এই দেবযানীর পর ১৯৬৬ সালের ২৯শে মার্চ জন্ম নিল আমার একমাত্র পুত্র দেবজ্যোতি। এতদিনে নিজের বড় ছেলের পুত্রসন্তান হওয়াতে খুশি ঠাকুমার কাছে মঙ্গলার আদর আরও বেড়ে গেল। ভাই এনেছে মঙ্গলা, তাই গয়লা বাড়ি থেকে আধ সের দুধ এনে তুলসীতলায় দাঁড় করিয়ে মঙ্গলাকে তিনি দুধ দিয়ে স্নান করালেন। কোন মানে হয়? কিন্তু মনের আনন্দ কি যুক্তির ধার ধারে সব সময়? পুরুষানুক্রমিক সংসার বংশে বাতি দিতে চাই পুত্রসন্তান, সেই লালিত সংস্কারের ফলেই মঙ্গলার হল দুগ্ধস্নান। বিজ্ঞান মানুষের চেতনায় অনেক পরিবর্তন এনেছে, মানুষ আজ অনেক বেশি আলোকপ্রাপ্ত। তবুও এই বৃদ্ধার একান্ত ইচ্ছা, পুরাতনী ধ্যানধারণাকে তাচ্ছিল্য করে আঘাত দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করিনি। তাই সেদিন চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলাম।
আমার পুত্রের জন্মের সময় আমার বড় কন্যা দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সংসারে অভাব অনটন তুঙ্গে। পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ হয়েছে, চালের দাম পাঁচ টাকা কেজি, হাতে পয়সা আছে তারাও চাল পাচ্ছে না। কিন্তু আধপেটা খাওয়া আমার মেয়েদের বাৎসরিক পরীক্ষার ফল, আর সংশাপত্র দেখে সেই অভাবের অনুভূতি ম্লান হয়ে যেত। এগিয়ে চল, এগিয়ে চল এই মনোভাব নিয়ে এদের প্রেরণা দিতে মনোনিবেশ করতাম।
এইভাবে চলতে চলতে এসে গেল আশ্বিন মাস। আমার ছেলের বয়স মাত্র ছয়মাস। দুর্গাপঞ্চমীর দিন ঘটে গেল এক আকস্মিক দুর্ঘটনা। মেয়েদের জন্য তো চুড়ি, ফিতে এসব তো চাই। জামা সে হোক না অল্পমূল্যের। যদিও আমার মেয়েদের অধিক মূল্যের জিনিসের জন্য বায়না ছিল না। তবু মায়ের তো শখ হয়। সেদিন দুপুরের খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে, ছেলেকে, আর ছোট মেয়ে তিনজনকে ঘুম পাড়িয়ে বড় মেয়ের জিম্মায় রেখে গেলাম নৈহাটি শহরের অরবিন্দ রোডে, মেয়েদের সাজের জিনিস টুকিটাকি কিনতে। সঙ্গে ছিলেন পাশের বাড়ির দুই মহিলা।
রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেছে, ফেরি বন্ধ হয়ে গেছে। শেষে একজন মাছধরার মাঝিকে আবেদন করে বেশি পয়সায় রাজি করিয়ে আমরা — আমি, আমার স্বামী আর আমার ছোড়দা চললাম চন্দননগর। ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে নানা অসুবিধায় নাস্তানাবুদ হয়ে পুজোর চার-পাঁচদিন কাটালো আমার বড়মেয়ে। সেবার আবার সপ্তমী পড়েছিল দু-দিন। মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম একাদশীর দিন। ফিরে দেখি মেয়েদের নাস্তানাবুদ অবস্থা। পুজোর কদিন আনন্দ তো দূরে থাক, ঠিকমত খাওয়াও জোটেনি তাদের। বড় মেয়ে তখন ক্লাস টেনে পড়ে, সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। কোনমতে ডালভাত রেঁধে বোনেদের খাইয়েছে, ভাইকে স্নান করানো, দুধ খাওয়ানো সবই ছিল তার দায়িত্ব। হাসপাতালে তিনদিন আমার অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক থাকায় কর্তা প্রায় সারাদিনই থাকতেন হাসপাতালে।
বাড়ি ফিরে এলাম প্রায় বেলা তিনটে নাগাদ। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম ঘরের মধ্যে চৌকিতে ঘুমিয়ে ছয়মাসের অবোধ শিশু। ‘বাবু বাবু’ করে কয়েকবার ডাকার পর পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে বিস্ফারিত চোখ মেলে খানিক দেখল, চেনা-অচেনার ধন্ধে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কদিনের ধকলে আমার শরীর তখন প্রচণ্ড দুর্বল। মাথা ঘুরছে, হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। কোনমতে স্নান করে ঘরে ঢুকলাম, ধোয়া কাপড় পরে বিছানায় শুলাম। কিন্তু ছেলেকে প্রায় পনেরো দিন দুধ দেওয়া যাবে না। তাই কাছে গেলেই যদি দুধ খেতে চায় তাই সে-কদিন দিনরাত তার ঠাঁই হল বড়দির কাছে। শুয়ে শুয়ে ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, ‘হে পার্থসারথি তুমি আমাকে মরণের কোল থেকে ফিরিয়ে এনেছ, না হলে আমার ছেলেমেয়েদের কোন অস্ত্বিত্বই থাকত না। এদের দিকে তাকিয়ে যে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছুটে চলছিলাম, তার ইতি ঘটত এখানেই। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সন্তানদেরও ভবিষ্যত তলিয়ে যেত কোন অন্ধকারে।’ পুজোর আনন্দ তো ছেলেমেয়েদের কান্নায় কেটেছে, সামনেই লক্ষ্মীপূজা, তার আয়োজন শুরু করলাম।
এখানে আবার একটু পুরনো দিনের কথায় ফিরে যাই। দেখে নিই আমার আরাধ্য দেব পার্থসারথির ছবিখানা কিভাবে আমার কাছে এসেছিল।
বহুদিন আগে, আমি তখন নতুন বউ। দেশের বাড়িতে খুব ভোরে উঠে, উঠোন ঝাঁটপাট দিয়ে, গোবর ছড়া দিয়ে, রান্নাঘরের উনুনের ছাই পরিষ্কার করে যেতাম পুকুরে। বাসন ধুয়ে, স্নান সেরে বাড়ি ফিরে আসতাম। এবার ধোয়া শাড়ি পরে বড় একখানা কলসি নিয়ে পুকুরে জল আনতে যেতাম। পাড়ার লোকজন ওঠার আগেই আমি এইসব কাজ সেরে ফেলতাম। সারাদিন প্রায় ঘরকন্নাতেই কাটত। যে পুকুর থেকে খাবার জল আনতাম সেই পুকুরের ধারে ছিল বাঁশবন, বাঁশের ডগা ঝুঁকে থাকত জলের উপরে। পথের দুপাশে ছিল নানা গাছের ঝোপঝাড়। ঝোপে ঢাকা সেই রাস্তার শেষে ঝোপের আড়ালেই ছিল একটুখানি ঘাটলা, খেজুর গাছের গুঁড়ি পেতে বানানো। এই ঘাটলা দিয়েই জল নিতে নামতাম পুকুরে। সেই নির্জন কাকভোরে পুবদিকে তাকিয়ে দেখতে পেতাম কালচে সবুজ সীমান্তের উপর দিয়ে রক্তিম আভায় রঞ্জিত আকাশের ভালে লাল টকটকে শিশু সূর্যের আবির্ভাব। সে দৃশ্য দেখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করলেও উপায় ছিল না। কারণ আমি তখন মধ্যম বাড়ির মধ্যম কর্তার পুত্রবধূ, বিরাট এক কলসী কাঁখে নিয়ে পুকুর থেকে জল তুলে আনছি পাড়ার পাঁচজনে সে দৃশ্য দেখলে মধ্যম কর্তার সম্মানহানি ঘটবে না?! তাই সেই অনুপম দৃশ্য একটুখানি দেখেই ফিরতে হত।
কথায় বলে না, গাঙ মরলেও রেখ মরে না — অর্থাৎ নদী মরে গেলেও থেকে যায় তার চলপথের রেখাটুকু। তেমনই আর কি। পরিবার তখন আর একান্নবর্তী নয়। শ্বশুরমশাইদের তিন ভাইয়ের তিনটি আলাদা বাড়ি। আগেই বলেছি কি কারণে, বড় দাদার হাতে মহালের আমদানি সব অর্থ বিনা দ্বিধায় তুলে দিয়ে তিনি যে ভুল করেছিলেন তার ফলে তিনি আজ প্রায় নিঃস্ব, তাঁর পরিবারের অবস্থা পড়তির দিকে। তখন তাঁকে খানিক কৃপার পাত্র মনে করত অন্যেরা। শরিকে শরিকে নানা বিরোধ, পরশ্রীকাতরতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবহমান কাল ধরে সব দেশেই ছিল, আছে, থাকবেও। তাই তাঁর বৌমা কলসী টেনে জল আনছে, কাজের লোক রাখার সামর্থ নেই, এ-দৃশ্য শরিকদের নজরে পড়লে তাদের হয়ত মনে খানিক আনন্দ হতে পারে, কিন্তু আমার স্বামী-শ্বশুরের অসম্মান হবে। তা তো হতে দিতে পারি না। তাই প্রতিবেশীদের জাগরণের আগেই বাইরের কাজটুকু সেরে ফেলতাম আমি।
এমনি এক দিনে জামাইষষ্ঠীতে আমার বাপের বাড়ি যাওয়া হল না। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদলাম। কিন্তু রাতে শুতে যাবার আগেই মনে পড়ত যে সকালে কাকভোরে উঠতে হবে। একদিন মনে এই চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়েছি, স্বপ্নে দেখলাম কলসীকাঁখে দাঁড়িয়ে আছি পুকুরপাড়ে, লাল শিশুসুর্য দেখা দিচ্ছেন। বাড়ির দিকে ফিরতে গিয়ে আর এক নজর পিছন ফিরে সে দৃশ্য দেখতে গিয়েছি, দেখি কোথায় লাল গোলক, তার বদলে উদিত হয়েছেন এক অপূর্বসুন্দর দেবমূর্তি। ভাবছি ইনিই কি তাহলে সূর্যদেব। তবে রথ কই? ‘রথ কই, রথ কই’ চীৎকার করতে করতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখি তখনও আলোর আভা ফোটেনি, বাইরে ঘন অন্ধকার। পরদিন সকালে যথারীতি গেলাম পুকুরে, সারাদিন চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রইল সেই স্বপ্নের দৃশ্য।
তখন বয়স অল্প, চঞ্চল মন। কিছুদিনেই সেই স্বপ্নের দৃশ্য আবছা হয়ে এল, কিন্তু অবচেতনে সেই দেবমূর্তির অবয়বখানি জাগরিতই ছিল। এরপরেই দেশ ছাড়তে হল। এলাম পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটিতে। সে সময় একদিন আমাদের এক পরিচিতের বাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে, তাদের ছিল সোনার কারবার। তাদের ঘরে দেখলাম কিছু পাকানো ক্যালেন্ডার ঘরের দেয়ালের পাশে জমা করে রাখা আছে। ছবি দেখতে ভীষণ ভালোবাসি চিরকাল। আমি মহিলার অনুমতি নিয়ে ক্যালেন্ডারগুলি খুলে ছবি দেখতে লাগলাম। হঠাৎ একটি ক্যালেন্ডার খুলেই দেখি আমার দেখা সেই অপূর্বসুন্দর দেবমূর্তির ছবি, নীচে লেখা পার্থসারথি। আমি নির্বাক হয়ে ভাবছি পুব আকাশে উদিত সেই দেবমূর্তির কথা। তাঁদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এলাম সেই ক্যালেন্ডারখানি। ঘরে একখানি বাঁধানো জীর্ণ ছবি ছিল, সেটি খুলে ফেলে তাতে বাঁধিয়ে নিলাম এই পার্থসারথির ছবি। কালে ঠাকুরের আসন পাতলাম, আসনে বসালাম সেই ছবিখানি, তিনিই হলেন আমার আরাধ্য দেব, সুখে দুঃখে আবেদন নিবেদন জানাবার দেবতা। ধর্মের উন্মাদনা আমার কোনদিনই বিশেষ ছিল না। তবে ইনি হলেন সুখদুঃখের আশ্রয়। অপরূপ সেই ছবিখানির দিকে তাকিয়ে থেকে মন ভরে যায়, মন খারাপ উধাও হয়ে যায়। কাজে শক্তি আর উদ্যম পাই।
যাই হোক পরের বছর, ১৯৬৭ সালে আমার বড়কন্যার স্কুল ফাইনালের ফল বের হল, অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে পাশ করল। লোকের মুখেমুখে তার রেজাল্টের কথা ফিরতে লাগল। আমার সংসারে অনটন তখন চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। তবু, অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা আমার পরিবারের সবাই এই সাফল্যের আনন্দে বুঁদ হয়ে চলতে লাগল। চূড়ান্ত অভাবের মধ্যে, বিনা প্রাইভেট টিচারে, নানা অসুবিধায় পড়াশুনা চালিয়ে আমার কন্যা যে সাফল্য অর্জন করল তাতে আমার নিজের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল, নিজের হৃত সত্তাকে অনুভব করলাম।
সে সময় স্কুল ফাইনাল দিলে কলেজে এক বছর প্রি-ইউনিভার্সিটি ক্লাসে পড়ার পর বিএ ক্লাসে ভর্তি হওয়া যেত। নৈহাটি ঋষি বঙ্কিম চন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে ওই পরীক্ষা পাশ করে সে বিএ ক্লাসে ভর্তি হল অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে। স্কুল ফাইনালে প্রথম বিভাগে ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করাতে সে বছরে ৫০০ টাকা করে সরকারি বৃত্তি পেতে শুরু করল। এক ঝটকায় আমার সংসারের মোড় ঘুরে গেল। আমার দ্বিতীয়া কন্যা গৌরী দিদির পদাঙ্ক অনুসরণ করে জোর কদমে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। সে সময় আমার সংসারের অনটনের জন্য দুজনেই যে যার যোগ্যতামত প্রাইমারী থেকে কলেজ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী পড়ানো শুরু করল।
আমি এখন নীরব দর্শক। আমার বিদ্যাবুদ্ধিতে এদের পড়াশুনার বিষয়ে আমার কিছু বলার ছিল না। পরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে, সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে অলিখিতভাবেই ভারপ্রাপ্ত হয়ে গেল আমার বড়কন্যা। ১৯৭১ সালে আমার দ্বিতীয়া কন্যা গৌরী স্কুলফাইনাল পাশ করল গৌরবের সঙ্গে, ভর্তি হল বিজ্ঞান নিয়ে প্রি-ইউনিভার্সিটি ক্লাসে। ১৯৭২ সাল, ফেব্রুয়ারী মাস, আমার তৃতীয়া কন্যা মৈত্রেয়ী তখন অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছে, চতুর্থ দেবযানী পঞ্চম শ্রেণীতে আর একমাত্র পুত্র তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। বড়কন্যার কলেজ শেষ হয়েছে, ভর্তি হয়েছে এম এ ক্লাসে, ক্লাস হয় বরানগরের সিঁথির মোড়ের ক্যাম্পাসে। সংসারে নেমে এল প্রবল দুর্যোগ। কর্তা ভীষণ অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলেন। সেই রোগশয্যাই হল তাঁর শেষ শয্যা।
কর্তার অসুখের সময় একদিন পিতাপুত্রীর আলোচনা শুনছিলাম, কর্তা বলছেন ‘বাবু, কলেজ থেকে বেরিয়েছিস, এবার তো তুই একটা চাকরি পাবি নিশ্চয়। আমার মাইনেটাও (১৯৭২-এর এপ্রিল থেকে) এবার বেড়ে তিনশো টাকা হবে। সংসারে আর তখন অভাব থাকবে না, বল।’ ঈশ্বর আড়াল থেকে হেসেছিলেন বোধ হয়। তাঁর সে ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। জায়গার কথা জায়গাতেই রইল, তিনি চলে গেলেন ফেব্রুয়ারির শুরুতেই। প্রায় চারপাঁচ মাস ধরেই অসুস্থ ছিলেন, মাঝে মাঝে চিকিৎসায় একটু ভাল ফল দিচ্ছিল, আবার কাজে যোগ দিলেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। বছরের শুরুতে জানুয়ারির ১০-১২ তারিখ নাগাদ একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন, স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় তাঁর অবস্থা অধিক সঙ্কটজনক হয়ে পড়ল। হাসপাতালে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করল আমার বড় কন্যা। মেডিক্যাল কলেজে চেষ্টা করেও ভর্তি করা গেল না। আমাদের দেশের এক আত্মীয়ের চেষ্টায় ভর্তি করা হল কল্যাণী জওহরলাল হাসপাতালে। সেখানে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে ১৭ দিনের মাথায় ১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি তিনি সংসার থেকে চিরবিদায় নিলেন। এই ক’দিন বড়কন্যার নিজের এম এ ক্লাস, টিউশনি সব মাথায়, সারাদিনই প্রায় হাসপাতাল আর বাড়ি, বড় বলতে, আর তো কেউ নেই যে হাসপাতালে যাবে। বাড়িতে বড় বলতে আমি আর ছোট ছেলেমেয়েগুলো।
কর্তার হাসপাতালে থাকার ক’দিন সকাল থেকে ছোটাছুটি, কোনরকমে সকালের দুটো টিউশনি সেরে ট্রেন ধরে একবার যায় বাবাকে খাওয়াতে। বাবার বিদায়ের আশঙ্কায় বুঝতে পেরে গেল নিজের ভবিষ্যৎ। কি তার কর্তব্য। সংসারের আধা দায়িত্ব তো এতদিন ছিলই এবার পুরোটাই আসতে চলেছে বুঝতে পেরেছিল আমার বড়কন্যা। ছেলেবেলা থেকে যে আগ্রহ নিয়ে পড়াশুনা করেছে, বড় হবে, অনেক বড়, এক আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল সব মিলিয়ে গেল। সেই আশায় জল ঢেলে দিল বিধাতা। সব বুঝে সে হয়ে গেল নিজের প্রতি উদাসীন। নিরুৎসাহ মন নিয়ে সে নিজেকে নিয়োজিত করল সংসারের কাজে।
৮ই ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, প্রতিদিনের মত সকালের টিউশনি একটা করে বাড়ি চলে এল। বলল ‘ভালো লাগছে না, আজ একটু আগেই যাব হাসপাতালে।’ প্রতিদিনের মত সেদিনও হাসপাতালে গেল, ১০ টার আগেই পৌঁছে গেল। বেডের কাছে গিয়ে দেখে তার বাবা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে উপর দিকে, দৃষ্টি ঘোলা, চোখের তারা স্থির। বাবা বাবা করে ডেকে গায়ে হাত দিতেই একটু যেন নড়ে উঠল দেহটা, বুকের উপর থেকে হাতটা পাশে পড়ে গেল। সাড়া না পেয়ে ছুটলো নার্সেদের ঘরে। ডেকে আনল তাদের, তারা ডেকে আনল ডাক্তারকে। তিনি দেখে চলে গেলেন স্টাফরুমে। পিছন পিছন গিয়ে জিজ্ঞেস করায় তারা বললো বাড়ির বড়দের ডাকতে। মেয়ে বলল ‘বড় তো কেউ নেই, আমিই বড়। যা বলার আমাকে বলুন।’ উত্তরে জানলো যা হবার তাই হয়েছে, উনি আর নেই। তাড়াতাড়ি ডেডবডি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। সে কাকুতিমিনতি করে খানিকটা সময় চেয়ে নিল, কারণ যারা যারা আসবে মৃতদেহ নিতে তারা সব দূর থেকে আসবে।
মোবাইল ফোন তো বহুদূর, তখন এত ঘরে ঘরে ফোন ছিল না। এত বড় হাসপাতালে চেনা কাউকে পাচ্ছে না। উর্ধশ্বাসে ছুটলো চেনা কারও খোঁজে। আমাদের গ্রামের একটি মেয়ে সেই হাসপাতালে কাজ করে জানা ছিল, ভাগ্যক্রমে তার সাথে দেখা হয়ে গেল। তাকে ধরে সে বলল বাবার মৃত্যুর কথা, তার সাহায্যেই ফোন করল, নৈহাটি মিউনিসিপ্যালিটিতে, আর মামার কাছে শ্যামনগর অফিসে, আর ছোট কাকার কাছে ভবানীভবনে। হাসপাতালে নার্সদের বারংবার অনুরোধ করল, যাতে দেহটি মর্গে না দেয়। খবর পাওয়া লোকজনদের সেখানে পৌছুতে অন্তত দু-ঘন্টা লাগবে। সেই থেকে একবার গেটে এসে আর একবার যায় বাবার ঘের দেওয়া মৃতদেহের কাছে। দীর্ঘক্ষণ একটি মৃতদেহ অন্য রোগীদের মধ্যে রাখা তো ঠিকও নয়। তাই যদি কেউ নেই দেখে নার্সেরা লাসঘরে পাঠিয়ে দেয় তাই ঘুরে ফিরেই লাসের কাছে উপস্থিত থাকছে ২১ বছরের একটি মেয়ে। সে সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সেনাদের ছাউনি পড়েছিল কল্যাণী স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে ফাঁকা জায়গা থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত, বাড়িঘর ছিলই না আজকের মত। সারা পথের দুধারে ছিল বড়বড় আম গাছ ও অন্যান্য বড় বড় গাছ। এই পথেই আসা-যাওয়া করত আমার কন্যা। সে সেদিন ক্রমাগত আসা-যাওয়া করছিল গেট থেকে মৃত বাবার দেহের কাছে।
দুপুর দুটো বাজে, তখন দেখা গেল পৌরসভার লোকজন আসছে, আর আসছে আমার দাদা-ছোড়দা। অফিসিয়াল কাজকর্মের পর দেহ নিয়ে আসা ও দাহ ইত্যাদিতে রাত হল। জীবনের একটা অধ্যায়ের শেষ আর এক নতুন অজ্ঞাত অধ্যায়ের শুরু হল আমাদের জীবনে। ছেলে তখন মাত্র ছয় বছরে পা দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে পাক খেতে লাগলাম, আগামী অনিশ্চিত দিনের কথা ভাবার ক্ষমতাও হারিয়ে গেল আমার। হাল ধরল বড়কন্যা। পৌরকর্মী আর কর্তৃপক্ষের সহানুভূতিতেই পিতার স্থলে পুত্রীর কাজ জুটে গেল ছয় দিনের মাথায়। এমএ পড়া বন্ধ হয়ে গেল। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পেল না, সে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবেই কাজে যোগ দিতে বাধ্য হল।
বিরাট পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিজের উচ্চাশা, উন্নতির পরিকল্পনা সব জলাঞ্জলি দিয়া ছোট ভাইবোনদের আর মাকে কিভাবে ভাল রাখা যায় সেদিকেই নিজেকে নিয়োজিত করল। আকস্মিক এই ঘটনায় সকল উদ্যম হারিয়ে ফেলল, তার জীবনের গতিমুখ পালটে গেল, নিজের অপূর্ণ আশার পূর্ণতা দেখতে চাইল ভাইবোনদের মধ্যে দিয়ে। পিতৃস্নেহে তাদের সকল প্রকারের উন্নতির দিকে মন দিল। আমার সংসারে আমার একমাত্র আশা-ভরসার স্থল, অবলম্বন হয়ে উঠল আমার বড় কন্যা আশাপূর্ণা। ছাত্রজীবনের প্রতিভা আর স্ফূরণের সুযোগ পেল না। দ্বিতীয়া কন্যা গৌরী সে সময় প্রি-ইউনিভারসিটির ছাত্রী।
ক্রমে গৌরীর জীববিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে কলেজের পড়া যখন প্রায় সমাপ্তির পথে, সে সময় তৃতীয়া কন্যা মৈত্রেয়ী, বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল কলেজে, দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করল।
পিতার অপূর্ণ কাজ একে একে সম্পূর্ণ করে চলল তাদের বড়দি। বছর দু-একের মধ্যেই পুরাতন, জরাজীর্ণ ঘরদোর ভেঙ্গে পাকাবাড়ি তৈরি করল। মাথায় প্রচুর দেনা। ক্রমে সে ২৪ বছর পার করতে চলল। মনে চিন্তা সর্বক্ষণ, যে ঘানিতে জুড়ে দিয়েছে ভাগ্য তাকে সারাজীবন সেই ঘানিতে জুড়ে রাখা তো ঠিক হবে না। তাকে পাত্রস্থ করার চিন্তাও মাথায়, আবার তার অভাবে সংসারের অনিশ্চয়তার ভাবনাও আমাকে একেবারে অশান্ত করে তুলল। এই অবস্থায় নৈহাটিতে বসবাসকারী কর্তার এক সহকর্মী, আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধুকে আমার চিন্তার কথা জানাই। ভগবান সহায়, তিনিই একদিন এক সম্বন্ধ নিয়ে এলেন।
পাত্র দীর্ঘকাল নৈহাটিতেই বসবাসকারী, মহাপণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়দের পরিবারের এক অধস্থন বংশধর শ্রীযুক্ত ললিত মোহন ভট্টাচার্যের মধ্যম পুত্র, নাম বৈদ্যনাথ। পাত্রের পিতামাতা এলেন দেখতে, আমার কন্যার রূপে, গুণে মুগ্ধ হয়ে বিনা দাবিদাওয়ায় তাঁকে পুত্রবধূ করতে রাজি হয়ে কথা দিয়ে গেলেন। পাত্র, সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ চেহারার যুবক। এই অবস্থায় আমি নিজে নানা সংশয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে গেলাম আমার ছোড়দার কাছে। ছোড়দার সম্মতি পেয়ে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হলাম।
১৯৭৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বিবাহের দিন ধার্য হল। নির্ধারিত দিনে যথাসাধ্য, নামমাত্র দানসামগ্রী দিয়ে আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত, একমাত্র অবলম্বন, ভরসার স্থল বড় কন্যাকে সম্প্রদান করে দিলাম। পরদিন প্রাতে মহানুভব ললিতমোহন বাবু সাদরে আমার কন্যাকে ও জামাতাকে নিয়ে রওনা হলেন নিজের বাড়িতে। সাদরে বরণ করে বাড়ির সকলে ঘরে তুলল বরকনেকে। আমার ঘর শূন্য হয়ে গেল। মনিহারা ফণীর মত আমি পড়ে রইলাম এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তাকে মাথায় নিয়ে শূন্যতাময় সংসারে। আমার পুত্রকন্যাগণের অপ্রতিরোধ্য চোখের জলে আর কন্যাবিদায়ের শূন্যতায় আমি প্রায় বাক্যহারা হয়ে গেলাম। মুহূর্তে মনে হল আমার শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরাসহ হৃদপিণ্ডটি যেন সমস্ত রক্ত নিংড়ে, চুপসে অসাড় হয়ে গেছে। আমার নতুন গড়ে উঠতে থাকা সংসার পুনরায় কী অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছে! কিন্তু ঈশ্বর সহায়। ললিতমোহন বাবু আমার সংসার প্রতিপালনের বিষয়ে, আমার কন্যার দায়িত্বের ব্যাপারে যে কথা দিয়েছিলেন তা তিনি রাখলেন। আমার কন্যা নিয়মিত বিবাহপূর্ব অবস্থার মতই আমার সংসারের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে চলল। আমি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, আমার সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবই কন্যা মাসের ঠিক সময়েই যোগান দিতে লাগল।
ক্রমে এক বৎসর অতিক্রান্তের পথে, ১৯৭৭ সালের ১২ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করল আমার বংশের প্রথম দৌহিত্র — আমার চাঁদু — আশাপূর্ণার প্রথম সন্তান। আমার বংশে নতুন শিশুর আবির্ভাবে আমার সংসারে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। ক্রমে শিশুর বোধোদয় হতে শুরু হল। আমার ছেলেমেয়েদের মনে হল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল, শিশুকে কেন্দ্র করে এদের আনন্দে দিন কাটতে লাগল।
১৯৭৬ সালেই আমার দ্বিতীয়া কন্যা গৌরী জীববিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে পাশ করে ডাক্তারি পড়ার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। আর অন্যদিকে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে লাগল। ১৯৭৮ সালের জুন মাস — সেদিন আমার কন্যা ও নাতি আমার বাড়িতে, হঠাৎ দেখি জামাতা বৈদ্যনাথ এসে হাজির। একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে নিশ্চিত চাকরির সন্ধান নিয়ে সে হাজির। আজই গৌরীকে নিয়ে যেতে হবে সেই স্কুলে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে, ইন্টারভিউ নেবেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে বড় কন্যা গৌরীকে নিয়ে রওনা দিল বারাকপুর গার্লস হাইস্কুলের উদ্দেশ্যে।
গৌরীর শিক্ষিকাজীবন শুরু হতে না হতেই আমি আবার যমের সঙ্গে পুনরায় লড়াই শুরু করে দিলাম। দীর্ঘ দশ বছরের লালিত মেয়েলি রোগ মারাত্মক হয়ে উঠল। বড়কন্যা আশাপূর্ণা দিশেহারা হয়ে কোথায় ভালো স্ত্রীরোগের ডাক্তার আছেন খুঁজতে বেরোল জামাইয়ের সাথে। অবশেষে ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া গেল কল্যাণী হাসপাতালের ডাক্তারদের কোয়ার্টারে। বড় কন্যাই নিয়ে গেল ডাক্তার মীনা গুহের নিজের চেম্বারে। পরীক্ষা করে দেখে তিনি বললেন অপারেশন অবশ্যই করতে হবে, এবং শীঘ্রই করাতে হবে। তবে তার আগে কিছু টেষ্ট করাতে হবে। একমাস পরে অপারেশন করবেন কল্যা্ণী নেহেরু হাসপাতালে। হাসপাতালে কথা বলে জানা গেল দু একদিনের মধ্যেই স্ত্রী-বিভাগে একটি বেড খালি হবে, একমাস পরে সীট খালি থাকবে কি না সে নিশ্চয়তা নেই। তাই ডাক্তারের নির্দেশ অনুসারের ভর্তি হতে হল হাসপাতালে, অনেক দিনের জন্য। ভর্তি থাকার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব হাসপাতালেই হবে। নিরুপায় হয়ে বড়কন্যা প্রায় একমাস আগেই ভর্তি করে দিল হাসপাতালে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সে নিজে এসে ঠাঁই নিল আমার বাড়িতে। সেখানে আমার ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজের ভাত-জল কে দেবে? যথাসময়ে অপারেশন হল। দীর্ঘ ৪৫ দিন পরে আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলাম।
(ক্রমশ)