• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গল্প
    Share
  • মধুপুরের পাঁচালি : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়

    দিলীপ



    যে গপ্পোটা এখানে বলছি তার প্রায় সবটাই সত্যি। একটুখানি, মানে জাস্ট একটুখানি, ইয়ে। পরমহংসী পাঠিকা ঠিক বুঝে যাবেন।

    কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মানে জানেন? আর গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো? মাছের তেলে মাছ ভাজা? নিশ্চয় জানেন - তার মানে এটাও জানেন যে কুয়োয় কখনো কখনো‌ বালতিটা (বা হাওয়া লেগে শুকনো কাপড়টা) পড়ে গেলে সেগুলো তুলে আনা হয় কাঁটা বলে একরকম ছোট নোঙর ডুবিয়ে। ভালো।

    একটা কিছু তুলতে গিয়ে দড়িতে বাঁধা গেরো ফসকে যদি কাঁটাটাই কুয়োয় পড়ে যায় তখন কি হয়? ঠিক ধরেছেন, আরেকটা কাঁটা দিয়ে আগেরটাকে তুলে আনা হয়। আর এইজন্যেই আজও মফস্বলের দিকে "বালতি-চুড়ি তুলে দিব-অ-অ-অ" ওলারা দু-দুটো কাঁটা নিয়ে ঘোরে।

    পথ চলতে পায়ে কাঁটা ফুটলে আর একটা সরু কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে তোলা হয় কখনো সখনো। আমার ধারণা ছিল কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মানে তাই - আমার ছোট পিসেমশাই বুঝিয়ে দেন যে না, আসলে মানে হচ্ছে কুয়োর কাঁটা আরেকটা কাঁটা দিয়ে তোলা। এই মানেটা আমার খুব পছন্দসই।

    আমাদের কুয়োগুলোতে কখনো কখনো কপিকল, লোহার জাল, ভেতরে নামবার জন্য দেওয়ালে আংটা, এইসব থাকতো।

    যাক আমাদের ওদিকে বাংলাদেশের মতো অমন কাঁটাওলারা ঘুরতো না, আমাদের যাকে বলে একজন না একজন লোকাল এক্সপার্ট থাকতো - তাও আবার এক একটা কুয়োর এক একজন! মানে ধরুন আপনার গিয়ে কুয়ো হলো ষোলো নম্বর, শিলবারের (এলুমিনিয়ামের) মগটা গেছে পড়ে তার মধ্যে। ইন-হাউস এক্সপার্ট শ্যামা "এই বিকেলে আসছি" বলে দেওঘর গেছে গত বিষ্যুৎবার, ফেরেনি। ওপাশে হলো বারো নম্বর কুয়ো। সেখানে দেখাশোনা করে লালু। হাজার সাধ্য সাধনা করলেও সে হারামজাদা আপনার মগটা তুলে দেবে না। কড়া নিয়ম, বুঝলেন তো?

    আমি জিজ্ঞেস করে দেখেছি, মনে হয়েছে নিয়ম ছিল ওই সিকিটা আধুলিটা যার বরাতে তার। তা বেশ। অবিশ্যি ওদের কুয়ো পরিষ্কার-টরিষ্কার রাখার দায়িত্বটাও ছিল।

    আমার আবার সাঁতারটা আসতো, ডুব দেওয়াটাও। পাছে আমি বাঙালি বাবু সাময়িক মানসিক দুর্বলতার জন্য কারুর ঘটিটা তুলে দিই - কখনো তা করিনি - তাই আমাকে ভয় দেখানো হতো জল-পেত্নীর, যারা চেনা বেহারী লোকেদের ছোঁয় না কিন্তু নতুন কচি বাঙালি ছেলে খেতে ভালোবাসে - সে সব ছেলেরা মাছ খায় কি না?

    যাক এ কাহিনী আসলে তিন নম্বর কুয়োর - যেটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে ছিল। তিন নম্বর বাড়িটা জোড়াবাংলো ছিল না, আলাদা ডিজাইনের আলাদা বাড়ি ছিল, যেমন ছিল দশ নম্বর। নামকরা সেতারশিল্পী শ্রীমতী জয়া বিশ্বাসের খুড়শ্বশুর মিস্টার বিশ্বাস থাকতেন ও বাড়িটায়। ওনার ভাইপো, মানে জয়া বিশ্বাসের স্বামী ডঃ সনৎ বিশ্বাস শিবপুর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হয়েছিলেন। ওবাড়ির বাগানের মালির ঘরে থাকতো মালি হরুয়া। ওর ছেলেটা, নাম দিলীপ, খানিকটা বড়ো ছিল আমার চেয়ে, সে ছিল ওদিককার কুয়োটার ইন-চার্জ। তা দিলীপ চিত্তরঞ্জন কারখানায় কাজ পেয়ে চলে গেলো, রোববারে বাড়ি আসতো, কারো কিছু কুয়োয় পড়ে গিয়ে থাকলে তুলেও দিতো। প্রচুর ডিম নিয়ে আসতো রবিবারে, কিনে না ন্যাশনালাইজ করে কে জানে!

    আপনারা দেখে থাকতে পারেন - সাইকেলে তখন একরকম ছোট্ট চৌকো মতন তিন দিকে লেন্স দেওয়া কেরোসিনের আলো লাগানো হতো - মানে যাদের ডায়নামো ছিল না তাদের কথা বলছি। সে অনেক ব্যাপার - লেন্স পরিষ্কার রাখা, তেল ভরা, সলতে ছাঁটা এই সব। তবেই সন্ধেবেলা দূর থেকে অন্যলোকে আপনাকে দেখতে পেতো ওই সব জায়গায়। আপনি ঘোড়ার ডিম কিসুই দেখতে পেতেন না। তাও, আমার একটা ওই রকম আলো হলো একবার। কি বদবুদ্ধি হলো, ওদের ওদিকে নিয়ে গেলাম দেখাবো বলে, আর গোবরে পড়ে একদম নোংরা হয়ে গেলো নতুন জিনিষটা। ওদেরই কুয়োপাড়ে নিয়ে গেলাম, ধুয়ে পরিষ্কার করবো - ওমা, গেলো এবার হাত থেকে কুয়োর ভেতরে পড়ে। দিলীপ দেখছিলো, তক্ষুনি নেমে গিয়ে দু'মিনিটে তুলে আনলো। নতুন জিনিষ, তেল তখনো ভরা হয়নি, তাই কুয়োতে গন্ধ-টন্ধ হলো না, বেঁচে গেলাম। অনেক পরে অবিশ্যি আমারও ডায়নামো হয়েছিল।

    বুঝতেই পারছেন, দিলীপ ছিল যাকে বলে দোস্ত! আমাদের বলেছিলো ইঞ্জিন তৈরি করা দেখাতে নিয়ে যাবে। আমরাও উদগ্রীব হয়ে ছিলাম কবে ইঞ্জিন তৈরি শিখে ফেলবো।

    এর মধ্যে একদিন তার এলো যে একটা নতুন টেন্ডার লুজ শান্টিং হচ্ছিলো, আমাদের দিলীপ খেয়াল না করে চাপা পড়েছে। কারখানার নতুন জিনিস, তেল-টেল দেওয়া, নিঃশব্দে আসছিলো টেন্ডারটা, দিলীপ আমাদের বোঝেও নি।

    অনেকে গেলেন, দেহটা নিয়ে আসা হলো, হরুয়ারা খুব কান্নাকাটি করলো, শ্রাদ্ধ-শান্তি সব হয়ে-টয়ে গেলো। কিছু দিন বাদে আমিও কলকাতা চলে গেলাম "পড়াশোনা" করতে।

    সাউথ পয়েন্ট, হায়ার সেকেন্ডারি, হ্যান পরীক্ষা, ত্যান পরীক্ষা, প্রেসিডেন্সি কলেজ। '৭০ সালের গোড়ায় বেশ জমিয়ে কলেজ গেলো বন্ধ হয়ে। ঘুরে এলাম মধুপুর থেকে কটা দিন। অনেক কিছু আবার নতুন করে দেখলাম - নাক ততদিনে আমার অনেকটাই উঁচু হয়ে গেছে - জ্ঞানও বেড়েছে, ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাস শিখেছি যে! আড্ডায় বসে বসে বন্ধুদের কত কলকাতার গল্প শোনাচ্ছি, কলকাতায় গেলে আমাদের বাড়িতে উঠতে বলছি, এইসব আর কি!

    নিজেই যখন বিশ্বাস করিনি, এবং এখনো করি না, তখন আপনাদের আর কি বলবো জানি না। তবে পাড়ার পিসি-মাসি-দিদিরা যা বললেন তা হলো এই, যে, তিন নম্বর কুয়োয় কারুর কিছু পড়ে গেলে দেখা যায় যে কয়েক ঘন্টা পর সে জিনিসটি বাড়িতে ফিরে এসেছে, মেজে টেজে চকচকে করে রাখা। পাঁচ নম্বর বাংলোর পিসি (ওনারা বিহারের লোক, আগে শ্যামবাজারে থাকতেন) তো কেঁদেই ফেললেন বাংলায়, "ওরে, কুয়োপাড়ে আধুলি রেখে এলেও সেটা সে নেয় না রে, কি লক্ষী ছেলে রে, আমাদের কি ভালোটাই বাসতো রে, ওরে আমাদের কি হবে রে!"

    তিন নম্বর কুয়োর পাড়ে গিয়ে সন্ধে অবধি চুপ করে বসে রইলাম, মনে মনে দিলীপটার সঙ্গে দুটো কথাও বললাম, কিছুই হলো না, জানেন?

    রুটি জুড়িয়ে গেলে দিদা বকবেন, তাই বাড়ি ফিরে এলাম - পরের দিন দুপুরে তুফান ধরে কলকাতা।

    ট্রেনে ফেরার সময় আসানসোলের পর চেকারকে টিকিট দেখানোর জন্য পকেটে হাত দিতে পেলাম একটা কাঁচের গুলি। গুলিটার ভেতরের রঙ দেখেই চিনলাম। একমাত্র আমারই ওরকম ছিল। তিন নম্বর কুয়োয় অনেক দিন আগে ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়েছিলাম। দিলীপকে কোনো দিন বলার দরকার মনে করিনি।

    তুফান তখন ঝড়ের বেগে চলছে।



    (তুফান এক্সপ্রেসের অনুচ্ছেদটি সুধী বন্ধুবর প্রজ্ঞাব্রত সেনের সংযোজন - ডাহা মিথ্যে। )




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ দীপঙ্কর ঘোষ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments