ওষধিবাগান;— স্বপন ভট্টাচার্য; তৃতীয় পরিসর (প্রকাশক); প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০১৮
মহাপুরুষেরা বলে থাকেন “আমি দেহ নই, আত্মা; স্বামীজী বলতেন প্রায়শই “চিদানন্দরূপে শিবোহম্, শিবোহম্”। রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা, মল, মূত্র ভরা এই নশ্বর দেহকে নস্যাৎ করার মত অধ্যাত্মচেতনা আমার নেই। কিন্তু কোনো সার্থক কবিতা বা কাব্যগ্রন্থের ময়নাতদন্ত করে তার ভাষা, ছন্দ, যতি শব্দ-চয়ন, অলঙ্কার ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে কখনও কবিতার মর্মে পৌঁছোনো যায়না, তা বুঝি ও জানি। তবু সমালোচনার খাতিরে সামান্য কিছু কাটাছেঁড়া করতেই হয়। তবে এই লেখার শেষাংশে কবি মানসের কিঞ্চিৎ কাছাকাছি পৌঁছোবার প্রয়াস করা যাবে, এমন সদিচ্ছা আছে।
৪২ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত কবিতা ‘ওষধিবাগান’-এর ছায়ায় গ্রন্থটির নামকরণ। যে গাছ একবার ফলবান্ হয়ে ইহলীলা সাঙ্গ করে, সে যদি ওষধি বলে খ্যাত হয়, তাহলে নামকরণের সার্থকতায় একটা ছোট প্রশ্নচিহ্ন থাকে না কি? কবিতাটিতেও ওষধিবাগানের পুড়ে যাবার ঘোষণা আছে বলে প্রশ্নটি আরো কিছুটা জোর পায়!
তবে ক্ষীণতনু কাব্যগ্রন্থটির পেছনের মলাটে লেখকের একটি প্রায় আধ্যাত্মিক আত্মকথনে এই নামকরণের এক অপরূপ ব্যাখ্যা মেলে। যেখানে তিনি ত্রস্ত, ভীত; পাহাড়, সমুদ্র, ইমারত তাঁকে গ্রাস করে নিতে ভয় দেখায়। সে ভয় যতনা physical extinction-এর, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আস্থা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা হারানোর। তাই তাঁর সমর্পণ:
“ভয় আর ভালোবাসার যে অনুভূতিগুলি কবিতার জন্মের সাথে সাথেই মরে যেতে চায় বর্ষজীবী গুল্মের মতো-- তাদের জন্য একখানা বাগান। দানাশষ্যের জন্য বাগান একখানা—ওষধিবাগান।”
সর্বমোট ৪৭টি কবিতা ৬৪ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত। প্রেম, পৃথিবী, প্রত্যাখ্যান, ভাষা, দেশ, এমনকি ঈশ্বর এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও ছুঁয়েছে কবিতাগুলি। দুটি কবিতা বাদ দিলে (পৃ ৩৩, পৃ ৫৬) আর কোথাওই তথাকথিত ছন্দ-মিলের যুগলববন্দি দেখা যায় না। কিন্তু অন্ত্যমিল না থাকলেও পঙ্ক্তিগুলির পর্ব-বিভাগ এত নিখুঁত যে আক্ষরিক ছন্দের কোনো অভাবই অনুভূত হয় না। মনে হয় যেন অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্তের বন্ধনে কবিতাগুলিকে আবদ্ধ না রেখেই কবি সুবিচার করেছেন: আরোপিত শৃঙ্খলা এখানে সুখকর হত না।
কাব্যগ্রন্থ পড়বার একটি আকর্ষণ আমার কাছে নতুন/সৃষ্টিশীল বাক্যবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। কবিতা লেখা আমার চায়ের কাপ না হতে পারে, একটি সজীব ভাষার গাছে নতুন পাতা বা কুঁড়ি বা ফুল চিনতে পারা নিঃসন্দেহে লোভনীয়। স্বপনের গ্রন্থেও আমি পেয়ে যাই মুঠোভরা শীতঋতু, সবুজ সময়, মুক্তাপ্রজ ঝিনুক, গর্ভক্লান্ত জমি, অনুরাগী ঘামের গন্ধ, ক্ষণপ্রাণ দেবতা বা সিপিয়া মুহূর্ত; দেখি ইচ্ছেপ্রাকার, ভেসে-যাওয়া স্মরণপ্রদীপ কিম্বা শুনি লাজুক ব্যালাড। শব্দ-ভাণ্ডারের চাবি এবং ব্যাকরণের ওপর যথেষ্ট দখল থাকলেই কবিমানস এ’জাতীয় চিত্রকল্প সৃষ্টি করতে পারে।
তবে বাংলা বানান নিয়ে আমার কিছুটা শুচিবাই আছে। যদিও জানি হৃস্ব-ইকার বা দীর্ঘ-ঈকার-এর মধ্যে কোনো উচ্চকিত বিবাদ নেই, তবু তীরে হৃস্বইকার (তির) বা বন্দীতে হৃস্বইকার (বন্দি) চোখে কিছু পীড়া দেয়। যদি বা সরলীকরণের খাতিরে তির/বন্দি মানা যায়, কোথাও ‘ডুবুরী’, কোথাও ‘পূজারি’, কোথাও ‘বন্দি’, কোথাও ‘কচুরীপানা’ সঙ্গতির অভাবের দিকে আঙুল তোলে। স/ষ-এর ব্যবহারেও একই প্রমাদ দেখি (ফ্রষ্ট, গোস্পদ)। এ দুটি যদি মুদ্রণপ্রমাদ বলে ধরে নিই, ন/ণ-এর ব্যবহারের অসাবধানতা অস্বস্তি সৃষ্টি করে: লবনাক্ত, ফনা, স্থানু, শূণ্য, নিয়ন্ত্রণ, ভ্রুন, প্রেক্ষন তাদের মধ্যে কয়েকটি। ভুল বানানে কবিতার রসাস্বাদন হয়তো বিঘ্নিত হয় না, তবু যে কোনও গ্রন্থমুদ্রণেই ত্রুটিহীনতা একটি প্রয়োজনীয় শর্ত (necessary condition)।
সাহিত্যের সংজ্ঞার মধ্যে একটা মঙ্গলচিন্তা আক্ষরিক অর্থে জড়িত। প্রেম, ঈশ্বর, স্বদেশ, প্রকৃতি এর মধ্যে এক বা একাধিক বিষয় উপজীব্য হলে পরেও এক শ্রীমণ্ডিত সুষমা ঘিরে থাকে কবিতার সঙ্গে সঙ্গে পাঠককেও। আর থেকে থেকে তার মাঝেই উচ্চারিত হয় একটি-দুটি-তিনটি অমোঘ সত্য, যা সেই ব্যক্তিক অনুভবকে পাঠকের অনুভবের সঙ্গে কম্পাংকে মিলিয়ে দেয়। “ওষধিবাগান” এর ব্যতিক্রম নয়:
ক. দেবতারা কোণারক ছেড়ে চলে গেছেন (কোণারক/৫৪)খ. পরিচয়ের মতো প্রত্যাখ্যানের জন্যও (শূককীট/২১)
মানুষের তো মানুষকে দরকার।গ. অন্ধের জাদুঘরে স্পর্শই ঈশ্বর (অন্ধের জাদুঘরে ম্যানিকুইন /১০)
ঘ. বালিকা কি জানেনা কত কিছু ঘটে যায় অযাচিত আলাপের শেষে? (ভাষা-২/৫৩) ঙ. দেশ শুধু মানচিত্র নয়...মানুষকে নিয়েই দেশ (বহিরাগত/৬৪)
শুধু অমোঘ এই জাতীয় উচ্চারণ নয়, ‘ওই যে পুরুষ’ (৩১) আর ‘অন্ধকার, সাবধানে চলুন’ (৩৩) শীর্ষক দুটি কবিতাতে বেশ আঁটোসাঁটো এক স্টোরি-লাইন আমাদের চমকে দেয় অনচ্ছপর্দার আড়ালের আভাস দিয়ে। ‘তিনি কখনও এই জনপদে থামেননি’ (৪৯) আমাকে মনে করিয়ে দেয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় ছোটগল্প ‘শুক্লাপক্ষ’কে--সাদৃশ্য যত কমই থাক না কেন! ‘অন্ধের জাদুঘরে ম্যানিকুইন’ যেমন মনে করায় শঙ্খ ঘোষের তন্বী গ্রন্থ ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’কে। আউসভিৎস (২২) কবিতার শব্দ দিয়ে আঁকা ছবি অশ্রু-রক্তের রঙে বিবর্ণ হয়ে যায়, যখন--
“বন্দিশিবিরে আজও রাত জাগি তুমি আমি রাত জাগে সলিটারি সেল--চাঁদ, ইঁদুর, সাপ আর পেঁচাকে নিয়ে কবির লাজুকছায়া (১৯) জীবনানন্দকে মনে করালেও ‘ধানসিঁড়ি’ পাঠককে স্মৃতির পানসিতে করে একলা নিয়ে যায় দেশের বাড়িতে, যে দেশের কোনো মানচিত্র নেই কিন্তু নদী, বাড়ি, পাঠশালা মিলে এক গভীর-প্রোথিত অস্তিত্ব রয়েছে; চট্টগ্রাম, রাজশাহী- কিম্বা কুমিল্লা—নাম তার যাই হোক্ না কেন!
হননবৃত্ত থেকে ভেসে আসে প্রার্থনাসঙ্গী- কেউ শোনে, কেউ কেউ
সম্পূর্ণ বধির।”
অদ্ভুত এক সমাপতনে মোট ৪৭টি ছোটবড় কবিতার মধ্যে অন্তত: ২০টির মধ্যে ফিরে ফিরে এসেছে নদী, ঝর্ণা, সমুদ্র, ভেসে যাওয়া স্নান, সন্তরণ, নিমজ্জন--এরকম জল-সংশ্লিষ্ট শব্দাবলী এবং ছোটবড় চিত্রকল্প। আপাতদৃষ্টিতে কবির এই জলপ্রিয়তার কোনো ব্যাখ্যা না মিললেও ‘জল শীর্ষক’ কবিতাটিতে (২৯) তাঁর নি:সংকোচ স্বীকারোক্তি আমাদের অনেকটাই কাছে নিয়ে যায় তাঁর কবিমানসের, যখন তিনি লেখেন “জল আর প্রতারণা করে না তেমন” কিম্বা, “আমার ভিতরে জল ততটাই ডুবে আছে/ আমি তার ভিতরে যেমন”। আধার আর আধেয়র বিচার এখানে গৌণ। এই ব্যালকনিতে দাঁড়ালে যেমন চোখে পড়ে জলের ওপর দৃপ্তগ্রীব রাজহংসী, লাইটহাউস, মাঝিমাল্লা, হয়তো বা প্রবালের দ্বীপও তেমনই শোনা যায় জলাভূমির শ্যাওলার মেলডি, দৃশ্যমান হয় পালকের মত ঢেউ, কিম্বা দ্রাঘিমাচ্যূত কোনও মলিন জাহাজ!
বইটির নিবিড় পাঠ পাঠককে পৌঁছে দেয় শেষ দুটি কবিতায়:--
‘পুনর্জন্ম’ (৬২) আর ‘বহিরাগত’ (৬৪) যেখানে নিজের তুচ্ছতা বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে সচেতন কবি কল্পিত এক মৃত্যু-উপত্যকায় বেঁচে থাকেন এবং তাঁর--
“...ভয় হয় / ভাবি শেষের পরেও কিছু থেকে যায় যদিআর সেই জন্মই বোধহয় বীজের মতই “মুখ্যত মৃত্তিকাকেন্দ্রিক”। কারণ “সীমা ও কালের প্রভাব/ নেহাতই সামান্য বলা যায় শিকড়ের উপর”। ওষধিবাগানের কবিও তাই বেঁচে থাকুন “অসীম কালের হিল্লোলে”, তাঁর গান জেগে থাকুক অপার বিস্ময়ে।
হতেও তো পারে--
সেটুকু থেকেই আমাকে বারবার জন্ম নিতে হয়।”