বিকেলের সূর্য এখন আলো গোটাচ্ছে। চোখের সামনে অস্তরাগ। গৈরিক আকাশ। শর্তহীন ত্যাগ, বৈরাগ্য বা বিসর্জন যেন অপেক্ষমান। শীত শেষের পাতা ঝরার মরসুম। এমনই এক উদাস নিঃস্ব মনখারাপের বিকেলে চেনা নদীটির পাড়ে অপেক্ষা করছে ঋতব্রত। রিনি ডেকেছে। রিনি আজই এসেছে কলকাতা থেকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পিএইচডি স্কলার। ইংরেজি সাহিত্যের ডক্টরেট, প্রায় রোজগারহীন ঋত টিউশানি করে। টুকটাক রোজগার। সঙ্গে মফস্বলের কলেজে পার্ট টাইম।
কী এমন বলবে রিনি, যে এত তাড়াতাড়ি এবং জরুরি ডাকল, ভেবে ঋতব্রত একটু বেশিই অস্থির। ওই আসছে। ওর আসা, তা যত দূর থেকেই হোক, ঋত শুনতে পায়। এমনকি দেখতে না পেলেও। ঋত, রিনির দূরাগত শব্দের ছন্দও ঠিক বুঝতে পারে। তার পায়ের শব্দ শুনতে পায় চোখ বন্ধ করে, যেভাবে বৃষ্টির শব্দ শোনে নিঃসঙ্গ কবি। এই শোনা যেন কান দিয়ে নয় অন্তর দিয়ে। রিনির আসা তার কাছে ঠিক আবির্ভাবের মতো। একটা আবেশ জড়িয়ে যায়। এই নিবিড়তাই সারাজীবন পেতে চায় ঋত। রিনির প্রতিটি আবির্ভাব তার আগেরটাকে ছাপিয়ে নতুন ভালোলাগায় আবিষ্ট করে দিক ওকে, সে এটাই চায়। রিনিকে দেখলেই বুকের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। দূরাগত সূর্যের প্রথম আলো যেভাবে প্রান্তর পর্বত মরুভূমি সাগর পেরিয়ে একটা থেকে অন্য কণায় ছড়িয়ে যায়, এসে স্পর্শ করে প্রাণ, তেমনই রিনির আসা ঋতকে ভিজিয়ে দেয়। এইজন্যই ঋত ওকে বলে, "তোর নামের বানানটা আমি পাল্টে দিয়েছি। 'ঋণী' তোর নাম। যে অন্যকে ঋণী করে। আমার যে অপূরণীয় ঋণ তোর কাছে! আমার জীবনে তুই, যে মূল্য নিয়ে নিহিত, আর কোনও কিছুরই এত মূল্য নেই আমার জীবনে।”
রিনি হাসে। অনাবিল। বলে, "পাগল।”
কমলা রঙের শাড়িতে, শ্যাম্পু করা ফুরফুরে খোলা চুলে, মানানসই সব পোশাক-প্রসাধনী উপাদানে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় রিনি। গোধূলি আলোর বৈরাগ্য তার চেহারায়। কিছুটা ম্লানতাও। এবং তারও বেশি চঞ্চলতা। বলে, "আমার সঙ্গে এসো। কথা আছে।”
নদীর পাড় বরাবর হেঁটে ওরা গিয়ে দাঁড়ায় ক্যানাল ব্রিজের উপর। ব্রিজের ধারে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। এখান থেকে অনেকটা নীচে আছে বহতা স্রোত। অনেক গভীরে। একটা বড় কিছু যে ঘটবে সেটা আন্দাজ করেছে ঋতব্রত। কয়েকদিন আগে রিনি ফোন করেছিল। কলকাতা থেকে। বলেছিল, "একটা খুব বড় ডিসিশন নেওয়ার আছে।” সিদ্ধান্ত, ভালো খারাপ যা কিছুই হতে পারে। ঋতর মন কু ডাক দিয়েছিল সেদিনই। একটা অজানা ভয়ে সে গুটিয়ে আছে তারপর থেকে।
গৈরিক আকাশকে পেছনে রেখে রিনি দাঁড়িয়েছে। সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে। ওর মুখোমুখি ঋতব্রত। কিছু শোনার জন্য মরিয়া।
রিনি বলে, "কিছু বলার আছে।” প্রবল অস্থিরতা ওর গলায়।
"হ্যাঁ। বল।”
"আমি চলে যেতে চাই।”
"কোথায়? কেন?"
চুপচাপ। স্তব্ধতা ঘিরে ধরে ওদের। নিঃস্ব হাওয়া আসে। পাক খায়। চলে যায়। একটা লোকাল ট্রেন নদীর ওপর রেলব্রিজ দিয়ে দূর গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছে। রিনি যেন এই ছেড়ে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে। ট্রেনের দিকে তাকায় ঋত। বলে, "বল না, ঠিক কী বলতে চাস? আমি শুনছি।”
"না আসলে, পোস্টডক করতে আমি, স্টেটসে যাব। টেক্সাস। কামিং জুনে। কবে ফিরব ঠিক নেই। তাই বলছিলাম, যেহেতু আমার আগামী এতটাই অনিশ্চিত, সুতরাং, আমি সরে যাচ্ছি, তোমার কাছ থেকে। তুমি এবার গোছাও নিজেকে। শুধু তো দিয়েই গেলে, দিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছ!"
"চাইলেই সরে যাওয়া যায়? আমি অপেক্ষা করব।”
"তা হয় না। ফেরার ঠিক নেই আমার। অনেক দেরি হয়ে যাবে এই জীবনে।”
"আমি জন্ম জন্ম অপেক্ষা করতে রাজি।”
"তা হয় না। জীবন তো উপন্যাস নয়।”
কথা শেষ হয়ে আসে রিনির। যুক্তি খাড়া করতে পারে না। ঋতর চোখের তারায় ক্ষয়িষ্ণু সূর্য। সারা শরীরে গেরুয়া আলোর আভা। স্থবির ঋত ক্ষয় হতে থাকে ক্রমশ। জ্বলন্ত মোমবাতির মতো তার অস্তিত্ব সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। জীবন কি এমনই! স্বপ্নের কোলাজ এঁকে তাকে ছিঁড়ে দেয় আবার। স্বপ্ন আঁকা আর ভাঙার মধ্যে ঘুমন্ত মায়া হয়ে লুকিয়ে থাকার গল্পটুকুই প্রেম! বাকি সবই মিথ্যে! সব কেমন গুলিয়ে যায় ঋতর। রিনি নিজেকে গোছাতে চায়। একজন শিক্ষিত বেকারের অনিশ্চয় আগামী থেকে সবদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন করতে চায় নিজেকে।
ঋত সোজাসুজি তাকায় রিনির দিকে। চোখে চোখ। এই দৃষ্টি জিজ্ঞাসার। হাজারো প্রশ্নের গভীরতা যেন সম্পৃক্ত আছে এই তাকিয়ে থাকায়। রিনি পুড়ে যেতে থাকে। ভয়ে। যুক্তিহীনতায়। প্রতারণার অপরাধে।
#
কলকাতায় পড়াশুনো করার সময় ঋত বারবার বলত, "এই মেট্রো লাইফ আমি নিতে পারছি না। মফস্বলে ফিরে যাব। ওটাই আমার জায়গা।”
রিনি ঠিক উল্টো। সে বলত, "আমার যে এই পরিবেশেই ভাল লাগে ঋত! আমি আরও এগিয়ে যেতে চাই। জীবনকে চরমভাবে উপভোগ করতে চাই। কোনও ভৌগোলিক সীমারেখায় আটকে থাকতে পারব না। এ বিশ্ব আমার ঘর।”
ওদের ভাঙ্গনের রেখা কি এখান থেকেই আঁকা হয়েছিল! এখন তো প্রায়শই সন্দেহ জাগে ঋতর মনে।
অনেক অনেক ঘটনার চিহ্ন গেঁথে আছে বিগত দিনের যাপনে। কিছু কিছু দৃশ্যমান। বাকিগুলো জল হাওয়ার দাগের মতো। চিহ্নহীন। অথচ যার উপস্থিতি সতত উজ্জ্বল। চেতনে। অবচেতনে। দৈনন্দিনে। একটা ঘটনা এতটাই গভীরে দাগ কেটেছিল যে, ঋত কোনোদিন ভাবতেই পারেনি, রিনি চলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে বা বলতে পারে। সে ধরেই নিয়েছিল, রিনি ওর একার। একজন কবি যখন আত্মক্ষরণে, আয়ুক্ষরণে, মনের গভীর থেকে অনুভব দিয়ে একটা কবিতা লেখে, তার যতটা অধিকার এবং উৎসর্গ সেখানে থাকে, তেমনই নিবিড় স্পর্শ যেন লেগে আছে ঋত-রিনির সম্পর্কে। ঋতর কাছে এটাই পরম নিশ্চিন্তির আশ্রয়।
একদিন ওরা রবীন্দ্রসরোবরে, বিকেলের দিকে বসে আছে। কথা বলছে। দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে, ম্লান চেহারায়, ময়লা জামাকাপড়ে ভিক্ষা করছে। এসে হাত পেতেছে ওদেরও কাছে। রিনি যেন গলে যায়। নিজের ওয়ালেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে দিয়ে দেয়। মেয়েটা হেসে প্রণাম করে প্রবল উৎসাহে চলে যায়। যেন তার অন্তপ্রাণ থেকে শুভকামনা জানিয়ে যায়। এই রিনিকে দেখে মোহিত হয় ঋত। বলে, "এত উদার তুই? এত টাকা কেউ দেয় এভাবে? ভিখারীকে? "রিনি ঋতর হাতে চাপ দেয়। বলে, "ওরাও তো মানুষ। আমরা কত লাকি এরকম জীবন পেয়েছি। সবই তো আছে আমার। তোমার। ঘরবাড়ি। সংসার। আত্নীয়জন। পড়াশুনো। স্কলারশিপ। এমনকি প্রেম। ভালোবাসা। তুমি আছ। আমার ঋতব্রত। আসলে, আমরা আরও উত্তরণ চাই। আমাদের চাওয়ার তো শেষ নেই! কিন্তু ওদের কী আছে?"
ঋত অবাক হয়। রিনি কত বোঝে। কত বাস্তবধর্মী। এটাই তো ঋতর বিরাট অহংকার!
ঋতর আবেগ বাড়তে থাকে। হাত রাখে রিনির কাঁধে। পাশাপাশি বসে আছে ওরা। একে অন্যের দিকে তাকায়। একের স্বপ্ন আর অনুচ্চার ছুঁয়ে যায় অন্যের আঁখিপল্লব। ঋত বলে, "আমি মুগ্ধ রিনি। এমনই ভাল থাকিস সবদিন। সারাজীবন। শুধু আমারই থাকিস।”
রিনি ধরা দেয় ঋতর ইচ্ছেমতোই। তার চেয়ে থাকা, তার দৃষ্টি যেন বলে, "আমার সৃষ্টি তো তোমারই জন্য।” মুখে বলে, "আমি তো তোমারই। তুমিও আমারই থেকো।” বলেই ওর হাতটা ঋতর কাঁধে রাখে। আলিঙ্গনের এই অপেক্ষাটুকু লিখে নেয় রবীন্দ্রসরোবরে নেমে আসা শেষ বিকেলের মিষ্টি আলো। হাওয়া। বাসার অভিমুখে ধাবমান ফিরতি পাখিদের কলরব।
এমন নিবিড় সময়ের পর ঋত আর কোনও দুশ্চিন্তাই করেনি কোনওদিন। প্রয়োজনই পড়েনি। কখনওই ভাবেনি মৃদু হাওয়া ঝড় হতে পারে। অথচ, আজ ঝড় ধেয়ে এল ওর উঠোন জুড়ে। ভেজা ভেজা ছন্নছাড়া ঝরা পাতা, নরম ডাল পড়ে থাকবে ওর অঙ্গনে আজীবন। এই জল হাওয়ার দাগই তো গাঁথা থাকবে জীবনের মর্মে মর্মে! পড়ে থাকা ছিন্ন পাতা-প্রশাখায় লেখা থাকবে অতীতের অনশ্বর অভিজ্ঞান। যা আসলে হয়ে উঠবে ওর আমৃত্যুর অক্ষয় দুঃখগাথা।
পশ্চিমে ঢলে যাওয়া সূর্যের মতো এক অনিবার্য সমাপ্তির দিকে দৌড়াচ্ছে ঋত। যেন ওর শেষ গন্তব্য ও জেনে গেছে এবং তা খুব সামনেই। হঠাৎ বৈশাখী ঝড় দিগন্তের লাল ধুলো নিয়ে উড়ে এসে তছনছ করে দেয় চারপাশ, কিছু বোঝার আগে বা গুছিয়ে নেওয়ার আগে, তেমনই রিনি বিক্ষত করছে ঋতকে। ফুলের নরম পাপড়িতে প্রজাপতি এসে যখন দোলা দেয় ফুল তা বাধ্য মেনে নেয়। ঋত আজ নরম সেই ডালেরই মতো। প্রজাপতির উড়ানে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দ বিনাশের দিকে।
#
নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে, একটা প্যাকেট বের করে রিনি।
ঋত জিজ্ঞাসা করে, "কী এগুলো, রিনি?"
"আমাদের যাপিত সময়। ভাবনা। পাগলামির প্রতিচ্ছবি।
এতদিন অব্দি লেখা চিঠি সব। আর তোমার দেওয়া উপহার। এগুলো রাখার আর দরকার নেই।”
কিছু বুঝতে পারে না ঋত। ভাবলেশহীন তাকায়। রিনি বলে, "নাও ধরো এটা। ধরো আমার হাত। যা আছে বিসর্জন দিই নদীতে।”
কথা বলতে বলতে প্যাকেটটা উচুঁ কিনারা থেকে নদীর জলে ফেলে দেয় রিনি। ঋতর হাতটাও অনিচ্ছায় এবং ওর অবাধ্যেই সঙ্গ দেয় রিনিকে।
নিজের সুবিধা, নিজের স্বপ্ন, নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে রিনি ওদের মাঝের সাঁকোটা ভেঙেই দিল আজ। একটা দমকা হাওয়া যেন ঝড় হয়ে এল। দুরন্ত ঘূর্ণির মতো উড়িয়ে দিল জীবনের সঞ্চিত সমূহ বৈভব।
আর বেশি কথা হয় না। বিদায় বলে এগিয়ে যায় রিনি। পেছনে তাকায়ও না আর। একটু এগোতেই হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনতে পায় রিনি। বেশ জোরে। জলের ওপর কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে তাকায়। দেখে ঋত নেই। দৌড়ে ফিরে আসে আগের জায়গায়।
পাগলের মতো ডাকছে রিনি। "ঋত....ঋত.....ঋত.....!"
ওর হাহাকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড়ে পাহাড়ে। কিছু করতে না পারার অক্ষমতায় মাটিতে বসে পড়ে রিনি। জঙ্গলপথ বেয়ে ঝড় হয়ে আসছে হাজার হাজার ব্যর্থ প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস। গভীর জলে সন্ধ্যা নেমে আসছে। প্রায়শ্চিত্ত করার কোনও রাস্তাই খোলা নেই আর। ওদের জীবনের সমূহ গল্প জল হাওয়ার দাগের মতোই মুছে দিল রিনি। এ তো ক্ষমাহীন অন্যায়! নিজেকে ধিক্কার জানায় রিনি।
নদীর মতোই বইছে রিনির দুচোখ। ঋতব্রত সাঁতার জানে না যে!