• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | ছোটদের পরবাস | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • লেপচা জগৎ : রঞ্জাবতী চট্টোপাধ্যায়

    সেপ্টেম্বর পরীক্ষার মাস, অক্টোবর এলেই পুজো। কালিপুজোর সময়টা তাই পরীক্ষার পেন-খাতা-অক্ষর আর পুজোর মানুষ এবং প্রতিমার ভিড় থেকে একটু ছুটি চাইছিলাম। যেমন ভাবা তেমন কাজ, ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তিন দিনের জন্য--শান্তির খোঁজে। সারারাত ট্রেনের চাকার আর বুকের ভেতরের চাপা উত্তেজনার শব্দ শুনতে শুনতে এক সময় পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। গাড়িতে উঠে কাচ খুলে দিতেই ঠান্ডা হাওয়া চুলের ভিতর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে হাতছানি দিয়ে গেলো।

    অনেক উঁচুতে পাহাড়ের খাঁজে ছোট্ট গ্রাম লেপ্‌চাজগৎ। গাড়ি থেকে নেমে প্রথম প্রথম জায়গাটা একটুও পছন্দ হলো না আমার। পর পর অনেকগুলো হোমস্টে, কলকাতার মতোই ঘিঞ্জি। আমাদের হোমস্টে কাঞ্চনকন্যা বেশ পরিষ্কার, সাজানো-গোছানো। আমাদের ছাদের ওপরের একটা ঘরে জিনিসপত্র রেখে দিলাম। মা বাবা সব জিনিসগুলো যখন গুছিয়ে রাখছিলো তখন আমি ছাদে হাঁটতে লাগলাম চারপাশটা ভালো করে দেখবো বলে। ওপর থেকে দেখছিলাম বলে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা হোমস্টেগুলো মন্দ লাগছিলো না। সামনে-পেছনে পাইন বন; ঘন সবুজ পাইন সাদা মেঘের শাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেখানে। হঠাৎ চোখ আটকে গেল বলিষ্ঠ, চওড়া, সাদা, এক অদ্ভুত মায়াবী পাহাড়-চূড়ায়। সূর্যের আলো সেখানে ঠিক্‌রে পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। চূড়ার ওপরে আকাশটা‍য় সোনা রং ধরেছিল। হঠাৎ বুঝলাম কে এই দৃঢ় সুপুরুষ। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। মা বাবা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আমাদের তিনজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিঃশব্দে দেখলাম উজ্জ্বল, বলিষ্ঠ রাজপুত্রকে। বরফ-ঠান্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে আমরা পেট ভরে ভাত খেয়ে নিলাম। বাবা আর আমি খাঁটি বাঙালি; ভাত খেলেই আমাদের চোখ জুড়ে যায় ঘুমে। মা মাথা খারাপ করে দিল। মাকে রাগিয়ে দেওয়ার মতো সাহস আমার বা বাবার কারো নেই। কাজেই গায়ে সোয়েটার-মাফলার ইত্যাদি চড়িয়ে বেড়াতে বেরোলাম। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে আমরা পাহাড়ের গায়ে বানানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। উঠে হাঁপিয়ে পড়লাম বটে কিন্তু সেটা ব্যর্থ হল না। নীচে দার্জিলিং। পাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। একটা দোলনা ছিল ওখানে। দোলনায় দুলতে দুলতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যে কী ভালো লাগে তা যে দেখেনি সে কোনদিন বুঝবে না। হোমস্টেতে ফিরতে না ফিরতেই চারপাশ শান্ত করে রাত নেমে এল। আমার কী খেয়াল হল, রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘আকাশ-ভরা সূর্য তারা’ গেয়ে ফেললাম।

    পরেরদিন জলখাবার খেয়েই আশিস-দাজুর গাড়িতে করে আমরা গেলাম তাক্‌দা-তিনচুলে-পেশ্‌ক-রঙ্‌লী-লামাহাট্টা। তাক্‌দার অর্কিড গার্ডেন বন্ধ ছিল। কিন্তু আশিস-দাজুর উৎসাহে আমরা পাঁচিল টপকে ঢুকে গেলাম ভিতরে। অপূর্ব সব অর্কিড দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একটা ছোট্ট ঝরনা ছিল। আমি তার কাছে দাঁড়িয়ে তার গল্প শুনলাম কিছুটা। তারপরেই যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ‘বাবা, আমরা তো ট্রেসপাসিং করছি!’ আমি বললাম। আমরা তিনজনেই খানিক লজ্জিত হয়ে গাড়ির কাছে ফিরে গেলাম। তিনচুলেতে একটা বেশ বড়ো মনাস্ট্রি আছে। আমরা যে রাস্তাটা দিয়ে সেখানে যাবো ভেবেছিলাম সেটা বড়ই পিছল। তিনচুলের কিছু বাসিন্দাদের সমাধির সামনে আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর শুরু হল হন্টন। পিছল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল যেন ট্রেক করছি। অনেকবার পা পিছলে গেল, কিন্তু পড়ে যাইনি একবারও। অবশেষে পৌঁছে গেলাম মনাস্ট্রিতে। তখন প্রার্থনা চলছিল। কিছুক্ষণ ওখানে বসলাম। সব কিছুই কেমন গম্ভীর-গম্ভীর। পেশক আর রঙ্‌লী চা বাগান দেখে আমি বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম। কচি চা পাতার রং যে এতো সুন্দর তা আমি জানতামই না! লামাহাট্টা ঘুরে ওইদিনের মতো আমরা ক্ষান্ত দিলাম। লামাহাট্টাতে পাহাড়ের ৭৫০মিটার উঁচুতে একটা লেক আছে। আমি আর মা ৫৫০ অবধি উঠে গিয়েছিলাম। তারপর অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল বলে ফিরে আসতে হল। খুব দুঃখ পেলাম আমি, কিন্তু মা আমাকে ভালোবেসে এতটা উঠেছিল, সেই ভালোবাসাটা ব্যর্থ করবো না বলে আর কিছু বললাম না। হোটেলে ফিরে সোজা কম্বলের ভিতর। এত ঠান্ডা লাগছিল যে ঠিক করে হাতমুখটাও ধুলাম না। কোনোরকমে রাতের খাবার খেয়ে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম নরম-গরম বিছানায়। শোয়ামাত্র ঘুম।

    ২৮ তারিখ ছিল লেপ্‌চাজগতে আমাদের শেষ দিন। ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম ঘুম মনাস্ট্রিতে। ঘুম-ঘুম ভাবটা কাটানোর জন্য প্রথমেই কফি খেয়ে নিলাম। মনাস্ট্রিটা যতটা না পছন্দ হল তার থেকেও বেশি ভালো লাগল মনাস্ট্রির পাশে চেনে বাঁধা কালো রঙের কুকুরটাকে। ভারি সুন্দর, চামরের মতো ল্যাজ তার। ‘আরাধনা’ সিনেমায় ‘মেরে স্বপ্ন কি রানি’ গানের দৃশ্যটা আমার অন্যতম প্রিয়। বাবা সেটা জানে। তাই আমাকে নিয়ে গেল বাতাসিয়া লুপ। ‘দ্যাখ, তোর প্রিয় দৃশ্যগুলো এখানেই শুট করা হয়েছিল।' বলল বাবা। আমি মনমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলাম। টয়ট্রেন পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল গায়ে কয়লার কুচি ছড়িয়ে দিয়ে। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এরপর আমরা এইচ.আই.এম.-এর মিউজিয়ম আর চিড়িয়াখানা দেখতে গেলাম। তেনজিং নোরগের জিনিসপত্র দেখে আমি খুব খুশি হলাম। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, আমাকেও এভারেস্ট জয় করতে হবে। অবশ্য ওখান থেকে বেরিয়েই বুঝলাম সেটা অসম্ভব। দার্জিলিং-এর ওইটুকু ঠান্ডাই সহ্য করতে পারছিলাম না। এভারেস্টের বেস ক্যাম্প অবধি পৌঁছতে পৌঁছতেই তো হিল ডায়েরিয়া আর ডবল নিউমোনিয়া হয়ে বেঘোরে আমরা প্রাণটা যাবে! চিড়িয়াখানাটা দারুণ। সব কটা পশুর সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব করে ফেললাম। এরই মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটলো। বাবা আর আমি হাত ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখলাম আমার পাশে একটা দরজা, তাতে তালা-টালার বালাই নেই। কেবল ছিট্‌কিনিটা টানা রয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, দরজাটা খুলে দিই?’ ‘কী দরকার,’ বলল বাবা। আমরা এগিয়ে চললাম। সামনে এসে দেখি ওই ঘরটার মধ্যে ছিল হিমালয়ান উল্‌ফ্‌! প্রাণী। বাবা আর আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। ওখানে একটা ভাল্লুকের মন খারাপ ছিল। গালে হাত দিয়ে বসেছিল সে। তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে হলেও তার নখ দেখে আমি আর এগোলাম না। এখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম ম্যালে। জায়গাটা অত আহামরি লাগল না আমার। ততক্ষণে আমাদের খুব ক্ষিদে পেয়ে গেছে। তাই আমরা কেভেন্টারের ছাতে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে হ্যাম স্যান্ডউইচ, পর্ক সসেজ এন্ড এগ পোচ্‌ হ্যাম ফ্রায়েড আর হট্‌ চকোলেটের একটা অনবদ্য লাঞ্চ খেলাম। একেবারে শেষে আমরা গেলাম একটা জাপানি মন্দিরে। সেখানে ছিল একটা পীস প্যাগোডা। সময় তখন গোধূলি। রক্তবর্ণ আকাশের গায়ে ব্রোঞ্জ-রঙা কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন উজ্জ্বল। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে আমি শেষে পৌঁছলাম বুদ্ধদেবের ছবি আর মূর্তিগুলোর একদম কাছে। দেখলাম পাইনবনে ঘিরে রয়েছে আমাকে। মেঘ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমায়। মনে হল এখনি আমি কবিতা লিখবো! ফিরতে ফিরতে রাত নেমে এল। লোডশেডিং হয়ে গেছে অনেক আগে। আমি গরম জামার ভিতর থেকে শুধু চোখ দুটো বের করে একদৃষ্টিতে চেয়েছিলাম দার্জিলিং-এর দিকে। ভাবছিলাম, কলকাতার হইচই ঝগড়া কেমন শান্ত হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ায় এই পাহাড়ের কাছে।

    পরেরদিন আমাদের বাড়ি ফেরার কথা। সকালে আমরা ফিরে গেলাম প্রথম দিনের সেই ভিউ পয়েন্টে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে চোখ সরছিল না। মনে হচ্ছিল সারাজীবন থেকে যেতে পারি ওখানে। পাহাড় থেকে নামতে ইচ্ছে করছিল না। আমাদের গাড়িটা যখন প্রায় সমতলে নেমে পড়েছে, তখনও দেখা যাচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দেশের যা অবস্থা, পরেরবার যখন আসব, এইরকমই সুন্দর থাকবে তো এই পর্বতমালা? পাহাড় চূড়ায় থাকবে না তো কোন আতঙ্ক? আর্দ্র চোখে চেয়ে রইলাম উত্তরবঙ্গের অত্যাশ্চর্যের দিকে।




    অলংকরণ (Artwork) : ছবি : রঞ্জাবতী চট্টোপাধ্যায়
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments