হলোনমি
ফেরা তো হয় না কারো, প্রারম্ভবিন্দুতে। এমনকি বৃত্তপথে ঘুরে
এলেও অগোচরে সামান্য বিচ্যুতি। হাতে হাত রেখে, সমান্তরাল আবর্তন
শেষে অনিবার্য ব্যবধান-- মাঝের শূন্যতায় আকুলতার চুম্বক-টান
হলোনমি - জ্যামিতির অমোঘ নিয়মে! বক্রতাই দায়ী এ জন্যে, সরল
সমতলে এসব ঝামেলা হতনা; অথচ বক্রতার জন্যই ব্রহ্মাণ্ডে
মহাকর্ষ, দেশকাল-তল নুয়ে আসে নিবিড় মেঘের মত
ঘন সন্নিবেশে। শূন্য হতে, এভাবেই, ভালবাসার জন্ম হয়...
চাঁদিপুর
আজ জল বড়ো অন্যরকম। রোজ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে জেগে থাকা শুরু হয়
নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েও রেহাই মেলে না বড়ো ক্লান্তিতে তেষ্টায়
ছাতি ফেটে যায় তখন দূর থেকে আবছা স্মৃতির মতো হাওয়ায় নোনা সুবাস আসে
দিগন্তে অপেক্ষার দু এক পলক বেগুনি আভায় জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়; ততক্ষণে
কোলাহল থামে, বাঁধানো চাতালে কয়েকটা ঘুমন্ত কুকুর আর বেওয়ারিশ ছাগল ছাড়া
কেউ নেই নোনা হাওয়া গড়িয়ে গড়িয়ে শেষ ঘাটের একটু আগে থমকে দাঁড়ায়। জল
আসে না অতদূর। ছায়ার হাত টেনে লম্বা করেও নাগাল পায় না। আজ সব অন্যরকম।
জল বেড়েই চলেছে ঘাট ডুবছে একে একে ফেনার উদ্বাহু সাহসী ডাক চাতাল ছাড়িয়ে
উঠে আসছে শেওলা মাখা ঝিনুকের মুখ খুলে অন্ধকারের নেশা ধরানো নিজস্ব ঘ্রাণ
বাতিস্তম্ভ থেকে নেমে আলো জল ছুঁলো, এই প্রথম, অথচ যেন জন্মের চেনা সমুদ্র-শরীর
ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে প্রত্যাগত জলের সাথে ঢেউয়ের গায়ে মাথায় ফেনার মতো
জড়াতে জড়াতে আলো নিজের সুপ্রাচীন উৎসের দিকে বয়ে চলে গেলো।
ছায়াটিকে চাতালে ফেলে রেখে পরিত্যক্ত বস্ত্রের মতো
সমান্তরাল
সমান্তরাল রেখার সংজ্ঞা দু ভাবে দেয়া যায়
এক, যারা কখনো মেলে না, আর দুই,
যারা শুধু অসীমেই পরস্পরকে পায়।
আসলে এ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা প্রকল্প
দ্বিতীয়টি বেশি প্রচলিত। পথ চলতে চলতে
দূরে দৃষ্টি স্থির, ঐখানে অদেখা অন্তিম
দুপাশে ভ্রুক্ষেপ না করে হেঁটে গেলে
অভিসারী পথ চরিতার্থতা ছোঁবে
অথচ, যত দূরেই যাওয়া হোক অসীম
অলীক উপহাসের মতো সমান অধরা
পক্ষান্তরে, অন্য সংজ্ঞাটি মেনে নিলে
স্বতঃ চোখ চলে যায় দু ধারের প্রান্তরে
গন্তব্য নয়, পথকেই আপন করে নিলে
মাটির মৃদুতম কম্পনও টের পাওয়া যায়
পথ ছেড়ে অনায়াসে হারিয়ে যাওয়া যায়
ঘাসের নিরালায়, মেঘের নির্লিপ্ত চলনে
বিষন্ন সবুজ পুকুর ঘাটে গোড়ালি ডুবিয়ে
বসে থাকা যায় সারাবেলা। মেঠো রাস্তা
ধরে আল ধরে সোঁদা হাওয়ায় উন্মনা
বেভুল হেঁটে যাওয়া যায় একটানা।
যাওয়ার ঠিকানা নেই জেনে চলার
প্রতিটি মুহূর্তকে স্পর্শ করে থাকা যায়
আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে প্রতিটি ঘাসের শিশির।
দুই নদী
দুই নদী, কাছে আসে, চেনে পরস্পর
ভিজিয়েছে কতকাল, অভিন্ন জমিন
পলি ঢেলে, হৃদয়ের, মাধুর্যে অশ্রুতে
ব্যবধান ছিল তবু, বেদনার চর,
অদেখা আকাশ, অচেনা সময়ের স্তর;
মাটি তো জেনেছে তার দুই তটে
ওঠা-পড়া, ঢেউ ভাঙ্গা, তবু অকপটে
সরায় নি স্বরচিত নির্বেদ-প্রস্তর;
কখনো ওপারের সজল প্রশ্বাস
দেয়াল পেরতো, এপারের ঢেউয়ের গুঞ্জন
ওপারের বনে বনে মৃদু শিহরন
তুলেছে কখনো, মেঘলা আকাশ
হয়ত এনেছে বয়ে চেনা সুবাতাস
মাটির গহন স্তরে দু ধারার জল
গোপন গানের মত মিশেছে, পলল
সঞ্চয় নিয়ে বেড়ে-ওঠা ঘাস
ধারণ করেছে দুই স্রোতের শীকর;
সময়-উজান বেয়ে দুই নদী আসে
কাছাকাছি, হৃদয়ের নিবিড় শিহর
ভাগ করে, দুই সখী, ছোঁয় পরস্পর।
পড়ন্ত বেলার ছায়া
পড়ন্ত বেলায় ছায়া দীর্ঘতর হয়
পথের দুপাশ থেকে ছায়াময় বাহু
বাড়িয়ে আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে নেয়
দুই তরু; পাহাড়িয়া ঢাল বেয়ে নামে
তরল আঁধার, নিবিড় নিশ্চিন্ত লয়ে;
আলোর কৌতূহলী চোখ, মধ্যাহ্ন-সূর্যের ভ্রূকুটি
ব্রীড়া শঙ্কা নাকি শুধুই দ্বিধায়
সংকুচিত ছিল ছায়া সারা দিনমান
বেলা পড়ে এলে জমিন আসমান
শিশির-সজল, নীড়মুখী পাখিদের গান
সূর্য নিভে এলে আর কোনো অভিমান
টানে না লক্ষণ-রেখা, মায়াবী আঁধার
চেনায় পাহাড় জুড়ে এই সারাত্সার
জীবনের: প্রেম, শান্তি, আসঙ্গ-কামনায়
গাঢ়তর হয় ছায়া, দুহাত বাড়ায়
অনায়াসে, শঙ্কাহীন, প্রত্যয়ী বিস্তারে
অপরূপ আলো জাগে দিগন্তের পারে
সূর্য-ডোবা পাহাড়ের মন্দ্র অন্ধকারে
হিসেবী বৃত্তপথে উদ্ভ্রান্ত গ্রহের মতন
ঘুরে ঘুরে ক্লান্তশ্বাস, দিন সমাপন
হয়ে এলে, মেঘের মৃদুল আয়নায়
মরমী আলোয় জীবনের মুখ দেখা যায়
চোখ-ঝলসানো দিন হয়ে এলে ক্ষয়
তরুমূলে ঘন ছায়া, অঢেল আশ্রয়
পড়ে এলে বেলা, ছায়া দীর্ঘতর হয়...
বোস্টন ২০১৫
হিম-সন্ধ্যা ঠেলে ঠিক রাস্তায় ঢোকা
পরিচিত ওম, চেনা দরজায় টোকা
ডোর-বেলে চেনা কণ্ঠের সাড়া
ক্লান্তিতে ভেজা বর্ষাতি ছাড়া
তোমার কাছে তো, এরকমই, ফেরা
চানে ঢুকেছিস, ঘুমিয়ে মেয়েরা
এখানে এখনো রাত সুনিবিড়
মোবাইল তোর সময়ে স্থবির
সন্ধ্যার পরে ঘোর অবকাশ
সংযোগহীন এই পরবাস
একাগ্র হয়ে, জাগে শুধু মন
গোলার্ধ পার, গভীর গগন
একই দেহ দুই কালসত্তায়
এক কোজাগর প্রহর কাটায়
আর এক তোর হাত ছুঁয়ে থাকে
প্রত্যহিকীর, প্রতি বাঁকে বাঁকে
প্রবাস সতত, তোর কাছে ফেরা
তোর স্বহস্তে, সুগন্ধে ঘেরা
গোছানো লাগেজ, ভোর অবশেষে
উড়াল এবার, তোর বুকের স্বদেশে।
তোমাকে
কি দেব তোমাকে মেয়ে, কি দিয়ে সাজাই
ভাঙা পাড়, উর্দ্ধশ্বাস নাব্যতার ঢালে
স্মৃতির কাগজী ভেলা, ঘাট ছুঁয়ে যাই
ঘোর-লাগা গোধূলিতে, কৈশোর-কালে
প্রথম অঙ্কুর, প্রথম পালক ইচ্ছে-ডানায়,
কোমল ঋষভ প্রগল্ভ দিনের আড়ালে
মুখে দেখে সংগোপনে ঊষার আয়নায়
উদ্ব্যস্ত রিক্ত বেলায় আজ হাত বাড়ালে
এলোকেশী ঝর্ণা জাগে বুকের ভিতর
সমুদ্র-সোহাগ, ঢেউ ফেনিল দামাল
ডোভার লেনের সেই নিশি উজাগর
বাঁশিতে মধুর দেশ, কাফির গুলাল।
শার্ল দ্য গ্যল ২০১৫
এখানে কি আজো ঝরা ফুল?
সীতার গহনার মতো ইতস্তত আহত
অভিমান পথ জুড়ে, অশ্রুর মুক্তোদানা?
অথচ, সেদিন তো জানত না
নীড়ের ঠিকানা ডানার তলায় গুঁজে
দিয়েছিলো যে উড়াল আকাশে অজানা
ঈশান কোণে অশনির আভাস খুঁজে
না পেলেও তো ভেঙেছে খড়কুটো-বাসা
নিমেষে কালিক মাত্রায় উষ্ণগহ্বরে
তলিয়ে যাওয়া, ভেসে ওঠা জন্মান্তরে;
. .......
মনে হয়, এতো অবহেলা ছিল জমে?
পাথরে পাথরে ঘষা খেয়ে যদি জ্বলতো
আগুন, চেরা-জিভ অন্ধকার মাটি ফুঁড়ে
উঠতো বাসুকির মতো দুলিয়ে মেদিনী
তবু মনে হোত, সার্থকতা ছিল কিছু
স্বল্পায়ু স্বপ্ন-যাপনে, এতো অনায়াসে
নিবিড় বলয় ছিঁড়ে, বধির আকাশে?
অন্য কক্ষপথে, অনিকেত পরাবৃত্তে?
..... .......
যুগান্ত পেরিয়ে স্মৃতির জানলা জুড়ে
তবুও মায়াবী রোদ, বেদনার পলিতে
অশ্রুর শিশির-স্নেহে ফুটেছে ঘাসফুল
অলৌকিক বৃষ্টি এসে মাটির বলিরেখা
মুছে দিচ্ছে, যাবতীয় ফাটল ভরে উঠেছে
বিন্দু বিন্দু অমৃতরসে, অপসারী পথেরা
অসীম স্পর্শকতলে বক্রতা বদলে
ছুঁয়ে যাচ্ছে পরস্পরকে; সময়ও পিছু ফেরে
অদৃশ্য চরণরেখা ধরে কুড়িয়ে নেয়
পুঁতির মতো যাপিত মুহূর্ত, মেঘের
স্তব্ধতা ভেঙে সুর জাগে মন্ত্রের স্বরে:
আজন্ম-লালিত সাধ ধরণীর প্রাণে
সোঁদা মাটি ঘাস থেকে উঠে আসা ঘ্রাণে
গোধূলি-আকাশ জুড়ে নীড়গামী গানে
সব, সব ভালোবাসা যেটুকু যেখানে
কুঁড়ি হয়ে জেগেছিলো, কিংবা পূর্ণদল
স্থিরচিত্রে ধরা থাক সেই মধুপল
পিছুটান নয়, শুধু হাতে হাত ধরে
জ্যোৎস্না-সুখের রাতে, বিষাদ প্রহরে
মাঝে মাঝে দু একটি স্মরণীয় ক্ষণে
এসেছিলো আলো, তাকে বিচ্ছেদে বিজনে
হারাতে দিও না, রেখো বাহিরে অন্তরে
নিকটে ও দূরে, প্রেম জাগুক শিয়রে।