• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | গল্প
    Share
  • কবর : চৈতালি সরকার


    অফিস থেকে ফিরেই তুতুনের হাতের খেলনাটি লক্ষ্য করল তনুজা। কাঠের তৈরি পুতুল। চোখদুটো কালো গোল গোল। সারা দেহে গাঢ় হলুদ বার্নিশের আলগা চটক। মুখের তুলনায় দেহ খানিকটা ছোটো। তুতুন সেটিকে নিয়ে একছুটে রান্নাঘরে চলে গেল। দিদান সেখানে গরম গরম কচুরি ভাজছেন। এক্ষুনি মায়ের সাথে ওর প্লেটও রেডি হবে। সঙ্গে থাকবে ওর ফেভারিট আলুভাজা।

    তনুজা ছেলের হাতে অদ্ভুত খেলনা দেখে মাকে জোরের সাথে ডাকল। ওর ধৈর্য বরাবরই একটু কম। অফিস থেকে এলে অল্পেতেই হাঁকডাক শুরু করে দেয়। হিরণ্ময়ী গরম কড়াই ওভেনে রেখে ছুটে এলেন। বললেন, "কি হয়েছে? এত চিৎকার করছিস কেন?" মায়ের কথায় বিরক্ত হয়ে তনুজা বলল, "তুতুন ঐ খেলনা কোথায় পেলো। জানো না কাঠের জিনিস দিয়ে জোরে আঘাত করলে কাচের দামি দামি ফার্নিচার ভেঙে যেতে পারে? আর তাছাড়া ওর বেকায়দায় লেগে যেতে পারে।"

    মা দিদানের মাঝে প্রতিটি কথা মেপে নিচ্ছিল পাঁচ বছরের তুতুন। হঠাৎ দুম করে বলে বসল, "এটাতো আমাকে হাবিব দাদু দিয়েছে।" আদো-মুখের জড়ানো কথা যেন কান পর্যন্ত পৌঁছল না। তাই স্পষ্ট ভাষার জন্য তনুজা মায়ের দিকে তাকাল।

    "হাবিব মানে হাবিবুল্লাহ - এই কাছেই থাকে। খেলনা বানিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে। তুতুন বায়না করল। তাই কিনে দিলাম।" হিরণ্ময়ী সহজভাবে বলে গেলেন।

    তনুজা ছেলের হাত থেকে পুতুলটা কেড়ে নিয়ে ধমকে উঠল। "যাও ভালো করে হাত ধুয়ে এসো।"

    তখনকার মতো ব্যাপারটা মিটে গেল। বাইরে অন্ধকার তখনও নামেনি। জ্বলন্ত লাল সূর্য তার নিভু আলো নিয়ে কেবল পশ্চিমে পা বাড়িয়েছে। ঘরের ভেতর শুধু ছোট্ট আকাশে একঝাঁক মেঘ! কিছুক্ষণের মধ্যেই দুগাল বেয়ে নেমে এল বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা।

    অলোক কলকাতার একটি বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করে। কৃষ্ণনগর থেকে যাতায়াত সম্ভব নয় বলে রাজারহাটে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। তনুজা কৃষ্ণনগর কালেক্টারি অফিসে বড়ো পোস্টে চাকরি করে। বাবা দুবছর হল মারা গেছেন। একলা মায়ের দেখভাল করা ছাড়াও ছোট্ট ছেলেটার দেখাশোনার জন্য মাকে নিজের কাছে রেখেছে। তুতুন আর দিদান তো মেড ফর ইচ আদার। তুতুনের সব বায়না মেটানোর একমাত্র মানুষ দিদান। মাঝে মাঝে তনুজা অবাক হয়ে যায়, কিভাবে হিরণ্ময়ী ছেলেকে সামলান! বিশেষ করে খাওয়ানো। ছুটির দিনে এই কাজটি করতে গিয়ে ওকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। চিৎকার চেঁচামেচি করে শেষপর্যন্ত খাবার উগলে দেওয়াতে গিয়ে শেষ। কখ‌নো কখনো অফিসের কাজ ঘর পর্যন্ত চলে আসে। তখন ছোট্ট ছেলেটাকে দূরে দূরে রাখতে হয়। দরকারি কাগজপত্রে কখন যে দস্যি হাতের ছোঁয়া লাগে বলা যায়! তুতুন সেসব দিনে দিদানের ঘরে দামি খেলনায় নিজেকে বেঁধে রাখে। পুতুলরা জীবন্ত হয়ে ওর সাথে খেলা করে। সেইসময় ছোট্ট শিশুর কল্পরাজ্য ঘিরে ব্যাটারি লাগানো একগুচ্ছ মুখের আনাগোনা!

    পরের দিন হাবিবদাদু আবার বাইরের বারান্দার গ্রিলের বাইরে এসে দাঁড়াল। গ্রিলের অপর পারে ছোট্ট হাত টেনে আনে দিদানকে। আবার সেই পুতুলের বায়না। হিরণ্ময়ী এবার কিছুতেই রাজি নন। মেয়ের কড়া নির্দেশের কাছে নাতির বায়না হার মানে। কাঁচুমাচু মুখে হাবিব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। শীর্ণ চেহারা, গায়ের রং বেশ কালো, পৃষ্ঠদেশ কিছুটা ঝুঁকে গেছে। মাথার ঝাঁকাতে সাজানো কয়েকটি পুতুল। দশটাকা দাম চাইলে লোকে আট টাকা দেয়। বেশিরভাগ নিম্নবিত্তের লোকজন এগুলো কেনে। বড়ো বাড়ির লোকেদের কাছে এই রকম হাতের জিনিসের মূল্য কম। ওরা ব্যাটারি দেওয়া অত্যাধুনিক জিনিসের কদর করে। হাতকে পিছনে ফেলে মেশিন যে অনেক এগিয়ে চলেছে হাবিবরাও জানে। তবু বাঁচতে তো হবে!

    হাবিব চলে গেলে তুতুন কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। ও এখনো খেলনার পার্থক্য শেখেনি। হঠাৎ এই পুতুলটার ওপরই ওর বেশি আকর্ষণ। হয়তো মা বারণ করেছে বলেই, হয়তো হাবিবদাদু দিয়েছিল বলে। কিংবা নিছক খামখেয়ালি। হিরণ্ময়ী বাধ্য হয়ে কাঠের পুতুলটি এনে নাতির হাতে তুলে দেন। একটি নিষ্প্রাণ পদার্থ আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। ছোট্ট মুখের হাসিতে ভরে যায় ঘর।

    অনেকদিন ধরে মা ছেলের মধ্যে লুকোচুরি খেলা চলছে। দিদান আড়ালে থেকে নাতিকে সাহায্য করেন। মাঝে মাঝে ভয় হয় রাগী মেয়ের হাতে ধরা না পড়েন! সেদিন রবিবার অলোক এসেছে। বেশিরভাগ সপ্তাহে ও শনিবার হাফ-ডে করে চলে আসে। এই শনিবার অফিসে জরু‌রী মিটিং ছিল। তাই রবিবার আসতে হল। হিরণ্ময়ী ষাটোর্ধ্ব হলেও রান্না করতে ভালোবাসেন। জামাই-এর প্রিয় রান্না করেন রবিবার। চিকেন কষার সাথে পোস্তর বড়া, লাউ দিয়ে মটর ডাল, এঁচোড় চিংড়ি কিংবা পটল চিংড়ি থাকে। তুতুন বাবার সাথে সারাদিন হইহুল্লোড় করে। কখনো সারা সপ্তাহের আঁকা ছবি দেখায়। সেগু‌লো দেখে অলোক ভালো খারাপের ঊর্ধ্বে উঠে প্রশংসার ঝাঁপি উপুড় করে দেয়। বাবা বাড়িতে এলেই মায়ের পড়ানো ছুটি থাকে। সারাদিন খেলা আর খেলা। দস্যিপনা প্রশ্রয় পায় বাবার কাছে।

    দিলখোলা বাবাকে বিশ্বাস করে তুতুন। ও মায়ের আড়ালে চুপিচুপি পাশের ঘরে নিয়ে যায় বাবাকে। তারপর সেই লুকানো পুতুলটা সাবধানে বের করে। আর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে সেটিকে। কালো বড়ো বড়ো চোখ। হলুদ বার্নিশ করা দেহ। তুতুনের কাছে এটি অষ্টম আশ্চর্য। চেহারায় ফুটে ওঠে অনাবিল আনন্দের ছাপ। ওর বিশ্বাস বাবাও বুঝি খেলায় মেতে উঠবে। হাততালি দিয়ে বলবে বাঃ! দারুণ তো।

    মুহূর্তের মধ্যে অলোকের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বিরক্তি। কাঠের শক্ত জিনিসে ভেঙে যাবে ওর শখের কাচের আলমারি। শুধু তো তাই নয়। এইধরনের খেলনা কোথা থে‌কে আমদানি হল! ওরা কিনে দেয়নি। নিশ্চয় কোনো সস্তা ফেরিওয়ালার থেকে নেওয়া। ফাঁকা বাড়িতে বয়স্ক আর বাচ্চা পেয়ে গছিয়ে দিয়েছে। হয়তো কোনো মতলব আছে। অলোকের এই ভাবনার মধ্যে হঠাৎ তনুজা ঘরে এসে দেখল পুতুলটি তুতুনের হাতে। জোর করে কেড়ে নিয়ে বলল, "তোকে যে বলেছিলাম এটাকে ফেলে দিতে। আবার এই জিনিস নিয়ে খেলছিস।" অলোকেরও এতে সমর্থন আছে। তাছাড়া খেলনার তো অভাব নেই। দামি দামি খেলনার পাহাড় জমে আছে ঘরে। ওরা কি করে জানবে তুচ্ছ মনে করা হয় যা হয়তো তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে গভীর ভালোবাসা!

    তনুজা ছেলের হাত থে‌কে খেলনাটি নিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে দিল নীচে।

    হাতদুটো ছিটকে পড়ল কিছুটা দূরে। দেহটি পড়ে রইল রাস্তার ওপরে। কিছুক্ষণের মধ্যে চারচাকা এসে পিষে দিল দেহটিকে। তুতুন ওপর থেকে একদৃষ্টে দেখছিল। পুতুলটা ওর চোখের সামনে কেমন গুঁড়িয়ে গেল।

    অনেকদিন হয়ে গেল হাবিবুল্লাহ এদিকে আসে না।

    সেদিন তুতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই বলে ওঠে "দিদান দেখো, ঐ যে হাবিবদাদু।" সত্যিই তো মাথায় ঝাঁকা নিয়ে হাবিবুল্লাহর মতোই একজন। সাজানো রয়েছে কাঠের পুতুল। কাছে আসতেই ফুটে ওঠে অন্য মুখ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মিশকালো রঙের সুঠাম চেহারার লম্বা পুরুষ। লোকটি গ্রিলের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

    "পুতুল নেবেন?"

    প্রশ্নটি এড়িয়ে হিরণ্ময়ী বলল, হাবিবুল্লাহ তো পুতুল নিয়ে আসে। বেশ কয়েকদিন ওকে তো দেখি না। লোকটি হেসে বলল, "ও তো আমার আব্বাজান আছে। গত সপ্তাহে হঠাৎ ইন্তেকাল করল তাইতো ব্যবসা আমি করছি।"

    হিরণ্ময়ী অবাক হয়ে বললেন মারা গেছে! এই কিছুদিন আগেই তো এসেছিল। দুজন বক্তার মাঝে হাঁসের মতো কথা গিলছিল তুতুন। হঠাৎ বলল, "মারা যাওয়া কি দিদান?" হিরণ্ময়ী ছোট্ট প্রশ্নের জবাবে বললেন, "মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়। আর ফিরে আসে না। তাকে কোথাও দেখা যায় না।" তুতুন বিমর্ষ মুখে শুধু বলল, "ঠিক ঐ পুতুলের মতো না দিদান?"

    চমকে উঠলেন হিরণ্ময়ী। এই ছোট্ট শিশুর অভিব্যক্তি সহজেই পড়ে ফেলা যায়। সত্যিই তো শুধু হাবিবুল্লাহ নয়, তুতুনের সবচেয়ে প্রিয় একটি প্রাণও শেষ হয়ে গেছে। চলন্ত গাড়ির চাকায় পিষে গেছে ছোট্ট শিশুর ভালোবাসা। তিনি যেন পরিষ্কার দেখতে পেলেন - হাবিবুল্লাহর ঠিক পাশে ছোট্ট আর একটি কবর খোঁড়া হয়েছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments