• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | উপন্যাস
    Share
  • মহাসিন্ধুর ওপার হতে : অমিতাভ প্রামাণিক


    || দশ ||

    শীত পড়ে যাওয়ায় সমরকন্দ আক্রমণ স্থগিত রেখে অন্দিজান ফিরে গেছিল বাবর। তার মেজ জ্যাঠার মেজ ছেলে বৈশুঙ্ঘর মির্জা সমরকন্দের অধিপতি। সমরকন্দের ওপর নজর শুধু বাবরেরই নয়, বৈশুঙ্ঘরের নিজের সহোদর দাদা মাসুদ মির্জা ও সহোদর ভাই আলি মির্জারও। বুখারার অধিপতি আলি মির্জার সঙ্গে বাবরের গোপন চুক্তি হয়েই আছে, শীতকাল পেরোলেই তারা একযোগে সমরকন্দ আক্রমণ করবে।

    সারা শীতকাল জুড়ে বাবর চুপচাপ বসে না থেকে এর জন্যে প্রস্তুতি নিতে লাগল। এমনি এমনি যুদ্ধ জেতা যায় না, তার জন্যে লাগে উপযুক্ত সেনা। আশপাশ থেকে বহু তাগড়া জোয়ানকে নিজের দলে জুটিয়ে সে পোক্ত সেনাবাহিনী গঠন করতে লাগল। কাকপক্ষীও জানতে পারল না বাবরের মতলবের কথা।

    ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাস। অন্দিজান থেকে বাবর ও বুখারা থেকে আলি মির্জা একযোগে যাত্রা শুরু করল সমরকন্দের দিকে। অন্দিজান শাসন ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব বাবর দিয়ে গেল আলি দোস্ত তঘাই নামে বিশ্বস্ত বেগের কাছে।

    শত্রুসৈন্য সমরকন্দের দিকে ধেয়ে আসছে, এ খবর যথাসময়ে পৌঁছে গেল বৈশুঙ্ঘর মির্জার কাছে। নিজেদের সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের মোকাবিলায় প্রস্তুত হল সেও। তার সেনাপতি মেহদি সুলতান দুর্ধর্ষ যুদ্ধবাজ। আলি মির্জা সমরকন্দের কাছে কুফিন নামে এক জায়গায় হাজির হতেই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মেহদি সুলতানের সৈন্যদল। তুমুল যুদ্ধে ছত্রখান হয়ে গেল আলি মির্জার উজবেকি সেনাদল। যারা প্রাণ হারাল না, তারা পালিয়ে চলে গেল তুর্কিস্তানের উজবেকি সেনাপ্রধান শইবানি খানের কাছে, আশ্রয় নিল সেখানে। আলি মির্জা পিছু হঠতে বাধ্য হল।

    বৈশুঙ্ঘর নিজেও কিছু সৈন্য নিয়ে ছাউনি ফেলেছিল সরাইপুল নামের অন্য এক জায়গায়। সে জানেশত্রুরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ শানায়, কাজেই সব সৈন্য এক জায়গায় রাখা যাবে না। বৈশুঙ্ঘরের ছাউনির ঠিকানা পেয়ে পলায়নপর আলি মির্জা নতুন উৎসাহে অন্যদিক থেকে ঘোড়া ছোটালসেদিকে। রাঘব বোয়ালকে হারাতে পারলে বাকিদের নতিস্বীকার করানো কঠিন না। সে খবর বৈশুঙ্ঘরের ছাউনিতে পৌঁছাতে সে সঙ্গে সঙ্গে খাজা আবুল মকারম আলি নামে আর এক সেনার নেতৃত্বে কিছু সেনা পাঠাল আলি মির্জার আক্রমণ প্রতিহত করতে। কিন্তু তারা আলি মির্জার কাছে যুদ্ধে হেরে পালিয়ে এল বৈশুঙ্ঘরের ছাউনিতে। তাদের তাড়া করে এল আলি মির্জার দল। দুই ভাই এবার মুখোমুখি হল সমরাঙ্গনে।

    বাবরের কানে এ খবর পৌঁছাল। বাবর তো এটাই চাইছিল। দুই ভাই যুদ্ধে মারামারি করে মরুক, যাতে সে সমরকন্দের গদির দখল নিতে পারে। সমরকন্দ মানে চেঙ্গিজ খাঁর শহর। সমরকন্দ মানে তৈমুরলঙ্গের শহর। এদের খানদানি রক্ত তার ধমনীতে। সমরকন্দ দখল না করতে পারলে বৃথাই তার যোদ্ধাজীবন।

    শ’ তিনেক লড়াকু যোদ্ধা ছুটে গেল তার পরামর্শে বৈশুঙ্ঘরের ছাউনির দিকে। তাদের উদ্দেশ্য অতর্কিতে আক্রমণ হেনে পুরো বেসামাল করে দেওয়া বৈশুঙ্ঘরকে। বৈশুঙ্ঘর ধারণাই করতে পারেনি যে বাবরও তার দিকে এগিয়ে আসছে, বিশেষ করে আলি মির্জার সঙ্গে তার সম্ভাব্য যুদ্ধের ঠিক প্রাক্কালে। এই দুই শত্রুকে একসঙ্গে মোকাবিলা করা তার পক্ষে এখন অসম্ভব, সে শিবির গুটিয়ে পশ্চাদপসারণের প্রস্তুতি নিল।

    বাবরের হানাদার সেনারা বাঘের মত তাড়া করে চলল তাদের পেছন পেছন। ঘোড়া থেকে শুরু হল ঝাঁকে ঝাঁকেতীর বৃষ্টি। তার আঘাতে ছুটন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে কেউ প্রাণ হারাল, কেউ বন্দি হল। তাদের কাছে যা পাওয়া গেল, সব লুঠ করে নিল বাবরের সেনারা। বৈশুঙ্ঘর কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে গেল সমরকন্দের দুর্গে।

    শত্রুপক্ষের এই পিছন-ফিরে পালানোয় প্রবল খুশি বাবর। সে বুঝেছে সমরকন্দ অধিকার এখন আর অসম্ভব নয় আদৌ। বৈশুঙ্ঘরের দলের মনোবল এখন তলানিতে, এই হচ্ছে সময় চরম আঘাত হানার। আলি মির্জার সঙ্গে হাত মিলিয়ে দু’ দলের সেনা চলতে লাগল সমরকন্দের দিকে। পথে পড়ল শিরাজ শহর। বৈশুঙ্ঘর একে রক্ষার ভার দিয়েছিল কাশিম বেগ দুলদাই নামে এক বেগের কাছে। তার সেনারা বাবরের সেনাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করল। বাবর নিজের সহচর ইব্রাহিম সারুর ওপর দায়িত্ব দিল শিরাজ দুর্গের।

    পরদিন ইদ-উল-ফিতর। সারাদিন উপোস। বিকেলের দিকে বাবরের সেনা রওনা হল সমরকন্দের দিকে। পথে পড়ল আবিয়ার নদী। সেটা পেরিয়ে এক মাঠে পড়ল বাবরের ছাউনি।

    সমরকন্দের অধিবাসীদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তুমুল ব্যস্ততা। তারা শুনেছে শিরাজের পতন হয়েছে। বৈশুঙ্ঘর মির্জা বাবরের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছে। সমরকন্দ দখল হলে বাবর কি আর তাদের ছেড়ে দেবে? একে একে কোতল করতে শুরু করবে হয়ত। কাশিম বেগ দুলদাই শিরাজ রক্ষা করতে না পেরে পালিয়ে এসেছিল। সে প্রায় শ’ চারেক বেগ ও সেনা জুটিয়ে এনে বাবরের ছাউনিতে এসে তার দলে যোগ দেওয়ার অভিপ্রায় জানাল।

    উজবেক ছোট ছোট রাজ্যের সেনা ও তাদের অধিপতিদের এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক। নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তারা যখন যার সঙ্গে প্রয়োজন, তখন তার সঙ্গে যোগ দেয়। আজ যে দলের সঙ্গী, কাল সে দলের লোকদের হত্যা করতে তাদের আদৌ হাত কাঁপে না। এ রকম দলছাড়াদের নিজের দলে নিলে যে ঝামেলা হতে পারে, সে বিষয়ে বিলক্ষণ অবহিত বাবর। সে তাদের নিজের দলে ঢোকাতে চায় না। এরা বর্বর, লোভী, এদের সমর্থন অনিশ্চিত। কিন্তু সমরকন্দ যতক্ষণ না নিজের মুঠোয় আসছে, ততক্ষণ শত্রু কম রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। অবশ্য ঝামেলা শুরু করলে তা কঠোর হাতে দমন করতে হবে, সে সময় তাকে নরম হলে চলবে না। সেনাদের পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া আছে, যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন লুঠপাট না করে, পথে যেতে যে গ্রাম বা শহর পড়বে, সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে যেন খারাপ আচরণ না করা হয়।

    কিন্তু দেখা গেল, নতুন যোগ-দেওয়া এই দলের লোকদের মধ্যে সেই অনুশাসন মানার কোনো ইচ্ছেই নেই। পরদিন এক গ্রাম পার হওয়ার পর বাবরের কানে এল, এদের মধ্যে কয়েকজন গ্রামের বাড়ি লুঠ করেছে, সেখানকার নিরীহ মহিলাদের ধর্ষণ করেছে। এ জিনিস একেবারেই বরদাস্ত করবে না বাবর। তিনজনকে ছাউনিতে ডেকে সবার সামনে তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করা হল তার আদেশে।

    আরও একটা নদী পেরিয়ে ইয়াম শহরে তাঁবু ফেলল বাবর। একেবারে অনায়াসে সে এখানে পৌঁছাতে পারেনি অবশ্য। পথে বৈশুঙ্ঘরের কিছু সেনার সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়েছে, তাতে তার বাবা উমর শেখ মির্জার এক সময়ের সহচর ও বাবরের বিশ্বস্ত বেগ খাজাকি মোল্লার জীবনহানি হয়েছে। খাজাকি মোল্লা শুধু যুদ্ধই করতেন না, বাবরের বাবা তাকে সিলমোহর রক্ষকের পদে বহাল করেছিলেন। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি, ভাষার ওপরেও তার প্রভূত দখল। উমর শেখের মত তারও পারদর্শিতা ছিল বাজপাখি পালনে। পোষা বাজপাখি দিয়ে তিনি শিকার ধরতে পারতেন, যাদুবিদ্যাও জানতেন। এমন সহযোগীর অভাবে বাবর বিমর্ষ হয়ে গেল। আহতও হল কয়েকজন বর্শা ও তীরের আঘাতে।

    ইয়ামের ছাউনিতে শুরু হল সমরকন্দের কারবারিদের আনাগোনা। তারা মালপত্তর নিয়ে আসে, বিক্রি করে সেনাদের কাছে। একদিন বিকেলে নমাজ পড়ার সময় শোনা গেল বিরাট শোরগোল। বাবর খোঁজ নিয়ে জানল, এই ব্যবসায়ীদের জিনিসও লুঠ করেছে তার সেনাদের দলে ঐ নতুন যারা যোগ দিয়েছে, তাদের কেউ কেউ। অবিলম্বে তাদের নির্দেশ দেওয়া হল পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই যেন যাদের জিনিস কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তারা তা ফেরত পেয়ে যায়। রাতের মধ্যেই বাড়ি খুঁজে খুঁজে জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে এল সেনারা, নইলে তাদের গর্দান যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।

    কিছুদিন পর সেখান থেকে পাট চুকিয়ে এগিয়ে গেল বাবর সমরকন্দের দিকে, ছাউনি ফেলল সমরকন্দের মাত্র তিন ক্রোশ আগে। সেখান থেকে শহরের চারদিক অবরোধ করে ফেলা হল সেনা পাঠিয়ে। মাঝেমধ্যেই বাবর সেনা পাঠাতে লাগল প্রতিরোধ ভেদ করে শহরে ঢুকে পড়তে, কিন্তু কিছুতেই বৈশুঙ্ঘরের সেনাদের পর্যুদস্ত করে এগোতে পারল না। তীব্র সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হতে লাগল। বাবর বুঝে গেল, অধৈর্য হলে চলবে না। সময় নিয়ে অপেক্ষা করলে সবুরে মেওয়া ফলতে বাধ্য। কতদিন আর এইভাবে দুর্গ রক্ষা করতে পারবে বৈশুঙ্ঘর? দেড় মাসের ওপর বাবর অপেক্ষায় রইল এইভাবে।

    শহরের মধ্যে চলতে লাগল জল্পনা। বৈশুঙ্ঘরের সমর্থক একদল শহরবাসী ফন্দি করে বাবরের কাছে এক প্রতিনিধিদল পাঠাল এই বলে যে, সে যদি শহরের কাছাকাছি এক গুহায় তাদের সঙ্গে দেখা করে, তবে তার হাতে তুলে দেবে দুর্গে প্রবেশ করার চাবি।

    সেই গুহার স্থানীয় নাম প্রেমিক গুহা। বাবর ওদের কথায় বিশ্বাস করে কয়েকজন ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক সেনা নিয়ে গেল সেই প্রেমিক গুহায়। অকুস্থলে পৌঁছে বাছা বাছা কয়েকজনকে পাঠাল গুহার ভেতরে। ছোটবেলা থেকে তার দেখাশুনা করে যে চাকর, সেই হাজি, আরও কয়েকজন অতি বিশ্বস্ত ও কর্মঠ সহযোদ্ধা ছিল সেই দলে। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুহার মধ্যে তারা বন্দী হল শহরবাসীদের হাতে। নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করল তারা।

    ক্রুদ্ধ, অপমানিত বাবর ফিরে এল ছাউনিতে। এবার আর অপেক্ষা নয়। সর্বাত্মক লড়াইয়ে যাবে সে সমরকন্দ দখলে।

    সেই রকমই প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাবর। হঠাৎই মেঘ না চাইতেই জল! দুদিন পরেই সমরকন্দ শহর থেকে এক বড়সড় দল — সে দলে যেমন আছে গণ্যমান্য শহরবাসী, তেমনি আছে ব্যবসায়ীরা — এসে হাজির বাবরের ছাউনিতে। প্রকাশ্যে তার আনুগত্য স্বীকার করে তারা ওখানেই ব্যবসাপত্তর শুরু করে দিল। বাবর বুঝে গেল সমরকন্দ দখল এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু দুর্গে সামনাসামনি প্রবেশ এখনও নিরাপদ নয়।

    অকারণে ছাউনি পেতে বসে না থেকে বাবর কিছু সৈন্য নিয়ে একদিন অতর্কিতে আক্রমণ করল পাশের পাহাড়ের কোলে এক ছোট দুর্গ। সহজেই সেটা তার করায়ত্ত হয়ে গেল। তারপর পুরো সেনাবাহিনী একত্রিত করে এগিয়ে গেল সমরকন্দের দুর্গের দিকে। কুল্‌ব নামে এক ঘাসজমির মাঠে পড়ল তার তাঁবু। সামনে এক নদীর ওপর দুখানা সেতু, ওপারেই সমরকন্দ।

    সমরকন্দের এক বিপুল সেনাদল সেতুর ওপর থেকে আক্রমণ করল বাবরের সেনাদের। বাবর তখনও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে তার সৈন্যরা উপযুক্ত জবাব দিতে পারল না। কয়েকজন মারা পড়ল, কয়েকজন বন্দীও হল শত্রুদের হাতে।

    উপায় না পেয়ে বাবর কুল্‌ব থেকে একটু সরে গিয়ে এক পাহাড়ের আড়ালে ছাউনি ফেলা সাব্যস্ত করল। সমরকন্দের সেনারা ভাবল বাবর পালিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে তারা আক্রমণ শানাল। বাবর সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সেনাদের আদেশ দিল শত্রুদের দিকে ধেয়ে যেতে। দুই সেতুর মধ্যবর্তী জায়গায় তুমুল যুদ্ধ হল। বৈশুঙ্ঘরের সেনাদলের বিশিষ্ট অনেকেই নিহত হল সেই যুদ্ধে। শহরবাসী সহ বেশ কিছু যুদ্ধবন্দীদের ধরে আনা হল বাবরের কাছে। প্রেমিক গুহায় বাবরের খাসভৃত্যসহ কয়েকজনের মৃত্যু তখনও বাবরের সচেতন মনে দগদগ করছে। বন্দীদের জিভ উপড়ে নিয়ে গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে দগ্ধে দগ্ধে মেরে ফেলার হুকুম দিল বাবর। তার সেনারা সমরকন্দের দুর্গপ্রাকারের পরিখার একদম কাছ অবধি চলে গেছিল। সেখান থেকে ধরে এনেছিল কিছু বাঁদি। রাতে তাদের নিয়ে ছাউনিতে ফুর্তির ফোয়ারা ছুটল।

    এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্য প্রবেশ করছে তুলারাশিতে। শীত পড়ছে। শীতকাল মানে খোলা আকাশের নীচে ছাউনি করে থাকা অসম্ভব। হয় তার আগেই সমরকন্দ আক্রমণ করতে হবে। অথবা আশ্রয় নিতে হবে কাছাকাছি কোনো দুর্গে। এখান থেকে অন্দিজান ফিরে যাওয়ার এখন কোনো মানেই হয় না, এই যুদ্ধ তাদের না-জেতার, সমরকন্দ দখল না-করার কোনো কারণ নেই।

    বিশ্বস্ত বেগদের ডেকে সভা করল বাবর। ঠিক হল, কাছের এক দুর্গের দখল নিয়ে আগে সেখানে শীতের উপযুক্ত আবাস তৈরি করতে হবে, তারপর সেনাদল এক এক করে সেখানে স্থানান্তরিত করা হবে। এখনই সেটা সবাইকে জানিয়ে দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, সেই অবস্থায় শত্রুরা আক্রমণ করলে তাদের ক্ষতি।

    দুর্গ নির্বাচন করে তার সামনের মাঠে ছাউনি পড়ল তাদের। শহর অবরোধ করাই রইল। কুটির তৈরির জন্যে লাগিয়ে দেওয়া হল কিছু সেনাকে। তাদের পরিদর্শক হিসাবেও থাকল কয়েকজন। যতদিন আবাস তৈরি না হয় ততদিন থাকার জন্যে কেউ কেউ কাছাকাছি কিছু শহরেও চলে গেল।

    সমরকন্দের দুর্গের মধ্যে বৈশুঙ্ঘর মির্জা অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে ছিল না। সে জানে, তার রসদ ফুরিয়ে আসছে। বহুদিন ধরে সে অবরুদ্ধ, এখন বেরোতে যাওয়াও বিপদ। বাবরের সঙ্গে কতজন সেনা আছে সে নিশ্চিত নয়। সাহায্যের জন্যে বারে বারে তার দূত যেতে লাগল তুর্কিস্তানে শইবানি খানের কাছে। শইবানি খান যদি বাইরে থেকে বাবরের ওপর আক্রমণ শানায়, তবে সে দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে এসে তাকে পরাস্ত করতে পারবে।

    বাবরদের শীতকালীন আবাস দুর্গের মধ্যে প্রস্তুত হতেই ছাউনি গুটিয়ে তারা সেখানে আশ্রয় নিল। তখনও কাছেপিঠের শহরগুলোতে যারা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের কাছে সে খবর যায়নি। এর মধ্যেই শইবানি খান দ্রুতগতিতে এসে উপস্থিত হল তার দুর্গের কাছে। এসে বেশ অবাক হল শইবানি খান। দূতের মুখে শুনেছিল বাবরের ছাউনি মাঠের মধ্যে, এখন দেখছে মাঠ পুরো ফাঁকা। মাঠের মধ্যে শত্রুদের অতর্কিতে আক্রমণ করা অনেক সহজ। চারদিক ঘিরে ফেলে ঝাঁক ঝাঁক তীর চালালেই তারা দিশেহারা হয়ে মারা পড়বে, অনেক সময় নিজেদের ছোঁড়া অস্ত্রেই।

    বাবরের সেনাদল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় আদৌ, তারা তখন ঘর গোছাচ্ছে। অনেকে তো ফেরেইনি। এর মধ্যে শইবানি খানের মত শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা বেশ কঠিন। কিন্তু বাবর অদম্য, অবিলম্বে সেনাদের আদেশ দেওয়া হল দুর্গের চারিদিকে সারিবদ্ধ হয়ে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে।

    শইবানি খান এদের লোকবল জানে না, সে দেখল বাবর যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত এবং তার সেনাও প্রচুর। দুর্গের মধ্যে উঁচুতে আছে বলে তারা অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এ সময় তাদের আক্রমণ করতে হলে নিজের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে, হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। নিরাশ হয়ে শইবানি খান বাবরকে আক্রমণ না করে সমরকন্দের দুর্গে চলে গেল বৈশুঙ্ঘর মির্জার সঙ্গে দেখা করতে।

    এতে বৈশুঙ্ঘর খান খুব চটে গেল। সে ভেবেছিল শইবানি খান বাবরের সেনাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে সে বাকিটুকু সামাল দিতে পারবে। শইবানি খানের সঙ্গে ভাল করে কথাই বলল না বৈশুঙ্ঘর। তার সেনাবল নেই, তার ভাঁড়ারে টান, এখন এই শুকনো কথাবার্তার অর্থই বা কী!

    দূত পাঠিয়ে ডাকিয়ে এনে উপযুক্ত আদর-অভ্যর্থনা না পেয়ে শইবানি খান অপমানিত বোধ করে নিজের রাজ্যে ফিরে গেল।

    সাত মাস ধরে বৈশুঙ্ঘর মির্জা বাবরের অবরোধ সামলে চলেছেন। শইবানি খান ছিল তার শেষ ভরসা। তারা চলে যেতেই সে একেবারে নিরাশ হয়ে গেল। এখন বাবর সামনাসামনি যুদ্ধ করতে এলেও তাদের হার অনিবার্য, প্রাণ সংশয়। কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারী নিয়ে এক রাতে সে দুর্গ ছেড়ে যাত্রা শুরু করল নতুন আশ্রয়ের খোঁজে। কুন্দুজে আছে খুশরাউ শা, তার কাছে আশ্রয় মিলতে পারে।

    চরের মুখে এই খবর পেয়েই পরদিন ভোরবেলা নিজের দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে অশ্বারোহী বাবর সৈন্যসামন্ত নিয়ে সমরকন্দের দিকে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হয়, সেই বাবরকে তাদের সম্রাট হিসাবে কুর্নিশ করে। মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। বাবরকে – তাদের নতুন সম্রাটকে — অভ্যর্থনা জানাতে সমরকন্দের প্রাসাদের প্রাকারে জমা হল হাজার হাজার জনতা। মুখে তাদের বাবরের নামে জয়ধ্বনি।

    মাত্র পনের বছর বয়স বাবরের। এই মুহূর্তে সে তার স্বপ্নের দেশ সমরকন্দের অধিপতি। নিজের ডায়রিতে লিখল সে — সারা পৃথিবীতে সমরকন্দের মত অপরূপ শহর কি আর আছে?

    * * *

    অতি প্রত্যূষে শয্যাত্যাগ করে সূর্যপ্রণামাদি অন্তে পাঠদানে বসেছেন কেরালার কেলাল্লুরের নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ নীলকণ্ঠ। তাঁর মুখে হাল্কা বিষাদ, কপালে চিন্তার রেখা। সমুদ্র-উপকূলে বিদেশীদের সঙ্গে কালিকটের জামোরিনের সংঘর্ষ দিন দিন বেড়েই চলেছে, খবর পাচ্ছেন নিয়মিত। যদিও এখনও তা উপকূল অঞ্চলেই নিবদ্ধ আছে, শত্রুরা সুযোগ পেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লে কতদিন এই শিক্ষায়তন তিনি চালিয়ে যেতে পারবেন, কে জানে! বিদেশীদের আচার-ব্যবহার তিনি সম্যক জানেন না, তারা কী চায়, তাও তাঁর অজানা। তাঁর উৎসাহ গণিতে, জ্যোতির্বিদ্যায়। প্রথমে বেদান্তের পাঠ তিনি নিয়েছিলেন আচার্য রবি-র কাছে। শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, কল্প ও জ্যোতিষ — ষড়বেদাঙ্গেই পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন নীলকণ্ঠ। পিঙ্গলের ছন্দসূত্র, মীমাংসাশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণেও তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি, এসব নিয়ে এদের পণ্ডিতদের সঙ্গে সমানে সমানে চর্চা করতে সক্ষম ছিলেন তিনি। কিন্তু কেরালা-দৃগ্‌গণিত রচয়িতা আচার্য পরমেশ্বরের পুত্র দামোদর তাঁকে উৎসাহিত করেন আকাশে চলমান গ্রহ-নক্ষত্রের পথ অনুসরণে ও তজ্জন্য প্রয়োজনীয় গণিতে। স্বনামধন্য প্রাচীন জ্যোতির্বিদ আচার্য আর্যভটের আরকগ্রন্থ আর্যভটীয়র একটি সরল টীকাভাষ্য রচনা করেছেন নীলকণ্ঠ, বর্তমানে তিনি ব্যস্ত তন্ত্রসংগ্রহ নামে আর এক গ্রন্থের উপাদান সংগ্রহে। বুধ ও শুক্রগ্রহের গতিপথ নিয়ে তাঁর গবেষণা, এ বিষয়ে আচার্য আর্যভট যা বলে গেছেন সেগুলো নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করছেন তিনি। পঞ্চান্ন বছর বয়স তাঁর, স্বাস্থ্য সুঠাম। বিশিষ্ট নাম্বুদিরিদের নীতি অনুসরণ করে বৈদিক মতে তিনি সোমযজ্ঞ পালন করেন বলে তাঁকে সোমযাজী বলা হয়।

    নীলকণ্ঠ গার্গ্য-গোত্রীয় জটাদেবের পুত্র, শঙ্কর নামে তাঁর এক ভাই আছে। এঁরা ঋগ্বেদের অশ্বালায়ন-সূত্রের অনুসারী। পত্নী আর্যাদেবী, দুই পুত্র রাম ও দক্ষিণমূর্তি ছাড়াও পুত্রসম তাঁর শিষ্যদের সংখ্যা কম নয়।

    তেমনই এক শিষ্য রামানুজন এড়ুতাচানকে চুপচাপ আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীলকণ্ঠ বলে উঠলেন, কী ব্যাপার রামানুজন? তোমার দেখছি পাঠে একেবারেই মন নেই। গতদিন যে সূত্রগুলোর ওপর পাঠ দিয়েছিলাম, সেগুলো আয়ত্ত করেছ?

    রামানুজন চুপ করে বসে থাকল। সে ঐ সূত্রগুলো পড়েইনি। আগের দিনের পাঠও মন দিয়ে শোনেনি। কী যেন একটা নাম বলেছিলেন গুরুদেব, কার যেন সূত্র, কিছুতেই তার স্মরণে আসছে না। গণিতের চেয়ে কবিতা লেখায় তার আগ্রহ বেশি। সে এখনই কয়েক লাইন মালয়ালম কবিতা লিখে ফেলতে পারে।

    আজ নতুন আর একজন ছাত্র আসায় রামানুজন ছাড় পেয়ে গেল। নীলকণ্ঠ বললেন, আবার সেই অধ্যায়টা বলছি, মন দিয়ে শোনো। অতি প্রাচীনকালে, আচার্য আর্যভটেরও অনেক শতাব্দ আগে, এমনকি ভগবান বুদ্ধের জন্মেরও বেশ কয়েক শতক আগে এই সূত্রগুলো রচনা করেছিলেন কয়েকজন মহাজ্ঞানী পুরোহিত। তাঁরা যাগযজ্ঞ করতেন বৈদিক নিয়ম মেনে। যজ্ঞের জন্যে বেদী প্রস্তুত করতে হয়, তাকে ঘিরে দিতে হয় এক রজ্জু দিয়ে। যে-কোনভাবে বেদী প্রস্তুত করলে হয় না, তার দিক নির্দিষ্ট করা থাকে। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিক সব নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন। সেই পুরোহিতরা গাণিতিক সূত্র নিরূপণ করে এক রেখার ওপর তার উল্লম্ব রেখা অঙ্কন করতে পারতেন, যাতে পূর্বদিকের নিরিখে উত্তরদিক নিরূপণ করা যায়। যজ্ঞবেদীর ক্ষেত্রফল, তার চারদিকের সীমানা ইত্যাদি সংক্রান্ত অনেকগুলো সূত্র তাঁরা রচনা করে গেছেন সেই প্রাচীনযুগেই। এই সূত্রসমূহ কারও একার রচনা নয়, একাধিক পুরোহিত এই সূত্রাদি প্রণয়ন করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন অপস্তম্ব, বৌধায়ন, মানব, কাত্যায়ন, বরাহ প্রমুখ। রজ্জুকে সংস্কৃতে বলা হয় শুল্‌ব। যেহেতু সমস্ত সূত্রগুলোই রজ্জু-সংক্রান্ত, তাই একত্রে এদের বলা হয় শুল্‌বসূত্র। গতকাল আমি বৌধায়নের এক শুল্‌বসূত্র নিয়ে আলোচনা করেছি, আজ পুনরায় সেটাই বলছি।

    বৌধায়নের সূত্রটা এই রকম — দীর্ঘচতুরশ্রস্যাক্ষ্ণয়া রজ্জুঃ পার্শ্বমানী তির্যগ্‌মানী চ যৎ পৃথগ্‌ভূতে কুরুতস্তদুভয়ং করোতি। রজ্জুকে কোনো আয়তাকার ক্ষেত্রের তির্যগ্‌রেখা বা কর্ণকে বাহু ধরে বর্গাকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলে তার ক্ষেত্রফল পার্শ্বের দুই বাহুর ওপর প্রস্তুত বর্গাকার ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান।

    মাটিতে দাগ দিয়ে তিনি এক আয়তক্ষেত্র ও তার কর্ণ এঁকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে লাগলেন শিষ্যদের। আর একজন ছাত্র — সে কয়েক মাস আগেই নীলকণ্ঠের কাছে পাঠ নিতে শুরু করেছে — বলে উঠল, আচার্য, এই সূত্র তো তবে সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল সমকোণের সন্নিহিত বাহুদ্বয়ের উপর অঙ্কিত দুই বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান। কিন্তু এই সূত্র তো শুনেছি গ্রিসদেশের পণ্ডিত পিথাগোরাসের আবিষ্কার।

    নীলকণ্ঠ বললেন, ঠিকই শুনেছ, বৎস। তবে বৌধায়ন প্রায় নিশ্চিতভাবেই পিথাগোরাসের জন্মের দেড়-দুই শতাব্দ আগের মানুষ।

    ছাত্রটি বলে উঠল, আর ক্ষেত্রটি আয়তক্ষেত্র না হয়ে যদি বর্গক্ষেত্র হত, অর্থাৎ যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সমান, তাহলে তার কর্ণের বর্গ হত বাহুর বর্গের দ্বিগুণ। তার মানে কর্ণ আর বাহুর অনুপাত হত দুই-এর বর্গমূল।

    একদম ঠিক বলেছ, পুত্র, নীলকণ্ঠ বললেন, শুধু তাই নয়, সেই সামান্য রজ্জু দিয়ে তারা দুই-এর বর্গমূলের মানও নির্ণয় করে দিয়েছিলেন আর একটা সূত্রের মাধ্যমে। সেই সূত্র অনুযায়ী দুই-এর বর্গমূল বের করতে হলে এক মাপবিশিষ্ট এক রজ্জুকে দীর্ঘ করতে হবে তার এক-তৃতীয়াংশ, তারপর তাকে আরও বর্ধিত করতে হবে এই দীর্ঘীকৃত অংশের এক-চতুর্থাংশ এবং তা থেকে হ্রাস করতে হবে এই দ্বিতীয় বর্ধিত অংশের চৌত্রিশ ভাগের একভাগ। অর্থাৎ এর মান ১ + ১/৩ + ১/(৩x৪) – ১/(৩x৪x৩৪)

    রামানুজন বলে উঠল, কী করে ঐ সময় সামান্য এক রজ্জু দিয়ে এত কঠিন সূত্রাদি রচনা করেছিলেন ওরা? আমার তো রজ্জু দেখলেই সর্পভ্রম হয়।

    নীলকণ্ঠ বললেন, সেইজন্যেও প্রতীয়মান হচ্ছে, বৎস, এই বস্তু সম্ভবত তোমার জন্য নয়। তুমি কি কাব্য রচনাতেই মনোনিবেশ করতে চাও?

    অন্য একদিন তিনি আর্যভটের আর্যভটীয় থেকে পাঠদান করছিলেন। আর্যভটীয় এক চটি বই। চার পর্বে বিভক্ত এতে মাত্রই ১২১টা সূত্র। সেই সূত্রগুলোরও কোনো প্রমাণ দেওয়া নেই। এমনভাবে লেখা, যেন সূত্রগুলো তিনি স্বপ্নে পেয়েছিলেন। গীতিকাপাদে ১৩টি, গণিতপাদে ৩৩টি, কালক্রিয়াপাদে ২৫টি ও গোলপাদে ৫০টি শ্লোক নিয়ে চার পর্বে এই সূত্রগুলো বিন্যস্ত। বড় বড় সংখ্যাগুলোকে শব্দে প্রকাশ করার জন্যে যে হেঁয়ালির আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটাও বর্ণনা করা আছে গীতিকাপাদের দু-নম্বর শ্লোকেই।

    গীতিকাপাদ হচ্ছে অনেকটা উপক্রমণিকা। গণিতাংশ শুরু গণিতপাদ থেকে। শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, গণিতপাদের ছয় নম্বর সূত্র বলছি, এটি ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল গণনা করার, শ্রবণ করো। ত্রিভুজস্য ফলশরীরং সমদলকোটী ভুজার্ধসংবর্গঃ। মানে ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল এর এক ভুজের অর্ধের সঙ্গে সেই ভুজের ওপর বিপরীত শীর্ষ থেকে অঙ্কিত লম্বের গুণফলের সমান। নয় নম্বর সূত্র বৃত্ত-সংক্রান্ত — পরিধেঃ ষড্‌ভাগজ্যা বিষ্কম্ভার্ধেন সা তুল্যা।এর অর্থ হচ্ছে, পরিধির ছ-ভাগের একভাগের জ্যা বিষ্কম্ভার্ধের তুল্য। কীসের পরিধি? অবশ্যই এক বৃত্তের। বিষ্কম্ভ মানে কী? বিষ্কম্ভ হচ্ছে কীলক বা প্রতিবন্ধ। দরজা বন্ধ করার সময় যে খিল দেওয়া হয়, সেই খিল বা হুড়কা হচ্ছে এই কীলক বা প্রতিবন্ধ বা বিষ্কম্ভ। তবে বিষ্কম্ভ শব্দটাকে আচার্য আর্যভট বৃত্তের ব্যাস অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। তাহলে বিষ্কম্ভার্ধ মানে কী?

    চটপট উত্তর দিল রামানুজন, ব্যাসার্ধ, আচার্য।

    ঠিক, নীলকণ্ঠ বললেন, এর অর্থ, পরিধির এক-ষষ্ঠাংশ অংশের জ্যা ব্যাসার্ধের সমান। অর্থাৎ, বৃত্তের পরিধিকে যদি ছয় সমান অংশে বিভক্ত করা হয়, তবে সেই অংশগুলোর জ্যা প্রত্যেকটাই ব্যাসার্ধের সমান হবে। মনশ্চক্ষে সেই জ্যাগুলোকে দেখার চেষ্টা করো। দেখবে সেগুলো একত্রে বৃত্তের অন্তঃস্থ এক সুষম ষড়ভুজ। বৃত্তের কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের শীর্ষ যোগ করলে ছখানা সমবাহু ত্রিভুজ পেয়ে যাবে, যে ত্রিভুজগুলোর দুখানা বাহু ঐ বৃত্তের ব্যাসার্ধ আর তৃতীয় বাহু ঐ জ্যা।

    বৃত্তের পরিধিটা ঐ ষড়ভুজের ছটা বাহুর সমষ্টির চেয়ে কিঞ্চিৎ বড়। ছয় বাহু একত্রে ছয় ব্যাসার্ধ তথা তিন ব্যাসের সমান। অর্থাৎ এটা জানা গেল যে বৃত্তের পরিধি তার ব্যাসের তিনগুণের চেয়ে বড়। কিন্তু তিনগুণের চেয়ে কতখানি বড়, তা বলা যাচ্ছে না এই সূত্র থেকে। পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত গণিতশাস্ত্রে এক নিরন্তর কৌতূহলের সামগ্রী, কাজেই আচার্য আর্যভট নিরন্তর তা নিয়ে গবেষণা করতে লাগলেন। বৃত্তচাপ ও জ্যা-এর দৈর্ঘ্যের পার্থক্যের জন্যেই এই সমস্যা, সমান দুই বিন্দুকে যুক্ত-করা বক্ররৈখিক চাপ সর্বদাই সরলরৈখিক জ্যা-এর চেয়ে বড়।

    এটা সহজেই বোঝা যায়, যে বৃত্তের মধ্যে সুষম ষড়ভুজের বদলে যদি বাহুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে চাপের দৈর্ঘ্য কমে আসবে, তার সঙ্গে জ্যা-এর পার্থক্যও ক্রমাগত কমতে থাকবে। অর্থাৎ পরিধি-ব্যাসের অনুপাতের মান ক্রমে ক্রমে সঠিকের কাছাকাছি আসবে।

    আর্যভট এই অনুপাতের মানের সূত্র দিলের গণিতপাদের দশ নম্বর শ্লোকে। বললেন — চতুরধিকংশতমষ্টগুণং দ্বাষষ্টিস্তথা সহস্রাণাম্‌।

    অযুতদ্বয়বিষ্কম্ভস্য আসন্নোবৃত্তপরিণাহঃ।।

    মানে কী? চতুঃ অধিকম্‌ শতম্‌ হচ্ছে ১০৪, তার অষ্টগুণম্‌ হচ্ছে ৮৩২, তার সঙ্গে দ্বাষষ্টিসহস্রাণাম্‌ মানে ৬২০০০ যোগ করলে পাওয়া যাবে ৬২৮৩২। সেটা কী? সেটা হচ্ছে যে বৃত্তের বিষ্কম্ভ অযুতদ্বয়, তার পরিণাহ অর্থাৎ পরিধির আসন্ন মান। একক-দশক-শতক-সহস্র-অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটিতে অযুত মানে ১০০০০, অর্থাৎ অযুতদ্বয় হচ্ছে ২০০০০। বিষ্কম্ভ ২০০০০ হলে পরিধি হবে ৬২৮৩২, তাহলে পরিধি-ব্যাসের অনুপাত হচ্ছে ৬২৮৩২/২০০০০, অর্থাৎ ৩.১৪১৬।

    লক্ষ করো যে আর্যভট এর মান ৩.১৪১৬ বলেননি, বলছিলেন এটা তার আসন্ন মান। আসলে এর কোনো নির্দিষ্ট মান নেই।

    একজন শিষ্য কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করল, আচার্যআর্যভট এই সূত্র কোত্থেকে পেলেন?

    নীলকণ্ঠ বললেন, তা আমাদের জানা নেই। তবে এটা বোঝা যায় কী জন্যে তিনি এই সূত্র প্রণয়ন করেছিলেন। বৃত্তপথে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে যখন ঘোরে, তখন বৃত্তপথে কত দূরত্ব অতিক্রম করে তা জানতে। এসবই তাঁর সূক্ষ্ম গণনার ফল।

    আচার্য আর্যভটের বহু বছর পরে আচার্য ভাস্কর তাঁর রচনার টীকা প্রস্তুত করেছিলেন, নিজে রচনা করেছিলেন গাণিতিক সূত্রের ওপর একাধিক গ্রন্থমালা।

    এই যে গোলপাদ লিখেছিলেন আচার্য আর্যভট, সে তো পৃথিবীকে গোলক জ্ঞান করেই। গোলকের জ্ঞানই গোলপাদ। আচার্য ভাস্কর বললেন —

    ভোজ্যং যথা সর্বরসং বিনাঃ অজ্যং
    রাজ্যং যথা রাজবিবর্জিতং চ।
    সভা ন ভাতীব সুবক্তৃহীনা
    গোলানভিজ্ঞো গণকস্তথাঃ অত্র।।
    অর্থ কী? সর্বরস অর্থাৎ সমস্ত উপকরণ সহ ভোজ্যও যেমন অজ্য তথা ঘৃতবিনা বিস্বাদ, রাজাহীন রাজ্য যেমন বিশৃঙ্খল, সুবক্তা-হীন সভা যেমন অনুজ্জ্বল, তেমনই গোলক-বিষয়ে অনভিজ্ঞ গণকও অপটু।

    নীলকণ্ঠ পড়িয়ে চললেন, আজ থেকে প্রায় চার শত বৎসর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই আচার্য ভাস্কর। তাঁর গ্রন্থেই তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর জন্মসময়। লিখেছেন — রসগুণপূর্ণমহীসমশকনৃপসময়ে ভবন্মমোৎপত্তিঃ। বৎস রামানুজন, এইটির অর্থ তো তোমার বলতে পারা উচিত। চেষ্টা করো দেখি।

    রামানুজন ভেবেচিন্তে বলল, রস ছয় বা নয় দুই হতে পারে, আচার্য। এই রস কি খাদ্যের স্বাদ-অর্থে না কাব্যের প্রকৃতি অর্থে? খাদ্যের স্বাদ হলে ষড়্‌রস, অম্ল – মধুর – তিক্ত – লবণ – কষায় – কটু। যদি কাব্যের রস হয় তবে নবরস, শৃঙ্গার – হাস্য – করুণ – রৌদ্র – বীর – ভয়ানক – বীভৎস – অদ্ভুত – শান্ত।

    নীলকণ্ঠ বললেন, সাহিত্যে তোমার ব্যুৎপত্তি অসামান্য, পুত্র। তবে এক্ষেত্রে এটি স্বাদ-অর্থেই।

    রামানুজন বলল, তবে রস অর্থ ছয়। গুণ মানে তিন, সত্ত্ব – রজঃ – তমঃ। পূর্ণ নিঃসন্দেহে শূন্য, কেননা তা অখণ্ডমণ্ডলাকার-সদৃশ। আর মহী তো এই পৃথিবী, যা একটিই, সুতরাং এক। তাহলে রসগুণপূর্ণমহী হচ্ছে ৬৩০১। বিপরীতক্রমে বর্ণনা করাই রীতি, কাজেই এর মানে ১০৩৬ শকাব্দ। উনি কি ১০৩৬ শকাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আচার্য?

    নীলকণ্ঠ বললেন, হ্যাঁ। অর্থাৎ এখন থেকে ৩৮৬ বৎসর পূর্বে। বিজয়পুর গ্রামে। তিনি ছিলেন শাণ্ডিল্যগোত্রীয় কর্ণাটকি ব্রাহ্মণ। তাঁর পিতৃদেবের নাম মহেশ্বর, তিনিও ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাঁর লেখা গ্রন্থ বৃত্তশতক। তখন গণিতচর্চার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিল উজ্জয়িনী। এখন থেকে এক সহস্র বৎসর পূর্বে এই উজ্জয়িনীতে বরাহমিহির ও পরে ব্রহ্মগুপ্ত ছিলেন গণিতজ্ঞ-শিরোমণি। ভাস্কর উজ্জয়িনীর শিক্ষায়তন ও মানমন্দিরের অধ্যক্ষ ছিলেন।

    তো এই আচার্য ভাস্কর লিখলেন — রসগুণবর্ষেণ ময়া সিদ্ধান্তশিরোমণিঃ রচিতঃ, অর্থাৎ ৩৬ বৎসর বয়সে আমি সিদ্ধান্তশিরোমণি গ্রন্থ রচনা করলাম। এই সিদ্ধান্তশিরোমণি মানে চারখানা অধ্যায়ের — এক একটি অধ্যায় যেন এক একটি গ্রন্থই — একত্রিত রূপ। এরা হচ্ছে লীলাবতী, বীজগণিত, গোলাধ্যায় ও গণিতাধ্যায়। লীলাবতী আসলে একটি পাটীগণিত গ্রন্থ। পাটী বুঝলে তো? পাটী মানে শৃঙ্খলা। যে গণিত সুশৃঙ্খল, সেটাই পাটীগণিত। তাহলে এর নাম লীলাবতী কেন? কেননা লীলাবতী নামে তাঁর এক কন্যা ছিল। আচার্য ভাস্কর সেই কন্যার ভাগ্যগণনা করে তার অকালবৈধব্য যোগের লক্ষণ দেখতে পান। তার বিবাহ হয়নি, তিনি চিরকুমারী ছিলেন। বিমর্ষ পিতা কন্যাকে সান্ত্বনা দিতে ও তাকে গণিতশাস্ত্রে উৎসাহী করে তুলতে এই লীলাবতী নামের পাটীগণিত গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে গণনার পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে সহজ পদ্ধতিতে, সুললিত ভাষায়, সংক্ষিপ্তভাবে। স্থানে স্থানে তিনি এই গ্রন্থের উদ্দিষ্ট পাঠিকাকে — আত্মজা লীলাবতীকে — গণিতের শ্লোকে সম্বোধন করেছেন বালকুরঙ্গলোলনয়না, মতিমতী, সখী, চঞ্চলাক্ষী ইত্যাদি বলে। এতে বর্ণনা করা আছে সংখ্যাগণনার পদ্ধতি। সংখ্যার মান সম্বন্ধে আর্যভট বলেছিলেন —

    একং চ দশং চ শতং চ সহস্রং ত্বযুতং নিযুতে তথা প্রযুতম্‌।
    কোট্যর্বুদং চ বৃন্দং স্থানাৎ স্থানং দশগুণংস্যাৎ।।
    বুঝতেই পারছ সংখ্যার ক্রমে যে এক-দশ-শত-সহস্র-অযুত-নিযুত-প্রযুত-কোটি-অর্বুদ-বৃন্দ ইত্যাদির যে কোনোটির স্থানে যে সংখ্যা লেখা হয়, স্থান একঘর পরিবর্তনের ফলে তাদের মান দশগুণ হয়ে যায়।

    লীলাবতীতে ভাস্কর স্থানের নামের সংখ্যা আরও বর্ধিত করে বললেন —

    একদশশতসহস্রাযুতলক্ষপ্রযুতকোটয়ঃ ক্রমশঃ।
    অর্বুদমব্দং খর্বনিখর্বমহাপদ্মশঙ্খশ্চ তস্মাৎ।।
    জলধিশ্চান্ত্যং মধ্যং পরার্ধমিতি দশগুণোত্তরসংজ্ঞাঃ।
    সংখ্যায়াঃ স্থানানাং ব্যবহারার্থং কৃতাঃ পূর্বৈঃ।।
    অর্থাৎ আর্যভটের নিযুতকে ভাস্কর লিখলেন লক্ষ, অর্বুদের পর এল অব্দ-খর্ব-নিখর্ব-মহাপদ্ম-শঙ্খ-জলধি-অন্ত্য-মধ্য-পরার্ধ। এর ফলে আঠারোটা অঙ্কবিশিষ্ট সংখ্যাও বর্ণনা করা সম্ভব হল।

    সংখ্যাগণনার পর যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ-বর্গ-ঘন-বর্গমূল-ঘনমূলের প্রক্রিয়া, অনুপাত, বিপরীতক্রিয়া, সুদকষা, ভগ্নাংশ, লাভ-ক্ষতি, সমান্তর ও গুণোত্তর প্রগতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চর্চা করা আছে লীলাবতীতে। এগুলো ছাড়াওপুকুর খনন, ইঁটের পাঁজা নির্মাণ, কাঠের মাপ, ছায়ার মাপ ইত্যাদি নিয়েও সমস্যা ও সমাধানের প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন আচার্য ভাস্কর। দুটি সংখ্যা গুণ করার ছটি নিয়ম তিনি ব্যক্ত করেছেন, তাদের আলাদা আলাদা নাম — স্বরূপ, তৎস্থ, বিভাগ, খণ্ড, স্থান এবং ইষ্ট। গাণিতিকসমাজে অত্যন্ত আদরণীয় গ্রন্থ এই লীলাবতী।

    রামানুজনের এসব শোনায় মন নেই। সে মনে মনে ভাবতে লাগল, আহা, লীলাবতীর মত আচার্য নীলকণ্ঠের যদি একটি কন্যা থাকত!

    (চলবে)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ এখান থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments