পর্ব ১
সংস্কৃতভাষায় বিকল্প প্রয়োগের এত গুরুত্ব ছিল যে ব্যাকরণশাস্ত্রে ‘বা’ কিংবা ‘অন্যতরস্যাম্’ শব্দ দিয়ে বিকল্প প্রয়োগের নির্দেশ করা হত। ভাষা একটি অন্তহীন বহতা ধারা, তার মধ্যে গড়ে-ওঠা নানা প্রয়োগকে এভাবে স্বীকার করে নেওয়া হত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘ব্যাকরণ-কৌমুদী’ বাঙালির সংস্কৃতশিক্ষাকে লালন করে চলেছে উনিশ শতক থেকে। সে বই পড়তে গেলে কতবার যে পাই এই উক্তি --- পক্ষে এই হবে, বিকল্পে এই হবে। যেমন, ণত্ব বিধানের অধ্যায়ে পাওয়া যায়, সমাসবদ্ধ শব্দ হলে ণত্ব খাটবে না, তাই ‘হরিণাম’ নয়, ‘হরিনাম’; কিন্তু ‘গিরি’ ও ‘নদী’ শব্দের সমাসে পক্ষে ‘গিরিনদী’ ও বিকল্পে ‘গিরিণদী’ হবে। আবার, সংজ্ঞা (proper noun) বোঝালে নির্বিকল্প ভাবে ণ হবে, যেমন, ‘শূর্পণখা’। সেখানে কোনো বিকল্প নেই। এই ছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতি। পক্ষ ও বিকল্পের দ্বৈততা সেখানে খুব সহজেই মেনে নেওয়া হত। শিক্ষিত বাঙালিরা যখন সকলেই মজবুত রূপে সংস্কৃত জানতেন তখনও এই রীতি দিব্যি বহাল ছিল। ‘সংক্ষিপ্ত’-র পাশাপাশি ‘সংক্ষেপিত’, ‘বিশ্লিষ্ট’-র পাশে ‘বিশ্লেষিত’, ‘অনূদিত’-র পাশে ‘অনুবাদিত’ প্রয়োগ হত। এগুলো যে পুরোপুরি বিকল্পের উদাহরণ এমন কথা বলছি না কারণ এদের মধ্যে শব্দগঠনের অনেক গূঢ় বিষয় নিহিত আছে। কিন্তু আজকের যুগে যেমন ‘সংক্ষিপ্ত’ ‘বিশ্লিষ্ট’ ইত্যাদি বিকল্পহীন ভাবে বিহিত হয়ে গেছে এবং ‘সংক্ষেপিত ভুল’ বলা চালু হয়েছে তখন তা ছিল না। এমনকি নানাবিধ অসাধু অর্থাৎ অশুদ্ধ প্রয়োগও বাংলায় প্রচলিত ছিল, পণ্ডিত ব্যক্তিরাও ভুলটুল করতেন। কিন্তু বিদ্বৎসমাজ মোটের ওপর সহিষ্ণু ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় ‘নিষ্প্রয়োজনীয়’ শব্দ পাওয়া যায় (‘কমলাকান্তের দপ্তর’), তা নিয়ে কি কেউ ‘বঙ্কিমবাবু ভুল লেখেন’ বলে হইচই করেছে? সেই বঙ্কিমচন্দ্রই আবার অন্যত্র সমাসের নিয়ম মেনেই ‘নিষ্প্রয়োজন’ লিখেছেন।
একালের বাঙালি পণ্ডিত কিন্তু কোনো বিকল্প মানতে রাজি নন। এটা একটা আধুনিক প্রবণতা। বানানে সমতা আনার স্বার্থে যথাযোগ্য বিধান দেওয়া যেতেই পারে, তাতে একটা বানান-রূপ বদলে আরেকটা রূপ আসে --- সেটা বানানের একটা পর্বান্তর। কিন্তু বাংলাভাষা শিক্ষার সামগ্রিক অধোগতির ফলে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে যে বাঙালি ‘কেন’ ‘যেন’-র জায়গায় নিশ্চিন্তে ‘কেনো’ ‘যেনো’ লিখছে, ‘হয়’ ‘যায়’-এর জায়গায় ‘হই’ ‘যাই’ লিখছে, অথচ অন্যদিকে অপরের ভুল ধরার একটা ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠেছে। কীরকম ভুল? ‘রচনাবলী’ লিখলে লোকে বলে দিচ্ছে ‘রচনাবলী ভুল, রচনাবলি লিখুন’, ‘তরণী’ লিখলে চেঁচিয়ে উঠছে ‘বানানটা ভুল করলেন জনাব, তরণি লিখেন’। অথচ এই যে হ্রস্ব-ই দীর্ঘ-ঈ-এর তফাত, সেটা সংস্কৃতে দু’টি শব্দরূপাদর্শের তফাত মাত্র। অর্থাৎ, বিকল্প শব্দের ব্যাপার। বানানবিধি তৈরি করতে গিয়ে পণ্ডিতেরা মনে করলেন হ্রস্ব-ই বাঙালির পক্ষে সহজতর, তাই দীর্ঘ-ঈ বিদায় করা হল। এবং লোকের ধারণা হতে লাগল আগেরটা যখন বাদ দিয়েছে, নিশ্চয় ভুল ছিল। ক্রমে ক্রমে এমন ই-কার-খ্যাপা যুগ পড়ল যে আজকাল ‘কালিপূজা’ ‘ইদানিং’ ‘আগামিকাল’ কী না লেখা হচ্ছে। বানানের মতো অশুদ্ধিপ্রবণ ব্যাপারে প্রচলিত অভ্যাসে হঠাৎ আঘাত করলে যা হয় এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। উদোর পিণ্ডি যত্র তত্র বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। আমার প্রদত্ত নমুনাগুলো অবিশ্বাস্য হলে অনুরোধ, বাঙালির ফেসবুকে চোখ রাখুন। ফেসবুকই এখনকার সমাজদর্পণ, সব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। তার পাশাপাশি ছাপা বই ও পত্রপত্রিকা, এবং বিজ্ঞাপনের বয়ান। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকেরাও আছে। আমারও উপাত্ত (data) এই উৎসগুলি থেকেই কুড়িয়ে-নেওয়া। --- আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, সবার গোচরে দিয়েছি / লহো লহো আপন করে।
মুশকিল হয় যখন কোনো মান্য ব্যক্তি শব্দের বিষয়ে কোনো নতুন ঘোষণা করেন। মান্য ব্যক্তি কে? না, কোনো সামাজিক সম্পর্কের সূত্রে আমার কাছে একজন ব্যক্তি মান্য, আপনার কাছে আরেকজন। ধরে নেওয়া যেতে পারে এঁরা প্রধানত মাস্টারমশাই অথবা পরিচিত ভাষাতাত্ত্বিক। কিংবা অভিধান। কেউ হয়তো বললেন ‘সার্বজনীন’ কথাটা ভুল, ‘সর্বজনীন’ হবে, কেউবা বললেন ‘সঠিক’ কথাটা ভুল, অমনি সে বাণী দৈববাণীর মতো আমাদের সরল নির্মল প্রাণে গেঁথে গেল। সত্যি কি ভুল? তা দেখতে গেলে কোথাও সংস্কৃত প্রত্যয়ের গভীরে ডুব দিতে হয়, কোথাও সকারাদি শব্দ নামে একটি বিরাট শ্রেণির অন্বেষণ করতে হয়।
আপনারা লক্ষ করে থাকবেন আমি যে উদাহরণগুলি এখনও পর্যন্ত দিয়েছি তা প্রায় সবই তৎসম শব্দ। বর্তমান আলোচনা মূলত তৎসম শব্দেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যাঁরা এ যুগেও মনে করেন, ‘পক্ষী’ থেকে ‘পাখি’, ‘হস্তী’ থেকে ‘হাতি’, তাই ‘পাখী’ ‘হাতী’ লেখা উচিত, আমি তাঁদের দলে নেই। বস্তুতপক্ষে, বানানের শুদ্ধাশুদ্ধ আমার আলোচ্যই নয়। বাংলায় তৎসম শব্দ বিষয়ে যেসকল নির্বিকল্প অভিমতের ফুলকি আমাদের আলোকিত করছে আজকাল, মায়া ও বিভ্রম ঘটাচ্ছে, তারই কিছু কিছু আমি একটু তলিয়ে দেখতে চাই। আমি চেষ্টা করেছি প্রতিটি প্রশ্নের গভীরতম উৎসে পৌঁছোতে। সে উৎস অধিকাংশ স্থলেই পাণিনি। সকলেই জানেন, ইউক্লিডের জ্যামিতি যেমন গণিতশাস্ত্রের বিস্ময়, পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ব্যাকরণ তেমনি সমগ্র পৃথিবীতে ভাষাবিজ্ঞানের বিস্ময় ও ভারতীয় মেধার কীর্তিসৌধ। পাঠকের প্রয়োজন যতটুকুই হোক না কেন, আলোচককে উৎসে পৌঁছোতেই হবে। এবারকার পর্বে কয়েকটি প্রশ্নের পর্যালোচনা করেছি। পর্বান্তরে আরও কয়েকটি বিষয়ের সমীক্ষা করবার ইচ্ছে রইল।
প্রথমে একটা ব্যক্তিগত কাণ্ড দিয়ে শুরু করি।
ঈর্ষ্যা ও ঈর্ষা
অনেকে হয়তো জানেন না, 'ঈর্ষা' শব্দের আদি বানান 'ঈর্ষ্যা'। অনেকে বলেন, 'ঈর্ষ্যা'-ই খাঁটি বানান, ‘ঈর্ষা’ অশুদ্ধ। কথাটা শুনেছিলাম নিতান্ত অল্পবয়সে আমার পিতৃদেবের কাছে। তিনি বাংলাসাহিত্যের অধ্যাপক ও সংস্কৃতে বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন। ছেলেমানুষ হলে যেমন হয় আরকি, খাঁটি থাকব এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছুকাল য-ফলা সহ ‘ঈর্ষ্যা’ লেখা চালুও করে দিয়েছিলাম। একবারও কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখি নি বাবা নিজেও ওইরকম লেখেন কি না।
কথাটা সম্প্রতি মনে পড়ে গেল যখন জানলাম বিদগ্ধ ভাষাতাত্ত্বিক ক্ষিতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই 'ঈর্ষ্যা'-র য-ফলার হয়ে সওয়াল করেছেন। য-ফলাহীন 'ঈর্ষা'-কে তিনি ধর্তব্যের মধ্যে আনেন নি। তিনি ভেবেছেন 'চিকীর্ষা' ইত্যাদি শব্দের সাদৃশ্যে বাংলায় এই য-লোপ ঘটেছে। ক্ষিতীশচন্দ্র এমন সম্ভ্রম-জাগানো বিদ্বান্ যে তাঁর কথা অবিশ্বাস করা চলে না। অতএব খুব মুহ্যমান হয়ে গেলাম। এতকাল 'ঈর্ষা' লিখে আসছি, সকলে লিখছে, অভিধান বলছে, এখন কি বুড়োবয়সে 'ঈর্ষ্যা' লিখতে পারব? এর থেকে তো ধূমপান ছেড়ে দেওয়া সহজ।
কাজেই বইপত্র ঘাঁটতে হল। জানলাম, বৈদিক বানানটা 'ঈর্ষ্যা'-ই ছিল। 'ঈর্ষ্য্' নামে একটা ধাতুও ছিল, 'ঈর্ষ্যতি' ইত্যাদি রূপ হত। ব্যাকরণ-কৌমুদীর পরিশিষ্টে ‘ধাতুরূপাদর্শ’ অধ্যায়েও ঈর্ষ্য্-ধাতু পাওয়া যায় --- ভূ-আদিগণীয় ধাতু, পরস্মৈপদী রূপ হয়। কিন্তু রামায়ণ মহাভারতেই য-ফলাবর্জিত 'ঈর্ষা' শব্দ দেখা গেল। রামায়ণে পাওয়া গেল, 'ঈর্ষাং ন কুরুষে'। পরবর্তী কালে বৈয়াকরণ বোপদেব তাঁর সুবিখ্যাত ব্যাকরণ 'মুগ্ধবোধ'-এর একটি সূত্রে (৭৭৫ সংখ্যক) 'ঈর্ষা' বানান সিদ্ধ করে দিলেন। এই মুগ্ধবোধ বাঙালিরা খুব পড়তেন। বালক রবীন্দ্রনাথকে ভোরে উঠে মুগ্ধবোধের শ্লোক মুখস্থ করতে হত। সুতরাং 'ঈর্ষা' বানান প্রখ্যাত ব্যাকরণের সমর্থনেই সংস্কৃতে ও বাংলাভাষায় স্থায়ী হয়েছে। চৈতন্যচরিতামৃতেই 'ঈর্ষা উৎকণ্ঠা' পাওয়া যাচ্ছে। চরিতামৃতকার সংস্কৃতে দুর্ধর্ষ পণ্ডিত ছিলেন। এসব জেনে 'ঈর্ষ্যা'-র ভয় থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আধুনিক বাংলায় হিংসুটে অর্থে 'ঈর্ষাপরায়ণ', 'ঈর্ষান্বিত', 'ঈর্ষাকাতর' দিয়েই কাজ চলে, কিন্তু সংস্কৃতে ছিল 'ঈর্ষালু', 'ঈর্ষু', 'ঈর্ষ্যী', 'ঈর্ষ্যক', 'ঈর্ষ্যমাণ'।
অর্থনৈতিক, আর্থনীতিক ইত্যাদি
মাঝে মাঝে অনেকের লেখায় 'অর্থনৈতিক'-এর জায়গায় 'আর্থনীতিক' শব্দ দেখা যায়। কিন্তু সেই লেখকেরাই যে 'সমসাময়িক' স্থলে 'সামসময়িক' বা 'প্রত্নতাত্ত্বিক' স্থলে 'প্রাত্নতত্ত্বিক' লেখেন এমন নয়। 'অর্থনীতি' শব্দের সঙ্গে তদ্ধিত 'ইক' প্রত্যয় জুড়ে তাঁরা আদ্যস্বর অ-এর বৃদ্ধি ঘটিয়ে ‘আ’ করছেন কারণ 'ইক' প্রত্যয়ে সাধারণত আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয়, যেমন 'ইতিহাস' থেকে 'ঐতিহাসিক'। সেই একই নিয়মে 'সামসময়িক’ ‘প্রাত্নতত্ত্বিক’ ইত্যাদি হবার কথা। এখানে সমস্যার গোড়ায় আছে সমাসবদ্ধ পদ --- ‘সমসময়’ ‘প্রত্নতত্ত্ব’ ‘অর্থনীতি’। প্রত্যয় যুক্ত হলে আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হবে সমাসের পূর্বপদে, না উত্তরপদে? যেমন, ‘অর্থ’ থেকে ‘আর্থ’ হবে, না ‘নীতি’ থেকে ‘নৈতিক’ হবে? কোন্টা ঠিক, কোন্টা ভুল? এটা অতিশুদ্ধির সংকট, এবং এর ইতিহাসটা বিচিত্র।
প্রাচীন সংস্কৃতই এমন অতিশুদ্ধি মেনে চলে নি। রামায়ণ মহাভারত এবং কালিদাসেই 'গুরুলাঘব' শব্দটি আছে, তার অর্থ গুরুত্ব ও লঘুত্ব। 'গুরু' বা 'লঘু'-র সঙ্গে ত্ব-প্রত্যয় জুড়ে যেমন 'গুরুত্ব' ও 'লঘুত্ব' শব্দ তৈরি হয়, তেমনি অণ্-প্রত্যয় জুড়ে একই অর্থে হয় 'গৌরব' ও 'লাঘব'। 'ঋজু'-র সঙ্গে অণ্-প্রত্যয় জুড়ে ‘আর্জব’ হয়; তা(তল্)-প্রত্যয় জুড়ে হয় ‘ঋজুতা’। ‘গুরুলঘু’ এই সমাসবদ্ধ শব্দের সঙ্গে অণ্-প্রত্যয় যোগ হয়ে ‘গুরুলাঘব’ হল। পূর্বপদ গুরু-র আদ্যস্বরে বৃদ্ধি ঘটালে লিখতে হত ‘গৌরুলঘব’। কালিদাস শকুন্তলা নাটকে লিখেছেন, ‘ভবন্তমেবাত্র গুরুলাঘবং পৃচ্ছামি।’ অর্থ, এখানে কীসে বেশি দোষ কীসে কম দোষ আপনাকেই প্রশ্ন করছি। অতিশুদ্ধি মেনে লিখলে তাঁকে লিখতে হত ‘গুরুলাঘব’ নয়, ‘গৌরুলঘব’। রামায়ণে লেখা হয়েছে, ‘গুরুলাঘবমর্থানামারম্ভেষ্ববিতর্কয়ন্’। মহাভারতেও এই ‘গুরুলাঘব’ শব্দ আছে। প্রত্যয় যোগে পূর্বপদ গুরু-র আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয়ে 'গৌরুলঘব' হল না, উত্তরপদ লঘু-র আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয়ে 'গুরুলাঘব' হল। প্রাচীন সংস্কৃতসাহিত্যেই তাহলে 'উত্তরপদবৃদ্ধি'-র একটা বিশিষ্ট নমুনা পাওয়া গেল।
সুতরাং 'অর্থনীতি' থেকে 'ইক' প্রত্যয়যোগে যে 'অর্থনৈতিক' হচ্ছে সেখানে এই উত্তরপদবৃদ্ধি কাজ করছে। এতে কোনো দোষ নেই। এইভাবেই 'সমসাময়িক', 'প্রত্নতাত্ত্বিক', 'রাজনৈতিক' ইত্যাদিতেও দোষ নেই। বিশেষত 'সাময়িক' 'তাত্ত্বিক' 'নৈতিক' শব্দগুলো চালু থাকাতে এগুলোকেই বেশি স্বাভাবিক লাগে। একই কারণে ‘গৌরুলঘব’-এর তুলনায় ‘গুরুলাঘব’ বেশি স্বাভাবিক লাগে। 'আর্থনীতিক' ভুল তো নয়, হয়তো একটু বেশি মাত্রায় শুদ্ধ, ভাষার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে যেন অতিশুদ্ধির জয়ধ্বজা উচ্চে তুলে ধরেছে। এরকম শব্দ ব্যবহার করবার আগে তার পরিণাম (consequences) আমাদের ভেবে দেখা উচিত, বিবেচনা করা উচিত আরও কতগুলো অতিপরিচিত শব্দে এই শুদ্ধতার অভিঘাত গিয়ে পড়বে। 'আর্থনীতিক' লিখলে যেমন একই নিয়মে 'সামসময়িক' 'প্রাত্নতত্ত্বিক' ‘পারলোকিক’ ইত্যাদি লিখতে হবে।
আমি বরং একটু কৌতূহল প্রকাশ করব অন্য একটি শব্দগঠন নিয়ে --- 'আর্থ-সামাজিক', ইংরেজি socio-economic থেকে যা তৈরি হয়েছে, অথচ economic থেকে উত্তরপদ নয়, পূর্বপদ হয়েছে বাংলায়। এখানে তো দেখি পূর্বপদেও স্বরের বৃদ্ধি, উত্তরপদেও স্বরের বৃদ্ধি। অত্যন্ত কৌতূহলজনক অবয়ব সন্দেহ নেই।
আলোচনাটা এই জায়গায় ছেড়ে দিলে সেটা অনেকটা whataboutery-র মতো দাঁড়ায়। যেন, অমুকে লিখেছে, তো আমরা লিখলে দোষ কী? তাই কেবল প্রত্যুদাহরণের (counterexamples) বাইরে গিয়ে কিছু মৌলিক অনুসন্ধান করে দেখতে হয়।
রামায়ণ মহাভারত শকুন্তলা প্রভৃতির দৃষ্টান্ত থেকে মনে হয় যেন উত্তরপদবৃদ্ধি সংস্কৃতভাষায় শুরু হয়েছিল পাণিনির অনেক পরে এবং পরবর্তী যুগের বৈয়াকরণেরা এই প্রয়োগকে সিদ্ধ করেছিলেন। আসল ঘটনা কিন্তু তা নয়। সমাসবদ্ধ পদে তদ্ধিত প্রত্যয়যোগে পূর্বপদবৃদ্ধি উত্তরপদবৃদ্ধি ও উভয়পদবৃদ্ধি সবই কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে স্বয়ং পাণিনিই নিয়মবদ্ধ করে গেছেন। সংস্কৃত ব্যাকরণের যে আশ্চর্য নমনীয়তা, নানা বিকল্পকে আলিঙ্গন করার যে অশেষ ক্ষমতা, তার পরিচয়টা এখানে আরেকবার পেয়ে পুলকিত হতে হয়। সেই পাণিনীয় সূত্রগুলি একটু লিখে ফেলি। সূত্রপরবর্তী বন্ধনীতে সূত্রসংখ্যা দেওয়া হল, তার মধ্যে প্রথমটি অধ্যায়, দ্বিতীয়টি পাদ, শেষটি সূত্রের ক্রমিক সংখ্যা।
শব্দের পূর্বপদের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি:
১/ 'অচো ঞ্ণিতি' (৭|২|১১৫)। 'অচ্' বোঝায় পাণিনি-ব্যাকরণের সূচনায় মাহেশ্বর সূত্রের একটি 'প্রত্যাহার', যার মধ্যে স্বরবর্ণগুলি আছে। তাই 'অচ্' বোঝায় যাবতীয় স্বরবর্ণ। 'হল্' আরেকটি 'প্রত্যাহার', তা বোঝায় যাবতীয় ব্যঞ্জনবর্ণ। (মাহেশ্বর সূত্র বিষয়ে পরবর্তী পরিচ্ছেদে আরেকটু বিশদে বলেছি।) 'অচঃ' অর্থ ‘অচ্-এর’। এখানে ষষ্ঠী বিভক্তি আছে --- পাণিনীয় সূত্রাদিতে তা প্রধানত বোঝায় ‘অমুকের স্থানে’ (সূত্র ‘ষষ্ঠী স্থানেযোগা’, ১|১|৪৯)। তাই ‘অচঃ’ বোঝাবে ‘অচ্-এর স্থানে’। অচঃ + ঞ্ণিতি = অচো ঞ্ণিতি (বিসর্গসন্ধির নিয়মে)। ঞ্ণিতি-র মধ্যে মূল শব্দ 'ঞ্ণিৎ', অর্থাৎ ঞ্ণ্ + ইৎ। মানে যে প্রত্যয়ের ঞ্ বা ণ্ ‘ইৎ’ অর্থাৎ লুপ্ত হয়। প্রত্যয়ের নামে তার কার্যকর অংশ ছাড়া কিছু বাড়তি বর্ণ থাকে, তারা নানা ধ্বনিপরিবর্তন নির্দেশ করে ও কার্যকালে ইৎ (লুপ্ত) হয়। ‘ইৎ’ সংস্কৃত ব্যাকরণের একটি সর্বব্যাপ্ত পরিভাষা, বর্ণের লুপ্তি সহজে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ‘লুপ্তি’ বা ‘লোপ’ শব্দ দ্বারা ‘ঞ্ণিৎ’ বোঝানো কত জটিল হত তা বলাই বাহুল্য। ‘ঞ্ণিতি’ হয়েছে সপ্তমী বিভক্তিতে, অর্থ ‘ঞ্ণিৎ-এ’। তাহলে 'অচো ঞ্ণিতি' সূত্রের আক্ষরিক মানে দাঁড়াচ্ছে 'ঞ্ণিৎ-এ অচ্-এর স্থানে'। কিছু বোঝা গেল না এ থেকে। এরকমই অতিসংক্ষিপ্ত হিং-টিং-ছট্ ধরনেই লেখা হত সংস্কৃতভাষায় শাস্ত্রাদি, তারপরে তার 'বৃত্তি' ও 'ভাষ্য' দ্বারা মর্মার্থ বোঝা যেত। 'অচো ঞ্ণিতি' বা 'ঞ্ণিৎ-এ অচ্-এর স্থানে' বাক্যটির আসল অর্থ হল, শব্দের অন্তে যুক্ত যেসব অঙ্গে ঞ্ ও ণ্ ইৎ হয় সেসব যুক্ত হলে শব্দের আদ্যস্বরের (স্বর অর্থাৎ অচ্) বৃদ্ধি হবে। এই সূত্রানুসারে দশরথ-ইঞ্ > দাশরথি, মনু-অণ্ > মানব (অ > আ, বৃদ্ধি)। লক্ষণীয়, প্রত্যয়ের নাম ইঞ্ বা অণ্, ই বা অ শব্দের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, ঞ্ / ণ্ লুপ্ত (ইৎ) হচ্ছে, কেবল আদ্যস্বরের বৃদ্ধি নির্দেশ করা তাদের কাজ।
এই সূত্রটা একটি সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য প্রস্তাবনা মাত্র, বিভক্তি, কৃৎ প্রত্যয় ও তদ্ধিত প্রত্যয় সবকিছুর জন্যই সত্য, বিশেষ ভাবে তদ্ধিতের জন্য নয়। সেগুলি আসছে এর পরে।
২/ 'তদ্ধিতেষ্বচামাদেঃ' (৭|২|১১৭)। এ সূত্র নির্দিষ্ট ভাবে তদ্ধিত প্রত্যয়ের জন্য। অর্থ, তদ্ধিতেষু (তদ্ধিতগুলিতে) অচাম্ (অচ্-দের) আদেঃ (আদির)। তদ্ধিতে আদির অচ্-দের (আদ্য স্বরবর্ণের) বৃদ্ধি হবে। শব্দটির মধ্যে যত স্বরবর্ণ আছে তাদের আদ্য স্বরটির বৃদ্ধি হবে। অর্থাৎ, সমাসবদ্ধ শব্দে পূর্বপদেরই আদ্যস্বর বৃদ্ধি হবে। যেমন, অশ্বপতি-অণ্ > আশ্বপত, গণপতি-অণ্ > গাণপত। দু’ক্ষেত্রেই অ > আ (বৃদ্ধি)।
৩/ 'কিতি চ' (৭|২|১১৮)। এটি আগের সূত্রের ‘অনুবৃত্তি’ বা carried over --- অর্থ, ক্-ইৎ (বা ক-কারেৎ) প্রত্যয়েও আগের সূত্রের মতো হবে। তাই, ইতিহাস-ঠক্ (ইক) > ঐতিহাসিক (ই > ঐ, বৃদ্ধি), প্রাতিপদিক, প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক, সাম্প্রতিক। (পাণিনীয় ব্যাকরণে ঠ-বর্ণ ইক-প্রত্যয় নির্দেশ করে। তার তিনটি জাত, ঠক্, ঠঞ্, ঠন্।)
উত্তরপদের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি:
৪/ 'উত্তরপদস্য' (৭|৩|১০)। কোনো কোনো শব্দে কেবল উত্তরপদের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয়। এই সেই 'উত্তরপদবৃদ্ধি'। এভাবেই গুরুলাঘব, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক (কৌটনীতিক নয়), প্রশাসনিক (প্রাশাসনিক নয়), সমসাময়িক, প্রত্নতাত্ত্বিক, দ্বিপাক্ষিক, দ্বিমাসিক, পঞ্চবার্ষিক, শতবার্ষিকী, অতিলৌকিক, অলৌকিক, মহানাগরিক, মহাজাগতিক, বীজগাণিতিক, সরলরৈখিক, বহুমাত্রিক, আরও কত কী।
এই ‘উত্তরপদস্য’ একটি ‘অধিকার সূত্র’ এবং পরবর্তী ৭|৩|৩১-সংখ্যক পাণিনীয় সূত্র পর্যন্ত সমস্ত সূত্রে অন্য যে বৃদ্ধিই হোক, ‘উত্তরপদবৃদ্ধি’-ও প্রযোজ্য হবে।
উভয়পদের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি:
'উত্তরপদস্য' (৭|৩|১০) সূত্র থেকে ‘যথাতথযথাপুরয়োঃ পর্যায়েণ’ (৭|৩|৩১) পর্যন্ত নানা সূত্রে পূর্বপদ ও উত্তরপদ উভয়েরই বৃদ্ধির কথা এসেছে। তার মধ্যে দু’টি সূত্র উল্লেখ করছি।
৫/ 'হৃদ্-ভগ-সিন্ধ্বন্ত পূর্বপদস্য চ' (৭|৩|১৯)। ঞ্ ণ্ ক্ ইৎ হয় এমন প্রত্যয় পরে থাকলে হৃদ্ ভগ ও সিন্ধু ভাগান্ত (সিন্ধ্বন্ত = সিন্ধু + অন্ত) শব্দের উভয়পদের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয়। যথা, সুহৃদ্-অণ্ > সৌহার্দ, সুহৃদ্-ষ্যঞ্ > সৌহার্দ্য (বৃদ্ধি: সু > সৌ, হৃ > হার্), সুভগ-ষ্যঞ্ > সৌভাগ্য (বৃদ্ধি: উ > ঔ, অ > আ)। আবার বিকল্পে সুহৃদ্ থেকে অণ্ প্রত্যয় যোগে কেবল পূর্বপদের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হতে পারে --- সৌহৃদ, যার অর্থ ওই সৌহার্দ্য। কালিদাস 'রম্যাণি বীক্ষ্য' প্রসঙ্গে লিখেছেন 'জননান্তরসৌহৃদানি', জন্মান্তরের সৌহৃদ(সৌহার্দ্য)-সমূহ।
৬/ 'অনুশতিকাদীনাং চ' (৭|৩|২০)। 'অনুশতিক' প্রভৃতি শব্দেরও উভয়পদের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয়। অনুশতিক-অণ্ > আনুশাতিক, ইহলোক-ঠক্ > ঐহলৌকিক, পরলোক-ঠক্ > পারলৌকিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক, সার্বভৌম, ইত্যাদি ইত্যাদি। একান্ত আধুনিক শব্দ ‘আর্থ-সামাজিক’ (socio-economic) এই নিয়মেই সিদ্ধ হবে।
অতএব শব্দে যদি একাধিক পদ থাকে তাহলে কোন্ পদে আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হবে তা নিয়ে প্রায় কোনো অতিশুদ্ধির জায়গা নেই সংস্কৃত ব্যাকরণে। বৃদ্ধিটা ঠিকঠাক হলেই হল, এবং শব্দটা স্বাভাবিক লাগলেই হল।
এই বৃদ্ধি সূত্রে মনে পড়ে, ‘রবীন্দ্র’ থেকে ইক-প্রত্যয়ে ‘রাবীন্দ্রিক’, আদ্যস্বর অ-এর বৃদ্ধি হয়ে আ-কার। জীবনানন্দ ‘রবি’ থেকে তৈরি করেছিলেন ‘রৈবিক’ বলে একটি উদ্ভট শব্দ, কারণ ‘অ’ থেকে ‘ঐ’ হয় না। কিন্তু এই ‘রৈবিক’ কোনো কোনো মহলে চালু হয়ে গেল।
কার্ত্তিক/কার্তিক, বার্ত্তিক/বার্তিক: একটি মহাপ্রশ্ন
এ যুগেও অনেককে লিখতে দেখা যায় ‘চর্চ্চা’ ‘বর্দ্ধন’ ইত্যাদি এবং জাঁক করে বলতে শোনা যায় যে ওই ব্যঞ্জনের দ্বিত্বটাই শুদ্ধতর, যদিও এ প্রশ্ন সংস্কৃত ব্যাকরণের সমর্থনেই আজ থেকে চুরাশি বছর আগে মীমাংসিত হয়ে গেছে। তবু অন্য একটা বড়ো প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর যেন এখনও পাওয়া যায় না। তা নিয়েই এ আলোচনা।
১| রেফে বিকল্পে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব: 'অচো রহাভ্যাং দ্বে' (অষ্টাধ্যায়ী, সূত্র ৮|৪|৪৬)
'কৃত্তিকা' থেকে 'কার্ত্তিক', 'বৃত্তি' থেকে 'বার্ত্তিক'। ‘কার্ত্তিক’, না ‘কার্তিক’; ‘বার্ত্তিক’, না ‘বার্তিক’? মূল শব্দেই যদি ‘ত্ত’ থাকে তাহলে অপত্য প্রত্যয় যোগে যে শব্দ উৎপন্ন হল তাতে একটিমাত্র ‘ত’ দিয়ে 'কার্তিক' 'বার্তিক' হবে কেন? অনেকে 'রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন' বলে এ প্রশ্নের চটজলদি উত্তর দিতে চান, কিন্তু সে উত্তরে সবকিছু মেলে না। কারণ ‘ত্ত’ যে দ্বিত্বটা ছিল তা রেফের দ্বিত্ব নয়। রেফ এল মূল শব্দের ঋ-কার প্রত্যয় যোগে বৃদ্ধি হয়ে 'আর্' হবার ফলে। ‘ত্ত’ তার আগে থেকেই ছিল। এখানে তাই 'রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন'-এর প্রসঙ্গটা ঠিক খাটে না।
বাংলা লেখায় রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব প্রচলিত ছিল সেটা ঐতিহাসিক সত্য। তার উদাহরণ, 'সর্ব্ব' 'কর্ম্ম' 'মূর্ত্তি' ‘বর্জ্জন’ ‘আচার্য্য’ ইত্যাদি এককালে লেখা হত। ভট্টাচার্য-পদবীধারী যেসব বংশ ইংরেজিতে দুটো y দিয়ে Bhattacharyya লেখেন তাঁরা আসলে য-এর দ্বিত্বওয়ালা ‘ভট্টাচার্য্য’ বানান প্রতিফলিত করতে চান। এমনকি বাঙালি যে 'ঊর্ধ্ব' শব্দের ব-ফলা বাদ দিয়ে বসে, 'ঊর্দ্ধ' লেখে, তাও দ্বিত্বযুক্ত 'ঊর্দ্ধ্ব' ভুল পড়ার ফল। এখানে ধ-টাই আসল, সে ঘোষবর্ণ বলে তার দ্বিত্ব হল অঘোষ দ-এর সঙ্গে। এভাবে গর্ভ-কে গর্ব্ভ-ও লেখা হত, ১৮৩১ সনে প্রকাশিত 'হিতোপদেশ'-এর একটি ত্রিভাষিক সংস্করণে (সংস্কৃত-বাংলা-ইংরেজি) আমি সে বানান দেখেছি।
রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব আসলে একটি বানান-বিকল্প। পক্ষে সিঙ্গল, বিকল্পে ডাবল। এটি আসছে পাণিনীয় সূত্র 'অচো রহাভ্যাং দ্বে' থেকে। সে সূত্র বলছে যে অচ্-এর বা স্বরবর্ণের পরে র বা হ থাকলে হ-ভিন্ন ব্যঞ্জনের বিকল্পে দ্বিত্ব হবে। হ-এর পরে দ্বিত্বের উদাহরণ 'ব্রহ্মা' / 'ব্রহ্ম্মা' সংস্কৃতে ছিল। 'বিকল্পে হবে' কথাটা এখানে গুরুতর। কিন্তু কোনো কারণে বাঙালিরা এই দ্বিত্ব-বিকল্পই নির্বিকল্প ভাবে ব্যবহার করতেন। যেখানে রেফ আসছে একটি সন্ধির ফলে, যেমন ‘উপরি + উপরি’, সেখানেও তাঁরা লিখতেন 'উপর্য্যুপরি'। এটা একটা চূড়ান্ত নমুনা বলে মনে হয় আমার। কারণ ‘উপর্য্যুপরি’ সন্ধি ভাঙলে আমরা কী পাই? না, ‘উপর্যি + উপরি’। কোথায় গেল ‘উপরি + উপরি’? জানি না সে যুগের ছাত্রেরা ‘উপর্য্যুপরি’ সন্ধি বিচ্ছেদ করে টিপ্পনী দিত কি না, ‘ইহাতে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব রেফ হইতে আসিয়াছিল।’ বানানেরও একটি প্রচলিত অভ্যেস থাকে, এটা তারই ফল। এমন নয় যে সিঙ্গল ব্যঞ্জন অশুদ্ধ ছিল। এবং ভারতের সব প্রদেশ যে সংস্কৃত বানানে এই দ্বিত্ব গ্রহণ করেছিল তাও নয়। মনিয়র-উইলিয়ামসের সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে এই দ্বিত্ব দেখা যায় না; কিন্তু তিনি ‘কার্ত্তিক’ ‘কার্ত্তিকেয়’ ‘বার্ত্তিক’ শব্দে ‘ত্ত’ রেখেছেন।
এরপর একালে এল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতি। ১৯৩৬-এ রাজশেখর বসুর নেতৃত্বে তাঁরা যেসব সংস্কার প্রস্তাব করলেন তার মধ্যে সরলীকরণ ও বাহুল্যবর্জনের স্বার্থে তাঁরা রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জনের বিধান দিলেন। অর্থাৎ, পাণিনীয় সূত্রোক্ত প্রধান বিকল্পটিকে গ্রহণ করলেন। 'সর্ব' 'বর্জন' 'মূর্তি' ইত্যাদি লেখা বিহিত হল। তাঁরা বাদ রাখলেন কেবল 'কার্ত্তিক'। এ যে রেফের দ্বিত্ব নয় সেকথা তাঁদেরও মাথায় ছিল।
এর অনতিকাল পরে ব্যাপারটা নতুন মোড় নিল। বানান সমিতি তাঁদের পুনর্বিবেচিত রিপোর্ট পেশ করলেন, এবং তাতে বললেন 'কার্ত্তিক' বর্জনীয়, 'কার্তিক' লিখতে হবে। যে প্রশ্ন নিয়ে এই আলোচনা শুরু করেছি সে প্রশ্ন কিন্তু অনেকেরই মনে বিঁধে রইল। এইসময় মণীন্দ্রকুমার ঘোষ (শঙ্খ ঘোষের বাবা) রাজশেখর বসুর বাড়ি গিয়ে প্রশ্নটা তোলেন। এবং সেই প্রথম স্থিতধী ও যুধিষ্ঠিরস্বভাব রাজশেখর ধৈর্য হারান। বলে ওঠেন, “মশাই, সংস্কারই করলাম একটা। আপনারা ইস্কুলমাস্টাররা তো কিছুই করতে দেবেন না! ‘কার্তিক’ শব্দ সংস্কৃত অভিধানে আছে। ছেলেরা ‘কার্ত্তিক’ লিখলে কেটে দেবেন, শূন্য দেবেন, ‘কার্তিক’ই একমাত্র বানান।” (বাংলা বানান, মণীন্দ্রকুমার ঘোষ) --- কিন্তু পরিবর্তনটার মৌলিক ব্যাকরণগত কারণ কিছু বললেন না।
২| ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন: 'ঝরো ঝরি সবর্ণে' (অষ্টাধ্যায়ী, ৮|৪|৬৫)
রাজশেখর বসু যা অনুক্ত রাখলেন তা হল এই। 'কার্ত্তিক' 'বার্ত্তিক'-এর 'ত্ত' যে রেফের ফল না হওয়া সত্ত্বেও 'ত' করা যাবে তা হচ্ছে উপরোক্ত 'ঝরো ঝরি সবর্ণে' সূত্রের জোরে। এটিও পাণিনীয় সূত্র। 'ঝর্' একটি প্রত্যাহার, তা বোঝায় মাহেশ্বর সূত্রে ঝ থেকে র্-এর আগে অবধি যে বর্ণগুলো আছে। এ নিয়ে পরে বলছি। 'ঝরঃ' অর্থাৎ ঝর্-এর। 'ঝরি সবর্ণে' অর্থাৎ 'ঝর্-জাতীয় সবর্ণে'। এখানে ‘ঝর্’ শব্দ সবর্ণ-এর বিশেষণ। অধিকরণ কারকে সপ্তমী বিভক্তি দ্বারা 'সবর্ণে' হচ্ছে বলে 'ঝর্' শব্দেও এল সপ্তমী বিভক্তি, হল 'ঝরি'। একসঙ্গে ঝর্-সবর্ণে বা ঝর্সবর্ণে লেখা হল না। তাহলে 'ঝরো ঝরি সবর্ণে' অর্থ দাঁড়াল, ঝর্-এর (স্থানে) ঝর্-জাতীয় সবর্ণে। কিন্তু ঝর্-জাতীয় সবর্ণে কী? আগেই বলেছি, পাণিনীয় সূত্র রহস্যময় ভাবে কথা বলে, বাকিটা বোঝানো থাকে বৃত্তি-তে। বৃত্তি বলছে, 'হল উত্তরস্য ঝরো ঝরি সবর্ণে পরতো ভবতি লোপো অন্যতরস্যাম্।' একথার মানে, হল্-এর অর্থাৎ ব্যঞ্জনবর্ণের উত্তর ঝর্-এর পরে ঝর্-জাতীয় সবর্ণের বিকল্পে (‘অন্যতরস্যাম্’) লোপ হয়। লক্ষণীয় যে আগে আলোচিত ‘অচো রহাভ্যাং দ্বে’ সূত্রের মতো এটি রেফ-সংক্রান্ত সূত্র নয় অথচ বিকল্পে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন বিষয়ক সূত্র। অতএব ‘কার্ত্তিক’ ‘বার্ত্তিক’ প্রসঙ্গে প্রযোজ্য।
এবার দেখতে হবে 'ঝর্' কী বস্তু। --- বৈয়াকরণেরা লাঘব (economy) রক্ষার্থে ও স্বল্পাক্ষরে সূত্র গ্রথিত করবার জন্য একটি প্রকরণের সাহায্য নেন, তার নাম 'মাহেশ্বর সূত্র' বা 'শিবসূত্র'। কথিত আছে, নটরাজ যখন নৃত্যাবসানে চোদ্দবার ঢাক বাজালেন তখন ভাষার phoneme বা ধ্বনিমূলগুলি উৎসারিত হল ও চোদ্দটি সূত্রে বিন্যস্ত হল। এরাই মাহেশ্বর সূত্র। যেমন প্রথম সূত্র, 'অ ই উ ণ্'। যদি বলি 'অণ্' তাহলে সেটা অ ই উ বর্ণগুলোকে বোঝাবে। ণ্ কেবল সূত্রটির অন্ত-নির্দেশক ইৎ (লুপ্ত হবার মতো) বর্ণ। প্রথম সূত্রের অ থেকে চতুর্থ সূত্রের ইৎ-বর্ণ চ্ অবধি ধরলে বলব অচ্, এবং এর মধ্যে স্বরবর্ণগুলি পড়বে। এ কারণে স্বরবর্ণের সাধারণ নাম হল 'অচ্'। এমনিভাবেই অষ্টম সূত্রের (ঝ ভ ঞ্) প্রথম বর্ণ ঝ থেকে ত্রয়োদশ সূত্রের (শ ষ স র্) ইৎ-বর্ণ র্-এর আগে অবধি ধরলে পাব ঝ ভ ঘ ঢ ধ জ ব গ ড দ খ ফ ছ ঠ থ চ ট ত ক প শ ষ স, এবং এদের সংক্ষেপে বলব 'ঝর্'। এই যে অণ্ অচ্ ঝর্ ইত্যাদি, তাদের বলে 'প্রত্যাহার'। সুবিধামতো প্রত্যাহার উল্লেখ করলে স্বল্পাক্ষরে তাদের ভিতরকার সমস্ত বর্ণ বোঝানো যায়। তাহলে 'ঝর্' বোঝায় ওপরে উল্লিখিত ঝ - স তেইশটি বর্ণ।
এখন 'সবর্ণ' কাকে বলে দেখা যাক। পাণিনি ১|১|৯-সংখ্যক সূত্রে বলছেন, 'তুল্যাস্যপ্রযত্নং সবর্ণম্'। তুল্য বা সমান আস্য (মুখের ভিতর উচ্চারণ স্থান) ও প্রযত্ন (উচ্চারণের প্রয়াস: স্পৃষ্ট, ইষৎ-স্পৃষ্ট, বিবৃত, ইষৎ-বিবৃত, সংবৃত) যাদের তারা সবর্ণ। সেভাবে অ-আ সবর্ণ, ই-ঈ সবর্ণ, উ-ঊ সবর্ণ, ক-খ-গ ইত্যাদি সবর্ণ। কিন্তু 'নাজ্ঝলৌ' (ন অচ্ হলৌ, সূত্র ১|১|১০), অচ্ (স্বরবর্ণ) ও হল্ (ব্যঞ্জনবর্ণ) কখনও সবর্ণ নয়।
এবার ফিরে আসি 'ঝরো ঝরি সবর্ণে' সূত্রে। ঝর্-এর মধ্যে আমরা দেখেছি অনুনাসিক বর্ণগুলো ছিল না, অন্তঃস্থ বর্ণগুলো ছিল না, ছিল বর্গীয় ব্যঞ্জনগুলো ও উষ্মবর্ণগুলো। সূত্রের বৃত্তি-তে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের পরে কোনো ঝর্-সংজ্ঞক বর্ণের পিছনে যদি তার কোনো সবর্ণ থাকে তাহলে বিকল্পে তার লোপ হতে পারে, মানে একটি ঝর্-বর্ণ থাকলেই চলবে। পাণিনীয় ব্যাকরণে ও তার বৃত্তিতে এর কিছু দুরূহ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যা বাংলায় একদম চলে না। কিন্তু এই সূত্রানুসারেই 'কার্ত্তিক' 'বার্ত্তিক' স্থলে বিকল্পে 'কার্তিক' 'বার্তিক' লেখা যায়। এখানে ব্যঞ্জন র্-এর পরে ঝর্-বর্ণ ‘ত’ আছে ও তার পিছনে আছে তার সবর্ণ ‘ত’। অতএব পরের ‘ত’ বাদ দেওয়া চলে। এটা রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জনের ব্যাপার নয়। এখানে 'কার্ত্তিক' 'বার্ত্তিক' শব্দে আমরা নিতান্ত ঘটনাচক্রে (প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে বলে) রেফ পাচ্ছি, মূল শব্দ 'কৃত্তিকা' ও 'বৃত্তি'-তে রেফ ছিল না। এবং প্রত্যয়নিষ্পন্ন ‘কার্ত্তিক’ ‘বার্ত্তিক’ শব্দ থেকে যে একটি ‘ত’ বাদ দিয়ে ‘কার্তিক’ ‘বার্তিক’ লিখতে পারছি তা রেফে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন নয়, ‘ঝরো ঝরি সবর্ণে’ সূত্রের ফলে।
যুবতি, অবন্তি ও অন্যান্য
কালিদাস লিখেছেন, ‘যুবতিবিষয়ে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতুঃ।’ এ থেকে বোঝা যায় কালিদাসের বিশেষ্যটি ‘যুবতি’, ‘যুবতী’ নয়। তাঁর শব্দটি ‘যুবতী’ হলে তিনি লিখতেন ‘যুবতীবিষয়ে’। স্ত্রী-প্রত্যয় ‘ঙীপ্’ (ঙ্ প্ ইৎ হয়, ঈ থাকে) সমাসে ই-কার হত না, ‘কালীপূজা’ যেমন ‘কালিপূজা’ হতে পারে না। বাংলায় কিন্তু চিরকাল দীর্ঘ-ঈ-কারযুক্ত ‘যুবতী’ চালু ছিল, বাঙালির চোখ এতেই অভ্যস্ত ছিল। ‘যুবতি’ ও ‘যুবতী’ সংস্কৃতভাষায় একই অর্থবোধক ও সমলিঙ্গ দু’টি বিকল্প শব্দ। এরও উৎস খুঁজে পাওয়া যায় পাণিনিতে --- তাঁর ৪|১|৭৭-সংখ্যক সূত্র ‘যূনস্তিঃ’ (যূনঃ + তিঃ)। ‘যূনঃ’ হল ‘যুবন্’ শব্দের ষষ্ঠী বিভক্তির একবচন, অর্থ ‘যুবার’ বা ‘যুবন্-এর স্থলে’। এ সূত্রের জন্য ‘বৃত্তি’ বলছে: ‘যুবন্শব্দাৎ প্রাতিপদিকাৎ স্ত্রিয়াং তিঃ প্রত্যয়ো ভবতি। স চ তদ্ধিতসংজ্ঞো ভবতি।’ এর অর্থ, যুবন্ শব্দের প্রাতিপদিকের সঙ্গে স্ত্রীলিঙ্গে ‘তি’ প্রত্যয় যুক্ত হবে; সেই ‘তি’ প্রত্যয় স্ত্রী-প্রত্যয় নয়, তদ্ধিত প্রত্যয়। তাই যুবন্ + তি-প্রত্যয় > যুবতি। শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ।
তাহলে ‘যুবতী’ শব্দ কীভাবে নিষ্পন্ন হয়? সংস্কৃত ব্যাকরণে এক সহজ সূত্র আছে --- ‘ইদন্তাদ্বিভাষা’, ই-কারান্ত প্রাতিপদিকের উত্তর বিকল্পে ‘ঈপ্’ হয়। কিন্তু যে ই-কার এল স্ত্রী-বাচক কোনো প্রত্যয় থেকে তাতে স্ত্রী-প্রত্যয় ‘ঈপ্’ আসে কী করে? এর উত্তর ‘ইদন্তাদ্বিভাষা’-র মধ্যে নেই। অভিধান ঘাঁটলে এর কিছুটা অনুমান করা যায়।
তাই ‘যুবতী’ শব্দের ব্যুৎপত্তি বেশ অন্যরকম। পাণিনি-পরবর্তী প্রখ্যাত ব্যাকরণ ‘সিদ্ধান্তকৌমুদী’ বলছে, যু-ধাতু + শতৃ-প্রত্যয় + ঙীপ্ (স্ত্রী-প্রত্যয়) > যুবৎ + ঙীপ্ > যুবতী। যু-ধাতু অর্থ ‘মিশ্রিত হওয়া’, ‘যুবৎ’ মানে ‘মিশ্রিত হচ্ছে যে’। ‘যুবন্’ শব্দও যু-ধাতু থেকে, তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘পত্নীর সঙ্গে মিশ্রিত হয় যে’। একটু জটিল শোনালেও ‘যুবতি’-র মতো ‘যুবতী’-ও অতি প্রাচীন শব্দ, রামায়ণ মহাভারতে তার প্রয়োগ দেখা যায়। সংস্কৃতে দু’টিই স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ --- যুবতি-র শব্দরূপ ‘মতি’-র মতো, যুবতী-র রূপ ‘নদী’-র মতো। আজকাল অভিধানকারেরা বাঙালির পক্ষে হ্রস্ব-ই সহজতর মনে করে চিরাভ্যস্ত ‘যুবতী’ ছেড়ে ‘যুবতি’ প্রস্তাব করতে চাইছেন, তার ফলে কোথাও ‘যুবতী’ দেখলেই অনেকে ‘ভুল ভুল’ বলে উঠছে।
যুবতীর কথা উঠলে ‘তরুণী’-র কথা চলে আসে, এবং ‘যুবতি’ লিখলে ‘তরুণি’ লিখতে ইচ্ছে করে। সেটা কিন্তু সম্ভব নয়। ‘তরুণ’ শব্দের সঙ্গে স্ত্রী-প্রত্যয় ‘ঙীপ্’ জুড়ে ‘তরুণী’ হয়। এখানে অন্য কিছু হবে না। আর, ‘তরুণ’ শব্দ হচ্ছে ‘তৃ’-ধাতুর (তৃ-তে দীর্ঘ ঋ-কার) সঙ্গে ‘উনন্’ প্রত্যয় জুড়ে। এই ‘উনন্’ একটি উণাদি প্রত্যয়, নিয়মবদ্ধ কৃৎ প্রত্যয়ের বাইরে একদল প্রত্যয়। ‘তরুণী’ শব্দ যে স্ত্রীলিঙ্গ তা তো বলাই বাহুল্য; শব্দরূপ ‘নদী’-র মতো। তাহলে ‘যুবতি’ হতে পারে কিন্তু ‘তরুণি’ হবে না একথা মাথায় রাখবার কী উপায়?
আসন্ন আলোচনার খাতিরে কিছু কথা বলা প্রয়োজন ‘উণাদি প্রত্যয়’ সম্বন্ধে। ধাতু থেকে যাবতীয় শব্দসমূহের উৎপত্তি, এ ধারণা সংস্কৃত শব্দতত্ত্বের মূলগত ধারণা। ধাতুর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় কৃৎ প্রত্যয়, শব্দের সঙ্গে তদ্ধিত প্রত্যয়, পুংলিঙ্গ শব্দের সঙ্গে স্ত্রী-প্রত্যয়। কৃৎ প্রত্যয় যেমন ‘ক্ত’ ‘ক্তিন্’ ‘অনট্’ ইত্যাদি একরাশ প্রত্যয় সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট নিয়মাদি আমরা ব্যাকরণে পড়ি, কিন্তু তা দিয়ে ‘ধাতু থেকে শব্দসমূহের উৎপত্তি’ এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ প্রদর্শিত হয় না। তাই আরও একরাশ প্রত্যয় কৃৎ প্রকরণের পরিশিষ্ট রূপে পরিবেশিত হয়, ‘উণ্’ নামে একটি প্রত্যয় থেকে তাদের নাম ‘উণাদি প্রত্যয়’। এদের একেকটির প্রয়োগ ও নিয়মাদি কৃৎ প্রত্যয়ের তুলনায় কিঞ্চিৎ সীমিত, সব মিলিয়ে এরা যেন প্রত্যয়ের মূল এলাকার কিছুটা বাইরে।
‘তরি’ ও ‘তরণি’। নদীমাতৃক দেশে নৌকো জীবন ও সাহিত্যের অঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ লিখেছেন; মৃত্যুর কিছুদিন আগেও গেয়েছেন, ‘ভাসাও তরণী, হে কর্ণধার’। দীর্ঘ ঈ-কারে ‘তরী’ ও ‘তরণী’-র সঙ্গেই আমরা পরিচিত। তথাপি হ্রস্ব ই-এর যুগে ‘তরি’ ও ‘তরণি’ ভেসে উঠছে। এখানেও সেই দু’রকমের ব্যুৎপত্তি। তৃ-ধাতুর সঙ্গে উণাদি ‘ই’-প্রত্যয় যোগে ‘তরি’, উণাদি ‘ঈ’-প্রত্যয় যোগে ‘তরী’। দু’টি শব্দই স্ত্রীলিঙ্গ, ‘তরি’-র রূপ ‘মতি’-র মতো, ‘তরী’-র রূপ ‘নারী’-র মতো (শুধু প্রথমা বিভক্তি ও সম্বোধনের একবচনে ‘তরীঃ’)। কেবল প্রত্যয়ের তফাত। আবার, তৃ-ধাতুর সঙ্গে উণাদি ‘অনি’-প্রত্যয় যোগে ‘তরণি’। ‘অনি’-প্রত্যয়যুক্ত সমস্ত শব্দই স্ত্রীলিঙ্গ হয়। ‘তরণি’-র শব্দরূপ ‘মতি’ শব্দের মতো। আর ‘তরণী’? --- তৃ-ধাতু + ল্যুট্ (অনট্) কৃৎ-প্রত্যয় > তরণ, যে তরণ করে। ‘তরণ’ স্ত্রীলিঙ্গে (তরণ + ঙীপ্-প্রত্যয়) ‘তরণী’, রূপ ‘নদী’ শব্দের মতো।
‘অবনি’, ‘ধরণি’। পৃথিবীর দুই নাম। আমরা ‘অবনী’ ও ‘ধরণী’ রূপে বেশি চিনি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘হেরো হেরো অবনীর রঙ্গ’ বা ‘ধরণী আজ মেলেছে তার হৃদয়খানি’, একালেও লেখা হয়েছে ‘অবনী বাড়ি আছো’। এখানেও একইরকম। অব্-ধাতু + অনি (উণাদি প্রত্যয়) > অবনি, ধৃ-ধাতু + অনি > ধরণি। অব্ + ল্যুট্ (অনট্, কৃৎ-প্রত্যয়) > অবন (রক্ষণ/পালন), অবন + ঙীপ্ (স্ত্রী-প্রত্যয়) > অবনী। এবং এভাবেই ধরণ (ধৃ + অনট্, কৃৎ-প্রত্যয়) + ঙীষ্ (স্ত্রী-প্রত্যয়) > ধরণী। এ ক্ষেত্রেও ‘অবনি’ ‘ধরণি’-র শব্দরূপ ‘মতি’-র মতো, ‘অবনী’ ‘ধরণী’-র রূপ ‘নদী’-র মতো।
‘ধমনি’, ‘ধমনী’। এখানে ধাতুটি ‘ধম্’, অর্থ অগ্নিসংযোগ করা, জ্বালানো। বাকি উপরোক্ত শব্দদ্বয়ের মতো। ধম্ + অনি (উণাদি প্রত্যয়) > ধমনি। ধম্ + ল্যুট্ (অনট্, কৃৎ-প্রত্যয়) + ঙীপ্ > ধমনী। শব্দরূপ যথাক্রমে স্ত্রীলিঙ্গ ‘মতি’ ও ‘নদী’ শব্দের মতো।
‘রজনি’, ‘রজনী’। ‘রজনি’, ‘রজনী’। এখানে রন্জ্-ধাতু + অনি (উণাদি প্রত্যয়) > রজনি। রন্জ্ + অন (ক্যুন্, উণাদি প্রত্যয়) + ঙীপ্ (স্ত্রী-প্রত্যয়) > রজনী।
‘আবলি’। ‘আবলী’ আমরা জানতাম। অসংখ্য রচনাবলী, কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির পত্রাবলী, বৈষ্ণব পদাবলী, তাছাড়া চন্দ্রাবলী, রত্নাবলী, বংশাবলী, চরিতাবলী, শব্দাবলী, নিয়মাবলী। এখানে ‘বল্’-ধাতু, আ-উপসর্গ, উণাদি প্রত্যয় ‘ইন্’ ও বিকল্পে স্ত্রী-প্রত্যয়ের ফলে যথাক্রমে ই-কার ও ঈ-কার। দুই-ই স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ, ‘আবলি’-র রূপ ‘মতি’ ও ‘আবলী’-র রূপ ‘নদী’-র মতো। ভারতের অনেক ভাষায় ‘আবলি’-ই প্রচলিত।
এরকম আরও শব্দদ্বয় ‘বল্লরি/বল্লরী’, ‘বল্লি/বল্লী’, ‘ব্রততি/ব্রততী’, ‘মঞ্জরি/মঞ্জরী’, ‘পঞ্জি/পঞ্জী’, ‘শ্রেণি/শ্রেণী’, ‘সূচি/সূচী’। এ পর্যন্ত যে যে শব্দ উল্লেখ করা হল, লক্ষণীয় যে, (১) এরা স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ, (২) কোনো ধাতুর সঙ্গে কোনো একটি উণাদি প্রত্যয় যোগে ই-কারান্ত রূপ তৈরি হয়েছে, (৩) ধাতু থেকে বিশেষ্য হয়ে (অনেক ক্ষেত্রে কৃৎ প্রত্যয় যোগে) তার সঙ্গে স্ত্রী-প্রত্যয় জুড়ে ঈ-কারান্ত রূপ তৈরি হয়েছে। বাংলাভাষায় চিরাচরিত প্রয়োগ থেকে দেখা যাচ্ছে, স্ত্রী-প্রত্যয়যুক্ত ঈ-কারান্ত স্ত্রীলিঙ্গ রূপগুলোর প্রতি বাঙালি পণ্ডিতদের পক্ষপাত ছিল। সে পক্ষপাত ও তজ্জনিত অভ্যাসের মধ্যে আমি দোষের কিছু দেখি না। বরং সেসব জায়গায় ঢালাও ই-কার প্রস্তাব করার মধ্যে কিছু অপরিণামদর্শিতা আছে, তা নিয়ে পৃথক আলোচনা করা যেতে পারে। তার একটি দৃষ্টান্ত পরের প্রসঙ্গ।
আপাতত ‘অবন্তি/অবন্তী’ দিয়ে শেষ করি। আমরা ‘অবন্তী’ জানি, বাঙালি মেয়েদের ‘অবন্তী’ নাম হয়। ‘অবন্তী’ স্ত্রীলিঙ্গ। ঈ-কারান্ত সকল সংস্কৃত শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ হয়। কিন্তু সম্প্রতি এক বন্ধু ফেসবুকে COVID-19 ও সংস্কৃত ‘কোবিদ’ শব্দ নিয়ে রসিকতা করাতে আমি সেখানে মন্তব্য হিসেবে উদ্ধৃত করলাম কালিদাসের ‘প্রাপ্যাবন্তীনুদয়নকথাকোবিদগ্রামবৃদ্ধান্’ (মেঘদূত, পূর্বমেঘ, ৩১), এবং ‘অবন্তীন্’ শব্দটা নিয়ে নিজের কাছে নিজে মুশকিলে পড়ে গেলাম। এটা উদ্ধৃত করার কারণ ছিল ‘কোবিদ’ শব্দটা, আর কিছু নয়। বিরাট পদটার সন্ধি ভাঙলে পাওয়া যাবে, প্রাপ্য + অবন্তীন্ + উদয়নকথাকোবিদগ্রামবৃদ্ধান্। এ পঙ্ক্তির অর্থ, যেখানকার গ্রামবৃদ্ধেরা উদয়নকথাকোবিদ সেই অবন্তীতে পৌঁছে, ইত্যাদি। সংস্কৃতের নিয়ম হল, কোথাও গেলে বা পৌঁছোলে সেই স্থাননামের সঙ্গে দ্বিতীয়ার একবচনের বিভক্তি যুক্ত হয়। তাহলে শব্দটি যদি ‘অবন্তী’ হয়, অর্থাৎ ‘নদী’-র মতো শব্দরূপ, তার দ্বিতীয়ার একবচন হবে ‘অবন্তীম্’, বহুবচন ‘অবন্তীঃ’। তো এখানে ‘অবন্তীন্’ কেন? দ্বিতীয়ার তিনটি বচনের মধ্যে এ-হেন রূপ তো একমাত্র ‘মুনি’ জাতীয় শব্দের হতে পারে। সেই ‘মুনি’ পুংলিঙ্গ শব্দ। ‘মুনি’-র দ্বিতীয়ার বহুবচনের রূপ ‘মুনীন্’। এই হল আসল কথাটা --- তাহলে কালিদাস ব্যবহার করেছেন পুংলিঙ্গ ‘অবন্তি’ শব্দ, স্ত্রীলিঙ্গ ‘অবন্তী’ নয়। এবং বহুবচনে কেন? কারণ প্রদেশবাচক শব্দ সাধারণত বহুবচনে হয়, যদিনা তা ‘দেশ’ বা ‘বিষয়’ জাতীয় শব্দের সঙ্গে সমাসবদ্ধ থাকে (যেমন, বঙ্গদেশ)। তাই পুংলিঙ্গ ‘অবন্তি’ শব্দ দ্বিতীয়ার একবচনে ‘অবন্তিম্’ হল না, বহুবচনে ‘অবন্তীন্’ হল। দীর্ঘ ঈ-কারটা বহুবচনের সবিভক্তিক রূপ। এই পুংলিঙ্গ ‘অবন্তি’ বিকল্পে স্ত্রীলিঙ্গে ‘অবন্তী’। আগে আলোচিত শব্দগুলোর মতো এখানে তাহলে ই-কারান্ত ও ঈ-কারান্ত দু’টি শব্দই স্ত্রীলিঙ্গ তা নয়। প্রয়োগের জায়গা না বুঝে কেবল ই-কারের মোহে ‘অবন্তী’-র বদলে ‘অবন্তি’ গ্রহণ করলে লিঙ্গসংক্রান্ত বিপত্তি ঘটতে পারে। সুতরাং একমাত্র একটি প্রাচীন জনপদের নাম ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় ‘অবন্তি/অবন্তী’ শব্দজোড়কে পক্ষে ও বিকল্পের নমুনা হিসেবে ধরা যাবে না। আকাদেমি বানান অভিধান যে লিঙ্গের উল্লেখ না করে তারকাচিহ্ন (*) দ্বারা একমাত্র ‘অবন্তি’-ই প্রস্তাব করেছে তার মধ্যে একটু বিপদ লুকিয়ে থাকছেই। এর প্রত্যাশিত উত্তরটা --- নীলিমা, রক্তিমা, মধুচ্ছন্দা, সবিতা, সুতপা ইত্যাদি কত পুংলিঙ্গ শব্দই তো মেয়েদের নাম হয়ে চলছে --- আমি সে তর্কের মধ্যে যাচ্ছি না।
নিজেকেই প্রশ্ন করি, এই শব্দজোড় সংস্কৃতে কী অভিপ্রায় সিদ্ধ করত? ‘প্রাপ্যাবন্তীন্’-এর সাক্ষ্য থেকে বলতে পারি, মন্দাক্রান্তা ছন্দের অনুরোধে মহাকবির ওখানে ওই দীর্ঘ অক্ষরটিরই প্রয়োজন ছিল।
সহায়ক গ্রন্থ
১| বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২| বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস
৩| সংসদ বাংলা অভিধান, সুভাষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ঊনবিংশতিতম মুদ্রণ, মার্চ ২০১৩
৪| সংসদ ব্যাকরণ অভিধান, অশোক মুখোপাধ্যায়
৫| আকাদেমি বানান অভিধান, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, সপ্তম সংস্করণ, জুলাই ২০১১
৬| A Sanskrit-English Dictionary, Monier Monier-Williams
৭| ব্যাকরণ-কৌমুদী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত
৮| ব্যাকরণ-কৌমুদী, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত
৯| The Ashţādhyāyī of Pāņini, Edited and translated into English by Śrīśa Chandra Vasu
১০| শব্দ-কথা, ক্ষিতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়