• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • জীবনের রঙিন সুতোয় বোনা নকশিকাঁথা : পিনাকী ঠাকুরের কবিতা : সিদ্ধার্থ সেন



    মাঝে মাঝে হাওড়া থেকে রাতের আপ ট্রেনে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত কিন্তু কখনো মনে হয়নি এত তাড়াতাড়ি অসাক্ষাতের চিরকালীন এক দেওয়াল তৈরি হয়ে যাবে আমাদের দুজনের মধ্যে। বহুদিন আগে আমাদের চুঁচুড়ার বাড়িতে বেশ কয়েকবার এসেছে সে, পিনাকীদা — কবি পিনাকী ঠাকুর (১৯৫৯ - ২০১৯)। আমাদের বন্ধুদের পত্রিকা ‘বাতিঘর’-এ ‘সাইকেলে মধুপুর’ কবিতাটি দিতে যেদিন সে এসেছিল সেদিনের আড্ডাটির কথা আজও মনে পড়ে। পরে সেই কবিতাটি তাঁর ‘একদিন অশরীরী’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়। আজ এই লেখা যখন লিখতে বসেছি তখন পিনাকীদা সাইকেলে মধুপুরে পাড়ি দিয়েছে, এখন এই পৃথিবীতে তাঁর শারীরিক অস্তিত্বও নেই।

    একথা হয়তো আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারব না যে, কবি পিনাকী ঠাকুরের হঠাৎ চলে যাওয়ায় বাংলা কবিতার একটা বিরাট বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রেম, কৌতুকময় উচ্চারণ, কবিতা নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষার উদাহরণ তাঁর কবিতায় আমরা আর কোনোদিনই দেখতে পাব না। নানা বিষয়ে তাঁর কৌতূহল ছিল আর তাঁর প্রবল পাঠস্পৃহাও ছিল নানা বিষয়কে ঘিরে। সেই মনোভাবের নানা দৃষ্টান্ত আমরা খুঁজে পাই কবিতার বইয়ের পাতায় পাতায়। নয়ের দশকে কবি হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ঘটলেও যদ্দূর জানি তাঁর লেখালেখির শুরু গত শতকের সাতের দশকের শুরুতে। যদিও তাঁর স্বীকারোক্তিতে পাই ‘আমি ক্লাস থ্রি থেকে লেখা শুরু করি। অবশ্য সে লেখার পাঠক ছিলেন মাত্র একজন। আমার বাবা। বুঝতেই পারা যাচ্ছে, ওই বয়সের কবিতা (এবং গল্পও) কেমন হতে পারে! একটা বড় খামের ভিতর আমার সেই লেখার দপ্তর যত্ন করে লুকিয়ে রাখতাম। বাবার ছিল তিন শিফটের ডিউটি। বাবা ডিউটি থেকে ফিরলেই হাতে তুলে দিতাম নতুন লেখা। ওই কাঁচা বয়সের লেখা পড়েও সিরিয়াস মতামত দিতেন। হয়তো এক আধটা শব্দ বদল করতে বলতেন।’ এই উৎসাহ তাঁকে ভিতরে ভিতরে লেখালেখির দিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘কবিরে পাবে না তাঁর জীবনচরিতে’ — এ যেন পাঠককে কবির জীবন থেকে খানিক দূরে সরিয়ে রাখার ছল। তাঁর প্রকাশিত ষোলোটি কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় ছড়ানো রয়েছে তাঁর জীবন পদাবলীর চূর্ণ-বিচূর্ণ অংশ। তাঁর বাবা কম্যুনিস্ট পার্টি করতেন, ছোটোবেলায় বাবার কাছ থেকে নানা ধরনের বই উপহার পাওয়া, প্রায় রোববারই বাবার বন্ধু হরিকাকুর বউবাজারের মেসে যাওয়া, ট্রেনে যেতে যেতে বাবার দেশ পত্রিকা পড়া, মেসে সারাদিন দুই বন্ধুর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা পরোক্ষে তাঁকে সাহিত্যের প্রতি এক পা এক পা করে এগিয়ে দিচ্ছিল।

    সারাজীবনই এক অনিশ্চয়তা, অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছেন তিনি, এই অস্থিরতা ক্রমে হয়ে উঠেছে তাঁর ব্যক্তিত্বের অংশ। সেই অস্থিরতার শুরু যখন তিনি ক্লাস সিক্সের ছাত্র, ১৯৭০ সালের ১৬ অক্টোবর তাঁর বাবা অমল ঠাকুর সত্তরের রক্তক্ষয়ী দশকে দিনদুপুরে বাড়িতে ঘাতকের হাতে নিহত হন। মাঝেমাঝেই বাড়িতে এসে বোমা-পিস্তল দেখিয়ে গুণ্ডাদের শাসানি — এমন নিয়ত সন্ত্রাস ও শাসানির মধ্যে তাঁর মা মীরা ঠাকুরের দুটি মেয়ে, একটি ছেলে নিয়ে অদম্য বাঁচার লড়াই — কবিতা থেকে তাঁকে সাময়িক দূরে সরিয়ে দিল। এক তীব্র বিষাদে শৈশবের সেই কবিতাগুলিকে খামশুদ্ধ তিনি নষ্ট করে দিলেন। জীবনের কঠিন বাস্তব, পারিবারিক দায়িত্ব পালনের অনুভব তাঁকে কবিতার জগৎ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু স্মৃতিতে প্রথম প্রেমের অনুবর্তনের মতো বারে বারে তাঁর জীবনে কবিতা ফিরে এসেছে। বছর তিনেক বাদে যখন তিনি ক্লাস নাইনের ছাত্র তখন কারোর উপহার দেওয়া একটি সুরের ডায়েরির পাতায় আবার শুরু। ততদিনে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পাওয়া ‘বনলতা সেন’ এবং ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ’ (বিশ্ববাণী প্রকাশন) এবং আরও অনেক কবিতা পড়তে পড়তে আধুনিক কবিতা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। পুরোনো কৃত্তিবাস, গঙ্গোত্রী আরও নানা উৎস থেকে আধুনিক কবিতা পাগলের মতো পড়ে চলা তাঁকে কবিতার আরও কাছাকাছি নিয়ে এলো। এইসময় আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় যাওয়ার সূত্রেই বন্ধুত্ব বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে পরিচিত ঐতিহাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি-কথাকার-অধ্যাপক), গৌতম দেব, অদিতিকিশোর সরকার প্রমুখের সঙ্গে। এই সাহচর্য আবার তাঁকে নিয়ে এলো কবিতার কাছাকাছি। ১৯৭২-৭৩ থেকে আবার শুরু হল লেখালেখি। ১৯৭৫-এ বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘উশীনর’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হল। তারপর বন্ধু বিশ্বনাথের চাপে ‘দেশ’- ‘উত্তরসূরী’-‘পরিচয়’-‘সমতট’-‘কবিপত্র’ ইত্যাদি পত্রিকায় কবিতা পাঠানো ও কিছুদিন পর সেগুলির প্রকাশ তাঁকে পরিচিতি দিল। ইতোমধ্যে বাবার কর্মক্ষেত্র ডানলপ কোম্পানিতে কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি, নৈশ কলেজে পড়াশোনা, প্রবল চাপ — সকালে চাকরি, বিকেলে কলকাতায় কলেজ করে রাতে বাঁশবেড়িয়ায় ফেরা। এমন সময় আলাপ বাঁশবেড়িয়াতেই এক গুণী মানুষের সঙ্গে — তিনি অজয় মিশ্র। কিছুদিন বাদে আবার কবিতা লেখায় দীর্ঘ বিরতি। কবিতা লেখা বন্ধ হলেও পড়ার নেশায় ছেদ পড়েনি। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর পড়াশোনার চিহ্ন ধারণ করতে থাকে কবিতার শরীর। আর এক কবিতাপ্রেমী মানুষ কবি কানাই ঘোষও তাঁর কাছে মাঝে মাঝে কবিতা শুনতে চাইতেন। দশ বছর চাকরি করার পর সেটা তিনি ছেড়ে দিলেন এমন এক সময় যখন ডানলপ কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়রের বদান্যতায় কোম্পানি স্পনসর করে তাঁকে ইঞ্জিনিয়রিং পড়াচ্ছিল। তখন আর একটা সেমেস্টার মাত্র বাকি যা শেষ করলে নিশ্চিত আর্থিক নিরাপত্তা মিলত হয়তো। কিন্তু তখন কবিতার পোকা মাথায় কিলবিল করতে আবার শুরু করেছে।

    বন্ধুরা তখন সব জীবনে প্রতিষ্ঠিত আর চাকরি ছেড়ে কবির সম্বল দু-একটা টিউশনি, সারাদিন সাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়ানো, ছুটির দিন ছাড়া বন্ধুদের পাওয়া দায়। জীবনে পুনরায় কাব্যসরস্বতীর আবির্ভাব হয়েছে শুনে বন্ধু দীপংকর কিনে দিলেন একট বেগুনি খাতা আর বেগুনি কালির রেনল্ডস্-এর ডট পেন। খাতার পাতা ধীরে ধীরে ভরে উঠলেও সেমেস্টারের শেষ পরীক্ষাটা আর দেওয়া হল না। বন্ধুদের চাঁদার টাকায় ১৯৯৪-এর বইমেলায় হাওড়ার ‘স্বর্ণাক্ষর’ প্রকাশনী থেকে গৌতম ঘোষ দস্তিদারের সহায়তায় প্রকাশিত হল প্রথম কবিতার বই ‘একদিন, অশরীরী’। প্রথম কবিতাটিতেই তিনি বাঙালি কবিতাপাঠকের মন জয় করে নিলেন যদিও পরবর্তী কালে কবি নিজে এই বইটির কবিতাগুলিকে খুব কাঁচা বলে মনে করেছেন। কিন্তু সেই কবিতাটি ‘কথকজন্মের কথা’ দিয়েই তাঁর কবিজীবনের প্রকাশিত কথকতার সূত্রপাত ঘটেছিল, সেদিক থেকে কবিতাটি পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে:

    কোরা কাপড়ের খুঁটে নতুন আতপচাল, তোমাদের গাছের বেগুন
    বেঁধে দিয়ে বলেছিলে: ‘হরিশ্চন্দ্রের পালা, ও কথক, আর নয়
    পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ফিরে এসে শ্রীরাধার গল্পখানি বোলো’
    এই ধরতাই বাংলা কবিতায় এক নতুন কণ্ঠস্বরের জন্ম দিল সন্দেহ নেই। তারপর তাঁর কবিতায় পাঠক কত গল্প শুনেছে, উপলব্ধি করেছে ‘নিজের ক্রুশকাঠ নিজে নিজে বয়ে নিয়ে পেরেকের স্তম্ভিত, জমাট রক্তধারা’ প্রায় প্রথম বই থেকে শেষ বই ‘ন্যুড স্টাডি’ (২০১৯) পর্যন্ত। ধীরে ধীরে নয়ের দশকের অনেক কবিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, ‘বিজল্প’ পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ, জয় গোস্বামীর পরামর্শে বিজল্প প্রকাশ করল তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘আমরা রইলাম’। পরবর্তী কালে আরও কিছু কবিতা যোগ করে ২০০১ সালে সেটি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে আবার প্রকাশিত হয়। বইটির উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল ‘আর কোনও ভগবান না থাকলেও আমরা রইলাম’। আশি পৃষ্ঠার সেই বইটিতে বাহান্নটি কবিতায় প্রতিষ্ঠিত হলেন আরও বেশি করে পিনাকী ঠাকুর। প্রথম বইটির তুলনায় এই বইয়ের কবিতাগুলি অনেক পরিণত। নানা ধরনের কবিতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা দেখা গেল এই কাব্যগ্রন্থে। শব্দকে বশ করার মন্ত্রটি তিনি এতদিনে শিখে গিয়েছেন বেশ বোঝা যায়। প্রথম কবিতা ‘মা বাবা রবীন্দ্রনাথ’ থেকে শুরু করে শেষ কবিতা ‘ডার্ক লেডি’ পর্যন্ত সেই অনুশীলনের সাক্ষর ধরা আছে। আছে তাঁকে ঘিরে থাকা ‘আমরা’ বহুবচনধারীরা। রোজকার অতিবাহিত জীবনের খণ্ড লহমা থেকেই জন্ম নিতে থাকে কবিতা, কবির কলম খুঁজে নিতে থাকে এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা। ‘অনাথ ত্রিপুণ্ডি লেন, তস্য লেন মাথাঘষা গলি’-তে যে জীবনের শুরু সেই মফসসলের জীবন উঠে আসে আমাদের পরিচিত জনপদের বালি, ধূলিকণা, জলবাতাসের স্পর্শসহ। উঠে আসে কৈশোর প্রেমের গন্ধ:
    ডাকের সুন্দরী ছিলে, তিনবেলা হাঁ করে গিলতাম—
    রাঙা মেলভ্যান রোজ তোমাদেরই ফটকে দাঁড়াত
    তুমি ছিলে গণতন্ত্র, তুমি ছিলে উন্নয়নশীল
    বর্ডার পেরিয়ে যার প্রতিটি সাইক্লোন সরে আসে!

                                               (ছোট শহরের কাব্য)
    কিংবা,

    ‘আমরা রইলাম’ নামের দীর্ঘ কবিতায় আত্মজৈবনিক সুরে যে জীবন উঠে আসে সেখানেও আছে প্রেম, অসম আর্থিক বৈষম্য থাকলেও কৈশোর প্রেম বাধা মানে না কিন্তু সে প্রেম কলেজের মেয়ে আর স্কুলের ছেলের, যার অনিবার্য পরিণতি ব্যর্থতা। তাই পিনাকীর অনেক কবিতায় যে সংলাপধর্মিতা দেখি এই কবিতাতেও সেই প্রেমকাহিনি কিছুদিন বাদের সংলাপের সূত্রে পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়:

    --আমাকে বলোনি কেন? আমি কি তোমার কেউ নই!
    --তুমি? তুমি কার? আজ নিরাপদ সাততলার ঘরে
    বিলেত না আমেরিকা ফেরত ওই মিস্টার (কী যেন) তাঁর
    তাঁর কেনা কিউরিও, জীবন্ত ভেনাস
    --কী বল্লে, ভেনাস? আমি টেবিলের ছাইদান। এটাকেই
    চাকরি বলা
    এই কাব্যগ্রন্থেই পাই ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব’ নামের একটি কবিতা যেখানে কাঙাল হরিনাথ, মীর মশাররফ, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শিশির ভাদুড়ী, সুধীরকুমার মিত্র, বিভূতিভূষণ, বিদ্যাসাগর, বুনো রামনাথ, বাসস্থান বংশবাটী বা বাঁশবেড়িয়া কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। অনেক কবিতা প্রতিদিনের সংবাদপত্রের খবরের শিরোনাম থেকেও জন্ম নেয়। সে নামগুলিও বেশ, খবরের শিরোনামের মতো আকর্ষক। কবিতার ফর্ম নিয়ে নিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষায় ঘাটতি নেই। কাহিনিবন্ধনে কবিতাকে বাঁধতে ভালোবাসতেন তিনি, চোখে দেখা নানা ঘটনা, ব্যক্তিগত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, বিগত দিনের ইতিহাস, বাঙালির হারিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক ধারা, লৌকিক ইতিহাস, প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন মানুষের মনে ঘনিয়ে-ওঠা সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ সবকিছু মিলিয়ে এমন এক মায়াজগৎ কবিতায় তিনি নির্মাণ করেন যা পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লেখার জাদুদণ্ডটি তিনি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। কৌতুক আর পরীক্ষাপ্রবণতায় তাঁর কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে বার বার। ‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’ কাব্যগ্রন্থের ‘রাতের ট্রেনে’ বা ‘পুত্রার্থে’ কবিতায় সেই কৌতুকপ্রিয়তা ধরা আছে। আবার ‘পালাও কাঁটাগাছ’ নামের কবিতায় এক মফসসলি বৃত্তান্ত বলতে বলতে হঠাৎ কবিতার শরীরে এসে বসে:
    একশো কুড়ি রানে আউট সৌরভ
                পাথর বুদ্ধকে ভেঙেছে তালিবান
    নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখি
    দুটি খবরের কাগজের হেডিংয়ের পাশাপাশি এসে বসেছে একটি জনপ্রিয় আধুনিক চিত্রগীতির শুরুর একটি পংক্তি। আসলে মানবজীবন এমন এক জীবনাকাশ যেখানে ‘অতীত থেকে আসা তারার আলোরেখা/ আলোও চলে যায় অজানা আগামীতে’। তাঁর কবিতায় ভেসে ওঠে অতীত-বর্তমানের স্মৃতি-ঘটনায় স্পন্দিত নানা মুহূর্ত, সমকালের প্রবহমান জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্ত যেগুলির অনেকগুলির মধ্যেই লিপ্ত হয়ে আছেন স্বয়ং কবি। আছে ডেভেলপার অধ্যুষিত ক্রমশ বেড়ে চলা মেগাসিটি, প্রযুক্তির নিয়ত বিবর্তন, প্রজন্মের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বয়সের নিরিখে নব্বইয়ের অনেক কবির থেকে বড়ো হলেও এইসব উপাদানই তাঁর কবিতাকে কন্টেমপোরারি ও স্মার্ট করে তুলেছে, অন্যদিকে আছে হুগলি-বাঁশবেড়িয়া-চুঁচুড়া-চন্দননগর-শ্রীরামপুর-এর মতো জনপদের মফস্সলের বৃত্তান্ত, পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি; কবিতায় জড়িয়ে যায় সেইসব অঞ্চল থেকে কলকাতায় রেলপথে নিত্যযাত্রীর জীবন যে জীবন ‘শালিখের-দয়েলের’ মতো মধ্যবিত্তের, যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বেকারত্ব, টিউশনির অনিশ্চিত খণ্ড জীবন। সেইসব জীবনস্পন্দন ধ্বনিত হয় তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে বিন্যস্ত কবিতামালায়। দু-একটি কবিতার দিকে তাকানো যেতে পারে:
    ১.
    ভোর হয়ে গেল এসো ঈশ্বর গুপ্তের সেতু হেঁটে ঘুরে আসি।
    হাঁটা কত ভাল কাজ ব’লে ব’লে ফেল হল স্বাস্থ্যশিকারীরা।
    পার্কে লাফিং ক্লাব: হেসে আসি ফিরবার সময়।
                                               (মর্নিং ওয়াক)

    ২.
    সারাদিনব্যাপী প্রীতি-ফুটবল ‘সর্বদলীয় বন্ ধে
          কড়া সেজোমামা, স্ট্রিক্ট অর্ডার: একজামিনেই মন দে
                       ফুলুরি ভাজছে বকুলতলায়
                       জুঁই-বেলফুল ফেরি করে যায়
                                                (সুদূরভাষিণী)

    ৩.
    বিশ্বকাপের পরেই এখন প্রথম পাতায় ইরাকযুদ্ধ।
    খবরকাগজ জেঠুর হাতে, আইবুড়ো বোন আঁকড়ে টিভি,
    শ্যাওলাধরা চানের ঘরে ধুমধাড়াক্কা সকালবেলায়

    শহরতলির রঙওঠা দিন, সাট্টা চোলাই সুপারলোটো,
    একফালি ছাদ — আজকে শুরু হায়ার সেকেন্ডারির লড়াই
                                                (কখন বসন্ত গেল)

    ৪.
    সেবার শীতের শুরু, জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমী
    চন্দননগর নাচছে অবিরাম নৃত্য অনুষ্ঠানে

    ‘ড্রেসকো’ দোকানের সামনে ছেলেবুড়ো মারো ধাক্কা কিউ
    বিশ্বনাথ বলেছিল লক্ষ্মীগঞ্জে কীসের লাইন!
    গলির ভিতরে আলো-অন্ধকার, তার ভিতর এডস্-সিফিলিস
    লাল শাড়ি, ছায়া মতো, স্কার্টপরা, রোগা, স্বাস্থ্যবতী
    সব রকম দিদি ঘুরছে, বাড়িউলি মাসিরা গম্ভীর।
                                               (চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী)

    তাঁর কবিতায় ‘ব্যক্তিগত যেন পবিত্র’ হয়ে ওঠে আর পাঠকও বন্দী হয়ে পড়ে শব্দশৃঙ্খলে। এই রাজ্যের নানা প্রান্তে, ভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ তাঁর কবিতায় এক ভৌগোলিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। তাঁর এই ভ্রামণিক সত্তা যেমন বাংলা ও বাঙালির জীবনকে চশমার গাঢ় লেন্সে দেখতে চেয়েছে তেমনি ছুঁতে চেয়েছে তাঁর ইতিহাসকে। সে ইতিহাস যেমন অতীতের তেমনই চলমানতার। তাই পঞ্চানন কর্মকার, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন আছেন তেমনই আছে গোপাল উড়ে, জেলেপাড়ার সঙ, -আখড়াই-, হাফ-আখড়াই, নিধুবাবুর টপ্পাসহ আরও বঙ্গীয় সংস্কৃতির উল্লেখ। শিকড়ের টানটিকে কখনো আলগা হতে দিতে চাননি তিনি। তাই কবিতার একজন ‘হোলটাইমার’ হিসেবে তিনি সেই শিকড়টিকে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর সৃষ্টির মাঝখানে। পিনাকী সাতের দশকের শুরুতে কবিতা লিখতে শুরু করলেও মধ্যে তাঁর কবিতা রচনায় ছেদ পড়েছে। তাঁর পরিচিতির বিস্তার ঘটতে শুরু করেছে বিগত শতকের নয়ের দশকে। আশি থেকে নব্বইয়ের দিকে এগোতে এগোতে বিশ্বায়নের ফলে দ্রুত পরিবর্তন, অজস্র মিথের ভাঙন, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মননে নিয়ত আলোড়ন, সোভিয়েতের অবলুপ্তি, তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে উত্তাল গণআন্দোলন, প্রযুক্তিগত উন্নতির সম্প্রসার, উত্তর-আধুনিক ভাবনা, মিডিয়ার বিশ্বগ্রাসী বিস্তার, টিভি-ইণ্টারনেট-অফসেট-ডিজিটাল প্রিণ্টিং, কম্পিউটার-ল্যাপটপ ক্যাসেটের পরিবর্তে সিডি, যৌনতার খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা- এমন অনেককিছু পিনাকীর চোখ ও মনের সামনে উপস্থিত হয়েছে। তাঁর ভাষায় ‘চারপাশটা বদলে যাচ্ছিল নয়ের দশকে। তথাকথিত বিশ্বায়ন, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উথ্থান, মোবাইল-ইণ্টারনেট-ইমেল বদলে দিতে লাগল আমাদের চারপাশের দুনিয়া।... বাংলায় কথা বলতে লজ্জা পেলো অনেক ‘বাঙালি’। সজনে পাতার ফড়িং হারিয়ে গেল।’ তাঁর কৃতিত্ব এইখানে যে, তিনি এই সমস্ত কিছুকে আত্মস্থ করে আধুনিক একটি মন নিয়ে তাঁর কবিতায় এই পরিবর্তনের লক্ষণগুলিকে অসংকোচে ব্যবহার করে কবিতাকে স্মার্ট করে তুলেছেন। কবিতায় নতুন নতুন ভাবনা, শব্দ সংযোজন, জীবনের খুঁটিনাটি সমস্তকিছুর উপর দৃষ্টি, নতুন বাক্‌ভঙ্গি, বহুরৈখিক ব্যঞ্জনা, মানবমনস্তত্ত্ব, বিচ্ছিন্নতা, আত্মরতি, বিশ্বের নানা দর্শন, ম্যাজিক রিয়ালিজম, সংগীত, চলচ্চিত্রসহ সংস্কৃতির অন্যান্য শাখা, প্রতিকবিতা — সবকিছুকেই কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি মনে রেখেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের পাঠাভ্যাস তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছে। ‘সাত মিনিট ঝড়’ (২০০৫) কাব্যগ্রন্থের ‘আত্মপ্রকাশ’ কবিতাটির দিকে একটু তাকানো যাক:
    কবিতা লিখতে গিয়ে একদিন আমিই হয়ে উঠলাম কবিতার বিষয়
    গুজরাট, বানতলা, দাঙ্গা, ধর্ষণ, কারফিউ, এফ আই আর,
    মন্ত্রী ভাষণ দিতে এসেছেন, মৈথিলী ভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নে
    বলিউডের শিকারী আর সংরক্ষিত হরিণ হয়ে উঠলাম আমি,
    শিশুসাহিত্যের আড়াল দিয়ে ছড়ালাম ভায়োলেন্স আর বর্ণবিদ্বেষ,
    বেশ একটা কবি-কবি উদাস আত্মকেন্দ্রিক থেকে আমি হঠাৎ
    ইণ্ডিয়া টুডে, ফ্রণ্টলাইন, টাইমস্, বিজনেস ওয়ার্ল্ডের রঙিন কভার...
    আমার সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মানচিত্র, সীমান্ত সংঘাত,
    কোক-পেপসিতে কীটনাশক আছে কি না, পোস্টমর্ডানিজম কী
    ফেং শুই-এর শো রুমে লম্বা লাইন, এ সপ্তাহে আপনার ভাগ্যচক্র,
    লোডসেডিংয়ে জনজীবন, ভায়াগ্রা,---সব কবিতার বিষয় সব আমি
    একশো পঞ্চাশ বছরের হেরিটেজ ট্রেন হাওড়া টু ব্যাণ্ডেল---
    নতুন নতুন ফ্লাই ওভার, মোবাইল সস্তা হচ্ছে, এ টি এম, ক্রেডিট কার্ড,
    গ্রুপ থিয়েটারের নাটক, হ্যারি পটার, চিত্র প্রদর্শনী, পথ-শিশুদের সান্ধ্য স্কুলে
    কবিতার বিষয় আমি সব জায়গায় উপস্থিত…
    আশপাশে বয়ে চলা নিয়ত জীবনপ্রবাহের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভিজে যায় তাঁর কবিতার শব্দসমূহ:
    ট্রেনের কামরায় তাসের দেশ, গভীর মনোযোগে বিবিধ গ্রুপ
    কাগজ পড়ে কেউ, কেউ আবার হিসেব করে শুধু শেয়ারদর
    হিংস্র গুজরাট খুন জখম---মাথায় রোদ বেঁধে মিছিলে মুখ
    কবিতা ছবি গান নাট্যদল ছাত্র ডাক্তার অধ্যাপক—
    ব্যাগ বা স্যুটকেস মালিকহীন বাক্স হোল্ডঅল বোম্ব স্কোয়াড
    পৃথিবীগ্রামে আজ যে- সন্ত্রাস প্রতিটি দিনরাত আতঙ্কের
    লুঠেরা খুনে ঠগ দাঙ্গাবাজ, দাউদদাদা, ভাই ছোটা সাকিল,
    ধর্ম, রাজনীতি, ক্ষমতালোভ—বিশ্বজোড়া এক মাফিয়ারাজ।
                                               (মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য)
    বাংলা কবিতায় পিনাকী ঠাকুর নিজস্ব একটি স্বাক্ষর রাখার দক্ষতা ততদিনে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, সাহসও অর্জন করেছেন তার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা যেতে পারে উদ্ধৃত কবিতাটিকে। কতকগুলি কবিতা নিয়ে একটি সম্পূর্ণ কবিতা ‘কলকাতা ১৮ জুন ২০০২’-এ, চোখ চলে যায় হেডলাইনে, আজকে যা দেখবেন, কবিতার নাম: হারানো সুর, সিনেমার পাতা উলটে এবারে, সীমান্ত আকাশে নতুন ক্ষেপণাস্ত্র সেনাবাহিনী সতর্ক, আসছে আষাঢ় মাস মন তাই ভাবছে, একদিন দেওয়ালের পোস্টার, ঘুম ভেঙে তাকানো হেডলাইন — সব মিলিয়ে গোটা কবিতাটি হয়ে ওঠে ‘সংবাদ মূলত কাব্য’। তাঁর কবিতায় অবচেতনমানস ও অবদমিত চেতনা প্রায়ই উঠে আসে। মূলত ছেদচিহ্নহীন পংক্তির বিস্তার; মুখের গদ্যভাষায় রচিত সেইসব কবিতায় স্মৃতি-সত্তা-সমকাল সবকিছু এক অননুকরণীয় ভঙ্গিতে কবিতায় এসে বসে। আমরা যেন আমাদের অল্পবয়সটিকে খুঁজে পাই:
    ‘মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি’
    ডেকেছি, কারণ আমরা ছিলাম ক্যাবলা, ইন্নোসেণ্ট, আমরা জানতাম
    ‘ঋতু’ মানে গ্রীষ্ম, বর্ষা তারপর শরৎ, হেমন্ত …
    অথচ ‘ঋতুবন্ধে ডাঃ চৌধুরী’ কী ব্যাপার বুঝতেই পারিনি!
    তারপর ধরো গুপ্তপ্রেস পত্রিকায় ‘কোকশাস্ত্র’ বিজ্ঞাপন দেখে
    ‘আসনভঙ্গিমা’ মানে আমরা ভেবেছিলাম ওই যোগাসন।
                                               (আজকে যা দেখবেন)
    বাংলা আধুনিক জনপ্রিয় একটি গানের পংক্তিকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনে যৌনতা, যা ছিল গোপনতম লালন — সেই সামাজিক প্রতিবেশটি আজ ভেঙে চুরমার। এখন জীবনে অন্তর্জাল-এর অবাধ প্রবেশ সব গোপনীয়তাকে প্রতিমুহূর্তে জানার গরিমায় মহিমান্বিত করে তুলছে। এই ‘বিপজ্জনক’ সময় আরও বেশি করে উঠে এলো তাঁর কবিতায় ওই একই নামের বইটিতে। বহুদিন পর আবার তাঁর কাব্যগ্রন্থের সূচিপত্রে দুটি অংশে কবিতাগুলিকে বিন্যস্ত হতে দেখা গেল-- ‘ইস্তেহার’ ও ‘নিষ্ঠুরতম ইস্পাত’। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে আসছে স্পেশাল রিংটোন ডাউনলোড করে ভ্যালেণ্টাইনদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা, তমুকরাম ভুজিয়াবালা — ময়রাদোকান প্রায় বন্ধ হয়ে আসার কথা, বিয়েবাড়ির পরিবেশনে ক্যাটারারের কথা, ফাংশানে ডিসকো নাচসহ জোজোকণ্ঠীর গানের কথা, ডেটা এণ্ট্রির কথা, বিউটি পার্লার, মোবাইল, ই-মেল, কেবল্ চ্যানে্ল, সোনালি চতুর্ভুজ-এর কথা থাকলেও তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের ছোঁয়া কবিকণ্ঠে জেগে ওঠে ‘ঘাড়ের ওপর ভোটের চপার, জাগো চিকেন ভারতবাসীগণ’। বাইরে চারদিকে প্রগতির রমরমা অথচ ‘ফ্যাক্টরি সব বনধ এখন, তিনটে বড়, স্মল আর মিডিয়াম/ স্টেশন জুড়ে মাছের বাজার, রানিং ট্র্রেনে নাইট কুইন ধূপ’— সময়ের এক ধরনের ডকুমেন্টেশন কবিতাগুলিকে বিশিষ্ট করে তোলে। ‘বিপজ্জনক’ নামের নামকবিতায় আত্মকথনের ভঙ্গিতে বর্ণিত হয় সমকাল। এইরকম অনেক দীর্ঘকবিতার আধারে তিনি সময়কে ধরে রেখেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের নানা ডিপ্রেশন, অভিজ্ঞতা, তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষ, আশেপাশের মফসসল, পরিবর্তমান সময় — এইসব কিছুর মধ্যেই তিনি খুঁজে পান কবিতা। টাইমমেশিনে চড়ে কখনো কখনো তাঁর কবিতা গিয়ে পড়ে অতীতের মাঝখানে। সেখানে কখনো আসে মোরান সাহেবের বাংলো যেখানে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, প্রবর্তক সংঘে লুকিয়ে-থাকা বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের কথা, করুণাসাগর বিদ্যাসাগরের কথা, রামমোহনের কথা, ১৩০০ সালে ঝড়ের রাতে বোলপুরের ভুবনডাঙায় অগণন মৃত্যু, শিশির ভাদুড়ীর কথা, রমেশচন্দ্র দত্তের কথা, মধুসূদন দত্ত, কৃত্তিবাস ওঝা, বিপ্রদাস পিপিলাই, বিভূতিভূষণ, জগদীশ গুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের উল্লেখে তৈরি হয়ে যায় এক বিরাট টাইমস্পেস যার মধ্যে ঢুকে থাকে এক বিস্তৃত সময়, তাকে জড়িয়ে অনেক ইতিহাস। তাই কখনো তাঁর কবিতায় সময় চলতে শুরু করে উলটো দিকে ‘বাস লরি/ মারুতি টাটা-সুমোর শব্দ মুছে গিয়ে/ ভুবনডাঙার মাঠে’ শুনতে পাওয়া যায় ‘পাল্কির গান’। অতি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকা যে কোনো বিষয়কে নিয়ে কবিতা রচনার ক্ষমতা তাঁর ছিল, তার সঙ্গে ছিল কৌতুকমিশ্রিত বাক্‌ ভঙ্গি। কখনো কখনো যেন স্কিৎসোফ্রিনিয়া, অ্যাসাইলামের পরিবেশ ঢুকে পড়ে কবিতায়। ‘কালো রঙের আগুন’ কাব্যগ্রন্থের ‘বেড নং ৪৬’ কবিতার কিয়দংশ পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে:
    দ্যাখো, ওইখানে আমি থাকতাম। ওরা দিনরাতে
    চা দিত দু’বার। সিগারেট একদম বারণ।
    ট্রেন দেখা যেত। দূর গোরস্থানে এক আধটা চিরাগ।
    নিজেই এসে ভর্তি হয়েছিলাম।
    জীবনের শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ন্যুড স্টাডি’ (২০১৯)-তেও আছে ‘ক্ষতবিক্ষত লড়াই খ্যাপার নষ্ট জীবন’-এর কথা। আছে অতীতের নস্টালজিক স্মৃতিজনিত বেদনার উচ্চারণ। রোজকার জীবনের ব্যবহৃত ভাষাভঙ্গিকে ঘিরেই তাঁর অনেক কবিতা গড়ে ওঠে। আসলে মানুষ যে নিয়ত পাল্টে যাচ্ছে, তার বলার ভঙ্গিটাও বদলে যাচ্ছে — এইসব কিছু তাঁর কবিতাকে সমকালের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, গোপনীয়তার আড়ালটাও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। শব্দ তাঁর কাছে বশ মেনেছিল। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘শব্দ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আমরা পাই। সব কিছুকে আমরা মুঠোয় আনি। শব্দ তাই আমাদের মনের হাতিয়ার।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভালোবাসা, একসময়ে জয় গোস্বামীর সান্নিধ্য তাঁকে সমৃদ্ধ করেছিল। বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকার চাকরি চলে যাওয়ার পর অনেক বড়ো বড়ো পত্রিকার চাকরির অফার ছেড়ে দিয়ে সেই তুলনায় অনেক কম টাকায় বাংলা কবিতার উন্নতিসাধনে একটি সাহিত্য পত্রিকার হাল ধরেছেন কবি পিনাকী। অভাব আর অশান্তিই বার বার তাঁর কবিতার কণ্ঠলগ্না হয়েছে।

    ২০১৫ বইমেলায় কৃত্তিবাসের স্টলে পিনাকী ঠাকুর ও ধনঞ্জয় মাইতি

    গ্রিক দার্শনিক আরিস্ততল বলেছিলেন, (style) ‘invented by the poet himself’ ফরাসি দার্শনিক বুঁফো সেই কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন, ‘Style is the man himself’--- ভাষার পাশাপাশি বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার, চিত্রকল্প, ছন্দ-অলংকার, বিচ্যুতি, যতিচিহ্ন ইত্যাদি নিয়ে কবিতার প্রকরণশৈলীর সমৃদ্ধি ঘটে। একধরনের আত্মজৈবনিক কথনের ভঙ্গি তাঁর অনেক কবিতাতেই দেখা যায়। ছন্দ নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি আজীবন করেছেন, মিশ্রকলাবৃত্ত বা পয়ার, ও কলাবৃত্ত, — এই দুই রীতির ছন্দের পাশাপাশি নানা আকারের গদ্যকবিতা লেখার প্রয়াস তিনি জারি রেখেছেন। দু-একটি দৃষ্টান্তের দিকে তাকানো যেতে পারে:

    ১। দেখিয়াছি তারে / রজনী উতলা হলে

                                                 (৬+৮)
        বিজন আমার / মরা নদীটির ধার

                                                 (৬+৮)
    ২। দুপুরে বৃষ্টি, / রেনি ডে-র ছুটি

                                                 (৬+৬)
        দিনান্তে ছিল / আলুভাজা-রুটি

                                                  (৬+৬)
        আচারের ভাগ/ নিয়ে কতদিন/ বলো তো কাউকে /মারিনি!

                                                  (৬+৬+৬+৩)
    ৩। সকল রহস্য শেষ। রোমাঞ্চের অবসান। সব প্রহেলিকা সিরিজের চটিবই তুই কি ফেরত নিবি, মধু? তুমি কি ফিরিয়ে নিতে এসে বেশ আমার দুর্বল, শুধুই সা-সেধে দিন-কাটানো দিনের ফোঁটা বৃষ্টিজল ভেবে রবিবার বারান্দায় উঠে বলবে, কী রঙের শার্ট পরে, কোন্ ছবি-আঁটা সিগারেট খেয়ে থাকে আততায়ী--- ভালবাসে ছোরা না কার্তুজ?

    প্রথমটি মিশ্রকলাবৃত্ত, দ্বিতীয়টি কলাবৃত্ত আর তৃতীয়টি গদ্যকবিতা। মফসসলের ছেলে বলে সেখানকার জীবন তাঁর বেশিরভাগ কবিতায় ছায়া ফেলেছে। প্রকৃতিলগ্নতা আছে, আছে সারা দিনমানের খণ্ড খণ্ড মুহূর্ত, যৌনতা, বহু তৎসম, তদ্ভব, দেশি-বিদেশি শব্দের টানে আঁকা শব্দচিত্র। অনেক কবিতাই যতিহীন আবার অনেক কবিতায় ছোটো ছোটো বাক্যের ব্যবহার। নানা অলংকারের ব্যবহারে তাঁর কবিতা মোহমুগ্ধ করে ফেলে পাঠককে। ‘ওই কালো জিপ হাঁকড়ে কিরণ বেদী মতো পহেলা শ্রাবণ’, ‘জেলা কমিটিদের বলো সাপ্লাই দিক একশোটা উত্তমকুমার’, ‘বাদাম খাওয়ার দরকারই নেই, বিগ্রেড গেলে টিফিন দ্যায়’ — এমন বহু অশ্রুতপূর্ব পংক্তির দেখা মেলে তাঁর কবিতায়। আবার ছোটো ছোটো বাক্য অনেক কবিতার শরীর গড়ে তোলে। যেমন:

    রুদ্রপলাশ। কিংশুক।
    রডোডেনড্রন। অর্কিড।
    পেয়ালা-পিরিচ। টোস্টার।
    আমের ঠাণ্ডা সরবত।
    অনেকদিন না লিখে ভিতরে ভিতরে নিজের কলমটিতে তিনি শান দিয়েছিলেন, বেকারজীবনে বন্ধু শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন ‘কাহ্ন’ পত্রিকা। একাকীত্ব আর অবহেলার জীবনে কিছু বন্ধু তাঁর জন্য সাধ্যমতো করেছেন। নিজের ভবিষ্যৎকে নিজেই লিখে গেছেন তিনি ‘কবি মৃত। চাকরি নেই। মৃতের দারিদ্র্য নিরাপদ।’ সত্যটিও জানিয়ে গেছেন ‘মৃত কবি নিরাপদ’। কিন্তু সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার সঙ্গে দশ-বারো দিন যুঝে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কবি নিরাপদ অবস্থানে থাকলেও বাংলা কবিতার পাঠকদের তিনি নিরাপদে রেখে যাননি, দিয়ে গেছেন তাঁকে আবিষ্কারের দায়িত্বভার, পাঠকদের ঘিরে রয়ে গেছে তাঁর লেখা শব্দাবলীর অগ্নিময় চিতার উত্তাপ। সে আগুন আরও বহুকাল জ্বলবে, জ্বালিয়ে রাখবে অগ্নিময় সংকেত।


    ('পরবাস'-এ প্রকাশিত কবি পিনাকী ঠাকুরের কবিতা এখানে পড়ুন।)


    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাজীব চক্রবর্তী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments