• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | গল্প
    Share
  • জঙ্গলের ভদ্রলোকেরা : জোমো কেনিয়াট্টা
    translated from English to Bengali by ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    লোকটি থাকত একা এক গভীর, গহীন জঙ্গলে। কোনো মানুষ বন্ধু না থাকায় সে একটি হাতির সঙ্গে সখ্য পাতাল। লোকটি জঙ্গলের এক কোণে একটি ছোট্ট কুটিরে থাকত। এক রাত্তিরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির সময় হাতিটি সেই কুটিরে এসে উপস্থিত। “হে বন্ধু, এই বৃষ্টিতে আমি বড়ই কাহিল। আমার শুঁড়টা কি তোমার কুটিরে একটু রাখতে পারি?” বন্ধুর ভিজেকাদা অবস্থা দেখে লোকটির মায়া হল। “আমার ঘরটি খুব ছোটো, তোমায় কুলোবে না কিন্তু তোমার শুঁড়টার জন্য জায়গা হয়ে যাবে। এস, আস্তে করে ঢুকিয়ে দাও।” হাতিটি তাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তার শুঁড়টা ঢুকিয়ে দিল। “আঃ! আজ তুমি আমার একটা বিরাট উপকার করলে।”

    কিন্তু এরপর কী হল? হাতিটা আস্তেআস্তে শুঁড়ের সঙ্গে তার বিরাট মাথাটাও ঢুকিয়ে দিল। তারপর গা ও চার পা। শেষে লোকটাকে বাইরে বের করে দিয়ে নিজে বেশ আরাম করে হাতপা ছড়িয়ে বসল। “প্রিয় বন্ধু, তোমার চামড়া আমার থেকে অনেক শক্ত। এঘরে তো আমাদের দুজনকে কুলোবে না, তাই তুমিই বাইরে থাকো, আমি ভিতরে বসি।”

    বন্ধুর কীর্তি দেখে লোকটার ভারী রাগ হোল। এ কেমন কথা? সে চেঁচামেচি করে ঝগড়া শুরু করল। জঙ্গলের অন্যান্য পশুরাও মজা দেখতে জড়ো হয়ে গেল। গোলমাল শুনে জঙ্গলের রাজা সিংহ এসে জোর গলায় দাপিয়ে বলল, “চুপ! জানো না আমি কে? তোমাদের এত সাহস যে চেঁচামেচি করে জঙ্গলের শান্তিভঙ্গ করছ?” হাতিটা জঙ্গলের প্রধানমন্ত্রী। সে সিংহকে আশ্বস্ত করতে নম্রসুরে বলল, “হে রাজন, শান্তিভঙ্গ নয় আমি শুধু আমার বন্ধুর সঙ্গে কুটিরে কে থাকতে পারে তাই নিয়েই একটু আলোচনা করছিলাম।” সিংহরাজা শান্তিতে ঘুমোবার আশায় ঝগড়াটা মেটাবার চেষ্টা করল। “ঠিক আছে এখনকার মত ঝগড়াটা মুলতুবি রাখো। আমি রায় দিচ্ছি আমার মন্ত্রীরা একটা এনকোয়ারি কমিটি ঠিক করে সমস্ত ব্যাপারটা ভালোভাবে দেখে কাল আমায় একটা রিপোর্ট দেবে।” রাজা লোকটির দিকে ফিরে বলল, “তুমি এই জঙ্গলের পশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে খুব ভালো কাজ করেছ। আর ঝগড়া কোরো না। তোমার কুটির তোমারই থাকবে। হাতি আমার সভার প্রধানমন্ত্রী। আমি আশা করি কমিটির রিপোর্ট পেলে তুমি খুশিই হবে।” লোকটি মিষ্টিকথায় তুষ্ট হয়ে ভাবল শিগগিরই তার কুটির তাকে ফেরত দেওয়া হবে।

    রাজার আদেশমতো প্রধানমন্ত্রী হাতি পরদিনই অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে উঠেপড়ে কমিটির কাজে লেগে গেল। একটা কমিশন তৈরি হল। কমিশনের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হল--১- শ্রী গণ্ডার; ২-শ্রী বুনো মোষ; ৩-শ্রী কুমীর; ৪- অনারেবল শ্রী শেয়াল হল চেয়ারম্যান ও ৫-শ্রী নেকড়ে বাঘ হল সেক্রেটারি। লিস্টি দেখে লোকটি প্রতিবাদ করল যে তার দিক থেকে কোনও মানুষ নির্বাচন করা হয়নি। এ কেমন কথা? তাকে বলা হল যে সে ছাড়া তো অন্য কোনো মানুষই জঙ্গলের নিয়মকানুন জানে না। কী করে তাদের নেওয়া যায়? তবে তাকে আশ্বাস দেওয়া হল যে কমিশনের সদস্যরা সবাই বিদ্বান ও বিচক্ষণ, সবাই ন্যায়বিচার বিষয়ে সুদক্ষ ও একেবারেই নিরপেক্ষ। ভগবান নিজে এই ভদ্রলোকদের বেছে নিয়েছেন যাতে এরা অন্যান্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল পশুপাখিদের নিরপেক্ষভাবে দেখাশোনা করতে পারে।

    কমিশন সাক্ষীসাবুদ জড়ো করতে শুরু করল। প্রথমেই মন্ত্রী হাতিকে ডাকা হল। সে এল উন্নাসিক ভাবে নাক (শুঁড়) উঁচু করে। খুব গম্ভীর কর্তৃত্বপূর্ণ গলায় বলল “জঙ্গলের ভদ্রমহোদয়গণ, মূল কাহিনী আপনারা সবাই জানেন, তাই পুনরাবৃত্তি করে আপনাদের সময় নষ্ট করব না। বন্ধুদের সাহায্য করা আমার প্রধান কর্তব্য বলে মনে করি। তাই নিয়েই একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমার বন্ধু আমাকে অনুরোধ করেছিল ঝড়জল থেকে তার কুটিরটা বাঁচাতে। সেই কারণেই আমি ভিতরে বসেছিলাম যাতে কুটিরটা ঝড়ে উড়ে না যায়। বন্ধুকে বিপদে সাহায্য করাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। এই অবস্থায় আপনারাও নিশ্চয়ই ঠিক এই কাজই করতেন।”

    কমিশন হাতির বক্তৃতাটা অকাট্য প্রমাণ বলেই মেনে নিল। এরপর হায়না ও অন্যান্য গুরুজনদেরও ডাকা হল। তারাও সবাই অনুমানমাফিক হাতিকেই সমর্থন করল। সবশেষে বাদীস্বরূপ লোকটিকে ডাকা হল তার বক্তব্য পেশ করার জন্য। কিন্তু লোকটি শুরু করতেই কমিশন তাকে থামিয়ে দিল, “প্রিয় মানুষ, আমরা তোমাদের ঝগড়ার বিশদ বর্ণনাটা আগেই শুনেছি -- অনেক মান্যগণ্য ও নিরপেক্ষ সাক্ষীদের মুখে। এখন আমরা শুধু জানতে চাই যে তোমার খালি কুটিরটা হাতির আগে অন্য কেউ দখল করেছিল কিনা।” লোকটা শুরু করল, “না, কিন্তু—" তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই কমিশনের সদস্যরা উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে দিল যে তারা দুদিক থেকেই যথেষ্ট প্রমাণ পেয়ে গেছে, এখন তারা মধ্যাহ্নভোজনের পর বাকি বিচার বিবেচনা করবে।

    প্রধানমন্ত্রী হাতির সৌজন্যে কমিশনের সদস্যরা সবাই খুব পেটপুরে খাওয়াদাওয়া করল। একটু বিশ্রামের পর তারা সবাইকে ডেকে তাদের রায় জানাল-- “আমাদের বিচার অনুযায়ী এই বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে একটা শোচনীয় ভুল বোঝাবুঝি থেকে। তুমি মানুষ এখনো আমাদের আচার নিয়ম ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারনি। আমাদের মতে শ্রী হাতি শুধুমাত্র তোমাকে সাহায্য দানের পবিত্র কর্তব্য পালন করছিলেন। তোমার ভাগ্য ভালো নইলে ঐ ঝড়ে তোমার ছোট্ট কুটির কবেই উড়ে যেত। কুটিরটা বড়ো করার সামর্থ্য তো তোমার নেই, তাই আমরা রায় দিচ্ছি শ্রী হাতি তোমার কুটিরেই থাকুন আর তোমাকে আরেকটা নতুন কুটির তৈরি করার আজ্ঞা দিচ্ছি। তুমি সেখানে নিরাপদে থাকতে পারবে।”

    লোকটা বুঝল যে অন্য কোনো উপায় নেই। কমিশনের সদস্যদের দাঁত ও নখ থেকে রক্ষা পেতে হলে তাদের বিচার মানতেই হবে। কিন্তু নতুন বাসা তৈরি হতে না হতেই শ্রীমান গণ্ডার শিং বাগিয়ে এসে সেটা দখল করে বসল। আবার কমিশনের বৈঠক, আবার সেই একই বিচার--গণ্ডারের পক্ষে। বারেবারে একই ব্যাপার হতে থাকল। একে একে মহিষ, নেকড়ে বাঘ, হায়েনা, সবার নতুন বাসা হয়ে গেল। লোকটা বুঝল যে কমিশনের উপর নির্ভর করার চেষ্টা বিফল। তাকে নিজেই নিজের সুরক্ষার আয়োজন করতে হবে। পশুদের লক্ষ্য করে সে ভাবল, ‘তোমরা আমায় কয়েকবার ঠকালে, কিন্তু আর নয়।’

    পরদিন ভোরবেলা একটু দূরে সে আরেকটা বড়সড় শক্তপোক্ত বাসা বানাল। এতদিনে পুরনো বাসাগুলোর অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়েছে। পশুগুলি তো আর কোনোরকম মেরামত করেনি। নতুন বাসা তৈরি হতেই এল গণ্ডার শিং বাঁকিয়ে। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে দ্যাখে শ্রী হাতি তার আগেই এসে জাঁকিয়ে বসেছে। নেকড়েবাঘ জানলা দিয়ে উঁকি মারল। সিংহ, মহিষ আর শেয়ালও ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ল। হায়েনা একটু ছায়া পাবার আশায় ছোঁকছোঁক করতে থাকল। আর শ্রীমান কুমীর তো ছাতের ওপর শুয়ে ভোঁসভোঁস করে নাক ডাকাতে শুরু করল। বাসার দখল নিয়ে গোঁতাগুতিটা যখন বেশ জমে উঠেছে লোকটা তখনই বাসাটায় দিল আগুন লাগিয়ে। ব্যস, বাসাসুদ্ধু জঙ্গলের ভদ্রলোকেরা সব পুড়ে ছাই। লোকটা এবার নিজের জন্য বাসা বানিয়ে আরাম করে রইল, ভাবল, “শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যয়বহুল বটে কিন্তু যে-কোনো দামের পক্ষেই মূল্যবান।”




    (এই গল্পটি “African Short Stories” থেকে উদ্ধৃত। সম্পাদক Chinua Achebe ও C. L. Innes. প্রকাশক-- Heineman Educational Books Inc. 1985.)


    অনুবাদকের কথা — জোমো কেনিয়াট্টা (১৮৯৭ - ১৯৭৮) স্বাধীন কেনিয়ার প্রথম স্বদেশী প্রেসিডেন্ট (১৯৬৪-১৯৭৮) ও আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম ঔপনিবেশকতা-বিরোধী (anti-colonialism) রাজনেতা। ছাত্রাবস্থায় তিনি কিছু লেখালেখি করতেন। হয়তো এই গল্পটি সেই সময়ের লেখা। গল্পটিকে ব্রিটিশ উপনিবেশকতা-বিরোধী প্রতীক হিসেবেও ধরা যায়। ব্রিটিশদের সঙ্গে সংগ্রামের সময় তিনি কিছুকাল কুখ্যাত মাউ মাউদের নেতৃত্ব করেছিলেন। বিরোধীদল তাঁকে কঠোর ও নিষ্ঠুরও বলে থাকেন। এই গল্পে সেই নিষ্ঠুরতারও একটু আভাস পাওয়া যায়।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments