমার টাকাপয়সার প্রবলেম সল্ভড। মাসে মাসে টাকা পাঠানোর হাঙ্গামা আর রইল না। সৌম্যদা তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রজেক্ট শুরু করো। কি বলিস দাদা?
সুজাতা ফ্যাকাশে মুখে টুবাই-এর দিকে চেয়ে দেখল একবার।
বুবাই সায় দিল--হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। ঝিমলির গলায় আগের সেই উচ্ছ্বাস ফিরে এসেছে--প্রজেক্ট শেষ হতে, মানে ফ্ল্যাট হাতে পেতে কতদিন লাগবে সৌম্যদা?
- তা আট-দশ মাস ধরে রাখ। কাকিমা, জমির পেপার-ওয়র্ক কিছু আছে। ডেটটা আমি তোমাকে নেক্সট উইকে জানিয়ে দেব তাহলে।
- আর পেমেন্টের ব্যাপারটা? টুবাই-এর তাড়া সবচেয়ে বেশি।
- পেপারস্ রেডি হলে ফিফটি পার্সেন্ট আর বাকি ফিফটি কাজ শেষ হতে হতে পেয়ে যাবি। আমি সবটাই অনলাইন ট্রান্সফার করে দেব। তোর কোনো সমস্যা হবে না। বুবাই, বাড়িটা ভাঙা শুরু করার আগে তোদের তো শিফট করতে হবে কোথাও, এই ক'মাসের ভাড়া যা লাগে আমি দিয়ে দেব। রেন্টাল ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিছু…
- হুম, তুই ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাট বা বাড়ি দেখে দিস। বাবা-মা দুজনে থাকবে।
- আর তোরা? এতক্ষণে সুজাতার মুখ থেকে কথা বেরোল।
- আমরা ফ্ল্যাট নিচ্ছি না। সৌম্য, তুই আমার অংশটাও ক্যাশেই দিস।
সৌম্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ঘরের সবকটা চোখ আবার বুবাই-এর দিকে ঘুরে গেছে। সুজাতার গলাটা ফ্যাশফ্যাশে শোনালো এবার--সেকি! তোরা তাহলে কোথায় থাকবি?
—দেখি, আর্য-তিন্নির স্কুলের আশেপাশে কোথাও একটা ফ্ল্যাট, এদিক থেকে স্কুলটা তো অনেক দূর হয়ে যায়…
সেদিন রাতে পাশাপাশি ঘরগুলো নানাবিধ আলোচনায় মুখরিত হয়ে উঠল। বুবাই-শ্রেয়া পরিকল্পনা করছিল নতুন জায়গায় চলে যাওয়ার পর আর্য-তিন্নির স্কুল, পড়াশোনা, বাজার-দোকান, রান্না, নিজেদের অফিস সবকিছু কেমন করে সামলানো যায়।
টুবাই-শ্বেতা হিসেব করছিল, এদেশে থাকতে থাকতেই বাড়ি বিক্রির ঝামেলাটা মিটিয়ে পুরো টাকাটাই যদি সৌম্যর থেকে বুঝে নেওয়া যায়...নয়ত পরে কোন অসুবিধে হলে আবার আসা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কাল বিকেলেই ওরা শ্বেতার বাড়ি চলে যাবে। তার আগে একবার সৌম্যর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
সুরঞ্জনের আসতে আজ বেশ রাত হয়ে গেছে। সে এখন ঝিমলির কাছ থেকে রসিয়ে রসিয়ে শুনছিল সন্ধ্যের ঘটনাটা। হাজার হোক, বড়দাদার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ঝিমলি তার অধিকার ছিনিয়ে নিতে পেরেছে।
কথা নেই শুধু দুজন মানুষের মুখে। অন্ধকার ঘরে পাশাপাশি শুয়ে চুপচাপ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে। অনেকক্ষণ পরে সুজাতা বলল--আমাদের সামনেই ঝিমলি কেমন করে বলল গো আমাদের অবর্তমানে ফ্ল্যাট বিক্রির কথাটা?
—অবাক হয়েছ? আমিও আজ কিছু কম চমকাইনি সু। টুবাই সত্যি সত্যি মাসে কত টাকা পাঠায় সু? তুমি তো আমাকেও এতোদিন পাঁচহাজারের কথাই বলেছ অথচ...
সুজাতা বলতে চাইল--সেসব টাকার একটা টাকাও আমি খরচ করিনি গো। আপদ-বিপদের কথা ভেবে সে সব টাকা ব্যাঙ্কে জমা পড়ে আছে। রোজ খবরের কাগজ খুললেই কত খবর "ছেলে মাকে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে", "অসহায় বৃদ্ধ পথে একা", "সম্পত্তির অধিকারের জন্য বৃদ্ধা খুন" … আরো...কত কী। আমারও চিন্তা হয়। ভাবনা হয় নিজের জন্য। যদি আমার আগে তুমি চলে যাও, আমার কী হবে? যদি কেউ না দেখে? কাকে জোর করব? সেসব দিনে টাকাই তো আমাকে সম্বল জোগাতে পারে। সারাজীবন প্রতিটা জিনিস খরচ করতে হয়েছে গুনে গুনে। আমার নিজের বলতে তো কিছুই নেই গো। তাই টাকা কটা…তারজন্য এভাবে যে সবকিছু ভেঙ্গে যাবে...
কোনো কথাই মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠে না। অন্ধকার জুড়ে শুধু কান্না চেপে রাখার অসহায় শব্দ শোনা যায়। একটু পরে বিধানই আবার বলে--এবার তো টুবাই-এর টাকা পাঠানোও বন্ধ হল। বুবাইটাও অভিমান করে…যাক, এখন থেকে নিজেদেরটা নিজেদেরই বুঝে শুনে চলতে হবে।
সুজাতার দিক থেকে এবারও কোনো উত্তর এলো না।