• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • শরদিন্দু সাহিত্যে চিত্রনাট্যের উপাদান : ভাস্কর বসু

    মুখবন্ধ

    নাটক যে সাহিত্যের উপাদান তা অনেক আগেই স্বীকৃত। বাংলা ভাষার বরেণ্য সাহিত্যিকরা নাটক রচনার কাজে হাত দিয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলালের সর্বাধিক খ্যাতি নাট্যকার রূপেই। পরবর্তী কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি দেন নাটক রচনা করেই। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন—তাঁদের গ্রামে তখন নাটক রচনার ঢেউ উঠেছে।

    “এমনই আবহাওয়ার মধ্যে আমার মনেও নাটক রচনার জন্য আকুলতা জাগলো। অনেক ভেবে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ নিয়ে একখানা নাটক লিখলাম।” [১]

    নাটক রচনাকালীন তাতে সাহিত্যের উপাদান ঢেলে দিতে কার্পণ্য করতেন না সাহিত্যিকেরা। নাটক অভিনয়যোগ্য কিনা সে চিন্তা থাকলেও তাকে উঁচুমানে বাঁধতে অসুবিধে হয়নি। বরেণ্য সাহিত্যিকদের মৌলিক কাহিনি নাটক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে, এমন উদাহরণ অসংখ্য। রবীন্দ্রনাথের নাটক সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন—

    ‘রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলির মঞ্চ সার্থকতা থাকুক বা না থাকুক, নিতান্ত গণ্ডমূর্খ ছাড়া সেগুলির সাহিত্যমূল্য অস্বীকার করবে কে?’ [২]

    তুলনাতে সিনেমার চিত্রনাট্য সেভাবে সাহিত্যের স্বীকৃতি পায়নি। শুধুমাত্র চিত্রনাট্য রচনার তাগিদেই মৌলিক রচনা লেখার সেরকম কোন তাগিদ অনুভব করেননি বাংলার সাহিত্যিকরা। একসময় বাংলা সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বা নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের মত নামী সাহিত্যিকেরা। কিন্তু লিখেছেন তখনই, যখন সিনেমার প্রয়োজন হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবার তা রচিত হয়েছে প্রকাশিত কোন কাহিনির ভিত্তিতেই, একেবারে মৌলিক চিত্রনাট্য লেখার চল বাংলা সাহিত্যে নেই বললেই চলে।

    এর একটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। সেটি হল নাটকের তুলনাতে সিনেমা অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর। নাটকের কুশীলবদের মঞ্চ দাপানোর সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু সিনেমাকে বলা যায় পরিচালকের মাধ্যম। এবং অন্য কলাকুশলীদের। আমরা এখানে মনে করতে পারি ‘নায়ক’ সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপ, যা শংকরদা অরিন্দমকে বলেছিলেন—

    “ফিল্মের একটা গ্ল্যামার আছে জানি, কিন্তু তার সঙ্গে আর্টের কোন সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না।—A film actor is nothing but puppet, একটা পুতুল। পরিচালকের হাতে সে পুতুল, ক্যামেরাম্যানের হাতে সে পুতুল, সাউন্ড রেকর্ডিস্টের হাতে সে পুতুল, আর কাঁচি দিয়ে যিনি দৃশ্যগুলি কাটবেন, সেই এডিটরের হাতেও সে পুতুল।”

    এই সংলাপের মধ্য দিয়ে সত্যজিৎ অসাধারণভাবে নাটক আর ফিল্মের সম্পর্কে বাঙালি কুশীলবদের সাধারণ ধারণাকে সম্যকভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। ‘“ফিল্মের একটা গ্ল্যামার আছে জানি, কিন্তু তার সঙ্গে আর্টের কোন সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না’—এরকম প্রত্যয়ী সংলাপ বাঙালি নাট্য ও শিল্পমোদীদের একান্ত মনের কথা।

    ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সিনেমা ‘নায়ক’। ভারতীয় সিনেমাতে তখন সত্যজিৎ-পরবর্তী যুগ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘ফিল্ম হল গ্ল্যামার, তার সঙ্গে আর্টের সম্পর্ক নেই’ এই ধারণা বেশ বহাল তবিয়তেই বেঁচে ছিল। বাংলার নাট্য আন্দোলন যেভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছিল, ফিল্মে তার প্রতিফলন কমই দেখা গিয়েছিল।

    সম্ভবত এর মূল কারণ দুটি—প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক।

    নাটকের তুলনায় সিনেমাতে প্রযুক্তির প্রভাব অনেক বেশি—শংকরদার ভাষ্য অনুযায়ী—সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, ক্যামেরাম্যান এবং এডিটরদের অসামান্য ভূমিকা থাকে। প্রত্যেকটি ভূমিকার পিছনেই থাকে প্রযুক্তি নির্ভরতা। আর প্রযুক্তির সঙ্গে আর্টের যে সুপ্ত বিরোধ তখন ছিল (এখনো কি নেই?) এটা মোটামুটি সবার জানা।

    আর একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে যত টাকা লাগে তার থেকে অনেকগুণ বেশি টাকা লাগে সিনেমা করতে। কারণ ঐ প্রযুক্তির সুষম প্রয়োগে লাগবে পর্যাপ্ত উপাদান—ক্যামেরা, ফিল্ম, সাউন্ড রেকর্ডার, এডিটিং-এর জন্য প্রজেকশন রুম ইত্যাদি।

    সুতরাং কোন সাহিত্যিক যদি চিত্রনাট্য রচনা করতে চান, তাঁর এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে বিশদ ধারণা থাকা আবশ্যক। ধরা যাক তিনি এই ব্যাপারগুলি আয়ত্ত করলেন। এইবার সাহিত্যিক যদি চিত্রনাট্য রচনা করেন তার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই হয়তো আর্টের সম্পর্ক থাকবে। সেই চিত্রনাট্য বাণিজ্যিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে?

    হাতের কাছেই উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায় ‘নায়ক’ ছবির চিত্রনাট্য। সত্যজিৎ যদি ছবিটি মাথায় না রাখতেন, তাহলে কি শুধুমাত্র মৌলিক রচনা হিসেবে এটি কোথাও প্রকাশিত হতে পারতো? সম্ভবত না। কোন সাহিত্যিকের মাথায় যদি এই ফর্মে কোন চিন্তা আসতো, তাহলে কি তিনি তাঁর কোন মৌলিক রচনাকে এভাবে প্রকাশ করতে পারতেন? এর উত্তরও এক, সম্ভবত না।

    শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনের দীর্ঘ বিশ বছর কাটিয়েছিলেন চিত্রনাট্যকার রূপে। তিনি কিছু কিছু লেখা মৌলিক চিত্রনাট্য রূপেও প্রকাশ করেন। এছাড়াও তাঁর অনেক লেখাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চিত্রনাট্যের বেশ কিছু উপাদান, ঠিক সত্যজিতের সাহিত্যের মতই।

    এই উপাদানগুলি শরদিন্দু কাহিনিকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত করেছে। তাঁর বিভিন্ন কাহিনিতে ছড়িয়ে আছে চিত্রনাট্যের নানা উপাদান। তার বিস্তারিত বিবরণ ছোট পরিসরে ধরা অসম্ভব। বরং আমরা তাঁর জনপ্রিয়তম সৃষ্ট চরিত্র ব্যোমকেশের কাহিনি একটু বিস্তারিত নেড়েচেড়ে অনুসন্ধান করে দেখতে চাই। আমাদের ধারণা, কিছু মণিমুক্তোর সন্ধান আমরা পেয়ে যাবো। আধুনিক সাহিত্যস্রষ্টা ও চিত্রনাট্যকারদের কাছেও তা মূল্যবান হতে পারে।

    সংক্ষিপ্ত জীবনী

    তিনি নিজেই লিখেছেন (‘চলচ্চিত্র প্রবেশিকা’ নামক আত্মজীবনীমূলক গল্পে):

    আমার জীবনে একটা বৈচিত্র্য আছে; আমি জন্মেছি উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহরে, বড় হয়েছি বেহারের মুঙ্গের শহরে, লেখাপড়া করেছি কলকাতায়, কাজ করছি বম্বেতে এবং বাণপ্রস্থ অবলম্বন করছি পুনায়। নিখিল-ভারতীয় বাঙালী যদি কেউ থাকে সে আমি। [৩]

    সাহিত্যে অনুরাগ ছিল স্কুলে পড়াকালীনই। তাঁর জেলা স্কুলের শিক্ষক পূর্ণ চক্রবর্তীর উৎসাহে কবিতা রচনা করেন। পরে কলকাতায় কলেজে পড়াকালীন তাঁর বন্ধু অজিত সেনের উৎসাহে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ—যৌবনস্মৃতি। জোরদার সাহিত্যচর্চার শুরু বিশের দশকে। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘রক্তসন্ধ্যা’। ১৯৩০ সালে। তারপর মুম্বাই পাড়ি ১৯৩৮ সালে। ১৯৫২ সালে আবার চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পুনাতে সাহিত্যচর্চার শুরু। ১৯৭০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেখানেই বসবাস ও পুরোমাত্রায় সাহিত্য চর্চা।

    মুম্বাইতে থাকাকালীন সাহিত্যচর্চা কার্যত বন্ধ ছিল। প্রকাশকরা চাইলেও গল্প দিতে পারেননি। কিন্তু নিবিষ্টমনে এই সময় লিখে গেছেন চিত্রনাট্য। নিজের অজান্তেই আয়ত্ত করেছেন চরিত্র ও ঘটনাকে জীবন্ত, বিশ্বাসযোগ্য করার বিভিন্ন রীতিনীতি। পরবর্তীকালে তাঁর জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে।

    ব্যোমকেশ বক্সীর প্রথম আবির্ভাব ১৯৩৩ সালে ‘পথের কাঁটা’ গল্পে। আর শেষ লেখা ‘বিশুপাল বধ’ (অসমাপ্ত) ১৯৭০ সালে। অর্থাৎ ৩৭ বছরে তার পথচলার ইতিহাস।

    প্রাক-মুম্বাই

    আলোচনার সুবিধের জন্য আমরা এই কাহিনিগুলিকে ভাগ করতে চাই দুই পর্বে—প্রাক-মুম্বাই ও মুম্বাই পরবর্তী পর্বে।

    প্রাক-মুম্বাই পর্বের গল্পগুলি হল—‘পথের কাঁটা’, ‘সীমন্তহীরা’, ‘সত্যান্বেষী’, ‘মাকড়সার রস’, ‘অর্থমনর্থম’, ‘চোরাবালি’, ‘অগ্নিবান’, ‘উপসংহার’, ‘রক্তমুখী নীলা’, ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’।

    লক্ষ করলে দেখা যাবে আকারে এই গল্পগুলি বেশ ছোট। চরিত্রের সংখ্যাও কম। অজিত ও ব্যোমকেশ ছাড়া মোটামুটি পাঁচ ছয়টির বেশি চরিত্র নেই। গল্পগুলির প্লটও বেশ একমুখী। এছাড়া ‘চোরাবালি’ ছাড়া সব গল্পেরই পটভূমি কলকাতা শহরের উত্তরভাগ।

    শরদিন্দুর তখনো চিত্রনাট্যে সেভাবে হাতে খড়ি হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাহিনিতে ডিটেলের সম্ভার রয়েছে। আছে সেই পুরনো কলকাতার ছবি। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাতে পাই—

    —ব্যোমকেশ কাহিনীর পরতে পরতে বাঙালি জীবনের নানান খুঁটিনাটি উঠে এসেছে। যেসব খুঁটিনাটি এখন পড়তে বসে দেখছি হারিয়ে গেছে। তাই যেন ব্যোমকেশকে বাঙালির আজ আরও নিজের মনে হচ্ছে। মেসবাড়ি, সন্ধে হলে রাস্তায় গ্যাসের আলো, বড়ো ফটকওয়ালা বাড়ির গেটে দারোয়ান, সম্পন্ন বাড়িতে হাউস ফিজিসিয়ান— সেসব গেল কোথায়? ব্যোমকেশের যত কাছে যাই, ফিরে ফিরে পড়ি, আর ওদের দেখা পাই। [৪]

    হ্যাঁ। সত্যিই তাই। ‘নানান খুঁটিনাটি’—তো আছেই। তা কাহিনিকে অনেক জীবন্ত করেছে। শ্যামল তার কয়েকটির মাত্র উল্লেখ করেছেন।

    তার আগে আমাদের একটু পরিষ্কার করে নিতে হবে চিত্রনাট্যের উপাদান বলতে আমরা কী বোঝাতে চাইছি। আমরা বলতে চাইছি চরিত্রের এমন বর্ণনা যাতে আমাদের মনে সেই চরিত্র সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মায়। আরো বলতে চাইছি ঘটনাস্থলের বেশ বিস্তারিত বিবরণ যাতে কাহিনির গতির সঙ্গে আমরা নিজেদের মিলিয়ে নিতে পারি। যাতে মনে হবে আমরা পড়ছি না, দৃশ্যটিকে চোখের সামনে ঘটতে দেখছি।

    তাঁর ‘ডিটেল সম্পর্কে দু চার কথা’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ বলেছিলেন বঙ্কিমের কথা। বিষবৃক্ষ উপন্যাসে নগেন্দ্রের বাড়ীর উঠোনের বিবরণের কথা—

    “—বঙ্কিম জানতেন যে কাহিনি কাল্পনিক হলেও পাঠকের মনে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ডিটেলের সাহায্যে তার একটি বাস্তব পটভূমিকা রচনা করে নিতে হয়।” [৫]

    ডিটেলে ত্রুটি থাকলে তা পাঠকের মনে খুঁতখুঁতুনি তৈরি করে আর তাতেই কাহিনির চরিত্র পাঠকের কাছে রক্তমাংসের চরিত্র হতে পারে না।

    সুতরাং শরদিন্দুর কাহিনিতেও, আমাদের চোখ খুঁজে বেড়াবে ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ আর ‘বাস্তব পটভূমিকা’র সন্ধানে। খুবই আশার কথা আমাদের সন্ধানে উঠে আসবে বেশ কিছু মণিমুক্তো।

    প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘পথের কাঁটা’-তে শরদিন্দু সেই সময়কার কলকাতা শহরের ছবি ছোটখাটো বিবরণের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন।

    এখানে তিনটি ঘটনাস্থল বর্ণিত আছে। একটি হল তখনকার চৌরঙ্গী যেখানে অজিতের হাতে প্রথম ‘পথের কাঁটা’র সমাধানের সূত্রপাত। আমরা দেখি চৌরঙ্গির হোয়াইটওয়ে লেডলর দোকান দেখে সময় কাটাচ্ছে অজিত। তারপরে সে এসপ্ল্যানেডের ট্রাম ডিপোতে এসে চিঠির খোঁজ পায়। এছাড়া আর একটি অকুস্থল হল—খিদিরপুর রেসকোর্সের পাশের রাস্তা।

    ঘটনার সময় অর্থাৎ তিরিশের দশকে হোয়াইটওয়ে লেডল (Whiteway Laidlaw) ছিল ব্রিটিশ আমলের কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এরকম একটা বর্ণনাতে সহজেই পাঠকের কাছে অকুস্থলের চেহারা পরিষ্কার হয়। খিদিরপুরের রেসকোর্সের পাশের রাস্তাও শুনশান থাকে। তখনকার কলকাতাতে রাত্রি বারোটা। সব কিছু মিলিয়ে পাঠকের চোখে কাল্পনিক ঘটনার অকুস্থল একেবারে ‘বাস্তব পটভূমি’ হয়ে ধরা দেয়।

    চরিত্রের বর্ণনাতেও তাঁর মনোযোগ ছিল। আশুবাবুর চেহারার বর্ণনা ছিল—মধ্যবয়সী স্থূলকায় ভদ্রলোক। হাতে রূপো বাঁধানো লাঠি, গায়ে কালো গলাবন্ধ কোট, পরনে কোঁচানো থান। ফর্সা, সুশ্রী, দাড়ি গোঁফ কামানো, মাথার সামনে টাক পড়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

    আর অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র প্রফুল্ল রায়ের চেহারার বিবরণ—ভদ্রবেশধারী সুশ্রী যুবক, দাড়ি গোঁফ কামানো, একহারা ছিপছিপে গড়ন, বয়স ত্রিশের মধ্যেই। চেহারা দেখলে মনে হয় একজন অ্যাথলেট। এতেই শেষ নয়, পান খেয়ে দাঁতের অবস্থা খারাপ হওয়ার ফলে তার হাসিটি সুদর্শন নয়। ‘সুন্দর মুখ এত সহজে বিকৃত হয় দেখিয়া আশ্চর্য হতে হয়।’

    চরিত্রের বিবরণে মানুষ দুটি আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে যান না কি? কাল্পনিক চরিত্র কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যায় স্রেফ চমৎকার বর্ণনার গুণে। কাজেই কোন পরিচালকের পক্ষে চরিত্রাভিনেতার সন্ধান অনেক সুবিধাজনক হয়ে যায়।

    তাঁর পরের গল্পগুলিতেও এই রকম ডিটেলের ছড়াছড়ি। ধরা যেতে পারে ‘অর্থমনর্থম’ কাহিনিটি।

    ‘অর্থমনর্থম’ গল্পটি লেখা হয়েছে ১৯৩৫-৩৬ সালে। বোঝাই যাচ্ছে সেই সময় ‘চিত্রা’ সিনেমা হলের বেশ রমরমা। সেই চিত্রা, পরে যার নাম হয় ‘মিত্রা’ এবং কিছুদিন আগেই যে সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়।

    সুকুমারও ‘চিত্রা’তেই সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। সেই সময় ব্যোমকেশ ও অজিত থাকতো হ্যারিসন রোডেই। আবার রাতে খাওয়াদাওয়া করেই ব্যোমকেশ অজিতকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেল ‘চিত্রা’তেই—উদ্দেশ্য সত্যবতীর কথার যথার্থতা নির্ণয়।

    কিন্তু যেহেতু কাহিনিগুলি ছোট, সেহেতু চরিত্রের সংখ্যাও বেশি নয়। দেখা যাক, ব্যোমকেশের ভাবী স্ত্রী সত্যবতীর ছবি কীরকম ফুটিয়েছেন তিনি।

    প্রথম যখন সত্যবতীর সঙ্গে দেখা হয়, তখন সে ভীষণ বিচলিত ছিল কারণ তাদের বাড়িতেই একটা খুন হয়েছে। তার বিবরণ—রং ময়লা, লম্বা গোছের চেহারা, কেঁদে কেঁদে সে চোখ ফুলিয়েছে কাজেই সে সুশ্রী কি কুশ্রী বোঝার উপায় নেই। কিন্তু তার দাদার বিপদের সময় সে ব্যোমকেশের সাহায্য চাইতে এসে, লেখকের চোখে অন্য ভাবে দেখা দেয়। তার পায়ের মলিন জরির নাগরা থেকে অগোছালো চুল, সবকিছু মিলিয়েই তাকে অনন্যা লাগে। তাই হয়তো পরে অবশ্য ব্যোমকেশও জানিয়েছে—‘তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’।

    এই সময়কার ব্যোমকেশের বিবাহ পরবর্তী গল্পগুলিতেও সত্যবতীর উপস্থিতি দেখা যায়নি। এই পর্বে দুটি কাহিনির ঘটনাস্থল কলকাতার বাইরে, ব্যোমকেশ ও বরদা এবং চোরাবালি। চোরাবালি গল্পে তাঁর কিছু বিস্তারিত বিবরণের ছোঁয়া থাকবে।

    চিত্রনাট্য শুরুর পরে

    পরের দিকের অর্থাৎ পুনাতে গিয়ে সাহিত্যচর্চাতে মনোনিবেশ করার পর শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনিতে অনেক পরিবর্তন আসে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন সত্যবতীর উপস্থিতি।

    যদিও আমরা দেখেছি ব্যোমকেশের বিয়ে হয়েছে ‘অর্থমনর্থম’ গল্পে, কিন্তু পরবর্তী গল্পগুলিতে সে অনুপস্থিত। তার প্রথম উপস্থিতি ‘চিত্রচোর’ গল্পে। চিত্রচোর গল্পটিও আকারে বড় এবং তাঁর আগের গল্পের তুলনাতে অনেক বেশি চরিত্রের ভীড়। এছাড়া মূল প্লটের সঙ্গে আছে গুটি কয়েক সাব-প্লটেরও আনাগোনা। সম্ভবত এই মুনশীয়ানা তাঁর চিত্রনাট্য রচনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল।

    আগের একটি প্রবন্ধে আমরা দেখেছি অশনি সংকেত ও বিভূতিভূষণ সম্পর্কে সত্যজিৎ কি পরম শ্রদ্ধাশীল। তিনি মনে করতেন অশনি সংকেত উপন্যাসে যেন চিত্রনাট্য করাই আছে। বিভূতিভূষণের সংলাপ নিয়েও তিনি উচ্ছ্বসিত।

    “বিভূতিভূষণের সংলাপ পড়লে মনে হয় যেন সরাসরি লোকের মুখ থেকে কথা তুলে এনে কাগজে বসিয়ে দিয়েছেন। এ সংলাপ এতই চরিত্রোপোযোগী, এতই revealing যে, লেখক নিজে চরিত্রের আকৃতির কোন বর্ণনা না দিলেও কেবলমাত্র সংলাপের গুণেই চরিত্রের চেহারাটি যেন আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও স্মরণশক্তি না থাকলে এ ধরনের সংলাপ সম্ভবপর নয়।” [৫]

    শরদিন্দু সম্পর্কে একই রকম উচ্ছ্বাস আমার আছে। আর আমার প্রিয় উপন্যাসটির নাম শজারুর কাঁটা। এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে চিত্রনাট্যের নানান উপাদান।

    সাহিত্যের কাহিনি থেকে চিত্রনাট্য রচনার ব্যাপারে সত্যজিৎ রায় লিখেছেন—

    “আগেও বলেছি, আবার বলছি, ভাষার গুণে পড়ার সময় এসব খটকা মনে লাগেনা। কিন্তু চিত্রনাট্য রচনার প্রয়োজনে যখন মূল কাহিনির নির্মম বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, যখন চরিত্রগুলিকে রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, গল্পের পরিবেশ চোখের সামনে মূর্ত করে তুলতে হয়, সময়ের পরিষ্কার সূত্র ধরে ঘটনাবলীর একটা ধারাবাহিকতা তৈরী করতে হয়—তখনই এ জাতীয় ত্রুটি চোখে পড়ে। কাহিনির অদলবদল যে হয় তা এ কারণেই—খামখেয়ালবশত নয় বা পরের কাহিনির ভিত্তিতে ছবি তৈরী করে মৌলিক রচনার বাহবা নেওয়ার জন্য নয়।” [৬]

    কিন্তু যদি কাহিনিতে চরিত্রগুলিকে রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে চিত্রিত থাকে? গল্পের পরিবেশ যদি মূর্ত থাকে? সময়ের সূত্র ধরে ঘটনাবলীর একটা পরিচ্ছন্ন ধারাবাহিকতা কাহিনির মধ্যেই থাকে? তাহলে হয়তো বলা যেতে পারে সেই কাহিনি চিত্ররূপের জন্য আদর্শ।

    কাহিনির শুরু থেকেই দেখা যতে পারে।

    প্রথমেই আছে একটি বাগানওলা বাড়ীর কথা। বিবরণ অনুযায়ী বাগানটি অনাদৃত, খোলা জায়গায় ইতঃস্তত পরিকল্পনাবিহীনভাবে কয়েকটি ছড়ানো ফুলের গাছ। রাস্তার নাম আছে, ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের নতুন রাস্তা। আছে বাড়ীর সুস্পষ্ট স্থানের ইঙ্গিত। মনে হয় ক্যামেরা যেন রাস্তাকে অনুসরণ করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। নায়িকা দীপা রেডিও শুনছে, একটি শ্রান্ত দুপুর। অফিস থেকে তার বর দেবাশিস এলে সে তাকে খাবার দেয়। কিন্তু দেবাশিস সিনেমার প্রস্তাব করতেই সে প্রত্যাখ্যান করে।

    এখানেই পাঠকের কৌতূহল দানা বেঁধে ওঠে। মাত্র দুমাস তাদের বিয়ে হয়েছে, এরকম হওয়ার কারণ কী? দেবাশিস বেরিয়ে যায়। আড্ডার উদ্দেশে। আর দীপা?

    দীপা ওপরে এসে আবার আরামকেদারায় এলিয়ে পড়ল। তার মনের মধ্যে দশদিক তোলপাড় করে ঝড় বইছে। সারা গায়ে অসহ্য ছটফটানি। অভ্যাস বসেই সে হাত বাড়িয়ে রেডিওগ্রাম চালিয়ে দিল; কোন একটি মহিলা ইনিয়ে-বিনিয়ে আধুনিক গান গাইছেন। কিছুক্ষণ শোনার পর সে রেডিও বন্ধ করে দিয়ে চোখ বুঝে চুপ করে রইল। কিন্তু মুখের মধ্যে ঝড়ের ছটফটানি কমলো না। তখন সে উঠে অশান্ত ভাবে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল, অস্ফুটস্বরে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল—‘এভাবে আর কতদিন চলবে?’

    দীপা যদি হালকা চরিত্রের মেয়ে হতো তাহলে তার জীবনে বোধহয় কোন ঝড়-ঝাপটাই আসতো না।

    প্রায় নাটকীয় কায়দায় শরদিন্দু মূল চরিত্র আর তাদের জীবনের এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমাদের। তারপর শেষ বাক্যে ইঙ্গিত দিলেন এবার তিনি দীপার জীবনের ঝড়-ঝাপটার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করাতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ সিনেমার ভাষায় ‘ফ্ল্যাশব্যাক’। ওপরে অনুচ্ছেদটির মধ্যেই দীপার মনের মধ্যে ঝড়ের কথা থাকলেও কিন্তু দেবাশিসের সম্পর্কে সেরকম কোন ইঙ্গিত নেই। প্রত্যাখ্যাত দেবাশিসের মনের ক্ষোভ থেকেও আমরা জানতে পারি দীপা-দেবাশিসের দাম্পত্যজীবন স্বাভাবিক নয়। তীব্র কৌতূহলে আমরা অপেক্ষা করি দীপার জীবনকাহিনি শোনার জন্য।

    আমরা ভাবতে পারি ক্যামেরা দেবাশিসের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে দীপার বাপের বাড়ির দিকে। ছোট ছোট বাক্যের মধ্যে শরদিন্দু পরিচয় করাচ্ছেন চরিত্রগুলির সঙ্গে। তাদের বাড়ির বনেদিয়ানা, গোঁয়ার্তুমি, দীপার বিদ্রোহী মন, তার প্রেমে পড়া সব যেন সারি সারি ছবির মতন আমাদের সামনে চলে আসে। বাড়ির কর্তা, দীপার ঠাকুর্দার বিবরণ বিস্তারিত কিন্তু অল্প কথায় বিবৃত।

    উদয়মাধব মুখুজ্জে একদিন বুড়ো বয়সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান, তার মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লাগে। এই আঘাতের ফলে তার নিম্নাঙ্গ পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যায়, চলে ফিরে বেড়াবার ক্ষমতা আর থাকেনা। এছাড়া তাঁর স্বাস্থ্য বেশ ভালই। দোহারা গড়নের শরীর, মুখের চওড়া চোয়ালে প্রবল ব্যক্তিত্বের ছাপ। সত্তর বছর বয়সে মানসিক শক্তি বিন্দুমাত্র কমেনি। যে দাপট নিয়ে তিনি কলেজের অধ্যক্ষতা করতেন সেই দাপট পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান আছে। তাঁর চিরদিনের অভ্যাস হুঙ্কার দিয়ে কথা বলা। এখনো তিনি হুঙ্কার দিয়ে কথা বলেন।

    আমরা যদি কোন পরিচালকের আসনে বসে ভাবি, উদয়মাধবের চরিত্রের জন্য অভিনেতা নির্বাচনের কাজটি কি সহজই না করে রেখেছেন শরদিন্দু! এমনকি তাঁর ভাবভঙ্গিও যেন কলমে লেখা নয় তুলিতে আঁকা—

    দীপা তেতলায় দাদুর ঘরে ঢুকে দেখল তিনি বিছানায় আধ শোয়া হয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। তিনি প্রত্যহ দুটি খবরের কাগজ পড়েন। সকাল বেলা ইংরেজি কাগজ; আর দুপুরে দিবানিদ্রার পর বাংলা।

    তেতলার ঘর! অর্থাৎ যেন তিনি সংসারের থেকে একটু দূরে আছেন কিন্তু তাঁর দাপট সংসারের সর্বত্র। তাঁর আধশোয়া হয়ে কাগজ পড়ার বর্ণনাও খুব সহজে চিনিয়ে দেয় মানুষটিকে। সুতরাং দীপা যখন তাঁর কাছে দেখা করতে আসবে, কোন দুঃসাহসিক প্রস্তাব নিয়ে, কি পরিমাণ উত্তেজনা হতে পারে তার আঁচ পাঠক (বা সম্ভাব্য দর্শক) পেয়েই যাচ্ছেন।

    দীপার জীবনের সঙ্গে দেবাশিসের জড়িয়ে যাওয়াতে নৃপতির নেপথ্য ভূমিকা আছে। নৃপতির সংস্পর্শে বিয়ের আগেই এক নতুন জীবনে যেন প্রবেশ করতে চলেছে দেবাশিস। ভারি স্নিগ্ধ সেই বর্ণনা -

    দুজনে বেরুল। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। নৃপতির বাড়ির সামনে এসে তারা শুনতে পেল বৈঠকখানায় কেউ লঘু আঙ্গুলের স্পর্শে পিয়ানো বাজাচ্ছে।

    বৈঠকখানা ঘরে তিনটি উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কেবল একটি মানুষ ঘরে আছে, দেয়ালঘেরা পিয়ানোর সামনে বসে আপন মনে বাজিয়ে চলেছে।

    নৃপতি দেবাশিসকে নিয়ে ঘরে ঢুকল, বলল—‘ ওহে প্রবাল, দেখ আমাদের আড্ডার একটি নতুন সভ্য পাওয়া গেছে। এঁর নাম দেবাশিস ভট্ট।

    প্রবাল নামধারী যুবক পিয়ানো থেকে উঠে এলো। নিরুৎসুক স্বরে বলল, ‘পরিচয় দেবার দরকার নেই।’

    নৃপতি বলল,-‘আগে থাকতেই পরিচয় আছে নাকি?’

    প্রবাল বলল,-‘সামান্য । গরিবের সঙ্গে বড় মানুষের যতটুকু পরিচয় থাকা সম্ভব ততটুকুই।’

    প্রবাল আবার পিয়ানোর সামনে গিয়ে বসলো। টুংটাং করে একটা সুর বাজাতে লাগল। তার ভাবভঙ্গী দেখে বেশ বোঝা যায় সে দেবাশিসকে দেখে সে খুশি হয় নি।

    খুব ছোট লেখার মধ্যেই রয়ে গেল নৃপতির বৈঠকখানার বিবরণ এবং প্রবাল চরিত্রের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় পর্ব। তিনটি বস্তুর প্রতি আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই - লঘু আঙ্গুলের স্পর্শে, তিনটি উজ্জ্বল আলো আর নিরুৎসুক স্বরে । বিবরণ এবং সংলাপ ছোট অথচ কত জোরালো হতে পারে, এ তার এক ছোট্ট উদাহরণ। এই কাহিনির পরতে পরতে এমন উদাহরণ অজস্র। আর একটি অন্য চরিত্রের বিবরণের কথা ধরা যাক। যে জন্মসূত্রে অবাঙালি হয়েও মনে প্রাণে বাঙালি।

    খড়্গ বাহাদুর নেপালী যুবক। তার মা বাঙালি। তাই তার মাতৃভাষাও বাংলা। চমৎকার চেহারা, যেমন পীতাভ সোনালী রং তেমনি লম্বা ছিপছিপে গড়ন। তার মুখে মঙ্গোলীয় রক্তের ছাপ এত অল্প যে ধরা যায় না। বর্তমানে সে বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলোয়াড়। পায়ের কাছে বল পেলে সে যাদুকর বনে যায়। কলকাতার সবচেয়ে নামজাদা ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড়। তার খেলা দেখবার জন্য লক্ষ লক্ষ দর্শক মাঠে জমা হয়। কিন্তু তার চরিত্রে বিন্দুমাত্র চালিয়াতি নেই। উচ্চ বংশের ছেলে কিন্তু ভারী বিনয়ী বয়স তেইশ-চব্বিশ।

    ঘটনা ষাটের দশকের। অনেকের মনে থাকতে পারে এই সময় ইস্টবেঙ্গল দলে রাম বাহাদুর নামে এক বিখ্যাত নেপালী খেলোয়াড় ছিলেন। তার পরে পরেই এসে যাবেন শ্যাম থাপা। তাই পাঠকের এই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে অসুবিধে হয় না। আর যদি কোন পরিচালক অভিনেতার খোঁজে থাকেন, তার পক্ষেও কাজ সহজ।

    কিছু কিছু দৃশ্যের বর্ণনা একেবারে যেন সিনেমার একটি ফ্রেমের মত। যেমন ধরা যাক তাদের প্রজাপতি প্রসাধন ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে এসে দীপার ফুল সাজানোর দৃশ্য।

    দেবাশিস একবার নিঃশব্দে ওপর এসে দেখল, দীপা ভারি ব্যস্ত। আঁচলটা গাছ-কোমর করে জড়িয়েছে, মাথার চুল একটু এলোমেলো হয়েছে; ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। দেবাশিস দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট চোখে দেখল কিন্তু দীপা তাকে লক্ষ্যই করলো না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেবাশিস আস্তে আস্তে নিচে নামল, তারপর নৃপতির বাড়িতে চলে গেল।

    আচ্ছা, মনে হয়না, ক্যামেরা যেন খুব ধীরগতিতে দেবাশিসকে অনুসরণ করে ওপরে এল, তারপর ক্লোজ আপে দীপাকে ধরল, আবার ফিরল মুগ্ধ দেবাশিসের মুখে? এবার আবার আস্তে আস্তে দেবাশিসের নীচে নামা, তার বাড়ির বাইরে গিয়ে নৃপতির বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করিয়ে আবার বাড়িতে দীপার খবর নিতে ভিতরে ফিরে এল।

    এছাড়া আছে কলকাতা শহরের চমৎকার বর্ণনা। ধরা যাক প্রবালের বাসা যে রাস্তায় তার পরিপার্শ্বের ছবি।

    > আরেকটি রাত্রির কথা।

    গোলপার্ক থেকে যে কটা সরু রাস্তা বেরিয়েছে তারই একটা দিয়ে কিছুদূর গেলে একটা পুরনো দোতলা বাড়ি চোখে পড়ে; এই বাড়ির একতলায় গোটা তিনেক ঘর নিয়ে প্রবাল গুপ্ত থাকে। পুরনো বাড়ির পুরনো ভাড়াটে; ভাড়া কম দিতে হয়। বাসাটি মন্দ নয় কিন্তু প্রবালের প্রকৃতি একটু অগোছালো, তাই তার স্ত্রী মারা যাবার পর বাসাটি শ্রীহীন হয়ে পড়েছে।

    সদরের বসবার ঘরে মেঝের ওপর শতরঞ্জি পাতা। দেয়াল ঘেঁষে একজোড়া বাঁয়া তবলা, হারমোনিয়াম এবং তাল রাখার একটা ছোট যন্ত্র। প্রবাল যে সঙ্গীতশিল্পী বাসায় এছাড়া তার অন্য কোন নিদর্শন নেই।

    ক্যামেরায় দেখতে পাবো জনবহুল কলকাতা শহরকে। গড়িয়াহাটা থেকে গোলপার্ক। সেখানকার বিভিন্ন দোকানের পশরা, ব্যস্ত ক্রেতাদের ছবি। এরপর ক্যামেরা একটা সরু রাস্তা নিয়ে ঢুকে পড়বে। থামবে একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে। ঢুকে পড়বে সেই অগোছালো ঘরে যেখানে তবলা, হারমোনিয়াম ও তাল রাখার যন্ত্র রয়েছে।

    আর সময়ের ধারাবাহিকতা? অতি অল্প খুঁত আছে কিন্তু তা সহজেই কাটানো যায়।

    কাহিনির শুরু চৈত্রের অপরাহ্নে। দীপার বিয়ের দু’মাস পরে। অর্থাৎ দীপার বিয়ে হয়েছে মাঘ মাসে। অথচ বুড়ো ফাগুরামের (প্রথম শজারুর কাঁটার মৃত্যু) মৃত্যু হয়েছে ফাল্গুন মাসে। আবার দীপার বৌভাতের দিনই সেটি। এটি যদি মাঘ মাস হত তাহলে সমস্যা থাকতো না।

    তাহলেই প্রথম খুন হত মাঘ মাসে। দ্বিতীয় খুন তার মাসখানেক পর অর্থাৎ ফাল্গুনে। তৃতীয় খুন আরো দু সপ্তাহ পর অর্থাৎ ফাল্গুনের শেষ বা চৈত্রের কাছাকাছি। এর দশ বারো-দিন পরই ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু দেবাশিসের ওপর হত্যাপ্রচেষ্টার খবর পান। অর্থাৎ চৈত্রের মাঝামাঝি। সেটি ঐ দিন যে দিন দীপার সঙ্গে দেবাশিসের সিনেমা দেখার কথা হয়, দেবাশিস নৃপতির বাড়ি না গিয়ে ফিরে আসে। রাতে খড়্গ বাহাদুরের টেলিফোন পেয়ে লেক-এ যায় এবং আক্রান্ত হয়। কাজেই চৈত্রের মাঝামাঝি। এভাবে সাজিয়ে নিলেই সময়ের সূত্র ধরে কাহিনির চমৎকার ধারাবাহিকতা রাখা যায়।

    ফ্ল্যাশব্যাকে আমরা এসে পড়ি ঘটনার প্রবাহে।

    দেবাশিস আর দীপার বিয়ের পর দুই মাস কেটে গেল। যেদিনের ঘটনা নিয়ে কাহিনি আরম্ভ হয়েছিল, সেই যেদিন দেবাশিস ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে এসে দীপাকে সিনেমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু দীপা যায়নি, দীর্ঘ পশ্চাদ্দৃষ্টির পর আমরা সেইখানে ফিরে এলাম।

    লং ফ্ল্যাশব্যাক এর চমৎকার বাংলাও করেছেন—দীর্ঘ পশ্চাদ্দৃষ্টি! এর পর কাহিনি মোড় নেয় রহস্য উদ্ঘাটনের পথে। অনেকেই জানেন এই ক্ষেত্রে শরদিন্দু বেশ কিছুটা প্রভাবিত হয়েছেন আগাথা ক্রিস্টির ABC Murders কাহিনির দ্বারা। কিন্তু কাহিনির বুননে তিনি অসাধারণ মৌলিকতার ছাপ রেখেছেন।

    মনে করা যাক, দেবাশিসের দুর্ঘটনার পরে দীপার প্রতিক্রিয়াগুলি। ভেঙে পড়ার বদলে সে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎই সে দেবাশিসের প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করে। সেই মুহূর্তগুলিতেও শরদিন্দু অনবদ্য ভঙ্গিমাতে পেশ করেছেন। জ্ঞান ফেরার পর দেবাশিসের হসপিটাল থেকে ফোন পায় দীপা।

    “নকুলের শঙ্কা বিবশ মুখ দেখে দীপা হঠাৎ নিজের হৃদয়টাও দেখতে পেল। আজকের দীপা আর দুমাসের আগের দীপা নেই, সব ওলট পালট হয়ে গেছে। —সে নকুলকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল।”

    একদম ছবির মত বর্ণনা। পাঠক ইতিমধ্যে দেবাশিসের বাড়ির সঙ্গে এতটাই পরিচিত, দীপার, এমনকি নকুলের সঙ্গেও, যে বাড়ির দোতলায় টেলিফোনের সামনে দাঁড়ানো দীপা ও ভেঙে পড়া নকুলকে পুরোপুরি দেখতে পান। অনেকটা যেন আত্মীয়তাও অনুভব করেন।

    এরপর হাসপাতালে দেবাশিসের ঘুম ভাঙে।

    “চোখ চেয়ে দেখল, একটি মুখ তার মুখের পানে অপলকে চেয়ে আছে। ভারী মিষ্টি মুখখানি। দেবাশিস আস্তে আস্তে বলল—“দীপা, কখন এলে?” দীপা উত্তর দিতে পারলো না, দেবাশিসের কপালে কপাল রেখে চুপ করে রইল।”

    কত অল্পক্ষণের মধ্যেই লেখক দীপার মানসিক পরিবর্তনকে পাঠকের গোচরীভূত করলেন—মনে হয় না কি যেন দু তিনটি ছোট ছোট দৃশ্যের মন্তাজে পুরো ঘটনা বিবৃত হল?

    সম্ভবতঃ এই উপন্যাস লেখার সময় এই নতুন ফর্ম তিনি পরীক্ষা করেছিলেন। যে কারণে কাহিনিটিকে গোয়েন্দা কাহিনি বলতেও তাঁর নিজের কিছু দ্বিধা ছিল। নাহলে কেন লিখবেন?

    “এই কাহিনিতে ব্যোমকেশ আছে, রহস্য আছে, খুন-জখম আছে, রহস্য ভেদ আছে, তবু এটা রহস্য কাহিনি কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না। পাঠক-পাঠিকা বিচার করবেন।”

    আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, এই পরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এমনকি পরবর্তীকালে কেউ যদি চিত্রনাট্যের উপাদান সহ উপন্যাস লিখতে চান, তার জন্য একটি বেশ অনুকরণযোগ্য সৃষ্টিও তিনি রেখে গেছেন।

    শেষকথা –

    একথা অনস্বীকার্য বাংলা সাহিত্যের কাছে চলচ্চিত্র বিপুল পরিমাণে ঋণী। কিছুটা হলেও সাহিত্যের জনপ্রিয়তার মাধ্যমে চলচ্চিত্র কি ঋণশোধ করেছে? সত্যজিৎ ও শরদিন্দুর মাধ্যমে? সাহিত্য কি বাস্তবানুগ হয়েছে? হয়েছে আরো সজীব এবং প্রাণবন্ত?

    কোন সাহিত্যের সবকটি সৃষ্টিই ধ্রুপদী ও কালজয়ী হবে তা আশা করা অনুচিত। এছাড়াও সাহিত্যের পাঠকগোষ্ঠীও বিবিধ শ্রেণীর। সুতরাং একেবারে উচ্চতম শ্রেণীর পাঠকবর্গকে বাদ দিলে অন্য সব পাঠকবর্গের কাছে এই ধরনের বাস্তবানুগ, প্রাণবন্ত অথচ মননশীল কাহিনির জনপ্রিয়তা অম্লান থাকে। আমাদের মতে সত্যজিৎ ও শরদিন্দুর জনপ্রিয়তার মূল কারণ এটিই। মনে রাখতে হবে একটি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এমন লেখকদের বিরাট অবদান থাকে।

    এছাড়া আর একটি প্রসঙ্গও উত্থাপন করা যায়। সুস্থ বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র বেশিরভাগ সময়েই আখ্যানধর্মী। তাই সেই চলচ্চিত্রে জোরালো চিত্রনাট্য এবং জীবন্ত সংলাপ একান্ত প্রয়োজনীয়। আগেই দেখেছি এই ব্যাপারে সত্যজিৎ রায় বিভূতিভূষণকে আদর্শ মেনেছেন। বিস্তারিত আলোচনাও করেছি আগের একটি প্রবন্ধে। [৭]

    আমরাও একমত। তবে বিভূতিভূষণের সৃষ্ট চরিত্র বা পটভূমি বেশ কিছু ক্ষেত্রেই গ্রামভিত্তিক।

    হাল আমলের পরিচালকদের একটি বড় অংশই শহরকেন্দ্রিক ও আধুনিক চরিত্রের ভাবধারার ভিত্তিতে তাঁদের চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন।

    সুতরাং, নগরকেন্দ্রিক চরিত্র ও কাহিনি নিয়ে যদি কেউ বিনোদনমূলক, জনপ্রিয় এবং সুস্থরুচির সিনেমা করতে চান, আমার মতে তাঁর শরদিন্দু পাঠ অতি আবশ্যক। শুধু পাঠ নয়, “শজারুর কাঁটা” বা অন্যান্য ব্যোমকেশ কাহিনিগুলির গভীর বিশ্লেষণ ও মননশীল আলোচনা তাঁকে অনেক ভাবে লাভবান করবে। সুস্থ ও জনপ্রিয় মনোরঞ্জনের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রও আবার প্রগাঢ় দর্শকানুকূল্য লাভ করবে বলেই আমাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস।


    [১] আমার সাহিত্য জীবন—তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় - বেঙ্গল পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ, শ্রাবণ, ১৩৬০, পৃ - ১৩

    [২] রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার ও পুনরাবিষ্কার—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়—দেজ পাবলিশার্স—পৃঃ ৩৯

    [৩] চলচ্চিত্র প্রবেশিকা—শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়—শরদিন্দু অমনিবাস—আনন্দ—প্রথম সংস্করণ, ২য় মুদ্রণ—পৃঃ ৩৫৩

    [৪] অব্যর্থ ব্যোমকেশ—শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়—চিরায়ত শরদিন্দু—দ্য কাফে টেবিল—প্রথম সংস্করণ—পৃঃ - ৭০

    [৫] বিষয় চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়; অষ্টম মুদ্রণ; আনন্দ; সেপ্টেম্বর ২০০৯; পৃ: ৫৯

    [৬] বিষয় চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়; অষ্টম মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর—২০০৯, পৃ: ৯৮

    [৭] https://www.parabaas.com/PB77/LEKHA/pBhaskar77.shtml




    অলংকরণ (Artwork) : ছবিগুলি--আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments