• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গল্প
    Share
  • মধুপুরের পাঁচালি : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়

    গঝন্ডি



    দেখুন, যা পড়তে যাচ্ছেন তা কোনোভাবেই ভূতের গল্প নয়। সে আশা করবেন না, ভয় পাওয়ার আনন্দ পাঠকের একেবারেই হবে না। এর কারণ হচ্ছে, ভূত আমি দেখিনি। হয়তো শুনে থাকতে পারি, কিন্তু সে তো আর ভূত দেখা হলো না? বুঝলেন তো?

    নিশ্চয় সময় নষ্ট করে ওই ইংরিজি গল্পের বই - মেমারিজ অফ মধুপুর - পড়েছেন। তাহলে তো অলরেডি গোমেজ খুড়োকে চেনেন - নতুন করে আর পরিচয় দিচ্ছি না। ওই যে, যে বুড়ো ভদ্রলোক ভুলভাল খেয়ে টেয়ে ভুলভাল দেখতো রে বাবা - ওই হলো গোমেজ খুড়ো। এই গাঁজাখুরি গপ্পোটা ওর কাছেই আমরা কজন ছেলেমেয়ে অকারণে ভয় পেয়ে শুনেছিলাম - মাইন্ড ইউ, শুনে ভয় পাওয়া অন্য জিনিস।

    আমি কিন্তু, গপ্পোটা আমি যে ভাবে দেখেছিলাম, সেই ভাবে বলছি - তাতে গোমেজ খুড়োর “গোলাপকালী” পরে আসবে।

    একটা খুব পুরোনো কিন্তু অন্য রকম দেখতে রেলের কোচ আমাদের ওদিকে একধারে পড়ে থাকতো। মরচে পড়তো, রাত্তিরে ভেতরে সবুজ চোখ জ্বলজ্বল করতো, আরো কত কি হতো। পরিষ্কার তো কোনো দিন-ই করা হতো না। এক দিন খেয়াল করে দেখলাম যে কোচটা লাইনের ওপরে নয়, মাঠের ওপর রয়েছে, লাইন তার একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে। ইয়ার্ড-এর ধারে।

    পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে জখম হয়ে খেলাধুলো একটু যাকে বলে স্থগিত ছিল। ওই বিজুরীয়াটার সঙ্গে আড্ডা মেরেই সময় কাটছিলো, এর মধ্যে ও আইডিয়া দিলো - “চল, মাঠের গাড়িটা দেখে আসি।” মানে ওদিকে ইয়ার্ড-এর পাশে ঘাসের ওপর যে পুরোনো কোচটা রয়েছে, সেটা ইনভেস্টিগেট করে আসি।

    জখম হাত, তাই নিয়েই চললুম। সঙ্গে একটা লাঠি আর এক বাক্স দেশলাই। আর ওই বিজুরী। দুপুরে খেয়ে দেয়ে।

    কোচটা, গিয়ে দেখি, একেবারে অন্য রকম। মস্ত হলঘর, খাট, টেবিল, দুটো চেয়ার, আলমারি। একদিকে একটা বড়ো বাথরুম, তার পাশের গলি দিয়ে বাকি অংশে যাওয়া যায়, সেদিকটা পুরো ফাঁকা। অন্য প্রান্তে রেলিং দেওয়া বারান্দা, যেটার ধারের সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠেছিলাম। বেশ কিছুক্ষন ধরে ঘুরে ফিরে দেখলাম দু’জনে, ধুলো, মাকড়সার জাল, আরো নানা নোংরা এড়িয়ে এড়িয়ে।

    ইংরিজি তখন আমি বেশ ভালোই শিখে গেছি।

    হঠাৎ বাজখাঁই গলায় ধমক - “হোয়াট আর ইউ আরচিনস ডুইং হিয়ার? গেট আউট!”

    আঁতকে উঠে সোজা লাফিয়ে নিচে নেমে ইয়ার্ড-এ। পিছু দেখতে দেখতে কাট। যাকে বলে হাওয়া। মস্তিষ্ক খুব উর্বর ছিল বিজুরীটার - খুব কনফিডেন্টলি বললো -

    “গোমেজ চাচা ওহাঁ কা করতো রে বাবুয়া?”

    “দুসরা গোরা কেউ ছিল রে ছুঁড়ী। গোমেজ চাচা নয়।”

    “বাজে বকিস না - আর কে হবে?”

    মরুক গে - পরে বুড়োকে ধরলেই হবে - আমাকে অতো বকবার কে ও? আবার যাকে বলে মেয়েটার সামনে!

    দিন দুয়েক বাদে এমারেল্ড লজের বাগানে সবাই রয়েছি - ছোটরা - আমি বলে বসলুম গোমেজ চাচাকে, “সেদিন আমাদের অতো বকলেন কেন? এমনি দেখছিলাম তো আমরা।”

    “কি বলছিস?” জিজ্ঞেস করলো চাচা। বিজুরী হতভাগীর দিকে একবার তাকিয়ে চাচাকে সব কিছু বললাম।

    বেশ অনেকক্ষন একদম চুপ করে রইলো গোমেজ আংকেল। তারপর অদ্ভুত একটা গল্প শোনালো। আমার ধারণা-ই ঠিক ছিল - ও ওই গাড়িটার ধারে কাছে যায় নি, এবং কখনো যেতোও না। আমার পেছনে বসে আমার শার্টটা খামচে ধরে বিজুরী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো - “আমাদের বকলো কে রে সেদিন তাহলে?” বিচ্ছিরি লাগলো - ঠিক যেন আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে বদমাইশ মেয়েটা!

    গোমেজ খুড়োর গল্প -

    বহুকাল আগে বিলেতে একদিন ভোরে একজন সাহেব আরেকজন সাহেবকে গুলি করে মারে। পিস্তল দিয়ে। কিসব নিয়ম কানুন ছিল - ওকে বলতো “ডুয়েল”। যে জেতে সে নাকি কোন একটা নিয়ম ভেঙেছিল - অন্যজন মরতে মরতে তাকে বলে যায় - “আসছি তোর গুষ্টি-র ঘাড় মটকাতে!”

    ডুয়েলে জিতে সাহেব ভারতে আসে, মিলিটারিতে ঢোকে, কানাডায় বদলি হয়, সেখানে খাতাপত্তরের বড়োসাহেব হয়। তারপর আবার ভারতে ফেরে। তার ছেলেও মিলিটারিতে ঢোকে, তারপর কলকাতা কর্পোরেশন, তারপর ই আই আর-এ বড়ো সাহেব হয়। কিং না ড্রিং কি যেন নাম।

    ইতিহাস তো হলো, এবার একটু ভূগোল পড়াই। সীতারামপুর থেকে মোগলসরাই গ্র্যান্ড কর্ড নতুন খুলেছে তখন। সম্রাজ্ঞী বোধ হয় মারাও গেছেন। দিল্লি থেকে হাওড়া আসতে গয়ার দক্ষিণে গুরপা, তার পর গঝন্ডি, তার পর কোডার্মা, হাজারীবাগ রোড হয়ে গোমো। কোডার্মার লোকেরা তখন ভাবছে ওদের আলাদা লাইন হয়ে যাবে গিরিডি, মধুপুর হয়ে হাওড়া।

    গুরপা থেকে গঝন্ডি প্রচণ্ড ঘন জঙ্গল, পাহাড়, ভীষণ আঁকা বাঁকা লাইন। ডুয়েল-জেতা সাহেবের ছেলে, যিনি তখন বড়ো সাহেব, তিনি ঠিক করলেন সরেজমিনে একবার লাইনটা দেখবেন। গয়া থেকে চার নম্বর ডাউন বোম্বে মেলে সেলুন জুড়ে আসছেন, সামনে গয়ার এক্সট্রা ইঞ্জিন লাগিয়ে মেল আস্তে আস্তে গুরপা-গঝন্ডি ঘাট থেকে নামছে, গঝন্ডি মাইল দুয়েক আগে বেরিয়ে গেছে। ট্রলিওয়ালা মতলবরাম আর একজন সঙ্গী ট্রলি নামিয়ে হাঁ করে দেখছে। হঠাৎ ওরা দেখে সেলুন-এর বারান্দায় একজন সাহেব হাওয়ার সঙ্গে ঘুঁষোঘুঁষি, মানে বক্সিং লড়ছে। গাড়ি থেকে হঠাৎ সাহেব গেলো পড়ে। মেল কোডার্মার দিকে বেরিয়ে গেলো, মতলবরাম আর সঙ্গী ছুটে গিয়ে দেখে সাহেব শেষ। তক্ষুনি ট্রলি ঠেলে গঝন্ডির দিকে দৌড়।

    কোডার্মাতে সাহেবের চা তৈরি করে বেয়ারা দেখে সাহেব নেই। মেল দাঁড়ালো, খোঁজ শুরু হলো। ঘন্টা খানেক পর সব বোঝা গেলো। হই হই কাণ্ড, রেলের বড়ো সাহেব মেলে লাগানো সেলুন থেকে পড়ে মারা গেছেন। মতলবরাম আর তার শাকরেদ কিন্তু যথাক্রমে গীতা আর কোরানের নামে বললো যে সাহেবকে যেন কেউ ঘুঁষি মেরে ফেলে দিয়েছে।

    তখন সেই বিপ্লবীদের সময়, পুলিশ চারদিকে ধরপাকড় করে জেরা করে শুনলো, “সব সাহেব মারবো, ওনাকে ছোঁব না।” এতোই জনপ্রিয় ছিলেন রেলের ওই বড়ো সাহেব।

    এদিকে কোডার্মাতে সেলুনটির চাকা দেখা গেলো আটকে গেছে! গাড়িটিকে খুলে রেখে দিয়ে সব কিছু নিয়ে মেল চলে গেলো কলকাতা। সারিয়ে সেটিকে আসানসোল ডিভিশনেই রেখে দেওয়া হয় - সাউথ বিহার রেল কোম্পানি ততদিনে উঠে গেছে, মানে ই আই আরের সঙ্গে মিশে গেছে। গাড়িটিকে কেউ আর ব্যবহার করে নি এই চল্লিশ পঞ্চাশ বছর। কি করে জানি ওটি মধুপুর সার্ভিস ইয়ার্ড-এ পৌঁছোয়, এবং ওটিকে ঠেলে সরিয়ে সাইড লাইন খালি-ও করা হয়!

    অনেকক্ষন ধরে বহু বিবরণে এই গল্পটি বলে গোমেজ সাহেব হাঁপিয়ে থামলো। তারপর কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, “কেন গিয়েছিলে ওদিকে? যেদিকে কেউ কখনো যায় না সেখানে কি দরকার তোমার যাওয়ার?”

    আরেকটু পর আরও বললো, “শোন তোরা, হাসিস না। রেলের খাতা পত্তরে সব লেখা আছে, একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বুঝলি? তবে কিনা, বড়ো সাহেবের ব্যাপার, তাই কোম্পানী কখনো এসব চাউর করবে না। আমরা ইওরোপিয়ান তো, আমাদের সব-ই জানা। আর কক্ষনো ওই সেলুনটার দিকে যাস নি তোরা কেউ, মনে থাকবে তো?”

    যার যা ইচ্ছে বুঝে নিন আপনারা। রেলে জানাশোনা থাকলে ফাইল ঘাঁটিয়ে খোঁজ নিতে পারেন চান তো।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ দীপঙ্কর ঘোষ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments