আমি তখন কলেজে পড়ি, ১৯৭২ সাল, আমার মামনির বিয়ে, মামনি আমার পিসি। আমাদের যৌথ পরিবারের বড় বাড়ি, নাম লাল বাড়ি। আমাদের বাড়িতেই বিয়ে হত, কখনো ভাড়া করা বাড়িতে বিয়ে হয়নি। বাড়ির সামনে পেছনে বড় বাগান ছিল। দোতলা, তিনতলার বিরাট ছাদ, এছাড়াও উঠোন, একতলা-দোতলার দালান। এসবের জন্যে কোনোদিন বিয়ের জন্যে স্থান অকুলান হয়নি। কিন্তু মামনির বিয়ের সময় এই প্রথম আমাদের বাড়ি ভাড়া করতে হল। তার কারণ সে বছর প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমাদের বাড়ি প্রতি বছর রং করা হত, বিশেষ করে বাইরেটা, কে জানে হয়তো লাল বাড়ির নাম অক্ষুন্ন রাখার জন্যে। কিন্তু সে বছর রঙের মিস্ত্রিরা এসে ফিরে গেল। আর আমার জ্যেঠুর মতে, যেহেতু বাড়ির সাজুগুজু হলনা, আর আমাদের বাড়ি বড় খোলামেলা বাড়ি, এত বৃষ্টিতে এই বাড়িতে সামাল দেওয়া যাবেনা, অগত্যা বিয়েবাড়ির জন্যে অন্য ভাড়া বাড়ি দেখ।
পাওয়া গেল একটা বাড়ি, আমাদের বাড়ির থেকে মাইল খানেক দূরে, নাম কিশোরীভবন। সে বাড়ির রঙও লাল। বড় বড় থাম দেওয়া বিশাল বাড়ি, থামে সুন্দর জাফরির কাজ, সার্কুলার ড্রাইভওয়ে। চওড়া চওড়া সিঁড়ি, বিরাট বিরাট ঘর, বাড়ির মধ্যে একটা বারান্দা-ঘেরা সুন্দর উঠোন। আমার মন তখনই বাড়িটাকে ভালোবেসে ফেলেছে, তার দুটি কারণ। এই আমার প্রথম ভাড়াবাড়িতে এসে থাকা। ছোটবেলায় খুব মনে হত, যারা ভাড়াবাড়িতে থাকে তাদের কি মজা, কত নতুন নতুন বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারে, আমাদের মতো একঘেয়ে এক বাড়িতেই থাকতে হয় না। আর দ্বিতীয় কারণটা ক্রমশ প্রকাশ্য।
বিয়ের আগের দিন আমরা সবাই নতুন বাড়িতে চলে গেলাম। ওখানেই আইবুড়ো ভাত। আমাকে বলা হলো মামনিকে সাজিয়ে দিতে। এটা আর তত্ত্ব সাজানোটা আমার একটা পার্মানেন্ট পোস্ট ছিল। এরমধ্যেই আমার জাম্মা (জ্যেঠাইমা) বলল, খুকু উঠোনে বিয়ের জায়গাটা আলপনা দিয়ে দে। আমি তো এটাই চাইছিলাম। এত বড় জায়গা, আমায় আর দেখে কে। সারা উঠোন জুড়ে আলপনা দিলাম। মুখোমুখি দুটি ময়ূর। ঠোটে করে একটা মালা ধরে আছে, তার মধ্যে লেখা, শুভ-বিবাহ। সবাই দেখে খুব খুশি। কিন্তু সেটাই কাল হলো। এরপর আমি প্রত্যেকটা থামে, দরজায়, সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে, বিয়ের বাসর বসার ঘরের চার কোনায়, যেখানে যেখানে খালি জায়গা পেয়েছি সেখানেই মনের আনন্দে সারা রাত জেগে আলপনা দিয়ে ফেললাম।
ভোরবেলা আমার দাদাভাই হবু পিসুমদের বাড়ি অধিবাস নিয়ে যাবে বলে বাড়ি থেকে তৈরী হয়ে বিয়েবাড়িতে এসে, আমার কাণ্ড-কারখানা দেখে ক্ষেপে বোম। বুঝতেই পেরেছে যে কার কাজ। আধা-ঘুমন্ত আমায় একেবারে বিছানা থেকে তুলে এনে কি বকুনিই না বকলো। তার বক্তব্য, “করেছিস কি? এটা কি সরস্বতী পুজো হচ্ছে? এটা বিয়ে বাড়ি, আমাদের ভাড়া করা বাড়ি। তুই সবজায়গায় তোর কেরামতি দেখিয়ে আঁকিবুকি কেটে দিলি?” আমার তখন দুচোখ দিয়ে রাঙাপানি ঝরছে, ওটা আমার খুব সহজে আসে একটু জোরে কথা বললেই তিনি চলে আসেন। ইতিমধ্যে বাবা, বম্বের জ্যেঠু, জাম্মা সবাই হাজির। জাম্মা বলেই ফেললো, বাপি (দাদাভায়ের ডাক নাম) কেন মেয়েটাকে বকছিস, সারারাত ধরে কত খেটেছে। কি সুন্দর দেখচ্ছে, বাড়িটা যেন হাসছে। আহারে মেয়েটাকে কাঁদালি।” আর সেই শুনে দাদাভায়ের গলা আরো চড়ল, “সাধে কি আমি ওর নাম দিয়েছি নেকি অবলম্বনে খুকি? প্যানপ্যান করেই আছে। এখন কাল বাদে পরশু বাড়ি ছাড়তে হবে, তার আগে সব মুছে দিতে হবে, নাহলে ভাড়া বেশি চাইবে। এবার তোমরা বড়রা যা বোঝো তাই করো, আমি আর এর মধ্যে নেই। তোমরাই আদর দিয়ে দিয়ে ওর মাথা খেয়েছ। খুকু নামটাই হয়েছে কাল---” গজ গজ করতে করতে দাদাভায়ের প্রস্থান। আমাকে জাম্মা কাছে টেনে নিয়ে বলল, “বাপি ওসব মুখে বললেও আসলে তোকে খুব ভালবাসে। তুই মন খারাপ করিস না, ভেতরে গিয়ে আর একটু ঘুমিয়ে নে।”
এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। আমাদের বাড়িতে আমাদের ছোট করে রাখার একটা অসীম ক্ষমতা আছে। এরপর বিয়ের হইচই, আনন্দ, কান্নাকাটি, তত্ত্ব সাজানো সবকিছুর মধ্যে আর কিছু মনেই নেই যে আমার আলপনার কি হলো, কে মুছলো, কত টাকা বেশি দিতে হল ইত্যাদি। শুধু মনে আছে দুপুর বেলা সবাইকে লুকিয়ে দাদাভাই আমাকে একটা কাঠি আইসক্রিম এনে বলেছিল, “ছাতে গিয়ে চুপিচুপি খেয়ে আয়, কেউ দেখে ফেললেই পঙ্গপালের মতো সবাই আমাকে এসে ধরবে। আর যাবার আগে আমাকে এক কামড় দিয়ে যা।” এখনও কাঠি আইসক্রিম আমার খুব প্রিয়। লিখতে লিখতে চোখ ভরে আসছে, আমাকে নেকি বলার, আইস্ক্রিম থেকে কামড় দেওয়ার মানুষটা আমায় ভুলে গেছে। তার নাম স্বপন, তাই কোন স্বপনপারের দেশে চলে গেছে।
কলেজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমি কোনদিন একা স্কুলে যাইনি, এমন কি ক্লাস এইট পর্যন্ত আমার মনে আছে “বুড়ি” (আমাদের বাড়িতে থাকত, মনে পড়ে ছোটবেলায় মোটা করার জন্যে খুব দুলচে-মলচে তেল মাখাত, আমায় খোঁকি বলত) টিফিনেও দুধ-সন্দেশ নিয়ে চলে আসত। আমি যতই চেষ্টা করতাম ওকে না দেখতে পাওয়ার, ও ঠিক বন্ধুদের সরিয়ে আমাকে বসিয়ে দুধ খাইয়ে যেত, কারুকে ত্রিসীমানায় আসতে দিত না।
তারপর স্কুল শেষ করে যখন বেথুনে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। সে যে কি আনন্দ। একা একা কলেজে যাব। কেউ সঙ্গে নিয়ে যাবেনা। এক মাসের মত গেলামও। পিসি সঙ্গে নিয়ে যেত, ফেরার সময় বন্ধুদের সঙ্গে মিনি বাসে উঠে হাওড়া ময়দান, সেখান থেকে বুড়োর রিক্সা করে বাড়ি। এই বুড়োর গল্পেই আসব। তার আগে এই কথাটা বলে নিই। আমার বেথুনে পড়ার মেয়াদ মাত্র দুমাস, তারপর আমার জ্যেঠু বাবা কাকার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আমাকে হাওড়া গার্লস কলেজে নতুন কেমিস্ট্রি অনার্স খুলেছে সেখানে ভর্তি করে দেওয়া হলো। কারণ মেয়ে কাছাকাছি চোখের ওপরে থাকবে, চিন্তা থাকবে না। এই দুঃখের কথাটা এবার বলে শেষ করি। আমার কলেজের একপাশে হাওড়া কোর্ট, জ্যেঠু সেখানে প্রাকটিস করে, অন্যপাশে মিউনিসিপালিটি, দাদু ওখানকার চেয়ারম্যান। সুতরাং খুকুকে দুই জনের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ আশ্রয়েতেই রাখা হলো।
এবার বুড়োর কথা। আসল নাম জানিনা, ওকে সবাই বুড়ো বলেই ডাকতো। কলেজে যাই জ্যেঠুর সঙ্গে বাড়ির পুরনো অস্টিন গাড়িতে, তার হর্ন শুনলেই আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করত। ফিরি বুড়োর রিক্সায়। বুড়োকে দেখলে আমার বড় কষ্ট হত। অনেক বয়েস, রিক্সা চালিয়েই খায়। পাগুলো খুব সরু সরু, দেখলে মায়া লাগে। ও আমাকে খোঁকিমা বলত। ও আমাকে ওর বউ ছেলে বৌমার গল্প করত। ওই আমার ত্রাণকর্তা হয়ে গেল। রোজ আমি টিফিনটা রেখে দিতাম, ও নিতে এলে আগে ওকে খেয়ে নিতে বলতাম, তারপর বাড়ি ফেরা। ও প্রথম প্রথম খেতে চাইতনা, বলত, তুমি এত্ত দুবলা-পাতলা আচ, তুম হ্যায় তো খেতে হোবে খোঁকিমা। পরে আর আপত্তি করত না। সে সুখও আমার ভাগ্যে টিঁকলো না।
আমাদের বাড়ির বাইরের দিকে একটা ছোটো ঘর আছে, অনেকটা আউট হাউসের মতো। ওটা আমার খুব প্রিয় ঘর। ওখানেই আমি বেশি সময় কাটাতাম। বুড়ো অনেকদিন এসে জানলায় দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে গল্প করত। একদিন ও আমাকে টিফিন বাক্সটা ফেরত দিতে ভুলে গেছে। তাই জানলার মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে “খোঁকিমা তোমার ডিব্বা বলে ফেরত দিয়েছে।” আমি নয় আমার বৌদি (আসলে মা, বাড়ির সবার মতো বৌদি বলতাম) ওখানে চান করে খোলা চুলে বসে বই পড়ছিল। ব্যাস সব জানাজানি হয়ে গেল। আজ নির্ঘাত কপালে বকুনি আছে। বকুনির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কেন আমার খাবার দিয়ে দিই এই প্রশ্ন তো উঠলই, তার ওপর শরীর খারাপ করলে কি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সাজাটা কিন্তু কঠিন হলো না। আমার মা ( ঠাকুমা) বলল, ওকে বকে লাভ নেই, ওর অত মায়ার শরীর। কাল থেকে দুটো করে টিফিন গুছিয়ে দিও একটা ওর আর একটা ওর বুড়োর। শান্তিপূর্ণ সমাধান। এরপর একদিন সায়েন্স কলেজ ও এপ্লায়েড কেমিস্ট্রিতে বাবার সঙ্গেই গেছি, কারণ বাবা ওখানেরই কর্মচারী, আর পিসির সঙ্গে ফিরেছি। তাই বুড়োর সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছিল। শুধু চেয়েছিল খোঁকিমার দামাদকে আর খোঁকিমাকে ওর পক্ষীরাজে চড়াবে, সে আশা ওর পূরণ হয়নি।
আমি তখন এদেশে; বাবা একদিন জানালো, তোর বুড়ো আর নেই। মনটা বড় খারাপ হলো যে বুড়োকে আর দেখতে পাব না। তারপর শুনেছি ওর নাতি মংলু এখন রিক্সা চালায়। আমি ওকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না, হয়তো তখন খুব ছোটো ছিল। সে আমাদের বাড়ি থেকে কেউ কিছু কেনাকাটা করার জন্যে বেরোলেই তাকে তার এক্কাগাড়িতে তুলে নিয়ে যাবেই। সুতরাং আমাদের বাড়ির মানুষও মংলুতে খুব অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
একবার আমি দেশে গেছি ২০১২তে, তখন এই মংলু এসে আমায় পাকড়ালো। আমি চিনতাম না, মিমা (আমার পিসি) বলল, “এ তোর বুড়োর নাতি। রোজ সকালে এসে খোঁজ নিয়ে যায় তুই কবে আসবি।” দেখলাম একটা ১৯-২০ বছরের ছেলে, বেশ গাঁট্টা-গোট্টা। সে ব্যাপারে বুড়োর সঙ্গে কোনো মিল নেই। চোখদুটো সরল, যা ওর চেহারার সঙ্গে বেশ অমিল। আমি ভেবেছি কিছু চায়, শুনেছে বাইরে থেকে এসেছি। আমি ওকে জিগ্যেস করলাম যে কিছু চায় কি না। তার আবদার শুনে তো আমি হতভম্ব। সে চায় আমি যখনি কোথাও যাব তখনি ওর রিক্সা করে যেতে হবে। আমি যাই খুব কম দিনের জন্যে, তার মধ্যে বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সময় ভাগ করা। গাড়িতে না গিয়ে রিক্সা করে কোথাও গেলে তো দিনের অর্দ্ধেক সময়ই চলে যাবে। ওর কথা আমি রাখতে পারিনি, রোজই গাড়িতে বেরিয়েছি, কিন্তু দেখতাম সওয়ারী না থাকলে ও আমাদের গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতো। একদিন ওকে ডেকে একটা রফায় আসা গেল যে কেবল একদিন আমি ওর পক্ষিরাজে চড়ে বেরব। খুব খুশি সে। আমায় বলল ওর দাদু ওকে খোঁকিমার অনেক গল্প করেছে।
যাইহোক নির্দিষ্ট দিনে সে তো ভোর থেকে এসে হাজির, আমি তখনো ঘুমে কাতর, বিছানা ছেড়ে উঠিনি। কাকাভাই এসে বলল, “উঠে পড়, তোর সারথী তার রথ নিয়ে ভোর থেকে এসে বসে আছে।” নীলিমা, আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার (আসলে ম্যানেজার), আর্জি দিলেন, “মামাবাবু, ওকে পয়সা দিয়ে বিদেয় করুন, মেয়েটা কদিনের জন্যে একটু জিরুতে এয়েচে, ওকে ঘুমুতে দিন।” আমি আর ঝামেলা না করে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। আমার মামারবাড়ি কাসুন্দে শিবতলায়। ওকে বললাম আমি ওখানে যাব আর ওখানেই খাব, তুমি আমায় পৌঁছে দিয়ে চলে এসো। সে কি বুঝেছিল আমি জানিনা।
আমি দিব্যি মামার বাড়ির আদরের আহার সেরে দুপুরে খাটে শুয়ে মামীমনির সঙ্গে গল্প করছি। তাও প্রায় ঘন্টা চারেক সময় কেটে গেছে, মামা এসে বলল, “হ্যাঁরে, তোর ড্রাইভার তো তার গাড়িতে (রিক্সায়) গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে, তুই ওকে বলিসনি যে আমি পৌঁছে দেব?” আমি অবাক, “বলেছিলাম তো।” মামা তাকে জোর করে বাড়িতে এনে খাইয়ে দিল। তারপর ভাড়া দিতে গেলে সে কিন্তু কিছুতেই নেবেনা। একেবারে নাছোড়বান্দা। অগত্যা খোসগল্প ছেড়ে মামার বাড়ির মায়া কাটিয়ে তাড়াতাড়ি রিকসায় চেপে বসলাম।
একটু দুরে গিয়েই সে আসল কথাটা বলল। “দিদি, একটা জায়গায় আপনি আমার সঙ্গে যাবেন? বেশি সময় লাগবেনা, খুব দুরে নয়, যাওয়ার পথেই।” এইবার আমার মেজাজটা বিগড়ে গেল। এইজন্যেই বলে, এদের কখনো লাই দিতে নেই। কে জানে ওর বাড়িতে না কোথায় নিয়ে যাবে। আমার অনুমতির কি অপেক্ষা রাখে? সে কিন্তু আমার মনের কথা বোঝেনি, তখন তার পক্ষিরাজ এ গলি ও গলি দিয়ে ছুটছে। আমিও খুব ছুটছি পিছন পিছন। অবশেষে মিনিট ২০ পর সে এক জায়গায় এসে থামল। বেশ অনুনয়ের সুরে, “দিদি, একটু নেমে আসুন, একটুখানি যেতে হবে। এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব যে আপনি অগে কখনো যাননি।” বেজার মুখে নামলাম। পেছন পেছন গিয়ে যেখানে ঢুকলাম, সেটি আমার অচেনা জায়গা নয়, হাজারহাত কালীতলার মন্দির। এখানে মা কালীর হাজারটা হাত। ওকে বলতে যাচ্ছিলাম, “ওমা, এত আমার চেনে জায়গা। কিন্তু তার মুখটা জ্বলজ্বল করছে, যেন কি একটা আবিষ্কার করে আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মুখে বিজয়ীর হাসি। পারলাম না সত্যি কথাটা বলতে, ওকে খুশি করতে বললাম, “সত্যি আমি কখনো আগে দেখিনি। ভাগ্যিস তুমি দেখালে।“ তার প্রশ্ন,“দিদি আপনি পুজো দেবেন?” আমি পরে আবার আসবো বলে, প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম । তার এক্কাগাড়িতে উঠেই, “দিদি আপনাকে একদিন সকালে নিয়ে আসব তাহলে আপনি পুজো দিতে পারবেন।” তখনকার মতো এটা ওটা বলে পাশ কাটালাম।
বাড়ি ফিরে ভাড়া দিতে গিয়ে আর এক বিপদ, সে কিছুতেই ভাড়া নেবে না। সকাল এগারোটা থেকে সন্ধে ছটা অবধি ঘুরেছে। আমিও ছাড়বনা সেও নেবেনা। শেষে রফা হলো যে আমার কাছে একটা নতুন টিশার্ট ছিল সেটা জোর কর দিয়ে দিলাম। (তাতেও আর এক বিপদ, আমার ভাই বলল, দিদিভাই তোমার দেওয়া আমার এরকম একটা টিশার্ট আছে, আজকাল তোমার মংলু সারাক্ষণ সেই শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আর ওটা পরছিনা।) আমি যে কোন দিকে যাই।
এরপর থেকে এটা প্রায় একটা অলিখিত চুক্তি হয়ে গেল, যে আমি যখনি দেশে যাবো, তখন একদিন কিছুক্ষনের জন্যে ওর পক্ষিরাজে চড়ে আমায় কথাও যেতে হবে। প্রত্যেকবার আমি বাড়ি গেছি শুনলেই ওর রিক্সা আমাদের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে এত কম সময়ের জন্যে যাওয়া, সবার সঙ্গে দেখা করার থাকে যে গাড়িতে গেলে সময় কম লাগে। কে এখন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে ওর রক্ষায় ১৫ মিনিটের পর ১ ঘন্টা ধরে যাবে? মায়া লাগে, তাই কিছু না হলেও বাড়ির কাছেই ময়দানে গিয়ে কিছু কেনাকাটি করে আসি। প্রতিবারই ও আমার কাছ থেকে ভাড়া নেয়না, তাই দেশ থেকেই ওকেকিছু কিনে দিই। আগের মতো আর ভুল করি?
২০১৭তে আমার ভাইঝির বিয়েতে দেশে গেছি। আমার পিসতুতো দাদার মেয়ে। আমাদের বাড়ি থেকে দূরে নয়। তাই সে খুব ব্যস্ত হয়ে সারাক্ষণ এবাড়ি থেকে ওবাড়ি আর ওবাড়ি থেকে এবাড়ি করছে। আমি ভাবলাম এবার আর আমাকে ওর সঙ্গে একস্কার্সনে যেতে হবে না। ও হরি, ভবি ভোলবার নয়। এর ফাঁকেই আমাকে বলল, “দিদি, এবার আপনাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে আপনি কখনো যাননি।” আমি মনে মনে ভাবছি, আমি এখানের মেয়ে, এখানে বড় হলাম, তুমি তো দুদিনের ছেলে, তুমি আমাকে আর নতুন কি দেখাবে। কিন্তু ভাবা আর করা কি এক। শেষে রফা হল, বাসিবিয়ের দিন বিয়ে বাড়ি থেকে তুলে ও আমাকে বাড়ি পৌছে দেবার পথে ওর সেই “আমার কখনো না দেখার” জায়গায় নিয়ে যাবে। জানি তো ভাড়া নেবে না তাই আগে থেকেই বিয়ে বাড়ির সওয়ারী হওয়ার জন্যে একটা পাজামা-পাঞ্জাবী কিনে দিলাম।
বাসিবিয়ের দিন বড় কষ্টের, সবার চোখে জল, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। আমারও মনটা বড় খারাপ, তার মধ্যে দেখি বরের গাড়ির পেছনে মংলু তার পক্ষিরাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ রাগ হলো; ইচ্ছে করেই আমি ওকে পাত্তা দিচ্ছিলাম না। তারপরই ফুলসজ্জার তত্ত্ব সাজানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তারমধ্যে দুপুরের খাওয়াও হলো। বিয়েবাড়িতে সবার সঙ্গে দেখা হওয়া, রাতে লম্বা বিছানা করে একসঙ্গে শোয়া, রাত জেগে গল্পকরা, এরপর সাজগোজ, কে কবে কোন শাড়ি পরছে তার আলোচনা, সব মিলিয়ে একটা জমজমাট ভাব। কখন বিকেল হয়ে গেছে জানিনা, দাদা বলল, “খুকু তুই ওবাড়ি যাবি তো ঘুরে আয়, বেশি দেরী করিস না।” “আমি এখুনি যাচ্ছি” বলে গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি, আমার জন্যে বাহন সমেত সারথী প্রতীক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে। অগত্যা মনে মনে গজগজ করতে করতে রিক্সায় উঠতে হলো। উঠেই, “তাড়াতাড়ি চালাও, আমার তাড়া আছে।”
রিক্সায় পাঁচ মিনিটও যায়নি, মংলু জিগ্গেস করলো, “দিদি আমরা ওখানে যাচ্ছি তো?”
“ওখানে? কোথায়?” মংলুর উত্তর, “কেন, আপনি যে বলেছিলেন আজ আমার সঙ্গে সেখানে যাবেন।“
“কোথায় যাবো?”
মংলু, “ওই যেখানে আমি আপনাকে নিয়ে যাব বলেছিলাম।”
এবার আমার মেজাজ গরম হচ্ছিল, সব লোকজন হৈচৈ ছেড়ে আমায় ওনার কোন “ইসপেশাল” জায়গা আছে সেখানে যেতে হবে। আমিও যাবনা আর তার কাকুতি মিনতিও কমছে না। তার বক্তব্য, “দিদি আপনার সেখানে ভালো লাগবে, এটা যাওয়ার পথেই পড়বে, কদমতলায়। ওখান দিয়েই আমরা যাব।” ওর এই নেই-আঁকড়ে ভাবটা আমার একদম পছন্দ হয় না। বড্ড জেদ করে। তবে ওর চোখদুটো দেখলে বড় মায়া লাগে, বড় করুণ। শেষ পর্যন্ত আপস হলো যে কোথাও নামবনা, রিক্সা থেকে যা দেখা যায় তাই দেখবো, নামলেই সময় নষ্ট।
কদমতলা পেরিয়েই বাঁ পাশে একটা পুরনো জরাজীর্ণ বাড়ির গেটের কাছে এনে রিক্সাটাকে দাঁড় করালো। বাড়িটার বেশ দুরবস্থা। একজন লোক গেটের সামনে বসেছিল, তার সঙ্গে মংলু কি সব কথা বলল। তারপর ফিরে এসে বলল, “দিদি আমি রিস্কা নিয়ে ভেতরে যেতে পারব, নামতে হবেনা আপনি রিস্কাতেই বসুন।” এখন দেখে মনে হচ্ছে পোড়ো বাড়ি, কিন্তু এক সময় বাড়ির সৌন্দর্য ছিল। বাড়িটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল বাড়িটার সামনের থামে, সিঁড়িতে, দরজায়। ও মা একি? এ যে আমার আলপনা নকল করা। এখনো আমি পুজোয় বাড়িতে এরকম আলপনা দিই। এক ঝটকায় রিক্সা থেকে নেমে আমি কাছে গিয়ে আলপনাগুলো দেখছি। কিছুতেই অঙ্ক মিলছে না। কে দিল আমার আলপনা নকল করে? মংলু পাশে দাঁড়িয়ে অনর্গল বলে যাচ্ছে, “দিদি আমি বলেছিলাম যে আপনার ভালো লাগবে, আপনার মতো এখানে ডিজাইন করা। জানেন দিদি এই বাড়িটা আগে বিয়েবাড়ির জন্যে ভাড়া দেওয়া হত। অনেকে এই বাড়িটাকে আলপনা বাড়ি বলে। বলুন দিদি আপনার ভালো লেগেছে না? দাদার বাড়িতে আপনি তো এরকম ডিজাইন করছিলেন।”
আমি তখন বাক্যহারা, কি করে হয়? এতগুলো বছর বাদে সেই এক আলপনা, যার জন্যে কত বকুনি খেয়েছিলাম। কে? কে দিল? কাছে গিয়ে প্রত্যেকটা আলপনা খুঁটিয়ে দেখলাম। এটা জিঙ্ক অক্সাইড দিয়ে আঁকা নয়, কেউ আমার আঁকার ওপর তেল রং দিয়ে যত্ন করে আঁকাগুলো ধরে রেখেছে। এই সেই বাড়ি যেখানে মামনির বিয়ে হয়েছিল। যে মানুষেরা সেদিন আমাকে স্নেহ ভালবাসা দিয়ে ঘিরে রেখেছিল, জ্যেঠু, জাম্মা, বাবা, কাকা, পিসুম, দাদাভাই তাদের কারুকেই আমি ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু আজ এই জরাজীর্ণ বাড়িটা ৪৫ বছর বাদে, একটা জড় পদার্থ হয়েও আমার আলপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আমার সারথী আজ জানতে পারলনা যে আজ ও আমাকে সত্যিই এক অরূপ রতনের সন্ধান দিল। আজ বুড়ো থাকলে বড় খুশি হত যে ওর নাতি ওর খোঁকিমা কে খুশি করে দিয়েছে।