আকাশে বিষণ্ণ মেঘ। তার সঙ্গে অবাধ্য হাওয়ার আশকারায় সমুদ্রটা একেবারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । থেকে থেকে আচমকা আছড়ে পড়ছে পাথরের বুকে। তার এই উচ্ছ্বাসের ছিটে এসে লাগছে সমুদ্রতীরের লোকজনের গায়ে, সিক্ত করে দিচ্ছে তাদেরকে। এই যেমন আমাকে করে দিল এইমাত্র। আর সেই সঙ্গে আমার সিগারেটটাকেও – যেটা দিনের প্রথম সিগারেট - সেটাও একেবারে চুবড়ি-ভেজা হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে সেটা ফেলে দিতে যাচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে আমার বর্তমান বাসস্থানের মালিক ‘তে তেইরা’ - যার অন্য নাম রবার্ট সলোমন – এর গলা ভেসে এলো। “না না টমাস – যেখানে সেখানে নয় প্লিজ।”
একটু লজ্জিত হয়ে সিগারেটটা তুলে একটা কাগজের টিস্যুতে মুড়িয়ে জ্যাকেটের পকেটে গুঁজে রাখলাম। পরে ট্রাশক্যান দেখলে ফেলে দেবো অখন। মনে মনে নিজেকে ভৎসনা করলাম – নিজের দেশে তো রাস্তায় সিগারেটের টুকরো ছুঁড়তে যাই না।
তে তেইয়া পায়ে পায়ে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর সমুদ্রের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বললো “আজ তো সমুদ্র শান্ত হয়ে যাচ্ছে দেখছি।”
“বল কি?” বললাম আমি, কিছুটা অবিশ্বাসী গলায়। “আমি তো সেই একই রকম দেখছি গত কুড়ি দিন ধরে। মেঘলা আকাশ, অশান্ত সমুদ্র, বৃষ্টি! বেরোতেই তো পারছি না! ক্যামেরায় হাত দিতেও ইচ্ছে করছে না।”
জায়গাটার নাম চাথাম। নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণপূর্বে প্রায় পাঁচশো মাইল দুরে দশ-বারোটি দ্বীপের একটি দ্বীপপুঞ্জ। তার সবচেয়ে বড়ো দ্বীপটির নামটিও চাথাম। সেখানেই আছি আপাতত। এসেছি ছবি তুলতে। বা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় এসেছি চাথাম দ্বীপের বিখ্যাত ম্যাজেন্টা পেট্রেল এবং চাথাম আলবাট্রসের – এই দুটো পাখির ছবি তুলতে।
আমার নাম টমাস লুকিচ। পেশায় ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার - ন্যাশনাল জিওগ্রাফির নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট ফটোগ্রাফারদের অন্যতম। আমি মূলত মেরিন ফটোগ্রাফিতে স্পেশালাইজড – অর্থাৎ জলের তলার ছবি তো বটেই, তাছাড়া সামুদ্রিক পাখিদের ছবিও। এ ব্যাপারে আমার কিছুটা নামডাক আছে, সেই জন্যেই এই অ্যাসাইনমেন্টটা আমাকে দিয়েছে ওরা। টাকার অঙ্কটা ভালো। তার চেয়েও ভালো এরকম চমৎকার একটা জায়গায় বিনা পয়সায় বেড়াতে আসার সুযোগটা।
এই চাথাম দ্বীপপুঞ্জটিতে মানবসভ্যতার আগমন খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। নীলসবুজ সাগরঘেরা চাথাম একেবারে একলা ছিলো এই সেদিন অব্দি। আকাশ আর সমুদ্রের সঙ্গে গল্প করতো একা একা। তারপর আজ থেকে ছশো বছর আগের একটি দিনে - যেদিন ঝোড়ো হাওয়ায় অশান্ত সমুদ্র সগর্জনে আছড়ে পড়ছে এই পাথুরে দ্বীপগুলোর গায়ে, সেদিন নাম-না-জানা কোথা থেকে পাপাঙ্গুলের মতো ছোট্ট নৌকোয় করে মানুষ এলো এই চাথামে। সেই ছোট্ট নৌকো থেকে কাদামাখা পায়ে যারা নামলো এই চাথামে, তাদের নাম মরিওরি। নিঃসঙ্গ চাথামের প্রথম সঙ্গী তারা। প্রথম সন্তান।
তাদের হাত ধরে পুরুষাকারের সঙ্গে প্রকৃতির দেখা হল। সভ্যতার স্পর্শ পেল এই দ্বীপগুলো। আর পেল তার নাম। মরিওরিরা এর নাম দিল ‘রেকোহু’। অমৃতের পুত্রকন্যাদের হাতে মহাকাব্য রচনা শুরু হল।
আরো চারশো বছর পরে, আবার নৌকোয় চড়ে নিউজিল্যান্ড থেকে মাউরি উপজাতির লোকেরা এলো এই দ্বীপে। কিন্তু মাউরিরা ছিল নৃশংস হত্যাকারীর দল – বস্তুত তাদের মতো আগ্রাসন মানবসভ্যতায় কমই দেখা গেছে। লড়াই হয়েছিল একতরফা – মরিওরিরা একেবারেই লড়তে জানত না। দলে দলে মরল তারা, পঙ্গপালের মতো। যারা বেঁচে রইলো, তারা হয়ে উঠলো মাউরিদের ক্রীতদাস। দ্বীপটা হারালো তার ‘রেকোহু’ নামটা। তার নতুন নাম হলো ‘চাথাম’।
এলো ইয়োরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীর দল – চাথাম আবার বিজিত হলো। লুঠ-তরাজ-ঘৃণা-হিংসা-রক্তপাত চলতেই থাকলো একটানা। তারপর একদিন এই চাথাম দ্বীপগুলি হয়ে উঠলো নিউজিল্যান্ডের কলোনি – ওদের অংশ। তাদেরই হাত ধরে কিছুটা হলেও শান্তি এলো। মরিওরিরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেল। নিউজিল্যান্ড সরকার নানানভাবে সাহায্যও করলো এদের আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার। এখন চাথাম অনেক শান্ত। ট্যুরিস্ট আসে প্রচুর। এটাই এদের প্রধান ব্যবসা। এর সঙ্গে মাছের চাষ।
শান্তি এলো, স্বস্তি এলো, কিন্তু মরিওরিদের সাধের ‘রেকোহু’ আর ফিরে এলো না। শুধু নামটাই যে ফিরে এলো না, তা নয়, – মরিওরিদের ওই সহজ জীবনটাও কেমন যেন হারিয়ে গেলো। খুব অল্প ক’ঘর মরিওরি আদিবাসীই আজ বেঁচে আছে। যারা আছে তারাও নিতান্ত প্রান্তিকভাবে বেঁচে আছে – একেবারেই নিউজিল্যান্ডবাসী সায়েবদের পদতলে। এই অল্প কজন মরিওরিরা বেঁচে আছে একটা চাপা ক্ষোভ ও বেদনাবোধ নিয়ে, এতো বছর পরেও। আমার গৃহস্বামী তে তেইরা রবার্ট সলোমন তাদের একজন।
আমার এখানে এসে কুড়ি দিন হয়ে গেল। ক্রাইসচার্চ থেকে ছোট প্লেনে ওয়াইটাঙ্গিতে নেমে পয়েন্ট ডারবানের একটা হোমস্টেতে উঠেছি। যেচে হোমস্টে নিয়েছি – যাতে আদিবাসী মরিওরিদের সংস্কৃতির সঙ্গে একটু স্বাদ পাওয়া হয়। এটা আমার প্যাশন – স্থানীয় সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করা, তাদেরকে সংরক্ষণ করা। আমাদের নগরসভ্যতার থেকে দূরে এসে স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে আমার খুব ভালো লাগে। এখানেও এই হোমস্টেতে থাকতে থাকতেই তে তেইরার সঙ্গে, তার লাজুক স্ত্রী নগামারের সঙ্গে এবং ছটফটে বাচ্চা মেয়ে রিয়ার সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেছে। তে আবার আমার গাইডও বটে, কাজেই তার সঙ্গে রীতিমত সখ্য তৈরি হয়েছে আমার।
পয়েন্ট ডারবানে এসে প্রথম দুদিন আবহাওয়া ভালো ছিল, তাই চাথাম টাইকো – অর্থাৎ চাথাম দ্বীপের ম্যাজেন্টা পেট্রেল পাখিগুলোর ছবি তোলা হয়ে গেছে। ঝকঝকে শট বেশ ক’টা পেয়ে গেছি, কাজেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে দেবার পর বাইরে বিক্রি করার মতোও কিছু আছে। এবার বাকি চাথাম আলবাট্রস। তার জন্যে যেতে হবে ‘তে-তারা-কোই-কইয়া’ নামের একটা পুঁচকে দ্বীপে, তাদের ব্রিডিংয়ের ছবি তুলতে।
তে তেইরা চোখ ছোট করে কি যেন দেখছিলো দিগন্তে। একসময় আমার দিকে ফিরে বললো “আকাশ ফরসা হচ্ছে, টমাস। ঠিকই ধরেছি আমি। আমরা – মরিওরিরা - টের পাই। আমি স্পষ্ট দেখছি যে আজ দুপুরের পরেই সমুদ্র শান্ত হয়ে যাবে। কাল তোমাকে নিয়ে যাব ‘তে-তারা-কোই-কইয়া’তে।”
“বলছো?” বললাম আমি, উত্তেজিত গলায়। উত্তেজনাটা নিজেরই কানে লাগলো। “কাল কেন, তাহলে আজই যাই না। বিকেলে?”
মাথা নাড়লো তে। “আজকে আমি একটু দেখে আসি কি অবস্থা। তারপর কাল তোমাকে নিয়ে যাব। প্রথম দিনে একটু অভিজ্ঞ লোকেদের যাওয়াই ভালো।”
একটু বিরক্ত লাগলো আমার। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কল্যাণে কম ঘুরি নি আমি – এবং সেগুলো সাধরণ ট্যুরিস্ট স্পট নয়। সমুদ্রে ছোট্ট বোটে ঘোরাই শুধু নয়, আন্ডারওয়াটার সামুদ্রিক প্রাণীর ছবি তোলার অভিজ্ঞতাও আছে আমার। কি ভাবে তে - আমাকে?
তে বোধহয় বুঝতে পারলো আমার মনের ভাব। আমার পিঠে হাত রেখে বললো “টমাস – কিছু মনে কোরো না। তোমার অভিজ্ঞতা বা সক্ষমতাকে ছোট করে দেখছি না, কিন্তু তোমার পূর্বপুরুষরা সমুদ্রকে বুকে জড়িয়ে বড়ো হননি। তোমার ছোটবেলা কাটেনি এই সুবিশাল নীলের ওপর নেমে আসা কুয়াশার আবছায়ায় চোখ মেলে। তুমি মরিওরি নও, টমাস। প্লিজ – এটা নিয়ে রাগ কোরো না।”
আমি চুপ করে থাকলাম।
“তাছাড়া”, তে বললো – স্বগতোক্তির মতো কণ্ঠে, “দেখে আসি ‘তে-তারা-কোই-কইয়া’ এখনো আছে নাকি সমুদ্রের তলায় চলে গেছে।”
“সে আবার কি!” বললাম আমি। “একটা দ্বীপ জলের তলায় হারিয়ে যাবে আবার কি? সে আবার হয় নাকি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো তে। “আমাদের সবই হারিয়ে যায়, টমাস। আমাদের চাথানে একসময় পেঙ্গুইন ছিল, জানো? তারা হারিয়ে গেছে। এমনকি তুমি যে চাথাম টাইকোর ছবি তুললে, তারাও তো হারিয়ে গিয়েছিল একসময়। ওই ‘তে-তারা-কোই-কইয়া’ও একদিন হারিয়ে যাবে, টমাস। আমি জানি।”
মাথা নাড়লাম আমি। সাতসকালে এতো স্মৃতিকাতরতা ঠিক পোষাচ্ছিল না আমার।
রিয়ার সঙ্গে কার রেসিংএর খেলাটা জমে উঠেছিল।
এই মেয়েটার সঙ্গে প্রথম দিন থেকেই আমার ভাব। ভারি মিশুকে মেয়ে। গল্প শুনতে ভালো বাসে, খেলতে ভালো বাসে। মাঝে একদিন মাঝরাতে মেয়েটা খুব জ্বরে পড়েছিল – তার সঙ্গে প্রবল বমি। পয়েন্ট ডারবানে হাসপাতাল নেই, চাথামের একমাত্র হাসপাতাল ওয়াইটাঙ্গিতে – রাতবিরেতে সেখানে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। তে খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। নানান জায়গা ঘুরতে হয় বলে আমার একটা এমারজেন্সি ওষুধের পাউচ আছে – সেটা কাজে লাগলো তখন। ওই এমারজেন্সি ওষুধের পাউচ থেকেই আন্দাজে একটা ওষুধ দিয়ে দি মেয়েটাকে। আশ্চর্যজনকভাবে সেটা খেয়েই পরদিন সকালে মেয়েটা একেবারে সুস্থ। দুর্বল যদিও। তখন ওকে ভুলিয়ে রাখতে আমার ল্যাপটপে যে কটা গেমিং সফটওয়ের সেগুলো চালিয়ে দিয়েছিলাম। ব্যাস – সেই থেকে আমি বাড়িতে থাকলেই হয় ওকে কমপিউটার চালিয়ে দিতে হবে, নয় ওর সঙ্গে খেলতে হবে। ওদের বাড়িতে কমপিউটার নেই – কম্যুনিটি সেন্টারে অবশ্য আছে। ইন্টারনেটও সেখানেই।
ঘণ্টাখানেক খেলবার (এবং গো-হারান হারবার) পর আমি বললাম “এবার তুই খ্যাল। আমি এক চক্কর ঘুরে আসি। তোর বাবা কোথায় রে?”
“বেরোলো এই এক্ষুনি। কি সব বিকেলের জন্যে ব্যবস্থা করতে হবে বললো। ফিরতে দেরি হবে।” পাশের ঘর থেকে নগামার গলা ভেসে এলো।
বিকেলের ব্যবস্থা! ওহো - ও যে বিকেলে সমুদ্রে বেরোবে বলছিলো, তারই কিছু ব্যবস্থা হবে। আমিই বা বসে থেকে কি করবো – যাই নাহয় ওর সঙ্গে।
“আমিও যাই, দেখি ওকে ধরতে পারি কি না। আমারও দেখা হবে কি ব্যবস্থা করে ওরা।” বলে আমি উঠে পড়লাম।
“ও কিন্তু বলে গেছে ও একাই যাবে। আমি জিগ্যেস করেছিলাম তোমার কথা। ও বারণ করলো।” নগামা ইতিমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
কথাটা শুনে কেমন একটা খটকা লাগলো। তে’র সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই অন্তরঙ্গ, ও তো কখনো এরকম করে না ! আমি মরিওরি নই বলে আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে না – সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু তা বলে তার ব্যবস্থাতেও আমাকে নিয়ে যাবে না?
“ঠিক আছে” বলে বেরিয়ে পড়লাম আমি। হাল্কা বৃষ্টি এখন, সঙ্গে মৃদু হাওয়া। হাঁটতে ভালোই লাগবে।
বাইরে এসে একটু এগোতেই দূরে দেখতে পেলাম তে-কে - হনহন করে হাঁটছে। জনবসতি পার হয়ে গ্রামের বাইরের দিকে হেঁটে চলেছে। কিন্তু যাচ্ছে টা কোথায়?
আমারও কাজ নেই, আমিও হাঁটা লাগালাম তে-এর পিছু পিছু। অনেকটা দূরত্ব, তে-র দেখতে পাবার কথা নয়। তবুও একেবারে রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম – যাতে দরকার পড়লে চট করে পাশের গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়া যায়।
উরে বাপ – কি প্রচণ্ড স্পিড তে-র। হাঁপ ধরে গেল আমার একটু বাদেই। এদিকে তে-র স্পিড কমবার লক্ষণ নেই। ওই ঝোড়ো গতিতে একটানা প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে আমরা এসে পড়লাম এর পাশের গ্রামে – যার নাম পোর্ট গ্যাপ। এই গ্রামে ঢুকে পড়ার পর তে-র গতি একটু কমলো, আমিও একটু দম পেলাম। কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম তে একটা তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা জায়গার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকটা বড় বাগান, শেষ মাথায় একটা সাদা রঙের বড়সড় একতলা বাড়ি। বাগানটার গেটের কাছে গিয়ে তে ঘাড় ঘুরিয়ে চোর-চোর ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক দেখে সুট ঢুকে পড়লো ভিতরে। দূর থেকে দেখলাম বাড়িটার সামনে দেখলাম জনাতিনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তে গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো, তারপর একটু বাদেই সবাই ওই বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়লো। দূর থেকে দেখে মনে হলো ওরা সবাই বেশ উত্তেজিত।
আমি গাছের আড়াল থেকে দেখছিলাম। ওরা বাড়িটার ভেতরে ঢুকে যাবার পর একটু অপেক্ষা করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওই কাঁটাতারের গেটটার সামনে। দূর থেকে খেয়াল করি নি – কাছে এসে দেখলাম ওই তারজালের বেড়ার একপাশে একটা সাদা বোর্ড আছে। তাতে লেখা “প্রজেক্ট ফর্টি”। আর কিচ্ছু নয়। আর বোর্ডের এক কোনায় একটা উড়ন্ত ডানামেলা পাখির আউটলাইন আঁকা। অদ্ভুত তো - এটা কাদের অফিস ? প্রজেক্ট ফর্টি মানে কি? কিসের প্রজেক্ট?
পকেট থেকে ফোনটা বের করে এই বোর্ডটার একটা ছবি তুলে রাখলাম তাতে।
দুপুরে খাবার খেতে দেরি হল কারণ তে বেশ দেরিতে ফিরল। আমি অবশ্য আগেই চলে এসেছিলাম। খাবার খুব ভালো ছিল – একটা সবরকম সবজি মেশানো স্যুপ, স্কুইড আর ক্রে মাছ হাল্কা ভাজা আর তার সঙ্গে ভাত। রিয়াটা বায়না করেছে বলে একটু স্প্যাগেটি। আমার জন্যে পাউরুটিও আছে। তে-র দেখলাম খাওয়াতে মন নেই – কি যেন ভাবছে। তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করে আগেভাগেই উঠে চলে গেল দেখলাম।
ঘণ্টাখানেক বাদে দেখলাম তৈরি হচ্ছে তে। চুল আঁচড়াচ্ছে - বেরোবে এবার। আমি সামনে দাঁড়িয়েছি দেখে একটা অন্যমনস্ক আবছা হাসি হেসে আবার মন দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো।
কথা পাড়লাম আমিই “তাহলে চললে ?”
“হু” বললো তে।
“তা তোমরা কজন যাচ্ছো?”
“ওই জনা দশেক। চারটে নৌকো।” এখনো তে আমার চোখে চোখ ফেলে কথা বলছে না। খারাপ লাগলো সেটা দেখে।
“সকলেই মরিওরি?”
তে উত্তর দিল না। বোঝাই যাচ্ছে সে কিছু একটা লুকোতে চাইছে।
প্রশ্নটা করতামই, তবে তে’র এই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা দেখে প্রশ্নটায় একটা শান্ত অথচ ধারালো মাত্রা এসে পড়লো “‘তে-তারা-কোই-কইয়া’র পাশের সমুদ্রেই যাচ্ছো নাকি প্রজেক্ট ফর্টির কোনো কাজে?”
তে ভয়ানকরকম চমকে গেল। আমতা আমতা করে বলল “প্রজেক্ট ফর্টি…”
ফোনটা হাতের কাছেই ছিল। ছবিটা স্ক্রিনে দেখালাম।
তে’র মুখ হাঁ হয়ে গেল। ঢোক গিলে বলল “তুমি আমাকে ফলো করেছিলে কেন?”
“সেটা বাদ দাও। কিন্তু এটা কি ব্যাপার? আর এটা নিয়ে এতো লুকোচুরির কি আছে?”
তে গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর বলল “এটা নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। এটা আমাদের – মরিওরিদের নিজস্ব ব্যাপার।”
“সেটা হতেই পারে। কিন্তু এতো লুকোচুরির কি আছে? কোনো বেআইনি কাজ করছ নাকি?” জিগ্যেস করলাম।
তে চুপ করে থাকল। তারপর বলল “আমাদের কিছু জিনিস করতে হয় যেগুলো তোমরা – বাইরের লোকেরা বুঝবে না। তার জন্যে নিয়ম ভাঙতে হয় একটু আধটু। সেটা আমরা বুঝে নেব। তুমি আমাদের ব্যাপারে ঢুকো না। বুঝবে না।”
মাথাটা গরম হয়ে গেল আমার। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম “আমি তোমাদের ব্যাপারে ঢুকতে চাই না, তে। তবে মনে রেখ, তোমাদের ক্রীতদাস থেকে মুক্তি দিয়েছিল আমাদের মতো কিছু বাইরের লোকেরাই। আজ যে মাছ ধরতে পারছ, সেটার জন্যে মাউরিদের ওপর চাপসৃষ্টি করেছিলাম আমরাই – নইলে লিজ পেতে না। আজকে যে মরিওরিদের সংস্কৃতি আলাদা করে বাঁচিয়ে তোলবার চেষ্টা হচ্ছে, সেটাতে কি বাইরের লোকেদের সাহায্য নেই মনে করো তুমি? তোমাদের এখানকার হাসপাতাল চালায় সেন্ট জনের অ্যাম্বুলেন্স। ওষুধ আসে বাইরে থেকে। আমাদের থেকে কি কিছুই পাও নি?”
তে’র মাথা নিচু হয়ে গেল। ধরা ধরা গলায় বলল “একথা বলো না। আমার মেয়েটা সেরে উঠলো তো তোমার জন্যেই।”
“সে কথা আমি বলতে চাইনি মোটেই। তবে তোমাদের ভালোমন্দ নিয়ে আমরাও চিন্তা করি, তে। সেটাকে একটু মর্যাদা দাও।” বললাম আমি। তারপর একটু দম নিয়ে বললাম “এখানকার যে রিজার্ভ ফরেস্টে গিয়েছিলাম তোমার সঙ্গে, যেখানে চাথাম টাইকো আছে, তার সামনের বোর্ডটা পড়েছিলে? এই পাখিটা তো হারিয়ে গিয়েছিল – বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে পুনরাবিষ্কার করেন তো এক নিউজিল্যান্ডের সাহেব, তাই না?”
“ডেভিড ক্রকেট”, বলল তে।
“তবে?”
দুজনেই চুপ করে গেলাম একসঙ্গেই। স্তব্ধতা পড়ে রইল ঘরে কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তে বলল “চলো, তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে। যখন এতোটাই জেনে ফেলেছো…তাছাড়া তুমি আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, আমাদের ভালোই চাইবে নিশ্চয়ই। চল ‘তে-তারা-কোই-কইয়া’য়।”
তৈরি হয়ে নিলাম চটপট।
‘তে-তারা-কোই-কইয়া’ এই চাথাম দ্বীপপুঞ্জের একেবারে দক্ষিণের একটা দ্বীপ। এর আরেক নাম “দ্য পিরামিড”। জনমানবশূন্য ছোট্ট একটা দ্বীপ, পিরামিডের মতো তেকোনা, পাথুরে। এর চারপাশে আছড়ে পড়তে থাকে সমুদ্রের রুক্ষ ঢেউএর দল। এতো তীব্রভাবে আছড়ে পড়ে সমুদ্র এখানে যে গাছপালাও বেশি হয় না এখানে। শুধু একটাই জিনিস এখানে দেখা যায় – তা হলো ওই চাথাম আলবাট্রস। ওই বিরল প্রজাতির পাখিগুলো শুধু এই ‘তে-তারা-কোই-কইয়া’কেই তাদের বাসা বলে মনে করে; তাই তারা ডিম পাড়ে এখানেই। শুধু এখানেই। আর কোত্থাও নয়।
সেইজন্যেই আমি কুড়িদিন ধরে বসে আছি এখানে। কবে সমুদ্র একটু শান্ত হবে। কবে আমি এই দ্বীপে পা রাখতে পারবো। কবে আমার ক্যামেরায় ধরা পড়বে জনমানবশূন্য একটি দ্বীপে এই আশ্চর্য পাখিদের বাসার ছবি।
হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলাম আমি। তে পাশে পাশে হাঁটছে, চুপচাপ। ওও কিছু ভাবছে নিশ্চয় – কে জানে কী। শুধু পোর্ট গ্যাপের কাছে এসে বলল “টমাস – আজ যা দেখবে, তা যেন পাঁচকান না হয়। আমরা মরিওরিরা তোমাকে বিশ্বাস করছি – সেটার মর্যাদা দিও প্লিজ।”
“প্রজেক্ট ফর্টি”র তারজালের সামনে এসে তে বলল “তুমি এখানেই থাকো। আমি আগে ভেতরে গিয়ে একটু কথা বলি।”
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে তে বেরিয়ে এলো। সঙ্গে আরেকটি ছেলে। ওরই বয়েসি। নাম বললো নুকু ডেভিস। বেশ হাসিখুশি। একগাল হেসে বলল “গ্ল্যাড টু হ্যাভ ইউ উইথ আস স্যার। আপনি আমাদের নৌকোতে – আসুন এইদিকে।”
টালমাটাল সমুদ্রে পেরিয়ে চলেছি আমরা। চারটে নৌকো চলেছে – স্টিমার নয়, নৌকো। মরিওরিদের নৌকো। প্রত্যেক নৌকোয় আছে চারজন করে। নৌকোগুলো দাঁড় টানা, কিন্তু তাতে ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। ওই অদ্ভুত চেহারা এই নৌকোগুলোর । নুকু বললো যে এই নৌকোর ডিজাইন নাকি মরিওরিদের এবং অন্তত তিনশ বছর ধরে নাকি এই একই ডিজাইন। আশ্চর্য!
প্রায় তিনঘণ্টা বাদে এসে পড়লাম ‘পিরামিড’এর কাছে। একেবারে দ্বীপের কাছে এসে ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড় টেনে যেতে হয় বাকিটা। সমুদ্রের অশান্ত ওঠাপড়া সামলে নামা নেহাত সহজ নয়। যা হোক, শেষমেশ টালমাটাল ভাবে নেমে পড়লাম ওই পাথুরে দ্বীপটাতে। তারপর নুকু আর তে’র পিছু পিছু ওপরদিকে উঠতে থাকলাম - যেখানে চাথাম আলবাট্রসরা ডিম পাড়ে।
ছোট্ট জায়গা। চারপাশে লম্বা লম্বা জঙ্গুলে গাছ আর তার মাঝখানে এক টুকরো প্রাকৃতিক চাতাল। পাথুরে। অথচ ওইটুকু জায়গায় অসংখ্য আলবাট্রস জড়ো হয়েছে। একপাশে মা আলবাট্রসরা ডিমে তা দিচ্ছে, আরেকপাশে ডিমফোটা ছোট্ট আলবাট্রসরা তাদের পাতা দিয়ে গড়া বাসায় বসে আছে। এ এক অপার্থিব দৃশ্য।
অভ্যস্ত হাতে ছবি তুলে যাচ্ছিলাম আমি। আলো কমে এসেছে, কম্পোজ করার সময় নেই। পরে এডিট করে নেবো নাহয়। আর এই দৃশ্যে আর ক্যামেরার কায়দা করার দরকার পড়ছে না – প্রকৃতির স্ক্রিনে কম্পোজিশন-অ্যাপারচার-এক্সপোজারের-লাইটিংএর বিমূর্ত খেলা চলছে। বিকেলের পরিবর্তনশীল রঙে মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে চলছে ম্যাজিক।
খেয়াল করি নি প্রথমে, পরে দেখলাম বাকিরা সবাই মিলে ভাঁজ খুলে খুলে কাগজের বাক্স বানাচ্ছে। তারপর দেখলাম একটা একটা করে বাচ্চা আলবাট্রস তুলে তুলে বাক্সগুলোতে ভরছে। আগে অবশ্য তাতে ওই পড়ে থাকা গাছের পাতা আর কাগজ ভরে নিচ্ছে। এসব যে ওরা নিয়ে এসেছিলো, সেটা খেয়াল করি নি। তারপর দেখলাম খুব সাবধানে পাখিগুলোকে নিচে নিয়ে যাচ্ছে – আমাদের বোটে। একটু কলকল করলেও পাখিগুলো তারপর চুপ করে যাচ্ছে দেখছি।
ব্যাপার কি? এটা কি স্মাগলিং নাকি? কোন চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে এদেরকে?
প্রশ্ন করাতে নুকু একটু হাসলো। তারপর বললো “কথা দিয়েছো যে কাউকে বলবে না। প্রশ্ন করবে না। তবে জিগ্যেস করছো কেন?”
“একটু বাদেই উত্তর পাবে, টমাস।” বলল তে। “আমরা বেশি নিচ্ছি না। ঠিক চল্লিশটা বাচ্চা।”
প্রজেক্ট ফর্টি! কিন্তু কেন?
তিনঘন্টার সমুদ্রপথ পেরিয়ে এসে প্রজেক্ট ফর্টির সাইটে বসে আছি। যে বাড়িটা দেখেছিলাম, তার পেছনের বিস্তৃত মাঠের পাশে, একটা ক্যাম্প চেয়ারে। আকাশের মেঘ ফেটে সামনের মাঠে এলোমেলো চাঁদের আলো এসে পড়েছে। আর তার আলোতে দেখতে পাচ্ছি কিছু দূরে দূরে একটা করে ফুলগাছের টব রাখা আছে। আর এই টবে নরম মাটি-পাতা-খড়ের গদিতে বসে আছে একটা করে আলবাট্রসের ছানা। ইতি-উতি বেশ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তারা। কাগজের বাক্স থেকে বের করে এদের টবে বসানোর পালা শেষ হয়ে এলো আর কি।
নুকু কথা বলছিল।
“প্রজেক্ট ফর্টি একটা আলবাট্রস ট্রান্সলোকেশন প্রজেক্ট। এটা আমরা - মরিওরিরা করছি একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে। সরকার, স্বাভাবিকভাবেই, জানে – কিন্তু এটাকে প্রচার করতে দিতে চায় না।”
“কেন?”
“কারণ সরকার নিজেরাও এই একই জিনিস করতে চেষ্টা করেছিল ক’বছর আগে। ‘তে তারা কই কইয়া’ থেকে আলবাট্রস এনে অন্য দ্বীপে বসাতে চেষ্টা করেছিলো। তিনশো আলবাট্রসের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলো। কতগুলো বেঁচেছিল জান? ছ’টা! ভাবতে পারো?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো নুকু।
“এই কাজটা বেআইনি, টমাস। আমাদের কোন ডিগ্রি নেই - আমাদের কোন সংস্থার রেজিস্ট্রেশন নেই – আমরা তো অসভ্য জংলি আদিবাসী। জানাজানি হয়ে গেলে নানান আন্তর্জাতিক সংস্থা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তোমাদের সব পণ্ডিত পরিবেশবিদরা আমাদের কাজ করতে দেবে না। সরকারের খুব অল্প কজন এটা জানে। তারাই আমাদের সাহায্য করছে ভেতরে ভেতরে। কায়দা করে কিছু গ্রান্টও পাইয়ে দিয়েছে।”
“ওই পাখিগুলো আমাদের পাখি, টমাস। আমরা মরিওরিরাই ওদের বুঝি। বাকিরা বুঝবে না।” বললো তে। “জানই তো - এই পাখিরা শুধু ওই একটাই দ্বীপে ডিম পাড়ে। শুধু ওটাকেই ওরা ঘর বলে মানে। যদিও সে দ্বীপ পাথুরে। যদিও সেখানে ডিম পাড়তে গিয়ে অনেক ডিম ভেঙ্গে যায়। তবুও – ওটাই ওদের ঘর। যেমন এই চাথাম আমাদের ঘর।”
দম নিলো তে। তারপর বললো “আমরা শুধু প্রতি বছর গুনে গুনে চল্লিশটা আলবাট্রসের বাচ্চা নিয়ে আসি এখানে। ওদের জন্যে মাছ ধরি আমরা। কিম্বা স্কুইড। ওদের নিজের হাতে খাওয়াই। মায়ের মতো করে। তারপর দুমাস বাদে ওদের উড়িয়ে দি। প্রতিবছর।”
“আমরা আশা রাখি – একদিন ওই পাখিরা এই পোর্ট গ্যাপের প্রজেক্ট ফর্টিতে ফিরে আসবে। এখানে বাসা বাঁধবে, ডিম পাড়বে। এটাকে ওদের ঘর বলে মেনে নেবে। তারপর, যেদিন ওই ‘তে তারা কই কইয়া’ ডুবে যাবে জলের তলায়, সেদিন এই পাখিরা হারিয়ে যাবে না। ওরা বেঁচে থাকবে, আমাদের মতো। মরিওরিদের মতো।”
মেঘলা আকাশে চাঁদের আলো তরোয়াল খেলছে অবিরত। তার আঘাতে সামনের মাঠে ছিটকে পড়ছে জ্যোৎস্নারা। নাকি ওরা মেঘের দল? না না – এতো ওই সাদা ডানার পক্ষীশাবকরা! তাদের ডানায় ঠিকরে উঠছে আলো।
আমি পাখীদের দেখছিলাম না। আমি দেখছিলাম তে’র চোখদুটোকে। আশা আর বিশ্বাসে জ্বলজ্বল করে ওঠা একজোড়া চোখ। উজ্জ্বল। অনন্ত। এক মহাকাব্যের নায়কের চোখ।
উত্তরকথনঃ
কাহিনীতে বর্ণিত চাথাম দ্বীপপুঞ্জ এবং তাতে বাসকারী মরিওরিদের কথা যা লেখা আছে, তা সত্য। ‘পিরামিড’ তথা ‘তে তারা কই কইয়া’ দ্বীপটি সত্যি আছে এবং তার থেকে আলবাট্রস ট্রান্সলোকেশনের চেষ্টাও চলছে। অবশ্য মরিওরিদের সাহায্য নিয়ে বেআইনিভাবে নয়।