এই পৌষে খোকন ন’ মাসে পড়লো।
কোঞা-কোঞা-কোঞা …
বাবা ঘরে বই পড়ছিলেন। ঘর থেকেই চেঁচিয়ে বললেন, “খোকন কাঁদছে কেন?”
“খিদে পেয়েছে বোধ হয়,” ঠাকুরদা বললেন। আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে বাসি খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলেন। এখনও আজকের কাগজ এসে পৌঁছয়নি। ঢং ঢং করে ন’টা বাজল দেয়াল ঘড়িতে।
ঠাকুরমা জাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছিলেন, মুখে এক ঠিলি পান গোঁজা। এক গাল হেসে বললেন, “তুমি সব জানো, একা একা বিছানায় শুয়ে কি খোকনের ভাল লাগে? ও বেড়াতে চায়,--” কোলে তুলে নিয়ে ভোগা দিতে লাগলেন, “না-না-না, কাঁদে না সোনা, কাঁদে না ধন আমার; ও-লে বা-বা-লে, না-না, ওই দ্যাখো পাখি, পাখি আই-আই, আমার খোকন সোনা, চাঁদের কণাকে নিয়ে যা--”
তবু চুপ হয় না। সমানে কেঁদে চলেছে।
কোঞা-কোঞা-কোঞা …
কাকা ছিলেন পাশের ঘরে। বাজার যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অভিজ্ঞের মতো বললেন, “দ্যাখো, কিছুতে কামড়ে টামড়ে দিল কি না! এমন তো কাঁদে না, কি হল আবার? পেটের গণ্ডগোল হয়নি তো?”
কাকিমা রান্নাঘরে ছিলেন। এত কান্না শুনে থাকতে না পেরে বেরিয়ে এসে বললেন, “কই আমাকে দেন দেখি, খোকনের বোধ হয় ন্যাপিটা পাল্টাতে হবে, সেই নাই সকালে পরিয়ে দিয়েছে; আহাঃ বাছা আমার, বলি, দিদিই বা গেল কোথায়? ছেলেটা অমন করে কাঁদছে, শুনতে পায় না?”
ন্যাপি খুলে দেওয়া হল। জামা খুলে দ্যাখা হল কোথাও কিছুতে কামড়েছে কি না? কিন্তু কোথাও কোনো কামড়ের চিহ্ন নেই।
দিদি উপরের ঘরে বসে রেওয়াজ করছিল। এত আওয়াজে কি আর রেওয়াজে মন বসে! হারমোনিয়াম গুটিয়ে রেখে নিচে নেমে এসে বললো, “কই আমাকে দাও, ভাইকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি,” কোলে নিয়ে, “বেড়ু বেড়ু করবে? না-না, চলো ওই দিকে যাবো। পুকুরপাড়ে যাবে? মাছ দেখবে, মাছ, বড় বড় মাছ?”
কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝলমল করছে আকাশটা। উত্তরের শিরশিরানি হাওয়া বইছে। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ভোলা, নেড়ুদের বাড়ির হোঁৎকা কুকুরটা। হাঁসগুলো জলকেলি করছে। ভুস করে ডুব দিচ্ছে আর গুগলি তুলে খাচ্ছে। কখন যে কান্না থেমে খোকনের মুখে হাসি ফুটেছে দিদি খেয়াল করেনি। খেয়াল করতেই খোকনের কি যেন একটা মনে পড়ে গেল।
কোঞা-কোঞা-কোঞা …
“এ কি! এ যে আবার শুরু হয়ে গেল,” “নাহ্, কি যে হলো! যাই মাকে দিই গিয়ে,” নিজের মনেই বললো দিদি।
সকালের বাসি কাজ সেরে কাচা কাপড়-চোপড় ছাদে মেলে দিয়ে ভিজে কাপড় ছেড়ে মা ততক্ষণে প্রস্তুত। খোকনকে মায়ের কোলে দিতেই চুপ।
“এ কি! এত কাঁদছিল, এখন একেবারে চুপ,” সবাই বললেন।
মা বললেন, “খোকন মায়ের কোল চাইছিল।”