যুগের পর যুগ ধরে সিংহই যে বনের রাজা হয়ে বসে আছেন, এই নিয়ে একরকম চোরা ঈর্ষা অনেক পশুই মনে মনে পোষণ করে থাকে। তারা ভাবে, আমরা কম যাই কীসে! একবার রাজা হই, দেখিয়ে দেব।
পণ্ডিত বলে খ্যাত শেয়ালের সবার কাছেই গতায়াত। অবশ্য সিংহমহাশয়ের কাছে ঘেঁষতে তাঁর একটু বুক ধুকপুক করে। প্রয়োজন ছাড়া বিশেষ কথা কওয়া তাঁর পছন্দ নয়, এ কথা কে না জানে! শেয়ালের তাতে বেশ রাগই হয়। তিনি পণ্ডিত, তাঁর তো রাজার কাছে একটু পাত্তা পাওয়া উচিত! বনের রাজা বলে বড্ড অহংকার! প্রায়ই ভাবেন, কী করে সিংহের সিংহাসন কেড়ে নেওয়া যায়!
যার-তার সঙ্গে এমন গূঢ় বিষয়ে আলোচনা করাও মুশকিল। তাই শেয়াল করলেন কী, বেছে বেছে তাদের সঙ্গেই ঘোঁট করলেন যারা মনে মনে রাজা হতে চায়। সত্যি বলতে কী, শেয়াল নিজেও যে চান না, তা নয়।
শেয়ালের কথা শুনে হায়নারা হাঃ হাঃ করে একচোট হেসে বললেন, 'রাজা হব আমরা।'
হাতি একখানা চালতার ডাল ভেঙে গোটা চার চালতা মুখে পুরে জিভে টকাস টকাস শব্দ তুলে বললেন, 'রাজা হতে আমি কখনও চাই না। তার দরকারটাই বা কী! তবে হ্যাঁ, সিংহমশাইকে যদি গদিচ্যুত করা হয়, তবে সে আসনে বসার যোগ্য আমিই একমাত্র।'
কাঠবিড়ালী কাঠবাদামের খোসা ছুলে মুখে ফেলার আগে বললেন, 'ঠিক ঠিক। আপনার যেমন দাঁত, তেমন কান। যেমন বাহুবল, তেমনই বুদ্ধিবল। শুধু চোখ দুটোই যা ছোট!'
খরগোশ কাঠবিড়ালীর প্রাণের বন্ধু। তাকে একটু চিমটি কেটে কানে কানে বললেন, 'অত বেশি কথা বলার দরকার কী! আমরা ছোট প্রাণী। সাবধানে থাকাই ভাল।'
কানাকানি শেয়ালের নজর এড়াল না। ওমনি তাঁর মনে হল, এরা এখুনি গিয়ে সিংহের কানভাঙানি দেবে। তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, 'বাপু হে! তোমরা বুঝি সিংহের দলে? মনে রেখো, তোমাদের লুকোবার গর্তগুলো সব আমার চেনা!'
বাঁদর ও হনুমানের দল এক জাতি, এক প্রাণ। তাঁরা সব কিচিমিচি করে উঠলেন। গাছের ডালে ডালে বসে সবই শুনছিলেন। এবার বলতে লাগলেন, 'ভয় দেখিয়ে দলে টানা চলবে না চলবে না।'
পালের গোদা হনুমান একটি বুনোলতার ডগায় ঝুলে কিছুক্ষণ চমৎকার কলাকৌশল প্রদর্শন করে, মাটিতে গুছিয়ে বসে বললেন, 'আমরা ন্যায়ের পক্ষে এবং রাজার অনুগত। শৃগালমহাশয়, আপনার জানা আছে যে, জঙ্গলের আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক পশুপক্ষী ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর স্বাধীন মতামত দেওয়ার অধিকার আছে। আমি আমার দলের প্রধান হিসেবে মতামত দিচ্ছি, সিংহমহাশয় অরণ্যের মহারাজাধিরাজ থাকার সম্পূর্ণ যোগ্য। তাঁর পরিবর্তে অন্য কাউকে রাজা করার চক্রান্ত নিষ্ফল শুধু নয়, আমাদের পশুকুলের পক্ষে নিরাপদও নয়।'
'কেন নিরাপদ নয়?' হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ব্যাঘ্রমহাশয়। তিনি যে কখন এসে ঝোপের ভিতর আলো-আঁধারিতে মিশে গিয়েছেন, কেউ নজর করেননি! তিনি সুবিশাল রাজকীয় বাংলার বাঘ। তাঁর পিছনে চিতা, পুমা সকলেই জুটেছেন। তবে কিনা রয়্যাল বেঙ্গলের অহংকারই আলাদা! রূপে, গুণে, শৌর্যে, বীর্যে সিংহের সঙ্গে তাঁর তুলনাই সমানে সমানে যায়। কথায় বলে, বাঘ-সিংহ!
সুতরাং, গোঁফে তা দিয়ে বাঘ বললেন, 'আমি আপত্তি করিনি তাই, না হলে কে না জানে রাজকীয় লক্ষণ আমার মধ্যেই বেশি। ওই একগুচ্ছ ঝামর কেশর ছাড়া পুরুষ সিংহের আর আছেটা কী! তাই সকলেই মানবে, সিংহাসনে বসার উত্তরাধিকার সম্পূর্ণ আমার!'
রয়্যাল বেঙ্গলের অহংকারে অন্যান্য বাঘেরাও চটপটিয়ে থাবাতালি দিলেন। সমর্থনের উপায় হিসেবে নখে আঁচড়ে ফালা ফালা করে দিলেন চন্দন, বেল, শিমুল, শাল গাছের গা।
ঠিক তখনই আসরে অবতীর্ণ হলেন শিম্পাঞ্জি। এতক্ষণে লক্ষ করা গেল, বনের কোনও জন্তুই আর বাকি নেই। কী করে যেন সংবাদ রটে গিয়েছে --- বনের প্রান্তে, যেখানে বেশ একটু মাঠমতো, পাশে চওড়া স্বচ্ছ জলের ঝিলে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে এসে সাঁতার কাটে, কারও সঙ্গে মেশে না -- সেইখানে আজ রাজা বদলের সভা!
পশুসমাগমের বিপুল বহর দেখে শেয়ালের তো আনন্দ আর ধরে না! নিজের বুদ্ধির উপর এমনই আস্থা যে জ্যেঠতুতো দাদা খ্যাঁকশেয়ালের গলা জড়িয়ে কানে কানে বললেন, 'শুধু দেখে যাও, এমন চাল চালব যে সব্বাই আমাকেই রাজা করবে।'
'কিন্তু চালটা কী?' ফিসফিসানি কান পেতে শুনে প্রশ্নটা করলেন ভোঁদড়।
'সেটা গোপনীয়।' এই বলে শেয়াল সিংহের বিরোধীপক্ষকে একত্রিত করতে লাগলেন। মনে মনে ভাবছেন, রাজা হলে, বাঘের মতো না হোক, জেব্রার মতোও যদি একটু ডোরা কেটে নেওয়া যায়! আর সিংহের কেশরটাও ভারী লোভনীয়! অত লম্বা না হলেও, বাইসনের কেশরও বেশ রঙিন ও সুন্দর। কিছু একটা উপায় করে তা-ই পরা যাবে না হয়! সামনেই জেব্রার সঙ্গে দেখা। রাজনীতিতে আগ্রহ নেই বলে জেব্রা, হরিণ আর সম্বর ভাল জাতের ঘাস বনের কোন কোন অঞ্চলে জন্মায় এই নিয়ে আলোচনা করছিলেন। শেয়ালকে দেখে সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে চুপ করে গেলেন। শেয়ালের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে কারও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর ধূর্তামি বিষয়েও সকলেই অবগত। পণ্ডিত যদি ধূর্ত হয় তা হলে তার চেয়ে ক্ষতিকারক আর কেউ নয়। তাই গাধা পাঠশালা খোলার পর অধিকাংশ পশুই যাঁর যাঁর বাচ্চাদের শেয়াল পণ্ডিতের টোলে না পাঠিয়ে গাধার পাঠশালে পাঠাচ্ছেন। তাতে বাচ্চাদের জ্ঞানবুদ্ধির ক্রমোন্নতিও প্রকাশ পাচ্ছে।
তাঁকে দেখে যে আলোচনা থামিয়ে দেওয়া হল, শেয়াল তা ভালই বুঝলেন। তিনি মনে মনে বেজায় চটে উঠলেন বটে, কিন্তু মুখে মিষ্টি হাসির রেশ টেনে জেব্রার ঘাড়ে দুটি চাপড় মেরে বললেন, 'সত্যি করে বলো তো ভায়া, আসল না নকল?'
'কী? কোনটা? কেন?' জেব্রা তো থতমত খেয়ে কেশে, তুতলে অস্থির।
শেয়াল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বললেন, 'এই সাদাকালো ডোরাগুলো?'
জেব্রা চোখ কপালে তুলে বললেন, 'ওমা! নকল হতে যাবে কেন? জন্ম থেকেই তো আছে। প্রত্যেক জেব্রার নকশা আলাদা রকম। কারও সঙ্গে কারও মেলে না।'
'তাই তো সন্দেহ। বলি রহস্যটা কী?'
হরিণ তাঁর ডাগর ভীরু চোখ তুলে বলি কী না বলি ভাবছেন, এমন সময় লম্বা গলা নামিয়ে শেয়ালের মুখোমুখি হয়ে তুলোধোনা শুরু করলেন জিরাফ। এতক্ষণ তিনি ঘোড়া ডিঙিয়ে অতি উঁচু কুসুমগাছের কচি ডালপালা খাচ্ছিলেন। কিন্তু সব কথাই তাঁর কানে যাচ্ছিল। বললেন, 'দেখুন পণ্ডিতমশাই, বিদ্যেবুদ্ধি দুই-ই আপনার অনেক, কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপনি অতি হীন! একে তো মহান সম্রাট দ্বিরদান্তক পারীন্দ্র হর্যক্ষ কেশরী রক্তজিহ্ব সিংহের বিরুদ্ধে অন্যায় চক্রান্ত করছেন, তার উপর আমাদের চামড়া নিয়ে টানাটানি! মিথ্যে রঙ মেখে সঙ আমরা সাজি না। সাজার প্রয়োজনও হয় না। আমরা যারা সব নিরামিষ আহার করি, একটা পোকা পর্যন্ত খাই না, যাকে বলে সম্পূর্ণ ভেজিটেরিয়ান -- আমাদের সততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে আমরা প্রচণ্ড রেগে যাই।'
হঠাৎ ওপাশ থেকে একখানা দশাসই গোরু গম্ভীরভাবে বলে উঠল, 'ভে-গা-ন-ম্বা'
জিরাফের নির্ভীক প্রতিবাদের জোয়ারে শেয়াল একটু থমকে গিয়েছিলেন। চক্রান্তকারীরা সৎ ও নির্ভীকদের বোকা ভাবলেও খানিক সমঝে চলে। শেয়াল মনোযোগ সহকারে জিরাফের বক্তব্য থেকে সারকথা বুঝতে চাইছিলেন একটু বিব্রত মুখে। কিন্তু সে বেশিক্ষণের জন্য নয়। মুখে ধূর্ত হাসিটি ফিরিয়ে এনে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, 'গোরুজি, আপনার কথাটার মানে ভে-ভে করে গান। তাই না? এক্ষুনি ভেড়ার পালকে বলছি, তারা ভ্যা-গান শুরু করুক। সভার শুরুতে একটু সমবেত সঙ্গীত নইলে চলবে কেন?'
ভেড়ার দল কাছেপিঠেই ছিল। তারা ভে-ভে, ভি-ভি, ভ্যাক-ভ্যাক করে হাসতে লাগল। শেয়ালের পণ্ডিতির বেশ খানিকটাই যে বোলচাল আর হাব-ভাব, মেষকুলের তা জানতে বাকি ছিল না। গোরুজির বলা ভেগান শব্দের মানে একটুও বুঝতে না পেরে শেয়াল চালাকি করলেন। চালাকি অতি নিকৃষ্ট বিষয়। আজ না হোক কাল তা ধরা পড়বেই। তখন মানসম্মান বলে আর কিছু থাকে না। তবে শৃগালমহাশয় চিরকালই শঠতার পক্ষপাতী বলে মানসম্মান বোধটা তাঁর কম। ভেড়ার দলের হাসি শুনে তিনি ভাবলেন, উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হবে বলে তারা আহ্লাদে হাসছে।
ল্যাজের ডগা দিয়ে কান চুলকে, এক চোখ টিপে অদূরে দাঁড়ানো গোরিলার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, 'তা হলে, মশাইরা, আজকের এই বিশেষ সভা, সিংহাসন থেকে সিংহের বিতাড়ন, ভ্যা-গান দিয়ে শুরু হোক।'
গোরিলা কুঁতকুতে চোখে চেয়ে বুক বাজিয়ে তালি দিতে যাবেন, তার আগেই, কণ্ঠে নধর মুলোর লেঙুটিধারী, পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় শিক্ষিত গাধা চড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, 'গোড়াতেই ভুল থেকে যাচ্ছে পণ্ডিতমশাই। গোরুজি, আপনি বুঝিয়ে বলবেন, না কি আমি?'
গোরু জাবর কাটছিলেন। নিস্পৃহ মুখে ঢোক গিলে বললেন, 'আপনিই বলুন ভাই।'
গাধা বললেন, 'গোরুজি বলেছেন ভেগান। মানে ভেককুলের গানও নয়, ভেড়ার গানও নয়। এ হল নিরামিষ ভোজনের আরেক কাঠি উপরে।'
গোরিলা উৎসুক হয়ে বললেন, 'সেটা কীরকম?'
'প্রাণী খাওয়া তো চলবেই না, প্রাণীজাত কিছু -- যেমন ডিম, দুধ বা দুগ্ধজাত কিছু খাওয়া চলবে না।'
'এ আবার কেমন নিয়ম?'
'এর নাম খাদ্যাখাদ্য রেনেসাঁ। খাদ্যবিষয়ক রেনেসাঁ বা নবজাগরণ।'
'ব্যাপারটা খুব শাঁসালো লাগছে না তো!'
গাধার জ্ঞান ফলানো দেখে শেয়ালের হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। একে তো গাধা পাঠশালা খোলায় তাঁর টোলে ছাত্রাভাব, তাঁর পাণ্ডিত্যে নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে বলে শুনেছেন। এবার তিনি আর থাকতে না পেরে -- হুয়া হুয়া খুব হুয়া। গানা কৌন গায়েগা আ আ...বলে গলা ছেড়ে ডেকে উঠলেন। সব শেয়ালের এক রা। ওমনি বাকি শেয়ালেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে গানা হুয়া কব হুয়া আয়েগা গায়েগা বলে চেঁচাতে লাগল।
ঘন বনের প্রান্তে তখন দিব্য সুন্দর পূর্ণচন্দ্র উদয় হচ্ছেন। পাঠশালা ছুটি হয়ে যাওয়ায়, আর তাদের বাবা-মায়েরা সভায় ব্যস্ত থাকায়, বাচ্চারা বনের ধারে খুব খেলায় মেতেছে। সভায় সিংহ ছাড়া আর সব পশুই উপস্থিত। কেউ সিংহের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। কেউ নিজেই রাজা হতে চায়, কেউ অপর কাউকে রাজা হিসেবে সমর্থন করতে চায়।
রাত্রি হয়ে আসছে দেখে পাখিরা কলস্বরে বলে উঠলেন, 'এই সভার সঙ্গে আমাদের সরাসরি সম্পর্ক নেই। অন্ধকার নেমে আসছে। যাবার আগে বলে যাই, বাজপাখি শক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও পক্ষীকুলে ময়ূরই আমাদের রাজা, তেমনি পশুরাজ হিসেবে সিংহের প্রতিই আমাদের সমর্থন রইল।'
বাঘ লম্ফ দিয়ে বলে উঠলেন, 'কেন কেন কেন?'
কিন্তু পাখিরা নিরুচ্চারে তাদের নীড়ে ঢুকে পড়লেন। ঘরে কারও ডিম আছে তো কারও আণ্ডাবাচ্চা!
শেষ পর্যন্ত, শেয়ালের রব থামতেই চামচিকে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে চিঁ চুঁ চুঁই চিঁক বলে সুরে-তালে-লয়ে এক মনোহর উদ্বোধনী গেয়ে দিলেন। এই গান এক চিনে চামচিকের কাছে শেখা। কাউকে শোনাবার সুযোগ হচ্ছিল না, আজ যেচে পড়েই গাইলেন। পশু জগতে তিনি নগণ্য। কিন্তু গানটি ভাল গাওয়ায় সকলেই বেশ অনুপ্রাণিত বোধ করতে লাগলেন।
শিম্পাঞ্জি বলে উঠলেন, 'কে রাজা হবে ফয়সালা হয়ে যাক!'
তখন সভাস্থল থেকে বেশ একটু দূরে পশুরাজ তাঁর ছানাদের সঙ্গে খেলা করছিলেন। সিংহী রানিমা মুখখানা বিষণ্ণ করে বললেন, 'ওগো, কিছু শুনেছ?'
সিংহ শান্তস্বরে বললেন, 'শুনেছি বৈকি।'
'কার কাছে শুনলে?'
সিংহ একটু হাসলেন। সব রাজারই চর থাকে। পশুরাজেরও আছে। আর তিনি যে শুধু পশুরাজ তা-ই নয়। তিনি রাজার রাজা। সারা বনের রাজাধিরাজ!
সিংহী বললেন, 'ওই শৃগাল, পণ্ডিত হয়েও এমন নীচ! তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে! তোমাকে উৎখাত করতে চায়। তুমি কিছু করো। এই কি ছানাদের সঙ্গে খেলা করার সময়?'
সিংহ তাঁর প্রিয় রানির ঘাড়ে আলতো চাপড় মেরে বললেন, 'শান্ত হয়ে বসো তো এখানে। আমার কথা শোনো। "আমি রাজা" বললেই কেউ রাজা হয় না। পাঁচজনে যাকে রাজা বলে মান্য করে, সেই প্রকৃত রাজা! আর ছলনা করে, চক্রাভিসন্ধি করে, কিংবা ভয় দেখিয়ে রাজা হওয়া? ছিঃ ছিঃ! তার চেয়ে মানুষের চিড়িয়াখানায় থাকা ভাল।'
'তা বটে।'
'দেখো, আমার চেয়ে ভাল রাজা যদি কাউকে গণ্য করা যায়, হোক সে রাজা!'
'কী ভাবে বোঝা যাবে তোমার চেয়ে যোগ্যতর? ন্যায়যুদ্ধ হোক তা হলে!'
'দেখোই না কী হয়!'
সিংহী রানি বাতাসে উঁশ উঁশ গন্ধ শুঁকে বললেন, 'হ্যাঁ গো, তুমি মানুষের নাম করলে বলেই কি মানুষ মানুষ গন্ধ পেলাম? এ জঙ্গলে তো মানুষের তেমন আনাগোনা নেই!'
সিংহ বললেন, 'না রানি, গন্ধ আমিও পাচ্ছি। সতর্ক হও। দুষ্ট মনুষ্য না হলে আক্রমণ কোরো না।'
ওদিকে সভায় রাজা হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। শিম্পাঞ্জি বলছেন, 'শুধু গায়ের জোরে রাজা হওয়ার দিন আর নেই। এখন বুদ্ধির যুগ। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি আমার। আমি কম্পুটর চালাতে পারি। আমিই রাজা হব।'
কাঠবিড়ালী ফিসফিস করে খরগোশকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী টর বলল? কী চালায়? ঘাস ছাঁটাইয়ের যন্তর?'
খরগোশ বললেন, 'একটা তো মটর আছে। সেটা খায় আবার চালায়। এটাও যন্তরই হবে।'
কেউ লক্ষই করেনি উট ঝিমোচ্ছেন আর জাবর কাটছেন। হঠাৎ দড়াম করে উঠে দাঁড়ালেন। একটা বাঁদর দিব্যি উটের পিঠে বসে আরাম করছিল। ছিটকে পড়ল। উট তড়বড় করে বলে উঠলেন, 'হাঁ জি শিম্পাঞ্জি, সব্বাই জানে মানুষ তোমায় নাচায় আর তুমি নাচো। হ্যাঁ, আমাদের নয় বুদ্ধি কম, মানুষের পোষ্য হয়ে থাকি, কিন্তু তোমার অত মানুষ হওয়ার বাসনা কেন? মানুষের সঙ্গে থাকলেও একটা উট উটই থাকে, ঘোড়া ঘোড়াই থাকে, কুকুর পর্যন্ত আত্মসম্মান হারায় না। শুধু তুমি মানুষ হতে চাও। তোমাকে আমরা বিশ্বাস করি না। তুমি রাজা হলে মানছি না, মানব না।'
কারা সব গলা মিলিয়ে বলে উঠল, 'মানছি না, মানব না।'
হায়নারা বলে উঠলেন, 'হাঃ হাঃ আমরা সবাই রাজা হব হায়নারা!'
গাধা তারসপ্তকে গলা তুলে বলে ফেললেন, 'আমি উচ্চৈঃস্বরে, বিনা দ্বিধায়, সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আনুগত্য সহকারে সিংহ মহাশয়কেই সম্রাট বলে মান্য করছি। কারণ...'
হঠাৎ গলায় টান পড়তে তিনি একটু থামতে বাধ্য হলেন, দেখলেন এক রামছাগল তাঁর গলায় ঝোলানো মুলোয় কামড় বসাচ্ছে। গাধার চোখে চোখ পড়তেই লাজুক মুখে, দাড়ি নেড়ে রামছাগল বললেন, 'মুলোটা খাই?'
'খাও।'
'কিন্তু গলায় মুলো কেন?'
'ভদ্রতা। তা ছাড়া, সব্বাই মনে করে গাধার সামনে গাজর বা মুলো ঝুলিয়ে দিলে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায়। একজন শিক্ষিত গাধা কখনও তা করবে না। সে ঝোলানো মুলোর প্রলোভন জয় করবে।'
গাধার কথা শেষ হতেই রামছাগল মুলোয় মস্ত কামড় বসালেন। গাধা তাঁর অসমাপ্ত বক্তৃতার খেই ধরে বললেন, 'শৌর্য, বীর্য, পরাক্রমই শুধু রাজগুণ নয়। দয়া, পরোপকার, অপরের নিরাপত্তার জন্য আত্মত্যাগও রাজ্যের রাজার থাকা চাই। জানা চাই অরণ্যের আইন। থাকা চাই পশুধর্মের ন্যায়নীতিবোধ। সিংহমহাশয় এই প্রতিটি গুণের অধিকারী। তাই আমি চাই তিনিই রাজা থাকুন।'
কারা যেন গাধার সমর্থনে বলে উঠল, 'সিংহমশাই রাজা থাকুন, রাজা থাকুন।'
শেয়াল দেখলেন গতিক সুবিধের নয়। ভেবেছিলেন যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলবেন, পণ্ডিতেরই রাজা হওয়া উচিত। ওরাং ওটাং ও গোরিলার সমর্থন পাবার কথা ছিল। বাইসনদেরও বলে কয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন সবাই চুপ। তিনি ব্যাঘ্রমহাশয়কে খুঁচিয়ে বললেন, 'সিংহের এত গুণগান শুনে আপনার রক্ত ক্রোধে টগবগ করে ফুটছে না?'
বাঘ হাড় হিম করা গর্জন করে বললেন, 'হালুম! মালুম করো! বনের রাজা হাম হ্যায়!'
মুলোটা অত্যন্ত সুস্বাদু ও রসালো। তেজালোও বটে। সেই তেজে রামছাগল সক্কলকে অবাক করে প্রবল তেজস্বীতায় বলে উঠলেন, 'রাজা? আপনি হবেন রাজা? লজ্জা করে না আপনার? এত শক্তি, এত ক্ষমতা, অথচ চোরের মতো মানুষের গোয়ালঘরে ঢুকে, খামারে গিয়ে, বাছুর, ছাগল, মুরগি, শুয়োর চুরি করেন। আপনাতে আর ওই শেয়ালে কোনও তফাত আছে? ছিঃ ছিঃ!'
শূকর একটু মাটি খুঁড়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললেন, 'ঠিক বাত। ঠিক বাত। চোরি চোরি বাঘোরি।'
বাঘ একটা লম্বা আড়মোড়া ভেঙে বললেন, 'এখানে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক টেনে আনলে তা হলে আরও অনেক কথাই উঠবে!'
তাঁর কথা শেষ হয়েছে কী হয়নি, বাচ্চাদের ভয়ার্ত চিৎকার ও হুটোপাটির শব্দ এল। অচিরেই বাচ্চা পশুরা সভায় এসে কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'পাঁচজন দু'পেয়ে লোক। সঙ্গে দুটো কুকুর আর বন্দুক। একটা কুকুর এক লাফে হরিণছানা মারল।'
শুনে মা হরিণী কাঁদতে বসলেন। বাবা হরিণ বললেন, 'কাঁদবে পরে। এরা বন্দুকবাজ শিকারি। চলো আগে নিরাপদ জায়গায় লুকোই।'
এক নিমেষে সভা ভঙ্গ। যে যার বাচ্চা নিয়ে লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শিকারি কুকুরের নামে হায়নারা উধাও। শিম্পাঞ্জি এক লাফে যে কোন মগডালে লুকোলেন, কেউ দেখতে পেলো না। শেয়াল কখন গর্তে ঢুকে পড়েছেন।
রামছাগল বাঘের লেজ টেনে বললেন, 'আপনি কিছু করুন মশাই।'
'আমি? করতাম! কিন্তু আমার ছালটার উপর যে ওদের বড্ড লোভ! ভীষণ দামি কিনা!'
রামছাগলকে লাথি মেরে বাঘবাবাজি সদলবলে ঘনজঙ্গলে সেঁধোলেন।
গাধা রামছাগলকে বললেন, 'চলো মহারাজের কাছেই যাই।'
মানুষের গন্ধ পেয়েই সিংহ সতর্ক হয়ে উঠেছিলেন। এখনও তিনি বনের রাজা। বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তার ভার তাঁরই পরে। সিংহীকে নির্দেশ দিলেন, 'ছানাদের নিয়ে লুকিয়ে পড়ো গে।'
এই বলে গন্ধ শুঁকে শুঁকে শিকারিদের গতিবিধি বুঝে নিলেন। একটি কুকুর হরিণশিশু শিকার করল তাঁর নজর এড়াল না। প্রবল ক্রোধে তিনি লেজ আছড়ালেন। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন সঠিক মুহূর্তের জন্য। পাঁচজন মানুষ। দুটো কুকুর। তিনজনের হাতে বন্দুক। কুকুর দুটো প্রচণ্ড ডাকাডাকি করছে। আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। বিশাল লম্ফ দিয়ে পাঁচজনের জটলার মধ্যে আছড়ে পড়লেন সিংহ। নিমেষে কুকুর দুটো তাঁকে আক্রমণ করল। তিনি পরোয়া করলেন না। মানুষগুলোর হাত থেকে বন্দুক ছিটকে পড়েছে। না, প্রাণে তিনি কাউকে মারবেন না। শুধু শিকারের হাতগুলো কামড়ে গুঁড়িয়ে দেবেন!
কয়েক মিনিটে তাঁর কাজ শেষ। মানুষগুলো পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। বাপ রে মা রে দিদি রে ভাই রে! কে কাকে বাঁচায়! সিংহের শরীরের চাপেই কারও হাড় গুঁড়ো, কারও পা ভাঙা, রক্তাক্ত হাত, কাঁধ! মানুষের দিকেই সিংহের মনোযোগ ছিল প্রথমটায়। কিন্তু কুকুর দুটো তাঁর পিঠ থেকে পা থেকে কামড়ে, খাবলে মাংস তুলে নিয়েছে। ঝরঝরিয়ে রক্ত পড়ছে। শয়তান পোষা কুত্তা! মানুষের দাস! তোমাদের প্রতি আমার কোনও মায়া নেই! নিজেরা পশু হয়ে এসেছে কিনা পশুশিকারে সাহায্য করতে! নিরীহ হরিণশিশু ধরে প্রভুকে ভেট দিয়েছ। তোমরা জঙ্গলের কেউ নও। তিনি একজনের টুঁটি টিপে ধরলেন, আরেকজনকে মাটিতে ফেলে থাবা দিয়ে পেট চিরে দিলেন। কাজ শেষ।
ক্ষতস্থানগুলো চেটে নিচ্ছিলেন রাজাধিরাজ সিংহ। ক'দিন একটু বিশ্রাম চাই! শিকারি কুকুর হিংস্র ও উন্মত্ত! ছানারা বার বার সিংহর বুকে পিঠে উঠতে চাইছে। সিংহী বাধা দিচ্ছেন। 'এখন বিরক্ত কোরো না। বাবা যে যুদ্ধ করে এলেন। এখন তিনি পরিশ্রান্ত। আহত।'
'বড় হলে আমরাও বাবার মতো হব।'
সিংহমহারাজ তাঁর সিংহী রানির দিকে চেয়ে বললেন, 'যুদ্ধে তোমাদের মা-ও একইরকম পারদর্শিনী।'
গোল চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে ঠিক মাথার উপর উঠে এসেছে। তিনি দেখলেন গভীর জঙ্গল থেকে পশুরা বেরিয়ে আসছে। চাঁদের আলোয় কী সুন্দর লাগছে এই সমাবেশ! সমস্বরে ধ্বনি উঠলঃ জয়! মহান সম্রাট দ্বিরদান্তক পারীন্দ্র হর্যক্ষ কেশরী রক্তজিহ্ব সিংহমহারাজের জয়!